| ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই !
রণদীপম বসু
সমস্যা হলো পেটে দানা না থাকলেও পাছা বা লজ্জা আমাদের ঢেকে রাখতেই হয়। আমাদের মান সম্মান ইজ্জত ওই পাছার মধ্যেই থাকে কিনা ! তাই ভেতরে সদরঘাট হলেও বাইরে ফিটফাট থাকতে পারতপক্ষে কসুর করি না আমরা। কিন্তু চাইলেই কি ফিটফাট থাকা যায় ? প্রয়োজনীয় খাবার না পেলে আধপেটা কিংবা উপোস চালিয়ে দেয়া গেলেও পাছা অর্ধেকটা কিংবা পুরোটা উন্মুক্ত রাখার কায়দা কি আছে ? প্রকৃতির নিয়ম যে বড়ো উল্টো ! পাছা খোলা রাখো কিবা ঢেকে রাখো, প্রকৃতির কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু পেটে দানা না দিয়ে সইবে কতো ? প্রকৃতি সয় না তা। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির বশ না হয়ে উপায়ও থাকে না আমাদের। পাছা ঢাকো কি না ঢাকো, পেটের জোগাড় আগেভাগেই করে রাখতে হয়। পেট আর পাছার এই যে সমন্বয়, কারো কারো কাছে তা কোনো বিষয়ই নয়, যাদের আয় উপার্জনে লক্ষ্মীর বর রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া যাদের অনিবার্য ব্যয়ের সাথে আয়ের সংগতি পরিহাসের পর্যায়ে চলে যায়, তাদের পাছায় যে সত্যি সত্যি কাপড় থাকবে সে গ্যারান্টি কে দেবে ?
তবে আশ্বস্তের কথা হলো, এই লক্ষ্মীছাড়ারা কখনো ভদ্রলোক হয় না। তাই তাদের আবার লজ্জা-শরম একটু কমই থাকে। যেভাবে ভদ্রলোকদের লজ্জা থাকে বেশি। আর লজ্জা বেশি বলেই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েদের দেখে আমরা ভদ্রলোকেরা সাংঘাতিক লজ্জা পেয়ে বলে ওঠি- ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই ! একথা বলি বটে, কিন্তু আমরা যে নিজের পাছা ঢেকে রেখে অন্যের উদোম পাছা দেখে মনে মনে বড়োই আমোদ পাই, এর প্রমাণ আমাদের মাননীয় সচিব কমিটির সুপারিশকৃত এবারের অদ্ভুত পে-স্কেল।
সপ্তম জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য গঠিত সচিব কমিটির রিপোর্ট ২৭-০৭-২০০৯ তারিখ সোমবার নাকি মন্ত্রীসভায় পেশ করার কথা। মন্ত্রীসভার বৈঠকে সচিব কমিটির সুপারিশ অনুমোদন পেলে পয়লা জুলাই থেকে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করা হবে। কথা থাকলেও তা পেশ করা হয়েছে কিনা এখন পর্যন্ত তা জানা যাচ্ছে না। লেখাটা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত সরকারি কোন ঘোষণাও আমরা পাইনি। তবে পত্র-পত্রিকা থেকে জানতে পারি এবারের পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশে গ্রেড ভিত্তিক বেতন বৃদ্ধির শতকরা হার নাকি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দিচ্ছে। অর্থাৎ এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এবার বেতন বাড়বে সবচেয়ে বেশি। ছা-পোষা চাকুরে হিসেবে আমাদের কাছে বড়ই প্রীত হবার মতো খবর বৈ কি। কিন্তু যে রাষ্ট্র দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়নের রেকর্ড গড়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, সেখানে রেকর্ডের কথা শুনলে পিলেটা তো চমকে ওঠেই, কৌতুহলও বেড়ে যায়। অথচ এমন রেকর্ড সৃষ্টিকারী হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও যথাসময়ে যথাস্থানে তা উপস্থাপন হলো না ! কেন ?
কী আছে এই বেতন স্কেলে ?
এই বেতন স্কেলে কী আছে না বলে বোধয় বলা উচিত ছিলো কী নেই এখানে ? তা জানতে হলে নিচের সচিব কমিটির সুপারিশকৃত বেতন-চার্টটা একটু দেখে নেয়া প্রয়োজন।
গ্রেড নং- বর্তমান মূল বেতন- প্রস্তাবিত মূল বেতন- বৃদ্ধির পরিমাণ- বৃদ্ধির হার
১------ ২৩,০০০/- ----- ৪০,০০০/- ------- ১৭,০০০/- -- ৭৪%
২------ ১৯,০০০/- ----- ৩৩,৫০০/- ------- ১৪,২০০/- -- ৭৪%
৩------ ১৬,৮০০/- ----- ২৯,০০০/- ------- ১২,২০০/- -- ৭৩%
৪------ ১৫,০০০/- ----- ২৫,৭৫০/- -------- ১০,৭৫০/- -- ৭২%
৫------ ১৩,৭৫০/- ----- ২২,২৫০/- ------- ৮,৫০০/- --- ৬২%
৬------ ১১,০০০/- ----- ১৮,৫০০/- ------- ৭,৫০০/- --- ৬৮%
৭------ ৯,০০০/- ------ ১৫,০০০/- ------- ৬,০০০/- --- ৬৭%
৮------ ৭,৪০০/- ------ ১২,০০০/- ------- ৪,৬০০/- --- ৬২%
৯------ ৬,৮০০/- ------ ১১,০০০/- ------- ৪,২০০/- --- ৬২%
১০----- ৫,১০০/- ------ ৮,০০০/- -------- ২,৯০০/- --- ৫৬%
১১----- ৪,১০০/- ------ ৬,৪০০/- --------- ২,৩০০/- --- ৫৬%
১২----- ৩,৭০০/- ------ ৫,৯০০/- --------- ২,২০০/- --- ৫৯%
১৩----- ৩,৫০০/- ------ ৫,৫০০/- --------- ২,০০০/- --- ৫৭%
১৪----- ৩,৩০০/- ------ ৫,২০০/- --------- ১,৯০০/- --- ৫৭%
১৫----- ৩,১০০/- ------ ৪,৯০০/- --------- ১,৮০০/- --- ৫৮%
১৬----- ৩,০০০/- ------ ৪,৭০০/- --------- ১,৭০০/- --- ৫৭%
১৭----- ২,৮৫০/- ------ ৪,৫০০/- --------- ১,৬৫০/- --- ৫৮%
১৮----- ২,৬০০/- ------ ৪,৪০০/- --------- ১,৮০০/- --- ৬৯%
১৯----- ২,৫০০/- ------ ৪,২৫০/- --------- ১,৭৫০/- ---- ৭০%
২০----- ২,৪০০/- ------ ৪,১০০/- --------- ১,৭০০/- ---- ৭০%
এখানে যে বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমান বেতন স্কেলের সাথে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষিত অতিরিক্ত ২০% মহার্ঘ ভাতাটি কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো কার্য়করের সাথে সাথে বাতিল হয়ে যাবে। রেকর্ড ভঙ্গকারী এই বেতন তালিকার সাপেক্ষে বর্তমানে ৫০% থেকে ৭০% জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হারের কথা নাই আনলাম। তা বিশ্লেষণ করার জন্য দেশে বহু অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। সেক্ষেত্রে ৪ সদস্যের একটা পরিবারের ব্যয় বিবেচনা করে প্রস্তাবিত এই বেতন কাঠামো দিয়ে ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কী করে একটা পরিবার চালাতে পারেন তা পাঠকরাই বিশ্লেষণ করুন। আমার বক্তব্য ভিন্ন, এই সুপারিশের নৈতিকতা নিয়ে।
পাঠক হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রথম চারটি গ্রেডের কর্মকর্তারা বাড়ি গাড়ি টেলিফোন ইত্যাদি ইত্যাদি সকল রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে থাকেন। অথচ তাঁদের জন্যই বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭৪%। যাঁরা এই বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন সেই মহামান্য সচিবরা নিজেদের জন্য বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ও হার সর্বোচ্চ রেখে গাছের আগা ও মাঝখানটা নিজেদের ভাগে নিতে কার্পণ্য করেননি একটুও। কেননা তাঁরা যে অতি উচ্চ দরের ভদ্রলোক। ভদ্রলোকদের লজ্জা-শরম তো একটু বেশিই থাকে। আর এই বেশি পরিমাণের লাজলজ্জা ঢাকতে সবকিছুই তো বেশি বেশি লাগার কথা ! অন্যদিকে সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে গাছের গোঁড়াটুকু থাকবে নিচের স্তরের সেইসব কর্মচারীদের ভাগে, যাদের লাজ লজ্জা আবার এমনিতেই কম। অতএব তাদের পাছা উদোম থাকলেও সমস্যার তো কিছু নেই !
নৈতিকতা শব্দটি মনে হয় একটা বিমূর্ত ধারণা মাত্র। নইলে নৈতিকতাবোধের কতোটা অবনমন ঘটলে এরকম একটা বেতন-স্কেলের সুপারিশ করেন আমাদের মহামান্য সচিবরা, ভাবলেই অবাক হতে হয় ! তাঁদেরকে কি এই তালিকার ডান পাশের বেতন বৃদ্ধির হারের কলামটা কোন সংবেদনাই জাগাতে পারে নি ! পেটের কথা ভাবতে গেলে যাদের পাছা ঢাকার কাপড় থাকে না, সেই সব কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির হার ৫৬-৫৭% নির্ধারণ করতে একটুও লজ্জা হয় নি কর্ম ও সেবার মাহাত্ম্য বর্ণনাকারী এই সচিব মহোদয়দের ! নিজেরা এতো সুবিধা পাওয়ার পরও নিজেদের বেতন বৃদ্ধির হার কিছুটা কম রেখে নিচের দিকে পর্যাক্রমে একটু একটু হার বাড়িয়ে দেবার মুরব্বি-সুলভ উদারতা দেখাতে নাইবা পারলেন তাঁরা। অন্তত বৃদ্ধির হার সবার জন্য ৭৪% এক ও অভিন্ন রাখলেও কি তাঁদের ভাগে প্রাপ্তির পরিমাণ কোন অংশে কম পড়তো ? অন্তত চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা থাকে ! রাষ্ট্র কতো হাজার হাজার কোটি টাকা কতো খাতে খরচ করে। কিন্তু বিশাল কর্মী বাহিনী যারা সরকারের সব কর্মসূচি-কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের দেহ যৌবন খরচ করে ফেলে, তাদের জন্য রাষ্ট্র কি এতোটাই অনুদার ! রবীন্দ্রনাথ হয়তো এজন্যেই আক্ষেপ করেছিলেন- রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি !
অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা হয়তো বলতে পারবেন নতুন এই বেতন কাঠামো কার্যকর হলে সেই সব পাছা-খোলা কর্মচারীদের প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি কতো হবে, কিংবা ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার বেশি হবে কিনা। অথবা ১০ম গ্রেডের নমুনা উদাহরণ টেনে হিসেব কষে বের করবেন, নতুন বেতন কাঠামোয় বেতন বৃদ্ধির বদলে বেতন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কাটা সত্যিই অমূলক কিনা। অথচ নতুন স্কেলে লক্ষ্মীর আশির্বাদপ্রাপ্ত সেইসব কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সাথে মেইনটেন্যান্স খরচ তো রাষ্ট্রই দেবে। এবং তার পরিমাণও সম্ভবত মাসে ৩৫,০০০ টাকা। দয়ার শরীর তাঁদের। তাই হয়তো কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে তাঁরা যাতায়াত ভাতার প্রস্তাব করে ফেলেছেন মাসিক ১৫০ টাকা।
রাষ্ট্রের বর্তমান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন কে জানে। ভিশন ২০২১ কে প্রকৃতই সফল ও কার্যকর করে তুলতে এর প্রস্তুতি দৌঁড়ে জাতীয় বেতন স্কেলের কোন গুরুত্ব তাঁরা আদৌ অনুধাবন করেন কিনা সে প্রশ্নটা উহ্যই থাক। সরকারের দায়িত্ববান মন্ত্রী-এমপিদের কথাও কী আর বলবো ! দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁরা যদি এই বিশেষ জ্ঞানটুকু রপ্ত করে ফেলেন যে, কেবল শীর্ষলেভেলে যত্ন-আত্তি করে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান হাতি পুষলেই সরকার ব্যবস্থা চেলচেলাইয়া চলতে থাকে, তাঁদের সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁদেরই থাকুক। মূর্খ আমরা অনভিজ্ঞ বিবেচনা দিয়ে ভাবি, সচিব কমিটির প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত যখন ১ ঃ ১০ হয়ে যায়, নিশ্চয়ই তাঁদের খাওয়া পরা চলা সবই দশগুণ বেশিই হবে। এমনকি তাঁদের লজ্জাটাও নিশ্চয়ই দশগুণ বড়ই। এবং তা ঢাকার আয়োজনও দশগুণ বেশিই হতে হবে।
কিন্তু দুর্মুখেরাও যে তা দশগুণ ভিন্ন চোখেই দেখবে ! যে লজ্জা ঢাকতে দশগুণ বেশি আয়োজন করতে হয়, সে লজ্জা কি আদৌ ঢাকা পড়ে ? না কি লজ্জাটা অত্যন্ত লজ্জাকরভাবেই দশগুণ বেগে চিহ্ণিত হয়ে যায়, এর জবাব কে দেবে ? কাউকে কি দোষ দেয়া যাবে, সচিব মহোদয়দের এমন নির্লজ্জ আয়োজন দেখে যদি সত্যি সত্যি জানতে চায় কেউ- ওই ছেমড়ি তোর পাছায় কাপড় কই ?
...[sachalayatan]
...
No comments:
Post a Comment