Friday, July 11, 2008

# বাংলাদেশ কি ধনীদের দেশে পরিণত হচ্ছে ?







বাংলাদেশ কি ধনীদের দেশে পরিণত হচ্ছে ?
-রণদীপম বসু


চলতে চলতে হঠাৎ করেই সামনেরটিকে ধাক্কা মেরে বসলো আমাদের রিক্সাটা। যাত্রীর গুঞ্জন ছাপিয়ে সামনের চালক খেঁকিয়ে ওঠলো- অই হালার পো, আন্ধা নি ? চউক্ষে দেহছ না ?
রীতিমতো মারমুখি ব্যাপার। অথচ প্রতি উত্তর শুনে আমাদের চালকটিকে বেশ রসিকই মনে হলো- আবে হালায় ডাকাইত নি ! তুই এহনো চউক্ষে আন্ধাইর দেহস নাই ! হালায় জমিদারের নাতি হইছ তো রিক্সা ঠাপাইতে আইছস কেন্ বে ?
দূর হালার পো হালা। বলেই আগের চালক সামনে চলতে শুরু করলো। হয়তো আরো কিছুটা বাগড়াবাগড়ি চলতো। কিন্তু রাস্তার জ্যাম মুক্ত হওয়ায় যে যার পথে ছুটলো আবার।

ঢাকার রিক্সায় চড়েছেন অথচ রিক্সায় রিক্সায় ঠেলাগুঁতো বা চালকদের মধ্যে ঝক্কিফ্যাসাদ দেখেন নি এমন কেউ কি আছেন ? আমার জন্যে তো তা নিত্য নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতাই। কিন্তু আজকের বিষয়টাকে কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম বা আনকোড়াই মনে হলো। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে চালককে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কই আপনার ?
জী, আছিলো তো বরিশাল।
বরিশালের লোকেরা মনে হয় রসিক হয় খুব, তাই না ?
রস দেখলেন কই স্যার ! আমাগো জান বাইরয়, আর আপনে দেখতে আছেন রস ?
কেন, আপনাদের কথা চালাচালি শুনে আমার তো তাই মনে হলো !
ঘর্মাক্ত সচল শরীর দুমড়ে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম যেনো। হঠাৎ তাঁর কথার মধ্যে কটাক্ষের ছোঁয়া পাচ্ছি। হ, গরীবের কি আর ভাত খাওনের জোগার রাখছেন আপনেরা ? কথা দিয়াই তো আমাগোরে পেট ভরতে অয়।
হুম, ঠিকই বলেছেন। গরীবের বাঁচার আর কোন রাস্তাই নাই।
ফজরে ঘুম তনে উইঠ্যা দোকানে যাইয়া হুনি চাইলের দাম আবার বাড়ছে। কাইল আপনেগো উপদেষ্টা সাবে কী জানি কইছে রাইত, সকাইল্যা বেলাই সয়াবিনের দাম বাইড়া গেছে পনরো টেকা। আরে হালার দোকানে তেলই নাই। রাইতের বেলাই ফিনিশ ! সব মাগীর পুতেরাই এক রকম। গরীব হালার পুত হালায় একটায়ও বাঁচবো না আর। সব হালারা মরবো।...
কথা তো না, যেনো মাংস পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে ! আগের রাতে আমাদের অর্থ উপদেষ্টা মহোদয় সংবাদকর্মীদের কাছে ‘এটা শায়েস্তা খাঁ’র আমল না, দ্রব্যমূল্য কমার কোন সম্ভাবনা নেই ; এখানে সরকারেরও কিচ্ছু করার নেই’ বলে যে ঐতিহাসিক বাণী ছেড়েছেন, এর কয়েক ঘণ্টা পরই অস্থির বাজার পরিস্থিতি আর খেটে খাওয়া দিনজীবী মানুষগুলোর বেঁচে থাকার নাভিশ্বাস অবস্থার অতি ক্ষুদ্র এক টুকরো প্রতিফলন ভাসছে এই রিক্সাচালকের উক্তিতে।
আগে রিস্কার মালিককে আধা বেলায় দিতে হইতো পঞ্চাশ টেকা। এখন দিতে অয় নব্বই টেকা। বস্তির ভাড়া বাড়াইছে পাসশো টেকা। আপনেরা তো স্যার ভাড়া দুই টেকা বেশি চাইলেই সোজা হাঁটা শুরু কইরা দেন !
আমি বললাম, দেখেন ভাই, আপনার জন্য যেমন সব বাড়ছে, আমার জন্যেও তো বাড়ছে সব। ছোটখাট চাকরি করি। সব কিছুর দামই সরকার ক’দিন পর পর বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের বেতন তো একটাকাও বাড়ায় নাই ! আমি কার কাছে বলবো এসব ? আমার জন্যে তো রিক্সা চড়াটাই এখন বিলাসিতা !
তয় আমরা যামু কই ? দেইখেন গরীব হালার পুত হালারা একটাও বাচবো না ! মইরা সাফ হইয়া যাইবো সব।

কথোপকথনের সংবেদনশীলতায় পারতপক্ষে খুব একটা যেতে চাই না আমি। মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক যন্ত্রণাকে ঘাটানো বিপজ্জনকও। কষ্টের আগ্নেয়গিরিতে খোঁচা খেলে মানুষের আবেগ অস্থির হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই কোন বাধা মানে না আর। কিন্তু দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিতে সব কিছুই যেভাবে উদ্ভটতায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে করে সবাই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতায় ভুগছে, সব কিছুই একাকার হয়ে কেমন একটা গুবলেট অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে যেনো। তাই আমাদের কথোপকথনের পরিবেশটাকে সিরিয়াসনেস থেকে ঘুরিয়ে হালকা করার জন্য হঠাৎ করেই কৌতুকের আশ্রয় নিলাম। আমাকে বহনকারী রিক্সার চালকের শেষ উক্তির রেশ ধরেই বললাম- আপনি ঠিক বলছেন তো, গরীব সব মরে সাফ হয়ে যাবে ?
হ, গরীবের গুয়ায় যেই বাঁশ ঢুকাইবার লাগছেন, এক হালায়ও কি বাঁচবো আর ? সব শেষ।
তাহলে তো আমাদের এই দেশের জন্য বিশাল সুখবর এটা !
কোন প্রত্যোত্তর না পেলেও আমার এমন কথায় তাঁর জেগে ওঠা কৌতুহল টের পেলাম ঠিকই। আমি বলে চললাম, আপনার কোন আত্মীয় বা পরিচিত কেউ বিদেশে থাকে ?
আত্মীয় নাই। তয় পরিচিত আছে অনেকেই।
দেশের বাইরে বিদেশে বাংলাদেশের পরিচয় কী রকম, আপনি জানেন ?
মাথা নেড়ে তার অজ্ঞানতা প্রকাশ করলো।
বিদেশে বাংলাদেশের পরিচয় হচ্ছে ফকির মিসকিনের দেশ, এইটা তো শুনেছেন ?
হ।
এই সুযোগে আপনার কথা অনুযায়ী যদি দেশের সব গরীব মইরা যায়, তাইলে বাঁইচা থাকবে কারা, বলেন তো ?
বড়লোকেরা !
হ্যাঁ, তখন কেবল ধনীরাই থাকবে বাংলাদেশে ! কোন গরীব নাই ! বিশ্বে আর একটা দেশও কি পাবেন যেখানে কোন গরীব নাই ? তাহলে তখন বাংলাদেশের পরিচয় কি আর ফকির মিসকিনের হবে ? এটা তখন ধনীর দেশ হয়ে যাবে !
হ, ঠিকই কইছেন।
তাহলে সরকার কেন এই সুযোগ হাতছাড়া করবে ? কোন সরকার যা পারে নাই, এই সরকার তা করে দেখিয়ে দেবে ! বাংলাদেশ ধনীদের দেশ ! অতএব যত তারাতারি মইরা যাইতে পারেন ততই দেশের জন্য মঙ্গল। যারা এইটা বুইঝাও এখনো মরতেছে না, তাগরে মারনের একটা বুদ্ধি বের করতে হবে না !
তার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানো দেখেই বুঝলাম কথাটা বোধ হয় বেচারার মনে ধরেছে।

বাসার সামনে এসে ভাড়া দু’টাকা বাড়তি দিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললাম, আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু আমাদের কষ্ট কেউ বুঝে না।
ভাড়া গুনে হঠাৎ বাড়তি টাকা দুটো ফেরৎ বাড়িয়ে বললো, নেন স্যার। এই টাকা নিমু না আমি।
কেন ?
আপনিও আমাগোর মতোই।
আমি ফেল ফেল করে চেয়ে রইলাম। দেশটা যদি সত্যি সত্যি ধনীদের হয়ে যায়, এই সহানুভূতিটুকু কি থাকবে তখন ?
(১১/০৭/২০০৮)
(R_d_B)

No comments: