Wednesday, February 18, 2009

# টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০২ (কবিতাগুচ্ছ)


টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০২ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু


প্রতিদিন তোমাকে

যখন নিশ্ছিদ্র আচ্ছন্নে থাকি
অসংখ্য পঙক্তিতে শুধু তোমাকেই আওড়াই
অবিরাম...
কখনো সরব হলে, নিশ্চিন্ত হই-
ওখানে কবিতা নেই, তুমিই কেবল...

তোমার আলিঙ্গন ছাড়া কী করে অক্ষরেরা শব্দ হবে !
তোমার চুম্বন ছাড়া শব্দের সাধ্য কী পঙক্তি হবার !
তোমার বিরহ পেলেই অপাঙক্তেয় পঙক্তিরা সব
একেকটা কবিতা হয়ে
ঝাঁপ দেয় আদিগন্ত শূন্যতার ডানায়...

এবং ঝরতে ঝরতে পড়তে পড়তে
যখন খাবলে ধরি ক্রমশই অপসৃত তোমার অঢেল বুক
কী আশ্চর্য, কারা যেন কবিতা কবিতা বলে হর্ষধ্বনি করে !
ওরা কি জানে কবিতা আর মাংসের তফাৎ ?

কোথাও নিবিষ্ট নই তোমাকে ছাড়া, অথচ
অন্ধি-সন্ধি-মাংসের আড়ালে অশ্রান্ত খুঁজে খুঁজে
প্রতিদিন তোমাকে তোমার তোমাকে হারাই...
(১৭/০২/২০০৯)



শহীদ মিনার

যে আমি দু’কদম হাঁটলেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যেতাম,
অথচ প্রভাতফেরির উন্মুখ সচল ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে...
এক বিস্ময়কর উত্তেজনায়
একটুও কষ্ট হতো না আমার।
দু’পাশ আগলে রেখে বাবা আর মা,
মনে হতো
মাঠ-ঘাট-নদী-বন বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত পেরিয়ে
অনায়াসে যেতে পারি হেঁটে- কুয়াশা-সুদূর ওই-
আকাশের নেমে আসা প্রান্ত-সীমায়।

দু’হাতে মুঠোয় ধরা স্মিত-রঙ ফুলের স্তবক-
গুটি-গুটি-পায়ে হেঁটে যাই ছোট্ট আমি,
পাশে বাবা আর মা ;
একরাশ ইচ্ছের মতো পীচ-কালো পথটাও
মিশে গেছে-
শহীদ- মিনারের বিশাল বিস্তৃত আঙিনায়।
আমার প্রভাতী চোখে- রাজ্যের কৌতূহল ;
সম্মিলিত কোলাহল ছাপিয়ে
সবুজ দৃষ্টির পাতা
ফিরে আসে বারে বারে-
মিনারের নোয়ানো চূড়ায় ছুঁয়ে
পুনরায় মায়ের উজ্জ্বল মুখে।
এক অদ্ভুত অচেনা মায়ায় তাঁর দীঘল আনত মুখ
আমাকে বুলিয়ে যেতো বারবার।
মিনারের চূড়া, ফের মায়ের মুখের আকাশ-
দেখতে দেখতে
কখন যে এক মুঠো স্নিগ্ধ ভেজা ঘাস হয়ে যেতাম!

এখন সে মা আমার স্মৃতির উঠোন।
দু’কদম হাঁটলেই আজো ক্লান্ত হই আমি।
এখনো শহীদ মিনারে এলে কখন-অজান্তে যেন
চোখ দুটো ঘুরে-ফিরে ছুটে যায় মিনারের
সেই সে নোয়ানো চূঁড়ায়;
যেখানে মায়ের গভীর মুখ-
আনত উঠোন হয়ে আমাকেই ডাকে,
ডেকে যায়...।
(০৪/১২/২০০৭)
[sachalayatan]



খুনে তিল’টাই জানে

প্রহরায় জেগে রাখা তোমার ওই খুনে তিল’টাকেই জিজ্ঞেস করো
সে কি জানে- এটা যে তুমি নও, তোমার উঠোন শুধু ?
লাল জলে ফোটে থাকা কৃষ্ণ বাতিঘর !

যুদ্ধের মন্ত্র ভুলে নির্বোধ আহুতি দেয়া ইচ্ছের কবন্ধগুলো
নিরস্ত্র দেখে
ভেবো না শিখেনি ওরা সশস্ত্র হতে;
ওরাও খুঁজতে জানে অহিংস সবকে বোনা স্বর্ণচাপা সুখ, নারীর প্রাসাদ
কিংবা নিমেষেই হানা দিতে লুটেপুটে হালাকু চেঙ্গিস

তুমি আর টোল পড়া তিলের সৌরভ ছুঁয়ে
একেবেঁকে যে নদীটা নিশ্চিৎ হারিয়ে যাবে নাভির চরায়
জলল অক্ষর দিয়ে ওখানে একটি নাম লিখে দিতে বহুকাল ভেসেছি আমি।
অতঃপর কখন যে ডুবেই গেলাম !

খুনে ওই তিল’টাই জানে- ওটা কি ঝড়ই ছিলো,
না কি সময়ের ফুটো বেয়ে
আদিগন্ত গিলে ফেলা নহলী সাম্পান ?
(০৫/০৫/২০০৯)
[sachalayatan]



আলতো করে ছুঁয়ে থাকে

আমাকে উন্মুক্ত করে
তোমার অবাধ্য তর্জনীটা আলতো করে ছুঁয়ে থাকে
বুকের নিপুলে আমার ! অথচ কী নির্বিকার তুমি
আমার চোখে রাখো চোখ, আর
আশ্চর্য মগ্নতায় চেয়ে থাকো অন্য কারো স্পর্শাতীত চোখে-
মুখের মানচিত্রে কিংবা ভুল আর শুদ্ধতায় মাখা
এক বুক নির্মাণ জলে !

অবাধ্য তর্জনী তোমার
আমি ঠিক টের পাই শির শির স্পর্শের ঘ্রাণ
এদিক ওদিক সরে আমাকে জাগাতে চায়।
এতোই নির্বোধ তুমি, অথবা তোমার চোখ,
তোমার দৃষ্টিতে বেয়ে কতো বেশি অনায়াসে তোমাকেই পড়ে ফেলি
কখনোই জানবে না তুমি। কখনো বুঝবে না তাও-
আমারই শীৎকারে শীৎকারে মেখে বোধের আগুনে যে
কল্পিত অবয়ব আঁকো, ওটা যে আমি নই সেও নয়-
আর কেউ, বুকের দখলে রাখা অন্য কোনো অতৃপ্ত স্বজন !

নিপুলের চূঁড়া ছুঁয়ে তুখোড় তর্জনী ফেলে কোথায় লুকোবে আর !
চিবুকের তিল গ্রীবা সানুবুক ঠেলে
পিছলে যাওয়া চোখের সড়ক ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে যাবে
উঁচু নিচু ঢাল বেয়ে নিচে আরো নিচে আরো নিচে...

আর তোমার পতন দেখে ধীরে ধীরে উষ্ণ আমি
গেঁথে নেবো সব চিহ্ণ সব স্মৃতি তোমার নগ্নতা সবই,
হয়তো জানবে না কেউই অথবা তুমিও, বুকের নিপুল ছুঁয়ে
ফেলে যাওয়া তর্জনীটা যেখানে হৃদয় থাকে টিপ করে চেপে দাও যদি-
জরায়ুর অন্ধকার ছিঁড়ে আশ্চর্য আলোকপাতে ভেসে যাবো আমি !
রতিতৃপ্ত পতঙ্গের মতো তুমি তো উড়েই যাবে
অন্য কোনো অবয়বে খুঁজে নিতে নিত্যসুখ, বোধের সাম্পান। আর
তৃষ্ণা-কাতর আমি অন্য কোনো দৃশ্যপটে আবারো কম্পিত হবো তর্জনীর চাপে !
(২৪/০৫/২০০৯)
[sachalayatan]


কররেখা

মানুষের পদরেখা মানুষ বোঝে না
শুধু কররেখা গুনে গুনে কী আশ্চর্য মিলিয়ে নেয়
খরদাহ জ্যোতিষ্কের কাল, পাথরের অলৌকিক স্বভাব
কিংবা সময়ের গর্ভের আগাম উত্তাপ, সবই।
তবে কি কররেখা রেখা নয়, চুপ করে পড়ে থাকা নদীর স্বভাব ?

মানুষের কররেখা নদীই যেমন।
বুকের বর্ষায় ভেজা নিঃসঙ্গ উঠোন জুড়ে
এপার ওপার করে কতোবার মারিয়েছো তুমি ?
বসে যাওয়া বিবর্ণ পায়ের ছাপ নেড়েচেড়ে অসম্ভব কুটিকুটি আমি
পাইনি খুঁজে কোনো রেখাময় পায়ের প্রপাত-
কূলপ্লাবী স্রোতে-জলে যে নদী হারাতে জানে !
ওখানে ভাসাবো বলে নির্জন রেখাতটে বসে বসে
আয়ুধ সাম্পান গড়ে ঘূণের মোচ্ছবে শুনি আজ-
আহা, মানুষের পদতলে রেখা নেই, নদীর আহ্বানও নেই !

বুকের বর্ষায় ভেজা পিচ্ছিল উঠোন ভেঙে সত্যিই হেঁটে গেলে
একবারও ডাকেনি কি বৃক্ষল শরীরে তোমার
উন্মূল পতনের স্বর ? দেহের উষ্ণতা মেখে লেপ্টানো এ মাটি-বুক
অদৃশ্য উড়ালে না হয় হয়ে যেতো হৈমন্তী আকাশ,
সে সব হয়নি কিছুই।

নাই হলো দেয়া-নেয়া পরস্পর আদিম অভাব,
কখনো কি দেখা হবে তোমার আমার ?
কররেখা গুনে যদি দেখা যেতো নদীর স্বভাব...!
(২১-০৬-২০০৯)
[agunpakhi]
[somewherein]
...

No comments: