Friday, November 11, 2011

| বৌদ্ধদর্শন| পর্ব-৬/২| মাধ্যমিক বৌদ্ধ দর্শন: শূন্যবাদ|

| বৌদ্ধদর্শন | পর্ব-৬/২ | মাধ্যমিক বৌদ্ধ দর্শন : শূন্যবাদ |
-রণদীপম বসু

(…আগের পর্বের পর)

৫.১ : মাধ্যমিক বৌদ্ধ দর্শন : শূন্যবাদ (Madhyamik Buddhism Shunyabad)
.
মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এই মাধ্যমিক মত সর্বাস্তিবাদীর বস্তুবাদ (realism) এবং যোগাচার সম্প্রদায়ের ভাববাদের (idealism) মধ্যবর্তী। এটাও হয়তো মাধ্যমিক নামকরণের অন্যতম কারণ। বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন (১৭৫ খ্রী.) মাধ্যমিক মতের প্রতিষ্ঠাতা।


.
নাগার্জুনের জীবনী :
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে বিদর্ভদেশের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে নাগার্জুনের জন্ম। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিভাবান বিদ্যার্থী। তৎকালীন সমস্ত ব্রাহ্মণগ্রন্থই তিনি অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করেছিলেন। এরপর তিনি মহাযান বৌদ্ধ তত্ত্ব অধ্যয়নের সময়ে আকৃষ্ট হয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন এবং সমস্ত বৌদ্ধ গ্রন্থ গভীরভাবে পাঠ করে শ্রীপর্বতে (নাগার্জোনি কোণ্ডা, গুন্টুর) বসবাস শুরু করেন। তাঁর খ্যাতিতেই এই স্থানটি তাঁর নামে চিহ্নিত এক প্রসিদ্ধ স্থানে পরিণত হয়। তিনি ছিলেন অন্ধ্ররাজ গৌতমীপুত্র যজ্ঞশ্রীর (১৬৬-১৯৬ খ্রি.) সমকালীন। নাগার্জুনকে চিকিৎসা এবং রসায়নশাস্ত্রের গুরু বলা হয়। তাঁর ‘অষ্টাঙ্গ হৃদয়’ তিব্বতী বৈদ্যগণের নিকট এখনও প্রমাণিত পুস্তক হিসেবে আদৃত। অন্ধ্ররাজ সুহৃৎ সাতবাহনকে সদুপদেশ দেবার নিমিত্তে রচিত ‘সুহৃল্লেখ’ নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থ চীনা ও তিব্বতী অনুবাদে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। বহু গ্রন্থের প্রণেতা নাগার্জুন তাঁর দার্শনিক মত প্রচারের জন্য যেসব গ্রন্থ রচনা করেন তার উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মাধ্যমিককারিকা, যুক্তিষষ্ঠিকা, প্রমাণ-বিধ্বংসন, উপায়কৌশল্য, বিগ্রহব্যবর্তনী, প্রজ্ঞাপারমিতাশাস্ত্র, মহাযানবিংশক প্রভৃতি।
.
নাগার্জুন কারিকাশৈলীর প্রবর্তক। কারিকা হচ্ছে সূত্রাকারে লিখিত কাব্যধর্মী রচনা। কারিকার মাধ্যমে অধিক বিষয়কে সংক্ষিপ্ত শব্দে বলা ও মনে রাখা সুবিধাজনক ও সহজ হয়। দার্শনিক হিসেবে নাগার্জুনকে শূন্যবাদের প্রচারক বলা হয়। সত্তরটি কারিকায় তাঁর রচিত ‘বিগ্রহব্যবর্তনী’ গ্রন্থেরই আরেক নাম ‘শূন্যতা-সপ্ততি’। মাধ্যমিককারিকা তাঁর মতবাদের আধার হলেও বিগ্রহব্যবর্তনীর মাধ্যমে তিনি ন্যায় তর্ক অবলম্বন করে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও শূন্যবাদ প্রমাণের চেষ্টা করেন। তাঁর এই গ্রন্থের প্রথম ২০টি কারিকায় তিনি পূর্বপক্ষের আক্ষেপ তুলে ধরেছেন এবং গ্রন্থের উত্তরার্ধে তার উত্তর দিতে গিয়ে শূন্যতাকে সমর্থন করেছেন।
.
পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ধারণায় সে সময়ে গান্ধারদেশে ভারতীয় ও গ্রিক মতবাদের যে সমাগম হয়েছিলো (১৫০ খ্রীষ্টপূর্ব) তার সাথে নাগার্জুন কোনভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং নাগার্জুন সেই দর্শন-চক্র প্রবর্তিত করেছিলেন যা ভারতীয় দর্শনকে এক সু-ব্যবস্থিত ও অভিনব রূপ দান করেছিলো। তাই নাগার্জুনকে দিয়েই ভারতীয় দর্শনের নব্যযুগ শুরু হয়েছিলো বলা হয়।
.
কেউ কেউ (ড. চন্দ্রধর শর্মা, অধ্যাপক বিধুভূষণ ভট্টাচার্য) নাগার্জুনকে শূন্যবাদের প্রবর্তক বলে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে তাঁর পূর্বেও মহাযানসূত্রে শূন্যবাদের পূর্ণতঃ উল্লেখ রয়েছে। তবে নাগার্জুন সঙ্গতরূপে শূন্যবাদের উপস্থাপন করেছেন। তিনি তাকে ক্রমবদ্ধরূপে উপস্থিত করেছেন এবং ব্যবস্থিতরূপ প্রদান করেছেন।
.
নাগার্জুন তাঁর ‘বিগ্রহব্যবর্তনী’র কারিকায় শূন্যতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন এভাবে- ‘এই শূন্যতাকে যিনি অনুভব করতে পারেন তিনি সবকিছুরই অর্থ অনুধাবনে সক্ষম। যিনি শূন্যতাকে বোঝেন না তিনি কিছুই বোঝেন না।’
.
এর ব্যাখ্যায় এই বৌদ্ধ আচার্য আরো বলেন- ‘যিনি শূন্যতাকে বোঝেন, তিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকেও বোঝেন, যিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকে বোঝেন তিনি চার আর্যসত্যকে বোঝেন, চার আর্যসত্যকে বুঝলে তাঁর তৃষ্ণা নিরোধাদি পদার্থ প্রাপ্তি হয়। তিনি জানতে পারেন ধর্ম কী, তার হেতু ও ফলই বা কী ! অধর্ম, অধর্মের হেতু এবং ফলকেও তিনি জানতে পারেন, জানতে পারেন দুঃখ বা ক্লেশ, ক্লেশের হেতু ও ফলকে। যিনি এই সকল তত্ত্বকে জ্ঞাত হয়েছেন, সুগতি, দুর্গতি কী; সেখানে যাওয়ার এবং বহিরাগমনের পথও তিনি জ্ঞাত হন।’
.
শূন্যবাদের দার্শনিক মত :
শূন্যবাদ বলতে সাধারণত সংসারকে শূন্যময় বুঝিয়ে থাকে। ‘শূন্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্ব না মানা এবং পূর্ণতঃ নিষেধ করা। কিন্তু মাধ্যমিকের শূন্যবাদে ‘শূন্য’ শব্দটি পারিভাষিক অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। মাধ্যমিকের মতে শূন্যের অর্থ শূন্যতা (nihilism) নয়। তাঁদের মতে শূন্য মানে বর্ণনাতীত (indescribable)। নাগার্জুনের মতে পরমতত্ত্ব অবর্ণনীয়। মানুষের বস্তু-অস্তিত্ব প্রতীত হয়, কিন্তু যখন সে তার তাত্ত্বিক স্বরূপ জানতে প্রয়াসী হয়, তখন তার বুদ্ধি কাজ করে না। নিশ্চয় করতে পারে না যে, বস্তুর যথার্থ স্বরূপটি সত্য, না কি অসত্য, কিংবা সত্য ও অসত্য এই উভয় কিনা, অথবা সত্য নয় ও অসত্য নয় এই উভয়াত্মক কিনা ?
.
বৌদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিকরা সাধারণত মনে করেন যে, শূন্যবাদ অনুসারে বাহ্যবস্তু অথবা মানসিক প্রক্রিয়া সবই শূন্য। বস্তু বা মন বলে কোন কিছুরই সত্তা নেই। জড়জগৎ ও মনোজগৎ উভয়ই মিথ্যা। এ মতবাদের সমর্থনে অন্যতম যুক্তিটি হলো- জ্ঞাতা, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান এই তিনটি বিষয় পরস্পর নির্ভরশীল, যেহেতু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তিনটির মধ্যে একটির যদি অস্তিত্ব না থাকে অথবা একটি যদি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, তাহলে অন্যগুলিও মিথ্যা হতে বাধ্য। যেমন কোন ব্যক্তির সন্তানের অস্তিত্বের বিষয়টি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে তার পিতৃত্বও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অথবা, যখন আমরা দড়িকে সাপ বলে জানি তখন প্রকৃতপক্ষে সাপের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং সাপের জ্ঞান মিথ্যা এবং যেহেতু মনের সাহায্যে এই জ্ঞান লাভ করা হয় সেহেতু মনও মিথ্যা। অতএব, বাইরের জগতে অথবা মনোজগতে আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষ করি সবই মিথ্যা। সবই স্বপ্নবৎ অলীক। সুতরাং বস্তু বা মন কোন কিছুরই সত্তা নেই। এই জগত শূন্য। জগতে কোথাও কোন সদ্বস্তু নেই, সবই অসৎ, মিথ্যা ও শূন্য।
.
প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক মতে শূন্যবাদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নাগার্জুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাধ্যমিককারিকা’য় সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মাধ্যমিকদের শূন্যবাদ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর গ্রন্থের ব্যাখাকারদের মধ্যে চন্দ্রকীর্তি অন্যতম।
.
শূন্যবাদ অনুযায়ী, জগতের বিভিন্ন বিষয়কে আমরা সত্য বলতে পারি না, কেননা সত্যের অর্থ হচ্ছে নিরপেক্ষ। যেসব বস্তুকে আমরা জানি সে সব বস্তু কোন-না-কোন বস্তুর উপর নির্ভরশীল। জগতের বিভিন্ন বস্তুকে আমরা অসত্য বলতে পারি না, কেননা তার প্রত্যক্ষ হয়। যা অসত্য তা আকাশকুসুমের মতো কখনো প্রত্যক্ষ হয় না। জগতের বিষয়কে সত্য ও অসত্য এই উভয়াত্মক বলা যায় না, কেননা এরূপ বলা স্ববিরোধী। আবার জগতের বিষয় সত্যও নয় অসত্যও নয় এরূপ বলা যায় না, কেননা এরূপ বলা সম্পূর্ণ আত্মবিরোধী। ফলে বস্তুর স্বরূপ এই চার কোটি হতে মুক্ত হবার দরুন শূন্য বলা হয়। যা তত্ত্ব তা সৎ নয়, অসৎ নয়, সদসৎ নয়, সদসদ্বিলক্ষণ নয়। ফলে মাধ্যমিকগণ এই চারি কোটিবিনির্মুক্ত তত্ত্বকে শূন্য বলেছেন।
.
নাগার্জুনের মতে পরমার্থ সত্যের আলোচনা করতে গেলে অস্তি-নাস্তি, নিত্য-অনিত্য, আত্মা-অনাত্মা প্রভৃতি অন্তিম বাক্যের কোনটি সত্য নয়। পরমার্থ সত্যকে দ্বন্দ্ব শব্দগুলির কোনটি দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা ‘অস্তি’ বললে বস্তুকে শাশ্বত স্বীকার করা হয় এবং ‘নাস্তি’ বললে তাকে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বুদ্ধবচনের সত্য অর্থ গ্রহণ করলে কোনটি স্বীকার করা চলে না।
.
এক্ষেত্রে যোগাচার দার্শনিকরা হয়তো বলতে পারেন যে, বস্তুর অস্তিত্ব না থাকলেও চেতনার অস্তিত্ব আছে। কেননা যোগাচার বিজ্ঞানবাদ দর্শনের মূল বক্তব্য হচ্ছে, একমাত্র বিজ্ঞান বা চেতনাই পরমার্থ সৎ, তদতিরিক্ত কোন বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বাহ্য জগতে যে সকল বস্তুর অস্তিত্বের কথা আমরা চিন্তা করি, সেগুলি আমাদের মনের ভাব বা ধারণামাত্র।
এর উত্তরে মাধ্যমিকরা বলেন, সে বস্তুই যদি না থাকে তাহলে চেতনার সত্তা থাকতে পারে না। কারণ জ্ঞেয় বস্তু না থাকার অর্থ জ্ঞাতার কোন সত্তা না থাকা। সুতরাং বস্তু বা চেতনা কোন পদার্থেরই সত্তা নেই।
.
প্রশ্ন হতে পারে, সকল বস্তু যেহেতু বাস্তবিক এবং তা হতে প্রত্যক্ষ প্রতীতী হয়, অতএব তা সম্পর্কিত জ্ঞান সত্য।
.
কিন্তু মাধ্যমিকরা যুক্তির সাহায্যে জ্ঞানের সত্যতা সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন। সাধারণত মনে করা হয় যে জ্ঞানের মাধ্যমে বস্তুর সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু বস্তুর স্বরূপের মধ্যেই আত্মবিরোধ রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন একটি ঘটকে বস্তুর উদাহরণ হিসেবে নেয়া হয়েছে। ঘটনা হিসেবে যে ঘটকে আমরা সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করি, প্রশ্ন হলো ঘটটি কি একটি সমগ্র বস্তু না অংশের সমষ্টি ? যদি সেটি অংশের সমষ্টি হয়, তাহলে সেটি হবে পরমাণুর সমষ্টি। কিন্তু পরমাণু যেহেতু দৃশ্যমান নয়, সেহেতু ঘটনাটি দৃশ্যমান নয়। যদি বলা হয় এটি একটি সমগ্র বা অখণ্ড বস্তু, তাহলে অংশের সঙ্গে সমগ্রের বা খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
.
অন্যদিকে ঘটটির অস্তিত্ব আছে কি নেই তাও বলা যাবে না। কারণ ঘটটির যদি সকল সময়ই অস্তিত্ব থাকে তাহলে ঘটটি তৈরি করা হয়েছে এমন কথা বলা যাবে না। কিন্তু যদি বলা হয় যে ঘটটির পূর্বে অস্তিত্ব ছিলো না, এখন অস্তিত্বশীল হয়েছে, তাহলে অস্তিত্বশীলতা এবং অস্তিত্বহীনতা অর্থাৎ সত্তা এবং সত্তাহীনতা উভয় বিরুদ্ধ গুণই একই ঘটে আরোপ করা সম্ভব নয়।
.

আবার, কোন বস্তুকে জানতে হলে তাকে অন্য বস্তুর সঙ্গে নির্ভর বা সম্বন্ধযুক্ত করেই জানতে হয়। যেমন একটি বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে হলে বলতে হয় যে বস্তুটি অন্য একটি বস্তুর ডানে বা বামে, উপরে বা নিচে ইত্যাদি। অর্থাৎ বস্তুর নিজস্ব কোন স্বভাব নেই, সকল বস্তুই আপেক্ষিক। যা আপেক্ষিক তা-ই নিঃস্বভাব, যা নিঃস্বভাব তা-ই শূন্য। সুতরাং সবই শূন্য, অর্থাৎ বস্তুর কোন সত্তা নেই। বস্তু বা বিষয়ের এই পরনির্ভরতাকে স্বীকার করা হয় বলেই শূন্যবাদকে সাপেক্ষবাদও বলা যেতে পারে।
.
এই সাপেক্ষবাদ দিয়ে নাগার্জুন প্রতীত্য-সমুৎপাদকেও শূন্যতা বলেছেন। প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুসারে বস্তুর পরনির্ভরতাকেই স্বীকার করা হয়। এমন কোন বস্তু নেই যার উৎপত্তি অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না।
.
তাই মাধ্যমিক দর্শন অনুসারে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার এমন কি বিজ্ঞান- কোনটিরই যথার্থ সত্তা নেই। তাঁদের মতে বুদ্ধ বা তথাগতও ভ্রান্তিমাত্র। তিনি পঞ্চস্কন্ধের সঙ্গে অভিন্ন নন, আবার পঞ্চস্কন্ধের থেকে পৃথকও নন। তিনি বাস্তবিকই শূন্য। জীবদ্দশায় বা নির্বাণের পরে তিনি অস্তিত্বশীল, কি অস্তিত্বশীল নন, বা উভয়ই বা কোনটি নন, তা আমরা বলতে পারি না। অনুরূপভাবে জগৎ অন্তবান কিন্তু অন্তবান নয়, নাকি উভয়ই বা কোনটিই নয়, জগৎ শাশ্বত কি শাশ্বত নয়, নাকি উভয়ই, নাকি কোনটিই নয়- এ জাতীয় চৌদ্দটি বিরোধমূলক প্রশ্ন (যার মধ্যে বুদ্ধের দশ অকথনীয়ও রয়েছে) নাগার্জুনের মতে বুদ্ধির দ্বারা সমাধান করা যায় না। এগুলি আপেক্ষিক, কাজেই এগুলি নিছক অবভাসমাত্র। চারটি আর্যসত্যও মিথ্যা, কারণ এগুলির কোন যথার্থ সত্তা নেই। নির্বাণও ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। বন্ধন ও মুক্তি আপেক্ষিক, সেহেতু মিথ্যা।
.
অনুরূপভাবে জীবাত্মাও মিথ্যা। যদি জীবাত্মা পঞ্চস্কন্ধের সঙ্গে অভিন্ন হয় তাহলে পঞ্চস্কন্ধের মতো এটিও জন্ম মৃত্যুর অধীন হবে। আবার যদি পঞ্চস্কন্ধের থেকে পৃথক হয় তাহলে এটিকে জানা যাবে না। কাজেই জীবাত্মার যথার্থ কোন স্বভাব নেই, জীবাত্মা মিথ্যা। সবকিছুই পরিবর্তনশীল ক্ষণস্থায়ী ও অনিত্য। সবকিছুই আপেক্ষিক। সেহেতু সবই শূন্য।
.
পরাশ্রিত উৎপত্তির অর্থ গ্রহণ করে নাগার্জুন প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, যার উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিনাশ আছে তাকে কখনোই পরমার্থ সত্তা বলা যায় না। আবার বস্তুসত্তার পরমার্থ রূপের আলোচনায় তিনি বলেন- ‘না সৎ আছে, না অসৎ আছে, না সৎ-অসৎ উভয়ই আছে, না সৎ-অসৎ উভয়ই নেই।’
.
‘কর্মের নিমিত্ত (প্রত্যয়) থেকেই বলা যায় কারক আছে। এ ছাড়া অন্য কোনো সত্তার সিদ্ধির কারণ নেই।’ এভাবে কারক ও কর্মের সত্যতা পরস্পরাশ্রিত, অর্থাৎ স্বতন্ত্ররূপে এই দুই সত্তার একটিও সিদ্ধ নয়। আবার যে বস্তু স্বয়ং অসিদ্ধ তা অন্যকে কিভাবে সিদ্ধ করবে ? এই যুক্তিতে নাগার্জুন বলেন, কারও সত্তাকেই সিদ্ধ করা যায় না। সত্তা এবং অ-সত্তা এইরকম একটি অপরটির প্রথম আশ্রিত এবং সেই জন্য তারা পৃথক পৃথক, এবং উভয়ের রূপেও উভয়কে সিদ্ধ করা যায় না।
যেমন, যদিও আমরা গুণের মাধ্যমে দ্রব্যকে জানি, কিন্তু দ্রব্যের সঙ্গে গুণের সম্বন্ধ বোধগম্য নয়। যদি গুণের অস্তিত্বের আগে দ্রব্যের অস্তিত্বের ধারণা করা হয়, তাহলে আমাদের গুণহীন দ্রব্যের ধারণা করতে হবে। তখন প্রশ্ন হবে- গুণ কাকে আশ্রয় করে থাকবে ? গুণ গুণহীন দ্রব্যকে আশ্রয় করে থাকতে পারে না। আবার দ্রব্য বা গুণ ছাড়া গুণ অন্য কাউকেও আশ্রয় করে থাকতে পারে না। আবার গুণও নয়, দ্রব্যও নয়, এমন কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সুতরাং আমরা জানি না, দ্রব্য ও গুণ পৃথক, না অভিন্ন। অতএব দ্রব্য অথবা গুণ কোনটিই বোধগম্য নয়।
.
এই দ্রব্য ও গুণের মতোই, নাগার্জুনের মতে, যে কোন বস্তু বা বিষয়কে জানতে হলে বিভিন্ন সম্বন্ধের মাধ্যমেই জানতে হয়। কেননা বিভিন্ন সম্বন্ধ নিয়েই এই জগৎ। কিন্তু এই সকল সম্বন্ধ স্ববিরোধী হওয়ায় বোধগম্য নয়। কারণ দেশ ও কাল, কারণ ও কার্য, অংশ ও অংশী, গতি ও স্থিরতা, দ্রব্য ও গুণ সব কিছুই স্ববিরোধী। কিন্তু সত্তা স্ববিরোধী হতে পারে না। কাজেই এসব সম্বন্ধের কোন সত্তা নেই। নাগার্জুনের মতে, যেসব সম্বন্ধের মাধ্যমে জগৎ প্রকাশিত হয় সেগুলি স্ববিরোধী ও নিঃস্বভাব।
.
যেমন গতি ও স্থিতি কোনটিই বোধগম্য নয়। গতির অর্থ চলা। পথ চলতে গিয়ে পথকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- যে পথ চলা হয়ে গেছে এবং যে পথ এখনও চলতে বাকি। তৃতীয় কোন বিকল্প সম্ভব নয়। যে পথ চলা হয়ে গেছে সেই পথ আমরা চলছি, অথবা যে পথ চলতে বাকি সেই পথ আমরা চলছি- এই উভয় উক্তিই অর্থহীন। এই দুইপথ ছাড়া তৃতীয় কোন পথের অস্তিত্ব নেই। কাজেই চলা বা গতি বোধগম্য নয়।
.
অপরপক্ষে স্থিতিও বোধগম্য নয়। প্রশ্ন হলো, গতিশীল বস্তুই কি স্থিতিশীল হয়, না কি অগতিশীল বস্তু স্থিতিশীল হয় ? গতিশীল বস্তু স্থিতিশীল হতে পারে না। কারণ গতি ও স্থিতি পরস্পর বিরুদ্ধ। দুই বিরুদ্ধ একই বিষয়ে আরোপ করা চলে না। আবার অগতিশীল বস্তুর স্থিতির কথা বলাও নিরর্থক। আবার গতিশীলও নয়, অগতিশীলও নয়- এমন বস্তুর কথা বলাও অর্থহীন। সুতরাং স্থিতি বোধগম্য নয়।
.
অনুরূপ যুক্তিতে কার্যকারণতত্ত্বও বোধগম্য নয়। কারণ ও কার্য অভিন্ন হলে তাদের দুটি ভিন্ন নামে অভিহিত করার অর্থ হয় না। আবার কারণ যদি কার্য থেকে স্বতন্ত্র হয়, তাহলে কারণকে সেই কার্যের কারণ নয় বলতে হবে। সুতরাং কার্য ও কারণ এক না অভিন্ন তা জানা যায় না, অর্থাৎ কার্যকারণতত্ত্ব বোধগম্য নয়।
.
একইভাবে পরিবর্তনও বোধগম্য নয়। কেননা ‘ক’ যদি নিয়ত ‘খ’ না হয় তাহলে ‘ক’ ‘খ’-তে পরিবর্তিত হয়েছে বলা চলে না। তাছাড়া কার্যকারণতত্ত্ব যেহেতু বোধগম্য নয়, কার্যকারণতত্ত্ব পরিবর্তনকে বোধগম্য করতে পারে না। অতএব, পরিবর্তন বোধগম্য নয়।
.
সংসর্গকেও বোধগম্য বলা যায় না। কারণ সংসর্গের যথার্থ সংজ্ঞা নেই। দুটি বস্তু যদি পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয় তাহলে তাদের মধ্যে সংসর্গ সম্ভব হয় না। আবার দুটি বস্তু যদি পৃথক না হয় তাহলে সংসর্গের প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং সংসর্গ বোধগম্য নয়।
.
এ কারণে লঙ্কাবতারসূত্রে বলা হয়েছে যে, বস্তুর যথার্থ প্রকৃতি বুদ্ধি দিয়ে নির্ণয় করা যায় না, তাই বর্ণনাও করা যায় না। এজন্যে বস্তুকে অনির্বচনীয় ও নিঃস্বভাব বলে দেখানো হয়। বস্তুর যথার্থ প্রকৃতির এই অনির্বচনীয়তাই শূন্যতা। ‘শূন্য অবাচ্য বা চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত।’ অর্থাৎ শূন্য অর্থ সৎ নয়, অসৎ নয়, সৎ ও অসৎ নয়, আবার সৎও নয় অসৎও নয়- এমনও নয়। আচার্যরা বলেন, আমাদের মনে হয় বস্তু আছে। অথচ যখন আমরা বস্তুর অস্তিত্বের যথার্থ তাৎপর্য নির্ণয় করতে চেষ্টা করি, তখন ব্যর্থ হই বা বস্তুর অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যর্থতার জন্যই আমরা বস্তুকে শূন্য বলি।
.
মাধ্যমিক মতে বস্তুর অনির্বচনীয়তা বা শূন্যতা প্রতীত্য-সমুৎপাদ বা বস্তুর শর্তাধীনতা থেকেই নিঃসৃত হয়েছে। এ কারণে নাগার্জুন বলেন, বস্তুর শর্তাধীনতাই শূন্যতা। বুদ্ধ নিজেও প্রতীত্যসমুৎপাদ বা শর্তাধীন অস্তিত্বের মতবাদকে মধ্যপথ বলতেন। বুদ্ধের বক্তব্য অনুসরণ করে নাগার্জুন বলেন যে, শূন্যবাদ প্রতীত্য-সমুৎপাদ সূচনা করে বলে এর নাম মাধ্যমিক পথ।
.
মাধ্যমিকদের সমস্ত বক্তব্য প্রতিভাত জগৎ সম্বন্ধে সত্য হলে প্রশ্ন ওঠে- বুদ্ধ চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে যে বলেছেন সংসার দুঃখময়, সংসারের মূলে রয়েছে কর্ম ও কর্মফল এবং সংসার হতে মুক্তি লাভ করতে হলে সদ্ধর্ম অবলম্বন করা প্রয়োজন, এ বিষয়কে মাধ্যমিকরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন ? কেননা নাগার্জুনের শূন্যবাদ অনুযায়ী দুঃখ, সংসার, কর্ম, কর্মফল এসব কিছু নেই। এক্ষেত্রে বুদ্ধবচন কিভাবে সঙ্গত হয় ?
.
উত্তরে নাগার্জুন বলেন, বুদ্ধবাক্য মিথ্যা নয়। প্রথম থেকেই দু’প্রকার সত্য স্বীকার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে সংবৃতি বা ব্যবহারিক (empirical) সত্য, অন্যটি পারমার্থিক (transcendental) সত্য। প্রথমটির আবশ্যক হচ্ছে সাধারণ লোক ব্যবহারের জন্য এবং তার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধনমার্গে যারা অনুন্নত অর্থাৎ শ্রাবক তাদের চালিত করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উন্নত সাধক যারা গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে চায় তাদের জন্য। তাঁদের মতে, এই প্রতিভাত জগতের অন্তরালে একটি অপ্রতিভাত সত্তা রয়েছে যে সত্তা প্রসঙ্গে বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদের শিক্ষা প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ, প্রতীত্য-সমুৎপাদ কেবলমাত্র আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুর সম্বন্ধেই সত্য। যে সাধক নির্বাণ লাভ করেছেন তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন তাতে প্রতীত্য-সমুৎপাদের ব্যবহার নেই। যারা এই দু’প্রকার সত্যের পার্থক্য বোঝে না, তারা বুদ্ধদেবের শিক্ষার গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে না।
.
সংবৃতি সত্য থেকেই পরমার্থ সত্যে পৌঁছাতে হয়। অবিদ্যা, মোহ প্রভৃতিকে সংবৃতি সত্য বলা হয়। এই সত্য আবার দুই প্রকার- (১) তথ্য সংবৃতি : যা কোন কারণ হতে উৎপন্ন হয় এরূপ বস্তু বা ঘটনা, যাকে সত্য মেনে সাংসারিক ব্যবহার হয়। (২) মিথ্যা সংবৃতি : যা কারণ হতে উৎপন্ন হয় এমন বস্তু বা ঘটনা, কিন্তু তাকে সত্য বলে মানা হয় না। এতে লোকব্যবহার হয় না। পারমার্থিক সত্য হচ্ছে নিরপেক্ষ। পারমার্থিক সত্যের প্রাপ্তি নির্বাণে হয়। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দুঃখ, সংসার, কর্ম, কর্মফল প্রভৃতি সকলই আছে, কিন্তু পরমার্থতঃ এ সমস্তই শূন্য। স্বভাবশূন্যতা হচ্ছে একমাত্র সত্য। নির্বাণের অবস্থা বর্ণনা ভাবাত্মকরূপে সম্ভব নয়। তার বর্ণনা নিষেধাত্মকরূপে হতে পারে। নাগার্জুন নির্বাণের নকারাত্মক বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যা অজ্ঞাত, যা নিত্য নয়, যার বিনাশও সম্ভব নয় তাকে নির্বাণ বলে। মাধ্যমিক মতে সর্বত্র শূন্যতার দর্শন হচ্ছে নির্বাণ। তা দুঃখের অপুনরুৎপাদশূন্য দুঃখনিবৃত্তিরূপ।
.
নির্বাণ সাধারণ অভিজ্ঞতায় বর্ণনা করা যায় না। অনুরূপভাবে যিনি নির্বাণ লাভ করেছেন তাঁরও বর্ণনা দেওয়া যায় না। সম্ভবত এ কারণেই দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কিত প্রশ্নে বুদ্ধ সর্বদা অবক্তব্য বলে নীরব থাকতেন।

(চলবে…)
[ব্যবহৃত ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
[আগের পর্ব : বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায় ][*][ পরের পর্ব : যোগাচার বৌদ্ধদর্শন বিজ্ঞানবাদ ]
[ তথ্য-গ্রন্থসূচি ][ বৌদ্ধদর্শন অধ্যায়সূচি ]

No comments: