Wednesday, April 22, 2009

# [অনুগল্প] --- এই রিমি, দাঁড়া...!


এই রিমি, দাঁড়া...!
রণদীপম বসু
...
ধাম করে জড়িয়ে ধরলো সে। এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই নরোম ঠোঁট দুটো সজোরে চেপে ধরলো আমার খসখসে গালে। একটা মৌ মৌ গন্ধে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। যখন বুঝতে শুরু করলাম একটি সদ্য তরুণী-দেহ তার সমগ্র সত্তা দিয়ে অক্টোপাশ-বন্ধনে আমাকে আস্টেপৃষ্ঠে পিশে ফেলতে চাইছে, কী যেন হয়ে গেলো আমার ! এই প্রথম টের পেলাম, শক্ত-সমত্থ তরুণ শরীরটাতে বুঝি মনের আড়ালে মিশে লুকিয়ে ছিলো একটা বেয়াড়া পুরুষও ! কিন্তু তার আগেই ঝট করে ছেড়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো সে, জোড়া দীঘির মতো টলটলে চোখ দুটো মেলে কীরকম চেয়ে রইলো আমার দিকে ! চিকচিক করলো কি ? আচমকা ঘুরেই দৌড়াতে লাগলো !
আরে আরে করে কী ! কেবল তো এলো ! এখনই চলে যাচ্ছে কেন ! ওর সাথে আর কি দেখা হবে আমার ! কণ্ঠ চিরে অজান্তেই বেরিয়ে এলো- এই রিমি, দাঁড়া...!


ধাবমান ডাকে কোনো সাড়াই দিলো না সে। কোমরের কাছে নেমে আসা মোটা কালো বেণীটা রিমি’র পিঠ জুড়ে লাফাচ্ছে তখন...।

গোটা গ্রামে শেষপর্যন্ত রিমি’রাই একঘর হিন্দু। বরাবরের মতো দরদী করিম চাচা বাদে আর কেউ জানে না যে আজ রাতে ওরাও এ দেশের পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছে। কাল বাদে পরশু অনার্স সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষা আমার। রিমির কাছ থেকে খবরটা পেয়েই পরীক্ষা মাথায় ওঠেছে। সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গেছে তখন। রিমিকে আর কখনোই দেখবো না এটা কী করে সম্ভব ! উন্মত্তের মতো চলন্ত বাসের হ্যান্ডেলে ঝুলে পড়াটাই শেষ ঝুলা হতো কিনা কে জানে, বাসের হেলপার কন্ডাক্টর ড্রাইভার এমনকি যাত্রীরাও দমে-বেদমে কত কী যে বকে গেছে। কিন্তু আমার মাথা জুড়ে একটাই ভাবনা- রিমি, তোকে কোথাও যেতে দেবো না আমি !

দীঘির পাড় ছেড়ে গাছ-গাছালি পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আকাবাঁকা রাস্তাটার সাথে রিমি’র ছুটন্ত নদীমাখা শরীরটাও হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সত্যি কি রিমি হারিয়ে যাবে ! ভেতরে কোথায় কী যেনো থরথর করে কেঁপে ওঠলো আমার। তা কী করে সম্ভব ! কিছুতেই তা হবার নয় ! চোখের আড়ালে যাবার আগেই ওকে ধরতে হবে। না রিমি, কোথাও যেতে দেবো না তোকে ! এক অচেনা ক্ষিপ্রতা এসে ভর করলো, তীব্র বেগে ছুটিয়ে নিলো আমাকে। ওই তো রিমি ! বাঁশঝাড়টা পেরোবার আগেই দড়াম করে কী যেনো লাগলো এসে মাথায় ! মুহূর্তেই সবকিছু অন্ধকার... ... ...।


...গভীর কোন নৈঃশব্দ থেকে অস্পষ্ট গুঞ্জনটা ক্রমেই জোরালো হতে হতে একটা অসহ্য হট্টগোলে পরিণত হলো। কিসের এতো হৈহুল্লোড় ? চোখ দুটো খুলেছি কিনা বুঝতে পারছি না, সবকিছু ফকফকে সাদা ! বারকয়েক পিট পিট করতেই কুয়াশার পর্দাটা ধীরে ধীরে সরে গেলো। মাথার উপর ভনভন করে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটাকে বড়সড় অস্পষ্ট থালার মতো লাগছে। কিন্তু কোথায় আমি ? বুঝা গেলো চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাসপাতালের কোন কেবিনের মতো মনে হলো। পর্দার ওপাশে মানুষের একটানা গুঞ্জন। কিন্তু আমি এখানে কেন ? কী হয়েছে আমার ? ওঠে বসতে গিয়েও বসতে পারলাম না। ঝনঝন ধাতব শব্দ আর শরীর জুড়ে তীব্র ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠলাম। হাত-পাগুলো শেকলবদ্ধ করা ! মানে...!!

হঠাৎ পাশে কোথাও থেকে তীব্র চিৎকারে কেঁপে ওঠলাম ! ঠা ঠা শব্দে কারো অট্টহাসিও শোনা গেলো। একটা মৌ মৌ গন্ধ নাকে এলো। হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগলো শরীর ! মনে পড়ে যাচ্ছে সব- এটা তো রিমি’র শরীরের ঘ্রাণ ! আমার রিমি কোথায় ? ওকে আমি কোথাও যেতে দেবো না !
টান পড়ে শেকলগুলো ঝনঝন করে ওঠলো আবার। স্টেথো ঝুলানো গলায় পর্দা সরিয়ে কে যেন উঁকি দিলো। চেঁচিয়ে ওঠলাম- ডাক্তার ডাক্তার...প্লীজ ! আমাকে রিমি’র কাছে যেতে দিন...প্লীজ !
’নার্স’ ! অপসৃত ডাক্তারের বদলে পর্দা সরিয়ে স্থূলদেহী অদ্ভুত-দর্শনা নার্সটি একটা সিরিঞ্জ হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো...।
প্লীজ সিস্টার...প্লীজ, আমাকে একটিবার রিমির কাছে যেতে দিন...ওকে আমি কোথাও যেতে দেবো না...! শেকলবদ্ধ হাতে-পায়ে শরীরটাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে মোচড় দিলাম। কোনো লাভ হলো না। তীব্র ভূকম্পনের মতো একটা অনিঃশেষ কান্নার ঢেউ ছটফট করা বুকের খুব গভীর থেকে প্রলয়বেগে উঠে আসতে লাগলো...।
’হুঁহ্, দেশে মাইয়ার অভাব আছে ! হেই কবে মইরা ভুত হইয়া গেছে !’ গজগজ করতে করতে নার্সটি সাঁই করে সিরিঞ্জের সুঁই’টা আমার নিতম্বের পাশে ঢুকিয়ে দিলো...।
(২১/০৪/২০০৯)
...
[sachalayatan]
[khabor.com]
...

No comments: