Friday, October 30, 2009

| সৃজনশীল গাধা কিংবা বিনোদনের বিনোদন...|



| সৃজনশীল গাধা কিংবা বিনোদনের বিনোদন...|
রণদীপম বসু

...
আমাদের চারদিকে বিনোদনের এতো রকম উৎস ও উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে, 'বিনোদন নেই বিনোদন নেই' বলে যে হা-হুতাশ ছড়াই আমরা, তা কিন্তু বিনোদনের উৎসের অভাবে নয়, বিনোদন গ্রহণের অক্ষমতাই বলা যায়। বহু উৎস থেকেই মানুষ বিনোদন পেতে পারে। স্তর বা মাত্রা বা দেখার দৃষ্টি ভেদে এর ভিন্নতা হতে পারে। কেউ সিনেমা দেখে বিনোদন পায়, কেউ গান শুনে। কেউ মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে ঘোরাঘুরি করে, কেউ ঘরের নির্জন কোণে দিনভর প্রিয় বইগুলোর আশ্চর্য মোহময় জগতে ডুবে থেকে বিনোদন পায়। কেউ বিরতিহীন আড্ডা কিংবা তাস পেটানোর উল্লাসে বিনোদন খুঁজে, কেউ তার বিস্ময়কর সৃজনের একান্ত জগতে নিয়ত ভাঙচুর হতে হতে অনির্বচনীয় আনন্দ খুঁজে পায়। এরকম বহু একক কিংবা একাধিক উৎস থেকেই মানুষ তার নিজস্ব আনন্দটুকু নিংড়ে নিংড়ে বিনোদনের আয়োজন করে। ব্যক্তির রুচি, বোধ, উপলব্ধি, এগুলো বিনোদনের মাত্রা নিরূপনে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করে। তবে এখানে যে সব নমুনা-উৎস উল্লেখ করা হলো তা হচ্ছে লক্ষ্যবদ্ধ বিনোদন। অর্থাৎ তা থেকে বিনোদন পাবো এই সম্ভাব্যতা বুকে নিয়ে আমরা এসব উৎসে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আবার কিছু আছে ব্যতিক্রমী উৎস। চিরায়ত বৈচিত্র্যের এই ব্যতিক্রমী উৎসগুলো কিন্তু খুবই কৌতুহলোদ্দীপক এবং তা তাৎক্ষণিক অনুরণনে এক অনির্বচনীয় উপলব্ধির জন্ম দেয। আমাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ও চলমান জীবনযাত্রার মধ্যেই এই বিনোদনগুলোকে ধরতে পারি আমরা। ফাঁকেফুকে দেখার দৃষ্টিটাকে একটু তীক্ষ্ণ ও লক্ষ্যভেদী করে নিতে হয় কেবল।

ধরুন জনকোলাহল ডিঙিয়ে এসে ফুটপাথের কোন চায়ের দোকানের টুলটিতে বসে আনমনে হয়তো চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটাকে একটু তীক্ষ্ণ করুন। দেখুন না, কী এক মজার জগত আপনার চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়। প্রত্যেকটা মানুষের হাঁটা এবং হাঁটার স্টাইলটাকে খেয়াল করুন আর ভাবুন- ব্যক্তিত্ব মানুষের চেহারায় নয়, হাঁটার স্টাইলেই আঁকা থাকে। দৃষ্টিটাকে যতোটা সম্ভব সংবদ্ধ করে এবার মিলাতে থাকুন। অন্যরকম এক উপলব্ধিজাত আনন্দ তার সুক্ষ্ম বিনোদনকণা ছড়িয়ে আপনাকে রাঙিয়ে তুলবে।

অথবা ধরুন, আপনি কোন হোটেল বা রেস্তোরায় ঢুকলেন লাঞ্চ করতে। ছড়ানো ছিটানো অন্যান্য চেয়ার টেবিল জুড়ে আপনার মতো আরো অনেকেই হয়তো নিরিবিলি লাঞ্চ করছেন। খাবার খেতে খেতে আশেপাশে দৃষ্টিটাকে একটু তীক্ষ্ণ করে তুলুন। খুব ভালো করে প্রত্যেকটা লোকের খাবার ও খাবার গ্রহণ-পদ্ধতি এবং আনুষঙ্গিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো খেয়াল করুন। কে কিভাবে ভাত কচলাচ্ছেন বা মাখাচ্ছেন, কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে ভাতের গ্রাস বা লোকমাটা হাত দিয়ে মুখে পুরছেন, কিভাবে তা চিবানো হচ্ছে, মুখের বা মুখমণ্ডলের মাংসপেশীগুলোর সঞ্চালন ও তাতে করে ক্ষণে ক্ষণে চেহারার পরিবর্তনগুলো খেয়াল করুন এবং এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে সংশিষ্ট ব্যক্তির চাউনির ধরন বা দৃষ্টিবদ্ধতাটুকুও খুটিয়ে খুটিয়ে বিশ্লেষণ করতে থাকুন। দেখুন না, বিনোদনের কী বিস্ময়কর জগত আপনার সামনে খুলে যায় ! দেখার দৃষ্টি থাকলে এরকম কতো কিছু থেকেই আমরা জীবনের অনেক বোধ ও বিনোদন আহরণ করতে পারি।

কেউ কেউ ভাঁড়ামো করেও ব্যাপক আনন্দ পান। এই ভাঁড়ামো দেখে আবার অন্য অনেকে তা থেকে প্রচুর বিনোদন সংগ্রহ করেন। আবার এই ভাঁড়ামো থেকে অন্যদের আনন্দ কুড়ানোর উপায় বা প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেও কেউ কেউ বিনোদন পান বৈ কি। আসলে চারদিকে আমাদের কথায়-কাজে-আচারে-বিচারে এতো বেশি অসংগতি ও বৈকল্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যে, একটু গভীরভাবে দেখলে এগুলোর মধ্যে প্রচুর ভাঁড়ামোর উপাদান যেমন চোখে পড়বে, বিনোদন হিসেবেও তা কিন্তু ফেলনা নয়। আর চাইলে জীবনের নশ্বরতাটুকুও হয়তো তা থেকে খুঁজে পেতে পারেন। তবে বহতা নদীর মতো অবিরল ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো চলমান, অস্থির। এখন যা আছে, একটু পর সেটা আর থাকছে না। নতুন ঘটনা ঘটছে। নতুন কিছু হয়ে যাচ্ছে। নতুন আরেক বিনোদন বা এর উৎস সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। লেখালেখির জগতেও এসব উপাদানের কমতি নেই। এক্ষেত্রে বড় সুবিধাটা হলো, এগুলো লিখিত থাকে বলে অক্ষরগুলো সহজে ধুয়ে মুছে হারিয়ে যায় না। নমুনাগুলো দীর্ঘকাল থেকে যায়। তবে বহমান ঘটনা বা পলে পলে পাল্টে যাওয়া প্রেক্ষিতগুলোর বৈচিত্র্য বলেন আর মোহই বলেন, এর মাজেজাই আলাদা। না থাক প্রমাণপত্র কোনো, তাৎক্ষণিক বোধ, উপলব্ধি আর মুহূর্তকালীন জীবনের যে বিচিত্র চিত্র, এর অন্দরে প্রবেশের সূত্রটা যদি একবার আবিষ্কার করে ফেলা যায়, মনে হয় না এক জীবনের সাকুল্য সময়টা আর কখনোই কারো কাছে বোঝা হয়ে উঠবে। এজন্যেই বোধ করি সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা সময়ের ভারে বোর হবেন কি, চিরকাল সময়-ঘাটতিতেই থেকে যান !

এই আলোচনা প্রসঙ্গের যে কোনো বিন্দুতে এসে যে-কেউ হয়তো ধাম করে তাঁর ভিন্নমতটাও ছুঁড়ে দিতে পারেন। এতেও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। মতানৈক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এবং অহেতুক ঝুঁকি এড়িয়ে কানে কানে এটাও বলে রাখা আবশ্যক যে, এটাও বিনোদনের আরেক উৎস বৈ কি ! হা হা হা ! তবে খুব খেয়াল করে ! গোটা বিষয়টাই কিন্তু কিছুতেই ঝুঁকিমুক্ত নয়, যতক্ষণ না তা কেবল নিজের মধ্যেই বোঝাপড়ায় সীমাবদ্ধ থাকে ! কারো কোন সিরিয়াস বিষয় থেকেও আপনি বিনোদনের উৎস বা উপাদান খুঁজছেন এই বোধ যদি কেউ একটিবার টের পেতে পারে, তাহলে আপনার চেহারার অরিজিনালিটি বা ন্যাচারাল ফিনিশিং শেষপর্যন্ত অবিকৃত থাকবে এই গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টি আপনার সৃষ্টিকর্তাও আদৌ দিতে পারবেন কিনা তা অজ্ঞাত। অতএব আবারো বলি, খুব খেয়াল করে !

অতি উৎসাহী হয়ে এখনই যারা প্রতিমুহূর্তের ঘটনাপঞ্জির কেসহিস্ট্রি তৈরিতে নেমে যেতে একান্তই  একপেয়ে উদ্যোগী হবেন বলে মনে হয়, তাঁদের জন্য দূরবর্তী একটা হতাশার কথা না শোনালেই নয়। ঝুঁকিমুক্ত পদ্ধতিতে এটা করতে গিয়ে সাত-কাণ্ড রামায়ণ রচনার সম্ভাবনায় যে প্রাবল্য চোখে পড়ে, উপসংহারে এসে ‘সীতা কার বাপ’ হয়ে যাবার আশঙ্কাটা তার চেয়েও প্রবল বলেই মনে হয়। তাই মহামুনি বাল্মিকী হয়ে ওঠার আগে উপলব্ধির পূর্ণতার জন্যই দস্যু রত্নাকর হবার প্র্যাকটিসটাও সেরে নেয়া যেতে পারে। কেউ যদি আবার পাল্টা প্রশ্ন করেন, কিভাবে ? এর কোন সুষ্টু উত্তর নেই। কারণ রত্নাকর হতে হলে কোন কিছু জানার প্রয়োজন হয় না। বরং রত্নাকর হলেই কেবল বাল্মিকী হবার উপায়টার খোঁজ নাকি পাওয়া যায়। ঐ যে, পথ চললেই পথের হিসাব। শেষপর্যন্ত পথই পথের শেষটুকুতে নিয়ে যায়।

ঈর্ষণীয় ধৈর্য্য দেখিয়ে আবজাব আলোচনার এটুকু পর্যন্ত যাঁরা চলেই এসেছেন, তাঁদের জন্য দুঃসংবাদই বলা যায়। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা চিরকাল সময়-ঘাটতিতেই থেকে যায়। এদের ছাড়াও আরেক ধরনের প্রাণী আছে যারা কখনোই সময়ের ভারে আক্রান্ত হয় না। অলটাইম বোঝা বইতে বইতে এরা এতোই ব্যতিব্যস্ত থাকে যে, সময়ের বোঝা নেযার ফুরসৎ কই তাদের ! এরা হলো সেই গাধা, খাটি বাংলায় যাদেরকে মৌলিক গর্দভ বলা হয়। গাধার কি কোন বিনোদন থাকে ? মাঝে মাঝে কেন যেন আমার নিজেকেও এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে হয় না !
...
[sachalayatan]
...

No comments: