একটি ফকির প্রজন্ম ও এক টাকা ছাড় !
রণদীপম বসু
গরীবের বউ...
ফকিরের ঘরে ফকির জন্মাবে ধনীর ঘরে ধনী, এটা খুবই প্রাথমিক ও প্রকৃতিগত সত্য কথা। কেননা জন্মমাত্র ফকির পরিবারের সদস্য হিসেবে সে তো ফকিরই হবে। এর অন্যথা হবার কোন কারণ দেখি না। তেমনি ধনীর দুলালের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনুরূপই হয়। তবে জন্ম-পরবর্তী সে কি ফকিরই থাকবে, না কি থাকবে না, কিংবা ধনীর দুলাল কি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদে আজীবন সম্পদশালী থাকবে, না কি নিঃস্ব হয়ে যাবে তা নির্ভর করবে তার পরবর্তী জীবনের কর্মকৃতি বা কৃতকর্মের উপর। নিজ যোগ্যতা, শ্রম, স্বপ্ন ও দুর্নিবার ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে জন্মফকির যে কৃতি সম্পদশালী হয়ে উঠতে পারবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা কি কোথাও নাজেল হয়েছে ? হয নি। তাই এর নজির যেমন রয়েছে অনেক, তেমনি চুরি-চামারি-ছিনতাই-রাহাজানি-ডাকাতি-প্রতারণা ইত্যাদি অবৈধ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় কাড়ি কাড়ি অর্থসম্পত্তির মালিক বনে যাওয়ার নমুনারও অভাব নেই, বরং একটু বেশিই আছে। আবার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রচুর অর্থসম্পদশালী হয়েও দূরদৃষ্টিহীন অথর্বতা অযোগ্যতা বা অমিতব্যয়ী অবিমৃষ্যকারিতা ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে ফকির হয়ে যাবার ইতিহাসও কম নেই। এজন্যেই হয়তো বিবেকের-কবি গেয়ে উঠেন- ‘আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়...।’ এই যে চিরদিন কারো সমান যায় না, এর মাজেজাও হয়তো অনেক।
আজ যে ফকির, সে হয়তো কাল রাজা হতেও পারে বা উল্টোটাও সম্ভব। এ হচ্ছে দৃশ্যমান ফকিরত্বের কথা। কিন্তু যে ফকিরত্ব মনের গভীরে বা ব্যক্তিসত্ত্বার মর্মমূলে ঘাঁটি গেড়ে থাকে, তা কি সহজে অপসারণযোগ্য হয় ? মনে হয় না। ফকিরত্বের সৃষ্ট হিনমন্যতাবোধ বড় কঠিন। অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মতো বিস্তৃত শিকড় ছড়িয়ে ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠি বা জাতিকে আক্রান্ত করে ফেলে নির্মমভাবে, তা দূর করা দুঃসাধ্য বৈ কি। সময়ান্তরে যে ফকির সত্ত্বা রাজকীয় সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে, বাইরের ঠমক রাজকীয় হলে কী হবে, ভেতরে যে ফকির সে ফকিরই থেকে যায় ! এর প্রভাব বলয় এতোটাই সুদৃঢ় ও শক্তগ্রন্থিত যে, প্রতিটা কাজে-কর্মে আচারে-বিচারে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষেই হোক তা প্রকাশিত হতেই থাকে। আগ্রহ বা প্রতিজ্ঞা অনমনীয় না হলে এই ইচ্ছা নিরপেক্ষ প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করা খুব সহজ কথা নয়।
মানুষ নিজে নিজে তো আর নিজের চেহারা দেখতে পায় না। এ জন্যে দরকার হয় কোন আয়না বা প্রতিফলকের। সাহিত্য বা সংস্কৃতিই হচ্ছে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা জাতির সবচাইতে বিশ্বস্ত আয়না বা প্রতিফলক। জানতে বা অজান্তে আমাদের জীবনাচারের অবিকৃত প্রতিফলনটা সেখানেই ভেসে ওঠে। এর কল্যাণে নিজেদেরকে যেমন আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি, তেমনি অন্যেরাও আমাদেরকে দেখতে পায় ঠিকই। সব জাতিগোষ্ঠির জন্যই তা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই খুব সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে, জীবনাচারে আমাদের প্রকৃত প্রতিফলনটা আসলে কেমন ? এক্ষেত্রে মিডিয়ায় প্রতিফলিত সাম্প্রতিক কিছু ঝোঁক বা হুজুগের বিশ্লেষণ করলে আমাদের মনোজগতের ভূমিটাও কিঞ্চিৎ খনন করা হয়ে যাবে বলে মনে হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষকদের জন্য প্রচুর মশলা-উপাত্ত রয়ে গেছে হয়তো। কিন্তু আমি তো আর গবেষক নই, আকস্মিক বোধাক্রান্ত নিরীহ নাগরিক মাত্র। তাৎক্ষণিক প্রণোদনাই উপজীব্য যেখানে।
...সবার ভাবী
নানাবিধ কারণে ইদানিং খুব একটা টিভি দেখা হয় না। তবে পারিবারিক আবহে থাকায় টিভির দৈনন্দিন খোঁজ-খবরটা ঠিকই কানে চলে আসে। এই কিছুকাল আগেও একটা বিজ্ঞাপনচিত্র দেখতাম, খুব সম্ভবত সাবানের। একটা প্রাইভেট কার এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কশলো একটা শপিং মলের সামনে। ভেতর থেকে পুরুষ ও রমণীটি বেরিয়েই রীতিমতো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো শপিং মলের দিকে। ব্যাপার কী ! খুব সাংঘাতিক ব্যাপার ! নয় টাকা না কি চৌদ্দ টাকা দামের সাবানের প্যাকেটে এখন এক টাকা ছাড় ! কি জানি স্টক ফুরিয়ে যায়, তাই হন্তদন্ত হয়ে সেদিকেই ছুটছে ওরা।
বিজ্ঞাপনচিত্রটি দেখে প্রথম প্রথম ছাগলামিপনা ভেবে হাসতাম। প্রাইভেট কার পোষার সামর্থ রয়েছে যে ব্যক্তি বা পরিবারের, সে কিনা স্বল্পমূল্যের দৈনন্দিন ব্যবহারোপকরণে একটাকা ছাড় ঘোষণায় এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ! নিশ্চয়ই এটা বিশাল কোনো ব্যবসায়িক টেন্ডার বা এলসি খোলাজনিত কোন বিষয় নয়। বিজ্ঞাপন নির্মাতার মাথায় গোবরের আধিক্য যে একটু বেশিই ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ করে মাথায় এলো সেই বিষয়টা ! গোবড়ের পরিমাণ তো নির্মাতার মাথায় নয়, আমার মাথাতেই হয়তো বেশি ছিলো। নইলে সাথে সাথে মাথায় এলো না কেন যে, উঠতি বড়লোক হলে কী হবে, এ যে আমাদের জিনে করে বয়ে আনা সেই ফকিরি মানসিকতা ! অবচেতন সত্ত্বায় গেঁথে থাকা সেই ভিক্ষাবৃত্তিক মনেবৃত্তির আদি ধারা ! এ থেকে এতো সহজে রেহাই কই আমাদের ! অথচ এরাই আমাদের জাতি বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী মুখ। যা মুহূর্তেই মিডিয়া প্রচারে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বিজ্ঞাপনটি এখনো অন এয়ারে আছে কিনা জানি না। তবে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এরকম কাসুন্দির যে অভাব হবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই ঢাকা শহরে এরকম ফ্রি-এর ট্যাগ লাগানো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের কি অভাব আছে ! বাজার করতে কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকুন, ঘোষণা শুনবেন, দেড়হাজার টাকার বাজার করলে একটি সুদৃশ্য বাটি ফ্রি, দু’হাজার বা আড়াই-হাজার টাকার মালামাল কিনলে এক কেজি চিনি ফ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্রেতা কিন্তু আমাদের সমাজের উপরের দিকের উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই। যাঁরা দেড় হাজার বা দু’হাজার টাকার খরচের বিষয়টা বেমালুম ভুলে গিয়ে তিরিশ টাকা দামের একটা বাটি বা চল্লিশ টাকা মূল্যের এক কেজি চিনি ফ্রি পাবার প্রলোভনে সহজেই আকৃষ্ট হয়ে যায় ! যদি তা-ই না হতো তাহলে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এরকম আপত্তিকর ফ্রি-র মূলো নাকের আগায় ঝুলিয়ে দেবার দুঃসাহস দেখাতো না। যারা এই কাজটা করছে, এরা তো আমাদেরই ভাই-বেরাদর ! আমাদের আদি স্বভাবের হিরন্ময় অংশীদার তো এরাও !
যে সমাজের উপরের স্তরের মানসিকতার এই হাল, সেখানে গোটা জনগোষ্ঠির ছবি যে আরো মর্মান্তিক হবে তা খুব সহজ সূত্রেই বুঝা যায়। তাহলে কি জাতিগতভাবেই আমরা মানসিকতায় ফকির প্রজন্ম ? অস্বীকার করি কী করে ? আমরা নিজেরাই যদি এই হীনমন্যতাবোধের লালন-পালন ও চর্চা করার আত্মপ্রসাদকে অপমানজনক না ভাবি, অন্যেরা কেন ভাববে ? বরং আমাদের এই মনেবৃত্তিকে পুঁজি করে ফায়দা লুটার ধান্দায় থাকবে। এর প্রমাণ তো এখন হাতেনাতেই পাচ্ছি আমরা। যে অফারটা এখন আমাদের গোটা জনগোষ্ঠিকে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-চিন্তায়-চেতনায় দারুণভাবে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে, তা হলো বিভিন্ন ফোন-কোম্পানি বা অপারেটরদের দেয়া এক অদ্ভুত টক-টাইম সুবিধা। যা মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই আপত্তিকর ও অসৌজন্যমূলক বলেই মনে হয়। কথায় বলে, গরীবের বউ নাকি সবার ভাবী। কথাটা কেন বলা হয় সেটাও বুঝি না। সম্পর্কে ভাবী হলেই কি তাঁর সাথে যা ইচ্ছে তা-ই করা সম্ভব ! জানি না। তবে ফোন-কোম্পানিগুলো যে আমাদের জাতিগত ফকিরি মানসিকতাকে পুঁজি করে আমাদেরকে যেমন খুশি নাচিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তা যে গুঢ়ার্থে জাতিগত ধারাটিকে বিদ্রূপ করার নামান্তর, এটা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি ঠিক জানি না, বিশ্বের আর কোনো দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে মোবাইল ফোনে টক-টাইমের নামে এমন আপত্তিকর ও বিচিত্র কীর্ত্তণ আদৌ আছে কি না। এই সময় থেকে ওই সময় পর্যন্ত এতো পয়সা প্রতি মিনিট, ওই সময় থেকে এই সময়তক এতো টাকা এতো পয়সায় যতক্ষণ খুশি আলাপের সুবিধা, কিংবা এতোটি ফ্যামেলি নম্বরে এতো পয়সা প্রতি মিনিটে চব্বিশ ঘণ্টা কথা বলার সুবিধা বা পুরনো বন্ধ সিমটি চালু করলে এতো ঘণ্টা টক-টাইম ফ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নর্তকীপনা করানোর উদ্দেশ্য তো একটাই, আরো বেশি ব্যবসা, আরো অধিক মুনাফা। খুবই সত্য কথা যে, ব্যবসার সাথে মুনাফার বিষয় জড়িত থাকবেই। কিন্তু দুঃখ হয়, সেবার মানোন্নয়ন নয়, বরং আমাদের জাতিগত ভিক্ষাবৃত্তিক মানসিকতার ট্রেন্ডটাকে পুঁজি বিনিয়োগকারী বিদেশীরা জায়গামতো ধরে ফেলেছে ঠিকই, এবং তা নিয়ে ব্যবসার নামে রুচিহীন কটাক্ষ করতেও তাদের বাধছে না। অথচ আমাদের কাছে তা কিছুতেই মানহানিকর বা আপত্তিকর বলে মনে হচ্ছে না বা হয় না। আমাদের সরকারগুলোর পুরু চামড়ায়ও এরকম বিষয় যে কোন সংবেদন তৈরি করে না বা করছে না, এতে আর আশ্চর্য়ের কী ! সরকার মানে তো হাওয়াই কিছু নয়, আমাদেরই কিছু সংখ্যক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা জাতিগতভাবে আমাদের সেই জেনেটিক ধারাই তো বহন করবে। নইলে ফোন-কোম্পনিগুলোর কানে ধরে বাধ্য করা উচিৎ ছিলো- দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমন সাত-রকমের টকিং-রেট না রেখে একটাই রেট রাখা, কম বা বেশি যাই হোক, অবশ্যই যৌক্তিক মাত্রায়। তা-ই সম্মানজনক হতো।
তা আর হচ্ছে কই ! এ বিষয়গুলোকে যারা সর্বোত্তম প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতন করে তোলার কথা ছিলো, আমাদের সেই সব ফুটানিধারী প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমগুলোর কথা কী আর বলবো ! মাপে ও মানে ওই সব সর্বোচ্চ বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলোর কাছে সবার আগেই এরা এমনভাবে নিজেদেরকে বিকিয়ে বসে আছে যে, আত্মসার্থ ক্ষুণ্ন করে এমন কোন জনসচেতনমূলক উদ্যোগ তারা নেবে এটা ভাবাই তো নির্বুদ্ধিতা !
...
[sachalayatan]
No comments:
Post a Comment