Monday, December 24, 2012

| সাংখ্য দর্শন-০৯ : সাংখ্যমতে মোক্ষ বা কৈবল্য |



| সাংখ্য দর্শন-০৯ : সাংখ্যমতে মোক্ষ বা কৈবল্য |

রণদীপম বসু

.: সাংখ্যমতে মোক্ষ বা কৈবল্য

সাংখ্যমতে, আত্মা বা পুরুষে যে সুখ-দুঃখ-মোহাদিরূপ প্রাকৃতিক ধর্ম উপচারিত হয়, তার তিরোধানই হলো মুক্তি। এই মুক্তি-প্রাপ্তিকে সাংখ্য দর্শনে কৈবল্য-প্রাপ্তি বলা হয়, এবং এই কৈবল্যই সাংখ্য দর্শনে পরম পুরুষার্থ।

 .
মহর্ষি কপিল বা অন্যান্য সাংখ্যাচার্যগণ ত্রিতাপ দুঃখভোগকে আত্মার বন্ধনের ফল বলেছেন। এই ত্রিতাপ দুঃখ কী ? সকল জীবই এ সংসারে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক- এই ত্রিবিধ দুঃখভোগ করে। শারীরিক ও মানসিক দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। বজ্রপাত, ভূকম্পন প্রভৃতি দৈব-দুর্বিপাক বশত জীবের যে দুঃখ হয়, তাকে বলে আধিদৈবিক দুঃখ। মানুষ ও অন্যান্য পশুপক্ষিজনিত প্রাপ্ত দুঃখকে বলা হয় আধিভৌতিক দুঃখ। মোটকথা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীব এই ত্রিবিধ দুঃখের কবলে পতিত হয়। এই যে দুঃখের কবলে পতিত হওয়া, সাংখ্যমতে একেই পুরুষের বদ্ধাবস্থা কিংবা সংসারদশা বলা হয়েছে।
 .
এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে মানুষ যুগে যুগে নানা উপায় খুঁজেছে, উদ্ভাবন করেছে। ঔষধ সেবনে রোগাদিজনিত দুঃখ থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণ পাওয়া গেলেও তা দিয়ে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না। সুষুপ্তিতে যে দুঃখের নিরসন হয়, তাও আত্যন্তিক নয়। পুনর্জাগরণে পুনরায় সেই দুঃখভোগ শুরু হয়। যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়া এবং দৃষ্ট ও লৌকিক কোন উপায়ই দুঃখের আত্যন্তিক বা চির নিবৃত্তি দিতে পারে না। বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ে এই দুঃখের চির নিবৃত্তির উপায় খোঁজা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকরা তত্ত্বজ্ঞানকেই মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করেন। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ করতে দ্বিতীয় কারিকায় বলেছেন-
ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ’-
অর্থাৎ, ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ-এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয়।
 .
ব্যক্ত’ হলো পরিণামপ্রাপ্ত সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থসমূহ, ‘অব্যক্ত’ হলো প্রকৃতি এবং ‘জ্ঞ’ হলো পুরুষ বা আত্মা। এই ত্রয়ের বিবেকজ্ঞান বা ভেদজ্ঞানই সর্ববিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। অপরদিকে ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং জ্ঞ- এই ত্রয়ের অবিবেক বা অভেদজ্ঞানই জীবের সর্ববিধ বন্ধনজনিত দুঃখের হেতু।
 .
সাংখ্যমতে পুরুষ স্বরূপত নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব। সুতরাং স্বরূপত পুরুষ বদ্ধ হয় না, আবার মুক্তও হয় না। বুদ্ধির ধর্ম যখন পুরুষে প্রতিফলিত হয়, তখন অবিদ্যাবশত পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এক বলে মনে করে। এর ফলে মনের বৃত্তিগুলি যথা- সুখ, দুঃখ ও মোহকে বিবেকজ্ঞানহীন পুরুষ নিজের মনে করে অর্থাৎ নিজেকে কর্তা বা ভোক্তা বলে মনে করে। পুরুষ বা আত্মার এই অবস্থার নাম বন্ধনদশা। এর ফলে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির সুখ-দুঃখাদি পুরুষে আরোপিত হয়। পুরুষ যখন অবিদ্যামুক্ত হয়ে চৈতন্য স্বরূপে অবস্থান করে, তখন সেই পুরুষের অবস্থাকে বলা হয় মুক্তাবস্থা।
 .
সাংখ্যমতে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞানই মুক্তির পথ। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা সূক্ষ্মতম ভেদ লক্ষিত হয়। ক্ষণে যে পরিণাম হয়, তাই সূক্ষ্মতম ভেদ। বিবেকজ্ঞান এই সূক্ষ্মতম ভেদের জ্ঞান। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ বা পুরুষের বিবেকজ্ঞান এই ত্রিতত্ত্বেও স্বরূপকে প্রকাশ করে। এর ফলে পুরুষের স্ব-স্ব রূপে অবস্থান হয় এবং পুরুষ কৈবল্য বা মোক্ষ লাভ করে। পুরুষের আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠাই হলো কৈবল্য।
 .
অপরোক্ষ বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয় বলে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। আবার সকল দুঃখের নিবর্তক বলে এই জ্ঞান আত্যন্তিক। যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী বলে এই জ্ঞান অক্ষয়। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের বিবেকজ্ঞান উৎপন্ন হলে বুদ্ধিধর্ম পুরুষ থেকে অপসৃত হয়। এ অবস্থায় পুরুষের সুখ, দুঃখ ও মোহ কিছুই অনুভূত হয় না। আত্মার এই শুদ্ধাবস্থাই সাংখ্যশাস্ত্রে মোক্ষাবস্থা বা কৈবল্যাবস্থা বলে পরিচিত।
 .
তবে সাংখ্যমতে জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি নামে দ্বিবিধ মুক্তিই স্বীকৃত। দেহের বর্তমানে বন্ধনের মূলোচ্ছেদ হলে জীবের যে মুক্তিলাভ হয়, তাই জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্তিতে জীবের সূক্ষ্ম সংস্কার বর্তমান থেকে যায়। দেহের বিনাশে এই সংস্কারের বিনাশ হয়। সকল প্রকার সংস্কারমুক্ত পুরুষের স্বরূপে অবস্থানই বিদেহমুক্তি বা পরম কৈবল্যাবস্থা।
 .
ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি মোক্ষ বা মুক্তিকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করলেও মুক্তির স্বরূপ সম্পর্কে তারা একমত হতে পারেননি। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতিরও অবস্থা নয়। কারণ সুখ ও দুঃখ আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ-দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন।
 .
এই মতে, মুক্তাবস্থায় পুরুষের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়। বুদ্ধির সঙ্গে সে আর নিজেকে অভিন্ন বলে মনে করে না। এই অবস্থাকে বোঝাতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ পঁয়ষট্টি নম্বর কারিকায় বলেন-
তেন নিবৃত্তপ্রসবামর্থবশাৎ সপ্তরূপবিনিবৃত্তাম্ ।
প্রকৃতিং পশ্যতি পুরুষঃ প্রেক্ষকবদবস্থিতঃ স্বস্থঃ।।’- (সাংখ্যকারিকা-৬৫)
অর্থাৎ : সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা পুরুষ-প্রকৃতি বিবেকজ্ঞান-রূপ সিদ্ধ হওয়ায় স্ব-স্বরূপে অবস্থিত পুরুষকে তখন সপ্তভাবশূন্যা প্রকৃতি স্পর্শ বা প্রভাবিত করতে পারে না এবং দর্শকের ন্যায় পুরুষ তখন উদাসীন, অসঙ্গ ও নির্বিকার।
 .
বিবেকজ্ঞান যুক্তির দ্বারা বা গ্রন্থাদি দ্বারা প্রামাণ্য নয়। আত্মাকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করতে হলে দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। বিবেকজ্ঞান, সাধনবল ও সাংখ্যোক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞানের দ্বারা জীব এইরূপ মোক্ষাবস্থা লাভ করে।
(চলবে…)

No comments: