Tuesday, June 24, 2008

# সচল পেন্সিলে আঁকা - ০১...(সেই আংটিটা)



সেই আংটিটা
-রণদীপম বসু



‘ছাদনাতলা’ শব্দটার কূলঠিঁকুজি খুব একটা জানা নেই আমার। কৌতুহলও তেমন ছিলো না বলে ‘বেলতলায়’ যাওয়ার মতোই ‘ছাদনাতলা’-কেও ব্যঞ্জনাময় প্রতীকী ও রসাত্মক শব্দ হিসেবে ইতিবাচক সম্মতি নিয়েই দেখেছি। কিন্তু বেলতলার মতো ওখানেও যাওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগত আতঙ্কটা আর কাটাতে পারলাম কই ! সহপাঠি বন্ধুদের সৃষ্ট প্রজন্ম যখন স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে বসেছে, তখন যে কোন্ আত্মদর্শনে আদিষ্ট হয়ে এমন এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলাম, প্রবল চিন্তাস্রোত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম- এ কী করেছি ! আমিও খোঁয়াড়ের হয়ে গেলাম !

অফিসের সহকর্মীদের অর্থপূর্ণ দৃষ্টি চালাচালিকে কৌতুকপূর্ণ মনে হলেও অবজ্ঞা করার কোন উপায় ছিলো না। কথা নেই বার্তা নেই আকস্মিক বিয়ে করে ফেলা বাঙালী যুবকের গলায় এট লিস্ট একটা স্বর্ণের চেইন আর হাতে অন্তত একটা আংটি থাকবে না ! এটা কী করে হয় ! রহস্য না থেকেই যায় না। এতে যে কোন রহস্য নেই, এক্কেবারে সোজা সাপ্টা একটা ব্যাপার, সম্ভবত কেউ এটা বিশ্বাস করে নি। একজন উত্তীর্ণ যুবক যৌতুক তো দূরের কথা, শাস্ত্রীয় বাধ্যবাধকতাকেও কচু দেখিয়ে উর্বর মঙ্গলের প্রতীক গোল করা বেডিংটাও সঙ্গে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে, এটাকে গুলমারা ভাবলেও ভাবতে পারে কেউ। কিন্তু আমি নিশ্চিৎ, হাতে আংটি না থাকার কারণ হিসেবে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞার পেছনে যে তুচ্ছ ঘটনার বয়ান করলাম সে বিবেচনায় আমি তাদের কাছে একটা বেয়াকুব হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছি। সম্ভবত বেয়াকুবি আর আত্ম-অহমিকার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই।

উনিশ’শ বিরাশি কি তিরাশি সালের ঘটনা এটা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র আমি। সিলেট এম সি কলেজ হিসেবে আদিনামে যাকে এখন চিনি আমরা, ওটাই কেন জানি কোন্ সরকারি ম্যাজিকে সিলেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নামে পরিচিত ছিলো এবং কাগজপত্রেও তাই লেখা হতো। আমাদের অনার্সের সার্টিফিকেটেও এই অযৌক্তিক নামটাই আছে। আর ভিন্নভাবে আলাদা কম্পাউণ্ড নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইণ্টারমিডিয়েট কলেজটাকে সরকারিভাবে বলা ও লিখা হতো এম সি কলেজ নামে, যা এখন সিলেট সরকারি কলেজ। যাক্, কেমিস্ট্রির ছাত্রদের পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে শিক্ষা সফরের নামে বিভিন্ন ইণ্ড্রাস্টিয়াল ট্যুরে যেতে হতো আমাদের।

সেবারের সফর সূচিতে ছিলো সুদূর শিল্পনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। স্টিল মিলস, টিএসপি, ইউরিয়া, বেভারেজ, সিরামিক, পেপার, রেয়ন, ফার্মাটিউক্যালস, রিফাইনারী ইত্যাদি। দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কলেজের বিশাল এলাকার একপ্রান্তে হোস্টেল এরিয়ার শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাঁসের বোর্ডার আমি। মোটামুটি লম্বা একটা সফরের প্রস্তুতি নিতে বাড়ি গেলাম। প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে আসবো হোস্টেলে, মা’র আঙুলে নতুন আংটিটার দিকে চোখ গেলো। বাহ, সুন্দর তো ! মেট্রিকের পর থেকেই বাড়ির বাইরে বাইরে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খুব একটা বাড়ি যাওয়া হতো না বলে নিজ গৃহে পরবাসী ভাবটা থিতু হতে শুরু করেছে তখন। উপর উপর দেখার কারণেই হয়তো বাড়িঘরের অনেক অনিবার্য পরিবর্তনগুলোও চোখ এড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। মা’র আংটিটাও আগে দেখেছি বলে মনে হয় নি। এটা কোন উল্লেখযোগ্য বিষয়ও নয়। আর আমিও তখন আংটি ব্যবহার করি না। তবু আংটিটার কোথায় যেন একটা বিশেষত্ব ছিলো। দেখি দেখি বলে অচেনা কৌতুহলে মা’র আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকি। বিশেষত্ব কী এটা ধরার চেষ্টা করছি। মা তার সংসারের আটপৌরে ব্যস্ততায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমিও আংটিটা হাতে নিয়ে কৌতুহল মেটাতেই ব্যস্ত। এবং মুগ্ধও। মেয়েলি হাতের ছোট্ট আংটি, আমার অনামিকা গলে ঢোকার মতো বড় নয়, আবার কড়ে আঙুলের জন্যেও ততোটা ছোট নয়। এক সময় মাকে দিতে যাবো, কিন্তু তাঁর ব্যস্ততা আর কাছাকাছি না থাকায় পরে দেবো ভেবে কড়ে আঙুলেই পরে রাখলাম। কিন্তু ফেরার সময় বেমালুম ভুলে গেলাম। মা-ও কি ভুলে গিয়েছিলেন ? না কি মাতৃত্বের অপার স্নেহে ওটা ফেরৎ চাইলেন না, কে জানে। চলন্ত গাড়িতে বসে খেয়াল হতেই ধক্ করে ওঠলো বুকটা। তখন তো আর সেলুলারের যুগ নয় যে ভুলের জন্য মা’র কাছে দুঃখ প্রকাশ করে নেবো। যাক্, পরেরবার বাড়িতে এসেই দিয়ে যাবো না হয়।

চিটাগাং এসে শিক্ষা সফরের বিচিত্র পাঠ আর অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চিত করতে টাইট প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হলো আমাদের। কেননা ওখান থেকে একটাদিন সময় বাঁচাতে হবে। এতো কাছে এসে কক্সবাজার ঘুরে যাবো না এটা তো হয় না। অবশেষে কক্সবাজার সৈকতে এসে সব কষ্ট ভুলে গেলাম। আমার মতো বেশিরভাগেরই জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শন, একেবারে ছুঁয়ে দেখার নৈকট্যে এসে। পঁচিশ বছর আগের সী বীচ ও আশপাশটা এখনকার মতো এতোটা সরগরম হয়ে ওঠেনি। এতো সুযোগ সুবিধা বা আবাসিক ব্যবস্থাও তখন ছিলো না। তিন-চারটা মোটেল যেমন সায়মন, শৈবাল, উপল, প্রবাল আর কি যেন নাম ছিলো। অথচ বীচের নিকটবর্তী ভুলে যাওয়া নামের ঐ মোটেলটাই ছিলো আমাদের মতো ছন্নছাড়াদের থাকার জন্য সুলভ ব্যবস্থা। বড়োসড়ো লম্বা একটা রুমে হাসপাতালের ওয়ার্ডের মতো গণশয্যার সুলভ বন্দোবস্তে আমাদের ঠাঁই হলো। গাইড কাম অভিভাবক হিসেবে আসা আমাদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. আজিজুর রহমান এবং রীতিমতো সন্ত্রস্ত করে রাখা অত্যন্ত কড়া মেজাজী অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা স্যারের বজ্র-নিয়ন্ত্রণে এই প্রথম একটু ঢিল পেতেই হুড়মুড় করে সৈকতের দিকে যে যার মতো ছুট দিলাম। চিৎকার করে সবাইকে মেঘনাদ স্যার আরো কী যেন বললেন বা সতর্ক করে দিলেন সে দিকে আর খেয়াল নেই।

সমুদ্রের কাছে এলে মানুষ কি শিশু হয়ে যায় ? প্রথম সমুদ্রের বুকে আমি এবং আমরা শিশুর উচ্ছ্বাসে জল খেলায় অস্থির হয়ে ওঠলাম। ছুটে আসা বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সাথে আকাশের দিকে ওঠে যাওয়া আবার আচমকা নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পায়ের নীচের বালি সরে ধপাস করে পড়ে গিয়ে ফিরে যাওয়া ঢেউয়ের সাথে তীর থেকে দূরে চলে যাওয়া। এ রকম অসতর্ক উল্লাসে কখন যে অনেক দূরে চলে গেলাম, বলতে পারি না। সচেতন হলাম যখন, দেখি দূরে সৈকতে দাঁড়িয়ে নিত্যসঙ্গি ছাতাটাকে শাসানোর ভঙ্গিতে উচিয়ে চিৎকার করে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন কেমিস্ট্রির বাঘ নামে খ্যাত আমাদের মেঘনাদ স্যার। ভাটা শুরু হয় হয়। পড়িমরি সাঁতরে তীরে এলাম। তখন অলরেডি স্যারের তুফান চলছে একেকজনের উপর। অপরাধীর মতো সয়ে যাচ্ছিলাম মাথা নীচু করে। তখনই খেয়াল করলাম, বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে মায়ের সেই আংটিটা নেই !

স্যারের বকাঝকা চুলোয় গেছে তখন। একটা অস্থিরতা পেয়ে বসলো। হয়তো বা চোখে মুখে অবয়বে প্রকট হয়ে ওঠা এই অস্থিরতা কারো চোখ এড়ায় নি, স্যারের প্রশ্ন- ‘এই, কী হয়েছে তোর ?’ খুলে বলতেই ততোধিক বিরক্তি আর ঝাঁঝ নিয়ে ‘বেশ হয়েছে ! খুব ভালো করেছো ! যত্তোসব অপদার্থ।’ বলেই গটগট করে ফিরে চললেন। মার প্রিয় আংটি। একে তো আঙুলে লুজ ছিলো। সাগরের লোনা পানিতে পিচ্ছিল করে দেয়া চামড়া সেটাকে আর ধরে রাখতে পারে নি। এখন এই সাগরের কোথায় খুঁজবো ! অবসন্ন মনে অপরাধীর মতো মোটেলে ফিরে এলাম।

শাওয়ার সেরে সবাই যে যার মতো হুল্লোড়ে মেতে ওঠেছে। আমার ভাল্লাগছিলো না কিছুই। আমি তো চেয়ে আনি নি। বা মা তো আমাকে এক্কেবারে দিয়ে দেন নি আংটিটা। অন্য রকম একটা আংটি। এর দামদস্তুর সম্পর্কেও স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। কী এক বিশেষত্ব ছিলো যেনো আংটিটাতে। স্যারের কথাটাকে মনের মধ্যে নেড়েচেড়ে হালকা হতে চাইলাম-‘ আংটি গেছে যাক্। তুমি তো রয়ে যাওনি !’ কিন্তু কিছুতেই অপরাধবোধ মন থেকে নামাতে পারছি না।

ভরা পূর্ণিমায় সাগর দেখতে মধ্যরাতে দল বেঁধে সবাই বীচে গেলো আবার। কেউ কেউ অতিরিক্ত ক্লান্তিতে পূর্ণিমার চেয়ে শয্যাই উত্তম বিবেচনা করে রয়ে গেলেও বিরল সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না আমি। এক অভুতপূর্ব অভিজ্ঞতা ! মহাপ্রকৃতির নিজের হাতে গড়া সুন্দরের রূপ মানুষের তৈরি অক্ষরের ভাষা দিয়ে প্রকাশ আমার আয়ত্তের বাইরে। সৌন্দর্য্যের গভীরতায় মানুষ কি অব্যক্ত কোন বিষাদে আক্রান্ত হয় ! কাছেই পাহাড়ের চূড়া থেকে বাতিঘরের ঝিকঝিক আলো ঘড়ির কাটার মতো ক্ষণে ক্ষণে বিষন্ন ঝলক মেরে যাচ্ছে। যে ছেলেমেয়েগুলো ক’ঘণ্টা আগেও দিনের আলোয় অসম্ভব উচ্ছল ছিলো, অদ্ভুত এক নীরবতায় এখন আবৃত সবাই ! আমি কি এই অসহ্য সুন্দরে ডুবে যাচ্ছিলাম ? হঠাৎ পেছন থেকে হাতের আলতো ছোঁয়া পেলাম কাঁধে। চমকে ওঠলাম ! পেছন ফিরেই দেখি মেঘনাদ স্যার ! ‘তুই খুব বোকা, তাই না ?’ কথা তো নয়, কষ্টের বরফ গলানো উষ্ণতা ! এ কোন্ মেঘনাদ স্যার ! পূর্ণিমার ভরা আলোয়ও ঠাহর করতে পারলাম না।

বাড়ি ফিরতেই মার প্রশ্ন, ‘কি রে, আংটি কাকে দিয়েছিস ?’ আমি থতমত খেয়ে ওঠলাম। না মা, ওটা সাগরের ঢেউয়ে কখন যে হারিয়ে...। কথা শেষ হবার আগেই মার পরের প্রশ্নে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ‘তুই কি কাউকে ভালোবাসিস ?’

তিনি জানেন, তাঁর ছেলে কখনো মা’র সাথে মিথ্যে বলে নি। অথচ আজ এ কী হলো ! সন্তানের প্রতি মা’র অবিশ্বাস মাখানো মুখ সচল পেনসিলে আঁকা অক্ষয় স্কেচ হয়ে গেঁথে গেলো আমার বুকে ! মুহূর্তেই পৃথিবীটা বদলে গেলো। মনে মনে এক ধনুর্ভঙ্গ প্রতিজ্ঞায় নিজেকে শৃঙ্খলিত করে নিলাম। যে সন্তান মায়ের বিশ্বাসের ছোট্ট একটা আংটিকেই ধরে রাখতে পারলো না, ওই আঙুলে তো আর কোন আংটিই শোভা পেতে পারে না !

সেই থেকে কখনোই আর আংটি পরি নি আমি। এখনো হু হু সমুদ্রের কাছে গেলে জলের প্রার্থণায় মগ্ন আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, এই সমুদ্রের বুকে আজো রয়ে গেছে আমার মায়ের বিশ্বাস মাখানো ছোট্ট আংটিটা !

(২৩/০৬/২০০৮)
(R_d_B)

No comments: