Friday, March 28, 2008

# লোপাটের লাম্পট্য ও কিছু উপলব্ধি

লোপাটের লাম্পট্য ও কিছু উপলব্ধি
- রণদীপম বসু

অন্তর্বয়ান

আন্তর্জালের www.qantara.de/এর আর্কাইভে এন্টার দিতেই চোখ আটকে গেলো একটা ইতিহাসের হৃদপিণ্ডে। স্পট আফগানিস্তান। ১৯৬৩ সালে ধারণকৃত The Bamiyan Valley-র ছবিটা না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না কী বিশাল গৌরব আর ঐতিহ্য ধরে আছে ওটা। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ফোকাস করা ছবিটার যে জায়গাটাতে গিয়ে অজান্তেই চোখ আটকাবে, তা হলো, দূরের পাহাড়টার মাঝ বরাবর সুবিশাল তোরনের মতো প্রবেশ মুখটাতে। বিপুল বিশালতা নিয়ে গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বানের এক সমৃদ্ধ ভাস্কর্য!


[চিত্র: The Bamiyan Valley 1963, Afganistan]

শুধু বুদ্ধমূর্তিটাকে ফোকাস করা অন্য ছবিটা দেখলেই এর বিশালতা টের পাওয়া যায়। মূর্তির পায়ের গোঁড়ালিরও নিচের অবস্থানে সুপ্রশস্থ বিরাটকায় গুহানুমুখে অতিক্ষুদ্র অবয়বে ঘোরসওয়ার মানুষের যে তুলনামূলক আকৃতি বিন্দুর মতো চোখে পড়ে তাতেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। এটাও ১৯৬৩ সালের গৃহিত ছবি। এখানে কাছে থেকে দেখে বুঝা যায় যে মূর্তিটা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত। এজন্যে কি মানুষ না প্রকৃতি দায়ি, প্রশ্ন থেকে যায়।


[চিত্র: The Bamiyan Buddha, 1963]

আর তৃতীয় যে ছবিটাতে একজন তালেবান যোদ্ধা বা সৈনিক সশস্ত্র বসে আছে, পেছনেই দূরবর্তী অবস্থানে সেই মূর্তিটারই সর্বশেষ ধ্বংসাবস্থা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। কে করেছে এটা-



কোন প্রশ্নের অবকাশ কি আর বাকি থাকে? UNESCO ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে The Bamiyan Valley’র ৩০০ মিটার লম্বা এ বুদ্ধমূর্তির ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধি ধ্বংস সবই Qantara.de ওয়েব সাইটে বর্ণিত আছে। ওটার পুনর্বয়ান আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসে ফটোচিত্রের তুলনামূলক বিষম প্রত্যক্ষতায় মনটা ভীষণ আহত হলো।

বহির্বয়ান

আজ ২৬মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। গতকাল দৈনিক সমকালে পড়লাম- ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় শহিদের নাম তালিকা সংবলিত ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিফলকের অংশবিশেষ কে বা কারা ভেঙে দিয়েছে! সরকারি রুটিন অনুযায়ী স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে অকেশনাল পরিদর্শনে ঘটনাস্থলে গিয়েই কেবল বিষয়টা কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এটা কি স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্রমান্বয়িক দুঃসাহস, না কি জাতি হিসেবে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির অদ্ভুত পরিহাস?

আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ। কোন মিল বা অমিল কি চোখে পড়ে? ক’মাস আগের সেই ফ্রান্সের গীমে মিউজিয়ামে আমাদের অমূল্য প্রত্নসামগ্রি প্রেরণের অনৈতিকতা নিয়ে সংস্কৃতিবান সচেতন মহলে ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদের উত্তাপটা এখন স্তিমিতপ্রায়। কিন্তু মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই বারবার ঘুরপাক খেতে লাগলো-

কোনটি আগে- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, না কি ধর্মীয় ঐতিহ্য? (এখানে সাংস্কৃতিক শব্দটি সংস্কৃতিগত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।) এরকম বিতর্ক শুধু যে অহেতুক তাই নয়, দুরভিসন্ধিমূলকও। কেননা, কোন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পেটের মধ্যেই তার ধর্মীয় সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের অবস্থান অন্য সব ঐতিহ্যের সাথে কালানুক্রমিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। উৎস সন্ধানী গবেষকের নিরক্ত অনুসন্ধানে তা বেরিয়ে আসে কেবল। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই যে কালানুক্রমিক প্রবহমানতা, তা কি কখনো পরিবর্তনযোগ্য হতে পারে! নিঃসন্দেহেই অসম্ভব। মহাকালের ইতিহাসে বিগতকাল মানেই অনন্তস্থির এবং অপরিবর্তনীয়। এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকার কথা নয়।

উপলব্ধি

ইচ্ছা করলেই কি অতীত মুছে ফেলা সম্ভব? বর্তমান বা ভবিষ্যতের আড়ম্বরের তলে সাময়িক চাপা থাকতে পারে শুধু। পেছনে খুঁড়তে থাকলেই তো বেরিয়ে আসে তা। আমাদের ভূমিপুত্র পূর্বপুরুষরা যে মাটিবর্তী ঐতিহ্যের অংশ ছিলেন, উত্তরপুরুষ হিসেবে আমরা যদি তা অস্বীকার করি তাতে ঐ স্বতসিদ্ধ সত্যের কি কোন নড়চড় হবে? আত্মপ্রবঞ্চিত প্রজন্ম হিসেবে আমরা মহাকালিক ইতিহাসের আরেকটা অপরিবর্তনীয় পৃষ্ঠা কলঙ্কিত করে উত্তরপ্রজন্মের মুখে চুনকালি মাখাবো শুধু।

একইভাবে ’৭১, বাঙালির দীর্ঘ ঐহিহ্যের এক অক্ষয় অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের অপরিবর্তনীয় পৃষ্ঠা বা অক্ষর মুছে ফেলার বা বিকৃতির বাতুল অপচেষ্টা শুধু কি হাস্যকর? কৌতুককরও। মহত্তম এ ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে যে যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের সহযোগীরা তাদের কুৎসীৎ কৃতকর্ম চাপা দিয়ে রাখতে চাচ্ছে, তা কতকাল ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব? চারদিকে শুরু হয়ে গেছে ঐতিহ্য অনুসন্ধানের দুর্বার খনন। আর এটা তো কালের ইতিহাসে সেদিনের ঘটনা। অপকর্মের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেই যদি অতীতকে সম্পাদনা করা যেতো, তাইলে এই সৃষ্টিটাই কি অবান্তর এবং কাল্পনিক হয়ে যেতো না? চাইলেই কি নতুন নতুন ভেকধারী সেই যুদ্ধাপরাধী অমানুষরা এই পড়ন্ত বয়সে এসে ফের সেই সাইত্রিশ বছর আগের রক্তখেকো নারীখেকো বিষ্ঠাময় হিংস্র কামুক বয়সে ফিরে যেতে পারবে? ইতিহাস লোপাটের লাম্পট্য দেখানোর এই বালখিল্য অপচেষ্টা আরেকটা কলঙ্কময় কৌতুককর ইতিহাসই হবে।

কালের চক্ষু বড় ভয়ঙ্কর! একে এক বিন্দু ফাঁকি দেয়ার কোন উপায় নেই। মহাকাল সবাইকেই যার যার কৃতকর্মের পাওনা কড়া-গণ্ডায় ঠিকই শোধ করে দেয়। এটাই চিরায়ত সত্য এবং অনিবার্য।

আমরা কি সেটা বুঝতে পারছি? #
R_d_B
Mukto-mona

No comments: