Sunday, March 2, 2008

# ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন ও দুঃশাসন (সাহিত্য)


ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন ও দুঃশাসন
- রণদীপম বসু



এটা কি শুধুই কষ্ট-কল্পনা ?

তাও তো প্রায় একশ’ বছরই হতে চললো। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালেই বাংলা কবিতা যদি তার ছন্দমিল-অন্ত্যমিল -এর স্বভাবী বাঁধন কেটে আধুনিকতার মুক্ত আকাশে এক বিপুল সম্ভাবনায় উড়াল দিয়ে আকাশের ওই চকচকে সীমানাটা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে যেতে পারে, সেখানে আমাদের কিশোর কবিতাকে এই স্বেচ্ছাকৃত মিল-বাধ্যকতার স্বর্ণশিকলে আটকে রেখে এর সম্ভাব্য উত্তরণ থামিয়ে রাখায় কতটুকু যৌক্তিকতা রয়েছে তা কি কখনো ভেবেছি আমরা ? সেই আদ্যিকালের বাঁধা লাইনে পদ্য-কবিতার রেলগাড়িটা চালাচ্ছি তো চালাচ্ছিই। এর বাইরেও যে বিশাল জগতটা পড়ে আছে, কিশোর মনের ভাবালুতা আর স্বপ্নমগ্নতাকে সাথে করে ওখানেও উড়াল দেয়া যেতে পারে এক অনন্য সম্ভাবনা নিয়ে, তাও কি ভাবেননি কেউ? হয়তো ভেবেছেন, উড়াল দিয়েছেনও কেউ কেউ। আর এখানেই স্বনির্মিত ডানা সৃষ্টির সামর্থ এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলোও সামনে চলে আসে।

উড়তে না জানলে উটপাখির মতো শরীরের বিশাল ভার নিয়ে একই জমিতে দাবড়ে বেড়ানোর সনাতন কসরতগুলো বারবার দেখানো যেতে পারে। এতে ভেসে বেড়ানোর কাব্যময় উপলব্ধি এবং তা অন্যের মনে চারিয়ে দেয়ার যোগ্যতা অর্জনের ডানাটা নৈরাশ্যজনকভাবে অকেজো এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এ জন্যে যে কষ্টসহিষ্ণু শিল্পশ্রম এবং অধ্যয়নতৃষ্ণা নিয়ে যথাশুদ্ধ অনুশিলন ও সাধনা দরকার, আমাদের এতো এতো কাজ অকাজের ভীড়ে সময় কই সময় নষ্ট করার ? আর এ কারণেই আমাদের অধিকাংশই কবিতার নামে কুকথা, পদ্যের নামে বর্জ্য এবং ছড়ার নামে হাজার হাজার কচুর ছড়া উৎপাদন করতে করতে ভরিয়ে ফেলছি সাহিত্য সাময়িকী সংকলনের ভিক্ষাবরাদ্দ পাতাগুলো।

প্রসঙ্গটা যেহেতু কিশোর কবিতা নিয়ে সেহেতু সহজ ছন্দ মাত্রা আর অন্ত্যমিলের শাসন রাজ্যেই আমাদের অর্জনের যে অরাজক বাহার, ছন্দমুক্তি বা মুক্তমিলের মুক্তোমালা গলায় পড়তে হলে আমাদের বাঁদর-গলাটাকে প্রয়োজনীয় সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে যদি যোগ্য করে তুলতে না পারি, পরিস্থিতিটা কী আতঙ্কজনক হতে পারে তা ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে আসে। তাই বলে কি আমরা সামনে এগুবো না? আমাদের প্রিন্ট-মিডিয়ার সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পাতাগুলোর ইমামতি-খবরদারীর দায়িত্বে রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের গা থেকে ওই উটপাখিসুলভ কুপ্রবণতাগুলো ঝেড়ে ফেলতে না পারলে কিশোরকাব্যের বর্তমান কূপমণ্ডুক স্থবিরতা আর কিভাবে দূর করা যায়, তা ভাবার অবকাশও খুঁজতে হবে।কেননা সাহিত্যের মতো সর্বব্যাপি একটা মাধ্যমে নতুন কোন স্বর ও বাঁক-কে সাগ্রহে স্বাগত জানাতে হলে সবার সুযোগ্য সহায়তাও জরুরি বৈকি।




যে কথা উদ্ধৃত না হলেই ভালো ছিলো

অনেক পাঠকই হয়তো বিস্ময়ের সাথে এটা ল্ক্ষ্য করেন যে, আমাদের মাছিমারা কলমগুলো কী ভয়ানক নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে কবিতা পদ্য ও ছড়ার মৌলিক পার্থক্য না বুঝেই ককটেল জাতিয় কিছু একটা তৈরি করে অর্থহীন বিকারগ্রস্তের মতো তাকে ছড়া বা কবিতা বলে চালিয়ে দিতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন না। এদের কেউ কেউ আবার কী এক বায়বীয় প্রভাবে সম্পাদক নামধারী আমাদের পরম সম্মানিত কিছু কিছু বিজ্ঞজনের মাথাটাকেও ঘুলিয়ে দিচ্ছেন কোন এক অদৃশ্য কারিশমায়! সম্পাদকীয় যোগ্যতাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে মামদো-বাণিজ্যের এই যথেচ্ছ বাজারে ভিক্ষাবরাদ্দ সাহিত্য-পাতাটায় যখন এসব আচানক বস্তু পাঠকের পাঠতিয়াসী চোখের সামনে নিদারুণভাবে জ্বলজ্বল করতে থাকে, পাঠককে গাধা ভাবার এসব অপরিণামদর্শী ক্রিয়াকাণ্ডে কেউ কি স্বপ্রণোদিত হয়ে একবারও ভেবে দেখেন না, কী ভীষণ হতাশাজনক অন্ধকার এরা লেপে দিচ্ছেন আমাদের সাহিত্যের আগামীদিনের পৃষ্ঠাগুলোয়? বুদ্ধদেব বসু বা আহসান হাবীব-এর কথা নাই বললাম, হাবীবুর রহমান, আফলাতুন বা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের মতো সম্পাদকীয় ব্যক্তিত্বও কি আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম? গোষ্ঠীপ্রীতি দলাদলি আর নির্লজ্জ দখলদারিত্বের এই মামদো-দুনিয়ায় ক্ষুব্ধ পাঠকের যখন লেখক হবার কোন সুযোগই থাকেনা, পাঠকচিত্তকে থোরাই কেয়ার করেন এরা। কোথায় পাঠকরুচির উত্তরোত্তর উন্নয়ন আর নবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন লেখক ঝলকের সুবর্ণ কলমটিকে তুলে ধরবেন, উল্টো এমন এক নিম্নগামিতার ধান্ধা পাঠকের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাঠক-বিমুখতা অতলস্পর্শি না হওয়া পর্যন্ত বুঝি এইসব যথেচ্ছাচার থেকে এরা নিবৃত হবেন না।

মানুষের অসাধ্য বোঝা হাতি দিয়ে টানানো হয়। কিন্তু বন্য হাতি যখন উপদ্রবকারী হয়ে মানুষের উপর হামলে পড়ে, এস্টাব্লিশম্যান্ট নামের এই বন্য হাতির উৎপাত থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় নেই আমাদের? আশার কথা ছড়াপত্রিকা, অন্ত্যমিল, ছড়াড্ডা, চমচম, চমক, ছড়াপত্র, প্রতীকী-এর মতো কিছু কিছু ছোট কাগজ তার সহজাত এস্টাব্লিশম্যান্ট বিরোধী স্বভাব দিয়ে দুর্বলভাবে হলেও এসব অনাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও সবগুলোই হয়তো ওইসব ককটেল ভাইরাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারছে না। এখানেও প্রশ্ন আসে, ভাষাগত জাতি হিসেবে আমরা কি আসলেই অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছি?



যে কথা না জানলে ক্ষতি নেই, আতঙ্ক থেকে যায়

লেখক-বোধ বলে একটা প্রসঙ্গ সাহিত্য জগতে প্রচলিত আছে। এই বোধ-কে একজন সৃজনশীল লেখকের বিবেচনার দিক-নির্দেশক কম্পাসের সমতুল্য মনে করা হয়। এটা প্রকৃতিদত্ত প্রতিভা হিসেবে নিজে নিজে তৈরি হয় কিনা জানা নেই। তবে কোন সৃজনশীল রচনাশৈলী ও এর স্পন্দনটুকু অনুধাবন করতে এই লেখকবোধ জরুরি হলেও অধ্যয়ন বা শিক্ষা ছাড়া এই বোধ অর্জন আদৌ সম্ভব কিনা তাও প্রশ্ন-সাপেক্ষ। ছড়া, পদ্য ও কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভেদটুকু নির্ণয় করতে এই আয়াসসাধ্য বোধের দরজাটাকে আমরা কি পারি না একটু উন্মুক্ত করে দিতে?

বলা হয়ে থাকে কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সর্বোচ্চ শিল্পীত বা উৎকর্ষ মাধ্যম। প্রায় একই অবয়বে সাহিত্যের আরো যে দুটো মাধ্যম রয়েছে, ছড়া ও পদ্য; প্রত্যেকেরই প্রাণস্পন্দন ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু কবিতা-ই কেন উৎকর্ষতার শিখরে? লিখিয়েদের মধ্যে উদ্দেশ্যমূলক মাতামাতি বা এক ধরনের সুচতুর নৈর্ব্যক্তিকতা দেখা গেলেও রসবিচারী পাঠকের কাছে এটা আজ আর কোন বিতর্কের বিষয়ই নয়। কেননা প্রতিটা মাধ্যমই নিজস্ব রূপসৌকর্য, রসগ্রাহিতা আর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও মহিমায় উজ্জ্বল। তাই ছড়া-কবিতা, ছড়া-পদ্য বা পদ্য-কবিতা নামের ইদানিং প্রচলিত কিছু ককটেলিয় ধারণা অযৌক্তিকভাবে শুধু যে উদ্ভট তাই নয়, হাস্যকর অর্বাচীনতার নমূনাও। কে জানে এমোন আবোল তাবোল খিচুরি কথা ভেবেই সুকুমার রায় ছড়ায় ছড়ায় এভাবে ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়ে উঠেছিলেন কিনা- ‘হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),/ হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।/ বক কহে কচ্ছপে- বাহবা কি ফুর্তি!/ অতিখাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।’

মিলনান্তিক ছন্দোবদ্ধ অবয়বের হালকা বা চটুল চালের মধ্যে আমাদের চারপাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংঘটিত অসংগতিগুলোর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কৌতুক বা কটাক্ষ টানার উদ্ভট বা নাটকীয় উপস্থাপনেই আধুনিক ছড়ার বিশিষ্টতা। হতে পারে তা ব্যক্তিক বা সামাজিক বা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে। থাকতে পারে ক্ষোভ, থাকতে পারে কষ্ট বা অন্য কোন তীব্র অনুভূতির আভাস। কিন্তু ছড়ার এইসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এড়িয়ে হিউমার বিহীন সৃষ্ট যে কোন রচনা আর যাই হোক ছড়া হতে পারে না। ‘আপনারা,/ দিলেন কেন/ সাপনাড়া ?/ সাপ হাকালো ফোস/ তাও আমাদের দোষ!’ - (দেশদ্রোহী/ আবিদ আজম)। সফল ছড়ার কী চমৎকার নবীন উদাহরণ! এরকম আরেকটি উদ্ধৃতিযোগ্য ছড়ার উল্লেখযোগ্য অংশ- ‘কুতুবপুরের নবাবজাদা হাফিজ আলী মোস্তাঁ-দের/ মস্ত বড় পরিবারে শতেক লোকের পোষ তাদের।/ অবাক হলে ? বলছি দাঁড়াও/ সে বাড়িতে মানুষ ছাড়াও/ বিশাল পালে গরু ছাগল এবং আছে মোষ তাদের।// ছাগল গরু মোষের দুধে/ পায়েশ লুচি সঙ্গে খেলেই মেজাজ থাকে খোশ তাদের।//.......... এদের গুণের বহর মেলা/ বলতে যাবে সারাবেলা/ তেষ্টা পেলে দেশটা গিলে, এটাই কেবল দোষ তাদের।// সারাবছর দেশেই থাকা/ ডিসেম্বরে দেয় গা ঢাকা/ শুনবে কারণ? বলবো না থাক, নিষেধ আছে ওস্তাদের।’ -(কুতুবপুরের নবাবজাদা/ শফিক ইমতিয়াজ)। আরেকটি উদাহরণ- ‘আম দু’টো ঠিক খাওয়ার পরে জানলো হুজুর যক্ষন / একটা ছিলো গোপালভোগ আর একটা ছিলো লক্ষণ/ কেমন জাতের আম / হিন্দু নামে নাম / জানলে আগে বিজাতি আম করতো না সে ভক্ষণ।’-(ছড়া/ নূরুল ইসলাম খান)

কিন্তু কবিতা কি ? নানা মুনির নানা মতে হাবুডুবু খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত কবিতা যে আসলে শিল্পোপলব্ধির এক মায়াবী রসের নাম, তা আর বুঝতে বাকী থাকে না। কাব্যরসে নিমগ্ন রসজ্ঞরা বলেন - ‘ভাব থেকেই কবিতার জন্ম।’ কিন্তু ‘ভাব’ তো একটা বিমূর্ত ধারণা মাত্র। আর যেহেতু কবিতা হচ্ছে একপ্রকার শব্দশিল্প, তাই আমরা বলতে পারি ভাবযুক্ত শব্দরচনাই কবিতা। আবার শব্দই যেহেতু ভাবের মাধ্যম এবং অর্থহীন বা ভাবহীন কোন শব্দ বাস্তবে অস্থিত্বহীন, তাই শব্দ মাত্রেই কোন না কোন বস্তু বা ভাবের প্রতীকী প্রকাশ। তবু মালার্মে কথিত ‘ শব্দই কবিতা ’ সংজ্ঞাটিকে ভাবগত অর্থে মেনে নিলেও কবিতার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা আদতে তৈরি হয় না। এজন্যেই ইংরেজ কবি কোলরিজের ‘শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্ঠ বিন্যাস’ সংজ্ঞাটিকে অধিকতর অর্থবহ মনে হয়। কিন্তু এখানেও বিপত্তিটা দেখা দেয় কবিতার সাথে একটা চমৎকার সফল গদ্যের পার্থক্য নিরূপন করতে গিয়ে। কিন্তু দান্তে যখন বলেন - ‘সুরে বসানো কথাই হলো কবিতা’ তখন কি সংগীত প্রাধান্য কবিতাকে আলাদাভাবে বিশিষ্ট হতে দেয়? এদিকে ছন্দ-অন্ত-প্রাণ কবি বলেই হয়তো শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা’ কথাটিকে মেনে নিতে গেলেও প্রশ্ন ওঠে - তবে ছড়া বা পদ্য কেন কবিতা নয়? তাই বুঝি শেষ পর্যন্ত আমাদের অগতির গতি রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যেতে হয়- ‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’ এটাকেই যথার্থ সংজ্ঞা বলে মনে হয়। প্রয়োজনীয় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে অপরূপ শব্দচিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয় তার মধ্যে অরূপের সন্ধান অর্থাৎ অন্তর্গত অনুভূতির রসে ভিন্ন কোন অর্থের আবহ তৈরি করাকে কবিতা বলা যায়।

কিন্তু আমাদের অর্থময় চেনা জগতের বাস্তব শব্দ দিয়ে তো আসলে অবাস্তব কিছু নয় বরং আমাদের চেনা দৃশ্য বা বাস্তব আদলই তৈরি করা যায়। তাই এ বাস্তবতাকে তীর্যকভাবে দেখার প্রয়োজনেই চলে এলো প্রতীক উপমা রূপক ইত্যাদির আলংকারিক ব্যবহারের মাধ্যমে চিত্রকল্প সৃষ্টির এক শিল্পীত প্রবণতা। সেজন্যেই জীবনানন্দ দাশের কথায় ‘উপমাই কবিতা’ বলতে মূলত কবিতার চিত্রকল্পতাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এভাবে যথাযোগ্য শ্রেষ্ঠ শব্দগুলোকে শ্রেষ্ঠ বিন্যাসের মাধ্যমে যে অপরূপ শব্দশরীরী চিত্রটা তৈরি হয়ে যায় তাও যখন প্রকাশের বর্ণনাময় আতিশয্যে রহস্যবিহীন, নিরাভরণ ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখন রূপকল্পের দ্যোতনাময় মায়াবী চাদরে জড়িয়ে তাকে করে তোলা হয় চেনা অচেনার মিশেলে গড়া আধা-বাস্তব আধা-কল্পনার এক স্পন্দনশীল মূর্তি। এটাই কবিতা। আক্ষরিক ব্যাখ্যাযোগ্যতার গভীরে ক্রিয়াশীল অন্য এক উপলব্ধির অর্থময় অনুভব। পাঠকমনের সৃজনশীল কল্পনাও এখানে ক্রিয়াশীল হবার বিষয়নিষ্ঠ সুযোগ পেয়ে যায়। সে রচনা তখন আর স্রষ্টা বা কবির একার থাকে না, পাঠকের স্বতস্ফূর্ত অন্তর্ভূক্তি একে নিয়ে যায় রসঘন এক ব্যাখ্যাহীন পরিতৃপ্তির অন্তর্গত জগতে। এবং তখনই একটি সার্থক কবিতা প্রকৃতই কবিতা হয়ে ওঠে। এখানে আর বুঝানোর কিছু থাকে না, বুঝে নিতে হয়; ম্যাকলিশের সেই বিখ্যাত পংক্তির মতোই- ‘কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে ওঠে।’ কেননা বুঝাতে গেলে সে যে আর কবিতাই থাকে না। এই উপলব্ধিজাত বিস্ময় থেকেই বুঝি রবার্ট ফ্রস্টও উচ্চারণ করেন- ‘সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়’। শেষ পর্যন্ত এই হয়ে ওঠাটাই যদি কবিতা হয়, তবে যা হয়ে ওঠে না? যদি এভাবে বলি- যেটুকু কবিতা হতে পারলো না সেটাই পদ্য, তা কি ভুল বলা হবে? ভাষাগত শব্দ ও অক্ষরে সৃষ্ট চেনা দৃশ্যের গভীরে যদি আর কোন দ্যোতনাময় অনুভব ও রসময় উপলব্ধির ছোঁয়া না থাকে বা ভিন্ন কোন অর্থদ্যোতনা তৈরি করতে না পারে এবং পাঠককে তাঁর নিজস্ব কল্পনার কোন অবকাশ না দিয়ে বর্ণিত অর্থটাই যদি একমাত্র আক্ষরিক ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে, তবে সেটাকে নিশ্চিতভাবে পদ্য বলে ধরে নিতে পারি আমরা। অতএব কবিতা প্রয়াসে সৃষ্ট যে রচনাটা শেষপর্যন্ত কবিতা হয়ে ওঠতে পারলো না, তাও পদ্যই।

কবিতার মতো পদ্যও সাহিত্যের অন্যতম শিল্প-মাধ্যম। যে শিল্পী সযত্নে বানর মূর্তি গড়তে জানেন, ওখানেও তাঁর শিল্প-সাফল্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর তাঁরই স্বকীয়তায় দীপ্যমান থাকে। এবং তাকে আমরা নিপুণ শিল্পী হিসেবে যথাযথ সম্মানও দিয়ে থাকি। কিন্তু প্রয়োজনীয় জ্ঞান আর অনুশীলন এড়িয়ে যিনি শিব গড়তে বাঁদর বানিয়ে ফেলেন, আসলে ওটা না হয় শিব না হয় বাঁদর। একটা অসফল শিল্প হিসেবে শিল্পীর করুণ ব্যর্থতা শিল্পরসিকের মনে করুণাই ডেকে আনে। যথার্থ শিল্পী হলে তাঁর মধ্যে ব্যর্থতার হাহাকার থাকবেই। আর যার মধ্যে শিল্পী-সত্ত্বার ‘স’ও নেই, তিনি হয়তো আবারও নির্বোধের মতো প্রয়োজনীয় অনুশীলন ছাড়াই আরেকটা বাঁদর বানাতে বসে যাবেন। তাঁকে কে বুঝাবে, শিল্পীর সাধনা নামে পরিশ্রমলব্ধ একটা অর্জনের বিষয় সব সৃষ্টির পেছনেই বিশাল প্রেরণা হয়ে সংগুপ্ত থাকে!




যেভাবে দোলে ওঠে মায়াবী পর্দাগুলো

প্রসংগ যখন কিশোর কবিতার, কবিতার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে কিশোর মনের ভাবালুতা ও স্বপ্নমগ্নতার উপকরণগুলো কবিতার অনুষঙ্গে মাখানো থাকতেই হয়। না হলে ওটা আর কিশোর কবিতা হবে কি করে? তবে প্রসঙ্গক্রমে এ বিষয়টাতেও সবাই একমত হবেন যে, কিশোর কবিতা হলো সর্বজনবোধ্য কবিতা। কেননা সব মানুষের মনেই থাকে একেকটা চিরায়ত কিশোরের বসবাস। বয়ষ্কপাঠ্য কবিতায় পরিণত বয়সী মানব মনের জটিল উপলব্ধিগুলো উচ্চতর জটিল শিল্পপ্রকরণ আর শাস্ত্র-তত্ত্বের দুর্ভেদ্য দেয়ালে সংরক্ষিত হয়ে যায়। এই দেয়াল ভেদ করে শিক্ষিত মনশ্চক্ষুর রস-আস্বাদী অনুভূতি ছাড়া সকলের জন্য যখন তা বুঝে ওঠা বা রস গ্রহণ করা সম্ভব হয় না, সহজ সরল ভাবুক মনের শিল্প আশ্রয় তখন সর্বজনবোধ্য কিশোর কবিতাকেই বেছে নেয়। ফলে কিশোর কবিতা বলে আমরা যাকে আজ চিহ্নিত করতে চাই, তা মূলত সবারই কবিতা, সর্বজনপাঠ্য। আর এজন্যেই সার্বজনীন শিল্পরুচিবোধ গড়ে তুলতে হলে এই কিশোর কবিতা-কর্মীদেরও যথাযথ শিল্প-শিক্ষিত হয়ে ওঠা খুবই জরুরি বলে মনে হয়। এখানেই প্রশ্ন, কিশোর কাব্যের এই মায়াবী পর্দাটাকে শিল্পীত স্ফূরণ দিয়ে বুনতে পারেন কারা ? যদি সেই উৎস থেকেই চোখ বুলিয়ে আসি, আমরা দেখবো সাহিত্যের মূল স্রোতে বিচরণকারী মহৎ কবিরাই এ যাবৎ এ দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করে আসছেন, এবং এখনো তাঁরাই আমাদের উজ্জ্বল অহংকার।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যাঁর কথা না বললে আমাদের অকৃতজ্ঞতা দুর্বহ হয়ে ওঠবে, তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- বাঙালী মানসের সর্বত্র-বিস্তারী এক অনিবার্য মহীরুহের নাম। আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বটা তাঁর বিশাল ছায়ায় পরিচর্যায় যেভাবে শৈশব থেকেই পরিপুষ্ট হয়ে হয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর অতিমানবিক ব্যক্তিত্বের হিরন্ময় প্রভাব আমাদের শিশু কিশোর সাহিত্যকে দিয়েছে প্রাণ, দিয়েছে রূপ, দিয়েছে আকার এবং দিয়েছে প্রকারও। অতএব ছড়া, কবিতা বা পদ্য কী- তা চিহ্নিত করার সুবিধার্থে রবীন্দ্রনাথ থেকেই আমরা এগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় প্রাণস্পন্দনগুলো জেনে নেয়ার চেষ্টা করতে পারি।
‘ভোলানাথ লিখেছিল,/ তিন-চারে নব্বই-/ গণিতের মার্কায়/ কাটা গেল সর্বই।/ তিন-চারে বারো হয়,/ মাস্টার তারে কয়;/ লিখেছিনু ঢের বেশি/ এই তার গর্বই।’ - ( ভোলানাথ )

হালকা শব্দের চটুল চালের ছন্দময় ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকরণ শৈলী তৈরি এবং নাটকীয়তার মাধ্যমে শিশুমনের যে নিটোল কৌতুক রস ব্যবহার করেছেন তিনি, শিশুতোষ ছড়া হিসেবে উৎকৃষ্ট উদাহরণ তো বটেই, পাশাপাশি ছড়ার বৈশিষ্ট্যসূচক নমূনাও উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের এরকম আরেকটা ছড়ার উদাহরণ-
‘সময় চলেই যায়’/ নিত্য এ নালিশে/ উদ্বেগে ছিল ভুপু/ মাথা রেখে বালিশে।// কবজির ঘড়িটার/ উপরেই সন্দ,/ একদম করে দিল/ দম তার বন্ধ-/ সময় নড়ে না আর,/ হাতে বাঁধা খালি সে,/ ভুপুরাম অবিরাম/ বিশ্রাম-শালী সে।// ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্দুর,/ তবু ভোর পাঁচটায়/ ঘড়ি করে ইঙ্গিত/ ডালাটার কাঁচটায়-/ রাত বুঝি ঝক্ঝকে/ কুঁড়েমির পালিশে/ বিছানায় পড়ে তাই/ দেয় হাততালি সে।’ -(খাপছাড়া)

একইভাবে তাঁর রচনা থেকে একটা পদ্যের বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক উদাহরণও টানা যাক-
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।/ পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,/ দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।// চিক্ চিক্ করে বালি কোথা নাই কাদা,/ এক ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।/ কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,/ রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।//........’ -(আমাদের ছোট নদী)

শব্দে ছন্দে একেবারে ছবির মতো স্বচ্ছ করে গোটা পদ্যটিতে শ্যামল সুন্দর এক চিরায়ত গাঁয়ের যে নিটোল রূপটি এতো চমৎকারভাবে এঁকেছেন, যেন কথা বলছে, চেনা দৃশ্যটাই কতো জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে আমাদের মনে। রবীন্দ্রনাথ এখানে নিপুণ শিল্পীর কলমতুলিতে কেবল বিবরণধর্মী ছবিই তো এঁকেছেন। অন্তর্গত কোন বক্তব্য এখানে পাওয়া যায় না এবং তিনি তা দিতেও চান নি বলে মনে হয়। আক্ষরিক অর্থচিত্রের বাইরে পাঠক হিসেবে আমাদের নিজস্ব কল্পনার কোন অবকাশও এখানে নেই। বস্তুত রচনাটি যতোভাবে পাঠ করি না কেন, আমাদের মনশ্চোখে ঘুরে ফিরে কেবল একটি চিত্রই বারবার ফিরে আসে। উত্তীর্ণ পদ্য বৈশিষ্ট্যে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে! পদ্যের আরেকটি নমূনা উদাহরণ-
‘নাম তার মোতিবিল, বহু দূর জল -/ হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল।/ পাঁকে চেয়ে থাকে বক, চিল উড়ে চলে,/ মাছরাঙা ঝুপ করে পড়ে এসে জলে।/ হেথা হোথা ডাঙা জাগে ঘাস দিয়ে ঢাকা,/ মাঝে মাঝে জল ধারা চলে আঁকাবাঁকা।’/..................... - (মোতিবিল)

আবার রবীন্দ্রনাথই যখন ‘কবিতা কী’ এটা বুঝাতে গিয়ে তাঁর দৃশ্যমান শব্দ-বিন্যাসের মধ্যেই সুনিপুণ চিত্রকল্প তৈরি করে শব্দ ও বাক্যের আক্ষরিক অর্থময়তার গভীরে অন্য এক অর্থময় ভাবনার মায়াবী জগতে আমাদেরকে একটানে ভাসিয়ে নিয়ে যান, অন্তর্গত উপলব্ধির অনুপম জারকরসে সিক্ত পাঠকমন কি চমকে ওঠে না এক অভূতপূর্ব দারুণ বিস্ময়ে!
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।/ মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়/ একেবারে উড়ে যায়;/ কোথা পাবে পাখা সে ?// তাইতো সে ঠিক তার মাথাতে/ গোল গোল পাতাতে/ ইচ্ছাটি মেলে তার,-/ মনে মনে ভাবে, বুঝি ডানা এই,/ উড়ে যেতে মানা নেই/ বাসাখানি ফেলে তার।// সারাদিন ঝরঝর থত্থর/ কাঁপে পাতা-পত্তর,/ ওড়ে যেন ভাবে ও,/ মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে/ তারাদের এড়িয়ে/ যেন কোথা যাবে ও।// তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়,/ পাতা-কাঁপা থেমে যায়,/ ফেরে তার মনটি/ যেই ভাবে, মা যে হয় মাটি তার/ ভালো লাগে আরবার/ পৃথিবীর কোণটি।’ --( তালগাছ )

তালগাছ কি কখনো উড়তে পারে ? হাওয়ায় থরথর করে কাঁপতে থাকলে গোল গোল পাতাগুলো তখন ডানা হয়ে যায়। মাটি ছেড়ে সে শূন্যে উড়তে থাকে, কালো মেঘ ফুঁড়ে আরো উপরে ওঠে তারাদের ফাঁকে ফাঁকে আকাশে ভেসে বেড়ায় মনের আনন্দে। আবার হাওয়া নেমে এলে পৃথিবীর ছোট্ট কোণের বাসাটিতে মা মাটির কথা মনে হয়ে যায় তার। এবং তখন ফিরেও আসে। আসলে তো তাল গাছটি নয়, উড়ে বেড়িয়েছে তার মনটি। বস্তুগত একটা তালগাছের মনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিরায়ত শিশুমনের ইচ্ছেকে যেভাবে চারিয়ে দিলেন, ওই মনটি আসলে কার ? চিরকালীন এ প্রশ্নটার উত্তর তো পাঠকমনের ওই উপলব্ধির গভীরতায়। এটাই বোধ করি কবিতা। ব্যাখ্যার চাইতে এখানে জরুরি উপলব্ধিটাই।

এরকম আরো উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ শিরোনামের রচনাটি অন্যতম - ‘মনে কর, যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চড়ে/ দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,/ আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।/ রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/ রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে// ...........।’ রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে- রূপের মধ্যে অরূপের কী অদ্ভুত সন্ধানই এখানে মুখ্য হয়ে ওঠে !

একটা শতাব্দী পরিক্রমায় এসেও রবীন্দ্রনাথের গড়ে তোলা সেই শিল্প-গণ্ডির বাইরে এই শিশুসাহিত্যকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে একটা পা’ও কি আমরা সামনে ফেলতে পেরেছি আজো ? ছড়া, পদ্য ও কবিতাকে লাবড়া বানিয়ে গুবলেট করে ফেলার অপপ্রয়াসের প্রতিবাদী অবস্থানে দাঁড়িয়ে এই যে আমরা আজ উচ্চকিত হবার চেষ্টায় রত হয়েছি এটাও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিতাপের ও পরিহাসের বিষয় যে, সেকালে তা নিয়ে খুব একটা মাতামাতি না হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠিকই কবিতা, পদ্য আর ছড়ার মধ্যে পার্থক্যসূচক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করতে তাঁর সৃষ্ট শিল্পের মাধ্যমেই তিনি সেসব সুস্পষ্টভাবে এঁকে দিয়ে গেছেন। এতোকাল পরে এসেও স্বীকৃত একটি বিষয় নিয়ে যদি থুক্কু দিয়ে ফের তর্কে লিপ্ত হতে হয়, পাঠবিমুখ শিল্প-প্রজন্ম হিসেবে আমাদেরকে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একদিন ঠিকই মাথা হেট করে দাঁড়াতে হবে। পূর্বপুরুষের কাছে বালখিল্যপনা যা-ই দেখাই না কেন, উত্তরপুরুষের কাছে অন্তত: লজ্জা নিবারণের মেধাটাও কি দেখাতে পারবো না আমরা ?



ছন্দ ও মিলের শাসন ও দু:শাসন

ছন্দ হচ্ছে মহাবিশ্ব প্রকৃতির আদি স্বভাব। এই কসমিক বিশ্বের সুবিশাল গ্রহ-নক্ষত্র-মণ্ডলের বৈশ্বিক ক্রিয়কলাপ থেকে শুরু করে আমাদের শরীরের মধ্যে ধমনীর অভ্যন্তরে রক্তের যে স্পন্দন, এমন কি প্রতিটা অনু-পরমানুর গভীরেও রয়েছে ছন্দের স্বচ্ছন্দ উপস্থিতি। যেখানেই ছন্দের পতন ঘটে সেখানেই শুরু হয় বিপত্তি। আমাদের সাহিত্যের পথচলা যে কাব্যসাহিত্যের হাত ধরে, হাজার বছরের এই কাব্যসাহিত্যের গর্ভধারিণী ছড়াসাহিত্যের উৎসতেও রয়েছে এই ছন্দেরই অনুশাসন।

‘........অপনা মাঁসে হরিণা বৈরী।/ খনহ ণ ছাড়ই ভুসূকু অহেরী।’
-(চর্যাপদ / ভুসূকুপাদ )
‘আপন মাংসের জন্য হরিণ সকলের শত্র“। এক মুহূর্তের জন্যেও শিকারী ভুসূকু (তাকে ) ছাড়ে না।’ দশম-একাদশ শতাব্দীতে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনের স্রোত ধরেই এগিয়ে গেছে আমাদের ছন্দপ্রাণ নদীটাও।

‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ,/ ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’ অথবা -‘ ভাদুরে মেঘ পুবে বয়,/ সেই দিন বড় বর্ষা হয়।’ কিংবা -‘ডেকে ডেকে খনা গান,/ রোদে ধান ছায়ায় পান।’ -( খনার বচন / একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী )

‘ আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই/ মা গিয়াছেন গয়াকাশী, ডুগডুগি বাজাই।’ -(লোকায়ত ছড়া)

ভাষাকে প্রাণচঞ্চল ও ব্যঞ্জনাময় করে শিল্পসম্মত উপস্থাপন তো বটেই, ধ্বণিময় পরিতৃপ্তির আবহ তৈরি করে সর্বজনীন স্মৃতিতে ধরে রাখা সহজ হয় বলেই ছড়াতে তানপ্রধান ছন্দমিলের আবির্ভাব। লেখার কোন লিপি বা কায়দা রপ্ত না থাকায় এভাবেই লোক মুখে ছড়াতে ছড়াতে স্মৃতিনির্ভর লোকায়ত বা চিরায়ত ছড়াগুলো হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে বিজ্ঞান-সভ্যতার সুযোগ্য ছোঁয়ায় আজ লেখ্যরূপ নিলেও, অনেক ছড়াই হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। তবে মুখে মুখে ছন্দশৈলীর উদ্ভাবনশীলতা শেষ পর্যন্ত হারায়নি বলেই সাহিত্য তার ভাষারূপটি ঠিকই আয়ত্ত্ব করে নিতে পেরেছে। আর তারই উত্তরাধিকার হয়ে প্রজন্ম পরম্পরায় আমরাও আজ ছন্দ ছড়া নিয়ে এতো মাতামাতিতে লিপ্ত থাকতে পারছি।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সেকালের সেসব ছড়াগুলোতে তৎকালীন জীবনাচার, পেশাবৃত্তি বা লোকশিক্ষামূলক বিষয়গুলোকে সহজ ও সর্বোত্তম উপায়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার অভিপ্রায় নিয়েই ছন্দশৈলীর প্রয়োগ ও উৎকর্ষতা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়কে ম্লান করে শুধু ছন্দবাজীর ব্যর্থ অপচেষ্টা হাল আমলের মতো আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছেন বলে তেমন কোন প্রমাণ কি আমরা পাই? আমাদের ‘আবোল তাবোল’ প্রবণতাগুলোকে কটাক্ষ করেই ছড়ায় ছড়ায় ছন্দে ছন্দে সুকুমার রায় যখন লিখেন-

‘.....আজকে দাদা যাবার আগে/ বলব যা মোর চিত্তে লাগে/ নাই-বা তাহার অর্থ হোক্/ নাই-বা বুঝুক বেবাক লোক।/.....ছুটলে কথা থামায় কে?/.....রাম-খটাখট্ ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ / কথায় কাটে কথার প্যাঁচ।/....গোপন প্রাণে স্বপ্ন দূত,/ মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভূত!/ হ্যাংলা অতি চ্যাং-দোলা,/ শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।/ মক্ষি রানী পক্ষিরাজ-/ দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ।/ আদিম কালের চাঁদিম হিম,/ তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।/ ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,/ গানের পালা সাঙ্গ মোর।’ -(আবোল তাবোল/ সুকুমার রায়)

-এখানে কিন্তু বিষয়সংশ্লিষ্টতা হারিয়ে যায় না। বরং বিদ্রুপের তীরটাকে তীব্রভাবে ছুঁড়ে দেন তিনি। এর পরেও হাল আমলে এসে আমাদের বোধোদয় কোন্ পর্যায়ে উঠেছে তার নমূনা দেখে হতাশায় আঁতকে ওঠি-

‘খেলতে খেলতে মাথায় ঝিম/ ঝিম-ঝিমুতে লাগলো হিম/ হিম বলেছে শিম খাবো/ কোথায় ঘোড়ার ডিম পাবো/ ওই তো ঘোড়ার ডিম আছে/ ডিম খাবারও টিম আছে/ টিম বলেছে ডিম নেই/ মস্তকে আর থিম নেই!’ -(ছড়া/ আবু সালেহ)

এই অর্থহীন ছন্দবাজীকেই বোধ করি ছন্দের কুশাসন বা দুঃশাসন বলা যেতে পারে। যদিও সর্বজনবোধ্য বয়স্কপাঠ্য আধুনিক ছড়া সাহিত্যে আমাদের অর্জন নেহায়েৎ কম নয়। বলা যেতে পারে ঈর্ষণীয়। কিন্তু উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত একটা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ধারণ করেও শিশুসাহিত্যের প্রথম সোপান হিসেবে শিশুতোষ ছড়ায় হালের সৃজনশীল ধারাটা এতো বেশী শীর্ণতায় ভুগছে যে, পত্র-পত্রিকা সংকলন ম্যাগাজিনের পাতায় শিশুতোষ ছড়া নাম দিয়ে ছড়ার বৈশিষ্ট্যহীন যে সব ছন্দমিলের আজব পদরচনা ভুরিভুরি প্রকাশিত হচ্ছে, তা থেকে আমাদের শিশু কিশোররা আদৌ কোন উপকার পাচ্ছে কিনা জানি না, তবে রচনাকারদের প্রভাব প্রতিপত্তি দৌরাত্ম্য যে বেড়েই যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরেও আমাদের উজ্জ্বল কিছু উদাহরণ তো এখনো হারিয়ে যায়নি -

‘অমুক পাড়ার তমুক কাজী/ গায়ে চাদর চাপিয়ে/ গোমড়া মুখে হাঁটেন সদা/ সারা পাড়া কাঁপিয়ে// মগজখানার ওজন ভারী,/ দেখতে পারো মাপিয়ে।/ মেপে তবু কূল পাবে না,/ পড়বে শুধু হাঁপিয়ে।// বিষ্টি এলে তড়াক ক’রে/ পথে ওঠেন লাফিয়ে,/ গা বাঁচাতে নদীর জলে/ পড়েন তিনি ঝাঁপিয়ে!’ - (বুদ্ধিমান/ শামসুর রাহমান)

‘এ দেশ থেকে ক মাইল দূরে/ সুয়েজ খাল ও পানামা/ ভূগোল পড়ে এ সব কিছু/ এখন আমার জানা মা// মায়ের ধমক: কই,/ আছিস তো মূর্খই/ লেখাপড়াই সব কিছু নয়/ টেবিল থেকে পা নামা।’ -(পড়ুয়া/ সৈয়দ আল ফারুক)

‘শেয়াল নাকি লোভ করে না/ পরের কোন জিনিসটার/ কী পরিচয় দিলো আহা/ কী সততা কী নিষ্ঠার/ তাই সে হলো বনের মাঝে/ এডুকেশন মিনিস্টার।’- ( ....সুকুমার বড়ুয়া)

‘আয় ভাই ভাগ করে নিই জমিদারি/ আমি রাখি জমিটুকু তুই রাখ ‘দাড়ি’/ আমি নেবো হাতিশালে যত হাতি আর/ তুই নিস ছুরি কাঁচি সব হাতিয়ার/ তারপরে ভাগ করি এই ঘোড়াশাল/ আমি নেবো ঘোড়াগুলো তোকে দেবো শাল/ ভিটে মাটি সব কিছু ভাগ করে নেবো-/ আমি যদি ভিটে পাই তোকে ‘মাটি’ দেবো।’ - (ভাগাভাগি/ আবদার রশীদ)

ভিন্ন ভিন্ন রসের শিশুতোষ ছড়ার এরকম উজ্জ্বল উদাহরণ আরো টানা যেতে পারে। পাশাপাশি ছড়ার নামে অজস্র অনাচারের ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত তো আশেপাশে কিলবিল করছেই। কিন্তু বিশাল একটা স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে ছড়াসাহিত্যের পূর্বাপর আলোচনা পর্যালোচনার বিস্তর অবকাশ থাকায় ভিন্ন কোন আলোচনায় বিশদভাবে তা তুলে ধরার ইচ্ছা রইলো। তবে শিশুতোষ ছড়ার সৃজনশীল শীর্ণতোয়া ধারাটা সমকালীন প্রেক্ষাপটে যথাযথ পরিচর্যা না পেলে একদিন যে তা শুকিয়ে সিকস্তিরেখায় ট্যাঁ ট্যাঁ করতে পারে, এই আশংকাটাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়াটা ঠিক হবে কি ?

ছন্দমিলের শাসন ছড়ার ক্ষেত্রে যতোটা অনিবার্য, কবিতার ক্ষেত্রে ততোটা আবশ্যক না হলেও শিশুসাহিত্যের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবিতার অবস্থা আরো শোচনীয় বলেই মনে হয়। লেজেগোবরে পদ্যকারের সংখ্যা ভুরিভুরি থাকলেও কিশোরকবিতাকর্মীর সংখ্যা এমনিতেই কম। তারপরেও দীর্ঘ সময় ধরে এ ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার প্রেক্ষিতে যে সব মুখগুলো থেকে প্রকৃত কাব্যমেধার স্ফূরণ আশা করা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলো, হয়তো যথাযথ অধ্যয়ন অনুশীলনের দুঃখজনক ঘাটতি অথবা মেধাহীনতার কারণে তাঁদের কাছে পুনর্বয়ন পুনর্বয়ানের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া ছাড়া নতুন কিছু পাওয়া থেকে আমাদের সাহিত্য নৈরাশ্যজনকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এঁরাই নাকি বর্তমান কিশোর কাব্যের প্রভাবশালী বিশিষ্টজন, এবং প্রতাপশালীও।

কথা বা বাক্যে তরঙ্গময় ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্যেই কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ। কিন্তু আমরা অধিকাংশই ছন্দমিলের তান বা ঝংকারের মোহ-কে অত্যধিক প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিষয় বক্তব্যের সাথে সাযুজ্যহীন শব্দ প্রয়োগ করে কতো চমৎকার সম্ভাবনাগুলোকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি, তার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেই বিষয়টি আরেকটু খোলাশা হবে।

‘মাগো তুমি বলো শুধু- “খোকন পড়ো,/ হতে হবে জ্ঞানী গুণী অনেক বড়,/ হতে হবে উঁচু শির পাহাড়ের মতো থির/ হতে হবে সুগভীর সাগর খর/ আকাশের মতো খোলা বিশাল বড়।” -(কোন একদিন/ সুজন বড়ুয়া)

অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৩৯১ প্রাপ্ত ‘আজ সারাদিন আমরা স্বাধীন’ বই এর উপরে উদ্ধৃতাংশের কবিতাটি একটি সেরা রচনা এবং প্রচলিত প্রকরণে আদর্শ নমূনা হিসেবে কিশোরকবিতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারতো। উদ্ধৃত অংশটুকু কবিতাটির প্রথম প্যারা। এখানে একটি খোকার প্রতি একজন মায়ের চিরকালীন চাওয়াটুকু বর্ণিত হয়েছে খোকার জবানীতে। কবিতার পরবর্তী ছ’টি প্যারাতে লেখক ছন্দের নিপুণ ব্যবহার ও চমৎকার কাব্যময় অভিব্যক্তির মাধ্যমে চিরায়ত খোকার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ রূপকাশ্রয়ে সমাপ্তিও টেনেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। কিন্তু কবিতাটির শুরুতেই প্রথম প্যারায় যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঠক এখানে এসেই অকস্মাৎ কর্কশ হোঁচট খেয়ে ছিটকে গেলে বাকী পথ পেরোবেন কী করে? উদ্ধৃত অংশের চতুর্থ পঙক্তিতে মায়ের অন্যতম চাওয়া ‘হতে হবে সুগভীর সাগর খর’।এখানে ‘খর’ শব্দটি ব্যবহার করে লেখক আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন?

‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ ৮ম পুনমুদ্রণ: মাঘ ১৪১৩/ জানুয়ারি ২০০৭ সংস্করণ থেকে দেখা যাক ‘খর’ শব্দটির কী অর্থ বেরিয়ে আসে। খর(১)- ১ ধারাল; তীব্র (খর অসি)। ২ প্রবল (খর দাহন)। ৩ তীব্রগতি (খরস্রোতা)। ৪ কর্কশ; কঠোর; রূঢ় (খর বচন)। ৫ উগ্র; কড়া (খর ঝাল)। ৬ প্রখর; প্রচণ্ড (খর রৌদ্র)। ৭ ধাতব পদার্থ মিশ্রিত (খর পানি)। খর(২)- ১ গর্দভ; খচ্চর; অশ্বতর। ২ রাক্ষস বিশেষ।

দেখা যাচ্ছে যে ‘খর’ শব্দটি একটি বিশেষণবাচক শব্দ এবং মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে এ শব্দের প্রয়োগ নেতিবাচক গুণাবলীই (?) প্রকাশ করে। কোন মা কি তাঁর সন্তানের মধ্যে ‘সুগভীর সাগরের’ বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে কোন খর বা নেতিবাচক গুণের প্রকাশ ঘটাতে চাইতে পারেন? শুধুমাত্র ছন্দ ও মিলের সুতীব্র মোহে চিরকালীন মায়েদের নির্মল আকাঙ্ক্ষায়ও বিপত্তি ঘটিয়ে দেয়া হলো!

উল্লেখ্য, ফেব্র“য়ারি ২০০৭ এ প্রকাশিত একই লেখকের ‘এসো ছন্দ শিখি ছড়া-কবিতা লিখি’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ছন্দ যেন মন্দ না হয়’ শিরোনামের নিবন্ধটিতে বিষয়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখক নিজের রচিত এই কবিতাটিরই পুরো উদ্ধৃতি টেনে এখানে আবার আলোচ্য ‘খর’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত করেছেন ‘খড়’ শব্দ দিয়ে। পূর্বোক্ত বাংলা অভিধানে ‘খড়’ শব্দের অর্থ দেয়া আছে- শুষ্ক শস্যশূন্য ধানগাছ; বিচালি বা শুকনা ঘাস। অতএব পঙক্তিটির সর্বশেষ সংস্করণ ‘হতে হবে সুগভীর সাগর খড়’-এর ভাবগত অর্থ কী হতে পারে তার সুযোগ্য ব্যাখ্যা হয়তো প্রাজ্ঞজনেরাই দিতে পারবেন।

আবার কৃষ্ণ গহ্বরের মতো হঠাৎ মেধাশূন্যতা দেখা দিলে ছন্দমিল ঝংকারের মোহে পড়ে একটা চমৎকার কবিতাও কীভাবে হতে হতেও শেষপর্যন্ত একটিমাত্র শব্দের জন্যেই বেমালুম হজম হয়ে যায় তার উদাহরণ-
‘আমার হবে না যাওয়া তোমাদের পথে নিরস মাঠে/ তোমরা ছুটতে চাও, ছুটে যাও, ছুটে যাও/ বানিয়ে হাওয়ার নাও/ অচিন ঘাটে;/ কখনো যাবো না আমি তোমাদের সেই ভুলের হাটে//........//....কোথাও যাবো না আমি, এ ঘরে নীরবে/ শুধু ঘুমাবো,/ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব লাল-শাদা-নীল/ স্বপ্ন খাবো।’ - (কোথাও যাবো না আমি/ রাশেদ রউফ)

উদ্ধৃত সর্বশেষ পঙক্তির শেষ শব্দটি ‘খাবো’। ছন্দমিলের তীব্র ক্ষুধায় ব্যবহৃত এই শব্দটাই শেষপর্যন্ত গোটা রচনাটিকেই যে খেয়ে ফেললো, তা কি লেখকের বোধের দরজায় একটুও নাড়া দেয় নি! তেমনি শব্দ-শাসন যথাযথ না হলে সমিল ঝংকারের মোহে বিষয় সাযুজ্য এলোমেলো হয়ে যাওয়া আরো বহু লেখকের বহু রচনা থেকে বহু নমূনা-উদ্ধৃতি আনা যেতে পারে। এবং পাঠক ভেদে রুচি বা উপলব্ধির ভিন্নতা থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিধায় পাঠকও ভেবে দেখতে পারেন উপরোক্ত মন্তব্যগুলোর সাথে ভিন্নমতের অবকাশ রয়েছে কি না।



আমাদের সেই সব অহংকার

ছন্দ মিলের দুঃশাসন যেমন একদিকে অনেক চমৎকার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে, অন্যদিকে ছন্দ বা মিল-এর সফল শাসন ও পরিমিতবোধে উত্তীর্ণ লেখাগুলোই শিল্প সৌকর্যে পাঠক-নন্দিত সৃষ্টি হয়ে সংরণযোগ্য হয়ে ওঠে শিল্পের নিকানো উঠোনে। আমাদের অহংকার সেই সব রচনা থেকে এরকম কিছু সফল পংক্তির উদাহরণ চেখে নেয়া যেতে পারে। পাঠকের উন্মুক্ত বিবেচনায় সমর্পণ করে এগুলো থেকেও আধুনিকতায় ছুঁয়ে যাওয়া কিশোর কবিতার অন্যতম কিছু মাস্টারপিস কবিতা বেছে নেয়া যেতে পারে।

(এক)

আমার মা না হয়ে তুমি/ আর কারো মা হলে/ ভাবছ তোমায় চিনতেম না,/যেতেম না ওই কোলে?/মজা আরো হত ভারি,/ দুই জায়গায় থাকত বাড়ি,/ আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে,/ তুমি পারের গাঁয়ে।/ এইখানেতেই দিনের বেলা/ যা-কিছু সব হত খেলা/ দিন ফুরোলেই তোমার কাছে/ পেরিয়ে যেতেম নায়ে।/ হঠাৎ এসে পিছন দিকে/ আমি বলতেম, “বল্ দেখি কে?”/ তুমি ভাবতে, চেনার মতো,/ চিনি নে তো তবু।/ তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে/ আমি বলতেম গলা ধরে-/ “আমায় তোমায় চিনতে হবেই,/ আমি তোমার অবু!”/.....
-(অন্য মা / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৬১ - ১৯৪১)

(দুই)

জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-/ ‘মা তোমারে কত ভালবাসি।’/ ‘কত ভালবাস ধন?’ জননী সুধায়।/ ‘এ-তো-’ বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।// ‘তুমি মা আমারে ভালবাস কত খানি?’/ মা বলেন, ‘মাপ তার আমি নাহি জানি।’/ তবু কতখানি, বল!’ ‘যতখানি ধরে/ তোমার মায়ের বুকে।’ ‘নহে তার পরে?’/ ‘তার বাড়া ভালবাসা পারিনা বাসিতে’/ ‘আমি পারি’। বলে শিশু হাসিতে হাসিতে।
-(কত ভালবাসি / কামিনী রায়, ১৮৬৪ - ১৯৩৩)

(তিন)

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,/ মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?/ পুকুর ধারে লেবুর তলে/ থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে/ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-/ মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?//.....
-(কাজলা দিদি / যতীন্দ্রমোহন বাগচী, ১৮৭৮- ১৯৪৮)

(চার)

কাঠবেরালি! কাঠবেরালি! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?/ বেরাল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-/ ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,/ খাও একা পাও যেথায় যেটুক!/ বাতাবি-নেবু সকলগুলো/ একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!/ তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?/ ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!//.....
-(খুকি ও কাঠবেরালি/ কাজী নজরুল ইসলাম, ১৮৯৯-১৯৭৬)

(পাঁচ)

আমার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;/ হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,/ সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;/ আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে/ জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;//......
-(আবার আসিব ফিরে / জীবনানন্দ দাশ, ১৮৯৯- ১৯৫৪)

(ছয়)

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল/ উদার হতে ভাই রে,/ কর্মী হবার মন্ত্র আমি/ বায়ুর কাছে পাই রে।/ পাহাড় শিখায় তাহার সমান/ হই যেন ভাই মৌন-মহান,/ খোলা মাঠের উপদেশে-/ দিল্-খোলা হই তাই রে।//..... বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,/ সবার আমি ছাত্র,/ নানান ভাবে নতুন জিনিস/ শিখছি দিবারাত্র;/ এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়/ পাঠ্য যে-সব পাতায় পাতায়,/ শিখছি সে-সব কৌতূহলে/ সন্দেহ নাই মাত্র।
-(সবার আমি ছাত্র / সুনির্মল বসু, ১৯০২-১৯৫৭)

(সাত)

শিউলি নামের খুকির সনে আলাপ আমার অনেক দিনের থেকে/ হাসিখুশি মিষ্টিমিশি অনেক কথা কই যে তারে ডেকে।/ সেদিন তারে কইনু,‘খুকি-কী কী জিনিস কওতো তোমার আছে?’/ সগৌরবে বলল, অনেক-অনেক কিছু আছে তাহার কাছে;/ সাতটা ভাঙা পেন্সিল আর নীল বরণের ভাঙা দু-খান কাঁচ,/ মারবেল আছে তিন-চারটে, কড়ি আছে গন্ডা ছ কি পাঁচ।/ ডলি পুতুল, মিনি পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল আর-/ পুঁতির মালা, রঙিন ঝিনুক, আরও অনেক খেলনা আছে তার।/ আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, শোলার পাখির ছা,/ সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার একটি খেলার মা।
-(খুকির সম্পত্তি / জসীম উদ্দীন, ১৯০৩-১৯৭৬)

(আট)

আলজিভেরই অপারেশন কালকে হবে খুকুর।/ খুকু যাবে হাসপাতালে। আজকে সারা দুপুর/ বোঝায় তাকে মা যে, “মোটেই একটুও ভয় নেই!/.....// বলল খুকু, মিনিটখানেক থামি,/ “হাসপাতালে যেতে মোটেই ভয় পাইনে আমি।/ তোমার মতন অপারেশন হোক্ না কেন আমার!/ ভয় কি তাতে? কিন্তু একটা কথা জেনো আমার-/ হাসপাতালের লোকেদের মা কিরকম যে বেভার!/ খেল্না দেবার নামে তোমায় গছিয়ে দিল সেবার/কাঁদুনে এক খোকা!/ আমি কিন্তু নেব না তা। নইকো অতো বোকা।/ বলে দিয়ো খোকা দিতে আছে খুকুর মানা।/ খুকুর আমার চাই যে কুকুর ছানা।”
-(খুকুর ভাবনা / শিবরাম চক্রবর্তী, ১৯০৩-১৯৮০)

(নয়)

জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা। যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।// মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে?/ বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।/........../ ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই/ যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই!// আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,/ কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়?/...........// বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,/ কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।
-(ঘুমের আগে / আহসান হাবীব, ১৯১৭-১৯৮৫)

(দশ)

বাণিজ্যেতে যাবো আমি সিন্দাবাদের মতো/ পাহাড়-সাগর-অরণ্য-মাঠ ছাড়িয়ে শত শত।/ মাগো আমায় দাও সাজিয়ে ময়ূরপঙ্খীখানা/ মাগো আমি আজকে তোমার শুনবো না আর মানা।// কোথায় আছে ঘুমতি নদী কোথায় মায়াবন?/ কোথায় আছে সোনার টিয়া কোথায় হীরামন?/ সোনার আলোর মুকুটপরা কোন্ পাহাড়ের পার/ ঝিলিক্ মারে ক্ষীর সাগরে গজমোতির হার?/ সে-সব দেশে যাবার তরে মন যে কেমন করে/ মাগো আমার ময়ূরপঙ্খী সাজাও ত্বরা ক’রে।/ সে-সব দেশে যাবো আমি শুনবো না আর মানা-/ মাগো আমায় দাও সাজিয়ে ময়ূরপঙ্খীখানা।//.....
-(বাণিজ্যেতে যাবো আমি / আশরাফ সিদ্দিকী, ১৯২৭- )

(এগার)

চাঁদ থাকে খালে বিলে, পুকুরের জলে,/ যেই বলি, মাস্টার কান দেয় মলে।/ কানমলা খেতে কারো ভালো লাগে নাকি/ এ কারণে ইস্কুল দিতে হয় ফাঁকি!//.....// উরুগুয়ে কাছে, নাকি সূর্যটা কাছে?/ এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা আছে?/ আমি বলি,“আমি জানি উরুগুয়ে দূরে,/ সূর্যটা রোজই আসে ছাদের উপরে।”//মাস্টার হাসে আর বলে, ‘তুই বোকা’,/ মাথায় আলতো করে মারে তিন টোকা।/ লজ্জায় অপমানে চুপ করে থাকি/ এ কারণে ইস্কুল দিতে হয় ফাঁকি।
-(এমনি কি আর স্কুল ফাঁকি দিই / গৌরাঙ্গ ভৌমিক, ১৯৩০- )

(বার)

লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই/ দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।/ ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন/ মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।/ হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে/ এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।/ “ওমা, দেখো নৃত্যনাট্য” -যেই বলেছি আমি/ মা বকে দেয়, “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”/.....
-(মিথ্যে কথা / শঙ্খ ঘোষ, ১৯৩২- )

(তের)

নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।/ ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর/ ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিলো থরথর।/...../ পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লালদিঘিটার পার/ এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।/ আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল/ বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল-/ পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ/ রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।/......
-(পাখির কাছে ফুলের কাছে / আল মাহমুদ, ১৯৩৬- )

(চৌদ্দ)

মা ও বলেন, বাবাও বলেন/ অভিযোগের সুরে/ আমি নাকি আলসে এবং কুড়ে।/ ঘরের কোনো কাজ করি না মিনু যেমন করে/ সারাটা দিন ধরে।// তাইতো মিনু সবার কাছে লক্ষ্মী সোনা মেয়ে/ বায়না যখন যা ধরে তাই তখ্খুনি যায় পেয়ে।// মিনুর কী কাজ? কখনো বা মসলা পাতি বাটে/ মা’র হয়ে বাসন-থালা যায় যে নিয়ে ঘাটে।/ কলসি ভরে জল আনে আর/ কাঁথায় নক্সা বোনে/ কখনো বা ঝাড় দিয়ে যায়/ দাওয়ায়, ঘরের কোণে।// আর আমি? কাজ করি যে কতো সারাটা দিন ধরে/ সে সব কথা একবারও কেউ, কেউ বলে না ঘরে।/ কালবোশেখীর ঝড়/ ভাঙলে পরে গাছের ডানা, পাখির বাসা-ঘর/ আমি যে যাই ছুটে/ খড়-কুটো সব খুঁজি গিয়ে মাঠপারে, প্রান্তরে/
ওদের বাসা দেই বানিয়ে সযত্নে তারপরে।// এগুলো নয় কাজ?/ মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।//..........
-(কাজ / আখতার হুসেন, ১৯৪৫- )

(পনের)

মাঠ মানে কি মজাই শুধু মাঠ মানে কি ছুটি-/ মাঠ মানে কি অথৈ খুশির অগাধ লুটোপুটি!/ মাঠ মানে কি হল্লা শুধুই মাঠ মানে কি হাসি-/ মাঠ মানে কি ঘুম তাড়ানো মন হারানো বাঁশি!/ মাঠ মানে তো সবুজ প্রাণের শাশ্বত এক দীপ-/ মাঠ মানে ছুট এগিয়ে যাবার-পিপির পিপির পিপ।// ছুট মানে কি ছোটাই শুধু ছুট মানে কি আশা-/ ছুট মানে কি শক্ত পায়ের পোক্ত কোন ভাষা।/...../ ছুট মানে কি ছুটন্ত আর ফুটন্ত সব প্রাণে-/ সাতটি সবুজ সমুদ্দুরের ঢেউকে ডেকে আনে!/..........
-(মাঠ মানে ছুট / কার্তিক ঘোষ, ১৯৪৬ - )

(ষোল)

কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি/ স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।/ নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল/ নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।/ আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ/ আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।// কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি/ ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।/ পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি/ চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।/ আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে/ বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।
-(কখনো আমি / হুমায়ুন আজাদ, ১৯৪৭ - ২০০৪)

(সতের)

আমি যখন ছোট ছিলাম/ খেলতে যেতাম মেঘের দলে,/ একদিন এক মেঘবালিকা/ প্রশ্ন করলো কৌতূহলে-/ “এই ছেলেটা/ নাম কী রে তোর?”/ আমি বললাম,/ “ফুসমন্তর!”/ মেঘবালিকা রেগেই আগুন,/ “মিথ্যে কথা। নাম কি অমন/ হয় কখনো?”/ আমি বললাম,/ “নিশ্চয় হয়। আগে আমার/ গল্প শোনো।”/..........
-(মেঘবালিকার জন্য রূপকথা / জয় গোস্বামী, ১৯৫৪ -)

(আঠার)

যখন পাখি বেঢপ সুরে ডাকিস/ পাখিরে তোর মন ভালো নেই বুঝি/ বৃক্ষ যখন ঝিম মেরে তুই থাকিস/ বুঝতে পারি মন ভালো নেই তোরও।// মন ভালো নেই পুষ্পরে তোর জানি/ বিলাস না তুই গন্ধ আগের মতো/ মন ভালো নেই, মন ভালো নেই মেঘের/ মন ভালো নেই আকাশ পাড়ের চাঁদের/ শুকতারাটি যখন নীরব, বধির/ তখন বুঝি মন ভালো নেই তারও।//..........
-(মন ভালো নেই / ফারুক নওয়াজ, ১৯৫৮- )

(উনিশ)

সবাই ছিলো ঘুমিয়ে, আমার/ দুচোখ ছিলো খোলা-/ আকাশ গাঙে শুভ্র চাঁদের/ নাও ছিলো পাল-তোলা।/ সে-নাও হঠাৎ ভিড়লো আমার/ ঘরের নিঝুম ঘাটে,/ দরজা খুলে দেখি গলুই/ ঠেকেছে চৌকাঠে।/ লাফিয়ে চাঁদের পাটাতনে/ যেই বসেছি গিয়ে/ ঝড়ের বেগে ছুটলো সে-নাও/ আমাকে চমকিয়ে।/ আকাশ-গাঙে শ্যাওলা নরম/ মেঘেরা তুলতুল/ দিঘির জলে শাপলা যেমন/ তেমনি তারার ফুল।/ তারার সে-ফুল একটি আমি/ যেই নিয়েছি ছিঁড়ে/ অমনি চাঁদের নাওয়ে সটান/ ঘরেই এলাম ফিরে।/..........
-(রূপকথা নয় / আবু হাসান শাহরিয়ার)

(বিশ)

কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে, কে?/ মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে,/ আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বারবার,/ তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর?// লাল পরাগে ডাল রাঙিয়ে; রাঙিয়ে নিজের মুখ/ আমার মাকে কাঁদিয়ে তোমার কেমন বলো সুখ,/
কী সুখ বলো মায়ের মনে ঝলকে তুলে আজ?/ ভাই হারানো বোন হারানো আগুন-ছবির ভাঁজ।//..........
-(কৃষ্ণচূড়ার কাছে / সুজন বড়ুয়া)

(একুশ)

আমাদের দিন কাটে সন্ধি-সমাসে/ কচিৎ সিনেমা দেখি ছ-মাসে ন-মাসে।/ গল্পের বইগুলো পড়ে থাকে তাকে,/ ইস্কুলে এত চাপ, পড়ি কোন্ ফাকে?/...../ ঘাড় গেল কুঁজো হয়ে, পিঠে এত বই-/ আমাদের দিনগুলো অকূল, অথই।// এর থেকে ঢের ভালো ছোট হয়ে থাকা,/ শুধু ঘুম, শুধু গান, খেলা আর আঁকা।/ অথবা হঠাৎ কোনও মন্ত্রের বলে/ একেবারে মিশে যাওয়া বড়দের দলে।/ দুপুরে গল্প-ঘুম, সন্ধেয় টিভি,/ কেমন ভাবনাহীন মজার পৃথিবী।/ ওগো ঈশ্বর, ওগো অন্তরতর,/ হয় দাও ছোট করে, নয় খুব বড়।
-(টুপুরের প্রার্থনা / প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়)

(বাইশ)

ওমা, সেদিন হাটের ধারে, মাঠের ধারে-/ করতে গেছি খেলা/ -দুপুরবেলা,/ এমন সময়, এলোমেলো/ কোথা থেকে বাতাস এলো!/ হঠাৎ থেকে থেকে/ অন্ধকারে সমস্ত দিক কেমন ছিল ঢেকে।/ বললে ওরা, ছুটে পালাই ঘর/ ওই এসেছে ঝড়।// আমার যেন লাগলো ভারী ভালো-/ চেয়ে দেখি আকাশখানা এক্কেবারে কালো।/ কালো হ’ল বকুলতলা,/ কালো চাঁপার বন,/ কালো জলে দিয়ে পাড়ি/ আসলো মাঝি তাড়াতাড়ি,/ কেমন জানি করল আমার মন।// -ঝড় কারে মা কয়?/..........
-(ঝড় / মৈত্রেয়ী দেবী)

(তেইশ)

আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা/ বাতাস জুড়ে বিষ্টি,/ গাছের পাতা কাঁপছে আহা/ দেখতে কী যে মিষ্টি!// কলাপাতায় বিষ্টি বাজে/ ঝুমুর নাচে নর্তকী,/ বিষ্টি ছাড়া গাছের পাতা/ এমন করে নড়তো কি?//.....// আকাশ এতো কাঁদছে কেন/ কেউ কি তাকে গাল দিলো?/ ছিঁচকাঁদুনে মেঘের সাথে/ গাছগুলি কি তাল দিলো?//..........
-(বিষ্টি / নির্মলেন্দু গুণ)

(চব্বিশ)

তোমার কেন! মনে থাকার কথাও নয় কারো!/ তখন তুমি অনেক ছোট/ একটু একটু বসতে কেবল পারো।/ ঘর ছেড়ে সেই প্রথম গেলাম দূরে/ তোমায় নিয়ে এলেম সমুদ্দুরে।/ অথই সাগর, ঢেউ ওঠে আর নামে/ ঝড়ের মতো শো শো বাতাস/ মাথায়, ডানে-বামে,/ পাহাড় ঘেঁষে উঠছে তখন/ সূর্যটা লাল বড়!/ দু’ঠোঁট ভেঙে হঠাৎ কেঁদে আমায় চেপে ধরো!/..........
-(প্রথম সমুদ্দুর / প্রণব চৌধুরী)

(পঁচিশ)

আকাশ যখন তারার বাগান হয়/ বাতাস যখন নদীর মতো বয়/ রাতের কানে আঁধার কথা কয়/ খুকুর বুকে জমতে থাকে ভয়/ তখন আমার ইচ্ছে জাগে/ একটু পেলে ছুটি/ ওই আকাশে তারার মতো ফুটি।// সাত-সকালে শিশির যখন ঝরে/ নরম ছোঁয়ায় ফুলের ওপর পড়ে/ সূর্যমুখী পাপড়ি মেলে ধরে/ সেই সুবাসে যায় না থাকা ঘরে/ তখন আমার ইচ্ছে জাগে/ একটু পেলে ছুটি/ ওই বাগানে ফুলের মতো ফুটি।//..........
-(একটু পেলে ছুটি / শাহাবুদ্দীন নাগরী)

(ছাব্বিশ)

একটা যদি ছবি আঁকি এমন/ যেমন- ছোট্ট নদী গাঁয়ের কোলে মেশে/ নৌকোগুলো যাচ্ছে কোথাও ভেসে/ গাঙচিলেরা পড়ছে যেন ঝুঁকে/ ও-পারেতে বন-বনানীর বুকে/ যেন, এমনিতরো স্নিগ্ধ পরিবেশ/ তোমরা তখন বলবে জানি এ-তো বাংলাদেশ।// একটা যদি ছবি আঁকি এমন/যেমন- চারদিকে শষ্য-শ্যামল মাঠ,/ মাঠের পাশে নদীর খেয়াঘাট।/ আকাশ পারে যায় ভেসে মেঘ রাশি/ বটের ছায়ায় রাখাল বাজায় বাঁশি।/ যেন- শেষ হয়নি তার সে গানের রেশ;/ তোমরা তখন বলবে জানি এ-তো বাংলাদেশ।//..........
-(বাংলাদেশ / মুক্তিহরণ সরকার)

(সাতাশ)

মা রেগে কন্,“মিনুরে আজ শাসন করা চাই,/ দুষ্টু অমন কোথাও আর নাই!/ লেখাপড়া কাজের বালাই কিছু তো নেই তার,/ ওকে নিয়ে থাকাই হোল ভার।/ সইব না আর আমি,/ তোমার আদর পেয়েই যে ওর বেড়েছে নষ্টামি।/ আদুরে অই লক্ষ্মীছাড়াটির/ গুণের চোটে পাড়ার লোকে হয়েছে অস্থির!/ দিনে দিনেই হচ্ছে কেমনতরো,/ আজকে তুমি শাসন তারে করো!”// বাপ শুনে কন্ হেসে-/..........
-(শাসন / মুরারিমোহন সেন)

(আটাশ)

আজকের এক রাজকুমারের গল্প শোনো/ রাজকুমারের নেইকো সোনার মুকুট কোনো/ তার যে প্রিয় রাজকুমারী/ তার নামও নয় কঙ্কাবতী/ খুব সাধারণ হলেও আছে রূপের জ্যোতি।/ কেমন আজব রাজার কুমার/ চড়ে না সে পঙ্ক্ষীরাজে/ দিন কাটে তার অন্য কাজে।/ রাজকুমারী, সেও তেমন/ শোয় না কোনো সোনার খাটে/ সখীবিহীন জলকে চলে নদীর ঘাটে।/..........
-(রাজকুমারের গল্প / মোখতার আহমেদ)

(উনত্রিশ)

ঋতু যেন একটি ছবির খাতা/ এই খাতাতে ছয়টি আছে পাতা।// এক-এর পাতায় শুকনো নদী আঁকা/ মাঠ-ঘাট সব শূন্য করে খাঁ খাঁ।/ গাছগাছালি নিঝুম নিরিবিলি/ উদোম গায়ে দাঁড়িয়ে মিলিঝিলি।// দু’-এর পাতায় আকাশ আঁকা মেঘে/ ভরা নদী বইছে স্রোতের বেগে।/ পথে-ঘাটে থিকি থিকি কাদা/ নদীরঘাটে নৌকো ক’খান বাঁধা।//......
..// ছবির খাতা যেই না দেখা শেষ/ ভাসলো চোখে আমার বাংলাদেশ।
-(ছবির খাতা / ফারুক হোসেন)

(ত্রিশ)

নিঝুম রাতে আকাশ পানে দু’চোখ মেলে চাই/ দেখি শুধু হাজার তারার মুগ্ধ পাড়াটাই।/ জোছনা মাখা চাঁদের হাসি/ ঝরে পড়ে রাশি রাশি,/ তখন আমি যাই ছুটে যাই ঘর থেকে ঠিক দূরে;/ শব্দ আসে ডাক শুনি কার? আসছে উড়ে উড়ে।// এপাশ দেখি, ওপাশ দেখি/ দু’পাশ ভীষণ শূন্য একি!/ কে ডাকে কে? পিছে-/ আমি এখন বাঁধনহারা ডাক শুনি কার? মিছে!//..........
-(ডাক দিয়ে যায় কে / জুলফিকার শাহাদাৎ)




পথ হারালেই পথের দিশা

সৃজনে উন্মুখ ব্যক্তিরা নাকি একই পথে দু’বার মাড়ান না। ঠিক যেন নদীর মতোই, এক নদীতে দু’বার ডুব দেয়া যায় না। প্রবহমানতার স্বভাবই তাকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। সৃজনশীল ব্যক্তিরাও নিজ নিজ নবায়নযোগ্যতাকে প্রবহমান রাখতেই যে-পথে একবার হেঁটে যান, পথের সঙ্গী-চিহ্নটাকে মুছে দিতেই ভালোবাসেন; নিজেকে নির্দ্বিধায় হারিয়ে যেতে দেন। যে জানে হারিয়ে যেতে, সেই খুঁজে পথের দিশা। এবং এক নতুন সৃষ্ট পথে ফিরেও আসেন। চেনা পথের চৌহদ্দিটা পেরিয়ে ক’জন পারে এভাবে হারিয়ে যেতে! একই বাঁধা-পথে জীবনভর হাঁটতে হাঁটতে এবং ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন যে পথটা গো’পাটের মতো সংকীর্ণ নালা হয়ে বদ্ধ পানি আর নোংরা কাদার দুর্গন্ধময় হাহাকারে বিষিয়ে ওঠে, সে পথে তাঁরা হাঁটবেনই বা কেন; তাঁরা তো পথ তৈরি করতেই জানেন। খুব সন্দেহাতীতভাবে যুগ-স্রষ্টা একজন রবীন্দ্রনাথই তাঁর বহুমুখী প্রবল সৃজনশীলতা দিয়ে সৃষ্টি-নদী-ধারায় বিচিত্র যতো বাঁক তৈরি করে দিয়ে গেছেন, দ্বিতীয় আর কোন একক ব্যক্তিত্বকে এতোটা প্রতাপ নিয়ে বাংলাসাহিত্যে আমরা পাইনি। তাঁর এই ব্যাপ্তি-বিশালতা মাপা ব্ক্ষ্যমান রচনার উদ্দেশ্য নয় এবং এই যোগ্যতা এ রচনাকারের ধারণাগত কল্পনারও অতীত। আজন্মের কৃতজ্ঞতা নিয়ে অন্তত এটুকু ধারণা করতে চাই যে, আমাদের শিশু-কিশোর-সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্য-প্রকরণে সর্বশেষ যে বাঁকটাও রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করে গেছেন তা থেকেই বা কতোটা এগুতে পেরেছি আমরা? ওই স্রোতের সঙ্গী হয়ে তাঁর সমকালীন ও সমসাময়িক কবিরা সৃজনশীলতার নতুন জলে যে জোয়ার তুলেছিলেন, একালে এসে এ অঙ্গনে তাও কি এখন ভাটার টানে থিতিয়ে যায়নি?

সৃজনশীলতায় সব যুগে সব কালে কবিরাই অগ্রপথিক বলে নতুন কিছু একেবারেই যে হয়নি তাও বলা যাবে না। তবে প্রবল স্রোতাঘাতে তা হয়তো কোন নতুন গতিমুখ তৈরি করতে পারেনি। তবু নতুন একটা স্রোতের সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম বৈ কী। এবং তাতে আমরা গা’ করিনি বলে নতুন বাঁকের সন্ধানও আর পাওয়া হয়নি আমাদের। এ বিষয়টাকেই শুরুতে ব্ক্ষ্যমান নিবন্ধে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে পাঠক-মনের ভাবনা-সূচিতে অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছি। বিজ্ঞ পাঠক, আমরা কি এ বিষয়টা নিয়ে এবার একটু ভাবতে পারি না?

পুনরুল্লেখ হলেও আলোচনার সুবিধার্থে আমাদের এটা অবশ্যই ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না যে, ছন্দ প্রকরণ বিষয়বস্তু ও বোধগম্যতা বিচারে কিশোর-কবিতাই সর্বজনবোধ্য কবিতা শৈলী। তাই দেখা যায় আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় কবিরা বুদ্ধি বিবেচনা বয়স নির্বিশেষে সবার কথা মনে রেখেই যেসব উত্তীর্ণ কবিতা সযত্নে সৃষ্টি করে গেছেন, কালে কালে ওগুলোই আজ কিশোর-কবিতা নামের শিল্প-উঠোনে কী সফলভাবে আসন করে নিচ্ছে! প্রকরণের ছুৎমার্গতা আর অভিনবত্ব এতে কোন বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। বরং নতুন একটা শিল্প-বাঁকের আভাস আমরা এ থেকে পেয়ে যাই। -

শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম।

অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।

কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানো ছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।

দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান ...।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো।
-(প্রত্যাবর্তনের লজ্জা / আল মাহমুদ )

বাংলা কবিতায় ‘সোনালী কাবিন’-এর মাটি-লগ্ন কবি আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ শিরোনামের কবিতাটি কি কবি সত্যি সত্যি কিশোর-কবিতা হিসেবে লিখেছিলেন? মনে হয় না।

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারি কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি। কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারতো ;
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন-কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি।
সেই অমলকান্তি- রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
-(অমলকান্তি / নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )

পরিণত বয়সেও কৈশোর-মগ্ন এমন ভাবাবেগপূর্ণ মন-কেমন করা উপরোক্ত কবিতাটার মতো এতোটা চুঁইয়ে পড়া আবেগ কোনো সমিল ছন্দ বা তানপ্রধান কবিতায় আদৌ কি সম্ভব? সবার জন্যে লেখা এই কবিতটা কিশোর-কবিতার কোন্ বৈশিষ্ট্য পূরন করতে পারেনি? অথবা কোন্ শর্তটা লঙ্ঘন করেছে?

ব্যক্তি-মনের একান্ত মৌলিক সত্ত্বাই হচ্ছে স্বাধীনতার স্পৃহা। স্বাধীনতা নিয়ে বহু বহু কবিতা লেখা হয়েছে। কিশোর-কাব্যে যে ভাবনার অনুষঙ্গ নিয়ে সর্বাধিক কবিতা লিখিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তা হচ্ছে স্বাধীনতা। এ যাবৎ এ বিষয়ে ছন্দে ও কথায় যতো সমিল কবিতা লেখা হয়েছে সেগুলোর তুলনায় নিম্নোক্ত সর্বজন-নন্দিত কবিতাটির সহজবোধ্য ভাষা চিত্রকল্প ব্যক্তি-মনের আর্তি হাহাকার ও পাওয়া-না-পাওয়ার আনন্দ বা কষ্টের অনুভূতিঘন এমন অদ্ভূত আবেগী প্রকাশে অন্য কোন কবিতার চেয়ে কোথাও কি কোন কমতি রয়েছে?-

স্বাধীনতা তুমি / রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/
স্বাধীনতা তুমি / কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-/স্বাধীনতা তুমি/শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্র“য়ারির উজ্জ্বল সভা/স্বাধীনতা তুমি/পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।/স্বাধীনতা তুমি/ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।/স্বাধীনতা তুমি/রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।/..................................................../
স্বাধীনতা তুমি/গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,/হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।/স্বাধীনতা তুমি/খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,/খুকীর অমন তুলতুলে গালে/রৌদ্রের খেলা।/ স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

-(স্বাধীনতা তুমি / শামসুর রাহমান)

অথবা মাতৃভাষা আন্দোলনের লাল রক্ত-মাখা যে একুশ আমাদের অহংকার, তাকে কেন্দ্রে রেখে রচিত কিশোর-মনস্ক সেই কালোত্তীর্ণ কবিতাটিকে আর কোন্ ছন্দোবদ্ধ সমিল কবিতা এখনো অতিক্রম করে যেতে পেরেছে?-

“কুমড়ো ফুলে-ফুলে/ নুয়ে পড়েছে লতাটা,/ সজনে ডাঁটায়/ ভরে গেছে গাছটা/ আর আমি/ ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।/ খোকা তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি?”// চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।// “মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/ বলো, মা,/ তাই কি হয়?/ তাই তো আমার দেরি হচ্ছে।/................../ তারপর/ দাওয়ায় বসে/ মা আবার ধান ভানে,/ বিন্নি ধানের খই ভাজে,/ খোকা তার/ কখন আসে কখন আসে।/....
-(কোন এক মাকে / আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)

উদ্ধৃতিযোগ্য এরকম আরো অনেক কবিতা পাওয়া যাবে, যা পাঠ করে চমৎকার এক ভালোলাগায় সব পাঠকই আচ্ছন্ন হবেন নিশ্চয়ই। তবে যে বিষয়টি উল্লেখ করা আবশ্যক, কিশোর-মনস্ক বা সর্বজনবোধ্য এসব কবিতা রচনার পেছনে উদ্দেশ্যগতভাবে খুব সম্ভবত কিশোর সাহিত্য রচনা করার মতো সুনির্দিষ্ট কোন প্রেরণা বা বোধ লেখকদের মধ্যে কাজ করেনি আদৌ। এবং প্রকৃতপক্ষে তা-ই যদি হয়ে থাকে, তবে এটা অত্যন্ত আশার কথা যে, সাহিত্যের মূল পঙক্তি-ভোজে আলাদাভাবে কথিত শিশুসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য বা বয়স্কসাহিত্য বলে চতুর বিভেদগুলোকে আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় কবিরা কখনোই মানেননি এবং আগামীতেও তা মানার প্রয়োজন বোধ করবেন বলে মনে হয় না। কবি তো নিজের ভাব-জগতে ডুব দিয়ে সৃজন-তাড়নায় ইচ্ছেখুশি সৃষ্টির খেলায় মগ্ন থাকেন। পাঠক তাঁর মনন উপলব্ধি দিয়ে প্রয়োজনীয় রসের তৃষ্ণা মিটাতে যোগ্যতমটাকেই বেছে নেবেন। আর এভাবেই শিল্পোত্তীর্ণ রচনাগুলোর যথাযোগ্য আত্তীকরণ ঘটতে থাকে নিজের নিজের মধ্যে। স্তরভেদে কিশোরও তাঁর প্রয়োজনটাকে ঠিকই বেছে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন আসে, আমরা কেন এই উত্তীর্ণ শিশু বা কিশোরকে এমন শক্ত দেয়ালের ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে রাখতে চাইছি? কী সেই শুভঙ্করের ফাঁকি?

এটা খুবই লক্ষ্যণীয় যে, শিশু-কিশোর কবিতা নাম দিয়ে ইদানিং আমরা যে সব অখাদ্য-কুখাদ্য বর্জ্য-জাতীয় কুষ্মাণ্ড-চাষে মত্ত রয়েছি, তাতে করে অন্তত: এটা বুঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি যে, এই ঘেরাটোপ দিয়ে প্রকৃত মেধাবী কবিদের-কে দূরে ঠেলে রেখে সাহিত্যের এ জগতটাকে দ্বিতীয় বা তারও অধস্থন শ্রেণীর বর্জ্যকারদের সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত করাতে না পারলে এই অযোগ্য-আমাদের মধ্যে তীব্র অস্তিত্ব-সংকট দেখা দেবে, এতে অনেক প্রজাতিই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অতএব মেধাহীন প্রজাতি সংরক্ষণে যে অভয়ারণ্য আমরা বানিয়েছি, ঘেরাটোপের বাইরে থেকে মাল-মশলা সরবরাহ করা না গেলে প্রকৃতিলব্ধ স্বাভাবিক বিবর্তন বা ক্রমোন্নতির আশা করাটা গোবরে পদ্মফুল চাওয়ার মতোই তো হবে! অতএব কবিতাকে জড়িয়ে যেকোন স্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিবর্তন, মাত্রিক পরিবর্তন বা ইতিবাচক কোন প্রয়োজনে আমাদেরকে এখনো সেই মূল স্রোতের নবায়নযোগ্য মেধাবী কবিদের দিকেই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে। এ অঙ্গনে মেধাবী মুখের আজ এতোই অভাব! প্রত্যাশিত ব্যতিক্রমও কি পাবো না আমরা? এতো এতো ‘ফুলটাইমার’এর ভীড়ে আমরা কাজ করবো কী, নিজেদের মধ্যে ঠেলা-ঠেলি করতে করতেই সময় গড়িয়ে যায়। আর ঠেলাঠেলির চূড়ান্ত সুবিধাটা হচ্ছে, এতে কোন ঘিলু বা কলমের দরকার হয় না, পেশিটাকে জুত্ মতো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে পারলেই হলো; কেল্লা-ফতে। একজন মেধাবী কলমধারী শুধু-শুধু এসব পেশি-ঠেলাঠেলির ভীড়ে কেনই বা অপদস্থ হ’তে যাবেন? প্রকৃত কবি নি:সঙ্গের সঙ্গি, একাকী, নিভৃতচারী। অবস্থা-বৈগুণ্যে হয়তো সমকালীন পাঠক তাঁদেরকে এতো বেশি করে পায় না। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে জহুরি পাঠক তাঁদেরকেই খুঁজে নেয় এবং খুঁজে বের করবেই। গৌণ পেশিবাজির স্থায়িত্ব সাময়িক। আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্তই।

লেখা-লেখির সাথে পড়াশোনা বা অধ্যয়ন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। কবি-প্রতিভা তো থাকতেই হবে। তবে অধ্যবসায় বা সাধনা না থাকলে প্রতিভার তাবিজ দিয়ে ঠুটু-জগন্নাথ পর্যন্তই হওয়া যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। তাবিজ খুললেই সিসিমফাঁক। প্রতিভা কলমের মতো; অধ্যবসায়-লব্ধ সামর্থের কালি না পেলে এ কলম আর পাটকাঠিতে কোন তফাৎ আছে কি? সেনা-শিক্ষণে একটা চমৎকার কথা প্রচলিত আছে-‘শক্ত প্রশিক্ষণ সহজ যুদ্ধ।’ ক্রিড়াক্ষেত্রে যিনি একশ’ মিটার দৌঁড়ে নাম লিখান, প্রতিদিন কত হাজার মিটার পথ দৌঁড়ে দৌঁড়ে তাঁকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হয় তা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু একজন শিশু বা কিশোর-সাহিত্য রচনাকারী হিসেবে আমরা অধিকাংশেই বোধ করি এটা মানি না যে, উদ্দিষ্ট রচনাটি তৈরি করতে আমাদেরকে আরো বৃহত্তর অভিজ্ঞতার পরিসরে ডুব দিয়ে নিজের মেধা ও মননকে ঋদ্ধ করে নিতে হয়। ‘শিশু-সাহিত্যিক’ নামের যুক্তিহীন ও অপমানকর একটা লেবেল বা সাইনবোর্ড বালখিল্যের মতো কপালে লাগিয়ে নিয়ে বৃহত্তর সাহিত্যক্ষেত্রে তো দূরের কথা, নিজের লেখাটি ছাড়া সহগামী আর কারো লেখায়ও চোখ বুলিয়ে নেয়ার ফুরসৎ আমরা পাই না। দিন-যাপনে কী ভয়াবহ ব্যস্ততা আমাদের! এমন কূপমণ্ডুকতা দিয়ে একপাল ব্যাঙাচি জন্ম দেয়া ছাড়া আসছে প্রজন্মের জন্য আর কীইবা রেখে যাবো আমরা!

সম্ভবত প্রসঙ্গ থেকে আমরা দূরে সরে যাইনি। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই কথাগুলো বলতে হচ্ছে এ জন্যেই যে, আজ যখন শিশুতোষ বা কিশোর কবিতায় বিপুল সম্ভাবনাময় একটা নতুন বাঁকের খোঁজে তানপ্রবণ ছন্দ বা মিল মুক্তির প্রসঙ্গ এসেই যাচ্ছে, সম্ভাব্য প্রয়োগকারী হিসেবে আমাদের যোগ্যতার প্রশ্নটিও খুব স্বাভাবিকভাবে এসে যাচ্ছে- আমরা কি কবিতা বুঝি? যেমন-তেমন শব্দ ক’খান জোড়া-তালি লাগিয়ে বৈচিত্রহীন বাঁধা লাইনের ওপর দিয়ে ঠাকুরদাদার আমলের মালগাড়িটা বাধাহীন চালিয়ে দিয়ে বিশ্বজয়ের উল্লাসে আমরা যারা বগল বাজিয়েই যাচ্ছি, প্রয়োজনীয় মেধার অভাবে স্বাধীনতার মর্ম না বুঝেই আবার কার না কার একান্ত ভিঠায় লাঙল সমেত মই চালিয়ে দেই! তাই যথাযথ অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মহৎ কবিরা তা দেখাতে কসুর করেননি। কিন্তু আমরা কি তা দেখছি?-

ছেলেটা এসেছে সেই কোন্ দূর পল্লী গ্রাম থেকে
কখনো বাসের ছাদে, কখনো পায়ে হেঁটে
কখনো ভিক্ষা মেগে-মেগে
সব শুনে রাখলেন শহরের বেগম সাহেবা।

ভালো ভালো খাদ্য পায়- উপরি পয়সাও পায়
ছেলেরা দিয়েছে কতো পুরাতন জামা আর জুতো
কিন্তু কি স্বভাব দেখো খেতে দিলে ছেলেটা কেবল
থালা নিয়ে বসে থাকে- কখন কখন
দুই ফোঁটা অশ্র“ ফেলে অকারণ।
তবে কি সে বেশি চায়? বেশি খায়? হা-ভাতে কি?
না- তাও তো নয়-
তারপর আরও অশ্র“ জমা হয় চোখে।

ছেলেটা এতোই বোকা-গেঁয়ো-সে একদিন
শুনে-শুনে পোস্টাফিসে গিয়ে
শুধালো ডাকেতে ভাততরকারি ডাল
গ্রামে কি পাঠানো যাবে ডাক বাক্সে ভ’রে?
যেখানে সবাই পিতা-মাতা-ভাই-বোন উপবাসী
পক্ষকাল ধরে-
না- ছেলেটা কেমন যেন বোকা- উড়ু উড়ু
কাজে মন নেই

ছেলেটা বিদায় হলো কাল সন্ধ্যায়।

-(ছেলেটা / আশরাফ সিদ্দিকী)

কী সহজ সাবলীল ভাষা আর শব্দের ব্যবহার! একটানা পড়ে যেতে যেতে এবং আক্ষরিক অর্থবোধ্যতায় একটা বাচ্চা ছেলেরও না বুঝার কথা নয়। এমন কি লেখাটির শেষ অংশে এসে বোধের দরজায় যখন ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠি আমরা, উপলব্ধির গভীরতায় যার যার মতো করে ডুব দিতে কারো কি কোন সমস্যা হয়? স্পষ্ট হয়ে যায়, কবিতার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এটা একটা চমৎকার কিশোর কবিতা। কিন্তু কবি কি এটা শুধুমাত্র কিশোরদের জন্য লিখেছেন? মনে হয় না। সর্বজনবোধ্যতায় এটা একটা চমৎকার কিশোর কবিতারই উদাহরণ। তেমনি নিম্নোক্ত রচনাটিকে কিশোর কবিতা হিসেবে অস্বীকার করার জো’ আছে? বিশেষ করে কবি নিজেই যখন জীবিতাবস্থায় বয়স বিচারে কৈশোর উত্তির্ণ হবার সুযোগই পাননি-

একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়-
আরো দু’তিনটি মুরগির সঙ্গে
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীব্র চীৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত-
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।

তারপর শুরু হল তার আস্তাকুঁড়ে আনাগোনা:
আশ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!

তারপর এক সময় আস্তাকুঁড়েও এল অংশীদার-
ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতর মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।

খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে-
‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!

তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধবধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে;
অবশ্য খাবার খেতে নয়-
খাবার হিসেবে।
-(একটি মোরগের কাহিনী / সুকান্ত ভট্টাচার্য)

সমিল পদবন্ধনে ঝংকৃত তানের অন্ত্যমিল না হলে উত্তীর্ণ কিশোর কবিতা হতে পারে না, এমন উজবুক ধারণা থেকে যাঁরা স্বেচ্ছায় মুক্ত হতে রাজী নন তাঁদের কথা আলাদা। কেননা সাহিত্যের নতুন জলের উদ্দাম স্রোতে সাঁতার কাটার আগ্রহ বা সামর্থ সৃষ্টির নবায়নযোগ্যতা হারিয়ে এঁরা এঁদোজলের বদ্ধ-মোহেই পড়ে আছেন। এঁদের কেউ কেউ তো আবার কোথাও সমপর্বের ছন্দময় পঙক্তি ভেঙে অসমপর্বের অন্ত্যমিলযুক্ত পঙক্তির অস্তিত্ব দেখলেই মারমুখি হয়ে ওঠেন। তাদের গেলো গেলো রব শুনে মনে হয় পয়ার-যুগের বাঙালী ললনা শাড়ি ছেড়ে শালোয়ার-কামিজ গায়ে চাপাতেই জাত তো গেলোই, বুঝি সম্ভ্রম-হানিও ঘটে গেছে! অথচ গত অর্ধ-শতাব্দি জুড়ে শিশুসাহিত্য তথা আধুনিক কিশোর কবিতায় এর সফল চর্চা কবিতাকে কতোটা গতিশীল, নান্দনিক ও শিল্প-সুষমায় ঋদ্ধ করে সবার কাছে হৃদয়গ্রাহী আকর্ষণীয় করে তুলেছে তার প্রমাণ ব্ক্ষ্যমান নিবন্ধে ‘আমাদের সেই সব অহঙ্কার’ পর্বে উদ্ধৃত নমূনা পঙক্তিগুলোর মধ্যে অনায়াসে পাঠকের নজরে আসবে, যা চিরায়ত আবেদনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এরকম আরো বেশ কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরা সম্ভব হলেও স্থান-স্বল্পতায় সে সুযোগ আপাতত সীমিত। তবে নবীন লিখিয়েদের মধ্যে সাম্প্রতিক চর্চা হিসেবে এই আঙ্গিক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সমপর্বের পয়ারধর্মী রেললাইনে এরা আর ততোটা আগ্রহী বলে মনে হয় না। আবার আবেগাশ্রিত ছন্দবদ্ধ সফল কিশোর কবিতায় অন্ত্যমিলও যে অতি-আবশ্যক নয় তা সাহিত্যের সব শাখাতে সিদ্ধহস্ত আমাদের সমাজ সচেতন মেধাবী কবি ফারুক নওয়াজ তো অনায়াসে দেখিয়েই দিয়েছেন। পাঠককে তাঁর সেই ‘মন ভালো নেই’ শিরোনামের কবিতাটা আবারও পড়ে দেখতে অনুরোধ করি-

যখন পাখি বেঢপ সুরে ডাকিস/ পাখিরে তোর মন ভালো নেই বুঝি/ বৃক্ষ যখন ঝিম মেরে তুই থাকিস/ বুঝতে পারি মন ভালো নেই তোরও।// মন ভালো নেই পুষ্পরে তোর জানি/ বিলাস না তুই গন্ধ আগের মতো/ মন ভালো নেই, মন ভালো নেই মেঘের/ মন ভালো নেই আকাশ পাড়ের চাঁদের/ শুকতারাটি যখন নীরব, বধির/ তখন বুঝি মন ভালো নেই তারও।//..........
-(মন ভালো নেই / ফারুক নওয়াজ)

কবিতার আবেগের সাথে স্বতস্ফূর্ততা এতো চমৎকার খাপ খেয়ে গেছে যে পাঠ করতে গিয়ে খুব সচেতনভাবে খেয়াল না করলে মনেই হয় না যে কবি এখানে অন্ত্যমিলের বাধ্যকতা উঠিয়ে দিয়েছেন। অথচ কোথাও এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি এর শিল্পমান বা আবেগের স্ফূর্ততা। তবে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাঁকে এ আঙ্গিকে খুব একটা চর্চা করতে দেখিনা আমরা। অন্ত্যমিল বিহীন ছন্দবদ্ধ পঙক্তির পরীক্ষামূলক এ চর্চা প্রথম লক্ষ্য করি আমরা গত শতকের চল্লিশের দশকের প্রভাবশালী কবি আহসান হাবীবের মধ্যে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কিশোর কবিতায় আধুনিকতার গোড়াপত্তনকারী কবি আহসান হাবীব তাঁর শিশু-কিশোর পাঠ্য ‘পাখিরা ফিরে আসে’ কাব্যগ্রন্থে অত্যন্ত সাহসিক পদক্ষেপ হিসেবে ‘স্বদেশ আমার’ শিরোনামের কবিতাটি দিয়ে অন্ত্যমিলের একান্ত আবশ্যকহীন শক্ত মাটিতে যে শিশু-বীজটি বপন করলেন, তা কি কিছুই ইঙ্গিত করে না?-

জেলের সেলে বন্দী ছিলো/ মৃতের স্তুপের অন্ধকারে বন্দী ছিলো/ বন্দী ছিলো বন্ধ দুয়ার/ ভয় থমথম ঘরের মাঝে।/ শহর জুড়ে কারফ্যু তার কাফন ছড়ায়/ সেই কাফনে বন্দী ছিলো।// ওরা তখন মন্ত্রপুত মশাল নিয়ে নামলো পথে/ মৃতের স্তুপে ফোটালো ফুল/ নতুন প্রাণে গাঁথলো নতুন দীপাবলি।// আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার/ গ্রাম নগরে রাত পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে/ রাত পেরিয়ে/ সূর্য নামে।// তখন দেখি/ আলোর মুকুট মাথায় পরে/ ভুবন জুড়ে বাইরে এলো বন্দিনী মা বাংলা আমার/ স্বদেশ আমার।
-(স্বদেশ আমার / আহসান হাবীব)

কিশোর কবিতায় ঝংকৃত ছন্দ-লালিত্য ছেড়ে সম্পূর্ণ গদ্য ছন্দের চর্চায় তাঁকে হয়তো আমরা পাইনি। কিন্তু সম্ভাবনার যে জলল দরজা দেখিয়ে দিলেন তিনি, পরবর্তী সূর্য-সন্তানরা নিশ্চয়ই তা খুলে দিয়ে নতুন পথের সন্ধানে নামবে এমন আশা করতেই পারি আমরা। যদিও এখনো এ অঙ্গনে গদ্যছন্দে কাব্যনিমগ্ন চর্চাকারী কাউকেই দেখছি না, তবে ইতিবাচক একটা প্রবণতা ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাজার বছরের বা পাঁচশ’ বছরের শিশু-কিশোর কবিতা নিয়ে কিছু কিছু সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে ইদানিং যার কোন কোনটিতে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের পূর্বসূরী মহৎ কবিদের গদ্যছন্দে রচিত গুটিকয় সর্বজনপাঠ্য নন্দিত কবিতাকে কিশোর কবিতা হিসেবে আত্তিকরণ করে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে। তা পাঠ করে চমৎকার এক ভালোলাগায় পাঠকও আচ্ছন্ন হবেন আশা করি। এ নিবন্ধেও এর উল্লেখযোগ্য কিছু কিছু উদ্ধৃতি রয়েছে। এভাবে এরকম অন্যান্য সংকলনেও যদি এই আত্তিকরণের বিষয়টি ঘটে, নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত আশার কথা হবে যে কিশোর কবিতার নতুন একটা দিগন্ত খুলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে তা আরো বেগবান করবে। হয়তো কারো ভাবনার দরজায় কোন সচেতন কড়াঘাত এখনো পড়েনি বলেই কিশোর কবিতায় গদ্যছন্দে কোন চর্চা এখনো চোখে পড়ছে না আমাদের। তবে তা পড়তে কতক্ষণ। ভাবের দুয়ারে নাড়া খেলে ছন্দ আর মিলের বন্ধন কবিতার জন্য বাহুল্য বৈ কিছু নয়, এটা দেখার জন্যে হয়তো আমাদেরকে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে এই যা। অথবা কেউ হয়তো নিভৃতে চর্চা করছেনও যা আমাদের নজরে এখনো আসেনি। সৃজনের শিল্প-সম্ভাবনায় কিছুই অগম্য নয়।
নিজের উপর আস্থাহীন ও সামর্থহীন যাঁরা, তাঁরা নাহয় বিভিন্ন কিসিমের গেলো গেলো রা করতেই থাকুন। আমাদের চিরকালের অহঙ্কার মহৎ কবিদের মেধা সামর্থের প্রতি যথা-আস্থা রেখেই আমরা আশাবাদী হবো। সৃষ্টির মহত্ব তার নতুন নতুন প্রণোদনায়, নতুন উদ্ভাসে, নতুন চিন্তায়, নতুন শৈলীতে এবং নতুন ভাবনায়। বুকের দরজাটা খুলে দিয়ে আমরা নতুনকে আবাহন করতে চাই। রসবিচারী পাঠক আর মহাকালই নির্ধারণ করবে কী থাকবে আর কী থাকবে না। নিজেকে রুদ্ধ করে রেখে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেই আক্ষেপ কেন আর প্রতিধ্বণিত করবো আমরা- ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’

... ... ...




রণদীপম বসু , ঢাকা, বাংলাদেশ।
Web published:
http://www.mukto-mona.com/Articles/ranadipam_basu/Juvenil_Litareture.pdf
Mukto-mona
Satrong

No comments: