Sunday, December 23, 2012

| সাংখ্য দর্শন-০৭ : সাংখ্যের পুরুষতত্ত্ব |



| সাংখ্য দর্শন-০৭ : সাংখ্যের পুরুষতত্ত্ব |

রণদীপম বসু

.: সাংখ্যের পুরুষতত্ত্ব

সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ তত্ত্বকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- প্রকৃতি, বিকৃতি, প্রকৃতি-বিকৃতি এবং প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয়। এর মধ্যে সাংখ্যদর্শনের পুরুষ হলো চতুর্থপ্রকার তত্ত্ব। প্রকৃতি অর্থ কারণ, বিকৃতি অর্থ কার্য। সাংখ্যমতে পুরুষ কারণও নয়, কার্যও নয়। পরিণামী প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের নেপথ্যে পুরুষ হলো এক অপরিণামী অপরিবর্তনীয় সত্তা। পুরুষ প্রকৃতির পরিপূরক। তাই সাংখ্য দর্শনে পুরুষকে নেতিবাচক ভাবে দেখানো হয়েছে। প্রকৃতিতে যার অভাব, তাই পুরুষে বর্তমান। আবার বিপরীতভাবে প্রকৃতি যে সকল ধর্মবিশিষ্ট, তার কোন কোন ধর্মের অভাবাধিষ্ঠানই হলো পুরুষ।
 .
প্রকৃতি বৈচিত্র্যের বীজরূপ হলেও তা একটি বিশেষ ধর্মবর্জিত। এই ধর্মটি হলো চৈতন্য। বিপরীতক্রমে ঐ চৈতন্যধর্মই পুরুষের স্বরূপধর্ম। ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো সাংখ্যের পুরুষ কেবল চৈতন্যগুণসম্পন্ন দ্রব্য নয় এবং চৈতন্য পুরুষের আগন্তুক গুণ নয়। সাংখ্যমতে পুরুষ চৈতন্যময়। এদিক থেকে সাংখ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায়ের মতৈক্য পরিলক্ষিত হয়। অদ্বৈতবেদান্তে পুরুষকে চিন্ময়সত্তা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বেদান্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাংখ্য সম্প্রদায়ের পার্থক্য হলো, সাংখ্য সম্প্রদায় যেখানে পুরুষকে চিন্ময় বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন, সেখানে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় চিন্ময় পুরুষকে সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ (সচ্চিদানন্দ) বলে উল্লেখ করেছেন।
 .
অন্যান্য সম্প্রদায়ের আত্মতত্ত্বের বিরোধিতা করে সাংখ্য সম্প্রদায় নিত্য কালত্রয়-অবাধিত, নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, পাপপুণ্যহীন স্বসম্মত পুরুষতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রে যাকে সাধারণত আত্মা শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়, তাকেই সাংখ্যদর্শনে পুরুষ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে। সাংখ্যকারিকার একাদশকারিকায় সাংখ্যের প্রকৃতি বা প্রধান থেকে পুরুষের ভেদ প্রতিপাদিত হয়েছে-
ত্রিগুণমবিবেকি বিষয়ঃ সামান্যমচেতনং প্রসবধর্ম্মি।
ব্যক্তং তথা প্রধানং তদ্বিপরীতস্তথা চ পুমান্ ।।’- (সাংখ্যকারিকা-১১)
অর্থাৎ : ব্যক্ত-এর ধর্ম হলো ত্রিগুণত্ব, অবিবেকিত্ব, বিষয়ত্ব, সামান্যত্ব, অচেতনত্ব, প্রসবধর্মিত্ব। অব্যক্ত বা প্রকৃতিও সেইরূপ। কিন্তু এই গুণগুলির কোনটিই জ্ঞ বা পুরুষে থাকে না। পুরুষ হলো ব্যক্ত ও অব্যক্তের বিপরীত।
 .
অতএব, পুরুষ হলো অত্রিগুণ, বিবেকী, -বিষয়, -সামান্য, চেতন, -প্রসবধর্মী। অর্থাৎ, পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব। পুরুষের বন্ধনও নেই, মোক্ষও হয় না। অত্রিগুণত্ব, বিবেকীত্ব, অবিষয়ত্ব, অসাধারণত্ব, চেতনত্ব এবং অপ্রসবধর্মীত্ব এই ধর্মগুলির মধ্যে চেতনত্ব এবং অবিষয়ত্বের দ্বারা পুরুষের সাক্ষীত্ব এবং দ্রষ্টৃত্ব সিদ্ধ হয়। কারণ চেতনই দ্রষ্টা হয়, অচেতন দ্রষ্টা হয় না। যাকে বিষয় দর্শন করানো হয়, সেই সাক্ষী হয়। অন্যে যাকে নিজ বিষয় প্রদর্শন করে, দর্শনের ব্যাপারে যার নিজের কোন সক্রিয়তা নেই, তাকেই সাক্ষী বলা হয়। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ বলে তার দেখবার বা জানবার শক্তি রয়েছে, কিন্তু তার ক্রিয়াশক্তি নেই। লোকে যেমন বাদী ও প্রতিবাদী উভয়ের বিবাদের বিষয় সাক্ষীকে দেখায়, অর্থাৎ সাক্ষীর নিকট উপস্থাপন করে, সেভাবেই প্রকৃতি যখন নিজ রূপকে পুরুষের সম্মুখে উপস্থাপন করে, তখন পুরুষ সেইরূপ প্রকৃতিকে দর্শন করে মাত্র।
 .
অত্রৈগুণ্যের জন্য পুরুষের কৈবল্য সিদ্ধ হয়। দুঃখত্রয়ের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক অভাবই কৈবল্য। এই কৈবল্য পুরুষের স্বাভাবিক ধর্ম। অত্রৈগুণ্য বা সুখদুঃখমোহ-রহিত বলে কৈবল্য পুরুষের অনায়াস-সিদ্ধ। এই অত্রৈগুণ্য থাকায় পুরুষ মধ্যস্থ অর্থাৎ নিরপেক্ষ। কারণ সুখী ব্যক্তি সুখের দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে বলে এবং দুঃখী ব্যক্তি দুঃখের প্রতি দ্বেষ করে বলে মধ্যস্থ হতে পারে না। এই উভয় রহিত অর্থাৎ সুখদুঃখরহিত যে, তাকেই মধ্যস্থ বা উদাসীন বলা হয়। ফলে প্রকৃতির রূপ দর্শনে পুরুষ সাক্ষী হলেও স্বভাবতই পুরুষ উদাসীন। আর বিবেকীত্ব এবং অপ্রসবধর্মীত্ব থেকে পুরুষ যে অকর্তা- এটা সিদ্ধ হয়। তাই সাংখ্যকারিকার উনবিংশ কারিকায় বলা হয়েছে-
তস্মাচ্চ বিপর্য্যাসাৎসিদ্ধং সাক্ষিত্বমস্য পুরষস্য।
কৈবল্যং মাধ্যস্থ্যং দ্রষ্টৃত্বমকর্ত্তৃভাবশ্চ।।’- (সাংখ্যকারিকা-১৯)
অর্থাৎ : সেই (ব্যক্ত ও অব্যক্তের) বিপর্যয় ও বৈপরীত্য-বশত এই পুরুষের উদাসীন নির্লিপ্তভাব, দ্রষ্টার ভাব, কেবল একাকীত্বের (শুদ্ধ-চৈতন্যের) ভাব, মধ্যস্থের ভাব এবং অকর্তাভাব সিদ্ধ হয়।
 .
উল্লেখ্য, প্রমাণের দ্বারা কর্তব্য বিষয় জেনে ‘চেতন আমি এটা করতে চাই বলে করছি’- এভাবে প্রযতœ ও চেতনার একত্র অবস্থান সবাই অনুভব করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সাংখ্যমতে তা সম্ভব হয় না। কারণ চেতন পুরুষ কর্তা নয় এবং কর্তা বুদ্ধিও চেতন নয়। এজন্যেই সাংখ্যকারিকার বিংশতি কারিকায় বলা হয়েছে-
তস্মাত্তৎসংযোগাদচেতনং চেতনাবদিব লিঙ্গম্ ।
গুণকর্ত্তৃত্বে চ তথা কর্ত্তেব ভবত্যুদাসীনঃ।।’- (সাংখ্যকারিকা-২০)
অর্থাৎ : সেইহেতু, পুরুষের সংযোগবশত অচেতন মহদাদি চেতনার মতো মনে হয় এবং ত্রিগুণের কর্ত্তৃত্ববশত উদাসীন পুরুষ কর্তার মতো প্রতিভাত হন।
 .
সাংখ্যমতে আবার পুরুষ সর্বব্যাপী ও সংখ্যায় বহু। অবিবেকবশত পুরুষ বদ্ধাবস্থাপ্রাপ্ত হয়। বদ্ধ পুরুষকে তাই একভাবে অবিবেকী বলা যায়। পুরুষের অবিবেক বিনাশ্য এবং তা বিনাশের মাধ্যমে পুরুষ মোক্ষ বা কৈবল্য লাভ করে। সাংখ্যকারিকার একবিংশ কারিকায় বলা হয়েছে-
পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য।
পঙ্গ্বন্ধবদুভয়োরপি সংযোগস্তৎকৃতঃ সর্গঃ।।’- (সাংখ্যকারিকা-২১)
অর্থাৎ : পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।
 .
সাংখ্যমতে সম্ভবত এখানেই জগৎসৃষ্টির মূল কারণটি লুকিয়ে আছে। স্বভাবসুলভ নিত্য মুক্ত উদাসীন দ্রষ্টা পুরুষের এই সংযোগ আপাতদৃষ্টে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। তাই এ কারিকাটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ টীকাগ্রন্থে বলেন-
পুরুষস্যাপেক্ষাং দর্শয়তি- ‘পুরুষস্য কৈবল্যার্থম্’ ইতি। তথাহি ভোগ্যেন প্রধানেন সম্ভিন্নঃ পুরুষস্তদ্গতং দুঃখত্রয়ং স্বাত্মন্যভিমন্যমানঃ কৈবল্যং প্রার্থয়তে। তচ্চ সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিনিবন্ধনম্ । ন চ সত্ত্বপুরুষান্যতাখ্যাতিঃ প্রধানমন্তরেণেতি কৈবল্যার্থৎ পুরুষঃ প্রধানমপেক্ষতে। অনাদিত্বাচ্চ সংযোগপরম্পরায়া ভোগায় সংযুক্তোহপি কৈবল্যায় পুনঃ সংযুজ্যত ইতি যুক্তম্ ।’- (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ : (প্রকৃতির সঙ্গে) পুরুষের (সংযোগের) অপেক্ষার (পক্ষে) যুক্তি দেখানো হয়েছে, ‘পুরুষের কৈবল্যের জন্য’ ইত্যাদি। প্রধানের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরুষ প্রধানের ধর্ম দুঃখত্রয়কে নিজের বলে মনে করে সেই দুঃখত্রয় থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে। সেই কৈবল্য বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি (বা বিভেদজ্ঞান) থেকে হয়। বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি প্রধান ছাড়া হয় না। (অতএব) কৈবল্যের জন্য পুরুষ প্রধানকে অপেক্ষা করে। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ-পরম্পরা অনাদি বলে (পুরুষ) ভোগের জন্য (প্রকৃতির সঙ্গে) সংযুক্ত হয়েও কৈবল্যের জন্য পুনরায় সংযুক্ত হয়- এটাই যুক্তিযুক্ত।
 .
পুরুষের অস্তিত্বসিদ্ধি
সাংখ্যাচার্যরা পুরুষের অস্তিত্ব বিষয়ে অনেক হেতুযুক্ত অনুমান প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সাংখ্যমতে প্রমাণ ত্রিবিধ- প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ বা আগম প্রমাণ। প্রশ্ন হলো, অনুমান ছাড়াও পুরুষ কি প্রত্যক্ষ ও শব্দ প্রমাণের দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ? এ প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্যাচার্যদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ ঘটতে দেখা যায়। পুরুষের অস্তিত্ববিষয়ে অনেক শ্র“তিবাক্য রয়েছে। তাই পুরুষের অস্তিত্ব বিষয়ে শব্দ বা আগম প্রমাণ নিয়ে বিশেষ বিচার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্রত্যক্ষ বিষয়ে অনেক সাংখ্যাচার্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। অজ্ঞাত রচয়িতা যুক্তিদীপিকাকার পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন। কিন্তু সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বিজ্ঞানভিক্ষু পুরুষকে প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে মনে করেন। ব্যাস-ভাষ্যে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষের আলম্বনরূপে পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে গৃহীত হয়। তবে পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ হোক বা না-হোক, তা যে অনুমানসিদ্ধ হতে পারে, সে বিষয়ে সকলেই একমত। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থসিদ্ধির ব্যাপারে অনুমানই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। তাই সাংখ্যাচার্যরা প্রধানত অনুমান বা যুক্তির সাহায্যেই পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রয়াসী হয়েছেন।
 .
গুণযুক্ত পরিণামী জড়বস্তুই সাধারণ জীবের প্রত্যক্ষের বিষয়। ত্রিগুণাত্মক জড়বস্তুকে পক্ষ করে বিভিন্ন হেতুর সাহায্যে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তারূপ চেতন পুরুষের অস্তিত্ব অনুমিত হতে পারে। সাংখ্যসূত্রকার মহর্ষি কপিল বলেছেন-
আস্ত্যাত্মা নাস্তিত্ব সাধনাভাবাৎ।’
অর্থাৎ : আত্মার নাস্তিত্ব সাধক প্রমাণ না থাকায় আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
 .
কারণ, আত্মার অস্তিত্ব নিষেধ করতে সচেষ্ট হলে সেই নিষেধের কর্তা ও কর্মরূপে আত্মার অস্তিত্বই সিদ্ধ হয়। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তাঁর সপ্তদশ কারিকায় পঞ্চবিধ হেতুর সাহায্যে সাংখ্যসম্মত চৈতন্যস্বরূপ পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণের অভিপ্রায়ে বলেছেন-
সংঘাতপরার্থত্বাৎ ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াদধিষ্ঠানাৎ।
পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ।’- (সাংখ্যকারিকা-১৭)
অর্থাৎ : সংঘাতবস্তু অপরের প্রয়োজন সাধন করে থাকে, ত্রিগুণ ইত্যাদির বিপরীত কেউ আছে, কোন চেতন অধিষ্ঠাতা ছাড়া জড়বর্গ চলতে পারে না, রূপরসাদি ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা আছে, এবং কেবল বা শুদ্ধ আত্মার ভাব কৈবল্য বা মোক্ষ লাভের জন্য চেষ্টা আছে বলে পুরুষ আছেন- এটাই প্রমাণিত হয়।
 .
পুরুষের অস্তিত্ব সাধক হিসেবে কারিকাটিতে যে পাঁচটি হেতু বা যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হলো- () সংঘাত পরার্থত্বাৎ, অর্থাৎ সংঘাত বস্তু অপরের প্রয়োজনসাধক হেতু, () ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াৎ, অর্থাৎ ত্রিগুণাদি বস্তুর বৈপরীত্য হেতু, () অধিষ্ঠানাৎ, অর্থাৎ জড়বস্তুর অধিষ্ঠান হেতু, () পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ, অর্থাৎ ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা হেতু, () কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ, অর্থাৎ বন্ধন হতে মুক্তিলাভের বা কৈবল্যের প্রচেষ্টা হেতু।
 .
আশঙ্কা হতে পারে যে, যারা পুরুষের অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন তাঁদের কাছে পুরুষের অস্তিত্ব সাধক অনুমান সিদ্ধসাধন দোষদুষ্ট হবে। কারণ প্রতিবাদী যা স্বীকার করেন বাদী যদি অনুমানের দ্বারা তারই সিদ্ধি করেন, তাহলে সিদ্ধসাধন দোষ হয়।
এই আশঙ্কার উত্তরে বলা যে, উক্ত হেতুগুলির দ্বারা কেবল পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ করা হয়নি, কিন্তু অব্যক্ত ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত পুরুষের অস্তিত্বই উক্ত হেতুগুলির দ্বারা সিদ্ধ করা হয়।
 .
প্রথম হেতু: (সংঘাত পরার্থত্বাৎ)- সাংখ্যকারিকা অনুসারে পুরুষের অস্তিত্বসাধক প্রথম অনুমানটি হবে, পুরুষ অস্তিত্বশীল যেহেতু সংঘাতমাত্রই অন্যের প্রয়োজন সিদ্ধ করে। যে পদার্থ মিলিতভাবে কার্য করে তাকেই সংঘাত বলা হয়। জড় পদার্থমাত্রই অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্য করে, এইজন্য জড়পদার্থমাত্রকে সংঘাত বলা হয়েছে। এই অনুমানে পুরুষ পক্ষ, অস্তিত্ব সাধ্য এবং সংঘাতপরার্থত্ব হলো হেতু।
 .
আশঙ্কা হতে পারে যে, উক্ত অনুমানটি স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস দোষে দুষ্ট। কারণ পক্ষে হেতু না থাকলে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়। এক্ষেত্রে পক্ষ পুরুষে সংঘাত পরার্থত্ব হেতু না থাকায় স্বরূপাসিদ্ধি দোষ হয়।
এই স্বরূপাসিদ্ধি দোষ পরিহারের জন্য সাংখ্যকারিকার টীকা সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থে অনুমানটি বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। অনুমানটি এইরূপ- অব্যক্ত মহৎ প্রভৃতি পরার্থ, যেহেতু তারা সংঘাত, যেমন শয্যা, বস্ত্র, আসন, ঘট, পট প্রভৃতি। যেখানে যেখানে সংঘাতত্ব, সেখানে সেখানে পরার্থত্ব- এটিই উক্ত অনুমানের ব্যাপ্তি। অর্থাৎ, যে সকল বস্তু সংঘাত তারা অপরের প্রয়োজন সাধন করে। শয্যা, আসন, ঘট, পট প্রভৃতি সংঘাত পদার্থ অচেতন এবং এরা সর্বদা অপরের প্রয়োজনই সিদ্ধ করে। প্রকৃতি এবং তার পরিণামজাত সকল পদার্থই সংঘাত বা সংহত বা মিলিত। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমাহারই হলো প্রকৃতি। এই সংঘাতপদার্থ কোন চেতন সত্তার প্রয়োজনেই সংঘাত বা উপাদানের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই সকল সংঘাত যার প্রয়োজন সিদ্ধ করে, সেই সংঘাতভিন্ন চেতন সত্তাই পুরুষ।
 .
দ্বিতীয় হেতু: (ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াৎ)- উপরিউক্ত যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি হতে পারে যে, উক্ত অনুমান অর্থান্তরতা দোষে দুষ্ট। কারণ যে সাধ্যের সাধনে অনুমানটি প্রযুক্ত হয়, ঐ অনুমানটি যদি সেই সাধ্যের সাধন না করে অন্য সাধ্যের সাধন করে, তাহলে অর্থান্তরতা দোষ হয়। আমরা বার বার প্রত্যক্ষ করে থাকি যে, একটা সংঘাত অপর সংঘাতেরই প্রয়োজন সিদ্ধি করে, আত্মা বা পুরুষের প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না। আত্মার নিদ্রা, বসা প্রভৃতি যদি প্রয়োজন হতো, তাহলে শয্যা, আসন প্রভৃতি আত্মার প্রয়োজন সিদ্ধি করতে পারতো। কিন্তু নিদ্রা, বসা প্রভৃতি শরীরের প্রয়োজন। শয্যা, আসন প্রভৃতি সেই প্রয়োজনই সিদ্ধ করে। সুতরাং, সংঘাতরূপ পদার্থ পরার্থ হলেও সেই অপর সংঘাত বিশেষই হয়। অর্থাৎ একটি সংঘাতপদার্থ অপর একটি সংঘাতপদার্থের প্রয়োজন সাধন করতে পারে, এর জন্য সংঘাত-অতিরিক্ত কোন চেতন সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
 .
উক্ত আপত্তি খণ্ডনের উদ্দেশ্যেই সাংখ্যকারিকাকার এই দ্বিতীয় হেতুটি বলেছেন। কেননা, যদি এরূপ কথা স্বীকার করা হয় যে, একটি সংঘাতপদার্থ অপর একটি সংঘাতপদার্থেরই প্রয়োজন সাধন করে, তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, ঐ দ্বিতীয় সংঘাতপদার্থ পুনরায় অন্য কোন সংঘাতপদার্থের প্রয়োজন সাধন করে। কিন্তু এরূপ বলা হলে সংঘাত-পরম্পরায় শেষ পর্যন্ত অনবস্থা দোষ দেখা দিতে বাধ্য। সুতরাং এই অনবস্থাদোষ পরিহারের জন্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, যে সত্তার প্রয়োজন প্রকৃতিজাত তত্ত্বের দ্বারা সাধিত হচ্ছে, সেই সত্তা স্বরূপত সংঘাতপদার্থ থেকে ভিন্ন। ‘বিপর্যয়’ শব্দের অর্থ অভাব। সংঘাতপদার্থ ত্রিগুণাত্মক। অতএব ত্রিগুণাদিবিপর্যয় বলতে ত্রিগুণের অভাব বা ত্রিগুণশূন্যতা বুঝতে হবে। সংঘাতপদার্থ যার প্রয়োজন সাধন করে, সেই পুরুষসত্তা অ-ত্রিগুণাত্মক। আবার একই যুক্তিতে ত্রিগুণাত্মক বস্তু জড় ও অপ্রকাশস্বভাব হওয়ায় পুরুষকে চেতন ও প্রকাশস্বভাব বলে স্বীকার করতে হয়।
 .
তৃতীয় হেতু: (অধিষ্ঠানাৎ)- ত্রিগুণাত্মক বস্তুমাত্রই কোন একজন নিয়ামকের অপেক্ষা রাখে। জড় পদার্থের অনন্ত পরিণামের ব্যাখ্যার জন্য অধিষ্ঠান হিসাবে পুরুষ স্বীকার্য। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণ তিনটি জড়। জড় কখনও স্বয়ং ক্রিয়াশীল হতে পারে না। সুতরাং, ঐ সকল জড় পদার্থের অধিষ্ঠানরূপে পুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার কার প্রয়োজন। পুরুষ অধিষ্ঠাতা না হলে জড়পদার্থগুলির ঐরূপ পরিণাম নিয়মিতভাবে কখনোই হতো না। এখানে অধিষ্ঠাতা বলতে প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধ বিশেষই বোঝায়। কিন্তু পুরুষ, প্রকৃতি প্রভৃতি ঐরূপ পরিণামের কর্তা নয়। পুরুষের সান্নিধ্য বা সম্বন্ধই প্রকৃতি প্রভৃতির পরিণামের হেতু। যেভাবে চালকের বা ঘোড়ার সান্নিধ্যবশত রথ চলে, সেভাবেই পুরুষের সান্নিধ্যবশত প্রকৃতি প্রভৃতির পরিণাম হয়। অতএব প্রকৃতি এবং প্রকৃতির পরিণামরূপ যাবতীয় বস্তুর নিয়ামকরূপে চেতন পুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। অচেতন ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি চেতন পুরুষের সান্নিধ্য ব্যতীত বিশ্বসৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি যে বিশ্বসৃষ্টিতে সক্রিয়, তা সিদ্ধ। অতএব প্রকৃতির অধিষ্ঠানরূপে চেতন পুরুষ স্বীকার করতেই হবে।
 .
চতুর্থ হেতু: (পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ)- সুখ, দুঃখ ও বিষাদ কোন না কোন কর্তার দ্বারা উপলব্ধ হয়ে থাকে। যে কোন অভিজ্ঞতাই কোন এক কর্তার অভিজ্ঞতা। কর্তাকে বাদ দিয়ে কোন অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করা যায় না। জাগতিক বস্তুর অভিজ্ঞতা প্রকৃতি বা প্রকৃতির পরিণামী কোন বস্তুর দ্বারা হতে পারে না। কারণ, ব্যক্ত ও অব্যক্ত অর্থাৎ প্রকৃতি ও তার পরিণামী সকল বস্তুই জড় ও অচেতন। অব্যক্ত ও ব্যক্ত সুখদুঃখমোহস্বরূপ হওয়ায় অচেতন। এইজন্য ব্যক্ত অব্যক্তকে ভোগ করতে পারে না এবং অব্যক্ত ব্যক্তকে ভোগ করতে পারে না। অতএব একজন ভোক্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন। বস্তুর ভোগ করার ক্ষমতা নেই, অতএব সুখ, দুঃখ ও বিষাদের অনুভূতি কোন এক চেতন সত্তারই হয়ে থাকে। যে চেতন সত্তার সুখ-দুঃখাদি ভোগ হয়, সেই চেতন সত্তাই হলো পুরুষ।
 .
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘ভোগ’ শব্দটি সাংখ্য দর্শনে ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুজগৎ সম্বন্ধে চেতন সত্তার সর্ববিধ অভিজ্ঞতাই ‘ভোগ’ শব্দের দ্বারা বোঝায়। এই অর্থে পুরুষ শুধু সুখ-দুঃখাদির ভোক্তা নন, পুরুষ প্রকৃতিভূত যাবতীয় বস্তুর ভোক্তা, দ্রষ্টা ও জ্ঞাতা। অপরদিকে প্রকৃতিজাত যাবতীয় পদার্থই ভোগ্য, দৃশ্য ও জ্ঞেয়।
 .
আশঙ্কা হতে পারে যে, পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ হওয়ার আগে ভোক্তৃত্ব ধর্ম পুরুষের অস্তিত্বে হেতু হবে কীভাবে ?
উত্তরে বলা হয়, ভোক্তৃভাব পদের দ্বারা ভোগ্য সুখদুঃখকে বোঝানো হয়েছে। ভোগ্যরূপ সুখদুঃখকে প্রত্যেক আত্মা অনুভব করে থাকে। সুখ অনুকুল বেদনীয় এবং দুঃখ প্রতিকুলবেদনীয়। সুখদুঃখ যেহেতু ভোগ্য সেহেতু ঐগুলির অতিরিক্ত এক ভোক্তা স্বীকার করা প্রয়োজন। ভোগ্য কখনও ভোক্তা হতে পারে না। সুতরাং যিনি ভোক্তা হবেন, তাকে সুখ দুঃখ মোহস্বরূপ বস্তু থেকে অতিরিক্ত বলতে হবে। ঐ ভোক্তাই পুরুষ।
 .
এখানে আশঙ্কা হতে পারে, সুখদুঃখ অনুকূল বেদনীয় এবং প্রতিকূল বেদনীয় হওয়ায় মহৎতত্ত্ব প্রভৃতিই ঐ সুখদুঃখের ভোক্ত হোক। সুতরাং, তার অতিরিক্ত পুরুষ স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
এই আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়, অতিরিক্ত পুরুষ স্বীকার করা না হলে এক্ষেত্রে কর্তৃকর্মবিরোধ উপস্থিত হবে। কর্তৃত্ব ও কর্মত্ব একই অধিকরণ বা আশ্রয়ে থাকতে পারে না। সুখ-দুঃখ মোহস্বরূপ বুদ্ধি প্রভৃতি ভোগকর্মত্বরূপ ভোগ্যত্ব এবং ভোগকর্তৃত্বরূপ ভোক্তৃত্বের আশ্রয় হতে পারে না। সুতরাং সুখদুঃখের ভোগ্যত্বের জন্য যে ভোক্তার অস্তিত্ব অবশ্যস্বীকার্য, সেই ভোক্তাই পুরুষ।
 .
প্রসঙ্গত, পুরুষ ভোক্তা কী না তা বিচার করা প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে সাংখ্যের পুরুষকে ভোক্তা বলা যায় না। কারণ ভোক্তৃত্ব কর্তৃত্বসাপেক্ষ। সাংখ্যমতে পুরুষ কর্তা হতে পারে না যেহেতু পুরুষ নিষ্ক্রিয়। আবার প্রকৃতির ভোক্তৃত্বও স্বীকার করা যায় না, কারণ প্রকৃতি হলো অচেতন। কেবলমাত্র চেতনেরই ভোগ ও অপবর্গ সম্ভব, অচেতনের ভোগ ও অপবর্গ সম্ভব নয়। এই কারণে বলা যায় পুরুষের ভোক্তৃত্ব স্বীকার্য। সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র তাঁর সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে পুরুষের এই ভোগকে স্বাভাবিক না বলে ঔপচারিক বা আরোপিত বলেছেন। তাঁর মতে পুরুষ স্বভাবতই মুক্ত। প্রকৃত ভোগ বুদ্ধি বা অন্তঃকরণের। বুদ্ধি সঙ্গে পুরুষের অভেদ প্রতীতিবশত বুদ্ধির ভোগ পুরুষের বলে প্রতিভাত হয়। পুরুষ স্বরূপত উদাসীন।
 .
প্রশ্ন হতে পারে, ভোক্তৃত্ব প্রকৃতিতে অথবা মহতে না থাকায় আরোপিত হবে কীভাবে ?
উত্তরে বলা হয়, মহৎ ও পুরুষের অনাদি অবিবেকবশতই পুরুষে ভোক্তৃত্বের প্রকাশ হয়ে থাকে। বিবেকের অগ্রহ বা অজ্ঞানই অবিবেক। অবিবেকের ফলেই ভোক্তৃত্ব আরোপিত হয়ে থাকে।
.
পঞ্চম হেতু: (কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ)- সাংখ্যমতে, কৈবল্যের জন্য প্রবৃত্তি হওয়ায় পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। শাস্ত্রসমূহকে অভ্রান্ত বলা হয়। শাস্ত্রে দুঃখ-নিবৃত্তির উপায়ের নির্দেশ আছে। সমাধি-প্রজ্ঞালব্ধ সত্যদ্রষ্টা করুণাপরায়ণ ঋষিরা দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে জেনেছিলেন যে, দুঃখ-নিবৃত্তির দ্বারাই দুঃখ-জর্জরিত জীবের পরম কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই কারণেই তাঁরা মোক্ষ বা কৈবল্যের উপদেশ দিয়েছেন। কৈবল্য শব্দের অর্থ আত্যন্তিক দুঃখত্রয়ের উপশম। এই কৈবল্য প্রকৃতি বা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত কোন বস্তুর হতে পারে না। প্রকৃতি তথা প্রকৃতিজাত বস্তু ত্রিগুণাত্মক হওয়ায় তাদের দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি কখনোই সম্ভব নয়।
 .
সাংখ্যদর্শনে ত্রিবিধ দুঃখের কথা বলা হয়েছে- আদিদৈবিক, আদিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক। পুরুষ নামক তত্ত্ব স্বীকার করা না হলে কৈবল্যের প্রবৃত্তি হতে পারে না। কারণ ঐরূপ প্রবৃত্তি মহৎ ইত্যাদির দ্বারা সম্ভব নয়, যেহেতু মহৎ প্রভৃতি পদার্থ হলো দুঃখাদিস্বরূপ। দুঃখ যদি মহৎ প্রভৃতির স্বরূপগত হয় তাহলে দুঃখের আত্যন্তিক উপশম বা নিবৃত্তি কখনোই সম্ভব হয় না। কারণ দুঃখস্বরূপ পদার্থকে দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। মহৎ প্রভৃতিকে দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে মহৎ প্রভৃতির নাশ স্বীকার করতে হবে। এই কারণে, যেহেতু কৈবল্য বা মুক্তির প্রবৃত্তি হয়, সেহেতু মহৎ ইত্যাদির অতিরিক্ত অ-দুঃখাত্মক পুরুষ অবশ্যস্বীকার্য। সুতরাং সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হলো, শাস্ত্রের ও মহর্ষিদের কৈবল্যের প্রবৃত্তির জন্য মহৎ প্রভৃতি থেকে অতিরিক্ত পুরুষ বা আত্মা আছে।
 .
বস্তুত উপরিউক্ত পঞ্চবিধ হেতুর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ভোগ ও অপবর্গের তাৎপর্য প্রকৃতি তথা প্রকৃতিজাত কোন বস্তুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ভোগ ও অপবর্গের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হলে প্রকৃতির অতিরিক্ত চেতন সত্তা স্বীকার করা প্রয়োজন। এইরূপ চেতন সত্তাই সাংখ্য দর্শনে ‘পুরুষ’ বলে অভিহিত হয়েছে।
 .
সাংখ্যসম্মত বহুপুরুষতত্ত্ব বা পুরুষের বহুত্ব
পুরুষের অস্তিত্ব প্রতিপাদনের পর প্রাসঙ্গি প্রশ্ন হলো, পুরুষ কি সকল শরীরে এক না শরীর ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে ?
সাংখ্যমতে পুরুষ বহু। পুরুষ স্বভাবত সর্বব্যাপি হলেও শরীরবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একটি ঘরে শত দীপ একসঙ্গে জ্বললেও তারা যেমন পরস্পরের অবিরোধে অবস্থান করে অর্থাৎ কেউ কারোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, তেমনি জীবভাবাপন্ন অনেক পুরুষ পরস্পরের অবিরোধে অবস্থান করতে পারে। একটি দীপ প্রজ্বলিত করা হলে বা নির্বাপিত হলে অন্যান্য দীপ যেমন তার সাথে প্রজ্বলিত হয় না বা নির্বাপিত হয় না, তেমনি একটি পুরুষের বন্ধনে বা মুক্তিতে অপর পুরুষের বন্ধন বা মুক্তি হয় না। পুরুষ প্রতি শরীরের ভিন্ন হওয়ায় একটি পুরুষের সুখ-দুঃখ, শোক-সন্তাপ, জন্ম-মরণ প্রভৃতি ভোগ অন্য পুরুষের সুখ-দুঃখ, শোক-সন্তাপ, জন্ম-মরণ ভোগের সহায়ক বা ব্যাঘাত্মক হয় না।
এ বিষয়ে ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা প্রভৃতি সম্প্রদায় একমত। কেবলমাত্র বেদান্ত দর্শন এই মতের বিরোধী। বেদান্তমতে আত্মা বহু নয়। এই মতে একই আত্মা উপাধিযুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবে পরিণত হয়। তাই এই মতে জীব অসংখ্য, কিন্তু আত্মা অসংখ্য নয়, এক।
 .
শরীর ভেদে পুরুষের বহুত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তাঁর অষ্টাদশ কারিকায় বলেন-
জনন-মরণ-করণানাং প্রতিনিয়মাদযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ।
পুরুষবহুত্বং সিদ্ধং ত্রৈগুণ্যবিপর্য্যয়াচ্চৈব।।’- (সাংখ্যকারিকা-১৮)
অর্থাৎ : জন্ম-মরণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের পৃথক পৃথক অস্তিত্বের জন্য, পৃথক পৃথক ভাবে অন্তঃকরণের চেষ্টা বা যত্নের জন্য এবং ত্রিগুণের বিশেষ বা তারতম্যবশত পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধ হয়।
 .
কারিকাটিতে পুরুষের বহুত্ব স্বীকারের পক্ষে তিনটি যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে- () জননমরণকরণানাং প্রতিনিয়মাৎ, অর্থাৎ জন্ম মৃত্যু ও ইন্দ্রিয়াদি করণের প্রতিনিয়ম হেতু, () অযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ, অর্থাৎ অযুগপৎ প্রবৃত্তি হেতু, () ত্রৈগুণ্যবিপর্যয়াৎ, অর্থাৎ ত্রিবিধ গুণের তারতম্য হেতু।
 .
প্রথম হেতু: (জননমরণকরণানাং প্রতিনিয়মাৎ)- এই যুক্তি অনুসারে, প্রত্যেক পুরুষের জন্ম, মৃত্যু এবং অন্তকরণ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় পুরুষের বহুত্ব অবশ্যস্বীকার্য। পুরুষ বহু। পুরুষ যদি এক হতো, তাহলে একজনের জন্ম বা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অপর সকলের জন্ম বা মৃত্যু হতো। প্রতিটি জীবের জন্ম, মৃত্যু এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ বিশেষ প্রকারের হয়ে থাকে। একজনের অঙ্গহানি হলে অর্থাৎ কোন একজন মূক, বধির বা অন্ধ হলে অপর সকলেই যে মূক, বধির বা অন্ধ হবে, তাও নয়। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকারের জন্ম, মৃত্যু ও করণের জন্য তাই বহু পুরুষ স্বীকার করতে হয়।
 .
আশঙ্কা হতে পারে যে, জন্ম শব্দের প্রচলিত অর্থ উৎপত্তি এবং মৃত্যু শব্দের প্রচলিত অর্থ বিনাশ। পুরুষ অনাদি, অনন্ত অর্থাৎ নিত্য। তার উৎপত্তি ও বিনাশ হতে পারে না। সুতরাং যেহেতু পুরুষ জন্ম প্রভৃতির অতীত, সেহেতু জন্ম-মৃত্যুকে পুরুষবহুত্বের হেতু বলা উচিত নয়।
উক্ত আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়, এই স্থলে ‘জন্ম’ ও ‘মরণ’ শব্দের দ্বারা পুরুষের উৎপত্তি বা বিনাশকে বোঝানো হয়নি। পুরুষ অপরিণামী নিত্য। সুতরাং তার উৎপত্তিরূপ জন্ম বা বিনাশরূপ মৃত্যু হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকার টীকাগ্রন্থ সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে বাচস্পতি মিশ্র বলেন-
নিকায়বিশিষ্টাভিরপূর্ব্বাভির্দেহ ইন্দ্রিয়মনোহহঙ্গারবুদ্ধি বেদনাভিঃ  পুরুষস্যাভিসম্বন্ধো জন্ম, ন তু পুরুষস্য পরিণামঃ তস্য হি অপরিণামিত্বাৎ। তেষামেব চ দেহাদীনামুপাত্তানাং পরিত্যাগো মরণম্, ন ত্বাত্মানো বিনাশঃ, তস্য কূটস্থনিত্যত্বাৎ। করণানি বুদ্ধ্যাদীনি ত্রয়োদশ। তেষাং জন্মমরণকরণানাং প্রতিনিয়মো ব্যবস্থা। সা খল্বিয়ং সর্ব্বশরীরেষ্বেকস্মিন্ পুরুষে নোপপদ্যতে।’- (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ : নিকায় বিশিষ্ট (অর্থাৎ মনুষ্যত্বাদি জাতি বিশিষ্ট) নতুন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার, বুদ্ধি ও সংস্কারের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধকে জন্ম বলে। পুরুষের পরিণামরূপ জন্ম হয় না, তার অপরিণামিত্বের জন্য। এরূপ সম্বন্ধযুক্ত (অর্থাৎ নিকায়-বিশিষ্ট) উপাত্ত দেহাদির পরিত্যাগকে মৃত্যু বলে। আত্মার কিন্তু মৃত্যু হয় না, তার কুটস্থ-নিত্যত্ব স্বভাবের জন্য। বুদ্ধি ইত্যাদি ইন্দ্রিয় তেরোটি। জন্ম, মৃত্যু ও ইন্দ্রিয়গুলির প্রত্যেকের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা আছে। সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে সেই ব্যবস্থা বা নিয়মের উপপত্তি হয় না।
 .
যখন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার, বুদ্ধি ও বুদ্ধির পরিণামস্বরূপ জ্ঞান পরস্পর মিশ্রিতভাবে একক প্রয়োজন সাধক হয়, তখন তাকে বলা হয় নিকায়। ঐ নিকায় যদি নতুন হয়, তাহলে ঐ নিকায়কে বলা হয় অপূর্ব-নিকায়। এইরূপ অপূর্ব-নিকায়ের সঙ্গে অভিসম্বন্ধই হলো পুরুষের জন্ম। অভিসম্বন্ধ হলো অভিমানস্বরূপ সম্বন্ধ, সংযোগ সম্বন্ধ নয়। নিকায়ের সঙ্গে অভিসম্বন্ধবশত পুরুষে ভোক্তৃভাব আরোপিত হয়। নিকায়ের বহুত্বহেতু পুরুষেরও বহুত্ব সিদ্ধ হয়। জনম, মরণ ও করণসমূহের সঙ্গে প্রত্যেক পুরুষের নিয়মিত সম্বন্ধ বা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থা পুরুষ এক হলে কখনোই সম্ভব হতে পারে না। একটিমাত্র পুরুষের ভোগ ও অপবর্গের পক্ষে একটি মাত্র নিকায়েই যথেষ্ট। তারপরও যদি একই পুরুষের সঙ্গে অনেক নিকায়ের সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়, তাহলে একটি পুরুষের নিকায় পরিত্যাগে সকল নিকায়ের পরিত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে একজন জন্মালে সকলেই জন্মাবে, একজন মারা গেলে সকলেই মারা যাবে। একজন অন্ধ, কালা ইত্যাদি হলে সকলেই অন্ধ, কালা ইত্যাদি হবে এবং একজন উন্মাদ হলে সকলেই উন্মাদ হবে। এভাবে অব্যবস্থা হবে। এবং তা বাস্তব অভিজ্ঞতা-বিরোধী। অতএব স্বীকার করতে হবে পুরুষ বহু।
 .
দ্বিতীয় হেতু: (অযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ)- প্রতি শরীরে ভিন্ন ভিন্ন প্রবৃত্তি হওয়ায়, পুরুষও ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রবৃত্তি অর্থ হলো ক্রিয়াজনক প্রযত্ন। এই প্রযত্ন যুগপৎ সকল শরীরে একরূপ নয়। কোন বিষয়ের প্রতি পুরুষের প্রবৃত্তি বিভিন্ন প্রকার হয়। ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের যেমন ভিন্ন ভিন্ন প্রবৃত্তি হয়, তেমনি একই বিষয়ের প্রতি একই পুরুষের প্রবৃত্তিও কালভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। মোটকথা, পুরুষের প্রবৃত্তি বিচিত্র। পুরুষের বহুত্ব স্বীকার না করলে প্রবৃত্তির এই বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করা যায় না। অযুগপৎ প্রবৃত্তির জন্য প্রতিশরীরে পুরুষভেদ স্বীকার না করলে আত্মা একটা শরীরে প্রযত্নবান হলে সেটি সকল শরীরে প্রযত্নবান হবে। সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে সেই পুরুষ একই সময়ে সকল শরীরকে চালিত করবে। কিন্তু এটা প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ হওয়ায় স্বীকার করা যায় না। সুতরাং, বহুপুরুষ অবশ্যস্বীকার্য।
 .
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, প্রবৃত্তি-ভেদ-বশত পুরুষের ভেদ কিরূপে সিদ্ধ হয় ? এর উত্তরে বাচস্পতি মিশ্র বলেন-
প্রবৃত্তিঃ প্রযত্নলক্ষণা যদ্যপ্যন্তঃকরণবর্ত্তিনী তথাহপি পুরুষ উপচর্য্যতে।’- (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ : অন্তঃকরণের ধর্মরূপ প্রবৃত্তি পুরুষে আরোপিত হয়েই পুরুষের ভেদ সাধন করে।
 .
সাংখ্যমতে প্রযত্ন অন্তঃকরণের ধর্ম। অবিবেকী বদ্ধপুরুষের সঙ্গে অন্তঃকরণের ভেদাগ্রহ থাকায় অন্তঃকরণস্থিত প্রযত্ন পুরুষে আরোপিত হয়। স্ব-স্বামিভাববশত অন্তকরণস্থিত প্রযত্নকে অন্তঃকরণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত পুরুষের প্রযত্ন বলা হয়। এরূপ প্রযত্ন সকল অন্তঃকরণে যুগপৎ হয় না। আবার পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধহীন শরীরেও প্রবৃত্তি হয় না। সুতরাং স্বীকার করতে হয় যে, বিভিন্ন অন্তঃকরণের সঙ্গে বিভিন্ন পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন সম্বন্ধবশতই অযুগপৎ প্রবৃত্তি সম্ভব হয়।
 .
তৃতীয় হেতু: (ত্রৈগুণ্যবিপর্যয়াৎ)- ত্রৈগুণ্য অর্থ হলো সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ- এই তিনটি গুণ। বিপর্যয় অর্থ হলো বৈচিত্র্য। অর্থাৎ গুণত্রয়ের নানাবিধ বৈচিত্র্যের জন্য পুরুষের বহুত্ব স্বীকার্য। ব্যবহারিক জীবনে যেমন আমরা সত্ত্বগুণের আধিক্যহেতু সাত্ত্বিক ব্যক্তিকে সুখী থাকতে দেখি, রজোগুণের আধিক্যহেতু রাজসিক ব্যক্তিকে অসুখী থাকতে দেখি, আবার তমোগুণের আধিক্যহেতু তামসিক ব্যক্তিকে মোহাচ্ছন্ন দেখি। এইভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন গুণের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। একেই ত্রিগুণের বিপর্যয় বলা হয়। সকল শরীরে যদি একই আত্মা বিরাজিত বলা হয়, তাহলে এইরূফ ভেদ-ব্যবহার উপপন্ন হয় না। আবার এ জগতে যখন কেউ জন্ম-যন্ত্রণা ভোগ করে, তখন অন্য কেউ বা মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করে। জন্ম-যন্ত্রণা ও মৃত্যু-যন্ত্রণা অত্যন্ত বিলক্ষণ। একই আত্মা বা পুরুষ একই ক্ষণে এইরূপ দুটি বিপরীত অনুভূতির ভোক্তা হতে পারে না। সুতরাং আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, প্রতিটি শরীরে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ বা আত্মা সুখ-দুঃখাদি ভোগ করে থাকে। সুতরাং পুরুষবহুত্ব অবশ্যস্বীকার্য।
 .
অষ্টাদশ কারিকায় তিনটি হেতু বা যুক্তির সাহায্যে পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সাংখ্যকারিকায় পুরুষ শব্দটি একবারও বহুবচন-এ ব্যবহার করা হয়নি। প্রশ্ন হতে পারে, পুরুষ যদি বহু হতো, সর্বদাই কেন ঐ শব্দটি একবচন-এ ব্যবহার করা হয়েছে ? তাছাড়া পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধি কী বেদ বা শ্র“তির অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরোধী নয় ? আস্তিক সাংখ্য কীভাবে শ্র“তি বিরোধী হতে পারে ?
এসব প্রশ্নের উত্তর সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র দেননি। তবে ‘সাংখ্যপ্রবচনসূত্র’-এ এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে এই সূত্রে-
নাদ্বৈত শ্রুতিবিরোধঃ জাতিপরত্বাৎ।’- (সাংখ্যপ্রবচনসূত্র)
অর্থাৎ : সাংখ্য পুরুষ-বহুত্ব স্বীকার করলেও শ্র“তি বিরোধী নয়, কারণ সাংখ্যমতে পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে বহু হলেও জাতি হিসেবে এক।
(চলবে…)

No comments: