Tuesday, January 27, 2015

| কেন চার্বাক পাঠ প্রাসঙ্গিক ?

...
| কেন চার্বাক পাঠ প্রাসঙ্গিক ?
রণদীপম বসু

একটা পর্যায় থেকে, মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে ধর্মেরই ইতিহাস। সম্ভবত কথাটা বলেছিলেন দার্শনিক ম্যাক্স মুলার, যিনি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন তথা বৈদিক সাহিত্য বা সংস্কৃতিরও একজন অনুসন্ধিৎসু বিদ্বান হিসেবে খ্যাতিমান। তবে যে-ই বলে থাকুন না কেন, সভ্যতার এক দুর্দান্ত বিন্দুতে দাঁড়িয়েও উক্তিটির রেশ এখনো যেভাবে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুব দৃশ্যমানভাবেই বহমান, তাতে করে এর সত্যতা একবিন্দ্ওু হ্রাস পায় নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অনেক বেশিই প্রকট থেকে প্রকটতরই হচ্ছে বলে মনে হয়।


বর্তমান বিশ্বে এমন কোন সভ্যতার উন্মেষ এখনো ঘটেনি যেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ উৎসব উদযাপন তথা প্রাত্যহিক জীবনাচরণের একান্ত খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলো কোন না কোন ধর্মীয় কাঠামো বা অনুশাসনের বাইরে সংঘটিত হবার নিরপেক্ষ কোন সুযোগ পেয়েছে আদৌ। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, গোষ্ঠির সাথে গোষ্ঠির, সমাজের সাথে সমাজের ইত্যাদি পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতগুলো এখনো ধর্মকেন্দ্রিকতার বাইরে একচুলও ভূমিকা রাখতে পারে নি বলেই মনে হয়। এমন কি মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যক্তি বা সামাজিক পরিচয়ের অন্তঃস্থ চলকগুলোও নিরেট ধর্মীয় পরিচয়েই মোড়ানো। একেবারে বহিরঙ্গের পরিচ্ছদে যে যেই রঙের আঁচড়ই লাগাই না কেন, এই আলগা পোশাকের ভেতরের নিজস্ব যতœশীল শরীরটা যে আসলেই কোন না কোন ধর্মীয় ছকের একান্তই অনুগত বাধক হয়ে আছে তা কি আর স্বীকার না করার কোন কারণ সৃষ্টি করতে পেরেছে ? অন্তত এখন পর্যন্ত যে পারে নি তা বলা যায়। আর পারে নি বলেই আরো অসংখ্য না-পারার ক্ষত আর ক্ষতিয়ানে বোঝাই হতে হতে আমরা ব্যক্তিক সামাজিক ও জাতিগতভাবেও একটা ঘূর্ণায়মাণ বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি কেবল, বাইরের সীমাহীন সম্ভাবনায় পা রাখতে পারছি না সহজে। এবং একই কারণে আমাদের সমাজ-সংগঠন-চিন্তা বা দর্শনের জগতটাও অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা স্থবিঢ় ও অনতিক্রম্য বিন্দুতে। বাড়ছে না আমাদের বৃত্তাবদ্ধতার আয়তন বা সংগঠিত করা যাচ্ছে না কোন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডও। এবং আমাদের বৃহত্তর সমাজ-মানসের বিজ্ঞান-চেতনাও দুঃখজনকভাবে থেকে যাচ্ছে শূন্যের কোঠায়। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ? কেনইবা এই অচলায়তন ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না ?

প্রশ্নের আকার যতো শীর্ণই হোক না কেন, ভাবগত অর্থে এতো বিশাল একটা প্রশ্নকে সামনে রেখে কোন একরৈখিক আলোচনা যে আদৌ কোন মীমাংসা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে একান্তই অকার্যকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আলোচনার কান ধরে টান দিলে হয়তো এমন অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও সামনে চলে আসার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না, যেগুলোর যথাযথ উত্তর অনুসন্ধানের মধ্যেই কোন না কোন সমাধানের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে। সে বিবেচনায় একেবারে নিশ্চুপ থাকার চেয়ে কিঞ্চিৎ হল্লাচিল্লা করায় সম্ভাব্য সুবিধা রয়েছে বৈ কি। এই কাজটুকুই প্রথম শুরু করেছিলেন লোকায়তিক চার্বাকেরা।

সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতির বহুমাত্রিক স্রোতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে মানুষের লিঙ্গীয় অবস্থান বা আরও খোলাশা করে বললে সামগ্রিক জনগোষ্ঠির অর্ধাংশ জুড়ে যে নারী- তাঁর ভূমিকা, কার্যকর প্রভাব ও অবস্থান চিহ্নিত করতে গেলে অনিবার্যভাবেই প্রচলিত ধর্ম ও অনিরপেক্ষ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গটি অনায়াসে সামনে চলে আসে। কেননা নারীকে কোন্ উপজীব্যতায় বিবেচনা ও মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে তা দিয়েই প্রচলিত ধর্মগুলোর বাইরের মোহন চেহারার আড়ালে ভেতরের প্রকৃত চেহারাটা সহজেই বুঝে ফেলা যায়। আর অনিরপেক্ষ বলা হচ্ছে এজন্যেই যে, মোহন মাদকতায় আক্রান্ত আমাদের ধর্মীয় চেতনদৃষ্টি যে প্রকৃতপক্ষেই লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ও সুস্পষ্টভাবেই পুরুষতান্ত্রিক পরম্পরায় গড়ে ওঠা তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই যুক্তিশীল মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, আমাদের যুক্তিরহিত আবেগের এই অন্ধ স্রোত আর বিকল চেতনার প্রশ্নহীন আনুগত্য- যে অচলায়তনে এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে, কী এমন জাদুর কাঠি রয়েছে ওই ধর্মতত্ত্বের পেছনে ? যুক্তিহীন কিছু অচল প্রাচীনত্ব ছাড়া আদৌ কি আছে কিছু ? এটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন চার্বাকেরা।

খুব মোটা দাগে দেখলে, ধর্মের দুটো দিক। একটি তার ভেতরগত দর্শন, অন্যটি বহিঃরঙ্গের নীতিশাস্ত্র। এই দুয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন ও প্রয়োগিক সিদ্ধান্তগুলো। এবং এই অনুশাসনমূলক আচার কাঠামোর বৃত্তে ঢুকে পড়ে আচরিত সমাজদেহের বাইরের চেহারাটা শেষপর্যন্ত সেভাবেই সেজে ওঠে, ভেতরের দর্শন তাকে যেভাবে সাজায়। এটাই মানব-সভ্যতায় আরোপিত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, যা অখণ্ড মানব-সংস্কৃতির আবহমান নিরপেক্ষ ধারাটিকে কালক্রমে খণ্ডিত ও গ্রাস করে এক অমোচনীয় পরিচয়-সংকটে ফেলে দেয়। মানুষের অখণ্ড পরিচয় ছিটকে পড়ে খণ্ডিত ধর্মীয় পরিচয়ে। তাই ধর্মীয় সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস হলো মানুষের খণ্ডিত হবারই ইতিহাস, মানবতার অবনমনের ইতিহাস এবং অমানবিক আধিপত্যবাদেরও ইতিহাস। বস্তুত এটাই মানব-সমাজের আদি মৌল ইতিহাস। যা মানবিক অধঃপতনের কলঙ্কময় দলিল হয়ে গেঁথে আছে প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলোর পাতায় পাতায় অবশ্য-পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে। যুগে যুগে এই মোড়কের অদল-বদলটুকু হয়েছে কেবল, পাল্টায়নি তার ভেতরের অন্ধ দর্শনটা একটুও। স্বভাবে প্রভাবে অবিকৃতই থেকে গেছে তা। ‘মনুস্মৃতি’র অনুশাসনগুলি সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। এবং তখনই আরো জোরো-সোরে সেই প্রয়োজনটাই মনে করিয়ে দেয়, কেন চার্বাক পাঠ আজ খুব প্রাসঙ্গিক।

ইতোমধ্যেই আমরা অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছি যে চার্বাক কোন ব্যক্তি-বিশেষের নাম নয়। চার্বাক একটি পরম্পরা। যার মূল চেতনা উপ্ত আছে সেই সুপ্রাচীন কোনো লোকায়ত চিন্তা-চেতনা-অভিজ্ঞতার গভীরে। যাঁরা কোন প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী না হয়ে হয়েছিলেন মুক্ত-চিন্তার দিশারী। কেন তাঁরা প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারেননি এটুকু মনে হয় আবার নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। কেননা বর্তমান গ্রন্থটির পটভূমিই তো তাই। কান ধরে টান দিলে যেমন মাথাটিও এগিয়ে আসে, তেমনি চার্বাককে পাঠ করতে গেলেই টান পড়ে যায় চার্বাকেতর অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের মাথায়ও। আর এ-কারণেই কেন দর্শন পাঠ জরুরি না বলে বলা হচ্ছে কেন চার্বাক পাঠ প্রাসঙ্গিক।

কী এবং কেন?Ñ এই দুটি প্রশ্নকে যদি তুলনা করা হয় দর্শনের দুটি চোখ হিসেবে, তবে চার্বাক হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা কোন কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার আগে যাঁরা নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে জানতেনÑ কেন এরকম হবে, ওরকম নয় কেন? এবং সাধারণ কান্ডজ্ঞান ব্যবহার করে  যাঁরা স্বাভাবিক অর্থেই জগতকে দেখেছেন এক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বস্তুগত অর্থে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মানদন্ডে। যাবতীয় বিষয়কে যাঁরা প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যের কষ্টিতে ঘষে যাচাই করে নিতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। কেননা প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্ততার বাইরে যা-কিছু রহস্যময়তা, সেখানে থেকে যায় কল্পনার আতিশয্যের সমূহ সুযোগ। আর তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে যতোসব কুঞ্চক-প্রবঞ্চক গোষ্ঠির যাবতীয় ছল-চাতুরির অবকাশ। এই অবকাশকে ঘিরে ছলা-কলার মাধ্যমে সহজ সরল অজ্ঞ জনগোষ্ঠিকে মোহগ্রস্ত করে গড়ে উঠে এমন এক পরজীবী ব্যবসায়িক শ্রেণী যাদের উপজীব্য কেবলই মানুষকে ঠকিয়ে নিজের ফায়দা তোলা। সেক্ষেত্রে ধর্ম নামের এক অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের পুঁজিই যে এই প্রতারকদের জন্য হয়ে উঠেছিলো সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম, সেটি খুব সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন চার্বাকেরা। কীভাবে? সেই সাধারণ কান্ডজ্ঞান ব্যবহার করেই, যা প্রতিটি মানুষই সহজাতভাবে পেয়ে থাকে। এই কান্ডজ্ঞান আর কিছুই নয়, লোকব্যবহার-কৃত অতি সাধারণ কিছু বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গি। যা আমরা প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে থাকি। তাই কোন কিছু প্রশ্নহীন বিশ্বাসে গ্রহণ করার আগে যে অন্তত নিজেদের কল্যাণেই সাধারণ যুক্তি বা কান্ডজ্ঞান ব্যবহার করা আবশ্যক, অন্তত এটুকু উপলব্ধির জন্যেও চার্বাক পাঠ আজ খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

চার্বাকেরা তাঁদের স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞান দিয়েই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। আর মানুষের জন্য ধর্ম হতে হলে সেটা হতে হবে মানবীয় ধর্ম, যেখানে মানুষের প্রয়োজনে মানুষই হবে প্রধান ও মুখ্য। কিন্তু মানুষকে ছাপিয়ে ধর্মই যেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রিত ক্রিড়নক কিছু বস্তুপিন্ডের মতো। আর তার নিয়ন্ত্রক হয় শাস্ত্র নামের অনড় কিছু অলৌকিক বিধান-গ্রন্থ। কিন্তু বস্তুগত কোন কিছুই যে কোন অলৌকিক শূন্য থেকে সৃষ্টি হতে পারে না, সেটাও মুক্ত-মনা চার্বাকদের সাধারণ যুক্তিতে-বুদ্ধিতে-বিচারে-বিশ্লেষণে বুঝতে কষ্ট হয়নি। সেগুলি যে কোন-না-মানুষেরই সৃষ্টি এবং তাকে অপৌরুষেয় বলে চালিয়ে দেয়ার মধ্যে কিছু স্বার্থবাদী প্রবঞ্চক গোষ্ঠিরই প্রচারণা কার্যকর সেটাও প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন চার্বাকেরা। আর এর জন্যে যে স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞানের বাইরে কূট-তার্কিক হবারও প্রয়োজন হয় না, তাও হাতে-নাতে দেখাতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন বর্তমান প্রচলিত বিজ্ঞান অর্থে বিশেষায়িত কোন শাস্ত্রের জন্মই হয়নি তখনো প্রকৃতিলব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোনকিছুর ব্যাখ্যার প্রয়োজনে সাধারণ যুক্তি-বোধ প্রয়োগের প্রবক্তরা যা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন, এই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় উৎকর্ষের যুগে এসেও যদি কল্পনাপ্রসূত অবাস্তব বিষয়ে সেই তাঁদের উত্তরসূরী হয়ে আমাদের যাঁদের সাধারণ কান্ডজ্ঞানটুকুই প্রশ্নহীন স্তব্ধতায় নিথর হয়ে থাকে এবং প্রকারান্তরে আমাদের মানস-জগতের ক্রিয়া-কান্ড ভূতের মতো পিছন-পা হয়ে হাঁটতে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, আমাদের মানসিক বিকাশ এই হাজার বছরেও বুঝি এক কদমও এগোয়নি। বরং সময়ের সাপেক্ষে ভাবলে বলতে হয় পিছিয়েই যাচ্ছে কেবল। সেক্ষেত্রে আমাদের যথাযথ মানবিক ও চেতনাগত মুক্ত-বিকাশের সমর্থনে মানসিক পুষ্টি সরবরাহের দায়িত্বটা ফের চার্বাক-পাঠের প্রাসঙ্গিকতার ঘাড়েই অর্পণ করতে হবে। অন্তত নিজেকে যাচাই করবার প্রয়োজনে হলেও।

লোকায়ত-চার্বাক হচ্ছে মানব-বিশ্বের প্রাচীনতম জড়বাদী দর্শন। নিজেদের সমকালীন জ্ঞানস্তরের সাপেক্ষে যুক্তির শাণিত অস্ত্রে তাঁরা তাঁদের যথাসাধ্য শক্তিতে আঘাত করেছিলেন অতীন্দ্রিয় ভাববাদী বিশ্বাসগুলির সন্ধিতে সন্ধিতে। নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে সমবেত অধ্যাত্মবাদী গোষ্ঠিগুলির অবিরাম আঘাতও ঠেকিয়ে গেছেন কোন আপোষের মধ্যে না গিয়েই। এই অনমনীয় শক্তিটাই হলো চার্বাক-দর্শনের যুক্তিবাস্তবতা। যা আজও বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তকদের অপরিমেয় অনুপ্রেরণার উৎস।
চার্বাকদের নিজস্ব সাহিত্য আজ বিলুপ্ত ঠিকই। ফলে তাঁদের নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ অবিকৃত অবয়ব  কেমন ছিলো আমাদের জানার সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁরা অধ্যাত্মবাদী দর্শনবিশ্বাসে যে আঘাতগুলি করেছিলেন, অধ্যাত্মবাদী দর্শন-সাহিত্যে সেই আঘাতের চিহ্নগুলি অনুসন্ধান করে করে চার্বাক দর্শনের মোটামুটি একটা রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন আধুনিককালের বিদ্বান গবেষকেরা। তাঁদের এই মহতি প্রচেষ্টার যথাসাধ্য পূর্ণ সহায়তা নিয়েই এই গ্রন্থেও চেষ্টা করা হয়েছে চার্বাক-দর্শনের একটা সম্ভাব্য অবয়ব তৈরির। পুন পুন পাঠের মধ্য দিয়ে এই অবয়বটা আরো স্পষ্টতর করে নিজেদেরকে প্রয়োজনীয় যুক্তিশীল করে পুনঃনির্মাণ করে নেয়ার মধ্যেই আসলে নিহিত রয়েছে চার্বাক-পাঠের প্রকৃত প্রাসঙ্গিকতা।

অলীকতাময় ভাববাদের অবাস্তবতায় গড়া কল্পরঙের পর্দাটা সরিয়ে যদি আমরা ‘যে বস্তুটি প্রকৃত যা’ সেটি  সেভাবে দেখতে সমর্থ হই, তবেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির যথাযোগ্য স্বচ্ছতা ফিরে পেতে পারি। এবং তবেই আমরা যতো সব জাল-জালিয়াতির কুঞ্চক থাবা থেকেও নিজেদের মুক্ত করে একটা অনন্ত সম্ভাবনাময় আগামীর যাত্রী হতে পারি। আমাদের যুক্তিশীল বিজ্ঞানদৃষ্টিই পারে আমাদেরকে পেছন-দৃষ্টি থেকে ফিরিয়ে সামনে তাকাতে সাহায্য করতে। অপার সম্ভাবনার উৎস হিসেবেও প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে তখন। চার্বাক আমাদেরকে সেই পাঠই দেয়ার চেষ্টা করেছে তাঁর সাধ্য অনুযায়ী। চার্বাক-পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সেই যুক্তিবোধের উপলব্ধি জেগে উঠবে, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বহমান দৃষ্টি-স্বচ্ছতা, এটুকু আশা নিশ্চয় করতেই পারি। মানুষই তো মানুষের জন্যে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করার স্বপ্ন দেখতে পারে। আমরাও পারি একে অন্যের আস্থাবান কাঁধে হাত রেখে এমন এক বৌদ্ধিক আগামীর স্বপ্ন দেখতে যেখানে ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির সাম্যতায় অনাবশ্যক অন্ধতা ঝেড়ে ফেলে অযৌক্তিক সংস্কারের উর্ধ্বে নিজেদের অধিষ্ঠিত করা কি অসম্ভব কিছু? নিশ্চয়ই তা নয়। 
... 
[ sachalayatan
... 

1 comment:

saifulhasan said...

অনলাইন কেনা কাটা বাজারে freshfishbd নিয়ে আসলো ১০০% ফরমালিন মুক্ত মাছ। আপনার চাহিদা মত এবং পছন্দ মত মাছ পেতে এখনি ভিজিট করুন freshfishbd.