Monday, June 29, 2009

# জন্মদিনের শুভেচ্ছা পোস্ট বনাম প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে উত্থিত প্রশ্নগুলো|


জন্মদিনের শুভেচ্ছা পোস্ট বনাম প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে উত্থিত প্রশ্নগুলো
রণদীপম বসু
...
প্রফেসর ইউনূসকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ‘সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস’, এই অভিন্ন শিরোনামে একটি লেখা গতকাল (২৭-০৬-২০০৬) অন্তর্জালের জনপ্রিয় দুটো ব্লগে (সচলায়তনসামহোয়ারইন) পর পর পোস্ট করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহলী ব্লগারদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এতে। নিজ নিজ মতামত তুলে ধরে অনেকেই বিচিত্র সব মন্তব্যও করেন যার যার রুচি, বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। আমার পারিপার্শ্বিক ও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই সারাক্ষণ এবং ইচ্ছেমতো অন্তর্জালে সংযুক্ত থাকা আমার দ্বারা সম্ভব হয় না। ফলে বেশ দেরিতেই মন্তব্যগুলো দেখা ও পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু মন্তব্যের ক্যাটেগরি অনুযায়ী উত্তর দিতে গিয়েই বেশ বিপাকে পড়ে গেলাম। বিতর্ক যাকে পিছু ছাড়ে না, সেই প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে দেয়া পোস্টে অন্য কোনো পোস্টের মন্তব্যের মতো ইয়েস নট ভেরীগুড ধন্যবাদ জাতীয় মন্তব্য জবার দিয়ে শেষ রক্ষা হবে না এটা আন্দাজ করলেও আমি নিজেও যে ব্যক্তি-আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারি সেটা কখনোই ভাবিনি। আর এর জবাব দিতে গিয়ে মন্তব্যের যে আকার দাঁড়াবে তাতে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি যদি দশগুণ বড় হয়ে যায় তাহলে তা সমন্বিতভাবে আলাদা পোস্ট আকারে দেয়াটাই সমীচিন মনে হযেছে।



শুধু যে এই একটাই কারণ তাও নয়। আসলে ওই সব মন্তব্যের উত্তর দেয়ার আগে প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গে উত্থিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানাটাও আবশ্যক আমার। যেভাবে এটাও জানা দরকার যে, আমরা কি সব সময় কেবল মুখ দিয়েই উত্তর দেই, না কি মাথাও ব্যবহার করি সাথে ? তবে সবার কাছে আগে এই অনুরোধ রাখি, আমার কোন বক্তব্যে কেউ যেন নিজেকে আক্রান্ত না ভাবেন। আসলে মন্তব্য-সূত্র ব্যবহার করে আমার একান্তই নিজস্ব চিন্তা-চেতনা নির্ভর কিছু যুক্তি উত্থাপনের প্রয়াস নিয়েছি কেবল। আমরা বাঙালিরা বোধ করি অস্থি-মজ্জায় বিতর্কপ্রিয়। তবু আশা করি আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যময় সম্পর্কে কোন নেতিবাচক আঁচড় আমরা কেউ পড়তে দেবো না।

‘সত্তরতম জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস’ পোস্টটিতে জনৈক ব্লগার (ইচ্ছে করেই এখানে নাম নিলাম না যদিও, তিনি যেন কোনভাবেই ভুল না বুঝেন আমাকে) আমার দীর্ঘ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেই অত্যন্ত শালিন ও নম্রভাবেই মন্তব্য করেছেন এভাবে-
অসাধারণ মেধা আর অনন্য সৃজনক্ষমতার চৌকস উপস্থাপন, অর্থনীতির ক্ল্যাসিক তত্ত্বকে উল্টে দিয়ে সৃষ্ট তত্ত্বের সাথে প্রয়োগযোগ্যতার বিস্ময়কর সাফল্য প্রদর্শন এবং সাদাসিধে ব্যক্তি-জীবনের গ্লামারাস কারিশমা ও ঈর্ষণীয় যোগ্যতা তাঁকে হতভাগ্য গরীব একটি দেশের সাধারণ শিক্ষক প্রতিনিধি থেকে এক প্রভাবশালী বিশ্ব-ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তাঁকে নিয়ে আমরা যত বিতর্কই করি না কেন, বিশ্ব-মানচিত্রের এক কোণে পড়ে থাকা অসংখ্য সমস্যা-জর্জরিত বাংলাদেশ নামের ছোট্ট এই দেশটির বিশ্বপরিচিতি তুলে ধরতে তাঁর অবদান কোন অংশে কম নেই। এবং তাঁর মতো দ্বিতীয় আরেকটা বিশ্ব-ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে এই হতভাগ্য জাতিকে আরো কতোকাল যে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। করে খাওয়ার বদলে কেড়ে খাওয়ার সংস্কৃতিতে পর্যুদস্ত এই দেশে তাঁকে নিয়ে অহঙ্কার আমরা করতেই পারি।...
ছিঃ বসু ছি!
এই সুবিধাবাদি-ধান্দাবাজ-সুদখোর-নীতিহীন জঘণ্য একটা লোককে এইরকম তেল চুপচুপে লেখা দিয়ে নিজের রেপুটেশন নষ্ট না করলেও পারতেন।”

প্রথমেই তাঁকে ধন্যবাদ এবং মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখি। কেননা তাঁর ধারালো ও ভারী মন্তব্যের তীব্রতা যখন ঘুরে আমার দিকেই ধেয়ে এলো, তখন আর জবাব না দিয়ে আমার কোন উপায় থাকে নি। এই মন্তব্যের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করেছি কয়েকটি কারণে-

ড. ইউনূস এই রণদীপম বসু নামের নগন্য একজন ব্লগারকে চিনেন কি না তা জানা নেই। চেনার মতো নগন্যতম কোন সম্ভাবনাও চোখে পড়ে না। কিংবা ওই লেখাটাও আদৌ তাঁর চোখে পড়ার কোন কারণ আছে কিনা সে ব্যাপারেও একশতভাগ সন্দিহান আমি। আমাদের প্রচলিত সিস্টেমে যেখানে কোন না কোন স্বার্থ জড়িত থেকে যায়, বৈধ বা অবৈধ কোন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া-নেয়ার বিষয় জড়িত থাকে সেখানেই তেল দেয়ার বিষয়টা প্রযোজ্য হয়ে থাকে জানি। সেক্ষেত্রে চুপচুপে দূরে থাক, সামান্যতম তেলও খরচ করা এই সংগতিহীন আমার জন্য মহার্ঘ অপচয় হয়ে যায় না কি ?

এই লেখকের ‘হরপ্পা’ নামের ব্লগে ঢুকতেই ব্লগ ব্যানারে প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিসের একটা বাণী নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে- ‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভালো।’ ভুল বা শুদ্ধ হোক, আমার চিন্তা আমারই। এর সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তা স্বীকার করেই আমার বক্তব্য হচ্ছে, নিজস্ব চিন্তা বা ভাবনাকে প্রকাশের সৎসাহসই যদি না থাকলো তাহলে অর্থহীন রেপুটেশন দিয়ে কী হবে ! আর রেপুটেশন মানেই কি কান-কথা নির্ভর যুক্তিবোধহীন হুজুগে জনস্রোতে ভেসে চলা ?

আপনার অপছন্দের কিছুকে ‘ছিঃ’ বলতে পারার মৌলিক অধিকারকে সংরক্ষণ করেই আমারও কি জানতে ইচ্ছে হয় না, ড. ইউনূসকে আখ্যায়িত করে যে ‘সুবিধাবাদি-ধান্দাবাজ-সুদখোর-নীতিহীন-জঘণ্য’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন তা কি ভালোভাবে জেনেবুঝে নিশ্চিত হয়ে করলেন ? কিংবা আমার চিন্তাপ্রসূত বক্তব্যের যে উদ্ধৃতিটাকে ‘ছিঃ’ শব্দ ব্যবহার করে এক কথায় প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তার পেছনে আপনার কোন্ তথ্য-উপাত্ত-যুক্তিবোধ কাজ করেছে তা জানার অধিকার নিশ্চয় আমিও সংরক্ষণ করি !

আমি আশা করবো, পারস্পরিক সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেই আমরা আমাদের আলোচনা-পর্যালোচনাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আর আলোচনায় যাবার আগে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভবত জরুরি এখন।

০১)
১৯৯২ সালে সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকা মাসিক জমাদান শর্তে একটা ডিপোজিট পেনশন স্কীম বা ডিপিএস হিসাব খুলেছিলাম ১০ বছর মেয়াদে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে পারিবারিক সমস্যার কারণে ওটার বিপরীতে তৎকালীন ১৮% ত্রৈমাসিক চক্রবৃদ্ধি সুদ হারে জমাকৃত আমানতের ৬০% সমপরিমাণ টাকা ঋণ নেই। সুদের হিসাব তো অনেকেই খুব ভালো জানেন দেখছি, একটু হিসাব করে বলবেন কি, এই সুদের হার বাৎসরিক হিসাবে কত পার্সেণ্টে গিয়ে দাঁড়ায় ? যেহেতু ঋণের বড় অংকের কিস্তির কারণে জাতীয় স্কেলের উল্লেখযোগ্যহীন বেতন নির্ভর ছাপোষা চাকুরে আমার দ্বারা খুব সঙ্গত কারণেই নিয়মিত ঋণের কিস্তি দেয়া সম্ভব ছিলো না, তাই অচিরেই তা সুদসহ বাড়তে বাড়তে আমার আমানতের মূল টাকাটাই গিলে খাবার জোগাড়। শেষপর্যন্ত ডিপিএস হিসাবটাকেই ক্লোজ করতে হলো। তাও ডিপিএস-এর প্রাপ্য ইন্টারেস্ট রেটে নয়, নরমাল সেভিংস এ্যাকাউন্ট হিসেবে।

এখন প্রশ্ন, একটা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সে সময়কার এমডি যিনি ছিলেন, তাঁকে কি সুদখোর মহাজন বলে অকথ্য ভাষায় গালি দেবো আমরা ? আর যদি সেই নিয়ম এখনও চালু থাকে, তবে কি বর্তমান এমডিও সুদখোর কাবুলিওয়ালা ?

০২)
গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অক্টোবর ১৯৮৩ সালের রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। যে কোন একটি নতুন শাখা খুলতে গেলেই আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। তাহলে আমাদের বিদ্যার জাহাজ বড় বড় সরকারি কর্মকর্তারা এটাকে এনজিও বলেন কেন এবং কোন্ যুক্তিতে ?

০৩)
ড. ইউনূস হচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভোগী এমডি। যেহেতু তিনি এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা, এবং সময়ে সময়ে পূর্ব-দৃষ্টান্তহীন এই আনকোরা নতুন দর্শনে চালিত প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম নীতি কৌশলের সংস্কার ও সম্প্রসারণে তাঁর মেধা ও দক্ষতার প্রয়োজন ছিলো, তাই তাঁকে সম্মানিত করে দীর্ঘকালীন এমডি হিসেবে রাখার বিধান যতটুকু জানি উক্ত অধ্যাদেশেই করা হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয় বা লাভ-লোকসানের যাবতীয় দায়ভার প্রতিষ্ঠানই বহন করে। ড. ইউনুসের ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি বা কোন ধরনের মুনাফার বিষয় এখানে কোনভাবেই জড়িত নয়। এছাড়া ব্যাংকটির পরিচালক মণ্ডলির নয়জন তিন বছর অন্তর ঋণগ্রহীতা সদস্যদের থেকে সদস্যদের দ্বারাই নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যানসহ বাকী তিনজন পরিচালক নিয়োগ দেন সরকার। নীতি-নির্ধারণী থেকে আয় ব্যয় এবং পরিচালন কৌশল সবকিছুই এই পরিচালক মণ্ডলিই অনুমোদন করে থাকে। তাহলে ড. ইউনূসকে কেন সুদখোর এবং আনুষঙ্গিক গালাগালগুলো শুনতে হয় ?

০৪)
ক্ষুদ্র ঋণ তত্ত্বের বেসিক নীতিটাই হলো জামানত বিহীন ঋণ। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যাদের জামানত দেয়ার ক্ষমতা আছে তারাই যে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাবার যোগ্যতা রাখেন এবং তাঁরা ঋণের জন্য ব্যাংকে আসেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থায় জামানত দেয়ার মতো ন্যুনতম সম্পদও যাদের নেই, তাঁদেরকে তাঁদের পেশা বা ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে জামানত বিহীন ঋণের সুযোগ তুলে দিতে ব্যাংকই মানুষের দরজায় যাবে।

এই নীতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে যারা নিজ নিজ পরিচালন ব্যয় ও আনুষঙ্গিক খরচাদি বিবেচনায় রেখে আয়ের নিমিত্তে ঋণের সুদের হার নিজেরাই নির্ধারণ করে থাকে। সুদের হারের সাথে ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের কোন সম্পর্কই নেই। এমন যুগান্তকারী তত্ত্বকে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ড. ইউনূস দেখিয়েছেন জাতীয় বেতন কাঠামোর মধ্যে থেকেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এরকম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব, শুধু সদিচ্ছা থাকলে। এজন্যই এই তত্ত্বের আলোকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে এবং দেশে দেশে তা পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সিস্টেমের যাঁরা বিরোধিতা বা সমালোচনা করছেন বা এর অসারতা প্রমাণ করতে লেগেপড়ে আছেন, তাঁরা কেন আরো উন্নত কোন সহজ সিস্টেম দাঁড় করিয়ে ড. ইউনূসকে অবসরে পাঠাচ্ছেন না ? প্রকৃত ধাপ্পাবাজ আসলে কারা ?

০৫)
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা তো দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন। এই কাল্পনিক নগর রাষ্ট্রের বাস্তবতা কতটুকু ? আদৌ কি তা বাস্তবায়নযোগ্য ? তাই বলে কেউ কি প্লেটোকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ? সময়ের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সমস্ত তত্ত্বই আপ-ডেট হতে হতে পুরনো তত্ত্ব বাতিল হয়ে নতুন তত্ত্ব এসে জায়গা করে নেয়। কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে পুরনো তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও ভুলগুলো চিহ্ণিত হয়ে সংশোধিত হতে থাকে। তা না করে ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই’ হয়ে আমরা যারা মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে গালাগাল করে নিজেদেরকে রহস্যময়ভাবে জাহির করছি, তারা কি আসলে কে কত তীব্র ও আখাট্টা ভাষায় গাল দিতে পারি এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিজেদের ব্যক্তি ও সামাজিক রুচিবোধের নিম্নগামীতা প্রকাশ করতেই গৌরববোধ করছি ?
০৬)
গ্রামীণ ব্যাংক হচ্ছে একটা সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর লাভালাভের দাবীদার প্রতিষ্ঠানটির ৭০ লক্ষ ভূমিহীন ঋণগ্রহীতা শেয়ার হোল্ডার মালিক সদস্য ও অন্যতম শেয়ার হোল্ডার বাংলাদেশ সরকার (৮৫ ঃ ১৫)। ভূমিহীন ঋণগ্রহীতা সদস্য ও সরকারের মালিকানা শেয়ারের অনুপাতের সর্বশেষ তথ্যে কিছুটা পরিবর্তন থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় যাঁর ন্যুনতম কোন শেয়ারও নেই, সেই ড. ইউনূসকে যখন আমাদের বিজ্ঞ ও জ্ঞানী(!) রাজনীতিকরা বিদ্বেষ ছড়ানো ‘সুদখোর কাবুলিওয়ালা’ বলে লোকদেখানো ঘৃণ্য ভাষায় সম্বোধন করে থাকেন, এবং এই সম্বোধন শুনে আমরা যখন প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ পাবার যোগ্যতাহীন ৭০ লক্ষ বা আরো অনেক বেশি পরিবারের সম্ভাব্য অসহায়ত্বের কথা ভুলে গিয়ে কুম্ভিরাশ্রু ছাড়তে ছাড়তে উদ্বাহু নৃত্যে নাচতে থাকি, তখন সেই আপ্ত-উক্তিটা মনে পড়ে যায়- ‘মূর্খের দেশে পণ্ডিত না হয়ে আমি জ্ঞানীর দেশে মূর্খ হয়ে জন্মাতে চাই।’ কে যেন করেছিলেন উক্তিটা।
তবে হাঁ, প্রফেসর ইউনূসের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি তো কিছু আছেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় সব সেরা ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের সাথে যতটুকু জানি বেশ ভালো অর্থমূল্যও রয়েছে। আশিরও অধিক এরকম পুরস্কার যাঁর থলেতে এবং যতটুকু বুঝি ভালো সম্মানীর বিনিময়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো প্রফেসর ইউনূসের আর্থিক সচ্ছলতা যদি তাঁর মেধা, সৃজনশীলতা ও যোগ্যতার বিনিময়ে অর্জিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার এই বৈধ আয় নিয়ে আমাদের গাত্রদাহ হবার রহস্য বা কারণ কী হতে পারে ?

০৭)
‘চিলে কান নিলো রে’ শুনেই আমরা কি হুজুগে দৌঁড়াতেই থাকবো, না কি নিজেদের সেন্স ও যুক্তিবোধ প্রয়োগ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকৃত রহস্যটা খোঁজার চেষ্টা করবো ?

ব্যক্তির ব্যবহৃত ভাষাই তাঁর ব্যক্তিত্বের আয়না। নিজের সন্তানকে পাশে রেখে কুৎসীৎতম যে শব্দটা পর্যন্ত আমরা উচ্চারণ করতে পারি, সেটাই আমাদের প্রকাশিত ব্যক্তিরুচির লোয়ার লেভেল হওয়ার কথা ছিলো। তাই যাঁরা কেবল যুক্তিহীন গালাগালি করে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতে চান তাঁদের শালিনতা ও রুচিবোধ নিয়ে আমার কোন কথা নেই। তবে যাঁরা যুক্তিবোধ সম্পন্ন এবং প্রকৃত তথ্য ও রহস্য খুঁজে পেতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য উপরোক্ত প্রশ্নগুলো আপাতত উত্থাপন করা হলো। এগুলোর জুৎসই উত্তর পাওয়া গেলেই সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক আরো কিছু অনিবার্য প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করি।

ব্যক্তিগত কৌতুহল ও নিরন্তর প্রশ্নমুখীনতাই আমাকে এ পোস্ট তৈরি করতে সহায়তা করেছে। আমি বিশ্বাস করি, প্রশ্নের সারি যত দীর্ঘ হয়, উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে রহস্য উন্মোচনের সম্ভাবনাও তত নিকটবর্তী হতে থাকে। আসুন না, অহেতুক হুজুগে মেতে না উঠে আমরা আমাদের প্রশ্নের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে থাকি। কেউ না কেউ এর উত্তর দিতে এগিয়ে আসবেই।
...
[sachalayatan]
...

No comments: