Friday, March 14, 2008

# উল্টোস্রোতের কূলঠিকানা, প্রসঙ্গ- নারী দিবস


উল্টোস্রোতের কূলঠিকানা,
প্রসঙ্গ- নারী দিবস

-রণদীপম বসু

৮ই মার্চ এলেই আমরা যারা নারীর অধিকার নিয়ে মুখে খইয়ের মতো অনর্গল কিছু তুবড়ি ফুটিয়ে অতঃপর নিজেদের দায়িত্ব সম্পন্ন হয়ে গেছে ভেবে আত্মতৃপ্তিতে বিগলিত হয়ে ওঠি, একবারও কি ভেবেছি আমরা, নারীর অধিকার আদায়ের দাবীতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন মানেই যে প্রতিবার আমাদের তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সভ্য গালে একেকটা অসভ্য থাপ্পড়ের মতো! চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া শুধু- আমরা এখনো যেকোনো অসভ্য প্রাণী থেকে এক কদমও এগিয়ে নেই। এটা বোঝার ক্ষমতা কি এখনো আমাদের হয় নি? নইলে একজন নারীকে কেন তারই সমসঙ্গী একজন পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে রাস্তায় নামতে হবে। নারী কি মানুষ নয়? ঘরে ঘরে আমরা পুরুষরা কি কোন মানুষের সাথে সংসার করছি না তবে? ভাবতে অবাক হই, পৃথিবীতে আর কোন্ মানবিক আন্দোলনকে এমন দীর্ঘমেয়াদি ও চূড়ান্ত ফলাফলহীন অবস্থায় এভাবে অনিশ্চিৎ দূরগামী সক্রিয়তায় যুক্ত থাকতে হয়েছে?

তৎকালীন ব্রিটিশরাজের অধীনস্ত সিপাহী, আমাদের বিক্ষুব্ধ পূর্বপুরুষ, মঙ্গল পাণ্ডে ১৮৫৭ সালে শৃঙ্খল ভাঙার যে ঐতিহাসিক বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি এটাকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে প্রচারণা চালালেও মূলত তাই ছিলো ভারত উপনিবেশে আমাদের জেগে ওঠা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের যন্ত্রণা যে আসলেই একটা অভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষা, তার প্রমাণ পাই ঠিক সেই সময়কালেই অর্থাৎ ১৮৫৭ সালেই পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁই কারখানায় যখন নারী শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি কর্মঘণ্টা পরিশ্রম, নিম্ন-মজুরি তথা মজুরি বৈষম্য, অমানুষিক নির্যাতন ও খাদ্যের অভাবের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ফলশ্রুতিতে তাদের উপর নেমে আসা দমন পীড়নের সেই ৮ই মার্চের ঘটনাকে বিশ্বের দেশে দেশে নিপীড়িত নারীরা কিন্তু ভুলে যায়নি।

১৮৬০ সালে এই নারী শ্রমিকরাই নিজেদের দাবি আদায়ের প্ল্যাটফরম হিসেবে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। আর তাই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই ১৮৬৮ সালে শ্রমিক শ্রেণীর সেই প্রথম আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে মহামতি কার্লমার্কস শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সঙ্গে নারী অধিকার ও নারী মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরেন। তাদের প্রচেষ্টায় এর পর থেকেই নারী শ্রমিকদেরও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য করা শুরু হয়। ফলে ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে প্যারি কমিউনের বিপ্লবী সংগ্রামে প্রবল সাহসিকতা নিয়ে শ্রমজীবী নারীরা অংশগ্রহণ করে দেখিয়ে দেয় সক্ষমকতায় পুরুষের চেয়ে কোন অংশেই এরা কম নয়। এভাবে এসব আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীদের একটি বড় অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিস্তৃতিলাভ করতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৮৮৯ সালে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে কমিউনিস্ট নেত্রী কারা জেটকিন সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে নারীর সমানাধিকারের দাবি তোলেন। আন্দোলন সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ১৯০৭ সালে জার্মানীর স্টুটগার্টে এই কারা জেটকিনের নেতৃত্বেই প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯০৯ সালে ৮ই মার্চ নিউইয়র্কের দর্জি শ্রমিক নারীরা প্রথম নারীর ভোটাধিকারের ঐতিহাসিক দাবি তুলে ধরেন। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ প্রতিনিধি নিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এ সম্মেলনের গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯১১ সাল থেকে প্রথমবারের মতো নারীদের সমানাধিকার দিবস হিসেবে ৮ই মার্চ পালিত হওয়া শুরু হয়। এ ধারা অব্যহত থাকে এবং দেশে দেশে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যতটুকু জানা যায় অবিভক্ত ভারতে ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে প্রথম ৮ই মার্চ পালিত হয়। আর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক প্রথম ৮মার্চ পালিত হয়।

নারী অধিকারের এই যৌক্তিক দাবিগুলোকে মাথায় রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে জেণ্ডার ইকোয়ালিটি নামের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সেই থেকে সদস্য দেশগুলো তা পালন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। আর বিশ্বব্যাপি পালিত হয়ে আসা ৮ মার্চের দিনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি বিল উত্থাপিত হয়। নিজ নিজ দেশের ঐতিহাসিক জাতীয় ঐতিহ্য ও প্রথার আলোকে মহিলাদের অধিকার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে জাতিসংঘ এই দিনটিকে দিবস হিসেবে পালনের জন্য রাষ্ট্র সমূহের প্রতি আহ্বান জানায়। আর এরই ফসল হিসেবে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহিত প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ই মার্চ-কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।

আজ ৮ মার্চের নারী দিবসের দাবি শুধু মজুরি বৈষম্য বিলোপ ও ভোটাধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে তা ব্যাপ্তিলাভ করেছে নারীর অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। সেই ১৮৫৭ থেকে আজতক এই যে দেড়শ’ বছরের নারী মুক্তি আন্দোলনের পরিক্রমা, এতো দীর্ঘকালব্যাপি পৃথিবীতে আর কোনো আন্দোলনকেই বোধ হয় এমন অনিশ্চিৎ অভিযাত্রায় ঘুরপাক খেতে হয় নি। এটাই বোধ করি মানবেতিহাসে মানব সভ্যতার এক চরম পরিহাস! এখানেই প্রশ্ন আসে, সভ্যতার জারিজুরি মাখা আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটা কি আদৌ বন্যতার আদিম সাম্য সমাজটাকেও অতিক্রম করতে পেরেছে? নইলে মানুষ পদবাচ্যে থেকে পুরুষের সমকক্ষ হয়েও একজন নারীকে কেন আজো পুরুষের সমানাধিকারের জন্য দাবি আদায়ের আন্দোলন করে যেতে হবে?

সমাজের ক্ষুদ্রতম প্রতিটা এককে বা এক একটা পরিবারে আমরা যে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা নিয়ে পরম আয়েশে দিনযাপন করছি, একবারও কি ভেবে দেখেছি, নারীর সত্ত্বার মানবিক অধিকার না দিয়ে মা’কে শ্রদ্ধা, বোন’কে মমতা, স্ত্রী’কে সোহাগ বা কন্যা’কে যে বাৎসল্য দেখাচ্ছি আমরা, আসলে তা কী দেখাচ্ছি? এটা কি মর্মস্পর্শি ভণ্ডামীরই নামান্তর নয়?

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আজ আমরা যখন এই বিপুল মহাবিশ্বের অলিগলির খোঁজে ছড়িয়ে যেতে পারছি নিমেষেই, সেখানে পাশের একান্ত সঙ্গিনীটিকে চিনে নিতে সামান্য নিজের ভেতরে ডুব দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি কেন আমরা? কোথায় তার সমস্যা? আসলে আদৌ কি ডুব দিতে চাচ্ছি আমরা, না কি পুরুষত্বের আদিম চামড়াটা ছিঁড়ে এখনো সত্যি সত্যি মানুষই হতে পারিনি?

পচনের উৎসটাকে রোধ না করে ধর্মতাত্ত্বিক সুগন্ধী মাখিয়ে মানবিক পচনশীলতাকে আর কতোকাল এভাবে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? #

No comments: