Sunday, February 16, 2014

| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৯ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- সৃষ্টিকর্তা |

.
| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-০৯ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- সৃষ্টিকর্তা |
রণদীপম বসু
২.২.০২. সৃষ্টিকর্তা :
.
ব্রহ্মকেই সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে। সেই নিত্য, মুক্ত, তৃপ্ত ব্রহ্ম কী প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন ? যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ব্রহ্মের সৃষ্টিকার্যের সকল শক্তিই আছে, তবুও ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্তৃত্ব বিষয়ে কিছু আপত্তি উত্থাপিত হয়। যেমন, উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ছাড়া কেউই কর্মে প্রবৃত্ত হয় না। কিন্তু ব্রহ্ম হলেন আপ্তকাম, সুতরাং সৃষ্টি করে পাওয়ার মতো তাঁর কিছুই থাকতে পারে না। সেজন্যেই ব্রহ্ম নিষ্প্রয়োজনে কোন কর্মে প্রবৃত্ত হবেন এরূপ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি না। সুতরাং ব্রহ্ম জগৎ-সৃষ্টির কারণ হতে পারেন না।

এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন-
‘লোকবত্তু, লীলাকৈবল্যম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩)।।
ভাবার্থ : সাধারণ জগতে দৃষ্ট মানুষের ক্রীড়াদির মতো সৃষ্টিকার্যও ব্রহ্মের লীলা মাত্র (ব্রঃ-২/১/৩৩)।
বলা হয়, মনুষ্যগণের মধ্যে যেমন অপেক্ষাকৃত ‘নিত্য মুক্ত তৃপ্ত’- মহারাজগণ কেবল খেলার জন্য গেণ্ডুয়া খেলেন, ব্রহ্মও তেমনই লীলাচ্ছলেই সৃষ্টিকর্ম করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সৃষ্টির মধ্যে যে জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতা দেখা যায়, যেমন কেউবা দরিদ্র আবার কেউবা ধনী হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ঈশ্বর কারও প্রতি পক্ষপাতী। এছাড়া কাউকে নিরতিশয় সুখে রাখেন আবার কাউকে কষ্ট ভোগ করান, এক্ষেত্রে ঈশ্বরকে নিষ্ঠুরও বলা চলে। তিনি সৃষ্টিকর্তা হলে এই বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে না। এই আপত্তির উত্তরে সূত্রকার বলেন-
‘বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।।
ভাবার্থ : জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে (ব্রঃ-২/১/৩৪)।
তাহলে এই বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতার হেতু কী ? বলা হয়, ঈশ্বরকে পক্ষপাতিত্ব এবং নিষ্ঠুরতার জন্য অভিযুক্ত করা চলে না, কারণ তিনি জীবের স্বকীয় পাপপুণ্য অনুযায়ীই ভালোমন্দের বিধান করে থাকেন। শ্রুতি শাস্ত্রেও এই মর্মে উক্তি রয়েছে-
‘…যত্রাস্য পুরুষস্য মৃতস্য অগ্নিং বাগপ্যেতি, বাতং প্রাণঃ, চক্ষুরাদিত্যং, মনশ্চন্দ্রং, দিশঃ শ্রোত্রং, পৃথিবীং শরীরং, আকাশং আত্মা, ওষধীর্লোমিনি, বনস্পতীন, কেশা, অপ্সু লোহিতং চ রেতশ্চ নিধীয়তে ক্বায়ং তদা পুরুষো ভবতীতি?… তৌ হ যদুচতুঃ কর্ম হৈব তদুচরথ। যৎ প্রশশংসতুঃ কর্ম হৈব তৎ প্রশশংসতুঃ পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি, পাপঃ পাপেনেতি।…’।। (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।।
অর্থাৎ : …মানুষ মারা গেলে বাক্ তার স্বস্থান অগ্নিতে, প্রাণ বায়ুতে, চোখ আদিত্যে, মন চন্দ্রে, কর্ম দিকসমূহে, শরীর পৃথিবীতে, আত্মা আকাশে, লোম ওষধিলতায়, মাথার চুল বনস্পতিতে, রক্ত, রেতঃ জলে ফিরে গিয়ে অবস্থান করে। তাহলে সে সময় আমাদের শারীরপুরুষ কোথায় থাকেন?
…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান… (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।
ভৃত্যগণকে স্ব স্ব কর্মানুযায়ী পারিতোষিক দেওয়ার উপর যেমন কোন রাজার পদমর্যাদা নির্ভর করে না, বা বৃষ্টির জল যেমন প্রত্যেকটি বীজকে স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করে, তেমনি ঈশ্বরও প্রতিটি জীবের অন্তর্নিহিত সুপ্ত প্রবণতাগুলিকে বিকশিত করার জন্য নিমিত্ত-কারণরূপে বর্তমান আছেন। সুতরাং জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতার জন্য ব্রহ্মের প্রতি দোষারোপ করা অনুচিত, কারণ ব্রহ্ম জীবের কর্ম থেকেই এরূপ জগৎ সৃষ্টি করেন। এই কর্ম অনাদিকাল থেকে চলে আসছে, বিশ্বসৃষ্টিও অনাদিকালের। এ প্রেক্ষিতে সূত্রকার বলেন-
‘ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।।
‘উপপদ্যতে চাপ্যুপলভ্যতে চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৬)।।
ভাবার্থ :
সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মে কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে তার উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।  জীব ও জগতের অনাদিত্বকে যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা যায়- এবং শাস্ত্রেও এর সপক্ষে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৬)।
শাস্ত্রেও জগৎ যে সৃষ্টির পূর্ব-কল্পেও বর্তমান ছিলো তা এ-জাতীয় শ্রুতিতেই আছে-
‘সূর্যাচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বমকল্পয়ৎ।
দিবং চ পৃথিবীং চান্তরিক্ষমথো স্বঃ’।। (ঋগ্বেদ-১০/১৯০/৩)।।
অর্থাৎ : সৃষ্টিকর্তা পূর্ববৎ-ই সূর্য ও চন্দ্রকে সংস্থাপিত করলেন এবং স্বর্গ, পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করলেন (ঋক-১০/১৯০/৩)।
তাই সূত্রকার বাদরায়ণের মতে, সাংখ্যমতের প্রধান বা বৈশেষিক-মতের পরমাণুকে জগতের কারণ মেনে যে সকল বক্তব্য আছে, তা অধিকতর নির্দোষ রূপে সিদ্ধ হতে পারে যদি ব্রহ্মকেই একমাত্র নিমিত্ত-উপাদান-কারণ বলে মানা যায়।
‘এইভাবে বাদরায়ণ জগৎ, আত্মা ও ব্রহ্মকে এমন এক শরীর বলে মেনেছেন, যা এই তিনের সংমিশ্রণে পরিপূর্ণ হয়। এবং শুধু সজীব, স-শরীর ব্রহ্মই নয়, উপরন্তু যাতে এক ‘অবয়বের’ দোষ ত্রুটি সেই অখণ্ড ব্রহ্মকে স্পর্শ করে না। কেমন করে? বাদরায়ণের এই প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ অসন্তোষজনক। তার ভিত্তি শব্দ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নয়।’- (রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৮১)। প্রকৃতই বাদরায়ণের সিদ্ধান্তের ভিত্তি কেবলই শব্দ-প্রমাণ অর্থাৎ শ্রুতি-শাস্ত্রের অমোঘ বচনই !

(চলবে…)

[আগের পর্ব : ব্রহ্মই উপাদান কারণ] [*] [পরের পর্ব : জগৎ]

2 comments:

limonhasan said...

অসাধারন, খুব ভালো লাগলো। অনেক দিন পর এমন কিছু পড়ার সুযোগ হল। আশা করি এমন অনেক লেখা আমরা পাবো আপনার কাছ থেকে।

limonhasan said...

তাজা বা টাটকা খাবার কে না পছন্দ করে। বর্তমানে ফরমালিনের ছড়াছড়ি, সব খাবারেই ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। টাটকা মাছ, শাকসবজি সাবাই ভালোবাসে। আপনি কি সামুদ্রিক মাছ, গলদা চিংড়ি, চিংড়ি, তাজা জল-মাছ, কাঁকড়া, ইত্যাদি দরণের মাছ খোঁজ করছে? তাহলে ভিজিট করুন freshfishbd.