Sunday, December 30, 2012

| যোগ দর্শন-০৫ : যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব |

.
| যোগ দর্শন-০৫ : যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব |
রণদীপম বসু

৫.০ : যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব

ভারতীয় জনশ্রুতি অনুসারে সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর সাংখ্য এবং যোগদর্শন সেশ্বর সাংখ্যরূপে গণ্য হয়। অর্থাৎ, সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু সাংখ্যকথিত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ছাড়াও যোগ দর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। তবে অন্যান্য ঈশ্বরবাদী দর্শনের মতো যোগদর্শনে জগতের সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়নি। এখানে ঈশ্বর প্রধান নয়, আবার পুরুষমাত্র নন। তিনি ঐশ্বর্যযুক্ত, চিত্তবান, সদামুক্ত, পুরুষবিশেষ।

যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি লাভের অন্যতম উপায় বলে মনে করেন। যোগসূত্রের সমাধিপাদে ঈশ্বরের উল্লেখ ও নিরূপণ করে বলা হয়েছে-

‘ঈশ্বরপ্রণিধানাৎ বা’- (যোগসূত্র : ১/২৩)
অর্থাৎ : সমাধি ও তার ফললাভের জন্য ঈশ্বর-উপাসনা ও ঈশ্বরে সর্বসমর্পণ করা।
 .
পতঞ্জলি বর্ণিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভের উপায় অষ্টাঙ্গিক যোগের একটি তথা দ্বিতীয় যোগাঙ্গ হলো নিয়ম। ঈশ্বরপ্রণিধান নিয়মেরই অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বরচিন্তা সমাধিলাভে সহায়ক হয়। তাছাড়া ঈশ্বর ধারণারও বিষয় হতে পারেন এবং তার ফলে সমাধিপ্রাপ্তি ত্বরান্বিত হতে পারে। পতঞ্জলি ঈশ্বরের এই ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়া কোন তাত্ত্বিক প্রয়োজনের কথা বলেন নি। সমাধি লাভের বিকল্প উপায়রূপেই তিনি ঈশ্বরপ্রণিধানের কথা বলেছেন। ঈশ্বরপ্রণিধান হলো ঈশ্বরে সর্বকর্ম অর্পণপূর্বক তাঁর নিরন্তর ভাবনা, শুধু কর্ম অর্পণমাত্র নয়। তাই ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার ভক্তি।  ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ বা আমিত্বকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদনের ফলে ঈশ্বর সাধককে ইচ্ছার দ্বারা অনুগৃহীত করেন এবং সাধকের সমাধিলাভ সমাসন্ন হয়। পতঞ্জলির পরবর্তীকালের যোগ দার্শনিকরা যোগদর্শনে উক্ত ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়াও ঈশ্বরের তাত্ত্বিক প্রয়োজন স্বীকার করেছেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নানা প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে।
 .
ঈশ্বরের লক্ষণ প্রসঙ্গে পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-

‘ক্লেশ-কর্ম-বিপাকাশয়ৈঃ অপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ’- (যোগসূত্র : ১/২৪)
অর্থাৎ : ঈশ্বর হলেন ক্লেশ, কর্ম, বিপাক এবং আশয় দ্বারা অপরামৃষ্ট পুরুষ বিশেষ।
 .
অপরামৃষ্ট অর্থ প্রভাবিত না হওয়া। যোগশাস্ত্রে ঈশ্বর কখনোই পুরুষ বা প্রকৃতির স্রষ্টা নয়। তবে তিনি পুরুষবিশেষ। ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়ের দ্বারা বদ্ধ না হওয়াই তার বৈশিষ্ট্য।
যোগশাস্ত্রে পঞ্চবিধ ক্লেশের কথা বলা হয়। এই পঞ্চক্লেশ হলো- অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ বা মৃত্যুভয়। এই পঞ্চক্লেশ ঈশ্বরকে কখনোই স্পর্শ করে না, যেহেতু ঈশ্বর ঐ সকল ক্লেশের মূল অবিদ্যারহিত।
 .
কর্ম হলো পাপ ও পূণ্য। যোগদর্শনে কর্মকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ধর্ম এবং অধর্ম। ধর্ম হলো বেদবিহিত কর্ম এবং অধর্ম হলো বেদনিষিদ্ধ কর্ম। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বিধি অথবা নিষেধ সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ ঈশ্বর যেহেতু আপ্তকাম, সেহেতু তার কর্মে প্রবৃত্তি অসম্ভব। ফলে ঈশ্বর পাপ-পূণ্যরহিত।
 .
বিপাক অর্থ কর্মফল। কর্মফল তিনটি, যথা- জাতি, আয়ু এবং ভোগ। জাতি বলতে বোঝায় আমরা কোন্ পরিবেশে জন্মাবো। যেমন, আমি সৎ ও শুচি পিতামাতার সংসারে জন্মাবো না-কি কৃমিকীটের সন্তান হয়ে জন্মাবো তা নির্ভর করে আমারই কর্মের উপর। সৎ কর্মের ফল হলো পূণ্য এবং অসৎ কর্মের ফল হলো পাপ। এই পূণ্য এবং পাপ সঞ্চিত থাকার ফলে আমাদের সুখ এবং দুঃখভোগ হয়। সুখভোগ এবং দুঃখভোগের দ্বারাই সঞ্চিত কর্মফলের ক্ষয় হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোগের জন্য প্রয়োজন হলো নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল। এইজন্য দ্বিতীয় বিপাক হিসেবে আয়ুর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, কর্মের ফলের জন্য ব্যক্তির আয়ু নির্দিষ্ট হয় এবং সুখ-দুঃখের ভোগের ব্যবস্থা হয়। যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু তার জাতি, আয়ু ও ভোগরূপ বিপাক থাকতে পারে না।
 .
আশয় হলো সংস্কার বা কর্মফল জন্য বাসনা। সংস্কার অর্থ এক্ষেত্রে পূণ্য কর্মজন্য অথবা পাপ কর্মজন্য সংস্কার। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু আশয়ও নেই।
 .
ঈশ্বরকে পুরুষবিশেষ বলার হেতু হলো, ঈশ্বর অন্যান্য পুরুষ বা আত্মা থেকে ভিন্ন। ঈশ্বরভিন্ন অন্যান্য পুরুষ কৈবল্যপ্রাপ্ত হন এবং যখন কৈবল্যপ্রাপ্ত হন তখন তিনিও ক্লেশাদিঅপরামৃষ্ট থাকেন। মুক্ত পুরুষের ক্লেশ প্রভৃতি মুক্তি বা কৈবল্যপ্রাপ্তির পূর্বে ছিলো, বর্তমানে নেই। কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ক্লেশ প্রভৃতি কোনকালেই ছিলো না। ঈশ্বর কৈবল্যপ্রাপ্ত হন না। ঈশ্বরের সঙ্গে কৈবল্যের বর্তমান, ভূত বা ভাবী কোন সম্বন্ধই নেই। এজন্য ঈশ্বর মুক্ত পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র। তিনি সদামুক্ত। তিনি বর্তমানে, অতীতে বা ভবিষ্যতে কৈবল্যপ্রাপ্ত হবেন এমন নন। বাচস্পতি মিশ্রের মতে জ্ঞান, ক্রিয়া, শক্তি প্রভৃতি সম্পদই ঈশ্বরের স্বরূপ বা ঐশ্বর্য। ঈশ্বরের ঐশ্বর্য সর্বাপেক্ষা মহৎ। এই ঐশ্বর্য অসাম্য ও নিরতিশয়। এই ঐশ্বর্যের তুল্য অথবা তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য আর কারোর থাকতে পারে না। তাই বলা যায়, কাষ্ঠাপ্রাপ্ত ঐশ্বর্যযুক্ত বিলক্ষণ পুরুষই ঈশ্বর। সুতরাং, ঈশ্বর নামক পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব।
 .
যোগদর্শনে ত্রিবিধ বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার বন্ধন হলো- প্রাকৃতিক, বৈকৃতিক ও দাক্ষিণ।
প্রকৃতিলীনদের প্রাকৃতিক বন্ধন, বিদেহলীনদের বৈকৃতিক বন্ধন এবং দক্ষিণা-নিষ্পাদ্য যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকারীদের দাক্ষিণ বন্ধন। সাধারণ কৈবল্যপ্রাপ্ত পুরুষগণ এই ত্রিবিধ বন্ধনের অধীনতার বশবর্তী ছিলেন এবং কালক্রমে তা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বরকে এসকল বন্ধন কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারে না। তাছাড়া ঈশ্বর সর্বজ্ঞ হলেও অন্যান্য পুরুষের ন্যায় চিত্তবৃত্তি তাঁর থাকে না। ঈশ্বরে চিত্ত স্বীকার করলেও সে চিত্ত হবে নির্মাণচিত্ত। পরম করুণাময় জীবের দুঃখ-ক্লেশ দূর করার জন্য চিত্ত গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর চিত্ত নির্মিত হয়। রজস্তম অপহত এরূপ সাত্ত্বিক চিত্তকেই নির্মাণ চিত্ত বলা হয়।
 .
যোগমতে পরমপুরুষ ঈশ্বর কিন্তু জগৎস্রষ্টা নন। নৈতিক দিক থেকে জীবের অদৃষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং অদৃষ্ট অনুযায়ী প্রকৃতির বিবর্তনের জন্য ঈশ্বরকে প্রকৃতি-পুরুষ সংযোগের নিমিত্ত কারণ বলা হয়। কিন্তু তিনি স্বয়ং জগৎ সৃষ্টি করেন না। জগৎ সৃষ্টি যোগমতে ব্রহ্মার কাজ। শ্রুতিতে বলা হয়েছে দেবতাদের মধ্যে হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা প্রথম উৎপন্ন হয়েছিলেন। তিনিই বিশ্বের কর্তা এবং ভুবনের পালয়িতা। স্মৃতিতে আছে, জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা মুক্তপুরুষ নন। পরে তাঁর মুক্তি হয়। নিত্যমুক্ত ঈশ্বরের পক্ষে জগৎ সৃষ্টি তাই যুক্তি-বিরুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরোধী। ঈশ্বরের উপদেশ অনুযায়ী ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেন। যোগমতে সৃষ্টিকালে ও কল্পান্তে ব্রহ্মাদি দেবগণের সৃষ্টি ও বিনাশ হয়। কিন্তু ঈশ্বর সৃষ্টি-বিনাশরহিত। তিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন নন। তিনি শুধু সাধারণ জীবেরই গুরু বা উপদেষ্টা নন, পূর্বাপূর্ব সৃষ্টিকর্তাদের তথা গুরুদেরও গুরু বা উপদেষ্টা।
 .
.
যোগশাস্ত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ
মহর্ষি পতঞ্জলি পৃথকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে কোন প্রমাণ দেননি। ঈশ্বরের প্রণিধান প্রসঙ্গেই তিনি ঈশ্বরের লক্ষণ বা পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে যোগসূত্রের সমাধিপাদে তিনি বলেন-

‘তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্’- (যোগসূত্র : ১/২৫)
অর্থাৎ : ঈশ্বরেই সর্বজ্ঞবীজ নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
 .
পরবর্তীকালে এই সূত্রটিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী যোগ দার্শনিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অনুমান ও আগমপ্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের উপস্থাপিত প্রমাণগুলি নিম্বরূপ।
 .
(১) প্রথমত, যে জিনিসের মাত্রাভেদ আছে তার একটি উচ্চতম বা চরমতম এবং নিম্নতম বা ন্যূনতম মাত্রা থাকতে বাধ্য। উচ্চতম বা চরমতম মাত্রাকে বলে কাষ্ঠা। জ্ঞান ও শক্তির মাত্রাভেদ আছে। ব্যবহারিক জীবনে কোন জীবের জ্ঞান ও শক্তি বেশি আবার কারো কম। যেখানেই আমরা অল্প, বহু, বহুতর, বহুতম- এইভাবে ক্রমবর্ধমান কোন গুণকে সাজাই, সেখানেই যুক্তিসঙ্গতভাবে আমাদের একটি নিরতিশয় বা পরাকাষ্ঠা স্বীকার করতে হয়। সর্বজ্ঞতার বিচারে প্রাণীদের এরূপ ক্রমিক তারতম্যের প্রেক্ষিতে পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির একটি নিরতিশয় পরাকাষ্ঠাও স্বীকার করতে হবে। পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী কোন সসীম জীব হতে পারে না। অতএব, পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী এক সর্বজ্ঞবীজস্বরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 .
(২) দ্বিতীয়ত, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। যোগদর্শন আস্তিক দর্শন। এই দর্শন বেদ তথা বেদানুসারী শাস্ত্রসমূহে বিশ্বাসী। শ্রুতিতে নিত্য, শুদ্ধ, মুক্তস্বভাব ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বেদ যদি অভ্রান্ত হয় তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।
প্রশ্ন হতে পারে, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি যেসব শাস্ত্র ঈশ্বরের রচিত বলে স্বীকার করা হয়, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিভাবে প্রমাণ করে ? এর উত্তরে যোগভাষ্যকার বেদব্যাস বলেন, বেদের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। যদিও ঈশ্বর বেদের রচয়িতা তবু অস্তিত্বের দিক থেকে বিচার করলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেদের অস্তিত্বের পূর্বে। অতএব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
 .
(৩) তৃতীয়ত, প্রকৃতির অভিব্যক্তির নিমিত্তকারণরূপেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। পুরুষের সঙ্গে সংযোগ ভিন্ন প্রকৃতির অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। অচেতন প্রকৃতি ও সচেতন পুরুষের স্বাভাবিক সংযোগ সম্ভব নয়। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় তার পক্ষে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা সম্ভব নয়। আবার প্রকৃতি অচেতন হওয়ায় তার পক্ষে পুরুষের অবস্থান জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া জগৎ সৃষ্টি বা প্রকৃতির বিবর্তন জীবের অদৃষ্ট অনুসারেই হয়। জীবের অদৃষ্ট সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। সুতরাং স্বীকার করতে হয় যে, অদৃষ্টানুসারে ঈশ্বর জগতের বিবর্তনের ইচ্ছা করেন এবং তাঁরই ইচ্ছায় প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ সম্ভব হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যতীত এসব সম্ভব নয় বলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 .
(৪) চতুর্থত, সৃষ্টির আদিতে বা অতীত সৃষ্টিতে যে মোক্ষজ্ঞান ও মোক্ষাভিলাষ পরিলক্ষিত হয়, সেই জ্ঞানের উন্মেষের জন্য কোন জ্ঞানী গুরু স্বীকার করা প্রয়োজন। কিন্তু এই জ্ঞানের কারণ হিসেবে কোন মানুষ অথবা স্বর্গের কেউ গুরু, একথা বলা যায় না। কারণ, যোগমতে কপিলাদি পূর্বাচার্যগণ এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ কালাবচ্ছিন্ন। কল্পেই তাঁদের আবির্ভাব আবার কল্পান্তে তাঁদের বিনাশ হয় বলে শ্রুতিতে উক্ত হয়েছে। যেহেতু তাঁরা সকলেই সীমিত, সেহেতু তাঁদেরও গুরু ছিলেন, একথা স্বীকার করা প্রয়োজন। ফলে অতীত ও অনাগত সৃষ্টিতে মোক্ষজ্ঞানের বা প্রকর্ষগতির হেতুরূপে কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ নন এমন একজন গুরু স্বীকার করতে হবে যিনি অনাদি ও অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। সেই গুরুই নিত্যমুক্ত ঈশ্বর। এজন্যেই যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-

‘স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ’- (যোগসূত্র : ১/২৬)
অর্থাৎ : তিনি (ঈশ্বর) অনাদি গুরু, যিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ নন।
 .
যোগমতে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’-কার শব্দ ঈশ্বরের বাচক শব্দ। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-

‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ’- (যোগসূত্র : ১/২৭)
অর্থাৎ : প্রণব বা ওঁকারই ঈশ্বরের বাচক।
 .
প্রতিটি বস্তুরই একটি বাচক শব্দ আছে। বাচ্য পদার্থ এবং বাচক শব্দের সম্বন্ধ হলো নিত্য অর্থাৎ স্বাভাবিক। তাই বাচক শব্দটি উচ্চারণ করলে বাচ্য পদার্থের একটি আকার বা চেহারা আমাদের মনে ভেসে ওঠে। যেমন- ‘গরু’ শব্দ উচ্চারণ করলে শিং ও লেজযুক্ত একটি পশুর আকার আমাদের মনে ভেসে ওঠে। অর্থাৎ বাচক শব্দের দ্বারা বাচ্যপদার্থ জ্ঞাত হয়। তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থসমূহ বাচক শব্দ ছাড়াও জ্ঞাত হতে পারে, যেমন নীল সবুজ ইত্যাদি বর্ণ বা বৃক্ষাদি দ্রব্য।
কিন্তু সব পদার্থ এরূপ নয়। ‘পিতা’, ‘পুত্র’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ কেবলমাত্র শব্দশ্রবণ বা শব্দস্মরণের মাধ্যমেই হতে পারে। যিনি পুত্র উৎপাদন করেন তিনিই পিতা। তাই ‘পিতা’ শব্দের অর্থ নির্ধারণ বিষয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার উপর নির্ভর করে না। অনুরূপভাবে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’ শব্দ সংকেতমাত্রের দ্বারাই বোধব্য। এ স্থলে বাচ্য-বাচক সম্বন্ধ প্রদীপপ্রকাশবৎ। প্রদীপ যেমন স্বভাবতই প্রকাশস্বভাব, তেমনি ‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই ঈশ্বর বা ‘ওঁ’ শব্দের অর্থ অন্তরে প্রকাশিত হন।
 .
‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই যার নিকট সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের স্মৃতি উপস্থিত হয় তিনিই বিজ্ঞ যোগী। সেইরূপ যোগীর দ্বারা প্রণবের জপ ও তাঁর ভাবনাই হলো ঈশ্বর-প্রণিধান। নিরন্তর প্রণব জপ থেকে চিত্তের একাগ্র সম্পাদিত হয়। এবং এইভাবে ঈশ্বরের প্রণিধানের মাধ্যমে সমাধিস্থ যোগীর আত্ম-চৈতন্য অধিগত হয়। আত্ম-চৈতন্যের এরূপ উপলব্ধি ও তার কারণরূপ পুরুষের স্বরূপতা নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত স্বভাবে অবস্থানকেই কৈবল্য বলে।
 .
উল্লেখ্য, মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে এভাবে ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি বা কৈবল্যলাভের বিকল্প উপায় বলে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তী পরিচ্ছদ সাধনপাদে অন্যতম যোগাঙ্গ ‘নিয়ম’-এর আলোচনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরপ্রণিধানের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে এটি সমাধিলাভের পক্ষে অবশ্যকর্তব্য।
এখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বরপ্রণিধান করতে হলে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা- এই চারটি ভাবনার অভ্যাস করতে হবে। সর্বজীবে মৈত্রীভাবনার অর্থ শত্রুর সুখেও মিত্রের সুখের মতো সুখী হওয়া। দ্বিতীয়ত, শত্রুর দুঃখকে প্রিয়জনের দুঃখ মনে করে করুণাভাবের সাধন করতে হবে। তৃতীয়ত, সধর্মী ও বিধর্মী সকলের পূণ্য আচরণেই মনে মুদিতাভাব আনতে হবে এবং অপরের দোষ দেখেও অগ্রাহ্য করতে হবে। চতুর্থত, ক্রোধ বর্জন করে উপেক্ষাভাবের সাধনাই কর্তব্য।
 .
সুতরাং, এসব আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের বিশেষ অবদান যোগদর্শনে স্বীকৃত না হলেও যোগসাধনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরপ্রণিধান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

(চলবে…)

[ আগের পর্ব : অষ্টাঙ্গিক যোগ ] [*] [ পরের পর্ব : পুরুষের বন্ধন ও কৈবল্য ]

No comments: