Friday, October 9, 2009

| নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ, লুঠপাটের নতুন ধান্ধা নয় তো !



| নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ, লুঠপাটের নতুন ধান্ধা নয় তো !
রণদীপম বসু

জাতে বাঙাল হওয়ার সমস্যা এটাই, শুরুতেই সন্দেহ এসে ভর করে। গত ০২ অক্টোবর ২০০৯ শুক্রবারের দৈনিক সমকালের প্রথম পাতায় বড় লাল শিরোনামে প্রধান সংবাদটা ছিলো- ‘সব ধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ’। তার নিচেই ছোট্ট উপশিরোনাম- ‘বিপণন কোম্পানিগুলোকে পেট্রোবাংলার চিঠি, উৎপাদন না বাড়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে’। ০১ অক্টোবর থেকে বলবৎ হওয়া এ সিদ্ধান্তটি গ্যাস (Gas) ও জ্বালানিসম্পদের তত্ত্বাবধানকারী সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলা  (Patrobangla) ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ বুধবার চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। এই সংবাদ শুনামাত্র নাকি সারাদেশে সংযোগ প্রত্যাশী, ঠিকাদার সংস্থার সদস্যরা বিপণন কোম্পানিগুলোর সামনে বিক্ষোভও করেছে। শেষপর্যন্ত ফলাফল যে কী দাঁড়াবে তা-ই ভাববার বিষয় বৈ কি। আদৌ কি ভালো কিছু হচ্ছে ?

এ মুহূর্তে বলার উপায় নেই সারাদেশে কী পরিমাণ নতুন বাড়ি-ঘর নির্মানাধীন আছে। গ্যাস সংযোগ ছাড়া এসব বাড়িঘরের আদৌ কোন মনুষ্য-ব্যবহারযোগ্যতা থাকবে কি ? বড় বড় শহর ও নগরীগুলোর আবাসন সমস্যা নিরসনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী কী পরিমাণ ডেভেলাপার বা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে কী পরিমাণ নির্মানাধীন বহুতল ভবন গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় অব্যবহার্য হয়ে থাকবে ? কী পরিমাণ পুঁজি এই খাতে স্তব্ধ হয়ে যাবে ? গড়ে উঠা গ্যাস নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শেষ গন্তব্য কী হবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি বহু প্রশ্ন মাথায় এসে ভীড় করতে লাগলো। এর সাথে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, রফতানিমুখী শিল্প ও অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সত্যি কি এগুলো সব বন্ধ থাকবে ? এর সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উপাত্ত আমার জানা নেই।  কিন্তু ধারণার মধ্যে থেকেও এটা কি ধারণা করা যায় না যে এর পরবর্তী প্রভাব কী হতে পারে ?

সারাদেশে পাইপলাইনে গ্যাস বিপণনের জন্য সরকারের চারটি কোম্পানি রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের ১৬ টি জেলায় গ্যাস বিতরণ করে থাকে তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কোম্পানি লিমিটেড, উত্তর ও পশ্চিমে বিতরণ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (ওয়েস গ্যাস), চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড এবং সিলেট অঞ্চলে শাহজালাল গ্যাস টিঅ্যান্ডডি সিস্টেম লিমিটেড। সারাদেশে এই চারটি গ্যাস বিপণন কোম্পানিতে প্রায় দু’লাখ সংযোগের আবেদন ইতোমধ্যেই জমা পড়ে আছে বলে জানা যায়। গত কয়েক বছর ধরেই গ্যাসের সংযোগ পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই, নতুন বাড়ি করেও অনেকে সংযোগ পাচ্ছেন না। আগে নতুন সংযোগকে করা হতো নিরুৎসাহিত, আর এখন ঘোষণা দিয়েই বন্ধ করে দেয়া হলো। আসলেই কি নতুন সব গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলো ? বিষয়টা কে কিভাবে নিচ্ছেন জানি না, তবে মনে হচ্ছে বেশ দুঃশ্চিন্তার এবং আতঙ্কজনকও। কেননা যে কোন কারণেই হোক পুনঃসংযোগের বেলায়ও নাকি গ্রাহকদের বেগ পেতে হতে পারে। আর যদি অনিয়মের কারণে কোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, সেগুলোর পুনঃসংযোগ না-ও দেয়া হতে পারে।

কিন্তু কেন এরকম হলো ? পেট্রোবাংলার হিসাবে প্রতিদিন ২০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস ঘাটতি রয়েছে। সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের বিপরীতে চাহিদা ২৩০ কোটি ঘনফুটের কথা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) মুক্তাদীর আলীর বক্তব্য থেকে জানা যায়। তিনি আরো বলেন, ‘উৎপাদন চাহিদার বেশি বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। তখন নতুন সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’ এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান যা পরিস্থিতি, এই হাল চলতে থাকলে আদৌ কি কখনো চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হবার কোন সম্ভাবনা আছে ? শোনা যায় বর্তমানে গ্যাসের অভাবে প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বহু শিল্প-কারখানায় গ্যাসের নির্দিষ্ট চাপ নেই। এছাড়া বহু সংযোগ সক্রিয় করার অপেক্ষায় রয়েছে। এসব ঘাটতি মিটিয়ে অবশেষে বাড়তি উৎপাদন এলেই তবে নয় মণ ঘি-ও হবে আর রাধাও নাচবে !

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অবশ্য কথায় একটু কিন্তু রেখে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে এটুকুও জানা গেলো যে, ‘ এতে সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ হবে না। তবে জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছু কিছু সংযোগ দেওয়া হবে।’ মনে হচেছ আসল রহস্যটা এখানেই। শেষপর্যন্ত এখানে এসেই বুঝি কবিকে নীরব হয়ে যেতে হয়। হয়তোবা কেঁদেও দিতে হবে। কেন ? সাধারণত দেখা যায় যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আসীন ও ক্ষমতাসীনরা কেন যেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তায় হাবভাবে কিরকম এক দার্শনিক মাত্রা যোগ করে এমন হাইপোথিটিক্যাল বয়ান শুরু করে দেন যে, সেই সব বয়ানের বোধগম্য কোন তাৎপর্য উদ্ধার করতেই আরেকটা ইনস্টিটিউশন খোলারই দরকার হয়ে পড়ে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের এরকমই একটা হাইপোথিটিক্যাল উক্তি হলো এই- ‘জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছু কিছু সংযোগ দেওয়া হবে।’

কিন্তু তিনি এটা তো বলেননি, এই জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনার আদর্শ মানদণ্ডটা আসলে কী এবং কোথায় লেখা আছে তা ? কি কি বিবেচনায় এসব মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় বা হবে ? আমাদের অভিজ্ঞতায় বলে, মানুষের দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয়তাকে জিম্মি করে লুঠপাটের বাণিজ্যেই আমাদের চিরাচরিত গুরুত্ব সবচেয়ে প্রবল হয়ে থাকে। হামেশাই যা দেখা যায়। কেননা যেখানে চামে দা মারা জাতীয় আর্থিক প্রাপ্তিতে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ এবং বটগাছ হয়ে উঠার সম্ভাবনা আকাশচুম্বি, সেখানে এই গ্যাস সংযোগের ইস্যুটি যদি নতুন করে জাতীয় মাত্রা পেয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই ! যেকোন ভুলের কারণে করিম সাহেবের গ্যাস সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বা করতে হলে জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার মতো কাঁচা টাকার মালিক না হলে তাঁকে যেমন কাঁচা মাংস চিবানোর প্র্যাকটিসে নামতে হবে, তেমনি এমপি মহোদয়ের বাদাইম্যা ভাতিজাটা যে জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে ? শিল্পকারখানা বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষিত নাই আনলাম। শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে হয়তো বা নতুন কোন মুদ্রাও যুক্ত হবে না। কিন্তু এতে করে গ্যাস ব্যবহার বৃদ্ধি কতোটা রোধ হলো কিংবা সংশ্লিষ্ট গুরুত্ব বিবেচনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব ব্যাংক ব্যালেন্স বা মালখানাগুলো কতোটা ফুলে ফেঁপে উঠলো এসবের মনিটরিং করবে কে ?

আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজ বাস্তবতা যারা পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা কে কী ভাবেন সে ব্যাপারে এখনো কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে আসে নি। জাতীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় গ্যাস ও কয়লা রপ্তানি বা উত্তোলন ও লিজ নিয়ে জনগণের সাথে সরকারের যে ঢাকগুড়গুড় ভাব চলছে, সেখানে হঠাৎ করে সবধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করার বিষয়টির পেছনে সত্যিকারের কী উদ্দেশ্য ঘাপটি মেরে আছে তা এখনো বুঝা যাচ্ছে না। এর পেছনে যদি সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি-মহলের লুঠপাটের নতুন কোন ধান্ধা কাজ করে না থাকে, তাহলে প্রশ্ন- শিল্প বা বাণিজ্য খাতে না হোক, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে একজন ব্যক্তিকে কেন তার জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রীয় অত্যাবশ্যক সুযোগ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে বা তার জন্য বৈষম্য তৈরি হবে ? এটা কি তাঁর নাগরিক অধিকার হরণ করা নয় ?

যে দেশে জন্মালে একটা গাধার সবচেয়ে বড় গুণ হয় সে গাধা, আর মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে যায় সে মানুষ, সেখানে অনিবার্য নাগরিক অধিকার কেঁড়ে নেয়ার মতো এরকম আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিরীহ নাগরিকদের জন্য আতঙ্ক ছাড়া আর কী ! এই সিদ্ধান্ত কতোটা বৈধ, এর জবাব দেয়ার দায়িত্ব কার ?


[sachalayatan]
...

No comments: