Tuesday, October 10, 2017

ভর্তৃহরির নীতিশতক



| ভর্তৃহরির নীতিশতক |
সংগ্রহ : রণদীপম বসু

সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য রক্ষিত না হওয়ায় সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম কবিশ্রেষ্ঠ ভর্তৃহরির জীবন-চরিতের জন্যেও জনশ্রুতি-নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিভিন্ন জনশ্রুতি-প্রসূত তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতককে ভর্তৃহরির অধিষ্ঠানকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী- ভর্তৃহরি ছিলেন মালব দেশের অধিবাসী এবং জাতিতে ক্ষত্রিয়। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভর্তৃহরির পিতার নাম ছিলো গন্ধর্ব সেন। গন্ধর্ব সেনের দুই স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর পুত্র ভর্তৃহরি এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর পুত্র বিক্রমাদিত্য- যার নামে ‘সম্বৎ’ সন বা ‘বিক্রমাব্দ’ প্রচলিত। উল্লেখ্য, বিক্রম সম্বৎ গণনা শুরু হয় ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। (বিস্তারিত জানতে এখানে)

এখানে উল্লেখ্য, M.R.Kale  সম্পাদিত ভর্তৃহরির নীতিশতক ও বৈরাগ্যশতকে মূল শ্লোক সংখ্যা যথাক্রমে ১০৮ ও ১০১টি। এ ছাড়াও দুটি শতকে অতিরিক্ত শ্লোক সংখ্যা যথাক্রমে ২৫ ও ৪৪টি। এই অতিরিক্ত শ্লোকসমূহেরই কোন কোনটি আবার শতকদ্বয়ের অপর অপর সংস্করণে মূল শ্লোকসমূহের অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। তাই কোনটা যে ভর্তৃহরির আর কোনটা প্রক্ষিপ্ত তা নিরূপণ কষ্টকর বলে গবেষকদের মন্তব্য। সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার (তৃতীয় খণ্ড)-এ শৃঙ্গারশতকে শ্লোক সংখ্যা ১০০টি। এ হিসেবে তিনটি শতকে মোট শ্লোক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭৮।

.
ভর্তৃহরি হয়তো তিনটি কাব্যে তিনশত শ্লোকই রচনা করেছিলেন, কিন্তু কালে কালে লিপিকর ও অন্যান্যদের অনুগ্রহপুষ্ট হয়ে তাদের কলেবর আজ এতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রক্ষেপণের কাজটি পরবর্তীকালের কোন কোন অখ্যাত কবিদের দ্বারাও হতে পারে। কারণ শ্লোকসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যসূত্রই যখন নেই তখন ভাবগত ঐক্য বজায় রেখে একটি দুটি রচিত শ্লোক এর সঙ্গে যোগ হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।

সে যাক, ভর্তৃহরি সম্বন্ধে বিস্তারিত অন্যত্র আলোচিত হয়েছে, তাই এখানে ভর্তৃহরির বিখ্যাত নীতিশতক বাংলা তর্জমাসহ সংরক্ষণের নিমিত্তে উদ্ধৃত করে রাখা হলো। এ সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক আলোচনা অন্যত্র করা হবে।


ভর্তৃহরি'র নীতিশতক…
.
নমস্ক্রিয়া :

দিক্কালাদ্যনবচ্ছিন্নানন্তচিন্মাত্রমূর্তয়ে।
স্বানুভূত্যেকমানায় নমঃ শান্তায় তেজসে।। ০১।।
অর্থাৎ : দিক-কালাদি দ্বারা যাঁর পরিমাপ করা যায় না, যিনি অনন্ত; জ্ঞাময় যাঁর আকৃতি (শরীর) (এবং) আপন উপলব্ধি-ই যাঁর একমাত্র প্রমাণ (অর্থাৎ আপন উপলব্ধি-ই যাঁকে জানার একমাত্র উপায়) (সেই) শমগুণবিশিষ্ট জ্যোতির্ময় (ব্রহ্ম)-কে নমস্কার।


অজ্ঞনিন্দা বা মূর্খপদ্ধতি :

যাং চিন্তয়ামি সততং মরি সা বিরক্তা
সাপ্যন্যমিচ্ছতি জনং স জনোন্যসক্তঃ।
অস্মৎকৃতে চ পরিশুষ্যতি কাচিন্যা
ধিক্ তাং চ তং চ মদনং চ ইমাং চ মাং চ।। ০২।।
অর্থাৎ : যাকে (যার কথা) নিরন্তর চিন্তা করেছি (অর্থাৎ যাকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবেসেছি) সে (সেই প্রিয়তমা পত্নী) আমার প্রতি নিরাসক্ত, সে ভালোবাসে (বা কামনা করে) অন্য পুরুষকে; সেই পুরুষ (আবার) অন্যাসক্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীলোকে আসক্ত); আবার আমার কারণেও অনুশোচনা করে (অর্থাৎ দুঃখ পায় বা ধ্বংস হচ্ছে) (সে) অন্য কোনও এক স্ত্রীলোক। (তাই) ধিক্ সেই (পরপুরুষগামিনী) স্ত্রীলোককে, ধিক্ সেই পুরুষকে (যে একাধিক স্ত্রীজনে আসক্ত), ধিক্ এই (বারবণিতা) স্ত্রীলোককে এবং ধিক্ আমাকেও, (সর্বোপরি) ধিক্ সেই মদনকে (যার প্রভাবে এসব সংঘটিত হচ্ছে)।

অজ্ঞঃ সুখমারাধ্যঃ সুখতরমারাধ্যতে বিশেষজ্ঞঃ।
জ্ঞানলবদুর্বিদগ্ধং ব্রহ্মাপি নরং ন রঞ্জয়তি।। ০৩।।
অর্থাৎ : যে অজ্ঞ তাকে প্রসন্ন করা সহজ, বিজ্ঞকে প্রসন্ন করা আরও সহজ, (কিন্তু) স্বল্পজ্ঞানে গর্বিত যে পণ্ডিত তাকে ব্রহ্মাও পরিতুষ্ট করতে পারেন না।

প্রসহ্য মণিমুদ্ধরেন্মকরবক্ত্রদংষ্ট্রান্তরাৎ
সমুদ্রমপি সন্তরেৎ প্রচলদূর্মিমালাকুলম্ ।
ভুজঙ্গমপি কোপিতং শিরসি পুষ্পবদ্ধারয়ে-
ন্ন তু প্রতিনিবিষ্টমূর্খজনচিত্তমারাধয়েৎ।। ০৪।।
অর্থাৎ : মকরের মুখের যে-দাঁত তার মধ্য থেকেও (হয়তো) বলপ্রয়োগে মণি উদ্ধার করা যেতে পারে; চঞ্চল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রও (হয়তো) সাঁতরে পার হওয়া যেতে পারে; ক্রুদ্ধ সর্পকেও (হয়তো) পুষ্পের ন্যায় মস্তকে ধারণ করা যেতে পারে, কিন্তু সন্তুষ্ট করা যায় না আগ্রহহীন মূর্খের চিত্তকে।

লভেত সিকতাসু তৈলমপি যত্নতঃ পীড়য়ন্
পিবেচ্চ মৃগতৃষ্ণিকাসু সলিলং পিপাসার্দিতঃ।
কদাচিদপি পর্যটঞ্ছশবিষাণমাসাদয়েৎ
ন তু প্রতিনিবিষ্টমূর্খজনচিত্তমারাধয়েৎ।। ০৫।।
অর্থাৎ : সযত্ন পেষণের ফলে বালুরাশি থেকেও (হয়তো) তৈল-লাভ সম্ভব, (সচেষ্ট হলে) তৃষ্ণাতুর ব্যক্তিও (হয়তো) মরুমরীচিকায় জল পান করতে পারে, ঘুরতে ঘুরতে (হয়তো) কখনও খরগোসের শৃঙ্গও লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু দুরাগ্রহী মূর্খের চিত্ত (কোনভাবেই) পাওয়ার নয় (অর্থাৎ জয় বা প্রসন্ন করা যায় না)।

ব্যালং বালমৃণালতন্তুভিরসৌ রোদ্ধুং সমুজ্জৃন্ততে
ছেত্তুং বজ্রমণীঞুশিরীষকুসুমপ্রান্তেন সংনহ্যতে।
মাধুর্যং মধুবিন্দুনা রচয়িতুং ক্ষারাম্বুধেরীহতে
নেতুং বাঞ্ছতি যঃ খলান্ পথি সতাং সূক্তৈঃ সুধাস্যন্দিভিঃ।। ০৬।।
অর্থাৎ : সুধাবর্ষী বাক্যের দ্বারা যিনি অসৎ ব্যক্তিদের সৎপথে আনার সংকল্প করেন, (বলতে হবে, তিনি) কচি মৃণালতন্তুর দ্বারা দুষ্ট হস্তীকে বাধার চেষ্টা করছেন, (কোমল) শিরীষ ফুলের প্রান্তভাগ দিয়ে কঠিন হীরক খণ্ডকে ছিন্ন করতে উদ্যোগ (বা আত্মনিয়োগ) করেন এবং বিন্দু বিন্দু মধু দ্বারা (বৃহৎ) লবন সমুদ্রের মধুরতা সম্পাদনের অভিলাষ করেন।

স্বায়ত্তমেকান্তগুণং বিধাত্রা বিনির্মিতং ছাদনমজ্ঞতায়াঃ।
বিশেষতঃ সর্ববিদাং সমাজে বিভূষণং মৌনমপণ্ডিতানাম্ ।। ০৭।।
অর্থাৎ : বিধাতার দেওয়া নীরবতা মূর্খদের নিজ আয়ত্তে, (ইহা তাদের) অজ্ঞতার আচ্ছাদন (স্বরূপ এবং) অত্যন্ত হিতকর; সর্বজ্ঞদের সভায় (ইহা তাদের) বিশেষ ভূষণ (স্বরূপ)।

যদা কিংচিজ্জ্ঞোহং দ্বিপ ইব মদান্ধঃ সমভবং
তদা সর্বজ্ঞোস্মীত্যভবদবলিপ্তং মম মনঃ।
যদা কিংচিৎকিংচিদ্বুধজনসকাশাদবগতং
তদা মূর্খোস্মীতি জ্বর ইব মদো মে ব্যপগতঃ।। ০৮।।
অর্থাৎ : আমি যখন স্বল্পজ্ঞ, তখন আমি ছিলাম মদমত্ত হস্তীতুল্য। ‘আমি সর্বজ্ঞ’ এই ভেবে আমার মন (তখন অহঙ্কারে) আচ্ছন্ন (ছিল)। (কিন্তু) যখন বিদ্বানদের কাছ থেকে কিছু কিছু জানতে (শিখতে) লাগলাম তখন ‘আমি একজন মূর্খ’ এই ভেবে জ্বরের ন্যায় আমার অহঙ্কার অপসৃত হলো।

কৃমিকুলচিতং লালাক্লিন্নং বিগন্ধি জুগুপ্সিতং
নিরুপমরসং প্রীত্যা খাদন্নরাস্থি নিরামিষম্ ।
সুরপতিমপি শ্বা পার্শ্বস্থং বিলোক্য ন শঙ্কতে
ন হি গণয়তি ক্ষুদ্রো জন্তুঃ পরিগ্রহফল্গুতাম্ ।। ০৯।।
অর্থাৎ : কুকুর (যখন) কৃমিকীটে পূর্ণ, লালারসে আর্দ্র, দুর্গন্ধযুক্ত, ঘৃণ্য, মাংসহীন (এবং) অতুল্য স্বাদযুক্ত (কুকুরের পক্ষে) নরাস্থি (বা গাধার হাড় অতিশয়) প্রীতির সঙ্গে খেতে থাকে (তখন) পার্শ্ববর্তী দেবরাজ (ইন্দ্র)-কে দেখেও (সে) ভয় (বা লজ্জা) পায় না। (এর কারণ) নীচ প্রাণীরা (সাধারণত) পরিগৃহীত (বা স্বীকৃত) বস্তুর তুচ্ছতা (বা নগণ্যতা) বিচার করে না।

শিরং শার্বং স্বর্গাৎ পশুপতিশিরস্তঃ ক্ষিতিধরং
মহীধ্রাদুত্তুঙ্গাদবনিমবনেশ্চাপি জলধিম্ ।
অধোধো গঙ্গেয়ং পদমুপগতা স্তোকমথবা
বিবেকভ্রষ্টানাং ভবতি বিনিপাতঃ শতমুখঃ।। ১০।।
অর্থাৎ : (সুরসরিৎ) এই গঙ্গা স্বর্গ থেকে শিবের মাথায়, শিবের মাথা থেকে হিমালয়ে, উত্তুঙ্গ হিমালয় থেকে পৃথিবীতে এবং পৃথিবী থেকে সমুদ্রে- (এভাবে) ধীরে ধীরে নীচ থেকে নীচতর অবস্থায় উপনীত হয়। সত্যই বিবেকহীন ব্যক্তিদের অধঃপতন নানাভাবে(-ই) হয়ে থাকে।

শক্যো বারয়িতুং জলেন হুতভুক্ ছত্রেণ সূর্যাতপো
নাগেন্দ্রো নিশিতাঙ্কুশেন সমদো দণ্ডেন গোগর্দভৌ।
ব্যাধির্ভেষজসংগ্রহৈশ্চ বিবিধৈর্মন্ত্রপ্রয়োগৈর্বিষং
সর্বস্যৌষধমস্তি শাস্ত্রবিহিতং মূর্খস্য নাস্ত্যৌষধম্ ।। ১১।।
অর্থাৎ : জলের দ্বারা অগ্নিকে, ছত্র (ছাতা) দ্বারা সূর্যাতপকে, তীক্ষ্ণ অঙ্কুশ (হস্তী-তাড়ন-দণ্ড) দ্বারা মদমত্ত হস্তীকে, দণ্ড দ্বারা গরু ও গাধাকে, ভেষজ (ঔষধ) দ্বারা ব্যাধিকে (এবং) বিবিধ মন্ত্রপ্রয়োগে (সাপের) বিষকে(-ও) প্রশমিত করা যায়; (অর্থাৎ) সবকিছুরই শাস্ত্রসম্মত প্রতিকার আছে, কিন্তু প্রতিকার নেই কেবল মূর্খের।

সাহিত্যসঙ্গীত কলাবিহীনঃ সাক্ষাৎপশুঃ পুচ্ছবিষাণহীনঃ।
তৃণং ন খাদন্নপি জীবমানস্তদ্ভাগধেয়ং পরমং পশূনাম্ ।। ১২।।
অর্থাৎ : সাহিত্য-সঙ্গীত-কলায় অনভিজ্ঞজন পুচ্ছ (লেজ) ও শৃঙ্গ বিহীন সাক্ষাৎ পশু; এরা যে তৃণ ভক্ষণ না করেও বেঁচে আছে এটা(-ই প্রকৃত) পশুদের পরম সৌভাগ্য।

যেষাং ন বিদ্যা ন তপো ন দানং জ্ঞানং ন শীলং ন গুণো না ধর্মঃ।
তে মর্ত্যলোকে ভুবি ভারভূতা মনুষ্যরূপেণ মৃগাশ্চরন্তি।। ১৩।।
অর্থাৎ : যাদের বিদ্যা নেই সাধনা নেই দান নেই জ্ঞান নেই চরিত্র নেই গুণ নেই ধর্ম নেই- তারা মানবকুলে পৃথিবীর বোঝাস্বরূপ; (তারা) মনুষ্যরূপ মৃগের ন্যায় (কেবল) বিচরণ(-ই) করে।

বরং পর্বতদুর্গেষু ভ্রান্তং বনচরৈঃ সহ।
ন মূর্খজনসম্পর্কঃ সুরেন্দ্রভবনেষ্যপি।। ১৪।।
অর্থাৎ : ইন্দ্রপুরীতে মূর্খসঙ্গের চেয়ে অরণ্যচারীদের সঙ্গে দুর্গম পর্বতে বিচরণও শ্রেয়।


বিদ্বৎপদ্ধতি :

শাস্ত্রোপস্কৃতশব্দসুন্দরগিরঃ শিষ্যপ্রদেয়াগমা
বিখ্যাতাঃ কবয়ো বসন্তি বিষয়ে যস্য প্রভোর্নির্ধনাঃ।
তজ্জাড্যং বসুধাধিপস্য কবয়ো হ্যর্থং বিনাপীশ্বরাঃ
কুৎস্যাঃ স্যুঃ কুপরীক্ষকা ন মণয়ো যৈরর্ঘতঃ পাতিতাঃ।। ১৫।।
অর্থাৎ : যাঁদের বাক্য শাস্ত্র-শাসিত শব্দে মনোহর (এবং) যাঁদের জ্ঞান (বা শিক্ষা) শিষ্য(ছাত্র)-কে উপদেশ দিতে পর্যাপ্ত- সেই সব বিখ্যাত কবি যে-রাজার রাজ্যে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন (তাঁদের দারিদ্র্য দ্বারা) সেই রাজার মূর্খতা(-ই সূচিত হয়)। কবিগণ ধন ছাড়াও ধনী। (রত্নশাস্ত্রে) অনভিজ্ঞ জহুরী (বহুমূল্য) রত্নের (যথার্থ) মূল্য না দিলেও তাতে তারই অপযশ হয় (রত্নের কোন ক্ষতি হয় না)।

হর্তুর্যাতি ন গোচরং কিমপি শং পুষ্ণাতি যৎসর্বদা
হ্যর্থিভ্যঃ প্রতিপাদ্যমানমনিশং প্রাপ্নোতি বৃদ্ধিং পরাম্ ।
কল্পান্তেষ্যপি ন প্রয়াতি নিধনং বিদ্যাখ্যমন্তর্ধনং
যেষাং তান্ প্রতি মানমুজ্ঝত নৃপাঃ কস্তৈঃসহ স্পর্ধতে।। ১৬।।
অর্থাৎ : যা চোরের(-ও) দৃষ্টিগোচর হয় না, (যা) সর্বদাই কোনও এক অনির্বচনীয় আনন্দ দেয়, (যা) প্রার্থীদের (বিদ্যার্থীদের) মধ্যে নিরন্তর বিতরণ করলেও (শেষ হয় না, বরং) প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, (এমন কি পৃথিবীর) প্রলয়কালেও (যা) ধ্বংস না হয়- সেই বিদ্যা নামক গুপ্ত ধন যাঁদের (আছে), হে রাজন্! তাঁদের প্রতি অহঙ্কার পরিত্যাগ করুন; কে তাঁদের কাছে স্পর্ধা দেখাতে পারে ?

অধিগতপরমার্থান পণ্ডিতান্মাবমংস্থা-
স্তৃণমিব লঘুলক্ষ্মীর্নৈব তান্ সংরুণদ্ধি।
অভিনবমদলেখাশ্যামগণ্ডস্থলানাং
ন ভবতি বিসতন্তুর্বারণং বারণানাম্ ।। ১৭।।
অর্থাৎ : (হে রাজন্!) তত্ত্বজ্ঞানলব্ধ পণ্ডিতদের (কখনও) অবমাননা করবেন না, (কারণ) তৃণের মতোই তুচ্ছ লক্ষ্মী (অর্থাৎ ধন-সম্পত্তি) তাঁদের আবদ্ধ করতে পারে না; (যেমন) পারে না মৃণালতন্তু সদ্যনিঃসৃত মদলেখায় কৃষ্ণকপোল মত্ত হস্তীদের বাধা দিতে।

অম্ভোজিনীবননিবাসবিলাসমেব
হংসস্য হন্তি নিতরাং কুপিতো বিধাতা
ন ত্বস্য দুগ্ধজলভেদবিধৌ প্রসিদ্ধাং
বৈদগ্ধ্যকীর্তিমপহর্তুমসৌ সমর্থঃ।। ১৮।।
অর্থাৎ : (কোন কারণে) ক্রুদ্ধ বিধাতা কেবল হংসকুলের কমল-বন-বিহারের আনন্দই বিনাশ করতে পারেন, কিন্তু দুধ ও জলের পার্থক্য নিরূপণে তাদের যে নৈপুণ্যের খ্যাতি (আছে) তা বিনাশ করতে তিনি সমর্থ নন।

কেয়ূরা ন বিভূষয়ন্তি পুরুষং হারা ন চন্দ্রোজ্জ্বলা
ন স্নানং ন বিলেপনং ন কুসুমং নালংকৃতা মূর্ধজঃ।
বাণ্যেকা সমলঙ্করোতি পুরুষং যা সংস্কৃতা ধার্যতে
ক্ষীয়ন্তে খলু ভূষণানি সততং বাগ্ভূষণং ভূষণম্ ।। ১৯।।
অর্থাৎ : কেয়ূর, চন্দ্রোজ্জ্বল কণ্ঠভূষণ, (সুগন্ধজলে) অবগাহন, চন্দনাদি (সুগন্ধদ্রব্য), পুষ্প, অলংকৃত কেশরাজি (কোনটাই) পুরুষকে (অর্থাৎ মানুষকে) অলংকৃত করতে পারে না (বরং ব্যাকরণ শাস্ত্রাদি দ্বারা) পরিশুদ্ধ যে বাণী পুরুষ ধারণ করে, কেবল তা-ই পারে পুরুষকে অলংকৃত করতে। (কালক্রমে) সব অলঙ্কার(-ই) ধ্বংস হয়ে যায়, (কেবল) বাগলঙ্কারই চিরকালের অলঙ্কার (হয়ে থাকে)।

বিদ্যা নাম নরস্য রূপমধিকং প্রচ্ছন্নগুপ্তং ধনং
বিদ্যা ভোগকরী যশঃসুখকরী বিদ্যা গুরূণাং গুরুঃ।
বিদ্যা বন্ধুজনো বিদেশগমনে বিদ্য পরা দেবতা
বিদ্যা রাজসু পূজিতা ন তু ধনং বিদ্যাবিহীনঃ পশুঃ।। ২০।।
অর্থাৎ : বিদ্যা মানুষের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য ও গোপনে রক্ষিত (বহুমূল্য) ধন। বিদ্যা (মানুষকে) ভোগ দেয়, দেয় সুখ ও সুখ্যাতি। বিদ্যা গুরুর(-ও) গুরু। প্রবাসে বিদ্যা(-ই) বন্ধু। বিদ্যা পরম দেবতা। রাজসভায় বিদ্যা(-ই) সমাদৃত হয়, ধন নয়। (তাই) বিদ্যা যার নেই সে পশু(তুল্য)।

ক্ষান্তিশ্চেৎকবচেন কিং কিমরিভিঃ ক্রোধোস্তি চেদ্দেহিনাং
জ্ঞাতিশ্চেদনলেন কিং যদি সুহৃদ্দিব্যৌষধৈঃ কিং ফলম্ ।
কিং সর্পৈর্ষদি দুর্জনাঃ কিমু ধনৈর্বিদ্যানবদ্যা যদি
ব্রীড়া চেৎকিমু ভূষণৈঃ সুকবিতা যদ্যস্তি রাজ্যেন কিম্ ।। ২১।।
অর্থাৎ : মানুষের (মধ্যে) যদি ‘ক্ষমা’ গুণ থাকে (তাহলে) ধর্মের (আত্মরক্ষার্থে লৌহাদি নির্মিত আচ্ছাদন বিশেষ) কি প্রয়োজন ? কি প্রয়োজন (আত্মধ্বংসের জন্য অন্য কোন) শত্র“র, যদি (অন্তরে) ক্রোধ থাকে ? সগোত্র (জ্ঞাতি) থাকলে অগ্নির (আর) দরকার হয় না (অর্থাৎ অগ্নির ধ্বংসকাজ নিজেরাই করতে পারে); (উত্তম) বন্ধু যদি থাকে (তাহলে) উৎকৃষ্ট (স্বর্গীয়) ঔষধের দরকার কি ? দুর্জন থাকলে (বিষধর) সর্পের (কাজ) কি ? যথার্থ জ্ঞান (সম্পদ বা পরিশুদ্ধ বিদ্যা) যদি থাকে (তাহলে অন্য) ধনের (আর) কি দরকার ? লজ্জা থাকলে (অন্য) অলঙ্কারের (আর) প্রয়োজন কি ? প্রয়োজন(-ই বা) কি রাজ্যে যদি উত্তম কবিত্বশক্তি (অর্থাৎ গভীর পাণ্ডিত্য) থাকে ?

দাক্ষিণ্যং স্বজনে দয়া পরজনে শাঠ্যং সদা দুর্জনে
প্রীতিঃ সাধুজনে নয়ো নৃপজনে বিদ্বজ্জনেপ্যার্জবম্ ।
শৌর্যং শত্র“জনে ক্ষমা গুরুজনে নারীজনে ধূর্ততা
যে চৈবং পুরুষাঃ কলাসু কুশলাস্তেষ্যেব লোকস্থিতিঃ।। ২২।।
অর্থাৎ : আত্মজনের প্রতি ঔদার্য, ভৃত্যজনের প্রতি দয়া; শঠের প্রতি সদা শাঠ্য, সজ্জনের প্রতি প্রেম; রাজজনের (রাজপুরুষদের) প্রতি নীতি, পণ্ডিতজনের প্রতি সারল্য; শত্র“দের প্রতি বীরত্ব (শৌর্য), পূজনীয়দের প্রতি সহিষ্ণুতা; নারীজনের প্রতি ছলনা (শঠতা) ইত্যাদি কলাবিদ্যায় যে-সকল পুরুষ পারদর্শী তাদের উপরই সংসারের স্থৈর্য (বা স্থিতিশীলতা নির্ভর করে, অর্থাৎ এই জগৎসংসারে তারাই সুখে বসবাস করতে পারে)।

জাড্যং ধিয়ো হরতি সিঞ্চতি বাচি সত্যং
মানোন্নতিং দিশতি পাপমপাকরোতি।
চেতঃ প্রসাদয়তি দিক্ষু তনোতি কীর্তিং
সৎসঙ্গতিঃ কথয় কিং ন করোতি পুংসাম্ ।। ২৩।।
অর্থাৎ : সৎসঙ্গ পুরুষের (মানুষের) কি-না করে, বলো ? (ইহা) বুদ্ধির জড়তা দূর করে, বাক্যে সততা সঞ্চার করে, সম্মান বৃদ্ধি করে, পাপ দূর করে চিত্তকে প্রসন্ন রাখে, (এবং) দিকে দিকে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়।

জয়ন্তি তে সুকৃতিনো রসসিদ্ধাঃ কবীশ্বরাঃ।
নাস্তি যেষাং যশঃকায়ে জরামরণজং ভয়ম্ ।। ২৪।।
অর্থাৎ : পূণ্যবান ও রসিকপ্রবর সেই সব কবিশ্রেষ্ঠের(-ই) জয়-জয়কার- যাঁদের কীর্তিকলেবরে জরা-মৃত্যুর ভয় নেই।

সূনূঃ সচ্চরিতঃ সতী প্রিয়তমা স্বামী প্রসাদোন্মুখঃ
স্নিগ্ধং মিত্রমবঞ্চকঃ পরিজনো নিষ্ক্লেশলেশং মনঃ।
আকারো রুচিরঃ স্থিরশ্চ বিভবো বিদ্যাবদাতং মুখং
তুষ্টে বিষ্টপহারিণীষ্টদহরৌ সংপ্রাপ্যতে দেহিনা।। ২৫।।
অর্থাৎ : (জগতের) দুঃখহর্তা অভীষ্টবর্ষী বিষ্ণু প্রসন্ন থাকলে (বা হলে) মানুষ চরিত্রবান পুত্র, পতিব্রতা স্ত্রী, প্রসন্ন প্রভু, স্নেহময় সুহৃৎ, বিশ্বস্ত ভৃত্য, নিরুদ্বেগ মন, মনোহর আকৃতি, অক্ষয় ঐশ্বর্য এবং জ্ঞানদীপ্র মুখ লাভ করতে পারে।

প্রাণাঘাতান্নিবৃত্তিঃ পরধনহরণে সংযমঃ সত্যবাক্যং
কালে শক্ত্যা প্রদানাং যুবতিজনকথামূকভাবঃ পরেষাম্ ।
তৃষ্ণাস্রোতোবিভঙ্গো গুরুষু চ বিনয়ঃ সর্বভূতাণুকম্পা
সামান্যঃ সর্বশাস্ত্রেষ্যনুপহতবিধিঃ শ্রেয়সামেষ পস্থাঃ।। ২৬।।
অর্থাৎ : প্রাণসংহার থেকে বিরতি, অপরের সম্পত্তিহরণে সংযম, (সদা) সত্যকথা (বলা), সাধ্যানুসারে যথাকালে (ধনাদি) দান (করা), পরস্ত্রীচর্চায় মৌন থাকা, কামনা-প্রবাহের অবরোধ, পূজনীয়দের প্রতি নম্রতা এবং সর্বজীবে দয়া- এই(-ই) হচ্ছে সর্বশাস্ত্রে সকলের সুখের (একমাত্র) নিশ্চিত পথ; (এই) পথ (অনুসারীরা কখনও) ব্যর্থ হয় না।

প্রারভ্যতে ন খলু বিঘ্নভয়েন নীচৈঃ
প্রারভ্য বিঘœবিহতা বিরমন্তি মধ্যাঃ।
বিঘ্নৈঃ পুনঃ পুনরপি প্রতিহন্যমানাঃ
প্রারব্ধমুত্তমজনা ন পরিত্যজন্তি।। ২৭।।
অর্থাৎ : অধমেরা (দুর্বলচিত্তেরা) বিঘ্নভয়ে (কোন কাজ) আরম্ভ করে না, মধ্যমেরা (সাধারণ জন) আরম্ভ করে(-ও) বাধাগ্রস্ত (হয়ে তা থেকে) বিরত থাকে, (কিন্তু) উত্তমেরা (সাহসীরা) বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েও আরম্ভকৃত (কাজ) কখনও পরিত্যাগ করেন না।

প্রিয়া ন্যায়া বৃত্তির্মলিনমসুভঙ্গেপ্যসুকরং
ত্বসন্তো নাভ্যর্থ্যাঃ সুহৃদপি ন যাচ্যঃ কৃশধনঃ।
বিপদ্যুচ্চৈঃ স্থেয়ং পদমনুবিধেয়ং মহতাং
সতাং কেনোদ্দিষ্টং বিষমমসিধারাব্রতমিদম্ ।। ২৮।।
অর্থাৎ : (একমাত্র) সন্তোষজনক (অথচ) ন্যায়সংগত জীবিকা(-ই গ্রহণীয়), প্রাণান্তকালেও নিন্দনীয় কর্ম (করা) সহজ নয় (অর্থাৎ নিন্দনীয় কর্ম করা উচিত নয়), দুর্জনেরা প্রার্থনীয় নয়, স্বল্পবিত্ত মিত্রও যাচনীয় নয়, বিপদে (পড়লেও) মর্যাদায় অধিষ্ঠান করতে হবে (অর্থাৎ আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে হবে এবং) মহৎ ব্যক্তিদের পদানুসরণ করতে হবে- অসিধারার ন্যায় এমন তীক্ষ্ণতর ব্রত(-এর) উপদেশ মহৎদের কে দিয়েছেন ?


মানশৌর্যপদ্ধতি :

ক্ষুৎক্ষামোপি জরাকৃশোপি শিথিলপ্রায়োপি কষ্টাং দশা-
মাপন্নোপি বিপন্নদীধিতিরপি প্রাণেষু নশ্যৎস্বপি।
মত্তেভেন্দ্রবিভিন্নকুম্ভকব লগ্রাসৈকবদ্ধস্পৃহঃ
কিং জীর্ণং তৃণমত্তি মানমহতামগ্রেসরঃ কেশরী।। ২৯।।
অর্থাৎ : ক্ষুধায় কাতর হলেও, বার্ধক্যহেতু দুর্বল হলেও, প্রাণশক্তি ক্ষীণ হয়ে এলেও, (জীবনের) কষ্টকর অবস্থায় উপনীত হলেও, তেজ দূরীভূত হলেও মদমত্ত গজরাজের কপোলের মাংস এক গ্রাসে খেতে (যে) লুব্ধ (এবং) আত্মসম্মানে যারা মহান্ তাদের (মধ্যে যে) অগ্রগণ্য (সেই) সিংহরাজ (মৃগরাজ) কি প্রাণপাত হলেও শুষ্ক তৃণ ভক্ষণ করে ?

স্বল্পস্নায়ুবসাবশেষমলিনং নির্মাংসমপ্যস্থিকং
শ্বা লব্ধ্বা পরিতোষমেতি ন তু তত্তস্য ক্ষুধাশান্তয়ে।
সিংহো জম্বুকমঙ্কমাগতমপি ত্যক্তা নিহন্তি দ্বিপং
স্বর্বঃ কৃচ্ছ্রগতোপি বাঞ্ছতি জনঃ সত্বানুরূপং ফলম্ ।। ৩০।।
অর্থাৎ : সামান্য স্নায়ু (দেহাভ্যন্তরস্থ সূত্রবৎ সূক্ষ্মনাড়ী বা তন্তুবিশেষ) ও মেদ অবশিষ্ট থাকায় মলিন (ও) মাংসবিহীন (এক টুকরো পরিত্যক্ত) অস্থি (অর্থাৎ, যে-কোন মৃত জন্তুর হাড়) পেয়েই কুকুর তুষ্ট হয়, কিন্তু তা তার ক্ষুধার উপশম ঘটায় না। (অন্য দিকে) অঙ্কগত (অর্থাৎ হস্তগত) শৃগালকেও ত্যাগ করে (বা ছেড়ে দিয়ে) মৃগরাজ (দূরস্থ এবং কষ্টায়ত্ত) হস্তীকেই হত্যা করে (তার মাংস খায়)। (তাই) সংকটাপন্ন হলেও সকল (মহান) ব্যক্তিরা(-ই) আপন পৌরুষের অনুরূপ ফল (সিদ্ধি) কামনা করেন।

লাঙ্গূলচালনমধশ্চরণাবপাতং
ভূমৌ নিপত্য বদনোদরদর্শনং চ।
শ্বা পিণ্ডদস্য কুরুতে গজপুঙ্গবস্তু
ধীরং বিলোকয়তি চাটুশতৈশ্চ ভুঙক্তে।। ৩১।।
অর্থাৎ : কুকুর অন্নদাতার (সম্মুখে সামান্য খাবারের পরিবর্তে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ) লেজ নাড়ায় এবং (প্রভুর) চরণতলে মাটিতে পড়ে (প্রভুকে নিজের) মুখ ও পেট প্রদর্শন করে (অর্থাৎ ভোজনের তৃপ্তির কথা জানায়)। কিন্তু গজরাজ (তার প্রভু বা অন্নদাতার প্রতি) গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাকায় (অর্থাৎ কোনরূপ দীনতা প্রকাশ করে না এবং (প্রভুর) অনেক অনুরোধের (পর) আহার গ্রহণ করে (কুকুর অর্থাৎ নীচ প্রাণীর মতো পেলেই খায় না)।

পরিবর্তিনি সংসারে মৃতঃ কো বা ন জায়তে !
স জাতো যেন জাতেন যাতি বংশঃ সমুন্নতিম্ ।। ৩২।।
অর্থাৎ : পরিবর্তনশীল (এই জগৎ) সংসারে মৃত কে-ই বা না জন্মগ্রহণ করে (অর্থাৎ কে-ই বা না মরে আর কে-ই বা না জন্মে, কিন্তু একমাত্র) সে(-ই) জন্মেছে (অর্থাৎ তার জন্মই সার্থক) যার জন্মের দ্বারা (তার) বংশ (প্রভূত) উন্নতি লাভ করেছে।

কুসুমস্তবকস্যেব দ্বয়ী বৃত্তির্মনস্বিনঃ।
মূর্ধ্নি বা সর্বলোকস্য বিশীর্যেত বনেথবা।। ৩৩।।
অর্থাৎ : পুষ্পগুচ্ছের ন্যায় মানী ব্যক্তিদের (জীবনেও) দুই প্রকার স্থিতি (বা পরিণতি) লাভ (ঘটে থাকে) হয়- সব মানুষের মস্তকে (অবস্থান) অথবা অরণ্যেই জীর্ণ হওয়া।

সন্ত্যন্যেপি বৃহস্পতিপ্রভৃতয়ঃ সংভাবিতাঃ পঞ্চষা-
স্তান্ প্রত্যেষ বিশেষবিক্রমরুচী রাহুর্ন বৈরায়তে।
দ্বাবেব গ্রসতে দিনেশ্বরনিশাপ্রাণেশ্বরৌ ভাস্বরৌ
ভ্রাতঃ পর্বণি পশ্য দানবপতিঃ শীর্ষাবশেষীকৃতঃ।। ৩৪।।
অর্থাৎ : দেখ, ভাই! বৃহস্পতি প্রভৃতি অপর পাঁচ-ছয়টি শ্রেষ্ঠ গ্রহ (বর্তমান) থাকতে যোগ্যস্থানে পরাক্রম প্রদর্শনে অভিলাষী, ‘দেহ’ বলতে যার কেবল মস্তকটিই অবশিষ্ট আছে- সেই দৈত্যরাজ রাহু তাদের প্রতি (কখনও) শত্রুতা দেখায় না, (কিন্তু তেজে) ভাস্বর (অপর) দু’টি গ্রহ সূর্য ও চন্দ্রকেই সে পর্বে পর্বে (অর্থাৎ অমাবস্যা ও পূর্ণিমায়) গ্রাস করে (অর্থাৎ আক্রমণ করে)।

বহতি ভুবনশ্রেণীং শেষঃ ফণাফলকস্থিতাং
কমঠপতিনা মধ্যেপৃষ্ঠং সদা স চ ধার্যতে।
তমপি কুরুতে ক্রোড়াধীনং পয়োধিরনাদরা-
দহহ! মহতাং নিঃসীমানশ্চরিত্রবিভূতয়ঃ।। ৩৫।।
অর্থাৎ : (ভগবান) শেষনাগ (বা সর্পরাজ তার) ফণাভাগে অবস্থিত লোকচক্র (স্বর্গাদি ত্রিলোক বা ভূরাদি সপ্তলোক) বহন করছেন, তাঁকে আবার মধ্যপৃষ্ঠে ধারণ করে আছেন কূর্মরাজ (অর্থাৎ বিষ্ণুর কূর্মাবতার); তাঁকেও আবার অবলীলায় অঙ্গে ধারণ করে আছেন (বিশাল) সমুদ্র। কি আশ্চর্য ! মহাত্মাদের চরিত্র-মাহাত্ম্যের (যেন) অন্ত নেই।

বরং পক্ষচ্ছেদঃ সমদমঘবন্মুক্তকুলিশ-
প্রহারৈরুদ্গচ্ছদ্ব হলদহনোদ্গারগুরুভিঃ।
তুষারাদ্রেঃ সূনোরহহ পিতরি ক্লেশবিবশে
ন চাসৌ সম্পাতঃ পয়সি পয়সাং পত্যুরুচিতঃ।। ৩৬।।
অর্থাৎ : উদ্ধত ইন্দ্রের নিক্ষিপ্ত বজ্রের দুঃসহ আঘাত- যে-আঘাতে অজস্র অগ্নি-শিখা উর্ধ্বে উদ্গত হয়েছিলো, তাতে হিমালয়পুত্র মৈনাকের পক্ষচ্ছেদন(-ও) বরং ভালো (ছিলো, কিন্তু) হায় ! পিতা (বজ্রাঘাতের) যন্ত্রণায় অবশ হলে (তাকে ফেলে) সমুদ্রের জলে এর (অর্থাৎ মৈনাকের) প্রবেশ (অর্থাৎ আত্মরক্ষার্থে সমুদ্রের জলে আত্মগোপন করা) উচিত হয়নি।

যদচেতনোপি পাদৈঃ স্পৃষ্টঃ প্রজ্জ্বলতি সবিতুরিনকান্তঃ।
তত্ত্বেজস্বী পুরুষঃ পরকৃতনিকৃতিং কথং সহতে।। ৩৭।।
অর্থাৎ : যেহেতু অচেতন সূর্যকান্তমণিও সূর্যের পদাঘাতে (অপমানিত হয়ে. অন্যার্থ কিরণ স্পর্শে) জ্বলে ওঠে, সুতরাং তেজস্বী (সচেতন) পুরুষ কি করে শত্রুকৃত অপমান সহ্য করে ?

সিংহঃ শিশুরপি নিপততি মদমলিনকপোলভিত্তিষু গজেষু।
প্রকৃতিরিয়ং সত্ত্ববতাং ন খলু বয়স্তেজসু হেতুঃ।। ৩৮।।
অর্থাৎ : সিংহ শিশু হলেও মদবারি দ্বারা শ্যামবর্ণগণ্ডবিশিষ্ট হস্তীর উপর(-ই) পতিত হয় (অর্থাৎ আক্রমণ চালায়)। তেজস্বীদের এটা(-ই) স্বভাব। আসলে বিক্রমের কারণ বয়স নয়।


অর্থপদ্ধতি :

জাতির্যাতু রসাতলং গুণগণস্তস্যাপ্যধো গচ্ছতু
কীলং শৈলতটাৎপতত্বভিজনঃ সংদহ্যতাং বহ্নিনা।
শৌর্যে বৈরিণি বজ্রমাশু নিপতত্বর্থোস্তু নঃ কেবলং
যেনৈকেন বিনা গুণাস্তৃণলবপ্রায়াঃ সমস্তা ইমে।। ৩৯।।
অর্থাৎ : (ব্রাহ্মণাদি) জাতি (সকল) অধঃপাতে যাক, তার চেয়েও অধঃপাতে যাক (ধৈর্যাদি) গুণ সকল; সদাচার পর্বতচূড়া থেকে পতিত হোক (অর্থাৎ, মহৎ ব্যক্তিদের কাছ থেকে স্খলিত হোক), বংশ (অর্থাৎ বংশের কৌলীন্য) অগ্নিতে ভস্মীভূত হোক, শত্র“রূপ শৌর্যের উপর এক্ষুণি বজ্র নিপতিত হোক, কেবল (সেই) অর্থ(-ই) আমাদের বর্তমান থাক- যার অভাবে ঐ সমস্ত গুণ শুষ্ক তৃণবৎ (মূল্যহীন) হয়ে যায়।

তানীন্দ্রিয়াণি সকলানি তদেব কর্ম
গা বুদ্ধিরপ্রতিহতা বচনং তদেব।
অর্থোষ্মণা বিরহিতঃ পুরুষঃ স এব
ত্বন্যঃ ক্ষণেন ভবতীতি বিচিত্রমেতৎ।। ৪০।।
অর্থাৎ : (যার চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়সকল প্রসিদ্ধ ও বিকারবিহীন, খ্যাতি(-ও যার) প্রসিদ্ধ; অকুণ্ঠিত বুদ্ধিবৃত্তি এবং নির্ভীক (যার) উক্তি- সেই পুরুষও মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে যায় (অন্যরূপ ধারণ করে যদি) না ধনের গৌরব (অর্থাৎ, ধনের প্রাচুর্য) থাকে; এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার !

যস্যাস্তি বিত্তং স নরঃ কুলীনঃ
স পণ্ডিতঃ স শ্রুতবান্ গুণজ্ঞঃ।
স এব বক্তা স চ দর্শনীয়ঃ
সর্বে গুণাঃ কাঞ্চনমাশ্রয়ন্তে।। ৪১।।
অর্থাৎ : যার ধন আছে সেই মানুষ(-ই) কুলীন, সে প্রাজ্ঞ (বা পণ্ডিত), সে শাস্ত্রজ্ঞ, সে গুণবান্, সে-ই (উত্তম) বক্তা এবং সে (সকলের) দর্শনীয় হয়; সকল প্রকার গুণ অর্থকে(-ই) ঘিরে থাকে।

দৌর্মন্ত্র্যান্নৃ পতির্বিনশ্যতি যতিঃ সঙ্গাৎ সুতো লালনা-
দ্বিপ্রোনধ্যয়নাৎ কুলং কুতনয়াচ্ছীলং খলোপাসনাৎ।
হ্রীর্মদ্যাদনবেক্ষণাদপি কৃষিঃ স্নেহঃ প্রবাসাশ্রয়া-
ন্মৈত্রী চাপ্রণয়াৎ সমৃদ্ধিরনরাত্ত্যাগপ্রমাদাদ্ধনম্ ।। ৪২।।
অর্থাৎ : রাজা কুমন্ত্রণার দ্বারা, যোগী সংসর্গ দ্বারা, পুত্র (অত্যাধিক স্নেহে) পালনের দ্বারা, ব্রাহ্মণ অনধ্যয়ন দ্বারা, বংশ কুপুত্রের দ্বারা, চরিত্র দুষ্ট লোকের সঙ্গদ্বারা, লজ্জা মদ্যপান দ্বারা, কৃষি অমনোযোগের দ্বারা, প্রেম প্রবাসযাপনের দ্বারা, বন্ধুত্ব ভালবাসার (বা প্রণয়ের) অভাবে, উন্নতি নীতিহীনতার দ্বারা এবং ধন অমিতদানের দ্বারা বিনষ্ট হয়।

দানং ভোগো নাশস্তিস্রো গতয়ো ভবন্তি বিত্তস্য।
যো ন দদাতি ন ভুঙ্ক্তে তস্য তৃতীয়া গতির্ভবতি।। ৪৩।।
অর্থাৎ : অর্থের গতি তিন প্রকার- দান, ভোগ (ও) বিনাশ। যে দান করে না, ভোগ(-ও) করে না- তার (ধনের) তৃতীয় গতি(-ই) হয়।

মণিঃ শাণোল্লীঢ়ঃ সমরবিজয়ী হেতিনিহতো
মদক্ষীণো নাগঃ শরদি সরিদাশ্যানপুলিনা।
কলাশেষশ্চন্দ্রঃ সুরতমৃদিতা বালবণিতা
তনিম্না শোভন্তে গলিতবিভবাশ্চার্থিষু জনাঃ।। ৪৪।।
অর্থাৎ : কষ্টিপাথরে ঘৃষ্ট (অর্থাৎ, ঘর্ষণের দ্বারা খাঁটি ও মসৃণ) রত্ন, অস্ত্রাহত রণজয়ী, মদস্রাবে কৃশ গজরাজ, শরৎকালে শুষ্কতট নদী, কলামাত্র অবশিষ্ট চন্দ্র, রতিক্রীড়ায় বিহ্বল নববধূ এবং প্রার্থীদের মধ্যে বিতরণের ফলে যারা নিঃসম্বল- এরা সকলে ক্ষীণতার দ্বারাই শোভা পায়।

পরিক্ষীণঃ কশ্চিৎস্পৃহয়তি যবানাং প্রসৃতয়ে
স পশ্চাৎ সম্পূর্ণঃ কলয়তি ধরিত্রীং তৃণসমাম্ ।
অতশ্চানৈকান্ত্যাদ্ গুরুলঘুতয়ার্থেষু ধনিনা-
মবস্থা বস্তূনি প্রথয়তি চ সঙ্কোচয়তি চ।। ৪৫।।
অর্থাৎ : কোনও এক দরিদ্র ব্যক্তি একমুষ্টি যব(-ও) কামনা করে, (কিন্তু) কালক্রমে সে (ধন-সম্পদে) সমৃদ্ধ হলে পৃথিবীটাকে(-ও) তৃণসম জ্ঞান করে। অতএব, অর্থের অনিশ্চয়তা হেতু ধনবানদের ভালো-মন্দ অবস্থা(-ই) বস্তুসকলকে মূল্যবান ও মূল্যহীন (বা বড়-ছোট প্রতিপন্ন) করে।

রাজন্ দুধুক্ষসি যদি ক্ষিতিধেনুমেতাং
তেনাদ্য বৎসমিব লোকমমুং পুষাণ।
তস্মিংশ্চ সম্যগনিশং পরিপোষ্যমাণে
ইানাফলং ফলতি কল্পলতেব ভূমিঃ।। ৪৬।।
অর্থাৎ : হে রাজন! পৃথ্বীরূপ গাভীকে যদি দোহন করতে চান তাহলে আজ(-ই) বৎসের ন্যায় ঐ প্রজাবর্গের (উত্তমরূপে) পরিপালন করুন। উত্তমরূপে তার (অর্থাৎ প্রজাবর্গের) নিত্য পরিপালন হলে পৃথিবী কল্পলতার ন্যায় নানাপ্রকার ফল প্রদান করে।

সত্যানৃতা চ পুরুষা প্রিয়বাদিনী চ
হিংস্রা দয়ালুরপি চার্থপরা বদান্যা।
নিত্যব্যয়া প্রচুরনিত্যধনাগমা চ
বারাঙ্গনেব নৃপনীতিরনেকরূপা।। ৪৭।।
অর্থাৎ : (কখনও) সত্যবাদিনী (কখনও) মিথ্যাবাদিনী, (কখনও) কঠোর ভাষিনী (কখনও) মধুরালাপিনী; (কখনও) নির্দয়া (কখনও) দয়াবতী, (কখনও) ধনলোভী (কখনও) দানবতী, (কখনও) প্রচুর ব্যয়-কারিণী এবং (কখনও) প্রচুর ধনার্জনকারিণী (এই) ‘রাজনীতি’ বারাঙ্গনার ন্যায় বহুরূপিণী।

আজ্ঞা কীর্তিঃ পালনং ব্রাহ্মণানাং
দানং ভোগো মিত্রসংরক্ষণং চ।
যেষামেতে ষড়্ গুণা ন প্রবৃত্তাঃ
কোর্থস্তেষাং পার্থিবোপাশ্রয়েণ।। ৪৮।।
অর্থাৎ : হে রাজন্! যাদের মধ্যে শাসন, যশঃ, ব্রাহ্মণদের প্রতিপালন, (সৎপাত্রে) দান, (ঐশ্বর্যাদি) ভোগ এবং বন্ধুবর্গের পরিপালন- এই ষড়বিধ গুণ নেই তাদের সেবা (বা আশ্রয় গ্রহণ) করায় কি লাভ ?

যদ্ধাত্রা নিজভালপট্টলিখিতং স্তোকং মহদ্বা ধনং
তৎ প্রাপ্নোতি মরুস্থলেপি নিতরাং মেরৌ ততো নাধিকম্ ।
তদ্ধীরো ভব বিত্তবৎসু কৃপণাং বৃত্তিং বৃথা মা কৃথাঃ
কূপে পশ্য পয়োনিধাবপি ঘটো গৃহ্নাতি তুল্যং জলম্ ।। ৪৯।।
অর্থাৎ : বিধাতা কর্তৃক আপন ললাটে যে-কম-বা-বেশি (পরিমাণ) ধন লিখিত হয়েছে তা মরুভূমিতেও (অর্থাৎ অস্থানেও) অবশ্য পাওয়া যায়, তার অধিক হেমাদ্রিতেও নয়। অতএব, (হে মানব!) ধৈর্যশীল হও; বিত্তবানদের কাছে অনর্থক দীন আচরণ করো না। দেখো, কূপেই হোক আর সমুদ্রই হোক ঘট সমপরিমাণ জল(-ই) ধারণ করে।

ত্বমেব চাতকাধারোসীতি কেষাং ন গোচরঃ।
কিমম্ভোদবরাস্মাকং কার্পণ্যোক্তিং প্রতীক্ষসে।। ৫০।।
অর্থাৎ : হে মেঘশ্রেষ্ঠ! তুমিই চাতকদের (একমাত্র) আশ্রয়- একথা কার না জানা আছে (বা কে না জানে)? অতএব, কেন তুমি আমাদের করুণ উক্তির অপেক্ষা করছো (অর্থাৎ করুণ প্রার্থনা শুনতে চাও)?

রে রে চাতক সাবধানমনসা মিত্র ক্ষণং শ্রূয়তা-
মম্ভোদা বহবো হি সন্তি গগনে সর্বেপি নৈতাদৃশাঃ।
কেচিদ্বৃষ্টিভিরার্দ্রয়ন্তি বসুধাং গর্জন্তি কেচিদ্বৃথা
যং যং পশ্যসি তস্য তস্য পুরতো মা ব্রূহি দীনং বচঃ।। ৫১।।
অর্থাৎ : ওহে বন্ধু চাতক! অবহিত চিত্তে ক্ষণকাল (আমার কথা) শোন- আকাশে অনেক মেঘই আছে, (কিন্তু) সকলেই একরকম নয়; কেউ কেউ বৃষ্টি দ্বারা পৃথিবীকে সিক্ত (উর্বরা) করে, (আবার) কেউ কেউ বৃথাই গর্জন করে। (অতএব) যাকে যাকে(-ই) দেখবে তার তার সম্মুখে(-ই তুমি) কাতরোক্তি করো না।


দুর্জনপদ্ধতি :

অকরুণত্বমকারণবিগ্রঃ
পরধনে পরযোষিতি চ স্পৃহা।
সুজনবন্ধুজনেষ্যসহিষ্ণুতা
প্রকৃতিসিদ্ধমিদং হি দুরাত্মনাম্ ।। ৫২।।
অর্থাৎ : নির্দয়তা, বিনাকারণে কলহ, পরধন ও পরস্ত্রীতে আসক্তি, সজ্জন ও সুহৃজ্জনে ঈর্ষা- এগুলো (হচ্ছে) দুর্জনদের স্বভাবসিদ্ধ (প্রবৃত্তি)।

দুর্জনঃ পরিহর্তব্যো বিদ্যয়া ভূষিতোপি সন্ ।
মণিনালংকৃতঃ সর্পঃ কিমসৌ ন ভয়ঙ্করঃ।। ৫৩।।
অর্থাৎ : বিদ্যা দ্বারা ভূষিত হলেও দুর্জন ব্যক্তি পরিহার্য; (দেখ) মণি-শোভিত এই ফণী কি ভয়ঙ্কর নয় ?

জাড্যং হ্রীমতি গণ্যতে ব্রতরুচৌ দম্ভঃ শুচৌ কৈতবং
শূরে নির্ঘৃণতা মুনৌ বিমতিতা দৈন্যং প্রিয়ালাপিনি।
তেজস্বিন্যবলিপ্ততা মুখরতা বক্তর্যশক্তিঃ স্থিরে
তৎ কো নাম গুণো ভবেৎ স গুণিনাং যো দুর্জনৈর্নাঙ্কিতঃ।। ৫৪।।
অর্থাৎ : (দুর্জন ব্যক্তি) লজ্জাশীলের মধ্যে জড়তা, ব্রতচারীর মধ্যে দম্ভ, চরিত্রবানের মধ্যে কপটতা, বীরের মধ্যে হৃদয়হীনতা, মুনিদের মধ্যে প্রজ্ঞাহীনতা, প্রিয়ভাষীদের মধ্যে দুর্বলতা, বলবানের মধ্যে ঔদ্ধত্য, বক্তার মধ্যে বাচালতা (এবং) ধীরস্বভাব ব্যক্তির মধ্যে অসমর্থতা (ইত্যাদি দোষসমূহ) আবিষ্কার করে। অতএব, গুণীদের এমন কি গুণ আছে (বা থাকতে পারে) যা দুর্জন কর্তৃক (এমনিভাবে) কলঙ্কিত নয় (অথবা কলঙ্কিত হয় না)।

লোভশ্চেদগুণেন কিং পিশুনতা যদ্যস্তি কিং পাতকৈঃ
সত্যং চেত্তপসা চ কিং শুচি মনো যদ্যস্তি তীর্থেন কিম্ ।
সৌজন্যং যদি কিং নিজৈঃ স্বমহিমা যদ্যন্তি কিং মণ্ডনৈঃ
সদ্বিদ্যা যদি কিং ধনৈরপয়শো যদ্যস্তি কিং মৃত্যুনা।। ৫৫।।
অর্থাৎ : (মানুষের মধ্যে) যদি লোভ (থাকে তাহলে আর অন্য কোন) দোষের কী দরকার ? যদি খলতা থাকে (তাহলে অন্য কোন) পাপের কী আবশ্যকতা ? যদি সত্য (অর্থাৎ সত্যবাদিতা থাকে তাহলে কষ্টকর) তপস্যার কী কাজ ? যদি পবিত্র মন থাকে (তাহলে) তীর্থ করার কী দরকার ? যদি সুজনতা (থাকে তাহলে দয়াদি) গুণের কী দরকার ? যদি সুখ্যাতি থাকে (তাহলে হারাদি) অলঙ্কারের দরকার কী ? উত্তম বিদ্যা যদি (থাকে তাহলে অন্য) ধনের (আর) কী দরকার ? (আর) যদি কলঙ্ক(-ই) থাকে (তাহলে) মৃত্যুর (আর) কী দরকার ?

শশী দিবসধূসরো গলিতযৌবনা কামিনী
সরো বিগতবারিজং মুখমনক্ষরং স্বাকৃতেঃ।
প্রভুর্ধনপরায়ণঃ সততদুর্গতঃ সজ্জনো
নৃপাঙ্গণগতঃ খলো মনসি সপ্ত শল্যানি মে।। ৫৬।।
অর্থাৎ : দিবসের ধূসর চাঁদ, বিগতযৌবনা কামিনী, পদ্মহীন সরোবর, দিব্যকায় পুরুষের বিদ্যাহীন মুখ, ধনলুব্ধ রাজা, নিরন্তর দুর্দশাগ্রস্ত সজ্জন (এবং) রাজগৃহাশ্রিত দুর্জন- (এই) সাতটি আমার হৃদয়ে শেল (স্বরূপ বিরাজমান)।

ন কশ্চিচ্চণ্ডকোপানামাত্মীয়ো নাম ভূভুজাম্ ।
হোতারমপি জুহ্বানং স্পৃষ্টো দহতি পাবকঃ।। ৫৭।।
অর্থাৎ : উগ্রক্রোধ রাজাদের কেউ আত্মীয় (হয়) না; (দেখ, করাঙ্গুলমাত্র দ্বারা) স্পৃষ্ট (হলেও) অগ্নি (তার-ই উদ্দেশ্যে) যজ্ঞকারী বা হব্যদানকারী পুরোহিতকেও দহন করে।

মৌনাদ্মূকঃ প্রবচনপটুশ্চাটুলো জল্পকো বা
ধৃষ্টঃ পার্শ্বে ভবতি চ বসন্দূরতোপ্যপ্রগল্ভঃ।
ক্ষান্ত্যা ভীরুর্যদি ন সহতে প্রায়শো নাভিজাতঃ
সেবাধর্মঃ পরমগহনো যোগিনামপ্যগম্যঃ।। ৫৮।।
অর্থাৎ : (সেবক যদি) নীরব থাকে (তাহলে তাকে বলা হয়) বোবা, বাকপটু হলে (বলে) বাচাল; সর্বদা (প্রভুর) পাশে-পাশে থাকলে (বলে) নির্লজ্জ (বা অবিনীত); (আর যদি) দূরে দূরে থাকে তাহলে (বলে) নির্বুদ্ধি; (যদি তার মধ্যে) সহিষ্ণুতা থাকে (তাহলে বলে) ভীরু-কাপুরুষ; (আর) যদি (সে প্রভুর কটূক্তি) সহ্য না করে (তাহলে) সাধারণত (তাকে বলা হয়) অকুলীন। (অতএব, এই) সেবাধর্ম অত্যন্ত কঠিন, (ইহা) মুনিদেরও (বুদ্ধির) অগম্য।

উদ্ভাসিতাখিলখলস্য বিশৃঙ্খলস্য
প্রাগ্জাতবিস্মৃতনিজাধমকর্মবৃত্তেঃ।
দৈবাদবাপ্তবিভবস্য গুণদ্বিষোস্য
নীচস্য গোচরগতৈঃ সুখমাস্যতে কৈঃ।। ৫৯।।
অর্থাৎ : সমস্ত দুর্জনদের প্রশ্রয়দানকারী (এবং) স্বেচ্ছাচারী যে-ব্যক্তি নিজের অতীত কুকর্ম ও কুপেশার কথা ভুলে গেছে এবং দৈববশতঃ (বা ভাগ্যবলে) ঐশ্বর্য লাভ করেছে, সেই গুণদ্বেষী নীচ ব্যক্তির সংস্পর্শে গিয়ে কে সুখ পেতে পারে ?

আরম্ভগুর্বী ক্ষয়িণী ক্রমেণ
লঘ্ঘী পুরা বৃদ্ধিমতী চ পশ্চাৎ।
দিনস্য পূর্বার্ধপরার্ধভিন্না
ছায়েব মৈত্রী খলসজ্জনানাম্ ।। ৬০।।
অর্থাৎ : (দুর্জন ও সজ্জনের মিত্রতা যথাক্রমে) দিবসের পূর্বাহ্ণ ও পরাহ্ণের ছায়ার ন্যায় ভিন্ন হয়ে থাকে। দুর্জনের মৈত্রী আরম্ভে ব্যাপক, (কিন্তু) ক্রমশঃ ক্ষীণ (হয়); সজ্জনের মৈত্রী প্রথমে ক্ষীণ, (কিন্তু) পরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত (হয়)।

মৃগমীনসজ্জনানাং তৃণজলসন্তোষবিহিতবৃত্তীনাম্ ।
লুব্ধকধীবরপিশুনা নিষ্কারণবৈরিণো জগতি।। ৬১।।
অর্থাৎ : (এ) জগতে ব্যাধ, ধীবর ও দুর্জনেরা অকারণে তৃণজীবী, জলজীবী ও সন্তোষবৃত্তিজীবী (যথাক্রমে) মৃগ, মৎস্য ও সজ্জনদের শত্রু হয়ে থাকে।


সুজনপদ্ধতি :

বাঞ্ছা সজ্জনসঙ্গমে পরগুণে প্রীতির্গুরৌ নম্রতা
বিদ্যায়াং ব্যসনং স্বযোষিতি রতির্লোকাপবাদাদ্ভয়ম্ ।
ভক্তিঃ শূলিনি শক্তিরাত্মদমনে সংসর্গমুক্তিঃ খলে
এতে যেষু বসন্তি নির্মলগুণাস্তেভ্যো নরেভ্যো নমঃ।। ৬২।।
অর্থাৎ : সজ্জনের সঙ্গ কামনা, অপরের গুণাবলীর প্রতি সন্তোষ, পূজনীয়দের প্রতি বিনয়, বিদ্যায় আসক্তি, স্বস্ত্রীর প্রতি অনুরাগ, লোকনিন্দায় ভীতি, শিবে ভক্তি, আত্মসংযমে সামর্থ্য, দুর্জনের সঙ্গত্যাগ- এ-সকল পবিত্র গুণাবলী যে-সকল মানুষের মধ্যে বর্তমান তাঁদের প্রতি নমস্কার।

বিপদি ধৈর্যমথাভ্যুদয়ে ক্ষমা
সদসি বাক্পটুতা যুধি বিক্রমঃ।
যশসি চাভিরতিব্যসনং শ্রুতৌ
প্রকৃতিসিদ্ধমিদং হি মহাত্মনাম্ ।। ৬৩।।
অর্থাৎ : বিপদে ধৈর্য (ধারণ), সম্পদে অনৌদ্ধত্য, সভায় বাকপটুতা, সংগ্রামে শৌর্য, খ্যাতির প্রতি অভীপ্সা এবং বেদাদি শাস্ত্রের প্রতি আসক্তি- এসব (হচ্ছে) মহাত্মাদের স্বভাবসিদ্ধ (গুণ)।

প্রদানং প্রচ্ছন্নং গৃহমুপগতে সম্ভ্রমবিধিঃ
প্রিয়ং কৃত্বা মৌনং সদসি কথানং চাপ্যুপকৃতেঃ।
অনুৎসেকো লক্ষ্ম্যাং নিরভিভবসারাঃ পরকথাঃ
সতাং কেনোদ্দিষ্টং বিষমমসিধারাব্রতমিদম্ ।। ৬৪।।
অর্থাৎ : দানের কথা গোপন রাখা, গৃহাগত (অতিথি)-কে সাদর অভ্যর্থনা জানানো, (কারও) উপকার করে মৌন থাকা, (কিন্তু অপরের) উপকারের কথা সৎসভায় (অর্থাৎ সজ্জনদের মধ্যে) প্রচার করা, সম্পদে গর্বহীনতা (এবং) অন্যের সম্পর্কে নিন্দা না করা- খড়গধারার মতো দুশ্চর এই ব্রতের উপদেশ সদ্ব্যক্তিদের কে দিয়েছে ?

করে শ্লাঘ্যস্ত্যাগঃ শিরসি গুরুপাদপ্রণয়িতা
মুখে সত্যা বাণী বিজয়ি ভুজয়োর্বীর্যমতুলম্ ।
হৃদি স্বচ্ছা বৃত্তিঃ শ্রুতমধিগতং চ শ্রবণয়ো-
র্বিনাপ্যৈশ্বর্যেণ প্রকৃতিমহতাং মণ্ডনমিদম্ ।। ৬৫।।
অর্থাৎ : হাতে প্রশংসনীয় দান, মাথায় গুরুচরণের স্নেহ, মুখে (সদা) সদ্য কথা, বাহুযুগলে বিজয়ের অনুপম শক্তি, হৃদয়ে পবিত্রভাব এবং কর্ণযুগলে বেদজ্ঞান- এই সকল সম্পদ বিনাও স্বভাব-মহৎদের ভূষণ (স্বরূপ)।

সম্পৎসু মহতাং চিত্তং ভবত্যুৎপলকোমলম্ ।
আপৎসু চ মহাশৈলশিলাসংঘাতকর্কশম্ ।। ৬৬।।
অর্থাৎ : সম্পদে সজ্জনদের চিত্ত পদ্ম ফুলের ন্যায় কোমল এবং বিপদে সুবিশাল পর্বত-শিলার ন্যায় কঠিন (হয়)।

সন্তপ্তায়সি সংস্থিতস্য পয়সো নামাপি ন শ্রূয়তে
মুক্তাকারতয়া তদেব নলিনীপত্রস্থিতং রাজতে।
স্বাত্যাং সাগরগুক্তিমধ্যপতিতং সম্মৌক্তিকং জায়তে
প্রায়েণাধমমধ্যমোত্তমগুণঃ সংসর্গতো জায়তে।। ৬৭।।
অর্থাৎ : উত্তপ্ত লৌহমধ্যে সন্নিবিষ্ট (এক ফোঁটা) জলের নামও জানা যায় না, (কিন্তু) পদ্মপত্রের উপর তা-ই মুক্তার ন্যায় শোভা পায়; (আবার) স্বাতীনক্ষত্রযোগে সমুদ্রশুক্তিমধ্যে (ঝিনুক) পতিত হলে (তা-ই বহুমূল্য) মুক্তা হয়ে যায়। (তাই দেখা যায়) সাধারণত অধম, মধ্যম ও উত্তম গুণ সঙ্গগুণেই জন্ম নেয়।

প্রীণাতি যঃ সুচরিতৈঃ পিতরং স পুত্রো
যদ্ভর্তুরেব হিতমিচ্ছতি তৎকলত্রম্ ।
তন্মিত্রমাপদি সুখে চ সমক্রিয়ং য-
দেতৎত্রয়ং জগতি পুণ্যকৃতো লভন্তে।। ৬৮।।
অর্থাৎ : যে সদাচারের দ্বারা পিতাকে আনন্দ দেয় সে(-ই) পুত্র; যে (সর্বদা) স্বামীর কল্যাণ কামনা করে সে(-ই যথার্থ) স্ত্রী এবং দুঃখে ও সুখে যে সমান আচরণ করে (সে-ই প্রকৃত) বন্ধু। জগতে এই তিনজনকে পুণ্যবানই লাভ করে থাকেন।

নম্রত্বেনোন্নমন্তঃ পরগুণকথনৈঃ স্বান্ গুণান্ খ্যাপয়ন্তঃ
স্বার্থান্ সম্পাদয়ন্তো বিততপৃথুতরারম্ভযত্নাঃ পরার্থে।
ক্ষান্ত্যৈবাক্ষেপরুক্ষাক্ষরমুখরমুখান্ দুর্মুখান্ দূষয়ন্তঃ
সন্তঃ সাশ্চর্যচর্যা জগতি বহুমতাঃ কস্য নাভ্যর্চনীয়াঃ।। ৬৯।।
অর্থাৎ : (যাঁরা) বিনয়ের দ্বারা উন্নতি (লাভ) করেন, অপরের গুণ বর্ণনার দ্বারা নিজগুণ প্রকাশ করেন, পরপ্রয়োজন (অপরের মঙ্গল) সাধনে অতিশয় মহৎ যত্নের দ্বারা নিজ প্রয়োজন সাধন করেন, (এবং একমাত্র) সহিষ্ণুতার দ্বারাই নিন্দনীয় কর্কশ বাক্যে মুখর দুর্জনদের ভর্ৎসনা করেন- সেই অদ্ভুত চরিত্রের (বিস্ময়কর বা অসাধারণ চরিত্রের) বিখ্যাত সৎপুরুষগণ জগতে কার না উপাস্য ?


পরোপকারপদ্ধতি :

ভবন্তি নম্রাস্তরবঃ ফলোদ্গমৈ-
র্নবাম্বুভির্ভূরিবিলম্বিনো ঘনাঃ।
অনুদ্ধতাঃ সৎপুরুষাঃ সমৃদ্ধিভিঃ
স্বভাব এবৈষ পরোপকারিণাম্ ।। ৭০।।
অর্থাৎ : ফলাগমে বৃক্ষসকল অবনত হয়, মেঘসকল নবজলভারে বিলম্বিত (নিম্নগামী হয় এবং) সজ্জনেরা সম্পত্তি (ঐশ্বর্য) লাভে বিনীত (হন)। পরোপকারীদের এটাই স্বভাব।

শ্রোত্রং শ্রুতেনৈব ন কুণ্ডলেন দানেন পাণি র্ন তু কঙ্কণেন।
বিভাতি কায়ঃ করুণাপরাণাং পরোপকারৈ র্ন তু চন্দনেন।। ৭১।।
অর্থাৎ : দয়ার্দ্রচিত্ত ব্যক্তিদের কর্ণ শাস্ত্রশ্রবণের দ্বারাই শোভা পায়, কুণ্ডল(-আদি ভূষণের) দ্বারা নয়; হস্ত দানের দ্বারা(-ই শ্রীমণ্ডিত হয়), কঙ্কণের দ্বারা নয়; (এবং) শরীর পরোপকার দ্বারা(-ই শোভা পায়), চন্দনের দ্বারা নয়।

পাপান্নিবারয়তি যোজয়তে হিতায়
গুহ্যং চ গূহতি গুণান্ প্রকটীকরোতি।
আপদ্গতং চ ন জহাতি দদাতি কালে
সম্মিত্রলক্ষণমিদং প্রবদন্তি সন্তঃ।। ৭২।।
অর্থাৎ : সজ্জনেরা সৎবন্ধুর এরূপ লক্ষণ-এর কথা বলেছেন (যে, তিনি বন্ধুকে) পাপ (কর্ম) থেকে নিবৃত্ত করেন, সৎকর্মে প্রযুক্ত করেন (প্রেরণা দেন), (বন্ধুর) গোপন বিষয় গোপন রাখেন, (বন্ধুর) গুণরাজি প্রকাশ করেন, বিপদ্গ্রস্ত (বন্ধু)-কে (কখনও) ত্যাগ করেন না, (এবং) যথাসময়ে (যোগ্য পাত্রে) দান করেন।

পদ্মাকরং দিনকরো বিকচীকরোতি
চন্দ্রো বিকাশয়তি কৈরবচক্রবালম্ ।
নাভ্যর্থিতো জলধরোপি জলং দদাতি
সন্তঃ স্বয়ং পরহিতেষু কৃতাভিযোগাঃ।। ৭৩।।
অর্থাৎ : অযাচিতভাবেই সূর্য কমলবনকে বিকশিত করে, চন্দ্র কুমুদকুলকে প্রস্ফুটিত করে, (এবং) মেঘ-ও (পৃথিবীকে) জল দান করে। সজ্জনেরা নিজেরাই (আপনা থেকেই) অপরের মঙ্গল সাধনে (সদা) অভিনিবিষ্ট (থাকেন)।

এতে সৎপুরুষাঃ পরার্থঘটকাঃ স্বার্থং পরিত্যজ্য যে
সামান্যাস্তু পরার্থমুদ্যমভৃতঃ স্বার্থাবিরোধেন যে।
তেমী মানবরাক্ষসাঃ পরহিতং স্বার্থায় নিঘ্নন্তি যে
যে তু ঘ্নন্তি নিরর্থকং পরহিতং তে কে ন জানীমহে।। ৭৪।।
অর্থাৎ : (একমাত্র) এঁরাই উত্তমজন (সজ্জন)- যাঁরা স্বার্থ বর্জন করে পরার্থ সাধন করেন; যারা স্বার্থের অনুকূলে পরার্থ সাধনে উদ্যোগী হয় তারা মধ্যম (অর্থাৎ সাধারণ মানুষ); (আর) যারা স্বার্থের কারণে পরার্থ বিনাশ করে, সেই তারা মনুষ্যরূপী রাক্ষস; কিন্তু যারা অকারণে পরার্থ বিনাশ করে তারা কারা (তা আমরা) জানি নে।

ক্ষীরেণাত্মগতোদকায় হি গুণা দত্তাঃ পুরা তেখিলাঃ
ক্ষীরে তাপমবেক্ষ্য তেন পয়সা স্বাত্মা কৃশানৌ হুতঃ।
গন্তুং পাবকমুন্মনস্তদভবদ্ দৃষ্ট্বা তু মিত্রাপদং
যুক্তং তেন জলেন শাম্যতি সতাং মৈত্রী পুনস্ত্বীদৃশী।। ৭৫।।
অর্থাৎ : দুধ প্রথমে স্বমিশ্রিত (আত্মগত) জলকে (তার শ্বেতত্ব ও মধুরত্বাদি প্রসিদ্ধ) সেই গুণ সকল দান করে; সেই জল(-ও আবার) দুধের উত্তাপ-জ্বালা দেখে নিজেকে আগুনে আহুতি দেয়; দুধ (আবার) বন্ধুর (জলের) বিপদ দেখে আগুনে প্রবেশ করার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে; সেই জল আবার তার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে শান্ত করে। সজ্জনদের বন্ধুত্ব(-ই) এরূপ।

ইতঃ স্বপিতি কেশবঃ কুলমিতস্তদীয়দ্বিষা-
মিতশ্চ শরণার্থিনঃ শিখরিণাং গণাঃ শেরতে।
ইতোপি বড়বানলঃ সহ সমস্তসংবর্তকৈ-
রহো বিততমূর্জিতং ভরসহং চ সিন্ধোর্বপুঃ।। ৭৬।।
অর্থাৎ : (সমুদ্রের) একদিকে (ভগবান) বিষ্ণু নিদ্রা যাচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁর শত্র“গণ (অর্থাৎ অসুরগণ) অবস্থানরত; এদিকে আবার আশ্রয়প্রার্থী পর্বতসকল আত্মগোপন করে আছে, অন্যদিকেও (আবার) প্রলয়কালীন সকল মেঘসহ বড়বানল (বিরাজ করছে)। আশ্চর্য! সমুদ্রের শরীর কতো বিশাল, কতো বলশালী এবং ভার-বহনে কত সমর্থ।

তৃষ্ণাং ছিন্ধি ভজ ক্ষমাং জহি মদং পাপে রতিং মা কৃথাঃ
সত্যং ব্রূহ্যনুযাহি সাধুপদবীং সেবস্ব বিদ্বজ্জনম্ ।
মান্যান্ মানয় বিদ্বিষোপ্যনুনয় প্রচ্ছাদয় স্বান্ গুণান্
কীর্তিং পালয় দুঃখিতে কুরু দয়ামেতৎ সতাং লক্ষণম্ ।। ৭৭।।
অর্থাৎ : (হে মানব!) তৃষ্ণা বিনাশ করো, ক্ষমার আরাধনা করো; অহঙ্কার ত্যাগ করো, পাপকর্মে বাসনা করো না, (সদা) সত্য কথা বলো, সজ্জনদের পথ অনুসরণ করো, বিজ্ঞজনের সেবা করো, পূজনীয়দের মান্য কর, শত্র“দেরও প্রসন্ন করো, নিজের গুণ সকল গোপন রাখো, কীর্তি রক্ষা করো, (এবং) দুঃখীদের প্রতি করুণা করো, (কারণ) এগুলিই (হচ্ছে) সজ্জনদের বৈশিষ্ট্য।

মনসি বচসি কায়ে পুণ্যপীযূষপূর্ণা-
স্ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণিভিঃ প্রীণয়ন্তঃ।
পরগুণপরমাণূন্ পর্বতীকৃত্য নিত্যং
নিজহৃদি বিকসন্তঃ সন্তিঃ সন্তঃ কিয়ন্তঃ।। ৭৮।।
অর্থাৎ : (যাঁদের) মন, বাক্য ও শরীর অমৃতময় পুণ্যধারায় পূর্ণ, (যাঁরা) বিবিধ প্রকারে উপকারের দ্বারা ত্রিলোককে প্রসন্ন করেন, (এবং যাঁরা) অপরের পরমাণু-প্রমাণ গুণকে(-ও) পর্বতপ্রমাণ (জ্ঞান) করে নিজ হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করেন- (তাঁদের মতো) সজ্জন (জগতে) অল্পই আছে।

কিং তেন হেমগিরিণা রজতাদ্রিণা বা
যত্রাশ্রিতাশ্চ তরবস্তরবস্ত এব।
মন্যামহে মলয়বেম যদাশ্রয়েণ
কঙ্কোলনিম্বকুটজা অপি চন্দনানি।। ৭৯।।
অর্থাৎ : কী লাভ সেই (সুপ্রসিদ্ধ) হেমগিরি কিংবা রজতগিরিতে- যেখানে (বা যাদের) আশ্রিত বৃক্ষসকল বৃক্ষই (থেকে যায় অর্থাৎ কোনরূপ পরিবর্তন সাধিত হয় না ? বরং) মলয় পর্বতকেই (সাতিশয়) মান্য করতে হয়- যার আশ্রয়ে কঙ্কোল (অশোক বৃক্ষ?), নিম্ব এবং কুটজ (কুড়চী) বৃক্ষ(-ও) চন্দনতুল্য হয় (বা হয়ে যায়)।


ধৈর্যপদ্ধতি :

রত্নের্মহার্হৈস্তুতুষুর্ন দেবা
ন ভেজিরে ভীমবিষেণ ভীতিম্ ।
সুধাং বিনা ন প্রযষুর্বিরামং
ন নিশ্চিতাার্থাদ্বিরমন্তি ধীরাঃ।। ৮০।।
অর্থাৎ : দেবগণ (সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত) মহামূল্য রত্নাদি পেয়ে(-ও) তুষ্ট হন নি; (ভয়ঙ্কর কালকূট নামক) গরলের ভয়ে(-ও) ভীত হন নি; অমৃত না পাওয়া পর্যন্ত (তাঁরা) ক্ষান্ত(-ও) হন নি। ধৈর্যশীল ব্যক্তিগণ স্থিরীকৃত বিষয় (সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তা) থেকে বিরত হন না।

ক্বচিদভূমীশায়ী ক্বচিদপি চ পর্যঙ্কশয়নঃ
ক্বচিচ্ছাকাহারী ক্বচিদপি চ শাল্যোদনরুচিঃ।
ক্বচিৎকন্থাধারূী ক্বচিদপি চ দিব্যাম্বরধরো
মনস্বী কার্যার্থী গণয়তি ন দুঃখং ন চ সুখম্ ।। ৮১।।
অর্থাৎ : কার্য সাধনে প্রবৃত্ত মনস্বী ব্যক্তি কখনও মাটিতে শয়ন করেন কখনও বা পালঙ্কে; কখনও শাকাহার করেন কখনও বা শাল্যন্ন ভোজন করেন; কখনও ছিন্নবস্ত্র পরিধান করেন, (আবার) কখনও (বা মনোহর) বস্ত্র পরিধান করেন। (এরূপ মহান ব্যক্তি) সুখ বা দুঃখের কথা ভাবেন না।

ঐশ্বর্যস্য বিভূষণং সুজনতা শৌর্যস্য বাক্সংযমো
জ্ঞানেস্যাপশমঃ শ্রুতস্য বিনয়ো বিত্তস্য পাত্রে ব্যয়ঃ।
অক্রোধস্তপসঃ ক্ষমা প্রভবিতুর্ধর্মস্য নির্ব্যাজতা
সর্বেষামপি সর্বকারণমিদং শীলং পরং ভূষণম্ ।। ৮২।।
অর্থাৎ : ঐশ্বর্যের অলঙ্কার সৌজন্য, শৌর্যের (অলঙ্কার) বাক্সংযম; জ্ঞানের (অলঙ্কার) শান্তি, বিদ্যার (অলঙ্কার) বিনয়; ধনের (অলঙ্কার যোগ্য) পাত্রে দান, তপের (অলঙ্কার) ক্রোধশূন্যতা; প্রভুত্বের (অলঙ্কার) সহিষ্ণুতা (এবং) ধর্মের (অলঙ্কার) নিষ্কপটতা, (আর) এ-সবের কারণ এই সচ্চরিত্র বা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার।

নিন্দন্তু নীতিনিপুণা যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্ ।
অদ্যৈব বা মরণমস্তু যুগান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ।। ৮৩।।
অর্থাৎ : নীতিবিশারদগণ যদি নিন্দা(-ও) করেন কিংবা প্রশংসা(-ও) করেন; অর্থ প্রচুর পরিমাণে উপার্জিত(-ই) হোক কিংবা ব্যয়িত(-ই) হোক; মৃত্যু আজই হোক কিংবা অন্যযুগে(-ই) হোক- ধৈর্যশীল ব্যক্তিগণ ন্যায়পথ থেকে এক পা-ও বিচ্যুত হন না।

কদর্থিতস্যাপি হি ধৈর্যবৃত্তে-
র্ন শক্যতে ধৈর্যগুণঃ প্রমার্ষ্টুম্ ।
অধোমুখস্যাপি কৃতস্য বহ্নে-
র্নাধঃ শিখা যাতি কদাচিদেব।। ৮৪।।
অর্থাৎ : দুর্দশাগ্রস্ত হলেও ধৈর্যশীল ব্যক্তির ধৈর্যগুণ (কেউ) বিনাশ করতে পারে না। (দেখ) অগ্নিকে নিম্নমুখী করলেও শিখা (তার) কখনও নীচের দিকে যায় না।

কান্তাকটাক্ষবিশিখা ন লুনন্তি যস্য
চিত্তং ন নির্দহতি কোপকৃশানুতাপঃ।
কর্ষন্তি ভূরিবিষয়াশ্চ ন লোভপাশৈ-
র্লোকত্রয়ং জয়তি কৃৎস্নমিদং স ধীরঃ।। ৮৫।।
অর্থাৎ : বণিতার কটাক্ষশর যাঁর হৃদয়কে ছিন্ন (বিদ্ধ) করতে পারে না, ক্রোধাগ্নির সন্তাপ (যাঁকে) দগ্ধ করতে পারে না, অমিত বিষয়-সম্পদ (যাঁকে) লোভের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে না- সেই ধৈর্যশীল ব্যক্তি(-ই) এই সমগ্র ত্রিভুবন জয় করতে পারেন।

পাতিতোপি করাঘাতৈরুৎপতত্যেব কন্দুকঃ।
প্রায়েণ সাধুবৃত্তানামস্থায়িন্যো বিপত্তয়ঃ।। ৮৬।।
অর্থাৎ : কন্দুক (খেলার বল) করাঘাতে (মাটিতে) পতিত হলেও (পুনরায় তা) উঠেই আসে। (অর্থাৎ) সদাচারীদের (বা ধৈর্যশীলদের) বিপদ সাধারণত ক্ষণস্থায়ী(-ই হয়ে থাকে)।

বরং তুঙ্গাচ্ছৃঙ্গাদ্গুরুশিখরিণঃ ক্বাপি বিষমে
পতিত্বায়ং কায়ঃ কঠিনদৃষদান্তর্বিদলিতঃ।
বরং ন্যস্তো হস্তঃ ফণিপতিমুখে তীব্রদশনে
বরং বহ্নৌ পাতস্তদপি ন কৃতঃ শীলবিলয়ঃ।। ৮৭।।
অর্থাৎ : সুউচ্চ পর্বতের শিখরচূড়া হতে (নিম্নে) কোনও বিষম কঠিন শিলাতলে পড়ে এই দেহ (যদি) খণ্ড-বিখণ্ডও (বা ছিন্ন-ভিন্ন) হয় সে-ও ভালো; (কিংবা) সর্পরাজের তীক্ষ্ণ দন্তবিশিষ্ট মুখমধ্যে (যদি) হস্ত পতিত (হয়)- সে-ও ভালো; (কিংবা যদি) অগ্নিতে(-ও দেহ) পতিত (হয়)- সে-ও ভালো, তথাপি চরিত্র-হনন করা উচিত নয়।

বহ্নিস্তস্য জলায়তে জলনিধিঃ কুল্যায়তে তৎক্ষণা-
ন্মেরুঃ স্বল্পশিলায়তে মৃগপতিঃ সদ্য কুরঙ্গায়তে।
ব্যালো মাল্যগুণায়তে বিষরসঃ পীযূষবর্ষায়তে
যস্যাঙ্গেখিললোকবল্লভতমং শীলং সমুম্মীলতি।। ৮৮।।
অর্থাৎ : যাঁর শরীরে সর্বজনপ্রিয় চরিত্রগুণের উন্মেষ হয় তাঁর কাছে আগুন জলের মতো, (বিশাল) সমুদ্র মুহূর্তে ছোট্ট নদীর মতো, (সুউচ্চ) মেরু পর্বত ক্ষুদ্র শিলা-খণ্ডের মতো, মৃগরাজ মুহূর্তে কুরঙ্গের (হরিণের) মতো, সর্প মালার মতো এবং তীব্র বিষ(-ও) হয়ে ওঠে শুধাবর্ষণের মতো।

ছিন্নোপি রোহতি তরুঃ ক্ষীণোপ্যুপচীয়তে পুনশ্চন্দ্রঃ।
ইতি বিমৃশন্তঃ সন্তঃ সন্তপ্যন্তে ন বিপ্লুতা লোকে।। ৮৯।।
অর্থাৎ : কর্তিত হলেও বৃক্ষ আবার উদ্গত হয়; চন্দ্র ক্ষীণ হলেও পুনরায় (তা) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়- এরূপ বিবেচনা করেই বিপদগ্রস্ত সজ্জনগণ জগতে অনুতপ্ত হন না।


দৈবপদ্ধতি :

নেতা যস্য বৃহস্পতিঃ প্রহরণং বজ্রং সুরাঃ সৈনিকাঃ
স্বর্গো দুর্গমনুগ্রহঃ খলু হরেরৈরাবতো বারণঃ।
ইত্যৈশ্বর্যবলবান্বিতোপি বলভিদ্ভগ্নঃ পরৈঃ সঙ্গরে
তদ্ব্যক্তং  ননু দৈবমেব শরণং ধিগ্ ধিগ্ বৃথা পৌরুষম্ ।। ৯০।।
অর্থাৎ : উপদেষ্টা যার বৃহস্পতি, বজ্র (যার) অস্ত্র, দেবগণ (যার) সৈনিক, স্বর্গলোক (যার) দুর্গ, শ্রীহরি (যার) ভরসা, ঐরাবত (যার) হস্তী- এরূপ সহায় ও শক্তিধর ইন্দ্রও যুদ্ধে শত্র“দের দ্বারা পরাজিত (হয়েছেন)। তাই (এটা) স্পষ্ট যে, দৈবই (একমাত্র) রক্ষক। ব্যর্থ পৌরুষকে বারংবার ধিক্ ।

ভগ্নাশস্য করণ্ডপীড়িততনোর্ম্লানেন্দ্রিয়স্য ক্ষুধা
কৃত্বাখুর্বিবরং স্বয়ং নিপতিতো নক্তং মুখে ভোগিনঃ।
তৃপ্তস্তৎপিশিতেন সত্বরমসৌ তেনৈব যাতঃ পথা
লোকাঃ পশ্যত দৈবমেব হি নৃণাং বৃদ্ধৌ ক্ষয়ে কারণম্ ।। ৯১।।
অর্থাৎ : হে মনুষ্যগণ! দেখো, (খাদ্যলোভে) এক ইঁদুর রাতে(-র অন্ধকারে) গর্ত করতে গিয়ে পেটিকায় আবদ্ধ, ক্ষুধাকাতর-ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট (এবং) খাদ্যলাভে নিরাশ এক সর্পমুখে আপনি পতিত হয়। ঐ সর্প তার (ইঁদুরের) মাংসে তৃপ্ত হয়ে তারই (ইঁদুরের) রচিত পথে দ্রুত বের হয়ে যায়। (অতএব) দৈবই মানুষের উন্নতি ও অবনতির (মূল) কারণ।

কার্যায়ত্তং ফলং পুংসাং বুদ্ধিঃ কর্মানুসারিণী।
তথাপি সুধিয়া ভাব্যং সুবিচার্যৈব কুর্বতা।। ৯২।।
অর্থাৎ : পুরুষের (অর্থাৎ মানুষের সুখ-দুঃখাদি) ফল (যদিও পূর্বকৃত) কর্মের অধীন, (এবং) বুদ্ধি কর্মের অনুসারিণী, তথাপি বিজ্ঞজনের উচিত সুবিবেচনাপূর্বক কার্য নির্ধারণ করা।

খল্বাটো দিবসেশ্বরস্য কিরণৈঃ সন্তাপিতো মস্তকে
বাঞ্ছন্ দেশমনাতপং বিধিবশাত্তালস্য মূলং গতঃ।
তত্রাপ্যস্য মহাফলেন পততা ভগ্নং সশব্দং শিরঃ
প্রায়ো গচ্ছতি যত্র ভাগ্যরহিতস্তত্রৈব যান্ত্যাপদঃ।। ৯৩।।
অর্থাৎ : মুণ্ডিতমস্তক এক পুরুষ সূর্যকিরণে মস্তক উত্তপ্ত হলে শীতল স্থান কামনায় দৈববশে (দুর্ভাগ্যক্রমে) তালতরুর মূলে আশ্রয় নেয়। সেখানেও (বৃক্ষ থেকে) পতিত এক গুরুভাব ফলে তার মস্তক সশব্দে বিদীর্ণ হয়। (আসলে) ভাগ্যহীন ব্যক্তি যেখানে(-ই) যায় বিপদও প্রায়শই (তার) অনুগামী হয়ে থাকে।

শশিদিবাকরয়োর্গ্রহপীড়নং
গজভুজঙ্গময়োরপি রন্ধনম্ ।
মতিমতাং চ বিলোক্য দরিদ্রতাং
বিধিরহো বলবানিতি মে মতিঃ।। ৯৪।।
অর্থাৎ : সূর্য ও চন্দ্রের রাহুর দশা, হস্তী ও সর্পের বন্ধনদশা এবং বুদ্ধিমানের দরিদ্র-দশা দেখে, হায়! আমার (নিশ্চিত) মনে হচ্ছে- দৈবই (সর্বাপেক্ষা) বলবান।

সৃজতি তাবদশেষগুণাকরং
পুরুষরত্নমলঙ্করণং ভুবঃ।
তদপি তৎক্ষণভঙ্গি করোতি চেদ্
অহহ কষ্টমপণ্ডিততা বিধেঃ।। ৯৫।।
অর্থাৎ : (বিধাতা) অসীম গুণসম্পন্ন (এবং) পৃথিবীর অলঙ্কার স্বরূপ (যে) পুরুষ-রত্নকে (অর্থাৎ মানুষকে) সৃষ্টি করেছেন, তাকেও যদি (তিনি) ক্ষণবিনাশী করেন (তাহলে), হায়! বিধাতার (এই) অজ্ঞতা (অপরিণামদর্শিতা বড়ই) পীড়াদায়ক।

অয়মমৃতনিধানং নায়কোপ্যোষধীনাং
শতভিষগনুযাতঃ শম্ভুমূর্ধ্নােবতংসঃ।
বিরহয়তি ন চৈনং রাজযক্ষ্মা শশাঙ্কং
হতবিধিপরিপাকঃ কেন বা লঙ্ঘনীয়ঃ।। ৯৬।।
অর্থাৎ : এই (চন্দ্র) ওষধি সকলের রাজা, শিবশিরের ভূষণ, শতবৈদ্যের অনুগম্য এবং অমৃতের ভাণ্ডার, (তথাপি) রাজযক্ষ্মা এই চন্দ্রকে(-ও) রেহাই দেয় নি; হায়! দৈবের পরিণাম কে-ই বা লঙ্ঘন করতে পারে ?

দৈবেন প্রভুণা স্বয়ং জগতি যদ্যস্য প্রমাণীকৃতং
তত্তস্যোপনমেন্মনাগপি  মহান্নৈবাশ্রয়ঃ কারণম্ ।
সর্বাশাপরিপূরকে জলধরে বর্ষত্যপি প্রত্যহং
সূক্ষ্মা এব পতন্তি চাতকমুখে দ্বিত্রাঃ পয়োবিন্দবঃ।। ৯৭।।
অর্থাৎ : সর্বশক্তিমান দৈব এ জগতে যার যেটুকু প্রাপ্য নির্ধারণ করেছেন তা সে পাবেই; মহান আশ্রয় (এ ক্ষেত্রে) কোনও কারণ নয়। সকলের অভিলাষপূরণকারী মেঘ যদি প্রতিদিনও বারি বর্ষণ করে তবুও দু’তিনটি বারি-বিন্দুই চাতক-মুখে পতিত হয়।

পত্রং নৈব যদা করীরবিটপে দোষো বসন্তস্য কিং
নোলূকোপ্যবলোকতে যদি দিবা সূর্যস্য কিং দূষণম্ ।
ধারা নৈব পতন্তি চাতকমুখে মেঘস্য কিং দূষণং
যৎপূর্বং বিধিনা ললাটলিখিতং তন্মার্জিতুং কঃ ক্ষমঃ।। ৯৮।।
অর্থাৎ : করীর (এক ধরনের পত্রহীন বৃক্ষ বা কচি বাঁশ) বৃক্ষে যদি পত্র না-ই (হয় তাহলে) বসন্তের কী দোষ ? কী দোষ সূর্যের যদি না পেঁচক দিনে(-র আলোকে-)ও দেখতে পায় ? (অবিরাম) বৃষ্টি যদি চাতক-মুখে না-ই পড়ে (তাহলে) মেঘের কী দোষ ? (আসলে) অতীতে বিধাতা (যার) কপালে যা লিখেছেন তা মুছে ফেলতে কে সমর্থ ?


কর্মপদ্ধতি :

নমস্যামো দেবান্ননু হতবিধেস্তেপি বশগা
বিধির্বন্দ্যঃ সোপি প্রতিনিয়তকর্মৈকফলদঃ।
ফলং কর্মায়ত্তং কিমমরগণৈঃ কিং চ বিধিনা
নমস্তৎকর্মভ্যো বিধিরপি ন যেভ্যঃ প্রভবতি।। ৯৯।।
অর্থাৎ : আমরা (কি) দেবগণকে নমস্কার করবো ? কিন্তু তারাও (যে) ঘৃণ্য বিধির বশীভূত। (তাহলে কি) বিধি বন্দনীয় ? (কিন্তু) সে-ও সদা কর্মানুযায়ী ফল দান করে থাকে। (আর) ফল যদি কর্মের(-ই) অধীন (হয় তাহলে) দেবতা কিংবা বিধাতার কী প্রয়োজন ? অতএব (সেই) কর্মকেই নমস্কার- যার উপর বিধিরও নিয়ন্ত্রণ নেই (অর্থাৎ বিধিও যার অধীন)।

ব্রহ্মা যেন কুলালবন্নিয়মিতো ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ডোদরে
বিষ্ণুর্যেন দশাবতারগহনে ক্ষিপ্তো মহাসঙ্কটে।
রুদ্রো যেন কপালপাণিপুটকে ভিক্ষাটনং কারিতঃ
সূর্যো ভ্রাম্যতি নিত্যমেব গগনে তস্মৈ নমঃ কর্মণে।। ১০০।।
অর্থাৎ : যার প্রভাবে ব্রহ্মা (বিশ্ব)জগতরূপ ভাণ্ডের অভ্যন্তরে কুম্ভকারবৎ নিযুক্ত (রয়েছেন); (স্বয়ং) নারায়ণ যার প্রভাবে (মৎস্যাদি) দশাবতাররূপ গভীর অরণ্যে মহাসঙ্কটে নিপতিত; যার প্রভাবে মহেশ্বর কপালপাত্র-হাতে ভিক্ষা করতে নিযুক্ত, (এবং যার প্রভাবে) সূর্য সদা নভোমণ্ডলে সঞ্চরণশীল- সেই কর্মকে নমস্কার।

নৈবাকৃতিঃ ফলতি নৈব কুলং ন শীলং
বিদ্যাপি নৈব ন চ যত্নকৃতাপি সেবা।
ভাগ্যানি পূর্বতপসা খলু সঞ্চিতানি
কালে ফলন্তি পুরুষস্য যথৈব বৃক্ষাঃ।। ১০১।।
অর্থাৎ : (মানুষের সুন্দর) আকৃতি (কোন) ফল দেয় না, (দেয় না উচ্চ) বংশ, সচ্চরিত্র, বিদ্যা কিংবা যত্নকৃত সেবাও। পুরুষের (অর্থাৎ মানুষের) পূর্বকালীন তপস্যায় সঞ্চিত অদৃষ্টই যথাসময়ে বৃক্ষের মতো (অভীষ্ট) ফল দান করে থাকে।

বনে রণে শত্রুজলাগ্নিমধ্যে মহার্ণবে পর্বতমস্তকে বা।
সুপ্তং প্রমত্তং বিষমস্থিতং বা রক্ষন্তি পুণ্যানি পুরা কৃতানি।। ১০২।।
অর্থাৎ : পূর্বার্জিত পুণ্য (কর্ম মানুষকে) অরণ্যে, সংগ্রামে, শত্রুমধ্যে, জলমধ্যে, অগ্নিতে, মহাসমুদ্রে কিংবা পর্বতচূড়ায় নিদ্রিত, উন্মত্ত কিংবা বিপদ্গ্রস্ত অবস্থায়(-ও) রক্ষা করে।

যা সাধূংশ্চ খলান্ করোতি বিদুষো মূর্খান্ হিতান্ দ্বেষিণঃ
প্রত্যক্ষং কুরুতে পরোক্ষমমৃতং হলাহলং তৎক্ষণাৎ।
তামারাধয় সৎক্রিয়াং ভগবতীং ভোক্তুং ফলং বাঞ্ছিতং
হে সাধো ব্যাসনৈর্গুণেষু বিপুলেষ্বাস্থাং বৃথা মা কৃথাঃ।। ১০৩।।
অর্থাৎ : হে সজ্জন! (যদি) অভীষ্ট ফল লাভ করতে চান (তাহলে) সেই (সর্ব গুণসম্পন্না) ভগবতী সৎক্রিয়ার(-ই) আরাধনা করুন- যিনি দুর্জনকে সজ্জন করেন, মূর্খকে পণ্ডিত করেন, শত্র“কে মিত্র করেন, পরোক্ষকে প্রত্যক্ষ করেন এবং তীব্র বিষকে(-ও) মুহূর্তে পরিণত করেন অমৃতে। অজস্র দুঃখে পূর্ণ গুণরাজির প্রতি বৃথা আসক্তি করবেন না।

শুভ্রং সদ্ম সবিভ্রমা যুবতয়ঃ শ্বেতাতপত্রোজ্জ্বলা
লক্ষ্মীরিত্যনুভূয়তে চিরমনুস্যূতে শুভে কর্মণি।
বিচ্ছিন্নে নিতরামনঙ্গকলহক্রীড়াত্রুটত্তন্তুকং
মুক্তাজালমিব প্রয়াতি ঝটিতি ভ্রশ্যদ্দিশো দৃশ্যতাম্ ।। ১০৪।।
অর্থাৎ : দেখ্, (মানুষের) সৎক্রিয়া যতক্ষণ বর্তমান থাকে ততক্ষণই মনোহর প্রাসাদ, বিলাসবতী রমণী এবং শ্বেতছত্রের ন্যায় উজ্জ্বল দীপ্তিময়ী (রাজ্য) লক্ষ্মী নিরন্তর উপভোগ্য হয়। (কিন্তু) সৎক্রিয়া বিনষ্ট হলে রতিবিবাদের খেলায় (কামিনীর) ছিন্নসূত্রমুক্তামালার মুক্তার ন্যায় সবকিছু মুহূর্তে সর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে (অর্থাৎ হারিয়ে যায়)।

গুণবদগুণবদ্বা কুর্বতা কার্যমাদৌ
পরিণতিরবধার্যা যত্নতঃ পণ্ডিতেন।
অতিরভসকৃতানাং কর্মণামাবিপত্তে-
র্ভবতি হৃদয়দাহী শল্যতুল্যো বিপাকঃ।। ১০৫।।
অর্থাৎ : কর্ম গুণযুক্ত(-ই) হোক আর গুণহীন(-ই) হোক (তার) ফলাফল বিবেচনাপূর্বক (অতিশয়) সাবধানতার সঙ্গে পণ্ডিতদের তা করা উচিত। (কারণ) অতিশয় হঠকারিতার সঙ্গে কৃত কর্মসমূহের শেলসম পরিণাম মৃত্যু পর্যন্ত হৃদয় দহন করে।

স্থাল্যাং বৈদূর্যময্যাং পচতি তিলখলীং চন্দনৈরিন্ধনৌঘৈঃ
সৌবর্ণৈর্লাঙ্গলাগ্রৈর্বিলিখতি বসুধামর্কমূলস্য হেতোঃ।
ছিত্বা কর্পূরখণ্ডান্ বৃতিমিহ কুরুতে কোদ্রবাণাং সমন্তাৎ
প্রাপ্যেমাং কর্মভূমিং ন চরতি মনুজো যস্তপো মন্দভাগ্যঃ।। ১০৬।।
অর্থাৎ : যে হতভাগ্য ব্যক্তি কর্মময় এই ভূমিকে পেয়ে(-ও) কৃচ্ছ্র সাধন না করে (অর্থাৎ কর্মময় এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলেও কর্ম না করে) সে বহুমূল্য চন্দন কাঠের আগুনে বৈদূর্যমণি-নির্মিত পাত্রে (তুচ্ছ) তিলপিঠা তৈরি (রন্ধন) করে; মন্দার বৃক্ষের মূলের জন্য স্বর্ণ-লাঙ্গলের অগ্রভাগে পৃথিবী কর্ষণ করে, (এবং) কর্পূর বৃক্ষ কেটে চতুর্দিকে কোদ্রবের (দরিদ্রভক্ষ্য নীচুমানের শস্য বিশেষ) আবেষ্টনী রচনা করে।

মজ্জত্বম্ভসি যাতু মেরুশিখরং শত্রূঞ্জয়ত্বাহবে
বাণিজ্যং কৃষিসেবনাদিসকলা বিদ্যাঃ কলাঃ শিক্ষতাম্ ।
আকাশং বিপুলং প্রয়াতু খগবৎকৃত্বা প্রযত্নং পরং
নাভাব্যং ভবতীহ কর্মবশতো ভাব্যস্য নাশঃ কুতঃ।। ১০৭।।
অর্থাৎ : (মানুষ) জলে(-ই) মগ্ন হোক, (আর) সুমেরু পর্বতের চূড়ায়(-ই) উঠুক; সংগ্রামে শত্রুকে জয়(-ই) করুক, (আর) বাণিজ্য, কৃষি-পরিচর্যা (কিংবা) সকল প্রকার বিদ্যা ও কলা(-ই) শিক্ষা করুক; অতিশয় চেষ্টা করে পাখির ন্যায় বিশাল আকাশে(-ই) বিচরণ করুক (না-কেন, তথাপি) এ জগতে যা হবার নয় তা (কখনও) হয় না, (তবে) কর্মানুসারে যা হবার তার বিনাশ কোথায় ?

ভীমং বনং ভবতি তস্য পুরং প্রধানং
সর্বো জনঃ সুজনতামুপযাতি তস্য।
কৃৎস্না চ ভূর্ভবতি সন্নিধিরত্নপূর্ণা
যস্যাস্তি  পূর্বসুকৃতং বিপুলং নরস্য।। ১০৮।।
অর্থাৎ : পূর্বজন্মে অর্জিত অজস্র পুণ্য যার আছে তার কাছে ভয়ঙ্কর অরণ্য(-ও) উত্তম নগর-এ পরিণত হয়, সকল লোক(-ই) তার আত্মীয় হয় এবং সম্পূর্ণ পৃথিবী তার কাছে মূল্যবান মণি-রত্নাদিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।


ভর্তৃহরির বিবিধ বিষয়ক শ্লোক…

আলস্যং হি মনুষ্যাণাং শরীরস্থো মহান্ রিপুঃ।
নাস্ত্যুদ্যমসমো বন্ধুঃ কৃত্বা যং নাবসীদতি।। (বিবিধ শ্লোক-০১)।।
অর্থাৎ : অলসতা মনুষ্য-শরীরের এক মহাশত্রু। (পক্ষান্তরে) উদ্যোগতুল্য বন্ধু (আর দ্বিতীয় কেউ) নেই; উদ্যোগকারী ব্যক্তি (কখনও) কষ্ট পায় না।

কো লাভো গুণিসঙ্গমঃ কিমসুখং প্রাজ্ঞেতরৈঃ সঙ্গতিঃ
কা হানিঃ সময়চ্যুতির্নিপুণতা কা ধর্মতত্ত্বে রতিঃ।
কঃ শূরো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ প্রিয়তমা কানুব্রতা কিং ধনং
বিদ্যা কিং সুখমপ্রবাসগমনং রাজ্যং কিমজ্ঞাফলম্ ।। (বিবিধ শ্লোক-০২)।।
অর্থাৎ : (এ জগতে) লাভ কী?- গুণীজনের সঙ্গ, অসুখ কী?- মূর্খসঙ্গ, ক্ষতি কী?- সময়ের অপচয়, দক্ষতা কী?- ধর্মতত্ত্বে অনুরাগ, বীর কে?- জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি, প্রিয়তমা কে?- পতিব্রতা (স্ত্রী), ধন কী?- বিদ্যা, সুখ কী?- প্রবাসে না যাওয়া, (এবং) রাজ্য কী?- আদেশ-সাফল্য (অর্থাৎ নিজ আদেশ প্রতিপালিত হওয়া)।

মালতীকুসুমস্যেব দ্বে গতীহ মনস্বিনঃ।
মূর্ধ্নিক্ষা সর্বলোকস্য শীর্ষতে বনে এব বা।। (বিবিধ শ্লোক-০৩)।।
অর্থাৎ : এ জগতে মালতী পুষ্পের ন্যায় মহাত্মাদের (জীবনেরও) দু’ধরনের গতি (পরিণতি) হয়- হয় সর্বলোকের মস্তকে (অবস্থান) অথবা বনেই জীর্ণ হওয়া।

[ সংগ্রহসূত্র : ভর্তৃহরির নীতিশতক/ দুলাল ভৌমিক/ বাংলা একাডেমী, ঢাকা, মার্চ ১৯৮৯ ]

No comments: