Monday, July 7, 2008

# ‘ইহা শায়েস্তা খাঁ’র আমল নহে’







‘ইহা শায়েস্তা খাঁ’র আমল নহে’
-রণদীপম বসু


গতকল্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে আকস্মিক এক মহতি বাণী শ্রবণ করিবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াও নিজেকে বুঝাইতে পারিতেছিলাম না, ইহা কী শুনিলাম। আর অদ্য প্রিণ্ট মিডিয়ার কল্যাণে উহা পর্যবেক্ষণ করিয়া চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করিবার সুযোগপ্রাপ্ত হইয়া নিশ্চিন্ত হইলাম যে, এই কর্ণকুহরে যাহা প্রবিষ্ট হইয়াছিল গতরাত্রিতে, কদাচ মিথ্যা ছিল না তাহা ; বিলক্ষণ সত্যই শুনিয়াছিলাম।

যাহা শুনিয়াছিলাম তাহার মর্মার্থ নিম্নরূপ। আমাদের মহামহীম অর্থ উপদেষ্টা ড.এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মহোদয় তাহার মধুমুখনিঃসৃত এক অমেয় বাণীর মাধ্যমে আমাদিগের মতো বুদ্ধিভ্রংশ অপগণ্ড নাগরিকদিগকে ইতিহাসের শায়েস্তা খাঁ’র আমলের কথা ভুলিয়া যাইবার অভূতপূর্ব সত্যপরামর্শ দিলেন তো বটেই, দ্রব্যমূল্য যখন নাগালের উর্ধ্বে উঠিয়া নভোমণ্ডলে উড়িয়া চলিবার মুক্ত প্রতিযোগিতায় ভীষণ পাগলাটে হইয়া সব কিছুকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া অশিক্ষিত মুর্খ জনতার কল্পনাকেও হার মানাইয়া ফেলিতেছে, তৎক্ষণাৎ তিনি অতিশয় জোর দিয়া ইহাও বলিয়াছেন যে, নিত্যপণ্য দ্রব্যাদির যদৃচ্ছ খরিদমূল্য কমিবার আপাতত কোনই সম্ভাবনা নাই। মূল্যহ্রাস ঘটিতে পারে, আমাদিগের এহেন দুর্মর আশা সম্পূর্ণরূপেই অবাস্তব এবং কাল্পনিকচিন্তা মাত্র। এবং ইহা বলিতেও তিনি কিয়ৎমাত্র ভুল করিলেন না যে, এতদবিষয়ে সমাসীন সরকার বাহাদুরের কিছুই করণীয় নাই। আহা, আমাদের রাজাধিরাজ, পাত্র মিত্র অমাত্যবৃন্দের প্রজাবাৎল্যর কী অপার মহিমা ! ধন্য আমাদের অকল্পনীয় সৌভাগ্যকে।

তিক্তবচন যতই দুর্বার সত্য হউক না কেন, তাহা স্পষ্টরূপে উদগীরণের এইরূপ অদৃষ্টপূর্ব ক্ষমতা সকলের থাকে না। ইহার জন্য বুকে বল আর বিচিত্র মানবশরীরের কটিদেশে যে শক্তিসামর্থ থাকিতে হয় তাহা যে আমাদের এই মহান বাণীদাতার বিলক্ষণ রহিয়াছে, ইহা ভাবিয়া বিনয়াবনত প্রজা হিসাবে অতিশয় তৃপ্তির উদয় হইল। কৃতদাস্য করিয়া করিয়া এই অভাগা জাতির বাঁকিয়া যাওয়া মেরুদণ্ড যখন সোজা সরল হইবার আর কোন সম্ভাবনা দেখিতে পাইতেছিলাম না, এতদলগ্নে তাঁহার এতদৃশ পরম সাহসী বাণী আমার মতো অভাজনকেও অতিশয় আশ্বস্ত করিয়াছে বৈ কি। না, আশাহত হইবার কোন কারণ নাই। এখনও আমাদিগের সূর্যসন্তানরা নিঃশেষ হইয়া যায় নাই।

নির্বুদ্ধিতায় আক্রান্ত হইলে মানুষ ইতিহাস বিস্মৃত হইয়া যায়। আমরাও ইতিহাস বিস্মৃত হইয়াছিলাম। কিন্তু ইতিহাসের এই খণ্ডিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ যে বাহুল্যস্বরূপ মনের মধ্যে ঘুপটি মারিয়া থাকিয়া সরিষার ভুতের মতো আমাদিগকে কোন্ অজান্তে বিপথে চালিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছিল, আমরা তাহা বুঝিতে না পারিলেও তিনি তাহা ঠিকই অনুধাবন করিতে পারিয়াছেন। এইখানেই পরম জ্ঞানীজনের সহিত অতিসাধারণ জনতার অনতিক্রম্য ব্যবধান রচিত হইয়া যায়। আমরা টু শব্দটি করিবার পূর্বেই দিব্যচোখে তিনি তাহা অবলোকন করিয়া ভাবের সারমর্ম উচ্চারণ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন, তোমাদের চিন্তাধারা সঠিক রাস্তায় চালিত হইতেছে না। ওইসব অনর্থক অষ্টবক্র চিন্তা পরিহার কর। নচেৎ মন্দ ফলাফলের জন্য নিজেরাই দায়ী হইয়া যাইবে। দৈবাৎ না খাইয়া মরিয়া যাইবে ? ইহা ভিন্নতর বিষয়। পরবর্তীতে সুযোগমত তাহা লইয়া ভাবা যাইবে না হয়। কিন্তু বাঙালীর পরাণ তো এতো ভঙ্গুর নহে। ইহা কৈ মাছের ন্যায়। ইহাকে তাড়াইতে চাহিলেও তাহা সহজে ছাড়িয়া যাইবে না। অতএব এই বাহুল্য প্রাণবায়ু লইয়া দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবার তো কোনই হেতু দেখি না !

শুনিয়াছি নবাব শায়েস্তা খাঁ’র অতিবিশ্রুত আমলে এক টাকার বিনিময়মূল্যে আটমণ ওজনের সমপরিমাণ চাউল খরিদ করা যাইত। অতিউর্বর সেইসব আমলে শস্যপ্রসবিনী দেশমাতৃকার জীবিত সন্তানদের মধ্যে ক্ষুৎপীড়িত হইয়া কেহ স্বর্গলাভ করিয়াছে এইরকম অকল্যাণমূলক দৃষ্টান্তও কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। অধিকন্তু তাহারা যে অতীব সুখ শান্তিতেই দিনাতিপাত করিয়া গিয়াছে ইহাই সর্বত্র বিশ্রুত আছে। ইহাতে ধারণা হইতেছে যে, তখনকার অধিবাসীদিগের দৈনন্দিন রাহা খরচসহ আনুষঙ্গিক আয়-উপার্জন অতিবিলাসী না হইলেও কোনভাবেই অকিঞ্চিৎকর ছিলো না। কেননা তৎকালীন ইতিহাসের খানাখন্দ খুঁজিয়াও সেই আমলের অকিঞ্চিৎ উপার্জনের এইরকম কোন নমূনা আজপর্যন্ত কেহ দাখিল করিয়াছেন বলিয়া শুনিতে পাই নাই।

এমতাবস্থায় মহামহিম উপদেষ্টার দীপ্যমান স্বতঃস্ফূর্ততার উজ্জ্বল পরামর্শবাণী মোতাবেক আমরাও ইতিহাসের পরিত্যাজ্য কণাসদৃশ বাহুল্যটুকু ভুলিয়া যাইতে চাই। ইহা শায়েস্তা খাঁ’র আমল নহে। তথাপি অতীব নগন্য যে কারণটির জন্য উহা ভুলিতে পারিতেছি না, তাহাই সুচাগ্র আলপিনের তীক্ষ্ণ শূলের মতো নিরবচ্ছিন্ন খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া পুনঃ পুনঃ মনে করাইয়া দিতে উদ্যত থাকিতেছে। সরকার বাহাদুরের নকড়ান্ন খাইয়া দিনাতিপাত করিবার সজোর প্রচেষ্টায় যাহারা কেবলমাত্র বাঁচিয়া থাকিবার প্রাণপণ চেষ্টায় লিপ্ত রহিয়াছে, তাহাদের দৈনিক কিংবা মাস মাহিনাটা যে শায়েস্তা খাঁ’র আমলের অপভ্রংশ স্মৃতিটাকেই ধারণ করিয়া বহাল তবিয়তে প্রাণবায়ুতে ধুম্র উদগীরণ করিয়া যাইতেছে, তাহা মহামান্য উপদেষ্টা মহোদয় তাঁহার প্রবল আত্মশক্তিতে ভুলিয়া যাইতে সক্ষম হইলেও মূর্খ অভাজনরা সেই অলৌকিক গুন সঞ্চয় করিতে পারিবেন কী করিয়া ? তাহারা তো ভাতের চিন্তা করিতে করিতে যাবতীয় সৃজন উন্মুখ চিন্তার প্রক্রিয়াই ভুলিয়া গিয়াছে ! আর রাষ্ট্রচিন্তার মর্মার্থ বুঝিলে তো এই বঙালদেশ কোন্ কালেই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ হইয়া সবাইকে তাড়াইয়া বেড়াইত। সে যাহাই হউক, তথাপি প্রজা বলিয়া কথা। কখন কী করিয়া বসে তাহার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে !

কখন আবার ধুম্রের আঁচ পাইয়া চামড়া জ্বলিয়া উঠিলে শায়েস্তা খাঁ’র নাম উল্লেখ করিয়া মূর্খ জনতা অহেতুক বেয়াদপি করিয়া বসে, সেই বিষয়টাও কি আমাদের মহামহিম উপদেষ্টা মহোদয় তাঁহার ত্রিকালদর্শী দিব্যচোখে অবলোকন করিতে পারিতেছেন ? শুনিয়াছি রাবণেরা যেইখানেই যায়, সেইটাই নাকি লঙ্কা হইয়া যায় !

(০৬/০৭/২০০৮)
(R_d_B)
(R_d_B)
(R_d_B)
(Sa7rong)

1 comment:

Agni said...

ধন্যবাদ, আপনার উচ্চারণ যতই তিক্ত হউক আমরা সত্যিই 'বুদ্ধিভ্রংশ অপগণ্ড নাগরিক'- এ বিষয়ে আমি কোন দ্বিমত করিতে ইচ্ছুক নহি। উচ্চমার্গীয় লেখা পড়িয়া চমৎকৃত হইলাম। বহু ধন্যবাদ প্রাপ্য হইলেন। কালান্তরে হস্তান্তর করা যাইবে।

ভাল থাকিবেন
ইতি
অগ্নি
http://agnisetu.blogspot.com