Thursday, July 24, 2008

# ‘সচল’ আগুনে পুড়ে, দূরাগত বাঁশি ফুঁকে কেউ...






‘সচল’ আগুনে পুড়ে, দূরাগত বাঁশি ফুঁকে কেউ...
- রণদীপম বসু


প্রতিটা মানুষেরই কদাচিৎ অসুস্থ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্যেই যে, তাতে করে সুস্থ থাকার আনন্দটা আত্মস্থ হওয়ার একটা অভাবিত সুযোগ ঘটে। কেবলই সুস্থ থাকার বৈচিত্র্যহীন অভ্যস্ততায় যারা ভোগেন, এ ক্ষেত্রে এরা দুর্ভাগা বৈ কি। সুস্থ আছেন কি না, এটাও বুঝে ওঠার উপলব্ধিটা হয়তো বা তাদের ভোঁতাই হয়ে যায়। আর ভোঁতা হওয়া উপলব্ধির লিঙ্ক ধরে আরো অনেক কিছুই যে ভোঁতা হতে শুরু করে দেয়, তা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সময় মতো বুঝে ওঠতে পারি না। আর সময় পার করে আসা আত্মোপলব্ধি শেষ পর্যন্ত কী কাজে লাগে, তাই বা কে জানে ! জায়গা জমি হারিয়ে চাষের ‘ভাইল’ বোঝার মতো হয়তো তখন কেবল আপ্তবাক্য জপা-ই সার !

ভার্চুয়াল জগতে আমার ‘অনুপ্রবেশ’ অনেক দেরিতেই। চাকুরির ধরন অনুযায়ী দীর্ঘকাল মফস্বলের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে চাকুরির সুবাদে পারসোনাল অন লাইন কম্পিউটার রাখার কোন সুযোগই ছিলো না। ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম, বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পাঠাইতাম’ এর মতোই পত্র পত্রিকায় যেটুকুই লেখালেখি করতাম, ক্রমান্বয়ে গোষ্ঠিবদ্ধ হয়ে ওঠা মিডিয়াগুলোর চেহারায় অপরিচিতির স্বরূপ স্পষ্ট হতে থাকায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। অনুকম্পার বিনিময়ে লেখক-আত্মা বিকিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় আমার যে গড়ে ওঠেনি। এ জন্যেই কি নির্বোধ আমার কখনো কোন পত্রিকা অফিস থেকে জমে থাকা প্রাপ্য লেখক সম্মানি তোলার জন্যেও ঢাকায় আসা হয়নি ? কিছু কিছু নামীদামী পত্রিকা ম্যাগাজিন তো এখন বন্ধই হয়ে গেছে। এমন আর কেউ আছেন কি না জানি না, তবে আমি যে দীর্ঘদিন যাবৎ লেখালেখি করেও সরকারি বেসরকারি পত্রিকা ম্যাগাজিন থেকে এযাবৎ কোন লেখক সম্মানি তুলতে যাই নি, এটা কি শুধুই টাকার চাওয়ার ব্যাখ্যাহীন জড়তার লজ্জা, না কি নির্বুদ্ধিতা, এখনো নির্ধারণ করে ওঠতে পারি নি। ভাগ্যিস ভার্চুয়াল জগতে এসবের টানপোড়েন নাই বলেই মনে হয়।

১৫ জুলাই ২০০৮ থেকে অনলাইন রাইটার্স কমিউনিটি ব্লগ ‘সচলায়তন’ ব্লক হয়ে গেলেও তা যে ব্লক হয়ে যাওয়া বা অন্য কোন কারণে বাংলাদেশ থেকে দেখা যাচ্ছে না বা ঢুকা যাচ্ছে না, তা বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার পিসি’র ইলেকট্রনিক বা অন লাইন সমস্যা বলেই ধরে নিয়েছিলাম। প্রকৃত বিষয়টা জানার পরেই কেন জানি প্রথমেই উপরোক্ত কথাগুলো মনে এলো আমার। আগে পরে অনিয়মিত হলেও সচলায়তন ছাড়াও সামহোয়ারইনব্লগ, আমার ব্লগ, প্যাঁচালী এবং মুক্তমনা, সাতরঙ ও বাসভূমির মতো অনলাইন ব্লগ ও পত্রিকা ফোরামগুলোতে কম বেশি লেখালেখি করার চেষ্টা করি। কিন্তু সচলায়তন ব্লক হওয়ার পর বুকের গভীরে কোথায় যেন একটা পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে লাগলাম ! তবে কি আমি অজান্তেই সচলের প্রতি অধিকতর পক্ষপাতি হয়ে ওঠছি ?

ভার্চুয়াল জগতের বাংলা পাড়ায় একটা ঝড় ওঠলো যেন। অন্য সবগুলো ব্লগ ফোরামে সচলায়তনকে নিয়ে ভীষণ তোলপাড় করা পোস্টের পর পোস্ট। ভালোয় মন্দয় মিলিয়ে এক হুলুস্থুল কারবার। কেউ সচলের পক্ষে কেউ বিপক্ষে। কেউ সচলের এই দুর্দিনে সহানুভূতির গলা বাড়িয়ে গলাগলি করতে চাইছে, কেউ আবার বুকের সমস্ত অন্ধকার খুলে চেপে রাখা গালাগালিগুলো উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। প্রতিকূল সময়ের আগুনে সচল যখন পুড়ছে, আগুন নেভানোর প্রয়াস নিতে ছুটে আসছে কেউ, কেউ বা ক্ষোভের আগুন যুক্ত করে কটাক্ষের আলু পোড়া দিচ্ছে সেই নির্দয় আগুনে ! আর কেউ কেউ নিরোর মতো বাঁশি বাজানোর কৌশল রপ্ত করছে। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে কেউ কি নিরাপদ থাকে ? অথচ কী আশ্চর্য ! জগৎটা আসলেই বড় বিচিত্র !

আগে জানতাম, একমাত্র টাকাই এমন শক্তিশালী বস্তু যে লেনদেনের মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতরটাকে এক টানে বাইরে নিয়ে আসে ! এখন দেখছি টাকার ভাইবেরাদরও রয়ে গেছে আরো ! তবে সচলের এই দুঃসহ পরিস্থিতি আমার মতো নবীন ব্লগারের জন্য যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হলেও অন্যদিকে লাভও হয়েছে বিস্তর। ‘অভিজ্ঞতা মানেই জ্ঞান’-এর দৃষ্টি দিয়ে মানুষের ভেতরের কুকুর আর দেবতার অস্তিত্ব বিষয়ক ধারণাগুলো আরেকটু পুষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই। সচলকে নিয়ে সচল হয়ে ওঠা ভার্চুয়াল কমিউনিটির এই আলোচনা সমালোচনা দেখে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রনেতা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সেই বিখ্যাত উক্তিটা যে শুধু সমকালীনই নয়, সর্বকালীনও, তা আবারো প্রমাণীত হলো- `Nobody kicks a dead dog.’.

বিচিত্র দুনিয়া, বিচিত্র দুনিয়ার মানুষ, আরো বিচিত্র মানুষের মন। ব্যান হোক বা প্রাযুক্তিক গোলযোগই হোক, ‘সচলায়তন’ যে আসলেই একটা ‘কিছু’, সমসাময়িক এই ঘটনার আগে অনেকেই আমরা তা ভালোভাবে উপলব্ধি করিনি বলেই মনে হয়। হয়তো তা সচলায়তনের জন্য শাপে বর হয়েই ধরা দেবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে ভার্চুয়াল জগত সংশ্লিষ্ট সবাই যদি এ ঘটনা থেকে বিশেষ কোন সংবেদনশীল মেসেজ আবিষ্কার করতে পারেন, বোধ করি সেটাই হবে এখনকার মতো বড় কোন পাওয়া। তবু সব কথার সার কথা একটাই, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মুক্তমনা মানুষের কথা বলার আপোষহীন অধিকার নিয়ে সচলায়তনকে ফের বাধাহীন ফিরে পেতে চাই। কথা বলার অধিকার মানষের জন্মগত, মৌলিক অধিকার।

এই দুঃসহ বেলায় সচলে ঢুকতে পারি আর না পারি, যে বোধটা ফের অর্জিত হলো, এটা মানতেই হবে যে, অভিজ্ঞতা মানেই জ্ঞান ; জ্ঞান মানেই চলমান অভিজ্ঞতা !
(২৪/০৭/২০০৮)
[Image: 'The thinker' by Auguste_Rodin]

(sachalayatan)

No comments: