‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Friday, March 7, 2008
# নোবেল লরিয়েটের সাথে একদিন
নোবেল লরিয়েটের সাথে একদিন
- রণদীপম বসু
১৩ অক্টোবর, ২০০৬ শুক্রবার। এই ঐতিহাসিক দিনে নরওয়ের নোবেল কমিটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেয়। বাংলার সোনার ছেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের এ পুরস্কার ছিনিয়ে আনার সংবাদে উল্লাসে ফেটে পড়লো গোটা জাতি।
১৯১ জন প্রতিযোগীর তালিকা থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্রঋণের জয়বার্তা ঘোষণা করে দারিদ্র্য বিমোচনে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় প্রায়োগিক অবদানের স্বীকৃতি দিলো অবশেষে। এর স্রষ্টা যে বাংলা মায়ের এই দামাল ছেলেটি। তাই এর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বাঙালীর বুকে মুহূর্তেই। হীনমন্য জাতি হিসেবে এতকালের মিথ্যে অপবাদের মোড়ক ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে একান্ত স্বরূপে আবার। আত্মবিশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছে তাই সেই একাত্তরের গর্জনের মতোই- ‘আমরা পারি, আমরা পারি.....’।
দেশী বিদেশী মিডিয়া আর দল মত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের উচ্ছল আর্দ্রতায় মাতোয়ারা গ্রামীণ ব্যাংক-চত্বরসহ গোটা দেশ যে উৎসবে মেতে উঠেছিলো, কেউ না দেখে থাকলে এই অনুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব?
পুরস্কার ঘোষণার প্রাক্কালে নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ওলে ডানবোল্ট মিওস কর্তৃক প্রদত্ত সাইটেশনটির বাংলা তর্জমা ছিলো এরকম-
“ নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি” ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় অবদানের জন্য এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের চক্র ভেঙ্গে বের করে আনার পথ দেখাতে না পারলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সে রকমের একটি পথের দিশা। এ পথে আনা উন্নয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অগ্রগতিকেও গতিশীল করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটি মানুষের স্বার্থে স্বপ্নের বাস্তব প্রয়োগে মুহাম্মদ ইউনূস নিজের নেতৃত্ব গুণের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
জামানত ছাড়াই দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেয়া অসম্ভব একটি ধারণাই ছিলো । তিন দশক আগে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ইউনূস প্রথম বারের মতো এ অসম্ভব ধারণাকেই শুধু ভাঙ্গেননি, তিনি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে গ্রামীণ ব্যাংক আজ অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্যই ধারণা ও মডেলের অফুরান উৎসের রূপ নিয়েছে। পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষের সুন্দর জীবন যাপনের অধিকার যেমন আছে তেমনি তাদের সম্ভাবনাও আছে। সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্বিশেষে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে গরিবের মধ্যে গরিবতম মানুষটিও নিজের উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। মেয়েদের জন্য নিপীড়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেসব সমাজে বিরাজ করছে ক্ষুদ্রঋণ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এক মুক্তির উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক গণতন্ত্র তার পুরো সম্ভাবনার বাস্তব রূপ দিতে পারে না। পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য নির্মূল ইউনূসের দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন। শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সে স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে এ স্বপ্ন পূরণে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বড় একটি ভূমিকা পালন করে আসছে।”
বাঙালি হিসেবে তৃতীয় আর বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম এই নোবেল লরিয়েট-কে কাছে থেকে দেখা ও তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হলো একদিন। ২২ জানুয়ারি, ২০০৭। ততদিনে তিনি তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের সহকর্মীদের সাথে নিয়ে এক জমকালো সফরের মধ্য দিয়ে নরওয়ের অসলো থেকে নোবেল পুরস্কার নিয়ে রাজকীয় মর্যাদায় সুইডেন ব্রিটেন ও ফ্রান্স ঘুরে এসেছেন। স্যার আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতেই প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বরে নোবেল কমিটি অসলোতে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান করে থাকে। ১০ ডিসেম্বর,২০০৬ তারিখে ঐতিহ্যবাহী সিটি হলে অনুষ্ঠিত এবারের রাজকীয় অনুন্ঠানটি তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে সরাসরি টিভি সম্প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় সবাই একযোগে উপভোগ করেছেন। সবাই দেখেছেন ড. ইউনূস কী বিশাল সম্মান এ জাতির ললাটে এঁকে দিয়েছেন।
এতোবড় ব্যক্তিত্বের বিশালতা আর গভীরতা পরিমাপ করা আমার মতো এতো ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। সে চেষ্টা করাটাও আমার জন্যে নির্বুদ্ধিতার নামান্তরই। শুধু উপলব্ধি করার অনুভূতিটা রয়েছে, এবং তা প্রকাশের ভাষা এ মুহূর্তে আমার আয়ত্তের বাইরে। অন্য কোন প্রেক্ষিতে তাঁর সুবিশাল কাজ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনার ইচ্ছা রইলো। আজ বরং এই নোবেল ব্যক্তিত্বের সাথে গুটিকয় স্মৃতিচিহ্নের সচিত্র নমূনা দানের জন্য অমায়িক আলোকচিত্রি জনার নূরজাহান চাকলাদারের কাছে আমার সবিশেষ কৃতজ্ঞতাটুকু জানিয়ে রাখি। পাঠক আপনাকেও ধন্যবাদ এতোক্ষণ সাথে থাকার জন্য। #
/ রণদীপম বসু, ঢাকা, বাংলাদেশ /
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
রণদীপম বসু, আপনার ব্লগটিও চমৎকার। আপনি কি গ্রামীন এর কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মধীন?
waheedrummon.blogspot.com
ধন্যবাদ ওয়াহিদ রুম্মন,
অব্যর্থ প্রশ্ন। কোন ভাবে তো জড়ানো আছিই।
Ranadipam Basu
horoppa.blogspot.com
Post a Comment