বাটা'র জুতো, পায়ে না বগলে শোভা পায় ভালো ?
রণদীপম বসু
[প্রথমেই বলে রাখি, এটা কোন জুতো প্রদর্শনের পোস্ট নয়। চলমান কিছু বাস্তবতা নিয়ে নাড়াচাড়া কেবল। তাই দয়া করে কেউ ভুল বুঝবেন না।]
বগলে জুতো মাথায় ছাতা, বাঙাল জনপদে এটা মোটেও কোন অপরিচিত দৃশ্য নয়। সেই ছোটবেলা থেকে তা এতো দেখে আসছি যে, মনে হয় জুতো পায়ে নয়, বরং বগলতলাতেই মানানসই বেশি। পায়ে পরার জুতো কেন পা ছেড়ে বগলতলায় উঠে যায় তা নিয়ে গবেষণার খুব একটা প্রযোজন হয়তো নেই। পা থেকে জুতো মহার্ঘ হয়ে গেলে বা পায়ের চেয়ে জুতোর নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পেলে এমনটা ঘটতে পারে। তবে পা থেকে কেন জুতো মহার্ঘ হবে বা অধিক নিরাপত্তা দাবী করবে সেটা হয়তো গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে গবেষণা কেউ যে করছে না, তাই বা বলি কী করে। বিশেষ করে জুতো নিয়ে যাদের কায়কারবার তেমন বড় বড় কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে দেশে তাদের পুঁজির বিস্তার ঘটাবে সেখানকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠির পা ও জুতোর সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহ দেখাবে এটাই তো স্বাভাবিক। নইলে তাদের ব্যবসার শনৈ শনৈ উন্নতির চাবির খোঁজ পাবে কী করে !
জুতোর ব্যবহার কেবল পায়েই নয়, বাঙালি সমাজে এর ব্যবহারে প্রচুর বৈচিত্র্য রয়েছে। বাংলায় জুতো-মারা, জুতো-পেটা, জুতো-দান, জুতো-নিক্ষেপ, জুতোর-মালা জাতীয় এরকম শব্দ-বন্ধই এর নিদর্শন। বাঙালি ছাড়া অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠিতে জুতোর এমন বিচিত্র ব্যবহার কতোটা প্রচল তা জানা নেই। তবে আজকাল এর পসারের কিছুটা ইঙ্গিত পাই ইরাকি সাংবাদিক জায়েদি কর্তৃক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারার মধ্য দিয়ে। বাঙাল মুল্লুকের এই বহুমাত্রিক সংস্কৃতি দেশ-কালের সীমানা ডিঙিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য শ্লাঘার বিষয় বৈ কি। এই জুতো দেখেই ব্যবহারকারীর পদ-পদবী-শ্রেণী-অবস্থান সম্পর্কেও নাকি কিছু কিছু আঁচ করা যায়। তাই পোশাকে-আশাকে যতোটা না, জুতো কেনার ক্ষেত্রে অনেকেরই খুঁতখুতিটা একটু বেশিই দেখা যায়। আর নির্দিষ্ট ও সীমিত আয়ের চাকুরেদের ক্ষেত্রে আরো বড় সমস্যা হলো মাথা থেকে নামতে নামতে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা মিটিয়ে শেষপর্যন্ত পায়ের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের এতো ফুটানি, সেই পা’কে বঞ্চিত করা হয়তো কারো উদ্দেশ্য নয়, আর্থিক অনটন বা অক্ষমতাই মূল কারণ। এক জোড়া জুতোই তো কেবল গোটা সংসার বা পরিবার নয়, অপূর্ণ হাজারো চাহিদার বেদনাময় চলমানতা নিয়েই খুঁড়িয়ে চলা অভাবী জীবন-যাপন। তাই একান্ত জুতো-বিলাসী না হলে নিম্ন-মধ্য আয়ের চাকুরের একাধিক পোশাক সেট থাকা বাধ্যগত হলেও ভদ্র-অবস্থান নিরূপণকারী এক জোড়ার বেশি জুতো রাখা অধিকাংশেরই ক্ষমতায় কুলোয় না। আর ক্ষমতাই যেহেতু এক জোড়া, তাই সাশ্রয়ী সীমার মধ্যে যতোটা সম্ভব রুচিসম্মত ও টেকসই জুতো-জোড়াটাই খুঁজে নিতে হয় তাঁদের। এবং সমস্যাটা সেখানেই।
জুতো নিয়ে এইসব মামুলি চাকুরেদের বড় সমস্যাটা হয বর্ষায়। জুতোও পরতে হবে, আবার নর্দমার ড্রেন হয়ে ওঠা রাস্তায়ও চলতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকা নগরীর বর্ষার কথা বলতে যাওয়ার চেয়ে কিছুক্ষণ হাউমাউ করে কেঁদে নেয়াই অনেক বেশি স্বস্তিকর। চাকুরিগত অবস্থান অনুযায়ী বর্ষায় ভেসে বেড়ানোর মতো জলচর জুতোর খোঁজে সেদিন ঢুঁ মারতে লাগলাম দোকান থেকে দোকানে, পছন্দসই একজোড়া স্যান্ডেল আর খুঁজে পাচ্ছি না। প্লাস্টিকের তৈরি যা পাচ্ছি, তার দাম কড়া হলেও, চেহারা ও মান দেখে এতোই কুৎসিৎ ও নিম্নস্তরের লাগছে যে, অফিস করা দূরের কথা, পোশাক ছেড়ে নেংটা হয়ে হাঁটাই বোধকরি ওগুলোর সাথে মানানসই বেশি হবে। (বলে রাখা ভালো, রুচিবোধ হচ্ছে আপেক্ষিক, কাউকে ছোট করার জন্য তা বলা হচ্ছে না, বরং তাৎক্ষণিক অনুভূতি ব্যক্ত করাটাই এখানে মূখ্য।) বড় কোম্পনী বাটা সু’তে বর্ষা উপযোগী প্লাস্টিকের স্যান্ডেল ও সু হিসেবে যেগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে তার দাম ফুটপাথের দোকানগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ হলেও তার চেহারা দেখে নিজের গালেই নিজের চড় খেতে ইচ্ছে করে। সেই ঠাকুরদাদার আমলে তাদের জন্য যে মডেলগুলো তৈরি করা হয়েছিলো, তা থেকে এই বাঙালদের রুচি ও প্রযুক্তি যে আর এক কদমও এগিয়েছে, বাটা কোম্পানি তা বিশ্বাস করে কিনা জানি না, তাদের এসব পণ্য অন্তত সেই প্রমাণ দেয় না। হৈতকাইল্যা আমলের ভেলামার্কা মডেলগুলো শোপিস হিসেবে ঝুলিয়ে রাখতে তাদের একটুও বাঁধে না। তাদের বাঁধবে কেন ! হায়া-শরম থাকলে আমিই বা সব ঘুরে ব্যর্থ হয়ে ওখানে ফের যাবো কেন ? আমার অভিরুচি জানতে পেরে দায়িত্বরত সেলসম্যান একজোড়া জুতো হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো- এগুলো নেন। দাম ? নয়শ’ টাকা। লাফ দিয়ে উঠলাম দাম শুনে ! বলে কী ! পাঁচ-ছ’শ টাকার চামড়ার স্যান্ডেল পরে রীতিমতো স্থলে বিচরণ করছি, আর জলে চরার জন্য নয়শ’ টাকা ! আমাকে আশ্বস্ত করে জানালো- এগুলো মটর স্যান্ডেল, শুকনায় বর্ষায় রোদে বৃষ্টিতে সব জায়গাতেই সমানতালে চলবে। অর্থাৎ উভচর ! আরো জানালো- অন্ধকারে পেছন থেকে হঠাৎ আলো পড়লে জুতোর বিশেষ বিশেষ জায়গা থেকে আলো ঠিকরাবে। এতো গুণ ! একটু বিলাসিতা হয়ে গেলেও গাইগুঁই করে নিয়েই নিলাম। শুকনা ও বর্ষা, উভয় মৌসুমে ব্যবহার করা গেলে দামটা না হয় একটু কড়াই হলো, রয়েসয়ে চালিয়ে দেয়া যাবে। লঙ্কাজয় করার ভাব নিয়ে জুতোর বাক্স বগলদাবা করে চলে এলাম। দিনটা ছিলো আটাশ জুলাই দুহাজার নয় তারিখ।
এবারের বর্ষা শেষপর্যন্ত আর জুত করে নামেনি। তবু তৃতীয় দিন থেকে অন্ধকারে পেছনের গাড়িকে চোখ রাঙানোর ফ্লুরোসেন্ট ফিতা জুতো থেকে আলগা হতে লাগলো। তা যাক, জুতো অন্তত এক বছর তো যাবেই, কোনোভাবে দুটো বছর কাটাতে পারলে টাকাটার একটা সদগতি হয়েছে ধরে নেবো। কিন্তু আমি কি জানতাম যে এ জুতো পায়ে দিয়ে নয়, বগলদাবা করে চলতে হয় ! বাটা কোম্পানির লোকেরাও তো আমাকে সেকথা বলেনি ! বাসা থেকে অফিস, হেঁটে আসলে পনেরো মিনিটের রাস্তা। ঘুমকাতুরে হিসেবে অধিকাংশ সময়ই অফিসটাইম ধরতে রিক্সায়ই যেতে হয়। অফিস শেষে হেঁটেই বাসায় ফেরায় আগ্রহী। তবু বৃষ্টি বা রাস্তায় পানি থাকলে তাও রিক্সায়। কিন্তু মাস না পেরোতেই জুতোর তলায় ধরণী দ্বিধা হতে লাগলো। দেড়মাসের মাথায় তলা দু’ভাগ। জুতোর এই তলাকে আবার পোশাকি ভাষায় নাকি সোল বলে। এটা ইংরেজি শব্দ। ইংরেজি ভাষায় জীবনের আত্মাকেও সোল বলে। হা হা হা ! বুকের কোণায় নয়শ’ টাকার চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করে বুঝলাম আমার মতো বাঙালির আত্মাটা জুতোর তলায়ই থাকে।
যেখান থেকে জুতো জোড়াটা কিনেছিলাম, মিরপুর এক-এর বাটা সু’র সেই শোরুমে গেলাম আবার। ক্যাশ-কাউন্টারে দায়িত্বরত মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের হাতে মানি-রিসিটটা ধরিয়ে জুতোটাও দেখালাম। জানতে চাইলাম- আপনাদের করণীয় কিছু কি আছে ? ভদ্রলোক হয়তো বাঁ-হাতিই হবেন, চেহারায় পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি জড়ো করে বাঁ হাতে রিসিটটা নিয়ে চোখ ও কপাল কুঞ্চিত করে নেড়েচেড়ে রিসিটটা পরখ করে অবদমিত তাচ্ছিল্যের সাথেই রিসিটটা ফিরিয়ে দিলেন বাঁ-হাতেই। অর্থাৎ পণ্য কেনার আগ পর্যন্ত আপনি সম্মানিত ক্রেতা, তারপরই আপনি ধুম পাবলিক। আমি চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। মাথাটাকে এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এখানে তাঁর কিছুই করার নেই।
...[sachalayatan]
No comments:
Post a Comment