Tuesday, May 6, 2008

# আত্মপরিচয়



আত্মপরিচয়
-রণদীপম বসু


বাচ্চাকে নিয়ে যখন শিশু হাসপাতালের গেটে পৌঁছলাম ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে সে। রিক্সায় সারাটা রাস্তায়ও বমি করতে করতে এসেছে। মাঝরাত থেকে ডায়রিয়া ও বমির যুগপৎ দৌরাত্ব্যে পেটে আর শরীরে সম্ভবত বমি হওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না, পানিও না। শেষ পর্যন্ত যা বেরিয়েছে, শরীরের কষ।

আর কখনো এই হাসপাতালে আসিনি। অফিসে আসতে যেতে এর সামনে দিয়েই গেছি বহুবার। ভেতরে ঢোকার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই হয়নি। রিক্সা থেকে নেমে বাচ্চাকে পাঁজাকোলা করে ভেতরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। অগুনতি শিশুরোগির সাথে উৎকণ্ঠিত অভিভাবকের এতো ভীড় ! কোথায় কীভাবে কী করবো বুঝে ওঠতে পারছিলাম না। বসবো কোথায়, তিল ঠাঁই নেই ! আবার উদ্গার শুরু হলো। বাচ্চার আতঙ্কিত মা ধাক্কা দিয়ে তাড়া দিতেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। কী করি এখন ? জরুরি বিভাগ খুঁজছি। দায়িত্বরত গার্ডকে জিজ্ঞেস করে ফাঁপড়ে। এখানে সবাই জরুরি।এতোসব জরুরির সিরিয়ালে পড়ে শেষপর্যন্ত বাচ্চাকে আদৌ চিকিৎসা করাতে কিংবা সে সুযোগ হয়ে ওঠবে কি না ভাবতেই অস্থিরতা গিলে ফেললো আমাকে। মাথার তালু থেকে শিরশির করে একটা ঠাণ্ডা স্রোত মেরুদণ্ড হিম করে নেমে যাচ্ছে নীচে। সন্তানের নিথর দেহ ধরে আছে অথর্ব পিতা, পাশে অসহায় আকুল জননী- এ বাক্যের উপলব্ধি যে যেভাবেই করুক অন্তত কাউকে যেন এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মারিয়ে যেতে না হয়। আমার তখন হুশজ্ঞান নেই।

খবর পেয়ে অফিসের কলিগ ও ঘনিষ্ট বন্ধু দাস প্রভাস যেন ত্রাতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। করিৎকর্মা এই বন্ধুটির বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর মানবিক বোধকে আবারো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। কোথা থেকে কীভাবে কী করলেন জানি না, প্রয়োজনীয় ফি-টাই আমি জায়গামতো দিলাম শুধু। ডাক্তার দেখানো এবং কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ মোতাবেক বাকি ফর্মালিটিজ সেরে এক নম্বর কেবিনের দশ নম্বর বেডে বাচ্চাকে শুইয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত এ যাত্রায় হয়তো রক্ষা পাওয়া গেলো। স্যালাইন ঔষধ ইঞ্জেকশানের অনিবার্য ধাপ পেরিয়ে তার শরীরে প্রাণের স্পন্দন যখন নিরাপদ হয়ে ওঠলো, এতোক্ষণে ফিরে এলো আমার চিন্তার স্বাভাবিক সুস্থতাও। এবং তাৎক্ষণিক মনে এলো, হায়, আমরা কতো স্বার্থপর ! শৃংখলা অটুট রাখার জন্য আইনের শাসনে বিগলিত আমরা নিয়মের পক্ষে কতো না সাফাই গাই প্রতিনিয়ত- লাইন ধরো, ধৈর্য্য ধরো ইত্যাদি কতো কিছু। কিন্তু বিপদ যখন নিজের ঘাড়েই পড়ে, অধৈর্য্য আমরাই সবার আগে সেটা ভাঙতে যাই। কেননা ওটা যে ‘আমার’ই বিপদ ! আমার নিজেকে দিয়েই এর পুনঃপাঠ হলো।

শরীরের নিঃশেষিত শক্তি কিছুটা ফিরে আসতে বাচ্চা হুট করে ওঠে বসেই- ‘আমার পরীক্ষা ?’ দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ; যান্ত্রিক প্রতিযোগিতার নাগরিক বোধ তার শিশু-মস্তিষ্কেও পেশাদার স্কুল কর্তৃপক্ষ এভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, ইতোমধ্যেই সে জেনে গেছে প্রাণের হিসাব পরে, আগে শরীরটাকে টেনে হিচড়ে পরীক্ষার টেবিলে পৌঁছাতেই হবে। নইলে এমন নামি-দামি স্কুলে ভর্তি হবার জন্যে একটা শূন্য-সিটের খোঁজে আগ্রহী প্রার্থির কোন অভাব নেই। চলমান পরীক্ষার তৃতীয়টা পরের দিন সকাল সাতটায়। সন্ধ্যা সাতটায়ও যার বমনোদ্গার তিরোহিত হয় নি, দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টা তখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে, সেই শিশু কিনা...! তাকে আশ্বস্ত করা হলো। রাতের বেলা শিশু হাসপাতালে পুরুষের অবস্থান করার কোন বিধান নেই। মা সহ রোগি হাসপাতালে, আর আমি মাঝরাতে বাসায় ফিরে সেই তীব্র উৎকণ্ঠা- বাচ্চার মা বারবার বলে দিয়েছে সকাল সাতটার মধ্যে বাচ্চাকে স্কুলের পরীক্ষায় এটেণ্ড করাতে হবে !

এতো সকালে কই ডাক্তার কোথায় কী ! অবশেষে দায়িত্বরত যাকে পেলাম, রোগিকে সাময়িক ছাড়পত্র দেয়ার ঝুঁকি তিনি নেবেন কেন ? বাচ্চার উৎকণ্ঠিত শিশুমুখ আর স্নেহময়ী মায়ের অসহায় মুখকে ব্যঙ্গ করে ঘড়ির কাঁটা দৌঁড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে। ‘দিন কাগজ।’ স্বেচ্ছায় নিজ দায়িত্বে রোগির নাম কাটিয়ে সাথে করে নিয়ে আসা স্কুল-ড্রেস পরিয়ে বাচ্চা নিয়ে আমাদের দু’দিনের নির্ঘুম বিপর্যস্ত শরীর দুটো সহ পারলে উড়ে যাই স্কুলের দিকে।

এখানেই হয়তো লেখাটা শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু খসড়াটুকু বাচ্চাকে দেখানের পরেই ওল্টে গেলো হিসাব। যেখানে আমি শেষ বলে ধরে নিলাম, মনে হলো আসলে ওটাই শুরু। এর শেষটুকু চলে গেলো তার হাতে। অর্থাৎ আমাদের বাচ্চাদের হাতে। কারণ শিশুরাই আমাদের আয়না। আমরা বয়ষ্করা যেখানে সংসারের অসংখ্য হিসাব নিকাশের সমীকরণ মিলিয়ে রাজা-হুজুরদের তোয়াজে নিজেদেরকে শর্তহীন অবমাননায় উৎসর্গ করে ফেলি, সেখানে নিরুদ্বিগ্ন শিশুই তো সেই মহাসত্যটি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারে- আরে, রাজা তো নেংটা !

লেখাটা পড়াতেই বাচ্চার তীব্র অনুভূতি ধাক্কা দিল আমাকে-‘এতো বাচ্চা বাচ্চা করছো কেন ? আমার কি কোন নাম নেই ?’ থ হয়ে গেলাম কথার তীক্ষ্ণ ধারে। কেন জানি মুহূর্তেই সমান্তরাল সেই বিষয়টাও মাথায় এসে ঘা দিলো। চা-দোকানে ঢুকেই আমরা যে চেচিয়ে ওঠি- এই পিচ্চি এদিকে আয় বলে, আমরা তো সচেতনভাবে কখনো খেয়াল করে দেখি না ওই পিচ্চি ছেলেটার বন্দি আত্মার মধ্যে তার আত্মপরিচয়ের নীরব হাহাকার ! অথচ আমরাই আমাদের নিজস্ব কাজ বা অর্পিত দায়িত্বগুলোকে স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট করে তোলার জন্য কতোভাবেই না সচেষ্ট হয়ে ওঠি ! এটা অমুকের কাজ, এই কথাটা শুনে যাতে অহঙ্কারী হয়ে ওঠতে পারি।

তারপরেও জাগতিক চাওয়া পাওয়ার ভীড়ে আমরা বয়স্করা যখন আত্মপরিচয়ের মৌলিক সংকটে ভুগে কষ্ট পাই, সেখানে শিশুরা কতো নির্দ্বিধ, প্রত্যক্ষ এবং স্পষ্ট !

আহা, আমরা কি কখনো শিশু হতে পারবো ?

(০৫/০৫/২০০৮)
[sachalayatan]

No comments: