Thursday, May 29, 2008

# আক্কাছের মোবাইল (গালগল্প)



আক্কাছের মোবাইল (গালগল্প)

-রণদীপম বসু


ফুটপাথ ধরে হাঁটলে এরকম ছোটখাটো জটলা সামনে পড়বেই। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে একটা পরিচিত স্বরের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনেই থমকে দাঁড়ালাম। দুকদম পেছনে এসে উঁকি দিতেই দেখি আমাদের আক্কাছ সাহেব ! নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কেউ কিছু বলেছে ! আপাদমস্তক সৎ ও প্রতিবাদী আক্কাছ তো কাউকেও কেয়ার করার লোক নন। কিন্তু এবারে ভিকটিম ব্যক্তিটিকে তো নিরীহ গোবেচারা বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলছেন- ‘দেখুন, আপনাকে তো আমি খারাপ কিছু বলিনি ! বলেছি যে আপনি একজন নীতিবান সৎ লোক। অফিসেও আপনি আপনার সাধ্যের মধ্যে অবৈধ কিছুকেই প্রশ্রয় দেন না।’

হাঁ, ভদ্রলোক যে অসত্য কিছু বলছেন না, তা তো আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু আক্কাছ সাহেব ক্ষেপে গেলেন কেন ?

‘আপনি কি জানেন, আপনাকে আমি পুলিশে সোপর্দ করতে পারি ?’ আক্কাছ সাহেবের জলদগম্ভীর হুমকী !
নিরীহ ভদ্রলোক যেন থতমত খেয়ে গেলেন- ‘আপনি এভাবে বলছেন কেন ! আমার অপরাধ ?’
আপনি রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলেছেন।
মানে !!
আপনি আমাকে এতো এতো লোকের সামনে সৎ বললেন কেন ?

ভদ্রলোকের কী অবস্থা জানি না। আক্কাছের এমন প্রশ্ন শুনে আমার নিজেরই তো মাথা ঘুলিয়ে যাবার অবস্থা ! জবারের অপেক্ষা না করেই আক্কাছ তাঁর তুফান মেইল ছুটিয়ে দিয়েছেন-
‘আপনি কি জানেন, কালো টাকা সাদা করতে সরকারকে কত পার্সেণ্ট ট্যাক্স দিতে হয় ? জানেন না ? সাড়ে সাত। এর অর্থ কী জানেন ? আপনি এই পাবলিকদের প্যাঁদিয়ে প্রতারণা করে হাইজ্যাক করে ডাকাতি করে একশ টাকা অবৈধ আয় করে সরকারকে সাড়ে সাত টাকা দিয়ে দিলেই খালাশ ! বাকি সাড়ে বিরানব্বই টাকা আপনার। ওইসব অবৈধ আয় দিয়ে আপনি ইণ্ডাস্ট্রি করবেন ? টাকার উৎস জিজ্ঞেস করা হবে না ! উল্টো ঋণ দেয়া হবে আপনাকে ! ট্রুথ কমিশন বুঝেন ? আপনার অবৈধ আয়ের পাহাড় হজম করতে পারছেন না ? ব্যবহার করতে পারছেন না ? স্বীকার করে ফেলুন, কোন সাজা হবে না ; জামাই আদর পাবেন !’

হঠাৎ তাঁর কণ্ঠ উচ্চগ্রামে চড়তে লাগলো। ‘আর এই আমি ? বেতন এক টাকাও বাড়ে নাই। আজকে খেতে না পেয়ে দশটা টাকা চুরি করি ? প্রথমে রামধোলাই, পরে চৌদ্দশিকা !’ কথার ঢেউয়ের মধ্যেই হঠাৎ গর্জে ওঠলেন আক্কাছ ! ‘রাষ্ট্র যেখানে অসতের পক্ষে আইন বানাচ্ছে, আপনি আমাকে সৎ বলে রাষ্ট্রবিরোধী বানাচ্ছেন ! আমার ইচ্ছা আমি সৎ থাকবো, তাতে কার কী এসে যায় !’

বুঝতে পারছি, আক্কাছ আজ বিপজ্জনক লাইনে দৌঁড়াচ্ছেন। জটলাটাও দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। যা ভাবা তাই কাজ। ভীড় সরিয়ে সোজা আক্কাছের হাত ধরলাম গিয়ে। আরে আক্কাছ সাহেব, আপনাকেই তো খুঁজছি আমি ! চলুন চলুন জরুরি কাজ ! বলেই আর কোন কথা বাড়াবার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে ছুটলাম নিরাপদ দূরত্বে।

কোথায় নিচ্ছেন আমাকে ?
গ্রামীণের সার্ভিস সেণ্টারে, মোবাইলের রেজিস্ট্রেশান করবো।
আগে করেন নি কেন ?
ওই করা হয়ে ওঠেনি আর কি !
বোঝা গেলো, আমার জবাবে সন্তুষ্ট হন নি আক্কাছ। যাক্, তবু সাথেই রইলেন। গ্রামীণ ফোনের সুদৃশ্য সার্ভিস সেণ্টারে ঢুকে এবার একটু স্বস্তি পেলাম। কোন ভীড় নেই। যথারীতি কাজ সেরে সন্তুষ্টি নিয়েই বললাম তাঁকে- চলুন, ফাও একশ টাকার টক টাইম পেলাম যখন, কোথাও একটু চা খাই। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, মুহূর্তেই আবহাওয়ায় ফের নিম্নচাপ দেখা দিতে পারে। আক্কাছ সাহেবের শীতল প্রশ্ন ফোন সেণ্টারের দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে- যাঁরা আগেই মানে যথাসময়ে রেজিস্ট্রেশান করেছেন, তাঁদের জন্য কী অফার অর্থাৎ পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন ?
না, ওভাবে কিছু রাখা হয়নি। তবে ওই এফএনএফ, অফপিক আওয়ার ইত্যাদিতে...
ভদ্রলোকের কথা শেষ করতে না দিয়েই আক্কাছের দৃঢ় মন্তব্য- ‘তার মানে আপনারাও অসতের পক্ষে ?’

হঠাৎ কী হলো, তাঁর চোখ দুটো কেঁপে কেঁপে লাল হয়ে ওঠতে লাগলো। বাঁ হাতটা প্যাণ্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। হাতে ওঠে এলো তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গি সেই জোড়াতালি দেয়া পুরানো মডেলের মোবাইল সেটটা। যা পাল্টানোর সঙ্গতি তাঁর নেই। গটগট করে কাচের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কান খাড়া হয়ে ওঠলো আমার ! কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা হলো। দ্রুত পিছু নিলাম তাঁর। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে !

মিরপুর এক নম্বর গোলচক্করের চতুর্মুখী গাড়িঘোড়ার ঘূর্ণমান চাকার তলে ক্ষীণ প্রতিবাদের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত খণ্ডাংশগুলো দেখে কেউ কি জানবে, ওটা আক্কাছের মোবাইল !

(২৮/০৫/২০০৮)

No comments: