‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Thursday, May 29, 2008
# ছোট কাগজ ‘অন্ত্যমিল’- একটি আলোচনা, একটি পর্যালোচনা
ছোট কাগজ ‘অন্ত্যমিল’- একটি আলোচনা, একটি পর্যালোচনা
-রণদীপম বসু
চশমা নিয়ে একটা পুরনো গল্প মনে হয়ে গেলো। খুঁজে পাওয়া একটি হারানো চশমার মালিকানা দাবি করে বসলেন দুজন। যথানিয়মে কাজীর বিচার বসলো। এক নজর দেখার পরও প্রথমজন দাবিকৃত চশমার বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করবেন কী, রংটাই বলতে পারলেন না। কিন্তু দ্বিতীয়জন চশমাটা দেখতে কেমন, হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেলেন। যিনি চশমার রংটাই জানেন না তিনি মালিকানা দাবি করেন কী করে ? কাজীর ধমকে প্রথম ব্যক্তি কাচুমাচু হয়ে বললেন- ‘হুজুর, বেয়াদবি নেবেন না, আমি যে চশমা ছাড়া চোখেই দেখি না, আর চশমা পরলে সবই দেখি কিন্তু চশমা দেখি না।’ সম্প্রতি বগুড়া থেকে প্রকাশিত রহমান তাওহীদ সম্পাদিত ছোট কাগজ ‘অন্ত্যমিল’ কিশোরকবিতা সংখ্যার ওপর একটি অদ্ভুত কিসিমের আলোচনা পড়ে উপরোক্ত গল্পাংশটি মনে হলো। চোখের অবস্থা শোচনীয় হলে এবং সময়কালে হাতের কাছে পুরু চশমাটি খুঁজে পাওয়া না গেলে এমনটাই হয়। শিব গড়তে বাঁদর হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর বিনোদন পাতা ‘আনন্দন’-এ ‘ছোটকাগজ ‘অন্ত্যমিল’ শিরোনামে কথিত প্রাবন্ধিক সঞ্জিত বণিকের আলোচনাটি পড়ে নির্মোহ পাঠকের মনে যদি এমন অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হয় তাতে কি পাঠককে দোষ দেয়া যাবে ? আলোচনার শুরুর দিকেই বিজ্ঞ আলোচক যখন লিখেন- ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনজন কিশোর কবিতার কবির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদিত্য রুপু। তাঁরা হলেন: কবি আখতার হুসেন, কবি সুজন বড়ুয়া ও কবি রাশেদ রউফ’ তখন খটকা লাগে, তিনি কি আদৌ পড়ে দেখেছেন ‘অন্ত্যমিল’ নামের এই ছোটকাগজটি ? একটু পরেই আবার বলছেন- ‘কিন্তু ঐ তিন ব্যক্তিত্বের সাথে চতুর্থ ব্যক্তিটি কোন্ বিবেচনায় যুক্ত হলেন আমার বোধগম্য নয়।’ সাথে সাথে পাঠক হিসেবে আমাদেরও বোধগম্য হয় না যে তিনি আসলে কী বুঝাতে চাচ্ছেন। কেননা ‘অন্ত্যমিল’-এর সাক্ষাৎকার পর্বে পূর্বোক্ত তিনজন কবির সাথে কবি জুলফিকার শাহাদাৎ সহ চারজনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। অতএব, আমাদের ধরেই নিতে হয় যে, চশমাহারা প্রাবন্ধিক-আলোচক দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির মাধ্যমে আলোচ্য ছোট কাগজটি শব্দ করে পড়িয়ে তিনি কেবল শ্রবণ করেছেন। তবে যিনি পড়ে শুনিয়েছেন তিনি আবার কোন অদৃশ্য কারণে আমাদের সেই গ্রাম বাংলার সনাতন বৌ-ঝি-দের মুখে ভাসুরের নাম না নেয়ার মতোই জুলফিকার শাহাদাৎ-এর নামটা নিশ্চয় মুখে নিতে ভয় পান। আর তাই হয়তো তিনজন ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দের সাথে চতুর্থ ‘ব্যক্তি’ নামক শব্দের অতিসচেতন ব্যবহারের মাধ্যমে তুচ্ছার্থক বৈষম্য তৈরি করে নিজের হীনমন্যতাবোধের নেতিবাচক প্রকাশ ঘটিয়ে দুর্গন্ধই ছড়িয়েছেন শুধু, মনে হয় না যে জুলফিকার শাহাদাৎ এতে একটুও খাটো হয়েছেন পাঠকের চোখে। আলোচনার ঢং দেখে তাই মনে হচ্ছে একজন নির্মোহ পাঠক বা প্রাবন্ধিক আলোচকের প্রজ্ঞায় কি এমন উদ্ভটতা মানায় ! আর যাঁদেরকে তিনি তৈলাক্ত মর্দনে খুব বড় করতে চেয়েছেন, তাঁরা যদি প্রকৃতই কবিসত্ত্বা ধারণ করে থাকেন আমার সাথে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, তাঁদেরকেই আসলে বালখিল্যভাবে ছোট করা হয়েছে।
আলোচনাটাতে ‘পাণ্ডিত্য’ শব্দটার আনুষঙ্গিক ব্যবহার দেখে পাঠক প্রথমে কৌতুকবোধ করবেন, তারপরে হাসবেন। অন্ত্যমিলে গোটা সাক্ষাৎকারটি পড়লে সাধারণ একজন পাঠকের কাছেও এটা বুঝতে বাকি থাকবে না যে, এই আলোচনাটিতে বিজ্ঞ আলোচকই ‘পাণ্ডিত্য’ শব্দটির কীভাবে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। জুলফিকার শাহাদাৎ নামে কিশোর কবিতা জগতের একজন জনপ্রিয় ও ভিন্নস্বরের কবিকে উদ্দেশ্যমূলক হেয় করার সম্ভাব্য সকল হীনপ্রচেষ্টাই করা হয়েছে এ আলোচনায়। এখানেই প্রশ্ন আসে উক্ত আলোচক কি আদৌ কবিতা বোঝেন ? না কি সম্পাদক তোষণে (প্রকাশিত আলোচনার সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় পাতাটির সম্পাদকও জনাব রাশেদ রউফ) সুবিধাপ্রার্থী ? যদি কবিতা বোঝেনই, তবে কি জবাব দেবেন- আলোচ্য ‘অন্ত্যমিল’ নামের ছোট কাগজটিতে রাশেদ রউফের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের যে রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে তা কি কবিতা পদবাচ্যের মধ্যে পড়ে ? যেমন তেমন কতকগুলো শব্দের হাস্যকর ব্যবহার আর জোর করে অন্ত্যমিল বসিয়ে আবেগহীন মালগাড়ি চালিয়ে দিলেই কি কিশোর কবিতা হয়ে যায় ? উপরোক্ত নমূনা বিশ্লেষণ করেই রাশেদ রউফের চাররঙা ‘নির্বাচিত কিশোর কবিতা’র (?) সমৃদ্ধ বইটিতে কী থাকতে পারে তা এখান থেকেই পাঠকের ধারণা করতে কষ্ট হবে কি ? আর এই ছোট কাগজেই জুলফিকার শাহাদাৎ-এর গুচ্ছ কিশোর কবিতাগুলো পড়লে পাঠকের উপলব্ধিজাত তুলনামূলক ধারণাও তৈরি হয়ে যাবে আশা করি। অশ্লীল গীবৎ গেয়ে আর পাঠককে রুদ্ধ করা যাবে কি ? অন্ত্যমিলে বেশ কয়েকজন কবির আরো অনেকগুলো চমৎকার কিশোর কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। ওগুলো পড়ে ফেললে পাঠক অন্তত এটাও টের পাবেন যে পাণ্ডিত্য দিয়ে কবিতাকে পণ্ড করা যায়, তাতে কবিতা হয় না। কবিতা রচনায় চাই যথাযথ কবিত্ববোধ।
সাথে সাথে এ কথাটিও আলোচকের মনে রাখা সঙ্গত ছিলো যে, খ্যাতি বা অখ্যাতি গোটা বিষয়টাই খুবই আপেক্ষিক। আজ যিনি নিজকে খুব খ্যাতিমান মনে করে বগল বাজাচ্ছেন, কাল তিনিই হয়তো পাঠকের বিচারে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন। আবার নতুন কোন নায়কের উদ্ভাসনও ঘটতে পারে। কে আসবে, কে যাবে, কে থাকবে তা সময়ই নির্ধারণ করে দেবে। বড় ছোট ভেদ নির্বিশেষে এক পঙক্তিতে ভোজনে বসলে যদি অহংসর্বস্ব উচ্চবর্ণিদের জাত চলে যায়, তবে ওই ‘জাত’ খুবই ঠুনকো, এমনিতেই চলে যাবে তা, ধরে বেঁধেও রাখা যাবে না। আলোচক একজন প্রাজ্ঞ প্রাবন্ধিক (!) হয়ে খোলাসা করে যখন বলেন- ‘খ্যাতিমান ঐ তিন ব্যক্তিত্বের সাথে নিজের নামটিও জুড়ে দিয়ে ‘খ্যাতিমান’ হবার দুঃস্বপ্ন বুকে ধারণ করে তিনি নিজেই সম্ভবত এ সাক্ষাৎকার পর্বটি সাজিয়েছেন’, তখন পাঠক হিসেবে আমাদের খুব দুঃখ হয় এই ভেবে যে, লিটল ম্যাগ বা ছোট কাগজ কাকে বলে, এর চরিত্র কী, ‘অন্ত্যমিল’ কেন ছোট কাগজ এসবে না গিয়ে তিনি ধান ভানতে শিবের গীত জুড়ে দিয়ে পাঠকের বিরক্তিই সৃষ্টি করেছেন।
এস্টাব্লিশম্যাণ্ট নামের হাতির বিশাল বর্জ্যের তলে যেসব চিত্রল হরিণীরা চাপা পড়ে হারিয়ে যায় ছোট কাগজ তাদেরকে তুলে আনে, শিল্পের নন্দনকাননে ছেড়ে দেয় অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা দিয়ে। সৌন্দর্য পিয়াসী পাঠকমন সেখান থেকেই খুঁজে নেয় রূপ রস ঘ্রাণের অনির্বচনীয় তৃপ্তি। এখানেই ছোট কাগজের বিশিষ্টতা, সাফল্য এবং চারিত্রিক ঔদার্যও। এস্টাব্লিশম্যাণ্ট যেখানে প্রভাবশালী খ্যাতিমানদের (?) নিয়ে নগ্ন বাণিজ্য-বন্দনায় রত, সেখানে কেবল সাহসী ছোট কাগজই পারে পাঠকের নির্মোহ ব্যবচ্ছেদের টেবিলে সবাইকে এক কাতারে পরিবেশন করতে, দাঁড় করাতে। পাঠকই বিচার করবেন কোনটা কলাগাছ আর কোনটা অমৃতান্ন ; কোনটা নেবেন কোনটা ফেলে দেবেন। এখানেই রহমান তাওহীদ ও তাঁর সহকর্মীদের কৃতিত্ব যে তিনি ‘অন্ত্যমিল’ নামের এই চমৎকার দৃষ্টিনন্দন ও গুনগতমান সম্পন্ন ছোট কাগজটি দিয়ে তা করতে চেয়েছেন এবং অনেকাংশে পেরেছেনও।
তবে এই আক্রার বাজারে পাঠকের হাতবাঁধা ইচ্ছের কাছে যখন ‘হৃষ্টপুষ্ট’ ‘চাররঙা’ ইত্যকার বিশাল বিশাল সমগ্রগুলোর অহঙ্কার অনতিক্রম্য দূরত্বে থেকে দুঃস্বপ্নের মতো দাঁত কেলাতে থাকে, অন্ত্যমিল হয়তো পারতো আলোচকের প্রজ্ঞা অনুযায়ী প্রথমোক্ত ওই ‘যথাযথ প্রাজ্ঞ এবং উপযুক্ত তিন শিশু সাহিত্যিকের’ কিছু গুচ্ছ রচনা একই সাথে উপস্থাপন করতে। এতে করে আমরা পাঠকরা তাঁদের পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি একপাত্রেই কাব্যঝঙ্কারটাও যাচাই করে নিতে পারতাম। তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনটাও হয়ে যেতো, কিশোর কবিতার আধুনিকতায় আলোচিত কবি আহসান হাবীব-কে আদৌ কেউ অতিক্রম করতে পারলেন কি না।
বগুড়ার রহমান তাওহীদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি অনেক বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক, আলোচক ও কবিতা-পদ্যকারে রচনাসমৃদ্ধ আটফর্মার কষ্টসাধ্য ও সাহসী ছোট কাগজ ‘অন্ত্যমিল’-এর একটা ঢিল দিয়ে কিশোর কবিতা ভুবনের বর্তমান নিস্তরঙ্গ দিঘিটাতে সপ্রাণ ঢেউ তুলে দেয়ার জন্য। আর ব্ক্ষ্যমান পর্যালোচনাসূত্রে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সংস্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদকও ধন্যবাদ প্রাপ্য। কেননা সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা ‘আনন্দন’ বিভাগের ব্যতিক্রমী প্রয়াস হিসেবে শিশু কিশোর সাহিত্য সংশ্লিষ্ট একটি আলোচনাকে স্থান দেয়ার ঔদার্য্য দেখিয়ে তিনি আমাদেরকে যথাসাধ্য বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
(০১/১০/২০০৭)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment