Thursday, July 3, 2008

# অদৃশ্য বাতিঘর-০৭ (কবিতাগুচ্ছ)








অদৃশ্য বাতিঘর-০৭ (কবিতাগুচ্ছ)
- রণদীপম বসু



যে গল্প গল্প নয়

যেখানে মেঘ সেখানে বৃষ্টি, এটা তো ভাদ্রের গল্প ;
এরকম আরো কতো গল্প আছে
আশ্বিন থেকে শ্রাবণ অবধি।
আমি তো এসেছি বনকৈশোর থেকে ঋতুপর্ণ যৌবন নিয়ে
তোমার কাছে,
তোমার গল্প শুনবো বলে..।

থামতে জানে না বলে ঘর নেই তার, এটা নদীর গল্প
হাঁটতে পারে না বলে স্বপ্নচারী ভীষণ, এটা বৃক্ষের গল্প
অথবা কষ্টেরা বড়ো বেশি আপন বলে
এতোটা বিশাল হয়ে ঝুলে থাকে জীবনের উপর,
এটা আকাশের গল্প।
এরকম আরো কতো কতো গল্প আছে
আগুনের পাহাড়ের মাটি আর পাথরের
সকালের বিকেলের অরণ্যের আঁধারের
দেখার গল্প শোনার গল্প দিকের গল্প দিশার গল্প
লক্ষ ফিকির বুকে নিয়ে মানুষগুলোর ভুলের গল্প
আরো কতো গল্প আছে !

আমি তো এসেছি তোমার কাছেই
সহস্র অযুত গল্পের নিভৃত ঠিকানা খুঁজে
গল্পহীনা তোমার কাছে
এক নতুন গল্প শুনবো বলে-
যে গল্প আর গল্প হবে না কখনো...।
(৩১/১০/২০০২)


নিশুতির পদাবলি

গলে গলে ঝরে পড়ে চাঁদ
গলে গলে ঝরে পড়ে চাঁদ
তারপর নিবিষ্ট আঁধার এলে বৃক্ষেরা জেগে ওঠে সব
চুপি চুপি গান গায় কথা কয়
প্রাচীন গল্পের গাঁথা বুনে বুনে
আমাকে পারায় ঘুম-
বলে আয় ঘুম আয় আয়...

আঁধার নিবিষ্ট হলে বৃক্ষেরা জাগে
আর ঘুমের ভেতরে জাগি অন্তহীন আমি এক..
চাঁদ গলে ব্যথা গলে তাবৎ ব্রহ্মাণ্ড গলে
গলে গলে ঝরে যায় সব !
আলো গলে অন্ধকার, গলে গলে একাকার,
গলে না কেবল এক
বুকের গভীরে খুব অর্থহীন বিষাদের ভার।
(২১/১২/২০০২)


প্রণয়ের আদিশ্লোক

ব্যাকরণ জানি না বলে
পারি না লিখতে কোনো প্রিয়ভাষী নাম
তবু ভাষিক দূরত্ব থেকে
আমার দেহের ভাষা সমস্ত ছাপিয়ে যদি
মিশে যায় কণ্ঠশীলা শরীরে তোমার
একে কী বলবে তুমি ?
প্রণয়ের আদিশ্লোক যে পারে খুঁজুক তা,
আমি তো শুদ্ধাচারী নই যে
বাঁধা পথেই যেতে হবে প্রলুব্ধ আমাকে !

ব্যাকরণ জানি না বলে
নাই বা পেলাম আদি-পথের দিশা,
অজ্ঞেয় পরিচয় বুকে তোমার মগ্নতায় নিমগ্ন আমি
মনে করো চন্দ্রাহত কোনো এক
পথহীন পথিক কেবল...।
(২৮/০২/১৯৯৯)


কৌমের শাসন ভেঙে

(১)
ঈভের পাপড়ির মতো ঝরে যাবে সুপর্ণ বাতাসে !
নীলকণ্ঠ কষ্ট ধুয়ে না পাও উষ্ণতা যদি
সাগরের গ্রন্থি খুলে মেখে নিও উৎকর্ণ আকাশের গায়
নিবিড় নিঃশ্বাসে ঝরে বয়ে যাবে আদি স্রোত
লেখা হবে প্রণয়ের অলিখিত উপাখ্যান যতো...।

(২)
কৌমের শাসন ভেঙে এ কোন্ গ্রন্থির মোহে
এসেছো শবরী কন্যা অশরীরী স্রোতে ?
পৃথিবী কৌমের ছায়া,
নিঃশেষে বিলীন হয়ে সব গ্রন্থি মিশে যাবে
আদি-অন্ত শরীরেরই ব্যুহে...।

(৩)
ফিরে যাও যাও কন্যা সেই সব মাটির পাঁজরে,
আপন দেহেতে লীন অভিন্ন উষ্ণতা বয়ে
এখনো যেখানে যতো প্রণয়ের কথামালা
চালাচালি হয়ে ফিরে
শব্দহীন শিকড়ে শিকড়ে...।


শিলালিপি

চোখের ভেতরে এক অনড় পাথর ধরে
আমাকেই বলছো তুমি- এই বুক কঠিন পাথর !
মানুষের অক্ষমতা এভাবেই ছুঁয়ে গেলে আঁধার-গভীরে আরো
এতোটা বিস্ময় কী করে লুকাই বলো ?
তার চেয়ে দৃষ্টির জলে কিছু ধুয়ে নিয়ে বিস্মৃতির ধুলো
পারবে কি চিনতে সেই স্থবির সময়,
যে আমার বুক নয়
আমৃত্যু গেঁথে যাওয়া কর্কশ অক্ষর হয়ে
বিপন্ন ফলকের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে !

আশরীর হৃদয়ে ভরা মানুষ বৃক্ষ তো নয়
বেদনার টুপটাপ জমাট শিশিরে ভেজা
পাথরে হৃদয় ঘষে
তবু যদি বৃক্ষই বলতে তুমি
হয়তো বা হয়ে যেতাম বৃক্ষই শুধু ;
মানুষের শিলালিপি কখনো বুঝিনি বলে
অন্ধ দৃষ্টির ঘোরে পাথরের চেয়ে তুমি বেশি কিছু নও !

ভালোবাসা দূরে গেলে চলে যায় ঘৃণারাও পিছু ;
ভালোবাসা না-ই হোক
আজন্মের ঘৃণা সব পুনর্বার জেগে ওঠার আগেই
অবিনাশী হাত ছুঁয়ে বলতে তো পারতে শুধুই
মানুষে পাথরে থাকে কতোটা তফাৎ !
সে সব বলোনি কিছুই।
চোখের ভেতরে তোমার শুধু এক অনড় পাথর...।
(০৫/০৩/১৯৯৯)

No comments: