Monday, November 2, 2009

| ছড়া’র গাঁঠছড়াটা খুলবে কে ?



| ছড়া’র গাঁঠছড়াটা খুলবে কে ?
 রণদীপম বসু
...
শূন্য থেকে কোন কিছুই সৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তা তো কল্পনাই করা যায় না। কথার ঠেলায় কথা বলতে গিয়ে যাঁরা ঠাশ করে বলে ফেলেন- ‘এই যে এটা আমার মৌলিক সৃষ্টি’, তাঁরা হয় ডাহা মিথ্যে কথা বলেন, কিংবা বোকার স্বর্গে বাস করেন। আর বোকার স্বর্গে বাস করে কেউ তর্কাতীতভাবে সৃজনশীল হবেন এটা যে বিশ্বাস করে, সে হয়তো এটাও বিশ্বাস করে যে সোনা দিয়ে নিশ্চয়ই পাথরবাটি বানানো সম্ভব। তবে সোনা দিয়ে পাথরবাটি বানানোর এই ধারণাটাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার জো নেই। অন্তত শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই অদ্ভুত উদ্যোগ বা চর্চার চেষ্টাটা যদি না থাকতো তাহলে সমালোচনা সাহিত্য নামের কোন বিশ্লেষণী সাহিত্য বিভাগ সৃষ্টিরও আদৌ প্রয়োজন হতো কিনা সন্দেহ। বনের মোষ তাড়ানোর মতো কার এতো দায় পড়তো কেউ কোথাও পাথর দিয়ে স্বর্ণপাত্র কিংবা সোনা দিয়ে পাথরবাটি সৃষ্টির ভয়ঙ্কর কোন কৃতিত্ব দেখালো কিনা ?



সাহিত্য-সংস্কৃতির সৃজনশীল ক্ষেত্র ও ধারাটাকে সাবলীল রাখতে হলে এ দায় কারো না কারো ঘাড়ে চাপবেই। কেউ নিজে থেকে এ দায় ঘাড়ে তুলে নেন, আবার কাউকে এ দায় চাপিয়েও দেয়া হয়। তবে প্রতি প্রজন্মেই এই দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হয়। হোক সে লেখক, পাঠক কিংবা অর্বাচীন গোছের কেউ। কেননা শিল্পের বহমান স্রোতে ব্যর্থতার দায়ভার কোন ব্যক্তিবিশেষ নয়, গোটা প্রজন্মকেই নিতে হয়। যিনি এটা বোঝেন না বা বুঝেও না বোঝার ভান করেন, তাঁকে আর যাই হোক সংস্কৃত বলা চলে না।

যে প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে এই আলোচনাটার সূত্রপাত, তা হলো- ছড়া’র গাঁঠছড়াটা খুলবে কে ? এই প্রতিপাদ্য বিষয় বা প্রশ্নটাতে চোখ আটকে গেলেই প্রথম যে প্রশ্নটা ফের সামনে এসে দাঁড়াবে, ছড়া নিয়ে কিসের এতো গাঁঠছড়া ? খুব মৌলিক না হলেও এর ভেতরে আবার বেশ কিছু প্রগৈতিহাসিক প্রশ্ন যেমন ছড়া কী, কেন, কিভাবে ইত্যাদিও এসে জড়ো হতে থাকবে। এ জন্যে শুরুতেই বলে দেয়া, শূন্য থেকে কোন কিছুই সৃষ্টি হয় না। ছড়া হলো সাহিত্য বা সংস্কৃতির খুব আদি একটা মাধ্যম। সংস্কৃতি যদি হয় মানুষের প্রবহমান জীবনধারা, তাহলে ছড়াও নিশ্চয়ই এর বাইরের কিছু নয়। বরং মিলেমিশে এক হয়ে থাকা মানুষের সংস্কৃতিগত ইতিহাসের প্রতিচিত্র তা। কিন্তু দৃশ্যমান বা উপলব্ধিজাত মাধ্যম হতে হলে অবশ্যই সে মাধ্যমের একটা সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি, কাঠামো বা শর্ত থাকবেই। কচু, ঘেচু, পাঁঠা, ছাগল, চাউল, ভুষি ইত্যাদি কোন কিছু না হয়ে ওটা ছড়া হবে কেন ? এটাই হচ্ছে ছড়া নিয়ে গাঁঠছড়া। ওটা যে কবিতা নয়, পদ্য নয়, গীত বা অন্য কিছু নয়, কেবলই ছড়া, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শিল্প মাধ্যম, তা নির্ধারণ ও সূত্রাবদ্ধ করতে গিয়েই এই গেরো বা গাঁঠছড়ার জন্ম।

কী সেই গেরো?
ছড়া নিয়ে গাঁঠছড়া’র যে গেরো তা ছাড়িয়ে এর সুনির্দিষ্ট একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে উনিশ শতকের শেষের দিকে সেকালের সব বাঘা বাঘা পণ্ডিতজনের মধ্যে রীতিমতো তাত্ত্বিক ও তথ্যগত যে আলোচনা ও প্রতি-আলোচনার সূত্রপাত হলো, তা বেশ মজার বৈ কি। এতে করে ছড়াসাহিত্যের বিশাল একটা লাভ হয়ে গেলো। লোক-ছড়া ও আধুনিক ছড়া’র পার্থক্য এবং শিল্প-মাধ্যম হিসেবে ছড়া’র একটা চারিত্রিক কাঠামো দাঁড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেলো। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (বঙ্গীয় শব্দকোষ), রাজশেখর বসু (চলন্তিকা অভিধান), যোগেশ চন্দ্র রায় (বাঙ্গালা শব্দকোষ), নগেন্দ্রনাথ বসু (বিশ্বকোষ), সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতদের মধ্যে যেমন ছড়ার ইতিহাস খোঁজা নিয়ে ঝঞ্ঝাট বাঁধলো, অন্যদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে যোগীন্দ্রনাথ সরকার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মোহিতলাল মজুমদার, সুকুমার সেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোঃ এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ পণ্ডিতজনের আলোচনার মধ্যদিয়ে ছড়া’র বৈশিষ্ট্য বিচারের এক তুমুল তত্ত্ব চালাচালিও হয়ে গেলো। এতে করে এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো জমা হলো, তার অনুসরণে গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তাঁর ছড়া বিষয়ক গবেষণা সন্দর্ভে আধুনিক ছড়া’র অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে সেগুলোকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন এভাবে-

১.    ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত বা বিশিষ্ট ভাব কিংবা ভাবের পারম্পর্য নেই।
২.    ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনী থাকে না।
৩.    ছড়া ধ্বনি প্রধান, সুরাশ্রয়ী।
৪.    ছড়ায় রস ও চিত্র আছে, তত্ত্ব ও উপদেশ নেই।
৫.    ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ।
৬.    ছড়া বাহুল্যবর্জিত, দৃঢ়বদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত।
৭.    ছড়ার ভাষা লঘু ও চপল।
৮.    ছড়ার রস তীব্র ও গাঢ় নয়, স্নিগ্ধ ও সরস।

আলোচিত মতামতগুলোর ভিত্তিতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। যেমন:
ক)    ছড়া ও সঙ্গীতের পার্থক্য:
১.    ছড়া আবৃত্তি বা ধ্বনিনির্ভর। অন্যদিকে সঙ্গীত তাল ও সুর নির্ভর।
২.    ছড়ার সুর একটানা বৈচিত্র্যহীন। অন্যদিকে সঙ্গীতের সুর বিচিত্র বা বৈচিত্র্যময়।
খ)    ছড়া ও শিশু-কবিতার পার্থক্য:
১.    ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত। শিশু-কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে।
২.    ছড়ার আকার হ্রস্ব। শিশু-কবিতার আকার দীর্ঘও হয়ে থাকে।
৩.    ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্ত। কিন্তু শিশু-কবিতার যে কোন ছন্দ হতে পারে।
৪.    ছড়ার পরিণতি আকস্মিক। অন্যদিকে শিশু-কবিতার পরিণতি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত।

(কিভাবে এবং কোন্ প্রেক্ষিতে ছড়া’র বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলো গ্রন্থিত হলো, তার ব্যাখ্যা করতে হলে বক্ষ্যমান রচনার শুরুতে এই লেখককে ‘প্রসঙ্গ: ছড়া কিংবা ছড়া নিয়ে গাঁঠছড়া’ শীর্ষক আরেকটি দীর্ঘ রচনা পত্রস্থ করতে হয়। তারচে’ বরং আগ্রহী পাঠক যদি একটু কষ্ট করে কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকাশিত জাহাঙ্গীর আলম জাহান সম্পাদিত নিরঙ্কুশ ছড়ার কাগজ ‘আড়াঙ্গি’ জুন ২০০৯ সংখ্যা কিংবা ঢাকা থেকে প্রকাশিত নূর আল ইসলাম সম্পাদিত সাহিত্য সূচক লিটল ম্যাগাজিন ‘শুচি’ জুলাই ২০০৯ ছড়া সংখ্যায় উল্লেখিত রচনাটা দেখে নেন, সেটাই অধিকতর শোভন হবে বলে মনে করি।)

মানবিক জীবনযাত্রার মতো সতত পরিবর্তন ও সঞ্চরণশীল শিল্প-মাধ্যমের ক্ষেত্রে অনড় ও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা স্বতসিদ্ধ নীতি আদৌ আরোপ করা যায় কিনা তা নিশ্চয়ই যুক্তিসাপেক্ষ বিষয়। তাই আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণী উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলোকেও চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়ে গেছে বৈ কি। কেননা ওইসব মতামত বা সিদ্ধান্ত আরোপকালীন সময়ে অর্থাৎ উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সমকালীন যাঁরা ছড়া জাতীয় রচনায় নিজেদেরকে পুরোপুরি বা আংশিক ব্যপৃত রেখেছিলেন তাঁদের অধিকাংশ রচনাই উপরোক্ত সবগুলো বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আরো মজার বিষয় হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যেসব কবি বিভিন্নভাবে ওই তাত্ত্বিক আলোচনায় নিজেদেরকে খুব সফলভাবেই জড়িত করেছিলেন, তাঁরাও অনেকেই তাঁদের ছড়া জাতীয় রচনায় আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলোকে সফলভাবে প্রয়োগ বা প্রকাশ করতে পারেন নি। অর্থাৎ তত্ত্বের সাথে বাস্তবতার ফারাকটা যে আসলে মেটানো সম্ভব হয় নি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে ছড়ায় আধুনিকতা বা আধুনিক ছড়া’র রূপ বিচার করতে উদাহরণের খোঁজে খুব বেশি পেছনে না গিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকেই শুরু করতে পারি।

খাপছাড়া কথাগুলো
শিশু-কিশোরদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ছড়া বা ছড়া জাতীয় রচনা ও পদ্য-কবিতার বই লিখেছেন পাঁচটি। ‘শিশু’ (১৯০৩), ‘শিশু-ভোলানাথ’ (১৯২২), ‘খাপছাড়া’ (১৯৩৬), ‘ছড়ার ছবি’ (১৯৩৭) ও ‘ছড়া’ (১৯৪১)। প্রচুর লোকছড়া সংগ্রহ করে বাংলা লোকছড়ার বিপুল ঐশ্বর্যে গভীরভাবে আলোড়িত হয়ে তিনি লোকছড়া-বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনায় হাত দেবার পাশাপাশি বিভিন্ন কবিতায় ছড়ার ছন্দ ব্যবহার করায়ও উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। খুব সঙ্গতভাবে এই প্রভাব যে শিশু-কিশোর রচনায়ও পড়বে এটা আর বলার বাকি রাখে না। তবে উপরোক্ত পাঁচটি বইয়ের মধ্যে ‘খাপছাড়া’ বাদে বাকিগুলোকে কোনভাবেই ছড়ার বই বলা চলে না। মূলত ‘শিশু’ ও ‘শিশু-ভোলানাথ’ শিশু-পদ্য বা কবিতার বই। লোকছড়ার কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও রচনাগুলোর ভাব ও দৈর্ঘ্য বিবেচনায় এগুলোকে কেউ পূর্ণাঙ্গ ছড়া বলেন না।

...কবে বিষ্টি পড়েছিল,
বান এল সে কোথা
শিবঠাকুরের বিয়ে হল
কবেকার সে কথা।...
(বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ শিশু/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

শিশু’র অধিকাংশ কবিতার গভীর ও তত্ত্বপূর্ণ ভাব ডিঙিয়ে যে কয়টা রচনা শিশুতোষ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে আবার অধিকাংশই কবিতা। যেমন ‘লুকোচুরি’, ‘বীরপুরুষ’, ‘জন্মকথা’ ইত্যাদি। আবার গুটিকয় যেমন ‘খেলা’, ‘সমালোচক’, ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘সাত ভাই চম্পা’ এগুলো ছড়ার বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি এলেও ৩৬ থেকে ৯৬ পঙক্তিতে বিন্যস্ত এতো দীর্ঘতার বিচারে কিছুতেই এগুলোকে ছড়া বলা যায় না। উপরে উদ্ধৃতাংশের ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ রচনাটির মধ্যে লোকছড়ার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট, কিন্তু ৫ স্তবকে ৮০ পঙক্তিতে দীর্ঘ বিস্তৃতির কারণে এটা আর ছড়া থাকে না। ‘শিশু’র পর প্রায় কুড়ি বছর ব্যবধানে রচিত ‘শিশু-ভোলানাথ’ বইটির রচনাগুলোতে যদিও এই দীর্ঘতা ও তত্ত্বের ভার কমে এসেছে, তবু ছড়া বিচারে ছড়ার ছন্দ থাকলেও এগুলো যথেষ্ট দীর্ঘাকৃতি এবং কবিতা পর্যায়ে। সেখানেও কোন ছড়া নেই।

মুচকে হাসে অতুল খুড়ো,
কানে কলম গোঁজা।
চোখ টিপে সে বললে হঠাৎ,
‘পরতে হবে মোজা।’

হাসল ভজা, হাসল নবাই-
‘ভারি মজা’ ভাবল সবাই-
ঘরসুদ্ধ উঠল হেসে,
কারণ যায় না বোঝা।

(খাপছাড়া/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

রবীন্দ্র-সাহিত্যে একমাত্র ছড়াগ্রন্থ আসলে ‘খাপছাড়া’। ১০৫ টি রচনার সবগুলোই যদিও সংগৃহীত লোকছড়ার মতো শিরোনামহীন, তবু দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে উপস্থাপিত ছড়া-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রচনাগুলোর আকারে হ্রস্বতা, সহজ-সরল বিষয় ও বলার ভঙ্গিতে বেশ দৃঢবদ্ধতা ও ছড়ার ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্তের সমিল ছন্দের উপস্থিতি সাপেক্ষে খাপছাড়ার রচনাগুলো পুরোপুরি ছড়া বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। পড়তে গিয়ে কোথাও আটকা পড়ে না বা ভাবের কোন আধিক্য নেই। বিষয় বৈচিত্রে জটিল মহাজটিল ভাবসমৃদ্ধ রচনাসম্ভারের বিশালতাও যার কাছে এতো নস্যি, সেই রবীন্দ্রনাথ জীবন সায়াহ্ণে এসে একেবারে পরিপূর্ণ অবস্থায় এত্তো সহজ রচনায় হাত দিলেন ! তবে কি আগে গুরুত্ব দেন নি ! আসলে তাও নয়। সহজ জিনিস লেখাটাই যে সবচেয়ে জটিল কাজ, তা রবীন্দ্র জবানিতেই জেনে যাই আমরা তাঁর ‘ছেলে ভুলানো ছড়া : ১’ শীর্ষক গদ্যে-
...হঠাৎ মনে হইতে পারে যে, যেমন-তেমন করিয়া লিখিলেই ছড়া লেখা যাইতে পারে। কিন্তু সেই যেমন তেমন ভাবটি পাওয়া সহজ নহে। সংসারের সকল কার্যেই আমাদের এমনি অভ্যাস হইয়া গেছে। সহজ ভাবের অপেক্ষা সচেষ্ট ভাবটাই আমাদের পক্ষে সহজ হইয়া উঠিয়াছে।

এই কথাই প্রতিফলিত হতে দেখা যায় ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থটির নামপৃষ্ঠায় কবির ভনিতায়-
সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।

লেখার কথা মাথায় যদি জোটে
তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।
কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,
যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।


পরবর্তীতে ‘ছড়ার ছবি’ ও ‘ছড়া’ নামের গ্রন্থ দুটোর রচনাগুলোর অবস্থা আবার পুরোপুরি বিপরীত। নামে ছড়া হলেও ওগুলোতে কোন ছড়াই নেই। ‘ছড়ার ছবি’ বই প্রসঙ্গে বইটিতে রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেন-
এই ছড়াগুলি ছেলেদের জন্যে লেখা। সবগুলো মাথায় এক নয়। রোলার চালিয়ে প্রত্যেকটি সমান সুগম করা হয়নি। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত জটিল যদি কোনোটা থাকে তবে তার অর্থ হবে কিছু দুরূহ, তবু তার ধ্বনিতে থাকবে সুর।
ছড়া হিসেবে এমন সরাসরি সচেতন ঘোষণার পরও রচনাগুলো ভাব ভঙ্গি দীর্ঘতায় আসলে যে ছড়া হয়ে ওঠেনি, হয়েছে কবিতা, সেটাই একটা রহস্য বৈ কি !

হিজিবিজি অক্ষরগুলো
জনভাষ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকছড়ার প্রথম সংগ্রাহক ও প্রথম আধুনিক বাংলা ছড়াকারের মর্যাদা দেয়া হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারকে। তৎকালীন বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় চারশত সংগৃহিত ছড়ার সংকলন ‘খুকুমণির ছড়া’ (১৮৯৯) গ্রন্থে তাঁর নিজেরও একাধিক ছড়া অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে তাঁর নিজস্ব রচনাগুলো রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমকালীনদের ছড়ারও পূর্ববর্তী। সেইদিক থেকে শিশু-মনস্তত্ত্ব নির্ভর উদ্ভট কল্পনায় গড়া আজগুবি ছড়া রচনা, হিউমার ও ছড়ায় চিত্রধর্মীতা সৃষ্টিতে সাফল্যই তাঁকে প্রথম আধুনিক ছড়াকারের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। ১৮৯১ সালে ‘হাসি ও খেলা’ পুস্তক প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা শিশু সাহিত্যের জগতে তাঁর পদচারণা শুরু হয়। এটা উপকথা ও ছড়াজাতীয় রচনার মিশ্র সংকলন। ছড়াগুলোর ছন্দ ও ভঙ্গি যথাযথ হলেও আকারে দীর্ঘতা ও ভাষার শৈথিল্যের কারণে এগুলোকে উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় ছড়া বলা যায় না। যেমন ৪ স্তবক ও ১৬ পঙক্তিতে বিন্যস্ত নিচের ‘কাকাতুয়া’ রচনাটির দীর্ঘতার সাথে রয়েছে তত্ত্ব-উপদেশ সমৃদ্ধ ভাষা শৈথিল্য।

কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?
বলিছে সোনার ঘড়ি, টিক্ -টিক্ -টিক্ ,
যা কিছু করিতে আছে করে ফেল ঠিক্।
সময় চলিয়া যায়-
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক্।
...
(কাকাতুয়া/ হাসি ও খেলা/ যোগীন্দ্রনাথ সরকার)

খুকুমণির ছড়া’ সংকলন প্রকাশের আগেই তাঁর ‘রাঙা ছবি’ (১৮৯৬), ‘ছড়া ও ছবি’, ‘খেলার সাথী’ (১৮৯৮) ও ‘হাসিরাশি’(১৮৯৯) বইগুলোও প্রকাশিত হয়। ওগুলোতেও যেখানে ছড়া জাতীয় রচনা রয়েছে সেগুলোর দীর্ঘ আকার, কোথাও গল্পরসের আধিক্য, কোথাও ছন্দবৈচিত্র্য ইত্যাদি ধারণ করে সেগুলো মূলত হাস্যরসপ্রধান কিশোরকবিতা হয়ে গেছে, ছড়া হয় নি। সেই বিবেচনায়, আমরা মানি আর না মানি, ‘হাসিরাশি’ গ্রন্থের ‘কাজের ছেলে’ শিরোনামের- ‘দাদ খানি চাল/ মুসুরির ডাল/ চিনি-পাতা দৈ,/ দু’টা পাকা বেল/ সরিষার তেল/ ডিম-ভরা কৈ।...’ সমৃদ্ধ সেই বিখ্যাত শিশুপাঠ্য রচনাটির মতো যোগীন্দ্রনাথের আরো অনেক রচনাই ছড়ার আসর থেকে নির্দ্বিধায় খারিজ হয়ে যায়। তবে প্রথম বই প্রকাশের দীর্ঘ সতের বছর পর ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ‘হিজিবিজি’-কেই বৈশিষ্ট্য বিচারে সফল ও সার্থক ছড়াগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়।

এক রত্তি ছিল যখন, ডিমের মতো ছাঁদ
পেটটি ছিল ঢাকাই জালা ষাঁড়ের মত নাদ;
বয়স বেড়ে ক্রমে এখন হল বেজায় বুড়ো,
ডাকতে হলে বলে সবাই ‘গঙ্গারামের খুড়ো’।

(গঙ্গারামের খুড়ো/ হিজিবিজি/ যোগীন্দ্রনাথ সরকার)


কেবল ঢং ও ছন্দ থাকলেই যদি ছড়া না হয়
শুরুতেই সাহিত্য ও ছড়া জগতের দুজন খ্যাতিমান প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের আলোচনাতে যেভাবে অধিকাংশ ছড়া জাতীয় রচনা নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় ছড়া থেকে বাতিলের তালিকায় পড়তে শুরু করেছে, তাতে করে ‘আর কাজ নেই বাবা মদন’ অবস্থার আশঙ্কাই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু চূড়ান্ত একটা রূপরেখা পেতে হলে যে মদন-বাবাজীর থামার কোন উপায়ও নেই, তাও তো সত্যি। তবে সেই আদ্যিকাল থেকেই ছড়া বা ছড়ার ঢংটা যে খুবই আকর্ষণীয় একটা শিল্প ও বিনোদন মাধ্যম হিসেবে যুগে যুগে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে তা বোধ করি অস্বীকার করার উপায় নেই। গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ ‘ছড়ায় বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে এ ধরনের কিছু নমুনা উপস্থাপন করেন।

মধ্যযুগীয় পুঁথিতে ১২০৪ সনে রচিত অজ্ঞাত রচয়িতার ‘কালিপ্রস্তুতের ছড়া’ এরকম-
লোধ লাহা লোহার গুঁড়ি   অর্কাঙ্গার যবার কুড়ি
গাবের ফল হরিতকী      ভৃঙ্গার্জ্জুন আমলকী
বাবলা ছাল জাঁটির রস   ডালিম সেছে করিবে কষ
ভেলায় করা এক আলি    চারিযুগলা উঠবে কালি।।


 পঞ্চদশ শতকের শেষ পাদে রচিত বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে যেমন ছড়ার ঢং দেখতে পাই আমরা-

শাক তুলিতে যায়ে ধাই চেড়ি।
বাহু লাড়া দিয়া ফিরে বাড়ি বাড়ি।।
পড়িয়া পাটের সাড়ি।
শাক তুলিতে বেড়ায়ে বাড়ি বাড়ি।।
নাচে ধাই দিয়া বাহু লাড়া।
শাক তুলিতে পড়িয়া গেল সাড়া।


তেমনি ষোড়শ শতকের মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যেও ছড়া-ঢঙের প্রতিফলন পাই-
আয়রে বাছা আয়রে আয়।
কি লাগি কান্দরে বাছা কিবা ধন চায়।।
আনিব তুলিয়ে গগন-ফুল।
একক ফুলের লক্ষৈক মূল।।
সে ফুলে গাঁথিয়ে পরাব হার।
সোনার বাছা কেদোনা আর।।


সঙ্গত কারণে প্রশ্ন এসে যায়, মঙ্গল কাব্যের রচয়িতাগণ কি তাহলে ছড়াও রচনা করেছেন ? এ প্রেক্ষিতে গবেষক শাহেদের মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য-
কিন্তু মঙ্গলকাব্যের রচয়িতাগণ সচেতনভাবে ছড়া রচনা করেননি। বরং বিচিত্র ছন্দে রচিত অসংখ্য পর্বে বিভক্ত এ-সকল দীর্ঘ কাব্যে লোক-ছড়ার অংশবিশেষ প্রবেশ করে কাব্যদেহে একাকার হয়ে গিয়েছে।

আমাদের প্রাচীন লোকজ উৎসব অনুষ্ঠান উপাচারগুলোতে ছড়ার উপস্থিতি কেমন ছিলো তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তন্ত্র মন্ত্র জপ ধ্যান বিয়ে পুজা মায় দলাদলির চূড়ান্ত ফলাফলে লড়াই সংঘর্ষের উজ্জীবনী শব্দসম্পাতেও ছড়ার অনিবার্য উপস্থিতিই বলে দেয় লোকায়ত-জীবনধারায় ছড়া কতোটা অভিন্ন অবস্থায় মিশে ছিলো। আমাদের সাহিত্যগত সংস্কৃতির উত্তরণ মানেই তো লোকছড়ার বিবর্তন মাত্র। তাই হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের আধুনিক হয়ে উঠা মনে-মননে নাড়ির টান হিসেবে ছড়ার প্রভাব এড়ানোর কোন উপায় থাকে না। ফলে পালা-যাত্রা-নাটকে সেই সুদূর অতীত থেকে ছড়া-অঙ্গের উপস্থিতি আমাদেরকে একটুও আশ্চর্য করে না, বরং একটা পরিতৃপ্তির উপলব্ধিই এনে দেয়। 
ঈশ্বর গুপ্তেরবোধেন্দু বিকাশ নাটক’ (প্র.১২৭০)-এ যেমন দেখি-
বড় দেখি, কথাগুলো, কড়া কড়া মুখে।
সভা মাজে, দাঁড়াইলি, চাড়া দিয়ে বুকে।।
...’

তেমনি ছড়াজাতীয় রচনা প্রায় নেই-হিসেবে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-১৮৮৭) কবিতায়ও ছড়ার ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়-
আয় যাদু আয়রে, আয় যাদু আয় রে,
আয় কোলে আয়রে।
কেমন ভুলিয়ে ছিলি অভাগিনি মায় রে।
...’
(সীতার বনবাস/ রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)

আর ঈশ্বরচন্দ্রের সমসাময়িক কালেই প্রথম বাংলা গদ্যে রচিত হয় উপন্যাস ও নাটক। এতেও ছড়াজাতীয় ঢঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। দীনবন্ধু মিত্রের ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬) প্রহসনে দেখা যায়-
স্বপোন যদি ফলে।
ঝোলবো তানার গলে।।
হাতে দেব রুলি।
মোম দেব চুলি।।
ভাত খাব থালা থালা।
তেল মাকবো জালা জালা।।
নটের মুকি দিয়ে ছাই।
অতি দিনি শুয়োর খাই।


কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩) উপন্যাসে দেখা যায়-
চলে বুড়ী শোনের নুড়ী,
খোঁপায় ঘেঁটু ফুল।
হাতে নড়ি, গলায় দড়ী,
কানে জোড়া দুল।
 

ছড়া বা কাব্যঘরানার দলভুক্ত না হয়েও নাটক-উপন্যাসে ছড়া বা ছড়া ছন্দের ব্যবহার সুস্পষ্টভাবেই সমকালীন প্রতিবেশে লোকায়ত ছড়ার মাধ্যমে ছড়ার প্রভাব ও তার জনপ্রিয়তাকেই প্রকাশ করে। এই প্রেক্ষিতে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) কিংবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) বা প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) ছড়া-চর্চার কথা আর নাই বা বললাম। তবে ছড়া যতো জনপ্রিয়ই হোক না কেন, ছড়ার ছন্দ বা ভঙ্গি প্রয়োগ করলেই যে ছড়া হয়ে যায় না তা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কারো বুঝতে বাকি নেই। নইলে বাংলা কাব্যে ছন্দের জাদুকর নামে খ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮২-১৯২২) ছড়ার ছন্দের প্রতি যে প্রবল আকর্ষণ তাঁর রচনাগুলোতে খুব উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠে, তাতে করে ছড়া রচয়িতা হিসেবে তাঁরই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার কথা ছিলো। তাছাড়া বিদেশী ছড়ার বাংলা অনুবাদের প্রথম কবি হিসেবেও যেখানে তাঁকে চিহ্ণিত করা হয়, সেখানে এক-দু’টা ব্যতিক্রম বাদ দিলে ছড়া-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাঁর সব রচনাই শেষ পর্যন্ত কবিতা বা পদ্য পদবাচ্যে অঙ্কিত হয়ে যায়। ছড়া আর হতে পারে না। অথচ একই সময়কালে এই সত্যেন্দ্রনাথের যুগেই খুব সমান্তরাল অবস্থানে থেকে কিছুটা কম জীবনদৈর্ঘ্য নিয়েও যে বিস্ময়কর ব্যক্তিটি আধুনিক ছড়া-রাজ্যের প্রধান পুরুষ হয়ে উঠলেন, তিনি তৎকালীন সেই বিখ্যাত ‘ননসেন্স ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)।

গাঁঠছড়াও যখন জট পাকিয়ে যায়
মূলত সুকুমার রায়ের মাধ্যমেই বাংলা আধুনিক ছড়া তার নিজ আসনে সত্যি সত্যি প্রতিষ্ঠিত হলো বলা যায়। যখন তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র, ক্লাবের এমন অদ্ভুত নামকরণ থেকেই সুকুমার সাহিত্যের মূল ধারাটার আগাম ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও কিছুকাল পরে এসে ছড়া-সাহিত্য ঠিকই বুঝে গেলো ‘সুকুমার ঘরানা’ আসলে কী ?
সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটিত যায় যায়।
...
ক্লাবের এই যায় যায় অবস্থায় ক্লাবটিকে তো বাঁচাতে হবে ! অতএব ক্লাব বাঁচাতে সকল সভ্যদেরকে নিমন্ত্রণ দেয়া হচ্ছে ছড়াতেই-
শনিবার ১৭ই,
সাড়ে-পাঁচ বেলা,
গড়পাড়ে হৈহৈ
সরবতী মেলা।
...
এরপরেও ক্লাবের না বেঁচে কি উপায় আছে ! হা হা হা ! এই হলো সুকুমার। কিন্তু এই সুকুমার সুকুমার হয়ে ওঠার পেছনে যে পারিবারিক ঐতিহ্য ও কৈশোরিক ভিত্তি, তাও আমাদেরকে খেয়ালে রাখতে হয়। আবহমান বাংলার লোকছড়া ও রূপকথা-উপকথা নিয়ে যার কায়কারবার, সেই উপেন্দ্রকিশোরের সন্তান হিসেবে একদিকে যেমন লোকায়ত পারিবারিক ঐতিহ্য লালন করে গেছেন, অন্যদিকে ইউরোপে তিন বছর (১৯১১-১৯১৩) উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তাঁকে একইসাথে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। এডওয়ার্ড লীয়র (১৮১২-১৮৮৮)-এর তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘Book of Nonsense’ (১৮৪০-১৮৫০), এডমন্ড কেরিহিউ বেন্টলী (১৮৭৫-১৮৫৬)-এর ‘Biography of Biginners’, লুই ক্যারল (১৮৩২-১৮৯৮)-এর ‘Through the Looking Glass’ প্রভৃতির অন্তর্ভূক্ত ছড়াজাতীয রচনা যে শুধু সুকুমার-প্রতিভাকেই সমৃদ্ধ করেছে তা-ই নয়, তাঁর মাধ্যমে বাংলা আধুনিক ছড়াকেও রাঙিয়ে তুলেছে পাশ্চাত্য আধুনিকতায়।

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে- “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
...
(খিচুড়ি/ আবোল তাবোল/ সুকুমার রায়)
এরকম উদ্ভট-অসংলগ্ন ‘ননসেন্স রাইম’ জাতীয় রচনার আধিক্য সুকুমার রচনাসম্ভারে দেখা যায়। তাঁর সব রচনাই পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী সম্পাদিত ও প্রকাশিত (১৯১৩) এবং পরবর্তীতে পিতার মৃত্যুশয্যায় (১৯১৫) সম্পাদনার ভার নিজের কাঁধে নেয়া ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উদ্ভট ছড়ার সাথে নিজ হাতে এঁকে দেয়া সাযুজ্যপূর্ণ ছবির উপস্থিতি রচনাকে যেমন আকর্ষণীয় করে তুলেছে, তেমনি ছড়ায় পাশ্চাত্য ঘরানার আধুনিক মাত্রাটাও যোগ করে দিয়েছে।

হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত ?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হটাৎ গেলেন ক্ষেপে!
আঁৎকে উঠে হাত-পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল!
হঠাৎ বলে “গেলুম গেলুম, আমায় ধরে তোল!”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ-বা হাঁকে পুলিশ,
কেউ-বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
ব্যস্ত সবাই এদিক-ওদিক করছে ঘোরাঘুরি-
বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!”
...
(গোঁফ চুরি/ আবোল তাবোল/ সুকুমার রায়)

ছড়ায় ছন্দ ব্যবহারের অনুপম দক্ষতা আর হিউমারের উপস্থিতি তো আছেই, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের চলমান অসংগতি-অসংলগ্নতাগুলোকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে কটাক্ষ করে স্যাটায়ারের উপস্থিতি এবং অদ্ভুত ধরনের 'টুইস্ট'-এর ব্যবহার সুকুমারকে অন্য সবার থেকে এক উজ্জ্বল ব্যবধান তৈরি করে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এজন্যেই হয়তো বুদ্ধদেব বসুর অভিমত- ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বড়োদের জন্য লিখলেও পড়ে আনন্দ পায় ছোটোরা। তেমনি সুকুমার ছোটোদের জন্য লিখলেও তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ পায় বড়োরা।
কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসুই সম্ভবত সুকুমার রায়ের মৃত্যুপরবর্তী সাহিত্যকীর্তি নিয়ে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটি করেন। তিনি সুকুমারের ছড়াজাতীয় রচনাবলীকে প্রথমেই কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে বিষয়ানুসারে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন-
১.    human experiences exaggerated’ ধরনের কবিতা।কাঠবুড়ো’, ‘গোঁফ চুরি’, ‘কাতুকুতু বুড়ো’, ‘গানের গুঁতো’, ‘চোর ধরা’, ‘সাবধান’, ‘বুঝিয়ে বলা’, ‘ডানপিটে’, ‘ফসকে গেল’, ‘ঠিকানা’, ‘কাঁদুনে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২.    সত্যি সত্যি অদ্ভুত ও আজগুবি কবিতা।খিচুড়ি’, ‘ছায়াবাজী’, ‘কুমড়োপটাশ’, ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’, ‘একুশে আইন’ ইত্যাদি।
৩.    satire’ কবিতা।সৎপাত্র’, ‘হাতুড়ে’, ‘রামগরুড়ের ছানা’, ‘কি মুস্কিল!’, ‘নোটবই’, ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’ ও ‘ট্যাঁশ গরু’।
এছাড়া সুকুমার রায়ের দু-চারটা বাস্তবিক ‘serious’ কবিতা আছে” বলেও বুদ্ধদেব বসু উল্লেখ করেন। ‘ভালো রে ভালো’ এবং ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম!’ এই শ্রেণীর কবিতা।

বাংলা সাহিত্যের বাঘা বাঘা পণ্ডিতজনের সক্রিয়তায় নির্ণীত বাংলা ছড়ার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের সাথে ছড়া-বাস্তবতার ধারণাগত ভিন্নতা থেকে ছড়া-ভাবনা নিয়ে যে গাঁঠছড়ার সৃষ্টি হলো এবং সুকুমারে এসে আধুনিক ছড়ার একটা আদর্শ-রূপ প্রত্যক্ষ করে যখন এই গাঁঠছড়া খুলতে  প্রস্তুত আমরা, তখন সাহিত্যের বিদগ্ধজন হিসেবে স্বীকৃত কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু’র উপরোক্ত মতামতে সেই গাঁঠছড়ার গেরোটা আবারো শক্তভাবে এঁটে বসে।  আর তারও আগে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় থেকে প্রথম প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’ (১৯২৩)-এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে তাঁর ছড়াজাতীয় রচনাগুলোকে কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে স্বয়ং সুকুমার রায়ই এই গাঁঠছড়াটাকে সত্যি সত্যি জট পাকিয়ে গেলেন বলা চলে-
যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।
পুস্তকের অধিকাংশ ছবি ও কবিতা নানা সময়ের “সন্দেশ” পত্রিকা হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। এক্ষণে আবশ্যকমত সংশোধন ও পরিবর্তন করিয়া এবং নানা স্থলে নতুন মালমশলা যোগ করিয়া সেগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হইল।’

গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা-
আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা।
গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তোড়ে প্রাণপণ,
ছুটছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্ভন্।
মরছে কত জখম হয়ে করছে কত ছট্ফট্-
বলছে হেঁকে, “প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্পট্।”
বাঁধন-ছেঁড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিৎপাত;
ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্পাত।
চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়ছে বেগে মূর্ছায়,
লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বলছে রেগে “দূর ছাই!”

জলের প্রাণী অবাক মানি গভীর জলে চুপচাপ,
গাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস পড়ছে দেদার ঝুপ্ঝাপ্।
শূন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী,
সবাই হাঁকে “আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষী।”
গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিলকুল,
ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশমেজাজে দিল্ খুল্।
এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এমনি সেটা ওস্তাদ,
গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাৎ।
আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা,
বাপ রে’ বলে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা।

(গানের গুঁতো/ আবোল তাবোল/ সুকুমার রায়)

পুরো রচনাটা উদ্ধৃত করা হলো এটাকে ছড়ার রূপ বৈশিষ্ট্য নিরূপণকারী কারখানার ছাঁচে ফেলে একটু যাচাই করে নেয়ার জন্যই মূলত। তার আগে আমাদের পাঠক-বোধ ও উপলব্ধির রসে জারিত করে কী পাই আমরা ? সেটাও দেখে নেযা জরুরি। হিউমার-সমৃদ্ধ এমন সরস রচনার অন্তস্রোতে তীব্র স্যাটায়ারের উপস্থিতি অস্পষ্ট নয়, বরং স্পষ্টভাবেই এসেছে। প্রকরণগত বিবেচনায় স্বরবৃত্ত বা ছড়ার ছন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা এই রসরচনাটিতে উপমা উৎপ্রেক্ষার চমৎকার প্রয়োগ পাঠকের শ্রবণেন্দ্রিয়কে এক তৃপ্তিকর মোহময়তায় জড়িয়ে রাখে। ভাবের আতিশয্যহীন সহজ-সরল লঘু শব্দে কোথাও না আটকে সাবলীলভাবে এগিয়ে যাওয়া রচনাটি বুঝতে বা এর রস উপভোগ করতে কাউকে খুব বুঝদার পণ্ডিতও হতে হয় না। জ্ঞানী মূর্খ ছোট বড় সবার জন্যেই উন্মুক্ত এই রসসৃষ্টি পাঠক বিবেচনায় অতি পছন্দের না হয়েই যায় না। এটাকে কি ছড়া বলে, না কি পদ্য কিংবা কবিতা বলা হবে এসব বিভ্রান্তি থেকে অনেক দূরে অবস্থানকারী  পাঠকের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু সাহিত্যের কল তাকে এত্তো সহজে ছেড়ে দিতে রাজী নয়। গ্রন্থিভুক্ত হতে হলে তাকে যে একটা ক্যাটেগরিতে ফেলতেই হবে ! এই কলে ফেলার আগে ‘গানের গুঁতো’ রচনাটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু কী বলেছেন তাও চেখে নেয়া যেতে পারে-
human experiences exaggerated’ ধরনের কবিতা।...এ-সব কবিতা বিশেষ আনন্দ দেওয়ার কারণ এই যে, এ-সব ঘটনা আমাদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনে একটু বিনম্র আকারে ঘ’টে থাকে- মনে হয়, কবি আমাদের প্রত্যেকের সমস্ত গোপন ইতিহাস জেনে নিয়ে একটু বাড়িয়ে-টাড়িয়ে বলছেন। গানের দাপে দালান ফাটুক বা না ফাটুক- কোনো-কোনো সুগায়কের অযাচিত অনুগ্রহে বিব্রত হয়তো অনেকেই হয়েছেন, এবং মনে-মনে বলেছেন, ‘আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী।’ তাই ভীষ্মলোচন শর্মার প্রবল সংগীতানুরাগের বর্ণনা প’ড়ে পাঠক প্রাণ খুলে হাসেন বটে, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ভীষ্মলোচনের ‘শিকার’দের প্রতি প্রত্যেকের বেশ একটু সহানুভূতিও জন্মে।

অন্যদিকে সুকুমার রায় সম্পর্কে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদারের ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি- ‘সুকুমার নিজে কখনও এমন একটিও পদ রচনা করেন নি, যার মধ্যে অর্থ এবং রস দুই-ই নেই। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি আঁচড় অর্থে আর রসে টইটম্বুর।
অর্থাৎ রচনাটি যে আসলে অর্থহীন বা লক্ষ্যহীন নয়, তা বুদ্ধদেব বসু ও লীলা মজুমদারের মতামত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। আসলে সুকুমারের কোন রচনাই অর্থহীন কিংবা লক্ষ্যহীন নয়। একটা অর্থপূর্ণ তীর্যক কটাক্ষকে সরসভাবে উপস্থাপন করাটাই সুকুমার সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ জন্যেই বয়স্কদের ক্ষেত্রে যেমন পূর্ণ রস উপভোগে কার্পণ্য ঘটে না, তেমনি উদ্ভটতার প্রতি সরল-স্বাভাবিক আকর্ষণে শিশুরাও নিরীহ আনন্দ থেকে কোনভাবেই বঞ্চিত হয় না। সুকুমার রচনায় এই যে একই সাথে বয়স্ক ও শিশুরা ভিন্ন অবস্থানে থেকেও যার যার নিজস্ব উপলব্ধি দিয়েই পূর্ণ মজা উপভোগ করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন, এখানেই সুকুমার রায়ের আশ্চর্য ক্ষমতা। এই ক্ষমতার গুপ্তঘরে কবি-কল্পনার যে উচ্চ-বিভা তার মায়াবী মোহ নিয়ে সুপ্তি-ঘোরে চুপটি করে থাকে সে-সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের বক্তব্যটিও উদ্ধৃতিযোগ্য-
...সুকুমার রায়ের পৃথিবী- ‘আবোল তাবোল’ যা সত্য হয়ে ফলে উঠেছে তা মোটেই আমাদের চেনাজানা পৃথিবী কিংবা তার প্রতিচ্ছবির মত বাস্তব না হয়েও তেমনি পরিচিত ও তেমনি সত্য। এইখানে কবির সাদাসিধেভাবে সে এক অনন্যসাধারণ শক্তি।

সুকুমার রায় সম্পর্কে গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের প্রণিধানযোগ্য মন্তব্যটি হলো- ‘ছন্দ ও স্পন্দক্রম, ‘Rhyme’ ও ‘Rhythm’-এর অপূর্ব সমন্বয়, নির্মল কৌতুক, শ্লেষমিশ্রিত ব্যঙ্গ, অনুপ্রাস-ধ্বনিঝংকার-যমক এবং সর্বোপরি কবিত্বগুণে সুকুমার রায়ের ছড়া বাংলা ছড়ার ধারায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তাঁর মন্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে আমরাও বলতে পারি, সুকুমার রায়ের ছড়া বাংলা ছড়ার ধারায় চির উজ্জ্বল সংযোজন অবশ্যই। কিন্তু গবেষক শাহেদের গবেষণা সন্দর্ভে সংকলিত ছড়া-বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে সুকুমার-নমুনা হিসেবে এই ‘গানের গুঁতো’ রচনাটাকে মিলাতে গিয়ে কী পাই আমরা ? আধুনিক ছড়ার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রধান যে আটটি শর্ত বা বৈশিষ্ট্যকে চিহ্ণিত করা হয়েছে, এর সাথে আমরা নিশ্চয়ই এবার সুকুমারকে একটু মিলিয়ে দেখতে পারি।

প্রথম বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, ‘ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত বা বিশিষ্ট ভাব কিংবা ভাবের পারম্পর্য নেই।’ কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকলেও ধরে নিলাম রচনাটির মধ্যে উক্ত বৈশিষ্ট্য পুরোদমেই বলবৎ আছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনী থাকে না।’ এখানে এসে সম্ভবত সুকুমারের আলোচ্য রচনাটিতে খানিকটা সন্দেহ আর অপ্রকাশিত রাখার সুযোগ নেই। ভীষ্মলোচনের প্রবল সংগীতানুরাগের ঘটনায় পর্যায়ক্রমিক একটা কাহিনী সুকুমার তৈরি করেই রেখেছেন, যা কিনা শিং বাগানো পাগলা ছাগলের গুঁতো খেয়ে ভীষ্মলোচনের ঠাণ্ডা হওয়ার মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটে। তাহলে আধুনিক ছড়ার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য কি ক্ষুণ্ন হয়ে গেলো না ?  ‘ছড়া ধ্বনি প্রধান, সুরাশ্রয়ী।’ তৃতীয় এ বৈশিষ্ট্যে যেমন কোন সমস্যা দেখা যায় না, তেমনি চতুর্থ বৈশিষ্ট্য ‘ছড়ায় রস ও চিত্র আছে, তত্ত্ব ও উপদেশ নেই’ এবং পঞ্চম বৈশিষ্ট্য ‘ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ’ এর সাথেও কোন সংঘাত চোখে পড়ে না। বরং পুরোমাত্রায় এ বৈশিষ্ট্যগুলো উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্যে এসে ফের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। এখানে শর্ত হলো- ‘ছড়া বাহুল্যবর্জিত, দৃঢ়বদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত।’ বাহুল্যবর্জিত ও দৃঢ়বদ্ধতা কোনোভাবে অতিক্রম করা গেলেও আকারে সংক্ষিপ্ত হবার শর্তটিতে এসে এবার আমাদেরকেই প্রশ্নমুখী হয়ে উঠতে হয়। ছড়ার সংক্ষিপ্ত আকার আসলে কতটুকু ? এ ধরনের নিয়মসিদ্ধ কোন শর্ত কি কোথাও পেয়েছি আমরা ? তবে সাধারণ বিবেচনা দিয়েও আমরা স্বরবৃত্ত চারমাত্রার সাড়েতিন পর্বের পঙক্তি হিসেবে ২ স্তবকে ২০ পঙক্তির কোন রচনাকে নিশ্চয়ই ছোট বলতে পারি না। আর বললেও কেউ মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে ছড়া-বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রচনাটিকে বেশ দীর্ঘই বলতে হবে। অতএব বাকি দুটো বৈশিষ্ট্য- ‘ছড়ার ভাষা লঘু ও চপল’ এবং ‘ছড়ার রস তীব্র ও গাঢ় নয়, স্নিগ্ধ ও সরস’ শর্তানুযায়ী খাপে খাপে মিলে গেলেও আটটি অনিবার্য শর্তের সবকটি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার দণ্ড হিসেবে সুকুমারের ‘গানের গুঁতো’ রচনাটি শেষপর্যন্ত ছড়াপদবাচ্য থেকেই বাদ পড়ে যায়। আর শুধু যে আলোচ্য রচনাটিরই ছড়া-মুক্তি ঘটলো তা-ই নয়, প্রতিনিধিত্বকারী এই রচনাটির সাথে বলা চলে সুকুমার রায়ের ছড়াজাতীয় প্রায় পুরো রচনাবলীরই ছড়ামুক্তি ঘটে যায়।

বিচার মানলে তালগাছ আমার বলার কোন সুযোগ কি আছে ? এখন কেউ যদি পাল্টা প্রশ্ন করে- “আপনি কোন্ সুকুমারের কথা বলছেন ? ছড়াকার সুকুমার রায় বলে তো কেউ নেই! তবে কবি ও শিশু-সাহিত্যিক সুকুমার রায় নামে একজন আছেন!...” কেমন মনে হবে তখন! এখানে উল্লেখ করা নিশ্চয়ই বাহুল্য হবে না যে, সুকুমার রায় নামটি মুখে নিলেই আধুনিক ছড়ার আদর্শ রচয়িতা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের যে চির-উজ্জ্বল মুখটি কল্পনায় ভেসে উঠে, সেই সুকুমার রায়ের প্রশস্ত আকারের প্রায় পাঁচশ’ পৃষ্ঠার হৃষ্টপুষ্ট রচনাসমগ্রটির (তপন রুদ্র সম্পাদিত) মাত্র বত্রিশটি পৃষ্ঠা ব্যয় হয়েছে ছড়া গ্রন্থনায়। বাকি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য কবিতা, গল্প, নাটক, বিবিধ, জীবনী ইত্যাদি। অথচ সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ‘ছড়া আর সুকুমার’ শব্দ দুটোকে আলাদাভাবে ভাবতে মোটেও অভ্যস্ত নই আমরা কেউ !

এই গাঁঠছড়া খুলবে কে?
কবিতার মৌলিক ভাব ও অর্থ-ব্যঞ্জনার সাথে ছড়া বা ছড়াজাতীয় রচনার ভাব, ভঙ্গি ও প্রকরণগত সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। রয়েছে লক্ষ্যবিদ্ধ করার বিষয়-বৈচিত্র্যেও। প্রতিটা শিল্প-মাধ্যমেরই চিহ্ণিত করার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি বা বৈশিষ্ট্য থাকবে এবং থাকা উচিৎ। কথার ঠেলায় চম্পকবাজী চললেও চলতে পারে, কিন্তু শিল্প-বিচারে এই ঠেলাঠেলি আদৌ সঙ্গত ও শোভন কিনা তা না ভেবেই আমরা অনেকেই খেয়ালখুশি অনুযায়ী যেভাবে লেবেল-আটা-সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়ে পড়ছি, তাতে করে যে শিল্প-মাধ্যমের প্রতিই অবিচার করছি, সেদিকটাতে গুরুত্ব দেয়াটাই ভুলে গেছি হয়তো। নইলে লেবেলের তলায় পৌঁছে প্রকৃত বস্তুটার শিল্প-প্রকরণ যাচাই করতে গিয়ে স্বয়ং সুকুমার রায়ই যদি চিহ্ণিতকরণের অপেক্ষায় ঝুলে যান, তাহলে তো সুকুমার পরবর্তী আমাদের প্রচলিত বুলির গোটা ছড়া-সাহিত্যটাই টলে ওঠার কথা ! প্রচলিত অর্থে সুকুমার রায়ের ছড়াগুলো যদি ছড়া-বৈশিষ্টের শর্তানুযায়ী ছড়া না হয়, কাব্য বিচারে সেগুলো আদর্শ কবিতাও না হয় কিংবা পদ্যও না, তাহলে কী ? ছড়ার ভঙ্গি ও স্বভাব অভিন্ন বলে ছড়াজাতীয় রচনাই বলবো ? ‘ছড়াজাতীয় রচনা’ কথাটা তো চিহ্ণিতকরণ সূত্র হতে পারে, চিহ্ণক নয়। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো ?

জানি না প্রশ্নটা অর্বাচীনের মতো হলো কিনা। তবে যে ছড়া-নির্ণায়ক সূত্রের মাধ্যমে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ পেলো, হয় সে সূত্রটাকেই পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে, নয়তো ছড়াজাতীয় রচনাগুলোর পরিচয় বা বৈশিষ্ট্যসূচক নামাঙ্করণের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। ছড়া-বৈশিষ্ট্য বা শর্তের ফাঁদে স্বয়ং সুকুমার রায় পড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সাতচল্লিশপূর্ব ছড়াশিল্প-চর্চাকারী হিসেবে অনেক রথি-মহারথিরাই কুপোকাৎ হয়ে যাওয়া বা তাঁদের অঙ্গহানি ঘটে যাওয়া। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১), কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত (১৮৮৪- ), সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪- ), ত্রিশের দশকের (দশকের হিসাবে ত্রিশ ব্যবহারে মতদ্বৈধতা রয়েছে) সাহিত্যাঙ্গনে ‘স্বপনবুড়ো’ নামে পরিচিত অখিল নিয়োগী (১৯০২-১৯৮৩), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮২), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯) এবং তৎপরবর্তী সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৫-১৯৪৭)। তাঁদের রচনা থেকে উদাহরণ টেনে টেনে শর্ত ও বৈশিষ্টের কষ্টিপাথরে ঘষাঘষি করা যেতে পারে। এতে তালিকা লম্বা হতে থাকবে, ফলাফল বা প্রশ্ন কি পাল্টাবে খুব ?

এই একই বিবেচনায় সাতচল্লিশ-উত্তর কিংবা একাত্তর-পরবর্তী একেবারে সমকালীনে এসেও আমাদের ছড়া-সাহিত্যের আরো বহু উদাহরণ যুক্ত হতে পারে, যা কিনা একইভাবে বৈশিষ্ট্য-নির্ণায়ক ছাঁচে পড়ে একাধারে পরিচিতি খোয়াতে থাকবে। কেননা পূর্বপুরুষের পরিচিতি সংকট দেখা দিলে উত্তরপুরুষে এসে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়াটাই খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যায়। তাই ছড়া নিয়ে এই যে বৈশিষ্ট্যসূচক গাঁঠছড়ার সংকট, তামাদি হয়ে যাওয়ার আগে তা চিহ্ণিত করা জরুরি নয় কি ? কিন্তু কে করবে তা ? চারদিকে আজকাল ছড়ার নামে টনে টনে যা উৎপাদিত হচ্ছে এগুলো কিসের ছড়া, কোন্ পদবাচ্যের, তাই বা কে জানে ! এখানে কি দায়বদ্ধতা বোধ করার মতো যোগ্য কোন বিষয় নেই ?

জানি না এ অর্বাচীন চোখে আমিই কি তিলকে তাল করে দেখছি, না কি যাঁদের দেখার কথা ছিলো সেই চকষ্মানেরাই তাল’কে তিল বানিয়ে রাখছেন, সেই সন্দেহটা মাঝেমধ্যে উঁকিঝুকি দেয় বৈ কি। মীমাংসায় নামলে হয়তো এরও একটা সুরাহা হয়ে যেতে পারতো। আদৌ কি হবে তা ? কিভাবে, কখন ?
...
কৃতজ্ঞতা:
০১)    ছড়ায় বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি/ সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ/ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৌষ ১৩৯৫, ঢাকা।
০২)    বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা/ ওয়াকিল আহমদ/ বইপত্র, এপ্রিল ২০০৭, ঢাকা।
০৩)    শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, বুদ্ধদেব বসু/ সঙ্কলন ও সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ ঘোষ/ বর্ণায়ন, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, ঢাকা।
০৪)    নির্বাচিত প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সম্পাঃ রবিশংকর মৈত্রী/ শুভ প্রকাশন, বইমেলা ২০০৫, ঢাকা।
০৫)    খুকুমণির ছড়া/ যোগীন্দ্রনাথ সরকার/ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, বইমেলা ২০০৬, কলকাতা।
০৬)    সুকুমার রচনা সমগ্র/ সংকলন ও সম্পাদনা: তপন রুদ্র/ সালমা বুক ডিপো, জুন ২০০২, ঢাকা।
০৭)    শিশু কিশোর কবিতার হাজার বছর/ সম্পাঃ কামরুন নাহার শিমুল ও কাজী ইমদাদ/ অনিকেত, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, ঢাকা।
.....

No comments: