Monday, October 17, 2011

| আলগা প্যাঁচাল-০৩ | লাঞ্চবিরতি ও একটি ডিনারপার্টির ভূমিকা |


| আলগা প্যাঁচাল-০৩ | লাঞ্চবিরতি ও একটি ডিনারপার্টির ভূমিকা |
-রণদীপম বসু

“পাছায় কষে না বাইড়ালে বাঙালি সোজা হয় না !” খুব বিজ্ঞের মতো মুখে অনর্গল খই ফুটিয়ে যাচ্ছেন তিনি- ‘গণতন্ত্র ফনতন্ত্র দিয়ে এদেশে কিচ্ছু হবে না ! এই দেশে সামরিক শাসকের কোনো বিকল্প নাই ! সব ধান্ধাবাজ ! ডাণ্ডা ছাড়া বাঙালি ঠাণ্ডা হয় নাকি !! এদের টাইট রাখতে…”
‘আপনার এরকম ধারণার কারণ ?’ মাঝপথে বাগড়া দিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি এমনভাবে আমার দিকে চাইলেন, যেন নতুন করে আমাকে দেখছেন !


 .
লাঞ্চবিরতির প্রাত্যহিক চায়ের আড্ডায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে এরকম গ্যাঁজানি হরহামেশাই হয়। পরিচিত আধা-পরিচিত অপরিচিত নতুন পুরাতন মুখের আনাগোনার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য জড়ো হওয়া শিক্ষিত-আধাশিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত চাকুরেদের খই-ফুটানো কথাবার্তার মধ্যে চলমান বাঙালি আত্মার প্রতিবিম্বটা দেখার সুযোগ পাওয়া কম কথা নয় ! একাডেমিক যোগ্যতা থাকুক আর না-থাকুক, এরা প্রতি বিষয়ে অতি বিজ্ঞ এবং পাণ্ডিত্যে ভয়ঙ্কর আত্মবিশ্বাসী হন। শুধু তা-ই নয়, এক বিস্ময়কর অলৌকিক উপায়ে সব রোগের কারণ সম্বন্ধে অবগত থাকেন এবং সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি চিকিৎসার অব্যর্থ পদ্ধতিটাও বলে দিতে পারেন অনায়াসে ! অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমি নিজেও তো এই বাঙালি ঘরাণারই একজন। অতএব বিজ্ঞতা কারো চেয়ে আমারও কম নাকি !
 .
আমি আমার প্রশ্নের সাথে তাই একথাও জুড়ে দিতে ভুল করলাম না- দেখুন, একজন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে আমরা কি সামরিক শাসনকে সমর্থন করতে পারি ?
“কেন পারবো না !” চল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক আগের চেয়ে আরো তেজি হয়ে ওঠলেন মনে হয়। হয়তো অনেকের মধ্যে তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই অচেতন আত্মভাবনাই তাঁকে আরো বক্তব্য রাখায় উদ্যমি করে তুলেছে- “দেখেন, গণতন্ত্র বিশ্বে সবচেয়ে ভালো মত তা আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু এই দেশের মানুষ গণতন্ত্রের কী বুঝে ? তাই এখানে গণতন্ত্র চলবে না ! দরকার সামরিক আইন। হাসিনা-খালেদার মহিলা শাসন আমল তো আমরা দেখছি, কই, এরশাদের আমলে কি এতো সমস্যা ছিলো ? এখন যে যেভাবে পারে তার মতো বলছে করছে, এরশাদের আমলে কেউ টো ফা করতে পেরেছে ? আবার যেখানে সেখানে উল্টাপাল্টা কথা বলবে ! সব কয়টাকে ধরে..”…
 .
কিন্তু ভদ্রলোক তাঁর কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই এরশাদ-এলার্জিতে আক্রান্ত অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী এবং কথায়বার্তায় বেশ শিক্ষিত তৃতীয় ব্যক্তির আপত্তি উচ্চকিত হয়ে ওঠলো- “ওই হারামির কথা বলবেন না। আপনি কি জানেন সামরিক শাসকরা প্রথমেই কী করে ? এসেই উপরতলার এক-দুইটাকে ধরে আচ্ছামতো প্যাঁদানি দেয়। সাধারণ পাবলিকের যেহেতু প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকে ওইগুলার উপর, তাই পাবলিক খুব মজা পায়। কিন্তু এইটা বিকৃত মজা। আর ভাবে, ওইগুলারেও যখন ছাড়ে নাই, তখন সাধারণ পাবলিক তো এদের কাছে নস্যি ! ফলে যা হবার তাই হয়, পাবলিক পুরা ভদ্রলোক বনে যায়, আর এই সুযোগে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে দেয়।”
“কিন্তু গণতন্ত্রের মতো এতো লুটপাট দুর্নীতি তো তারা করে না…!” প্রথম ভদ্রলোকের মরিয়া হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন।
“করে না মানে ! এসবের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদেরকে দৌড়ের উপর রাখে বলে আপনি টের পান না ভিতরে কিরকম খালি কইরা নিয়া যায় ! তাইলে শুনেন, আমরা আশেপাশে কী দেখি ? যে লোকটি খুব ভালো, তাকে আমরা বলি ‘ফেরেশতার মতো লোক’। কেন ফেরেশতার মতো বলা হয় ? কারণ তারা কোন অন্যায় করেন না। আল্লাহ্তালা নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতারা ওই দায়িত্বের বাইরে যেতে পারে না, অন্য কিছু করতে পারে না, এমনকি তাদের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা বা প্রশ্নও আসে না। একেবারে রোবটের মতো। এখন যে রোবট তৈরি হয়েছে এগুলোর ধারণা আল্লাহতাআলা কুরআনের মধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন ফেরেশতা তৈরির মাধ্যমে। ওখান থেকেই বিজ্ঞানীরা এই রোবট তৈরির ধারণা পেয়েছে। কিন্তু মানুষ রোবট না। তাকে নিজস্ব চিন্তাচেতনা দিয়ে আল্লাহ্তালা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ বানিয়ে ফেরেশতাদেরকে কুর্নিশ করতে বলেছেন। অতএব চিন্তাশীল মানুষদের জন্য দরকার গণতন্ত্র। কেউ কথা বলতে পারে না বলে আপনি ভাবলেন কেমনে যে সামরিক শাসকই ভালো !…”
 .
এবার চতুর্থ নিরীহ ভদ্রলোক আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি অনেকটা কাতর স্বরে কথা বলার ফ্লোর চেয়ে বললেন- “আমি শুধু জানতে চাই, চারদিকে আমাদের এই যে নৈতিকতার এতো অধঃপতন তা রিকভার করার উপায়টা কী ? কিভাবে আমরা এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি ?”
“দেখেন, কুরআনে আল্লাহতালা মানুষের যাকিছু দরকার তার সবই বলে দিয়েছেন। আমরা যদি মুক্তমনে তা সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারি, এনাফ ! তবে গোঁড়ামি বাদ দিয়ে সায়েন্টিফিক ওয়েতে তা ভাবতে হবে। হাদিসে কী দেখি আমরা ? রাসুলুল্লাহ একবার…”
 .
দ্বিতীয় ব্যক্তির এই অসম্পূর্ণ মত সমর্থন করেই প্রথম ব্যক্তি আবার ফ্লোর নিয়ে নিলেন- “সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই উদ্যোগটা নিতে হবে ক্ষমতার একেবারে শীর্ষে যে আছে তার থেকে। ওখানে এখন যারা বসে আছে তাদেরকে দিয়ে কিছু হবে বলে মনে করেন ? এজন্যেই বলি বাঙালিকে ঠিক করতে সামরিক শাসক দরকার। এই জাতি হইলো জাউরা জাতি। এদেরকে টাইটে না রাখলে কোনদিনই শান্তি আসবে না।”
.
ভদ্রলোকের কথায় উত্তর না দিয়ে পারলাম না। ‘কেন, আপনি ঠিক থাকলেই তো হলো ! উপর যদি ঠিক না হয় তাহলে আমরাও ঠিক হবো না নাকি !’
‍”আমি ঠিক থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে আপনি ভাবেন কী করে !”
কথার মোড় যে কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে তা অনুমান করে আমি আবার নাক গলালাম। কিন্তু তার আগে পঞ্চম আরেকজন ছোট্ট একটা উদ্ধৃতি টানলেন- “দাসত্বের জন্যে স্বৈরশাসন, আর স্বাধীন মানুষের জন্য গণতন্ত্র। আমাদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার জন্য আরো সময় লাগবে। ধর্মের মর্মার্থটা যদি আমরা আত্মস্থ করতে পারি তাহলে আমাদের মধ্যে এই জেদাজেদির প্রবণতা কমে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি হবে বলে আমার বিশ্বাস।”
 .
কথায় বলে- রাধা বিনে পিরিত নেই, কানু বিনে গীত নেই। অতএব আমাদের অধিকাংশ মুই কী হনুরে জাতিয় মধ্যবিত্ত কেরাণিমার্কা বাঙালি চিন্তা যে শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত লক্ষ্য ধর্ম আর নৈতিকতায় গিয়ে হাবুডুবু খাবে তা হয়তো আগে থেকেই আচ করে ফেলা যায়, অন্তত বর্তমান প্রোপটে। হতে লাগলোও তা-ই। এ অবস্থায় আমি আর চুপ থাকবো কেন ! অতএব ইদানিং চেষ্টা করে রপ্ত করা অভ্যাসমতে জোর করে নাক ঢুকিয়ে একটা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কিছুটা আজাইরা সময় ব্যয় করতে উদ্যোগী হলাম। তবে উদ্দেশ্য তো একটা ছিলোই।
 .
ক’দিন আগে হোটেল শেরাটন মানে বর্তমান রূপসী বাংলায় প্রথমবারের মতো একটা ডিনার পার্টিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। ওখানে যাওয়ার দুটো কারণ ছিলো। প্রথমত ওই স্পেশাল ডিনারটির আয়োজন করেছিলো দুজন জাপানি ব্যবসায়ী ইয়োশিহো তোয়োদা ও তোহরো ইয়ামামোতো, যাঁরা তাঁদের বিপুল অংকের অর্জিত পুঁজি বিনিয়োগের সম্ভাব্য লক্ষ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন। যাদের মাধ্যমে এরা এসেছে তাদের সাথে সম্পর্কিত এক বন্ধু বৃত্তের বাইরের আমাকে কেন আমন্ত্রণ করলো তার মাজেজা বুঝার দরকার ছিলো। দ্বিতীয়ত আর যদি সুযোগ না পাই, তাই নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের এই সুযোগটাকে অবহেলা না করা।
নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত হয়ে গেলাম, যদি নিজের মাপের চাইতে অনেক উঁচু মাপের এরকম পার্টিতে গিয়ে ভরা পার্টিতে বেইজ্জতির আশঙ্কা থাকে তো আগেভাগেই কেটে পড়বো এরকম একটা সুপ্ত পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু গিয়ে দুই বাদাইম্যা টাইপ জাপানি যুবকের পাল্লায় পড়ে ভুলেই গেলাম যে এরা নিজ দেশে বেশ বড় মাপের ব্যাসায়ী হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে ফেলেছে। দোভাষি বাঙালি তরুণটি জাপানেই লেখাপড়া করছে পাঁচ বছর। সে জাপান-বাংলা তর্জমার মাধ্যমে বুঝতেই দেয়নি যে ভিনদেশির সাথে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথার আদান-প্রদান চলছে। সেখানেই সরাসরি দুই জাপানির কাছ থেকে তাঁদের শিক্ষা সংস্কৃতি ধর্ম সমাজ তথা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে করে জানলাম অনেককিছু। সেই অভিজ্ঞতার সারাংশ থেকে প্রয়োজনীয় বিষয়টা তুলে ধরে বললাম-
 .
দেখেন, জাপানের শক্তিশালী অর্থনীতি সম্পর্কে মনে হয় আমাদের কারো সন্দেহ নেই। সেখানে নাকি প্রত্যেক জাপানি নাগরিক তাদের আয়ের ফিফটি পার্সেন্ট সরকারকে ট্যাক্স হিসেবে দিয়ে দেয়। কেউ ট্যাক্স ফাঁকি দেয় না বা তা চিন্তাও করতে পারে না, কারণ বাকি ফিফটি পার্সেন্টে তাদের জীবনযাপন কোনভাবেই ব্যহত হয় না। অর্থাৎ রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে তার নাগরিকদের কল্যাণেই। তাই রাষ্ট্রও তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উচ্চ অবস্থানে রাখতে সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেই সেখানে আমাদের দেশের মতো অসহায় গরীব ভুখা-নাঙ্গা নাগরিক প্রায় নেই। নগন্য যে ক’জন আছে তারা নিজেরাই সখ করে হয়েছে, কারণ সেখানে জীবিকার কোন অভাবও নেই। এখন প্রশ্ন, সেখানকার নাগরিকরা এই চমৎকার নৈতিকতাবোধ কোত্থেকে পেলো ? জাপানিরা যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্য,  বিনয়ী ও গণতান্ত্রিক জাতি এটা স্বীকার করতে নিশ্চয়ই আমাদের দ্বিধা থাকার কথা না।
 .
দ্বিতীয়ত সরাসরি তাঁদের ভাষ্য হলো, লিখিতভাবে তাঁদের ধর্ম একটা আছে বটে, বৌদ্ধধর্ম, কিন্তু বর্তমানে কেউ তা বিশ্বাসও করে না, পালনও করে না, অর্থাৎ নাস্তিক। কিন্তু তাঁদের সমাজে কোন বিশৃঙ্খলা আছে বলে জানা নেই। অথচ ধর্মকে গুলে খাওয়া জীবনে যাপনে আমাদের মতো দেশেই যত সব ভণ্ডামি, নোংরামি, অভাব, দুঃখ, অসভ্যতা আর অরাজক নীতিহীনতার ছড়াছড়ি ! এর মাধ্যমে কি এটা প্রমাণ হয় না যে, নৈতিকতা অর্জন ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ধর্মের আবশ্যকতা নেই ? বরং ধর্মের বাড়াবাড়ি আর গোঁড়ামিই যতোসব অনষ্টের মূল, একথা বললে কি খুব ভুল বলা হবে ?
 .
প্রথম ভদ্রলোক এবার মনে হয় অনেকটা উত্তেজিত হয়েই বললেন- “আপনি তুলনা টানছেন কেন ! আমি তো প্রথমেই বললাম এই দেশে একমাত্র দরকার সামরিক শাসক ! কেবল সামরিক শাসকই পারবে আমাদেরকে জাপানিদের মতো সোজা ও ভদ্র করে তুলতে, আপনি কি তা বিশ্বাস করেন না ?”
 .
ততক্ষণে হাতের সিগারেট নিঃশেষ হয়ে এসেছে। ধারণা হলো ভদ্রলোক হয়তো অন্য কোন কারণে এমনিতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তাই কিছুটা উষ্মা নিয়েই বলে ফেললাম- দেখেন, নিজের বালখিল্যতা অন্যের উপর না চাপানোই সভ্য মানুষের কাজ। আমি এতোটা অসভ্য নই যে আমার নিজেকে ঠিক রাখার জন্য বর্বর সামরিক শাসককে সমর্থন করতে হবে। বরং আপনিই সিদ্ধান্ত নেন আপনার জন্য কিরকম সামরিক ডাণ্ডা দরকার।
বলেই আর পেছনে না তাকিয়ে গট গট করে হেঁটে চললাম অফিসের দিকে। ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম এই অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ঝাণ্ডাটাকে ধারণ করে বয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে। আমরা কি এগুচ্ছি আসলে ?
(১৬-১০-২০১১)

No comments: