Saturday, August 30, 2008

@ বেয়াদপি করিলে তকদিরে পোকায় ধরিবে...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৪)








বেয়াদপি করিলে তকদিরে পোকায় ধরিবে...
-রণদীপম বসু



[০১]
ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান। এইখানে যে বেয়াদপি করিবে তাহার তকদিরে পোকায় ধরিবে। সব্বনাশ, এ কোথায় এলাম ! ভেতরে ভেতরে রোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠতে লাগলো। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে বিশাল বোর্ডে অঙ্কিত লেখাগুলো অনুসরণ করতে লাগলাম। নিম্নলিখিত কারণগুলি চরম ও জঘন্য বেয়াদপি বলিয়া গন্য হইবে।...

সম্ভবত উনিশশো ছিয়াশির মাঝামাঝি বা শেষের দিকে। সেশন শেষ, কিন্তু পরীক্ষার খবর নেই। ছাত্রজীবনের বিদায়লগ্নে এসে না ঘরকা না ঘাটকার মতো এরকম অদ্ভুত অবস্থায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিব্যি ঘুরছি ফিরছি আর ডুগডুগি বাজাচ্ছি। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির পাহাড় টিলা বন বনানী ঝোপ জঙ্গলের প্রাকৃতিক আদিমতার সাথে বনাবনি খুব একটা খারাপ ছিলো না বলে নিজেকে নিজের পূর্বপুরুষ ভাবতেও যে এতো চার্ম, ওটাই ঝালিয়ে নিচ্ছি এই সুযোগে। এছাড়া ছাত্র হিসেবেও বিশেষ গোত্রের কিনা, তাই পরীক্ষা যতক্ষণ না দরজায় এসে লাথি দাগাতে শুরু করে লেখাপড়ার মুডই যে ওঠে না ; এতে আমারই বা দোষ কোথায় ! তারচে’ বরং সন্ধ্যা থেকে কমনরুমে জাতীয় সংগীত বেজে না ওঠাতক বিটিভিকে সঙ্গ দেয়া। তারপর হল থেকে বেরিয়ে চা-দোকানের ঝুপড়ির মৃদু আলোয় কুঁজো হয়ে নির্বিকার বসে থাকা কল্কিধারী দোস্তদের অত্যন্ত মহৎভাবে অভয়দান করা, অথবা হাওয়াইন গিটারসহ ভীষণ সংস্কৃতিবান বন্ধুকে নিয়ে শুক্লপক্ষের মধ্যরাতে শীতের কুয়াশা ভেঙে আধাকিলো দুরের খোলা মাঠে চাঁদের আলোয় বসে সর্বশক্তি দিয়ে কোন মহতি সুর সাধা, এবং আশেপাশে এদিক ওদিক থেকে অত্যন্ত সমিল কণ্ঠে সঙ্গ দেয়া শেয়ালের হুক্কাহুয়াকে শ্রোতাদের অমূল্য স্বীকৃতি ভেবে আত্মতৃপ্তি নিয়ে শেষ রাতে হলে ফিরে দিনের বারোটা পর্যন্ত সময়কালকে প্রভাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। এরকম সৃজনশীল কর্মকান্ডে ক্লান্তিহীন নিয়োজিত থাকতে দেখেই অতীব তুষ্ট হয়ে কি না কে জানে, জনৈক দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্ধু অর্থাৎ বন্ধুর বন্ধুর কাছ থেকে প্রস্তাব এলো যে আমাকে তারা তাদের এক তীর্থযাত্রায় বেয়ারিং ভ্রমনসঙ্গি করতে চায়। তাও যে সে তীর্থ নয়। একেবারে আটরশি ! যার সানুগ্রহে এরা যাচ্ছে তিনি হলেন ফরিদপুর আটরশির বিখ্যাত পীরহুজুর বাবা কেবলাজানের একজন একনিষ্ঠ মুরিদ। কিন্তু এই তরিকায় আমাকে কোন্ যোগ্যতায় অন্তর্ভূক্ত করা হলো তা এক বিরাট ধাঁ ধাঁ হয়ে গেলো আমার কাছে। স্বভাবে ছন্নছাড়া বাদাইম্যা গোছের হলেও সেই বালক জীবনে ‘আউট বই’ পড়ে সীমা অতিক্রম করে ফেলায় ধর্মশাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের চোখে যার কিনা ‘স্বভাবচরিত্র ভালো তবে ধর্মে কর্মে মতিগতি কম’ খেতাবটাও পরবর্তীতে অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেছে, সেই আমাকে এমন প্রস্তাব ! অত্যন্ত অবমাননাকর বিবেচনা করে এক কথায় উড়িয়ে দিতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমার সেই ফুলটাইম কল্কিধারী মেধাবী দোস্তসহ আরো দুজন বেদ্বীন ছাত্র ইতোমধ্যেই এই যাত্রার সফরসঙ্গি নির্বাচিত হয়ে আছে। অতএব বিষয়টা পুনঃবিবেচনার দাবি রাখে বৈ কি। এবং অনতিবিলম্বে একদিন আমার পরিচিত কেউ এমন কি হলের রুমমেটও জানলো না যে আমি ক্যাম্পাসে অপেক্ষমান রিজার্ভ করা চেয়ারকোচটাতে কখন কোন এক তাৎক্ষণিক মুহূর্তে এক কাপড়েই চড়ে বসেছি। সেলুলার নামক যে অদ্ভুত বিস্ময়কর পদার্থটা আরো বেশ কিছুকাল পর দেশে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করে গোটা বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে, তার নামনিশানার খোঁজও তখন আমরা জানি না বা কশ্মিন শুনিও নি। অতএব হলের বন্ধুদের কাছে কোন অজ্ঞাত কারণে আমি আকস্মিক নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম !

তেইশজন যাত্রি নিয়ে গাড়িটা চট্টগ্রাম শহরের দিকে ছুটলো। বাকি সীটগুলো খালি। শহর থেকে নাকি আরো যাত্রি উঠবে। কিছুক্ষণের মধ্যে হালিশহরের একটা সম্ভ্রান্ত এলাকায় নিয়ে এলো আমাদের। আগে থেকেই এখানে আরেকটা বাস দণ্ডায়মান। মাঝারি সাইজের একটা তাবুর নীচে অনেকগুলো চেয়ার জুড়ে বসে আছেন অধিকাংশই চকচকে চেহারার হুজুরগোছের মান্যগন্য ধরনের ব্যক্তিবর্গ। এদের কেউ কেউ যাত্রি হবেন, বাকিরা এসেছেন কুশল বিনিময় করতে। একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত। নির্ধারিত ফ্যাটের বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসে তো চোখ ছানাবড়া ! খাওয়া দাওয়ার এ কী আলীশান ব্যবস্থা ! বহুদিন এমন উন্নত ও সুস্বাদু খাবার খাই নি। এথলেট শরীরের চাহিদা অনুযায়ী বেশ তৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিলাম।

[০২]
বিকেল মজে এলে এক সাথে দুটো বাসই ছাড়লো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তবে তার আগেই খালি সীটগুলো নতুন যাত্রিতে পূর্ণ করা হলো। কিন্তু এতো বড়ো আয়োজনের আয়োজক যিনি, মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, অন্য গাড়িটার আল্লাহওয়ালা বয়েসী যাত্রিদের সঙ্গি না হয়ে আমাদের গাড়িতেই এই অধিকাংশ নাবাল ছাত্রদের ভ্রমনসঙ্গি কেন হলেন তা আশ্চর্যের নয় কি ? তাঁর চেহারা দেখে হতাশও হলাম, একই তরিকার অন্যান্য বেয়ারিং যাত্রিদের তেলচকচকে উজ্জ্বল চেহারার তুলনায় তাঁর চাকচিক্যহীন চেহারায় মালিন্য দেখে। গাম্ভীর্যহীন হাসিখুশি মুখের আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে তাঁকে ভালো লেগে গেলো ঠিকই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এরকম একজন লোক কী করে বছরে দুবার এতো বড় আয়োজন নিয়ে পীরবাবার দরবারে যান, এর সপক্ষে কোন যুক্তি অন্তত আমার মাথায় এলো না। আরো কতো বিস্ময় যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে তা কি আর জানি ! অবশ্য এটা জানতে বিলম্ব হলো না যে, ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সহায় সম্পদে উন্নতি পীর বাবা কেবলাজানের দয়ায় খুব কম নয়।

যাত্রাশুরুর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে গেছে। শা শা বাতাসকাটা গুঞ্জনের মধ্যে গাড়ির ভেতর একটা অদ্ভুত নীরবতা ঘুরঘুর করছে। ঘুমঘুম ভাব নিয়ে জানলা দিয়ে সন্ধ্যার আবছা আঁধার মাপছি। হঠাৎ একটা গল্পের গুঞ্জন কানে এসে ধাক্কা মারলো। বয়ানে বুঝা যাচ্ছে এটা অলৌকিক ঘটনা।
‘তখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী আমি। বাঁচার আশা প্রায় শেষ। কোন ডাক্তার আর বাকি নেই। ডাক্তারদের সব ব্যবস্থাপত্রও ফেইল। চরম হতাশা বুকে নিয়ে ঘুম কি আর আসে ? মৃত্যুর প্রহর গুনছি। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম ফেরেশতার মতো চেহারার একজন আউলিয়া ধবধবে সাদা চুল দাঁড়ি, আমাকে বলছে, তোর তো কিছু হয়নি। ভালো হয়ে গেছিস। চলে আয় আমার কাছে। ঘুম ভেঙে গেলো। যে শরীরটাকে নাড়াতেই প্রাণটা বেরিয়ে যেতো, দিব্যি উঠে বসলাম ! কিন্তু কে তিনি ? পরদিন সবাইকে বললাম। চেহারার বর্ণনা দিলাম। কেউ বলতে পারলো না। অবশেষে বাবার মুরিদ একজন, আমার কথা শুনে বললেন, তুমি আটরশির পীরবাবার দরবার থেকে একবার ঘুরে আসো। চলে গেলাম আটরশিতে। হুজুরকে দেখেই আমার কী যেনো হয়ে গেলো ! এই তো তিনি ! সাথে সাথে তাঁর পায়ে পড়ে গেলাম, বাবা আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আজ থেকে আমি আপনার গোলাম।’

ধীরে ধীরে নৈঃশব্দের ভার কমে আসতে লাগলো। ভদ্রলোক এবার তাঁর এই অলৌকিক ঘটনার সপক্ষে আরো বললেন, বাবা তাঁর প্রত্যেক মুরিদকেই এরকম একেকটা অলৌকিক কাণ্ড দেখিয়েছেন। এক্কেবারে সাক্ষাৎ আউলিয়া তিনি ! পাশের অন্য কয়েকজন মুরিদও দেখি তার এই কথায় সায় দিয়ে ওঠলেন।

মানুষ স্বভাবগতভাবেই যুক্তিশীল। যুক্তি মানুক বা না মানুক, অবচেতনে এই যুক্তিবোধই মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। যদিও কখনো কখনো বিশেষ কোন অবস্থায় এই যুক্তি আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর এই বিশেষ অবস্থার স্থায়িত্বকাল কারো স্বল্প, কারো বা দীর্ঘ। আবার কারো কারো সারাজীবন এই আচ্ছন্নতা থেকে যায়। কেন তা হয় বা হয় না, এই যুক্তিচর্চা আমার এখনকার বিষয় নয়। হাঁ এবং না, এ দুটোর মাঝামাঝি কোন অর্থবহ শব্দ যেমন বাংলাভাষায় নেই, তেমনি পরস্পরবিরোধী দুটো বিষয় একই সাথে সত্য হতে পারে না। আমার নিজস্ব অদ্ভুত খেয়াল দিয়ে এই কাহিনীটাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করলাম না। ভুলে যেতে চাইলাম। কখনো কখনো ভুলে যাওয়াটাও স্বাস্থ্যকর বৈ কি ।

মাঝরাতের দিকে ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি ছ’তলা বাড়ির সামনে এসে আমাদের যাত্রা বিরতি হলো। ষষ্ঠ তলার চকচকে ফ্ল্যাটটাতেই আমাদের থাকার আয়োজন। যদিও এতোগুলো লোকের জন্য অপর্যাপ্ত, তবু এটাই বা আশা করেছে কে ? নীচের আরেকটা ফ্যাটে খাবারের ব্যবস্থা। এবার রাতের খাবার দেখে তো আক্কেল গুড়ুম ! এতো হাই ফাই ! বুঝতে পারছি না, এই আড়ম্বরের উদ্দেশ্য এবং উৎসটা কোথায়। চিটাগাংএর হালিশহরের সাথে ঢাকার ইন্দিরা রোডের লিঙ্কটাই বা কী ? শ্রান্ত মন আর ক্লান্ত শরীরে এতোসব ভাবাভাবি বাদ দিয়ে হামলে পড়লাম। খাবার আর শরীরের ভার এক করে ফিরে এসে দেখি, আরেব্বাশ, রুমের মেঝে সব নতুন নতুন তোশক আর দামী বেডশীটে আবৃত হয়ে ঝকমক করছে ! পরম প্রীত হয়ে বিড়ি টানার তুমুল অভ্যেসটাকে ঝালাই করতে ছাদে চলে গেলাম। প্রথমেই চোখ পড়লো সংসদ ভবনটার দিকে ! প্রশস্ত ছাদ থেকে হাতের কাছেই যেন, বিশ্ব-খ্যাত স্থাপত্যশিল্পী লুই কানের গড়া আমাদের সংসদ ভবনটি তার গোটা এলাকাসহ রাতের আলোয় ঝলমল করছে। এই প্রথম আমার এতো কাছে থেকে সরাসরি সংসদ ভবন দেখা। এর আগে দু-একবার ঢাকায় এলেও রাতের ঢাকাকে দেখার সুযোগ হয়নি। খুব ভোরে আবার গাড়িতে উঠতে হবে। তাই বেশিক্ষণ ছাদে থাকা হলো না। রুমের লাইট অফ। জানলার কাচ ভেদ করে বাইরের আলো রুমটাকে হালকা তরল আলোয় ভরিয়ে রাখলো। এতোগুলো লোক রুমে, তবু কেমন নীরব স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব একটা। কোথাকার কোন্ ভালোলাগায় ঘুম আসছে না আমার। জানলার পাশে ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে আশপাশগুলো দেখছি। হঠাৎ করে অজান্তেই সাক্ষী হয়ে গেলাম পাশের ফ্যাটের ডিমলাইটের গলন্ত আলোয় মিশে থাকা যুগল দৃশ্যের। আহা, তারুণ্যের চোখে যাকে আমি পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য হিসেবে বিবেচনা করতে ভালোবাসি।

[০৩]
অতি ভোরে ঘুম ভাঙানো হলো। শার্টপ্যাণ্ট পরা এক কাপড়ে গা ঝাড়া মানুষ। আলাদাকরে কাপড় পাল্টানোর দায় নেই। গাড়িতে উঠার আগে প্রাতের হোটেল থেকে যে যার মতো নাস্তা সেরে নিলাম। ঢাকা ছাড়লো গাড়ি। চূড়ান্ত পর্যায়ের জার্নি। প্রায় সবার মধ্যেই দেখছি একটা আধ্যাত্মিক ভাব চলে আসছে। আড়চোখে সেই দোস্তটির দিকে তাকালাম। মলিন মুখ। বড় ভুল হয়ে গেছে তার। চট্টগ্রাম ছাড়ার পর থেকেই খেয়াল করছি, পীর-ফকিরের আখড়ায় যাচ্ছে ভেবে যে উৎসাহ নিয়ে গাড়িতে উঠেছিলো, ফলাফল হয়ে গেছে উল্টো ! উৎফুল্লতার ধোঁয়াবঞ্চিত আমার দোস্তের অবিরাম হাসিখুশি থাকার অটোস্বভাব কেমন মিইয়ে এসেছে। যাত্রিরা সবাই যে একেকজন কৃচ্ছতার অবতার ! আহা, কখন যে ভ্রমন শেষ হবে তার ! কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে গেলো গাড়িফাটানো জিকির-আশকার। ফাঁকে ফাঁকে পীর বাবাকেবলাজানকে নিয়ে রচিত গানের সুরে টান দিচ্ছে কেউ, সাথে দোহা ধরছে অনেকেই। এক সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাবা ছাড়া জগতে আর কোনো ঠাঁই নেই ! এরকম ঘটনার পেটের মধ্যে থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম, এবং এটাই শেষ। নীরব শ্রোতা ও দর্শক হিসেবে বেশ উপভোগ করছি আমি। আরিচা থেকে দৌলতদিয়া ফেরি পার হয়ে জিকিরের তেজ বেড়ে গেলো আরো।

ফরিদপুর শহরের সুবিধাজনক স্থানে এসে গাড়িটা থেমে গেলো। আয়োজক ভদ্রলোক জনাকয়েক সতীর্থ ভক্ত নিয়ে নেমে গেলেন। আটরশি আর দূরে নেই। সম্ভবত আঠারো মাইল। গাড়ির জানলা দিয়ে প্রথম দেখার চোখ দিয়ে শহরটা দেখছি। কেমোন যেন মলিন মলিন মনে হলো। লোকজনের জীবনযাত্রার মান হয়তো খুব উন্নত নয়। বাড়ি ঘর দোকানপাট সবকিছুতেই এই মলিনতার ছাপ। এবার দেখি মণে মণে মালামাল এসে গাড়ি বোঝাই হতে লাগলো। বিরাট বিরাট মানকচু, মিষ্টিকুমড়া, আলু, চাল, পাঁঠা ছাগল ইত্যাদি ইত্যাদি কত কিছু ! বোঝা গেলো, বড় শক্ত লিঙ্ক। আগে থেকেই কেনা হয়ে আছে এগুলো। আর সাথে সাথে আমার মাথাটাও বোঝাই হতে থাকলো আবোলতাবোল কত্তোরকমের নীরব প্রশ্নে। এর উত্তর আদৌ কখনো পাবো কিনা জানি না।

দক্ষিণাঞ্চলগামী মূল সড়ক থেকে নেমে সরু একটা রাস্তা ধরে গাড়িটা মন্থর গতিতে এগিয়ে যেতে থাকলো। যেখানে এসে থামলো, ওখান থেকে হুজুরের দরবার বেশি দূরে নয়। হেঁটে যেতে হবে। বাঁশের তরজায় তৈরি কতকগুলো ছোট ছোট দোকানপাট, ঝুপড়ির মতো। ফটক পেরিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে আরো ভেতরে। বেষ্টনিঘেরা বিশাল তল্লাট ফাঁকা প্রায়, কোন বাড়ি ঘর চোখে পড়ছে না। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে দরবারের মূল গেট। ঠিক বিপরীতে ছোটখাট মাঠটার পরেই বহুতল বিশাল মাদ্রাসা। মাঠের মাঝামাঝি চওড়া গোলাকার পাকা করা হেলিপ্যাডটা দেখে কৌতূহল জাগলো। তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈর-রাষ্ট্রপতি হো:মো:এরশাদ কেবলা হুজুরের পেয়ারের মুরিদ জানতাম। এবং তার দেখাদেখি সাঙ্গপাঙ্গ আমলা ব্যবসায়ী সুবিধাভোগী অনেকেই যে এই তরিকা গ্রহণ করেছেন তখন, তারই নমূনা হয়তো এটা।

মাদ্রাসার তৃতীয় তলার বিশাল একটা কক্ষের মেঝেয় আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা এবং রাতের থাকাও। আদৌ এখানে লেখাপড়া হয় কিনা জানি না। হয়তো এটা মাদ্রাসাই নয়। মাদ্রাসার আদলে মূলত দেশবিদেশ থেকে আসা হুজুরের মুরিদানদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। ওদিকে গাড়ি আনলোড করে মালামাল সব ভ্যানে করে হুজুরের দরবারে পাঠানো হচ্ছে। এখানকার ভাষায় এ-কে নজরানা বলে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মধ্যদুপুরের ক্লান্তি কাটিয়ে মূল দরবারের দিকে যাবো আমরা। মূল দরবার এলাকাও বিশাল। জুতো নিয়ে এলাকায় ঢোকার বিধান নেই। মাদ্রাসায় জুতো রেখে সবাই নগ্নপায়ে রওয়ানা দিলাম। স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে সম্পর্কের আদানপ্রদান কেমন বোঝার উপায় নেই। তবে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজনের আসাযাওয়া। কাউকেই খালি হাতে দরবারে ঢুকতে দেখিনি। একটা কুমড়া বা কচু বা লাউ বা মুরগী বা ছাগল গরু যার যা সাধ্য ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসপত্রের নিয়মিত প্রবেশমুখি স্রোত লেগেই আছে। কী আশ্চর্য, এতো মালামাল যায় কোথায় !

দরবারের ফটক পেরিয়ে ছিমছাম পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর আগালেই দরবার শরীফের গায়ে লেগে দুভাগ হয়ে রাস্তাটা দুদিকে চলে গেছে। দুদিকে দুটো ভবন। মাঝখানদিয়ে ভেতর এলাকায় যাওয়ার রাস্তা। ডান দিকের ভবনটাই হুজুরের দরবার শরীফ। এর গঠনগাঠনই অন্যরকম। রাস্তা ধরে নবাগত কেউ দরবারে ঢুকেই আমার মতো নাবালের জন্য প্রথমেই যে সতর্কবাণী বিশাল বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে তা তো শুরুতেই বলেছি। হকচকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ! ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান। এইখানে যে বেয়াদপি করিবে তাহার তকদিরে পোকায় ধরিবে। নিম্নলিখিত কারণগুলি চরম ও জঘন্য বেয়াদপি বলিয়া গন্য হইবে। এরপর নীচে দীর্ঘ তালিকা। খুব সম্ভবত ছাব্বিশটি। প্রায় দুযুগ আগের স্মৃতিতে এগুলো থাকা উচিৎ ছিলো। বেয়াদবি বিষয়ক গবেষণায় যথেষ্ট উপকারে আসতো। কিন্তু আমার নাবাল স্মৃতি সে সুযোগ নিতে পারলো না। ক্রমান্বয়ে উল্লেখ করা বেয়াদপির নমূনা ও উপসর্গগুলো পড়তে পড়তে ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে ওঠছি। জোরে কথা বলা, শব্দ করিয়া হাসা, দাঁত দেখাইয়া রাখা, যত্রতত্র থুথু বা বর্জ্য পদার্থ ফেলা, দুই হাত ভাঁজ করিয়া রাখা বা দাঁড়ানো, খাবার মাটিতে ফেলা, দরবারের জানালা দরজা দিয়া উঁকিঝুকি মারা, নির্দেশিত নিয়ম মান্য না করা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেককিছু। কিন্তু নির্দেশ মনে না রাখাটাও যে একধরনের বেয়াদপি, ওখানে তা লেখা ছিলো কি না মনে করতে পারছি না। তবে নির্দেশই যদি মনে না থাকবে, মেনে চলা কী করে ? আমি কি বেয়াদপি করছি ? নির্দেশনামা পড়তে পড়তে হঠাৎ খেয়াল হলো আমি হাতদুটোকে রীতিমতো পেছনে ভাঁজ করে দিব্যি ফুলবাবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ! তাড়াতাড়ি হাতের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে দুপাশে সটান ঝুলিয়ে দিলাম। এদিক ওদিক মাথায় ও কোমরে গামছাবাঁধা বিশাল ভুড়িঅলা পাণ্ডাগুলো যেভাবে ঘুরাফেরা করছে, এই যদি বেয়াদপ বলে ধরে এসে ? এখানে নাকি তাদের কথাই আইন। ঘাড় ধরে বের করে দেবে। এতে আরেক সমস্যা দেখা দিলো এবার। বেআক্কেলের মতো হাত দুটো দুপাশে জগরদভের মতো ঝুলে পড়ে নিজেকেই কেমন বেআক্কেল বেআক্কেল লাগছে।

হঠাৎ করে উদ্বৃত্ত হয়ে পড়া হাতদুটোকে নিয়ে এই অবস্থার মধ্যে আরেক উপসর্গ আবিষ্কার করে আরো জবুথবু অবস্থা আমার। হে হে মার্কা মুখে কোদাইল্যা দাঁতগুলো সারাক্ষণ কেলিয়ে থাকার চিরায়ত স্বভাব। এখন কী করি ? একটাই উপায়। ঠোঁটদুটোকে জোর করে সংযুক্ত রেখে মুহূর্তের জন্যেও অসতর্ক বা অসচেতন না হওয়া। একে তো বেদ্বীন, তার উপরে বেয়াদপি, নিজেকে সংযত করার সাধ্যাতীত প্রচেষ্টার ফলাফল নিজের চেহারায় নিজে দেখার তো কোন উপায় নেই। অকস্মাৎ কোত্থেকে আমার দোস্ত এসে হাজির। কী হয়েছে তোমার দোস্ত ! তার চোখে উৎকণ্ঠা। আমি ততোধিক আশ্চর্য, কই, কিছু না তো ! চলো চলো, খেতে ডাকছে। খেয়াল হলো, দুপুরে খাওয়া হয়নি এখনো। শুক্রবার জুম্মাবার হওয়ায় দরবার শরীফের সামনে বিশাল এলাকাজুড়ে টিনের চালার নির্ধারিত স্থানটিতে সবাই নামাজ আদায়ে যাওয়ায় আমি অলস সময়টা এভাবেই ব্যয় করছিলাম। নামাজ শেষ। এখন খাবার পালা। দরবার ভবনের পাশ ঘেষে দুই ভবনের মাঝে দিয়ে ঢুকে ভেতরেই খাবারখানা। ঢুকার পথে ডান পাশে দরবার ভবনের দেয়ালে কয়েকটি কাউণ্টার। ওখান থেকে অত্যন্ত স্বল্প হাদিয়ায় খাবারের টিকিট নিতে হয় আগে। আয়োজক ভদ্রলোকের কল্যাণে আমাদের টিকিট একত্রে কাটা হয়ে গেছে। খাবারখানার দিকে যাওয়ার পথে ডানের সুরম্য দরবার ভবন ঘেষে একটা বাঁধানো কবর। তার গায়ে উৎকীর্ণ সতর্কবাণী, কবর জেয়ারত করা নিষেধ।

খাবারখানা মানেই স্বল্পপরিসরের একটা বারান্দার মতো কক্ষে শত শত বা হাজারও হতে পারে, মাটির সানকি উপুর করে রাখা। ওখান থেকে একটা তুলে নিয়ে মেলে ধরো। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশালদেহী পাণ্ডাব্যক্তিটি একটা বড় হাতা দিয়ে তাতে এক হাতা ভাত এবং একহাতা ডাল ও লাবড়া বা অন্য কোন আইটেম ধাম করে ঢেলে দেবে। এবার মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে ওগুলো মিশিয়ে গপাগপ গিলে ফেলা। খেতে বসে একদুটা ভাত মাটিতে পড়লে তা আবার সানকিতে তুলে নেয়াসহ এই সিস্টেমটা মন্দ লাগেনি আমার কাছে। এখানে দিনে একবেলাই সর্বসাধারণের খাবারের এই আয়োজন হয়ে থাকে। গরীব ধনী উচু নীচু কোন ভেদাভেদ নেই বলেই জানানো হলো আমাদেরকে। শুনে প্রীত হলাম। আবার ভাবলাম সত্যি কি তাই ? খাবার শেষে পাশের টিউবওয়েলে ধুয়ে নিয়ে সানকিটা জায়গামতো রেখে দিয়ে আসতে হয়। এরইমধ্যে খাবারপর্ব শেষে আমাদেরকে জানানো হলো, ঘণ্টাখানেক পর দরবারের বিশেষ গাইডের সহায়তায় আমাদেরকে দরবার শরীফের উল্লেখযোগ্য এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হবে। আপাতত বিশ্রাম।

অধিকাংশই মাদ্রাসায় চলে গেলো। কিন্তু আমার মধ্যে তখন ভর করেছে অদম্য কৌতূহল। যারা নিজ নিজ বিশ্বাস থেকে এখানে পবিত্র ভ্রমনে এসেছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু আমার যে বিশ্বাসবোধে ঘাটতি রয়েছে ! তাছাড়া দরবারে প্রবেশ করাতক একটা বিষয় আমার চোখ এড়ায়নি, দামী দামী কারগুলো সরাসরি এদিকে ঢুকে পাশের ভবনের সামনে সারি সারি পার্ক করে তা থেকে যে সুবেশি মুরিদানরা ভারী ভারী ব্রীফকেস হাতে বেরিয়ে আসছেন, সরাসরি দরবার শরীফের একটি বিশেষ কক্ষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন খালি হাতে, বেশ কিছুক্ষণ পর। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে ফের ফিরতি পথে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। আমি একা একা এই বিরতিকালটা এদিক ওদিক ঘুরঘুর করতে লাগলাম। হঠাৎ গোটা এলাকা জুড়ে অসংখ্য মাইক সচল হয়ে ওঠলো। স্থায়ী স্থাপনার উপর বিশেষভাবে সেট করা মাইগুলোতে কেবলাহুজুরের বয়ান বর্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ হুজুরকেবলা দরবারে তসরিফ নিয়েছেন এবং দর্শনার্থীদেরকে দর্শন ও দোয়া দিচ্ছেন। বিশেষ কোন জরুরি কাজে জড়িত না থাকলে যে যেখানেই আছেন বাইরে সবাই দেখছি হাতজোর করে অত্যন্ত বিনয়সহকারে দাঁড়িয়ে হুজুরের বয়ান শ্রবণ করছেন। আমার মতো আজাইরা আর একজনও পেলাম না যিনি হাতজোর না করে আছেন।

একইসাথে বিব্রত ও দ্বিধাগ্রস্ত আমি কী করবো না করবো বুঝে ওঠতে পারছি না। কিন্তু দেখাদেখি হাতজোর করবো তাও রুচিতে দিচ্ছে না। লোকসমাবেশ থেকে একটু একটু দূরে সরতে থাকলাম। এই সরতে গিয়ে কখন যে কী বেয়াদপি করে বসলাম তা বলতে পারবো না। অনেক বইপত্র দেখে যে কক্ষে ঢুকলাম ওটা লাইব্রেরী। হুজুরের উপর লেখা নিজস্ব প্রকাশনার অনেক অনেক বই আর পীরবাবার বয়ান সমৃদ্ধ অগুনতি ক্যাসেট। কিছু সময় নেড়েচেড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে আরেকটা কক্ষের জানালার কাচে উঁকি মারলাম। মনেই ছিলো না যে বেয়াদপি হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস কোন পাণ্ডাবাবাজীর চোখে পড়িনি। তবে আমার চোখে যা পড়লো, তাতে একটা ফাঁকির মধ্যে পড়ে গেলাম যেন। বিশাল বড়ো ডাইনিং রুম ? ওটাতে রাখা সুদৃশ্য ডাইনিং টেবিল কতোগুলো হবে ? গুনে দেখার ঝুঁকিতে গেলাম না। আগের কথাটাই ভাবছি, এখানে গরীব ধনী উচু নীচু কোন ভেদাভেদ নেই ! বিপজ্জনক হলেও এবার আর কিছুতেই কৌতূহল দমাতে পারছি না। দরবার ভবনের সেই বিশেষ কক্ষটির দিকেই বারান্দাধরে হাঁটা শুরু করলাম কোনধরনের ইতস্তততা না দেখিয়ে। সামনে দিয়ে দরজা পার হয়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখলাম, হতবাক হয়ে গেলাম ! আমার চোখ এমন দৃশ্য আগে আর দেখেছে কিনা মনে করতে পারলাম না। বিরাট এক রুমের মধ্যেই একটা কারাগার যেন। বিশাল কলাপসিবল গেটের মতোই একটা গড়াদে রুমটা দুভাগ করা। গড়াদের ভেতরে শতশত ব্রীফকেসের পাহাড় ! পাক কেবলাহুজুরের বিশিষ্ট মুরিদদের সামান্য নজরানার এই নমূনা ! ওগুলোর ভেতরে কী ? গড়াদের পাশেই কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বসে মোটা খেড়োখাতায় কি এসবই পোস্টিং দিচ্ছে ? পাশেই বড়আকৃতির কয়েকটা টুইনওয়ান এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কীসব রেকর্ড হচ্ছে। মনে হচ্ছে হুজুরের বয়ান। ভেতরের দরজার ওপাশেই সম্ভবত কেবলাহুজুরের তাসরিফ। ভাবতে ভাবতে ঘাড়বাঁকা করে দেখতে দেখতে রুমটা পেরিয়ে গেলাম এবং পরমুহূর্তেই থমকে গেলাম। সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে যথারীতি হাঁটুদৈর্ঘ্যের লুঙ্গি আর এক্সারসাইজ গেঞ্জি গায়ে মাথায় কোমড়ে গামছাবাঁধা রক্তচোখা বিশাল ভুড়িধারী পাণ্ডাটি ! ভয় পেয়ে গেলাম। বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে গেলেও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি যে জিজ্ঞেস করলেই বলবো বাথরুম খুঁজছি। আদৌ তা কোনো কাজে আসবে কিনা জানি না। কিন্তু জ্বলজ্বল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করছে না দেখে আমিও আচমকা পথ ভুল হয়ে গেছে ভাব দেখিয়ে ঘুরে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এক্ষুনি ঘাড়ে বিশাল থাবাটা পড়বে। সে আশঙ্কায় ঘাড়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে গেছে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে দমবন্ধের মতো হাঁটছি। খেয়াল হলো, কই না তো, থাবা তো পড়েনি ! পেছন ফিরে দেখি অনেক নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি। যাক বাবা, এবারের মতো রক্ষা পেলাম। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই আমাদের দলটাকে সামনে পেয়ে গেলাম। গাইড চলে এসেছে। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির ছাত্রভাইদেরকে দরবার শরীফের এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হবে। আমার সেই দোস্তটি হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে প্রায় নিঃশব্দ কিছু উষ্ণ বাতাস ঢেলে দিলো, দোস্ত, সব ভণ্ডামী !

[০৪]
দরবারের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে বায়ে মোড় নিয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটছি। কিছুদূর যেতেই সামনে উঁচু অয়ারলেস টাওয়ারটা চোখে পড়লো। পুলিশ ফাঁড়ি। পাশেই সোনালী ব্যাংকের শাখা। আশ্চর্য ! আশেপাশে এ তল্লাটের ধারেকাছে কোন বাড়িঘর বা লোকালয় চোখে পড়ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ব একটা ব্যাংকের ব্রাঞ্চ চলার মতো ফিডার কোথায় ? হঠাৎ মাথার ভেতরে অগুনতি কালো কালো ব্রীফকেসের পাহাড় ভেসে ওঠলো। মনে হলো উত্তরটা হয়তো পেয়ে গেছি। ওগুলো পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে আরো কিছুদূর। একটা সংরক্ষিত খামার এলাকার মতো মনে হলো। গোশালা, ছাগলশালা, মহিষশালা কাগজে লেখা ইত্যাদি সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। যেটাতেই ঢুকছি অনেকগুলো সারিতে গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির অগনিত সমাবেশ। সব্জির গোডাউন, একেক পদের সব্জির জন্য একেকটা। এগুলোর বিশালতা দেখে চোখে আমার বিস্ময় নাঁচছে। এটা দেশের কেন্দ্রিয় কোন পাইকারী আড়তের সমাহার নয়। একটা দরবার শরীফের সংরক্ষণাগার মূলত। দূরদূরান্ত থেকে আসা মুরিদানদের দেয়া নজরানাগুলো এখানে সাময়িক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ একটা বিদ্যাপিঠের ছাত্রদেরকে দাওয়াত করে এনে এগুলো দেখানোর উদ্দেশ্যটা কী ? এর মাজেজাই বা কোথায় ? সঙ্গিদের বিস্ময় কৌতুহল সবই শুনতে পাচ্ছি। পশুশালার বেড়ার গায়ে নির্ধারিত দূরত্ব পর পর কাগজের উপর হাতে লেখা কিছু সতর্কবাণী টাঙানো। বুঝাই যাচ্ছে এগুলো অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে রাখা। ইহা অলিআউলিয়াগণের স্থান, এইখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ।

আটরশির দরবার শরীফ এলাকার মতো এতো বড়ো এলাকা নিয়ে দেশে আর কোন দরবার শরীফ আছে কিনা আমার জানা নেই। যেদিকেই তাকানো যায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চাষযোগ্য জমি আর জমি ছড়িয়ে আছে। ওখানে চাষাবাদও হচ্ছে। বিভিন্ন জাতের সব্জি ধান হয়তো মাছও। যারা চাষাবাদগুলো করছে তারা কোনো বণ্টনচুক্তি মেনে তা করছে, না কি স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে আমার জানা নেই। পরিদর্শন সময়ে গাইডকে যে জিজ্ঞেস করবো তা মাথায়ও আসে নি। আসলে প্রাথমিক বিস্ময়গুলোই একেকটা এতো উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠছিলো যে ওইসব মৌলিক চিন্তা সাপ্লাই দেবার মতো মস্তিষ্কটা তখনও হয়তো গড়েই ওঠেনি। একটা জায়গায় এসে আমাদের দরবারী গাইড অঙ্গুলি নির্দেশে এবার যা দেখালেন তাও বিস্ময়ের বৈ কি ! শত শত পাকা করা সিমেণ্টের বড় বড় চূলো, সারি সারি, বিশাল এলাকা জুড়ে ! ব্যাপার ? গাইড এর উত্তর দিলেন। ওরসের সময়ে দেশ বিদেশ থেকে যে লক্ষ লক্ষ মুরিদানের মহসমাবেশ ঘটে, তখনই কেবল এই চূলোগুলো জ্বলে ওঠে। লক্ষ লক্ষ লোকের খাবার তৈরি ! এই মহাযজ্ঞ সামলানো কি যে সে কথা ! বিস্ময়ে থ হয়ে রইলাম আমরা। তাহলে সে অনুযায়ী হাড়ি পাতিল ডেকচি কড়াই বা বাসনপত্রও রয়েছে ! যদিও তা আর দেখা হয়নি। কিছু কল্পনা করার জন্যেও সংরক্ষিত রাখা জরুরি।

হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা রাউণ্ড আপ হয়ে যাচ্ছে হয়তো। দিনের রূপালি আলোয় কখন যে সোনালি রঙ ধরে গেছে। ক্লান্তি যে আমাদের আসতেই পারে সেটা গাইড লোকটি ঠিকই বুঝেছে। যেখানে নিয়ে এলো সেটা দরবার শরীফের কেণ্টিন। হায় হায়, এরকম সুবিধা যে রয়েছে এখানে তা তো আগে জানি না ! অনেক মুরিদানই চা নাস্তা পান বিড়িতে মজে আছে। উপোসীর মতো আমরাও হামলে পড়লাম। দীর্ঘবিরতির পর সিগারেটটা কেবল ধরিয়েছি, সাকুল্যে দুতিনটা টান দিয়েছি হয়তো। হঠাৎ একটা অস্থিরতা কেণ্টিন জুড়ে। হুজুর আসছে হুজুর আসছে। হকচকিয়ে গেলাম। যে যার বিড়ি সিগারেট নিভিয়ে মুখের ভেতরে থাকা পানসুপারি থুক করে ফেলে কুলকুচি করে কেণ্টিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সংলগ্ন পাকা রাস্তাটার পার্শ্বে জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে পড়ছে ! আমি এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাপের রোজগারের সীমিত টাকায় ধরানো সিগারেট নিভাই কী করে ! সিগারেটটা হাতের মুঠোয় আড়াল করে হাতদুটোকে পিছমোড়া অবস্থায় নিয়ে ক্যাণ্টিনের দরজা থেকেই ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছি, কী হতে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে জমিতে যে লোকগুলো কাজ করছিলো, এরাও দেখি একইভাবে রাস্তার কাছে সরে এসে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে সে আমালের ভয়ঙ্কর কোন সামন্ত জমিদারের রাজত্বে চলে এসেছি। হঠাৎ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটা খোলা জীপ মন্থরগতিতে অতিক্রম করে চলে গেলো। হুডখোলা জীপের পেছনটায় সিংহাসনের মতো বিরাট একটা চেয়ার ধরে দুপাশে দুই পাণ্ডা দাঁড়িয়ে আছে আর চেয়ারটাতে বসে আছেন শুভ্র কেশদাঁড়িমণ্ডিত গৌড়বর্ণের অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিটি। তিনিই আটরশির বিখ্যাত হুজুরে পীর বাবা কেবলাজান। এই প্রথম আমি দেখলাম তাঁকে। গুঞ্জন থেকে বুঝলাম নির্মিয়মাণ হাসপাতাল পরিদর্শনে যাচ্ছেন তিনি। তখনই লক্ষ্য করলাম বেশ দূরে নির্মাণাধীন ভবনের স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। ওটা একটা আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতাল হবে। পরবর্তীতে ওটা কেমন সুযোগ সুবিধা নিয়ে চালু হয়েছিলো বা এখন এতোগুলো বছর পরে এসে ওটার কী অবস্থা তা আর জানি না। জানার আগ্রহও হয়তো ছিলো না। যেভাবে এটাও জানি না যে, দরবার শরীফের সামনের ডানপাশ ঘেষে তখনো কেবল নির্মাণ প্রস্তুতি নেয়া আরেকটা স্থাপনা পরবর্তীতে কতোটা জাকজমকপূর্ণ মসজিদে রূপ পেয়েছে।

ক্যাণ্টিনের সামনে বিনা ব্যবহারে অর্ধেক পুড়ে যাওয়া সিগারেটটা টানছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, জীপটা নির্মানাধীন হাসপাতালটার কাছে গিয়ে থেমে গেলে পাণ্ডারা ধরাধরি করে চেয়ারটা নামিয়ে নিলো। হুজুর হয়তো এই রাজকীয় চেয়ার ছাড়া কোথাও বসেন না। হঠাৎ ফিক্সড মাইকে একটা বিশেষ ঘোষণা প্রচারিত হতে লাগলো গোটা এলাকা জুড়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রভাইদের জন্য বিশেষভাবে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বার কয়েক ঘোষণাটা দেয়া হলো। তাহলে সর্বসাধারণের জন্য দিনে একবার খাবার তৈরির রীতিটা অলঙ্ঘনীয় কোন বিধান নয় ! নয়তো বিদ্যাপিঠ থেকে আসা দরবার পরিদর্শনকারী এই ছাত্ররা সর্বসাধারণের পর্যায়ের নয় ! তারচে’ একটু ভিন্নতর ? অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করলাম। শুধু বুঝা হলো না, আমরা এই ছাত্ররা হঠাৎ এমন বিশেষ সম্মানের অধিকারী হলাম কী করে।

[০৫]
সন্ধ্যায় সাধারণ দর্শনার্থীদেরকে দর্শন ও দোয়া দেয়া পীরবাবার নিয়মিত রুটিনকাজ। আমরাও যথারীতি লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ লাইন, বহু দর্শনার্থী। বারান্দা হয়ে মাঝে একটি কক্ষ পেরিয়ে তবে মূল দরবার কক্ষ। একটু একটু করে লাইন এগুচ্ছে। এলাকার শত শত মাইকে বাবার বয়ান শুনতে পাচ্ছি আমরা। কত লোক কত সমস্যা নিয়ে বাবার কাছে আসে। কারো ব্যক্তিগত সমস্যা, কারো ধর্মীয় আদর্শগত সমস্যা, কারো রোগশোক ইত্যাদি কতো কিছু। মূল দরবার কক্ষে ঢুকার মুখেই দরজায় ভেতরের দিকে দাঁড়ানো উগ্রমুখি পাণ্ডাটি প্রত্যেক দর্শনার্থীর কাছ থেকে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই নগদ নজরানাগুলো আগেই আদায় করে নিচ্ছে। নজরানা জমা হচ্ছে বাবার পার্শ্বে রক্ষিত একটি বড় পাত্রে। ঢুকার আগে সবাই যার যার হাতে নজরানা বা দর্শনী মুঠোবন্দী করে নিচ্ছে। সময় নষ্ট করার মতো সময় এই আল্লাহওয়ালা জায়গায় নেই বললেই চলে। কক্ষের মৃদু আলোয় বাবা বসে আছেন একটি রাজসিক আরাম কেদারায়। তাঁর শুভ্র পদযুগল সামনেই লাগোয়া একটা জলচৌকির উপর বিছানো। বাবার পেছনে রাজদরবারের বিরাটকায় হাতপাখার মতো একটা চামড় দোলাচ্ছে আরেকজন পাণ্ডা। পাশেই স্ট্যাণ্ডে আটকানো একটা মাইক্রোফোন বাবার মুখের কাছে ফিক্সড করে রাখা। পবিত্র মক্কা মদীনাসহ আরো কী চমৎকার সব সম্ভ্রান্ত চিত্রকর্ম চারদিকের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। উপরে যে ঝলমলে বহুবর্ণিল মণিমুক্তোসদৃশ স্বচ্ছ পাথরখচিত বিরাট ঝালরটা তার সমস্ত অহঙ্কার নিয়ে ঝুলে আছে, আমার দেখা এযাবৎ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সম্ভ্রান্তময় বলেই মনে হয়েছে। অনেকক্ষণ এই ঝালরটার দিকেই চেয়ে থাকলাম। কত দাম হতে পারে এটার ? কোন ধারণাই নেই আমার। লাইনটা কক্ষের ভেতরে ঢুকে একটু গিয়ে তারপর একটা নব্বই ডিগ্রী বাঁক নিয়ে বাবার পাশে দিয়ে এগিয়ে সামনে আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাউকে কোথাও থামতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে লাইনে স্থির অচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই।

দরজার কাছে পৌঁছতেই দেখি পাণ্ডাটি তুখোড় চিলের মতো দর্শনার্থীদের হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে মেলে ধরা নজরানাগুলো। হঠাৎ কোত্থেকে কী হলো, দেখি আমার সামনের ছাত্রটিকে পাগল পাগল বলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিচ্ছে। কক্ষে একটু অস্থিরতা দেখা গেলো। কী ব্যাপার ? নতুন দর্শনার্থী হিসেবে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় একটা ভয়াবহ বেয়াদপি করে ফেলেছে সে, এটা আর পাণ্ডাটিকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। ঘটনা গুরুতর। নজরানা দিতে বুক পকেট থেকে টাকার নোট বের করতে গিয়ে বিশটাকার নোটের বদলে পঞ্চাশ টাকার নোটটি হাতে ওঠতে না ওঠতে নোটের মালিক নিজে দেখার আগেই পাণ্ডার ছোঁ-এ হাতছাড়া। ‘এটা না এটা না’ বলে ছাত্রটি আর কিছু বলার আগেই পাণ্ডার ধাক্কা, এই পাগল পাগল ! বাইর হ বাইর হ ! যে নোট বাবার পাত্রে জমা হয়ে গেছে তা আবার ফেরৎ নেবে ! বড় সাংঘাতিক কথা ! নজরানা তো জমা হয়েই গেছে, মাঝখান থেকে বেচারাকে ঠেলে বের করে দেয়া হচ্ছে ! খুবই অপমানকর অবস্থা। যাক, আমাদের মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে বিষয়টা শেষপর্যন্ত এতোটা হতাশাজনক খারাপ পরিস্থিতিতে আর গড়ায়নি। তবে আশ্চর্য হলাম, বাবা তাঁর বয়ানেই ব্যস্ত, এদিকে তিন চার হাত দূরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা বুঝি তিনি জানেনই না !

রুমে ঢুকেই যে দৃশ্যটা প্রথমে চোখে পড়লো তাতেই আমার মাথা ঘুলিয়ে গেলো ! আহা, প্রায় সব মুরিদানই বাবার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে জলচৌকিতে বিছিয়ে রাখা বাবার পায়ের তালুতে মুখ নামিয়ে নিবিড় চুমু খেয়ে যাচ্ছে ! তাও কি সম্ভব ! চিন্তার অগম্য এরকম দৃশ্যে আমি মোটেও প্রস্তুত নই। ধর্মীয় বিধানে কী বলে জানি না। তবে কারো পায়ে সরাসরি চুমু খাওয়া ব্যক্তিগত রুচিতে আমার সাংঘাতিক আঘাত করলো। যা বোঝার তা বুঝলাম কিনা জানিনা। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আর বিন্দুমাত্র আগ্রহও রইলো না আমার। আস্তে করে সটকে পড়লাম।

[০৬]
রাতের খাবার সেরে মাদ্রাসায় ফিরে আমার জুতো জোড়াটা কোথাও খুঁজে পেলাম না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ফজরের নামাজ সেরে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে সঙ্গিরা আমার ঘুম ভাঙালেন ফের। এক কাপড়ে গা ঝাড়া মানুষ আমি। ওঠেই বিষন্নতায় ভার হয়ে আসা শরীরটাকে নিয়ে সোজা গাড়িতে চড়ে বসলাম। বিরতিহীন দীর্ঘ এক ফিরতিজার্নি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় আঙিনায় এসে নগ্নপায়ে নামলাম যখন, বন্ধুদের বিস্ময়মাখানো প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সপক্ষে নিরুদ্দেশফেরা আমার একটাই উত্তর তখন-
হা হা হা ! বেয়াদপি করিলে তকদিরে পোকায় ধরিবে !
(২৯/০৮/২০০৮)

[mukto-mona]
[sachalayatan]
[khabor.com]
[sa7rong]
[amarblog]
[muktangon-nirmaaanblog]

Monday, August 25, 2008

@ সমুদ্রের যে সমুদ্র গুপ্তই থেকে গেলো





সমুদ্রের যে সমুদ্র গুপ্তই থেকে গেলো
-রণদীপম বসু


@ পথ চললেই পথের হিসাব

‘তুমি বললে ফুল/ আমি বললাম কাগজের নিষ্প্রাণ গন্ধহীন/ তুমি বললে যাই হোক/ তবুও তো ফুল/ মানুষটা তো কাগজ কেটে কেটে/ কামান বন্দুক মারণাস্ত্র বানাতেও পারতো’...

মানুষের শ্রেয়বোধে এমন গভীর আস্থা ঢেলে যাঁর কলম থেকে এরকম সুবর্ণ পঙক্তি ঝরে, তাঁর কি কোন অভিমান থাকতে পারে ? তবু ঝরে যাওয়া কালির মতো এরকম কিছু পঙক্তিচিহ্ণ রেখে ঠিকই চলে গেছেন তিনি আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কী এমন অভিমান তাঁর ?
‘চুমু খেয়ে ঠোঁট সরাতে না সরাতেই/ তোমার ওষ্ঠ সরে যায়/ হাজার বছর খুঁজেও কেউ/ সেই চুমুর চিহ্ণ খুঁজে পাবে না/ একই পথ একই পা পদক্ষেপ/ তবু প্রতিবার প্রতিটি চুমুর পরে/ তোমার ওষ্ঠ সরে যায়/ কেউ কোনদিন একই পথে দু’বার হাঁটে নি/... চুমু খেয়ে ঠোঁট সরাতে না সরাতেই/ তোমার ওষ্ঠ সরে যায়/ আমার স্মৃতিতে শুধু/ চুমুস্মৃতির খড় লটকে থাকে।’
--- (দুঃখ/ মাথা হয়ে গেছে পাখা শুধু ওড়ে)

এই লটকে থাকা স্মৃতির খড় খুঁজে খুঁজে এক জোড়া অবাধ্য পা ঢুঁড়ে বেড়িয়েছে এই বাংলার প্রতিটা জনপদ, নদীতীর, অরণ্য ; খুঁজে ফিরেছে নদী আর নদীর উৎসে ফেরার চিরায়ত সুর, মোহনার অন্ধকারে যা নাকি কেঁদে ওঠে বিহ্বলতায়। কুড়িয়েছে কষ্ট, সুখ, আজন্মের না পাওয়ার ব্যথা। হাঁটতে হাঁটতে বৃক্ষের চোখে চোখ রেখে ডুবে গেছে অদ্ভুত সাযুজ্যে মাখা মানুষের অচেনা বোধের এক মায়াবী আঁধারী ডোবায়। কিছুতেই মানে না বিস্ময় ! তাই বুঝি লুকানো থাকে না তাও-
‘পাতার মানচিত্র রঙ ও রেখা চেনা থাকলে/ গাছ চিনতে ভুল হয় না/... কথা, মানুষ-গাছের পাতার মতো/ কথার মানচিত্র রঙ ও রেখা/ আমাদের এক থেকে অন্যকে পৃথক করে দেয়/... কেবলই কাণ্ড শাখা বাকলসমেত দাঁড়িয়ে থাকলে/ মানুষকে আর চেনা যায় না ’
--- (কথা বললে চেনা যায়/ মাথা হয়ে গেছে পাখা শুধু ওড়ে)

কী আশ্চর্য পারঙ্গমতায় আমরা বুঝে যাই, এই মানুষ চিরকালই অচেনা। তবু চলতে চলতে পথের ক্লান্তি এলে এই মানুষ-গাছের তলাতেই জিরিয়ে নিতে হয় তাঁকে। কেননা অচেনার সাথে চেনার মিতালী করেই তাঁকে যে পাড়ি দিতে হবে বহু পথ। আজন্মের উদ্দিষ্ট স্বপ্নের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার যে দুর্বার মোহ তাঁকে পথে নামিয়েছে, তিনি জানেন এই পথেরও মোহনা থাকে নদীর মতো। আর নদী মানে জীবন, মানবিক প্রবাহ। ওখানে যে কুলকুল সুর বাজে তা শুধু জলের খেলা নয়, প্রবহমানতার চিরায়ত স্পন্দন। এ থেকে বিশ্লিষ্ট নয় কেউ। চাইলেও হতে পারে না। ওই মোহনার উদ্দেশ্যে মানুষ চিরকাল ছুটেছে, ছুটছে এবং ছুটবেও। নদী ছুটন্ত, মোহনা স্থির। বুকে নদীর স্বভাব নিয়ে যে মানুষটি এভাবেই ছুটে যায় আজীবন, তার সাথে কি নদীর সখ্যতা হয় শেষে ? এ প্রশ্নে এসে আমরাও থমকে যাই। তিনিই থমকে দেন আমাদেরকে। এক অনিঃশেষ বিভ্রমে জড়িয়ে দেন-
‘অদ্ভুত চরিত্র নদীর/ এই কিছুকাল আগে যেখানে যেভাবে ছিল/ আজ আর সেখানে নেই/ আগামীকাল এখানে থাকবে না/
অদ্ভুত চরিত্র মানুষের/ এই কিছুকাল আগে যেখানে যেভাবে ছিল/ আজ আর সেখানে নেই/ আগামীকাল এখানে থাকবে না/
কেবলমাত্র স্বাধীনতার চরিত্র অপরিবর্তিত/ কিছুকাল আগে যেমন যেভাবে ছিল/ আজো সেখানে সেভাবেই আছে/ আগামীকাল এখানে এভাবেই থাকবে/
শুধু/ নদী ও মানুষেরা, অনেকেই/ স্বাধীনতা থেকে অনেকখানি প্রস্থান করেছে’

--- (শুধু নদী ও মানুষেরা/ মাথা হয়ে গেছে পাখা শুধু ওড়ে)

মানুষ ও নদীর সাথে আচমকা এই স্বাধীনতা নামের স্বপ্নবিভ্রমে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আমাদেরকে হতবিহ্বল হতেই হয়। কেননা উদ্দিষ্টকে হাতের কাছে পেয়েও আমরা বিহ্বলতা মুক্ত হতে পারি না। কারণ কল্পনার যে আদি-বন্ধন বুকে ধারণ করে তাকে চেয়েছি আমরা, তাকে তো এর আগে দেখা হয়নি আমাদের। বহু ত্যাগ আর তিতিক্ষায় পাওয়া এই কি সেই আমাদের চাওয়া ? এ কেমন স্বপ্নমুখ !
‘আমাদের ধূলি ও মাটির ছোট ঘরে/ স্বপ্ন এসে থানা গাড়লে আমাদেরই থাকার জায়গা থাকে না/ স্বপ্ন এলে ঘাটতি পড়ে কাঁথা বালিশ চাটাই/ আবার বাসন বাটি../ আমাদের গরীবের ঘরে/ স্বপ্ন যেন ধড়িবাজ পীর../ অতিকষ্টে গরীবের ঘরে যা কিছু বা খুঁদ কাঁকর জমে/ স্বপ্নের ঘুঘু এসে তাও খেয়ে যায়’
--- (স্বপ্নের ঘুঘু/ স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)

আহা ! হঠাৎ করে আমাদের স্বপ্নগুলো এমন হয়ে গেল কেন ! তবে কি আমাদের চাওয়াতে ফাঁক ছিলো ? কল্পনায় খুত ছিলো ? না কি স্বপ্নটাই গড়া হয়নি কখনো ? যাকে এতোকাল সব পূরণের স্বপ্ন নামে ডেকে এসেছি, তাকে পেতে বিলিয়ে দিয়েছি বাদ বাকি সবকিছুই, সে-ই যদি এসে মুখ রাখে তলানিতে, এ কোন্ স্বপ্নের পিছে তবে এতকাল ছুটা ! বড় বেশি বাস্তব আর রুক্ষতায় খেয়ে ফেলে সময়ের সমস্ত সম্ভাবনা আমাদের। জীবনের জটিল মগ্নতায় দুঃস্বপ্ন তাড়িত বোধ আসলে আমাদের স্বপ্নকে আর স্বপ্ন হয়ে ওঠতে দেয় না মোটেও। আমাদের দেখাগুলো নিমেষেই পাল্টে যায় ব্যাখ্যাহীন এক আচ্ছন্নতায়। স্বপ্নকে আর স্বপ্ন বলে মেনে নিতে দ্বিধামুক্তি ঘটে না আমাদের। স্বপ্নহীন সময়াক্রান্ত আমরা কিছুতেই যেন নিজেকে অতিক্রম করতে পারি না আর-
‘স্বপ্ন এসে টোকা দিলে/ টোকা শুনে কপাট খুললে/ স্বপ্নের অশ্ব এসে পিঠ পেতে দেয়/ এখন এমন সময়/ অবলীলায় সেই অশ্ব/ দুঃস্বপ্নের ঘোড়া হয়ে যায়’
--- (সেই দিন/ স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)

স্বপ্নের দ্বারা প্রতারিত হলেও মানুষ দুঃস্বপ্নের কাছে আপোস করে না কখনো। তবুও স্বপ্নগুলো যখন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়, মানুষ হয়ে যায় অবলম্বনহীন। আর এভাবেই বেড়ে ওঠা দুঃসহ অভিমানে হয়তো সব কিছু ছেড়েছুড়ে একদিন হয়ে যায় নিরুদ্দিষ্ট সে। এটাই কি মানুষের নিয়তি ! তিনিও কি তাই করেছেন ? এর উত্তর খুঁজতে গেলে যে ফের নতুন করে জীবন শুরু করতে হয় !

@ যে সমুদ্র গুপ্তই থেকেই গেলো

মানুষের কোন সীমানা নেই। এই অফুরন্ত সীমানা ভেঙে ভেঙে যিনি নতুন নতুন সীমানা গড়ে যান তিনিই কবি। আর সীমানা ভাঙার খেলা খেলতে খেলতে যিনি কবি না হয়ে ওঠলে তাঁর পরিচয় হতো সেই পৈত্রিক বন্ধনে মোড়ানো মিয়া আব্দুল মান্নান নামে, হয়তো কোন অখ্যাত গৃহকোণে আবর্তিত হতো তাঁর গার্হস্থ্য সুখের জীবন। তা না হয়ে তিনি হয়ে গেলেন এক বোহেমিয়ান সমুদ্র গুপ্ত। মানুষের চিরায়ত সমুদ্রটা যে তাঁর বুকে গুপ্ত হয়ে আছে, এই বোধ কখন এসেছিলো তাঁর ? যতটুকু জানা যায়, ২৩জুন ১৯৪৬ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার হাসিল গ্রামের পৈত্রিক ভিটায় পিতা মোহসিন আলী মিয়ার ঔরসে মা রেহানা আলীর গর্ভে জন্মানো শিশু মান্নান তার কৈশোর উত্তীর্ণের আগেই পিতার জীবিকা সূত্রে বাংলাদেশের ষোলটি জেলার স্কুলে পড়া আর ছাড়ার মধ্যদিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন। দুরন্ত কৈশোরে যার এভাবেই ঘুরে ঘুরে চৈতন্যের শুভ্র পায়ে আঁকা হয় মানুষের বিচিত্র জীবন আর ঘরছুট নদীর স্বভাব, নিরীহ ঘরের কোণ তাকে কি বাঁধতে পারে আর ! সেই যে হাঁটা শুরু করলেন তিনি, আর কি থেমেছেন ? না, থামেন নি। নদীর মতোই গন্তব্য গড়েছেন মানুষ নামের মানুষের বুকের সমুদ্র খোঁজায়। জীবনভর নদীর স্বভাব নিয়ে নদীই তাড়িত করেছে তাঁকে। তাই তো তিনি নদীর উৎস খুঁজে কোথায় কোথায় চলে যান, চলে যান নদীর গন্তব্যেও।

বিএ পাশ করে তারুণ্যে বোহেমিয়ান সমুদ্র তখনো সমুদ্র হয়ে ওঠেন নি। ছয়ের দশক বা প্রচলিত অর্থে ষাটের দশকের উত্তাল সময়টাতে পৈত্রিক নামেই ঝরাচ্ছেন পঙক্তিমালা। ঢাকায় সংবাদকর্মীর প্রকাশ্য ঠিকানা গেড়ে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তুমুল উৎকণ্ঠায় জড়িয়ে গেছেন বামপন্থী ভূতলরাজনীতির অনিবার্যতায়। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত তিনি। বাঙালির ইতিহাসের রক্তাক্ত আর আলোকিত ঘটনাপুঞ্জের সাক্ষীও হয়ে যাচ্ছেন একে একে। এভাবেই একজন সমুদ্র গুপ্তের উত্থানকে ধারণ করে একজন আবদুল মান্নান, মুক্তিযোদ্ধা নং- ১১৮৮ যখন অস্ত্রহাতে বিজয়ীর বেশে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন, তখন তিনি যে সম্পূর্ণই একজন সমুদ্র গুপ্ত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীন দেশে নিশ্চিত জীবিকার সংস্থানে না গিয়ে ফের হাতে তুলে নেন স্বপ্নের কলমটাকেই। এভাবেই বুঝি নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে যায় বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্য কখনোই পাওয়া হবে না তাঁর। পাননিও। যে কিনা মাটি আর মানুষের স্বাধীনতাকে উদ্দিষ্ট করে এক তুমুল স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে সমুদ্রের উপমা ধারণ করেন, তাঁর কাছে এই তো স্বাভাবিক। নইলে কী করে বলেন তিনি-

‘আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে আমি/ অভিবাদন জানাবো/ যিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে/ দিন দিন শিক্ষিত করে তোলেন, যিনি/ তাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ/ একটি একটি করে খোলেন, আর/ আমাকে দেখান/ মানুষের কব্জির যাবতীয় কাজ ও কারুকাজ/ তিনি দেখান আর বলেন কোমল স্বরে/ শ্রেণীযুদ্ধের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস/ আমার চোখের সামনে একেকটি প্রাচীন গুহামুখ/ খুলে যায় নিঃশব্দে/ বৃদ্ধের দুই চোখ জ্বলে ওঠে/ মোমবাতির শিখার মতো সাবলীল নরোম আলোয়/ আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী/ লক্ষ বছর ধরে হেঁটে যাই পা গুণে গুণে/ চোখে খোলা তলোয়ারের ঝিলিক/ আঙুল জ্যামিতিক কাঁটার মতো নির্ভুল, আর/ নিঃশ্বাস পিঁপড়ের চেয়েও বেশী স্পর্শপ্রবণ/
প্রত্যেক যাত্রার শেষে সেই সৌম্যবৃদ্ধ বলেন/ মানুষের ইতিহাস ক্রমশঃ এগোয় সম্মুখে/ সমৃদ্ধতর এবং বেঁচে থাকার দিকে/ আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি, মুহূর্তেই শিখে ফেলি/ মানুষের চেতনা যতোই স্বপ্নাবৃত থাক/ একদিন এই স্বপ্ন ভাঙবেই/ স্বদেশের মানুষেরা ফিরে আসবে মাতৃভূমির স্বাধীনতার দিকে/ এবং/ রৌদ্রের বিপরীত ঝিলিকে ঝিলকে উঠবে জীবনের চোখ/ আমি/স্বাধীনতার তুমুল লড়াই শেষে/ করমর্দন করবো আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে/ আমি তাঁকে জানাবো অভিবাদন/ যাঁর/ নির্ভুল নির্দেশে/ রাত্রি শেষের মোরগের মতো ডেকে ওঠে আমার জীবন’

--- (আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধ/ কার্ল মার্কস এর জন্মদিনে)

এই শিক্ষিত নির্দেশনাকে পাথেয় করেই আবর্তিত হতে দেখি একজন সমুদ্র গুপ্তের দুর্মর কবি জীবন। এখানেই উপ্ত রয়ে গেছে তাঁর বিশ্বাস, নির্ভরতা এবং সামগ্রিক দর্শনটাও। ষাটের দশকের অন্যান্য কবিদের সাথে সমুদ্র গুপ্তের দৃষ্টিভঙ্গিগত যেটুকু পার্থক্য তা যেমন এখানে চোখে পড়ে, সাদৃশ্যটাও এখানে পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক রাজনৈতিক কারণেই বক্তব্যে উত্তাপ, বর্ণনায় সরলরৈখিক স্পষ্টতা আর শিল্পগভীরতাকে অস্বীকার করে নিজেকে ছড়িয়ে দেবার স্বাধীনস্পৃহায় ওই দশকের কবিদেরকে তীব্রভাবে আক্রান্ত হতে দেখি। অধিকার আদায়ের উত্তাল চেতনা ধারণ করে খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই শিল্পের চাইতেও জরুরি হয়ে ওঠে মানুষের স্বাধীনতাবোধ। কবিও সমাজের বাইরের কেউ নন। বরং অগ্রবর্তী সামাজিক মানুষ। শিল্পের হাতিয়ার নিয়ে তাঁকেই তো এগিয়ে আসতে হবে আগে। তাই শিল্পের ঘোরপ্যাঁচের চাইতে বক্তব্যের ঋজুতাই সময়ের দাবী হয়ে ওঠে আসে কবিতায়। শিল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতা বুঝি একেই বলে। আর এ কারণেই সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে সমুদ্র গুপ্ততেও দেখি কবিতায় নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পসুষমা মেনে পঙক্তির চিত্রকল্প বুননের চাইতেও জরুরি হয়ে ওঠে বক্তব্য প্রকাশের শিল্পদক্ষতা। কবি হিসেবে যেমন শিল্পের দায় এড়াতে পারেন না, তেমনি সমাজ ও সময়ের দাবীও উপেক্ষা করেন না তিনি। এ দুয়ের মিশেলেই গড়ে ওঠেছে তাঁর কবিতার শিল্পবৈভব।

‘ছেলেবেলায় একবার এক/ সম্পন্ন আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে/ কারুকার্যময় আলমারির ভিতরে রাখা/ সুন্দর পুতুল দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে/ আলমারির কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলাম/ পুতুলের কাছ থেকে ফিরে এসেছিলো/ রক্তাক্ত ক্ষুব্ধ আঙুল/
যৌবনে-/ চমৎকার তিল দেখে/ হাত দিয়ে ছুঁতে যেতেই/ তোমার লাল গাল থেকে/ উড়ে গেলো মাছি/
এখন তো/ চতুর্দিকে দেখতে শুনতে/ চলতে ফিরতে শুধু বিভ্রান্তই হই/ খরায় বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে/ আকাশ দেখতে দেখতে যখন/ মেঘ দেখে উৎফুল্ল হই/ অকস্মাৎ বুঝে ফেলি/ মেঘ নয় আকাশ রেখেছে ঢেকে/ আণবিক ধোঁয়া/
গমের শিষের মতো কোমল/ আমার স্বপ্ন যখন/ শিশিরের স্বপ্নে বিভোর/
ভোর না হতেই এই/ আমাদের প্রশান্ত আকাশে জমে/ পরমাণু বিস্ফোরণের ধোঁয়া/
ভেজা ঠোঁট দেখে যখন ভাবি/ চুম্বনের এই বুঝি উৎকৃষ্ট সময়/ ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে যেতেই দেখি/ ঘৃণা যেন জমাট চাঁচের মতো/ কঠিন জমেছে’

--- (বিভ্রম/ স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
এমন বিভ্রম সমুদ্রের কবিতায় প্রায়শই দেখি আমরা। এ বুঝি তাঁর দীর্ঘ ভ্রমন অভিজ্ঞতার নির্যাস। এ ভ্রমন তাঁর কবিতার, পরিযায়ী জীবনের। তাঁর অন্তর্গত কবিসত্তার মর্মভেদী দৃষ্টি তাই সেই সব সত্যগুলোকে কী নির্মম শিল্প আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলে। তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি। যাযাবর মনে গৃহের ঘেরাটোপে স্বস্তি কোথায় ! মুক্ত আকাশের টানে মাটির টানে বেরিয়ে পড়তেই হয় তাঁকে। এই মাটি তাঁর সমগ্র সত্তা জুড়ে বিছিয়ে রেখেছে স্বপ্নের আঁচল। যেখানে নদী আর সবুজে জড়াজড়ি করে থাকে সেই বাস্তুভিটার সন্তান তিনি এই মাটিকে চেনেন গভীর, দেখেন আরো গভীর করে। তাই তো মুঠো ভরে তুলে নেন যে মাটিকে, তা কি শুধুই মাটি ? মানুষ ভুলে গেলেও মাটি তার ঐতিহ্য ভুলে না। সমুদ্র তা জানেন বলেই দৃষ্টি তার চলে যায় মাটির গোপন শিকড়ে, যেখানে লেখা থাকে সেই রক্তাক্ত ইতিহাস গাঁথা। সমুদ্র তাও পড়ে শোনান আমাদের-
‘আদর্শ বর্গ আয়তনে/ সর্বাপো ক্ষুদ্র পরিমাপের/ একখন্ড মাটি নিয়ে হাতে তুলতেই সন্দেহ হলো/ লাল নাকি ! মাটির মতো লোহাও লবন !/
নানান চেহারা ছবি নানান ভঙ্গি/ একটুকরো মাটির বর্গে/ একেক আলোর নিয়মে একেক ঘটনা ফোটায়/
অজ্ঞান হতে হতে মানুষেরা বিস্মিত হতে পারে/ তবু, মাটি ধরে রাখে/ আকাশের নীচের সকল ঘটনা/
মাটি মাটিতে রাখলে মাটি/ হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি/ রক্তে ভিজে যায়’

--- (এই বাংলার মাটি)

কী স্বপ্নসন্ধ উচ্চারণ ! মাটি মাটিতে রাখলে মাটি, হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায় ! কলমের একটা আঁচরে এমন শেকড়ছোঁয়া উচ্চারণ বাংলা কবিতায় খুব কমই চোখে পড়ে। এরকম উজ্জ্বল পঙক্তি সমুদ্রের কম নেই। সমুদ্রের আরেকটি যে বিশেষত্ব তাঁকে বিশিষ্ট করে রেখেছে, ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম তাঁর কবিতায় গলাগলি করে হাঁটে-
‘ভালোবাসা হচ্ছে এক প্রকার পাথর/ দুজনে এক সাথে ছুঁয়ে দিলে/ নড়ে চড়ে কথা বলে, আলো বিকীরণ করে/ ছুঁয়ে না দিলে/ আলো না জ্বললে/ ভালোবাসা কেবলই পাথর/
দেশপ্রেম কেবলই বরফ/ মিছিলের উত্তাপে গলে’

--- (পাথর ও বরফ)

সমুদ্রের খুব কম কবিতাই রয়েছে যেখানে স্বাধীনতার বোধ উচ্চকিত থাকে না। এটা তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরতা, অন্যদিকে অভাববোধও। বন্ধনমুক্তির অবচেতন ইচ্ছাই তাঁকে এভাবে চালিত করে। সুদৃশ্য ষ্ট্যালিনগোফ আর নদীর বহতা মাখা শুভ্র দীঘল চুলের সন্তচেহারার এ কবিকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন তাদের কাছে ষাট পেরনো সমুদ্র গুপ্ত আর ঘাট পেরোনো নদীর সাথে কোন তফাৎ ছিলো কি ? কোন বাঁধা না মানার স্বভাবপ্রিয়তাকে তিনি তাঁর কবিতায়ও স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেছেন। এজন্যেই কি তিনি তাঁর কাব্যের প্রকরণশৈলীতে কোন বিরামচিহ্ণ বিশেষ করে পূর্ণযতি বা দাড়ির ব্যবহার এড়িয়ে গেছেন সযত্নে ? পাঠকের স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করে দিতেই কি উন্মুখ তিনি ? আর স্বাধীনতার অনুষঙ্গ হিসেবে নদী গাছ মানুষকেই তাঁর পর্যবেক্ষণের প্রধান ও প্রিয় বিষয় করে নিয়েছেন।
‘স্বাধীনতা জিনিসটা অন্যরকম/ একেক পরিপ্রেক্ষিতে একেক বিষয়কেন্দ্রে/ একেক পরিস্থিতিতে একেক চাহিদাক্ষেত্রে/ স্বাধীনতার একেক চেহারা/
আজ যা তোমার স্বাধীনতা/ একই সাথে অন্যের ক্ষেত্রে বিপরীত/ আবার/ সহসাই এটির চিত্র ও ভঙ্গি পাল্টে যায়/
নদীর স্বাধীনতা/ কখনো উৎসে কখনো মোহনায়/ কখনো কেবলি তার আকুল যাত্রার স্রোতে/
মানুষের স্বাধীনতা/ প্রতিদিন একই অবস্থানে থাকে/ মানুষ কখনো স্বাধীনতার নিকটবর্তী হয়/ আবার কখনো দূরে সরে যায়’

--- (মানুষের নিয়ম)

‘তোমরা কীভাবে যে কি কি বলো বুঝতে পারি না/ নদীর চলে যাবার কথা বোঝা যায়/ নদীর থেমে থাকার কথা বোঝা যায়/ ঘাস খেতে খেতে/ বাছুরের মাথা তুলে আকাশ দেখার কথা বোঝা যায়/ মেঘ ও বৃষ্টির ভাষা বোঝা যায়/ পথ ও বিপথের কথা বোঝা যায়/ সন্ধ্যা কিংবা সকাল/ বৃষ্টি ও রোদের ভিতরে গাছের ভাষা বোঝা যায়/
চাল কিভাবে গুমরাতে গুমরাতে ভাত হয়/ তা-ও বোঝা যায়/ কিন্তু/ তোমরা কি কি যে কীভাবে বলো বোঝা যায় না’

--- (বন্ধুদের প্রতি)

যে কবি অনায়াসে নদীর ভাষা বোঝেন, বাছুরের ভাষা বোঝেন, মেঘ বৃষ্টি পথের ভাষা বোঝেন, বৃষ্টি ও রোদের কিংবা গাছের ভাষা বোঝেন, শেষপর্যন্ত উদ্দিষ্ট লক্ষ্য যাঁর মানুষের বুকের কন্দরে থাকা অব্যক্তের সন্ধান, সেই তিনি মানুষের ভাষা বোঝেন না ! যারা তাঁর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে, চা খায় গপ্পো করে, এতোকাল যারা তাঁর সহচর তাদের ভাষা বোঝেন না ? এখানেই সমুদ্র গুপ্তের কাব্যিক অনন্যতা। সহজ সরল প্রকৃতির নিসর্গের মধ্যে কোন লোভ থাকে না লালসা থাকে না কৃত্রিমতা নেই বলে প্রকৃতি বিশাল সুন্দর স্বচ্ছ এবং লাবণ্যময়। তাকে বোঝা যায়। হানিকর নয় বলে বুকে টেনে নেয়া যায়। অন্যদিকে মানুষ কৃত্রিমতায় আবিষ্ট এক জটিল সত্তা। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল বহুরূপী এবং কুটিলতা আর প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রীকতায় আচ্ছন্ন। কবির সহজ স্পন্দনে এই জটিলতা তাঁকে বিক্ষিপ্ত করে, ক্ষুব্ধ করে, কষ্ট দেয় এবং কখনো কখনো মানুষকে মানুষ বলে চিনতেও বিভ্রম জাগে। আজীবন মানুষের শ্রেয়বোধে আস্থাশীল কবি তাই এই হতাশাই ব্যক্ত করেন পঙক্তিতে পঙক্তিতে। মানুষের প্রতি বিশ্বাসবোধের এ এক ভিন্ন উপস্থাপন। একই ভাবে নাগরিক জীবনের তুমুল অসংগতিগুলোও কী চমৎকার ক্ষীপ্রতায় পঙক্তিলগ্ন হয়ে ওঠে-
‘তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সভা শেষ হলে/ বক্তৃতার মধ্যেকার মিথ্যাগুলো/ বাদুড়ের মতো উড়ে যায় বিভ্রান্তির অন্ধকারের দিকে/ সেখানে রয়েছে স্বার্থের ডাঁসা পেয়ারা/ খাবে কামড়াবে ছড়াবে ছিটকাবে আর/ বাকিটা নষ্ট করবে এমনভাবে যেন/ অন্য কারও আহারে রুচি না হয়/ তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে সভা শেষ হলে/ বক্তৃতার মধ্যেকার ধাপ্পাগুলো/ উকুনের মতো দৌড়াতে থাকে লোভের চামড়ার দিকে/ সেখানে রয়েছে এঁটে রক্তের সূক্ষ ফোয়ারা/ কামড়াবে খাবলাবে আঁচড়াবে আর/ চামড়ার ঘা বানাবে এমনভাবে যেন/ নখ আঙুল বা চিরুনির দাঁত লাগাতেও বেদনা হয়/
তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সভা শেষ হলে/ সকলেই চলে যায় আপন গন্তব্যে, শুধু/ সভাস্থলে পড়ে থাকা সত্যের লাশ দেখে/ বাস্তবতা কাকের মতো ওড়ে আর হাহাকার করে/ কারোই কুড়িয়ে নেবার মতো কিছুই আর থাকেনা পড়ে’

--- (সভা শেষ হলে)

এই নাগরিক বোধ আসলে তিনি রপ্ত করেছেন সম্পন্ন কবিজীবনের শুরুতেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। এর আগের দু’দশকের একটানা কবিতাচর্চায় তিনি ছড়া বা পয়ারসুলভ সমিল কবিতা লিখেছেন প্রচুর। কিন্তু প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতাটিতে ছন্দোমুক্তির আভাষ দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন ওগুলো ছিলো তার শিল্পব্যাকরণে ঋদ্ধ হয়ে ওঠার প্রস্ততিকালের চর্চা। পরিণতপর্বে আর কখনোই ফিরিয়ে আনেননি তিনি। গ্রন্থবদ্ধ প্রথম কবিতাতেই ব্যবহার করলেন এক অদ্ভুত প্রতীকী। রাজপথে নির্বিকার শুয়ে থাকা একটি কুকুর হয়ে গেলো স্বদেশভূমির অভূতপূর্ব প্রতীক !
‘রাস্তার মধ্যিখানে শুয়ে আছে নির্বিকার একটি কুকুর/ গাড়ি ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক/ পাশ কেটে কুকুরের মাথার, ছায়ার/ প্রাণহীন কুকুরের হৃদপিণ্ড কুঁকড়ে গেছে/ খামচে ধরে রাজপথ কোঠাবাড়ি নাগরিক বিশাল শহর/
বড়লোক গাড়ির নীচে চাপা পড়ে মানুষ আর/ মানুষের সরল জীবন- এটাই নিয়ম, অথচ/ কি তাজ্জব ! সমস্ত বিত্তশালী গাড়ি ঘোড়া/ সতর্ক স্টিয়ারিংয়ে পাশ কাটছে/ শুয়ে থাকা কুকুরের লাশ/ যেন, এই লাশটাকে বাঁচাতেই হবে/
পৃথিবীর রাজপথে চিৎপাত শুয়ে থাকা/ এরকম কুকুরের লাশ যেন বাংলাদেশ/
আসলে তো, বাংলাদেশ মানেই হলো/ জীবনের মুখোমুখি বুলেটের অসভ্য চিৎকার/ শোকচিহ্ণ কালোব্যাজ পৃথিবীর শহীদ মিনার’

--- (কুকুর/ রোদ ঝলসানো মুখ)

রাজনীতি সচেতন আপাদমস্তক কবি সমুদ্র গুপ্ত। প্রথম গ্রন্থেই দেয়া এই উজ্জ্বল পরিচয় পরবর্তী গ্রন্থগ্রন্থগুলোতেও সমানভাবে দীপ্যমান। তীব্র যে জোয়ার বুকে নিয়ে লিখে গেছেন অজস্র, সে তুলনায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ কি খুব পেয়েছি আমরা ? রোদ ঝলসানো মুখ (১৯৭৭), স্বপ্নমঙ্গল কাব্য (১৯৮৮), এখনো উত্থান আছে (১৯৯০), চোখে চোখ রেখে (১৯৯১), একাকী রোদ্রের দিকে (১৯৯২), শেকড়ের শোকে (১৯৯৩), ঘাসপাতার ছুরি (১৯৯৮), সাত সমুদ্র (১৯৯৯), নদীও বাড়িতে ফেরে (২০০০), ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেই পথ (২০০৩), চলো এবার গাছে উঠি (২০০৪), হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায় (২০০৬), মাথা হয়ে গেছে পাখা শুধু ওড়ে (২০০৮), তাহলে উঠে দাঁড়াবো না কেন (২০০৮), ডিসেম্বরের রচনা (২০০৮) এবং যৌথগ্রন্থ ‘মুক্তডানার প্রজাপতি’ (২০০৬)। একটা সমুদ্রকে কি এই ক’টা পাড় দিয়ে বেধে রাখা যায় ? কূলপ্লাবী স্রোতে জলে আরো যে সব উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবিতা গদ্য প্রবন্ধ আলোচনা ও বক্তৃতা হয়ে ওগুলো যে শঙ্খের মতো সমুদ্রের স্বরকে ধারণ করে নি তা কি বলা যায় ? মুক্তবাণিজ্যের যুগের কোন প্রকাশক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ নিলে হয়তো আমরা পেয়ে যেতে পারি সেই গুপ্ত সমুদ্রকে, যেখানে এক আজন্মের কবি সমুদ্র ডুব মেরে ছিলেন বহুকাল। সময়ের শুদ্ধ ডুবুরীরা তা কি তুলে আনবে না ?

@ ঝিনুক নীরবে সয়েই যায়

‘কে যায় আর কে কে আসে/ বোঝা যায় না/ বিশাল চওড়া পথে/ কতো মানুষ কতো যানবাহন/ এইসবের/ কারা যায় আর কারা আসে/ কে জানে/
যাকে দেখা যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে/ অথচ সে যাচ্ছে না/ তার গন্তব্য থেকে বোঝা যায় সে যাচ্ছে না/ আসছে সে/
আমাদের গমনগুলো/ কীভাবে যে বদলে গেছে কবে/ বোঝাই যায়নি/
এখন সকলেরই যাওয়া কেবলই যাওয়া/ যেন কোন গন্তব্য নেই/ সম্মুখ ও পশ্চাত সব একাকার/ সামনে ও পেছনে বলে কোন পদার্থ নেই/
যেন, যাওয়াটাই উদ্দেশ্য কেবল/ যাওয়াই জীবন/ আমাদের কালে/ ফিরে আসা বলে কোন কথা যেন নেই’

--- (সম্মুখ ও পশ্চাত আজ একাকার/ মাথা হয়ে গেছে পাখা শুধু ওড়ে)

ঝট করে তাঁর এ কবিতাটাই মাথায় এলো, যখন শুনলাম তিনি অর্থাৎ কবি সমুদ্র গুপ্ত গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী। অবস্থা আরো সঙ্গীন হলে তাঁর বন্ধু ও সহচর কবিদের সহযোগিতায় তাঁকে বারডেম থেকে স্কয়ার হাসপাতালে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হলো। স্ত্রী সোহানা হ্যাপী, দুই কন্যা নীল সমুদ্র ও স্বপ্ন সমুদ্রকে নিয়ে একটা মানবিক সুখী গৃহকোণ থাকা সত্ত্বেও আজীবন বোহেমিয়ান কবি যে নিজের জন্য পরিবারের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করেন নি, তাঁর এ বিশাল চিকিৎসা ব্যয়ের প্রথম ধাক্কাতেই যা কিছু অস্থাবর চলে গেছে সব। এরপর প্রতিটা মুহূর্ত মানেই ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের বিশাল সঞ্চয়। এ সঞ্চয় কোন বস্তুগত সম্পদ নয়, বড় বেশি মানবিক, জীবনের অনিবার্য নিঃশ্বাস প্রশ্বাস।
১৯৭০-এর গোর্কীর থাবায় লণ্ডভণ্ড বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ভোলা ও মনপুরায় দীর্ঘদিন অবস্থান করে ত্রাণকার্য পরিচালনা, ১৯৮৮ এর বন্যায় ত্রাণকাজে ঝাপিয়ে পড়া, ১৯৯১ এর চট্টগ্রাম উপকূলে প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে মুছে দেয়া প্রায় কুতুবদিয়া, মহেশখালি ও কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় তিনমাসব্যাপী উদ্ধার ও ত্রাণকাজে লেগে থাকার মতো আরো বহু দুর্যোগে দুর্দিনে সাধারণের পাশে নিজেকে স্বেচ্ছাত্যাগকারী কোনো মানবিক কবিসত্তা যখন তাঁর ক্ষীয়মান দেহ নিয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকে চিকিৎসাহীন অনিশ্চয়তায়, বুঝতে হবে এ জাতিই অসুস্থ। বিবেকের ঘরে বাসা বেঁধে আছে দুঃসময়ের ঘূণ। কোথায় ছিলেন না তিনি ? বাঙালির এমন কোন আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল মিটিং কিংবা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আলোচনা বৈঠক সভা কি বাদ পড়েছে, যেখানে একজন তরুণ আব্দুল মান্নান থেকে সর্বশেষ স্ট্যালিনময় সুপুষ্ট গোঁফ আর চাঁদমাখা উচ্ছল নদীমাখা শুভ্র দীঘলকেশী সন্তের মতো চিরপরিচিত মুখটি কখনো তাঁর নিজস্ব আলো ছড়িয়ে যায় নি ? এক লহমায় কোন ফাইভস্টারের বুফে আর বলরুমে যারা নির্দ্বিধায় উড়িয়ে দেয় লক্ষ লক্ষ টাকা, তাদের এক কামড় ভিনদেশী ফ্রাই থেকে বেশি দামী নয় কবির জীবন। আমাদের ওই সব দেশীয় অহঙ্কারদের কানে একজন মুমূর্ষু কবির বাঁচার আর্তি পৌঁছাবে কেন !

যাদের একবেলার সংস্থান হলে আরেক বেলা পড়ে থাকে অনিশ্চিৎ, শেষমেশ তারাই এসেছে এগিয়ে। তাদের প্রাণের দোসর একজন কবিকে তারা যেতে দেবে না। কিন্তু তাদের সাধের কাছে সাধ্য যে নগন্য খুব। মূল্য দিয়ে যা কেনা যায় না কখনো সেই অমূল্য অফুরন্ত ভালোবাসায় কবি তাঁর অমর্ত্য স্বীকৃতি হয়তো পেলেন ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালের বিল পরিশোধে ভালোবাসা যে অক্ষম। এই উন্মুক্ত বাণিজ্যের কালে ভালোবাসা বৈধ কোন কারেন্সী নয়। তবু কোন চেষ্টা তো বৃথা হয় না কখনো। ওই সব অসংখ্য নগন্যের তিলে তিলে গড়ে তোলা মহার্ঘ সমষ্টিমান অনিবার্য প্রয়োজন ছুঁতে ছুঁতেই দেহের অর‌ক্ষ্য ঘূণে খেয়ে গেছে সব। অতঃপর সমুদ্রের নামে পড়েছিলো যা, শুধু কি সমুদ্রের খোলশ ?

‘এইভাবে বিবাদ ও বিষাদে অন্তহীন ডুবে যাওয়া/ কতদিন আর কতকাল/ দ্বিধাহীন দ্বিত্বহীন একক সঞ্চারে/ চেয়ারের হাতলের সাথে স্ট্যাটাসের শিকলে বাঁধা হাত/ যেন চারপাশে আর কিছু নেই কেউ নেই/
আমরা কি ভুলে যাবো ডুমরিয়া আত্রাই পেয়ারা বাগান/ হাকালুকি শীতলক্ষার রক্তরাঙা জল/ নড়াইল আর চিত্রার অবস্থান একটুয়ো না পাল্টানোর স্মৃতি কি/ স্মৃতি থেকে বিস্মৃতির অতলে তলাবে/
এইভাবে স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে আবর্তিত হতে থাকা/ কতদিন আর কতকাল/ মন ও মননের অমন উত্থান কি আবার আসবে না/
হাওয়াতে কান পেতে থাকি/ নাকশীর্ষে জাতীয় পতাকার মতো ওড়ে মাছি/ হে মাছি/ স্বপ্নের দ্রুততায় পক্ষ ঘূর্ণনে শরীরে বসো না হে/ এখনো মরিনি আমি বেঁচে আছি’

--- (মাছি)

আহ্ ! চলৎশক্তিহীন কবির আর্তি কি ওই মাছি শুনেছে আদৌ ? তাঁর বিভ্রম জাগানো স্বপ্নের মতোই এই মৃত্যুর মাছিটিকে কেউই তাড়াতে পারলো না আর ! ১৯ জুলাই ২০০৮, ব্যাঙ্গালোরের সুরক্ষিত হাসপাতালের বেডে ওই মাছি তাঁর নাকশীর্ষে বসে গেলো ঠিকই। ##
(২৪/০৮/২০০৮)
|Samudra Gupta, the hidden ocean/Ranadipam Basu|

[muktangon:nirmaanblog]
[sachalayatan]
[sa7rong]
[khabor.com]
[mukto-mona]
[amarblog]
[somewherein]
[pechali][episode01][episode02]
[banglamati]

Saturday, August 23, 2008

@ লোকাল বাস ...(ভেজাল গদ্য)







লোকাল বাস ...
-রণদীপম বসু


আনসার ক্যাম্পের বাস স্টপিজটাতে দাঁড়িয়ে আছি। টাউন বাসে উঠবো। কোন ডাইরেক্ট বা গেইটলক সার্ভিসের গাড়ি থামে না এখানে। লোকাল সার্ভিসই ভরসা। কিন্তু অফিস ফেরতা শেষ বিকেলের লোড নিয়ে মিরপুর এক নম্বরের দিক থেকে মুরগিবোঝাই হয়ে যেভাবে গাড়িগুলো একের পর এক সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, বাদুরঝোলা হয়ে আদৌ যে কোনো গাড়িতে উঠতে পারবো সে ভরসা পাচ্ছি না। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই আছি। আগে যা-ও দু’একটা বাস থেমেছে, এখন তাও আর হচ্ছে না। দরজায় ঝুলে থাকা হেলপারের ডবল-থাবার ছন্দে ছন্দে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। এদিকে কালো হয়ে ওঠা আকাশের মতিগতিও সুবিধের মনে হচ্ছে না, কখন যে ঝাঁপিয়ে পড়ে !

আমার পাশের মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটিও বোধ করি আমারই দশায়। তবে তার প্রকাশ্য উশখুশকে তিনি আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করছেন না, এটা তাঁর অস্থিরতাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মনে হয় ফুটন্ত উষ্মাকেও আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। কী জানি কী মনে করে আমাকেই উদ্দেশ্য করলেন।
দেখেছেন ! দেখেছেন !
কী ?
গাড়িগুলো থামছেই না এখানে !
তাঁর উত্তাপ মাখানো কণ্ঠস্বরে একটু ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগিয়ে আমি বললাম, ঝুলবেন যে, সে জায়গাটাও খালি না থাকলে শুধু শুধু কেনই বা থামবে, বলেন ?
ভদ্রলোক এবারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠলেন। কেন ? ফাইজলামী নাকি ! এটা কি ওদের স্টপিজ না ? থামবে না কেন ? যা ইচ্ছা তাই করবে ? যখন লোক থাকেনা, তখন তো পারলে ঘর থেকে টেনে নিয়ে আসে ! যত্তোসব বদমাইশ !...
এমনভাবে বলতে থাকলেন, যেন আমিই সেই অপরাধী ড্রাইভার। বুঝতে পারছি, তাঁর হয়তো কোনো অসম্ভব তাড়া আছে, কিন্তু ফাঁড়ায় আটকে গেছেন। আমি আর কী বলবো। তাঁর কথার তোড় বাড়তেই থাকলো,
..ওগুলোকে ধরে ধরে আচ্ছা করে যদি পাছায় চাবকানো যেতো !...
কথা শেষ হবার আগেই খ্যাশ্শ্শ করে এসে ব্রেক করলো গাড়িটা। এতক্ষণের দাঁড়ানো ভীড়টা পড়িমরি করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমিও ছুটলাম। ভদ্রলোকের কথা ভুলে গেলাম।

মুহূর্তের কয়েকটা ঘূর্ণিপাকের পর গাড়ির পেটের ভেতরে দুমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরে আবার ব্রেক। আবারো কিছু মানুষের হুড়োহুড়ি পাড়াপাড়ি। কোথা দিয়ে কীভাবে কে যে উঠছে আর নামছে তা উপলব্ধি করছি, নিজেকে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া থেকে বাঁচাতে বাঁচাতে ওগুলো ঠাহর করার কোন উপায় নেই। কয়েক কদম গিয়ে আবার ব্রেক। লোকাল বাসে চড়ার এই এক হ্যাপা, না মেনে উপায় কী ? কিন্তু সবাই তো আর আমার মতো নিরীহ নয় ! তাই এদিক ওদিক থেকে প্রতিবাদ ঝলসে ওঠে, এই ড্রাইভার, পাইছো কী ? যাও ! কেউ বলে, শালারা যত পায় আরো খাইতে চায়, এদের পেট ভরে না ; যাও মিয়া ! গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। তা কি যাত্রীর তাড়া খেয়ে, না কি হেলপারের ডবল থাবার প্রভাব সেটা ড্রাইভারই জানে।

একটু গিয়ে আবার ব্রেক। এবার বুঝি যাত্রীদের উত্তেজনা আরেকটু তেতে ওঠেছে। অই মিয়া, ফাইজলামি পাইছো ! কথা কানে যায় না ? কোন এক যাত্রীর হুঙ্কার। এদিকে হুল্লোড়ের মধ্যে ঢাকার অসহ্য পরিবহন সমস্যা নিয়ে যাত্রীদের পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। কারো কারো ক্ষোভ গোস্বাও কানে আসছে, বিশেষ করে যারা সীটে বসার সৌভাগ্যে একটু আয়েশ করার মাজেজা পাচ্ছেন। তাঁদের এতো গুরুগম্ভীর আলোচনার গভীরতা, বেশির ভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
বুঝলেন, আইয়ুব খানের ডাণ্ডাই এ জাতির জন্য উপযুক্ত !
ঠিকই বলেছেন, বেশি প্রশ্রয় দিয়ে এদেরকে এক্কেবারে মাথায় তুলে ফেলা হয়েছে !
যেখানে সেখানে যাত্রী নেবে, গাড়ি থামাবে, দেশে কোন আইন কানুন নাই !
আ-রে আইন কানুন দিয়ে হবেটা কী ? কেউ কি আইন মানে ? এদের জন্য দরকার ডাণ্ডার !
আরে ভাই, কয়জনকে ডাণ্ডা মারবেন ! আমাদের চরিত্র পাল্টাতে হবে।...
কিন্তু আলোচনা এগিয়ে যেতে পারে না। আচমকা ব্রেক খেয়ে গাড়িশুদ্ধো সব হুমড়ি খেয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লো। ওই হালার পুত, আন্ধা নি ? দেইখ্যা ব্রেক করতে পারোছ নাহ্ ! যাত্রীদের এমন উটকো মন্তব্যে যৌক্তিকতা কতটুকু জানি না। তবে কয়েক মুহূর্ত পরে ফের ব্রেক করা মাত্র আমার পাশ থেকে কে যেন ড্রাইভারকে উদ্দিষ্ট করে চীৎকার করে ওঠলো, শালার পাছায় লাত্তি দেন ! ওই শালার পুত, গাড়ি থামাইলি ক্যান ! পথে কি তোর সম্মন্ধি দাঁড়াইয়া আছে !

মন্তব্যের তীব্রতায় ফিরে দেখি সেই ভদ্রলোক ! চোখাচোখি হলো। তাঁর ভাবসাব দেখে মনে হলো না যে তিনি এর আগে আমাকে আর কখনো দেখেছেন। সদ্য আরোহী যাত্রীরা হয়তো এসব মন্তব্যের প্রচলিত অভ্যস্ততায় অপরাধীর মতো আনমনা ভাব করে থাকলেন। কিন্তু আমার কী জানি হয়ে গেলো। ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে প্রায় সবাই শুনতে পায় মতো ভদ্রভাবে বলেই ফেললাম, আপনারা কি কখনো এরকম পথ থেকে গাড়িতে উঠেন নাই ?
আমার প্রশ্ন তিনি শুনলেন বা বুঝলেন কি না বুঝা গেল না। শুধু আমার মুখের দিকে কটমট করে চেয়ে রইলেন !
(২১/০৮/২০০৮)
|Local Bas/Ranadipam Basu|

[sachalayatan]

@ ছড়াসাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিন [Little Magazin]




ছড়াসাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিন
- রণদীপম বসু

দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কলেবর বাড়িয়ে দিলেই যেমন ‘বড়-কাগজ’ হয় না, বিপরীতক্রমে কমিয়ে দিয়েও তা ‘ছোট-কাগজ’ হয়ে যায় না। নতুন স্বর ও সাহসী উচ্চারণে এস্টাব্লিশম্যান্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে সত্যনিষ্ঠ উদারতায় চোখে আঙুল দিয়ে অসারতা চিহ্ণিত করে দেখিয়ে দিতে পারে সে’টাই ‘ছোট-কাগজ’। প্রকৃত অর্থে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রই হচ্ছে প্রতিবাদী ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী। আর তাই প্রথাবিরোধী মেধাবী সৃষ্টিশীলদের সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে এই লিটল ম্যাগ। এর মাধ্যমেই সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তরুণ লিখিয়েদের আনকোরা উপস্থাপন ও সাহিত্যের নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। আর আমাদের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক তো এক কথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। তাই লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা আসলেই বাংলাভাষার অন্যতম খ্যাতিমান লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু’র নামটিও অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসে। চারিত্র্য বিশ্লেষণে লিটল ম্যাগাজিনের স্বরূপ কী হবে এ ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যাকেই মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ‘দেশ’ পত্রিকার মে ১৯৫৩ সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন-

“এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই- যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন আমাদের। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে-চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যে সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেইটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।”

মূল সাহিত্য ধারায় আমাদের দেশে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলেও এমন বিশিষ্টতার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে তেমন কোন ছোট কাগজ আমাদের শিশু-সাহিত্য বা ছড়া-কবিতা’র অঙ্গনে খুব একটা চোখে পড়ে না। আর থেকে থাকলেও এর খিন্ন আয়ু এবং এর প্রাসঙ্গিক অনিবার্যতায় কৌতূহলী সাধারণ পাঠকের কাছে সহজলভ্য থাকে না। তারপরেও কিছু কিছু কাগজ তার চোখ-ধাধানো ঝিলিক দিয়ে স্বাতন্ত্র্যটুকু জানান দিয়ে যায় বৈকি। এরকম কয়েকটি কাগজ হচ্ছে- ছড়াপত্রিকা, প্রতীকী, অন্ত্যমিল, ছড়াড্ডা, চমচম, একফর্মা ছড়াপত্র ইত্যাদি।





ছড়াপত্রিকা

বর্তমান ছড়া-কবিতা অঙ্গনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছেন অথচ ‘ছড়াপত্রিকা’র নাম শুনেন নি এমন কেউ সম্ভবত নেই। দু’বাংলায় সমাদৃত মাহবুবুল হাসান সম্পাদিত ছড়া বিষয়ক অত্যন্ত জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ‘ছড়াপত্রিকা’ ত্রয়োদশ সংখ্যা: ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সংখ্যাটি এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সংখ্যা। উৎকৃষ্ট ছড়ার মতোই কড়কড়ে আমেজ আর নজরকাড়া অঙ্গসৌষ্টব, অনেক ম্যাগাজিনের ভিড়েও আলাদাভাবে চেনা যায়। সুরুচির উৎকর্ষতা শুধু এর চেহারাতেই নয়, ভেতরেও এর সমৃদ্ধি উল্লেখ করার মতো। এজন্যে সম্পাদকীয় যোগ্যতায় মেধা, মনন, সাহস আর পরিমিতবোধের যে সমন্বয় থাকতে হয় তার একশ’ ভাগই রয়েছে মাহবুবুল হাসানের মধ্যে। সদ্য প্রকাশিত এই ত্রয়োদশ সংখ্যাটির সূচিপত্র ওল্টালেই এর নমূনা আন্দাজ করতে পারি আমরা।

কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ নিযামুদ্দীনের লেখা স্মারক গদ্য ‘শামসুর রাহমান; ছড়াতেও যিনি শক্তিমান’, ছড়াকার নূরুল ইসলাম খানের ফিচার ‘একান্ত অনুরোধ’, এখ্লাস উদ্দিন আহমদের বৈঠকী ছড়া নিয়ে ছড়াকার মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের একটি মিঠেকড়া আলোচনা ‘বৈঠকী ছড়া’, ছড়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিশুসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক এমরান চৌধুরীর নিবন্ধ ‘ছড়া হয়ে ওঠা’, কিশোর কবিতার অতীত, গতিপ্রকৃতি ও বর্তমান প্রবণতা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে রণদীপম বসুর গদ্য ‘চারুপাঠের মগ্নকিশোর ও আমাদের কিশোর কবিতা’, সতীশ বিশ্বাসের ছোট্ট গদ্য ‘উত্তর-আধুনিক ছড়া’, ছড়াকার প্রাবন্ধিক চন্দন চৌধুরীর নিবন্ধ ‘প্রকৃত ছড়া- ইঙ্গিতময়তা ও প্রতীকায়নেরই একটি ক্ষেত্র’, ছড়াকার গোফরান উদ্দীন টিটুর নিজস্ব ভাবনা ‘ছড়াশিল্পীর খাতা থেকে’, প্রাবন্ধিক মনজু রহমানের আলোচনা ‘পরিলেখ প্রকাশনী: ছড়াগ্রন্থের ছড়াকার ও প্রসঙ্গাদি’, ছড়াকার সৈয়দা সেলিমা আক্তারের স্মৃতিচারণমূলক খোলাচিঠি ‘বিনি সুতোর মালা’, কবি জুলফিকার শাহাদাৎ-এর বারোটি কবিতা নিয়ে ‘জুলফিকার শাহাদাৎ এবং তাঁর কিশোরকবিতার দ্বাদশ ক্যানভাস’ শিরোনামে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক গদ্যশিল্পী চন্দন কৃষ্ণ পাল এবং দু’টো ছড়াগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেছেন শান্তি মেহ্জাবিন ও নরেন্দ্র সুসন্ধ্যা। তবে এ সংখ্যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মননশীল দীর্ঘ লেখাটি লিখেছেন প্রাবন্ধিক-কবি-ছড়াকার-সমালোচক ইলতুৎ আলীদ।

ছড়াপত্রিকার সম্পাদকীয়তে যদিও উল্লেখ করা হয়েছে- ‘সম্পাদকের বরাবরে লেখক-পাঠকের গুনগান করে লেখা চিঠিগুলো চিঠিপত্র বিভাগে ছাপানোর একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে। আমরা সেই লোভ সংবরণ করেছি বরাবরই। বরং সম্পাদক বরাবরে লেখা কড়া সমালোচনার একটি চিঠি আমরা প্রকাশ করেছি চলতি সংখ্যায়; যেই চিঠিতে পত্রলেখক সম্পাদককেও ছেড়ে কথা বলেন নি মোটেই। সম্পাদক হবার বিড়ম্বনা যে কত!’ মূলত এটাকে চিঠি হিসেবে বিবেচনা করার দুর্মতি হবে না পাঠকের। কেননা ওটা আসলে চিঠির ঘোমটায় গুণ্ঠিত একটি সমালোচনামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধপত্র, তীর্যক মেধাবী দৃষ্টি আর মননশীলতায় ঋদ্ধ।

নবীন প্রবীন অনেক প্রখ্যাত ছড়াকারের অনেকগুলো ছড়া, কেরিহিউ, ছড়াক্কা রয়েছে ম্যাগাজিনটিতে পাঠকের ভাব ও ভাবনার খোরাক হিসেবে। এতে যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর ছড়া লিখে সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ হ’তে সহায়তা করেছেন তাঁরা হলেন- খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, আইউব সৈয়দ, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, জ্যোতির্ময় মল্লিক, ফারুক নওয়াজ, সনাতন চক্রবর্তী, খালেদ হোসাইন, আবুল হোসেন আজাদ, বিপুল বড়ুয়া, সৈয়দ আমির উদ্দিন, সিতাংশু কর, শফিক ইমতিয়াজ, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, জসীম মেহবুব, রমজান আলী মামুন, ইকবাল করিম রিপন, মিজানুর রহমান শামীম, জুবাইদা গুলশান আরা ফেন্সী, মানসুর মুজাম্মিল, জুলফিকার শাহাদাৎ, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, জাহিদ মুস্তাফা, জামান সৈয়দী, ফারুক হাসান, মাহফুজুর রহমান আকন্দ, আদিত্য রুপু, সাজ্জাদ বিপ্লব, সমীর গোলদার, আল রাহমান, মাসুদ কামাল, সনজিত দে, আরিফ বখতিয়ার, টি. এম. পলাশ, আবদুল মতিন রিপন, তুষার আহাসান, মাসুম আওয়াল ও প্রতীক ওমর।
এছাড়া মগ্ন পাঠকের গ্রন্থনায় সন্দেশ বিভাগে রয়েছে ছড়া ও ছড়াকার সংবাদ। তবে ছড়াপত্রিকার উল্লেখযোগ্যম নিয়মিত সংযোজনা গুনী ছড়াকার ও সম্পাদক মাহবুবুল হাসানের শ্রমলব্ধ গ্রন্থনায় বিভিন্ন ছড়াকারের এ পর্যন্ত প্রকাশিত ছড়ার বইয়ের তালিকা। যা আগামী দিনের ছড়া গবেষকদের জন্য নিঃসন্দেহে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।





প্রতীকী

ছড়া সাহিত্য বিষয়ক ষান্মাসিক লিটল ম্যাগাজিন ছড়াকার মিজানুর রহমান শামীম সম্পাদিত ‘প্রতীকী’ প্রকাশিত হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকেই। প্রতীকী’র চলমান সংখ্যাটি অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি/মার্চ ২০০৮ সংখ্যাটিকে দু’টো অংশে ভাগ করা হয়েছে। ছড়াসাহিত্যে যাঁর বিশেষ অবদান অনস্বীকার্য, স্বনামধন্য ছড়াকার ফারুক নওয়াজের পঞ্চাশে পা দেয়াকে প্রয়োজনীয় সম্মান দেখানোর প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে তাঁর সাহিত্য কীর্তি নিয়ে আলোচনা সাক্ষাৎকার ফারুক নওয়াজ অংশ এবং সামগ্রিক ছড়াসাহিত্যের উপর আলোচনা পর্যালোচনা ছড়া কবিতা ইত্যাদি নিয়ে সাধারণ অংশ।
ফারুক নওয়াজ অংশে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের যেসব রচনালেখ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা থেকে একজন ফারুক নওয়াজের বিস্তৃত প্রোফাইল পাই আমরা। এ অংশে তাঁকে নিয়ে গদ্য লিখেছেন ছড়াকার ফারুক হোসেন, জ্যোতির্ময় মল্লিক, মনি হায়দার, রফিকুর রশীদ, আবু সালেহ, জাকির আবু জাফর এবং নিবেদিত ছড়া রচনা করেছেন নাসের মাহমুদ, জিয়া হক, চন্দন কৃষ্ণ পাল, মানসুর মুজাম্মিল, আবু জুবায়ের ও মুহিব নেছার। আদিত্য রুপুর নেয়া ফারুক নওয়াজের একটি সাক্ষাৎকারও রয়েছে এ অংশে।
তবে এ ম্যাগাজিনের সমৃদ্ধ অংশ হলো এর সাধারণ অংশ। এতে রয়েছে ছড়া-কবিতা নিয়ে বেশ কয়েকটা চিন্তাশীল ও বৈচিত্র্যময় গদ্য ও প্রবন্ধ। লেখা ও লেখকরা হলেন ‘শিশুতোষ লোকছড়া: ঐতিহ্যে ও অধুনায়’/ চন্দন চৌধুরী, ‘ছড়া-কবিতায় নজরুলের শিশু কিশোর’/ কমরুদ্দিন আহমদ, ‘কিশোর কবিতা নিয়ে ভাবনা’/ তপন বাগচী, ‘ছড়া নিয়ে ছোট্ট কথা, কিশোরগঞ্জের বাস্তবতা’/ জাহাঙ্গীর আলম জাহান, ‘ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন ও দুঃশাসন’/ রণদীপম বসু এবং ‘রাজশাহীর ছড়া: সাম্প্রতিক পাঠ’/ নাজিব ওয়াদুদ। ছড়া-কবিতার বই নিয়ে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করেছেন ‘মেঘ দিয়ে সাঁকো বাঁধা যায়’/ইলতুৎ আলীদ, ‘আয়রে আয় তুতুয়া আহমেদ জসিমের মজার ছড়াগ্রন্থ’/ জসীম মেহবুব, ‘প্রিয় বই গোফরান উদ্দীন টিটুর আমার ছড়া কইবে কথা’/ শাহানা শাহীন অমি, ‘চঞ্চলা চঞ্চুর লিমেরিক’/ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন, ‘বাক্সে ভরা মজার ছড়া’/ গোফরান উদ্দীন টিটু এবং একটি স্মৃতিকথা ‘চার বেহারার পালকি ও অমলিন কিছু স্মৃতি’/ কেশব চৌধুরী। এছাড়া ছড়া কবিতা ও লিমেরিক রচনা করেছেন ৪১ জন ছড়াকার। এরা হলেন আহমেদ জসিম, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, দেলোয়ার বিন রশিদ, আহসান মালেক, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, জসীম মেহবুব, বিশ্বজিৎ সেন, বিপুল বিশ্বাস, অরুণ শীল, শফিক ইমতিয়াজ, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ফারুক হাসান, সিতাংশু কর, অপু বড়ুয়া, রমজান আলী মামুন, গোফরান উদ্দীন টিটু, নজরুল জাহান, বাহারুল হক লিটন, গোলাম নবী পান্না, অবিনাশ আচার্য, মুহিব নেছার, প্রদীপ ব্যানার্জী, নজরুল ইসলাম শান্ত, আবিদ আজম, আহসান সাব্বির, আদিত্য রুপু, আক্তারুজ্জামান রকিব, নার্গিস চমন, কাজী বর্ণাঢ্য, মাহমুদুল হাসান নিজামী, সনজিত দে, তালুকদার হালিম, মোক্তারুজামান, সোহেল সৌকর্য, ওসমান গনি এনু, মামুন আল-রশীদ, সৈয়দা সেলিমা আক্তার, সুজন সাজু, আবদুল গফুর, আবদুল কাইয়ুম, রুপন সিকদার।





অন্ত্যমিল

রহমান তাওহীদ সম্পাদিত ‘অন্ত্যমিল’ কিশোর-কবিতা সংখ্যাটি বগুড়া থেকে প্রকাশিত ৪র্থ বর্ষ ৩য় সংখ্যা। হাতে রাখার মতো এ সংখ্যাটি ইতোমধ্যেই শিশু-কিশোর-সাহিত্যের অঙ্গনে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। চারুপিন্টুর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের দুই মলাটের ভেতরে আট ফর্মার মোটা তাজা ও কড়কড়ে অবয়বে আগাগোড়া সুশৃঙ্খল সম্পাদনার চারুময় ছাপ এর উলেখযোগ্য আকর্ষণ। তবে প্রধান আকর্ষণ ভেতরের লেখা সমেত গোটা কাগজটিই। এতগুলো মননশীল প্রবন্ধ, গদ্য, আলোচনা, ছড়া-পদ্য-কবিতা’র সাম্প্রতিক পাঠ একসাথে পাওয়া বিশাল ব্যাপার বৈকি। এ অঙ্গনের বর্তমান হালচালটা একটু পরখ করে নিতে কৌতূহলী পাঠকের জন্য এ সংখ্যাটা অত্যন্ত সহায়ক হবে। এতে প্রবন্ধ লিখেছেন- হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, ইলতুৎ আলীদ, মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, জাকির আবু জাফর, জুলফিকার শাহাদাৎ ও মাহ্ফুজুর রহমান আকন্দ। বই নিয়ে আলোচনা করেছেন- সেলিনা শেলী, আদিত্য রুপু, আফসার নিজাম, এফ শাহজাহান ও মিজান আহসান। ‘অন্ত্যমিল’ পূর্বসংখ্যা নিয়ে মতামত লিখেছেন- ইলতুৎ আলীদ, মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, মাহফুজ ফারুক ও তপন বাগচী। আর পদ্য কবিতা লিখেছেন- রাশেদ রউফ, অরুন শীল, জুলফিকার শাহাদাৎ, নাসিরুদ্দীন তুসী, সাজ্জাদ বিপব, ফারুক হোসেন, মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন, জসীম মেহবুব, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, নাজিব ওয়াদুদ, মিজানুর রহমান শামীম, বিপুল বড়ুয়া, মাসুদ আনোয়ার, কামাল হোসাইন, আবুল কালাম বেলাল, মন্জু রহমান, নূরুল ইসলাম খান, সনজিত দে, এম এ কাইউম, রণদীপম বসু, শাকিল ফারুক, মাসুদ কামাল, ফজলুল হক তুহিন, জুবাইদা গুলশান আরা ফেন্সী, সৈয়দ আমির উদ্দিন, আরিফ বখতিয়ার, শামীম হাসনাইন, মামুন সারওয়ার, মামুন-আল-রশীদ, জোবায়ের আসাদ, আসাদুজ্জামান খোকন, মাসুম আওয়াল, আবদুল মতিন রিপণ, সাইফ মাহাদী, জালাল খান ইউসুফী, মাহফুজ ফারুক ও গোলাম নবী পান্না। তবে সংখ্যাটির বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে আদিত্য রুপু’র নেয়া এ অঙ্গনের ভিন্ন ভিন্ন বয়সী চার কবির এক ব্যতিক্রমী সমন্বিত সাক্ষাৎকার। এই এক্সকুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আখতার হুসেন, সুজন বড়ুয়া, রাশেদ রউফ ও জুলফিকার শাহাদাৎ।





ছড়াড্ডা

রাজশাহী থেকে প্রকাশিত আরিফ বখতিয়ার সম্পাদিত ছড়া বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন ‘ছড়াড্ডা’। চারুপিন্টু’র চারুময় চমৎকার প্রচ্ছদে মোড়ানো চার ফর্মার এই ছোট কাগজটি দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করবে। ঠাসবুনুনি লেখা-সমৃদ্ধ এ কাগজটিও ইতোমধ্যে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেছে এর ভেতরে রাখা মশলার কারণেই। হাতে রাখার মতো এ কাগজে প্রবন্ধ, গদ্য ও পাঠ-আলোচনা লিখেছেন- মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, জসীম মেহবুব, মন্জু রহমান, মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন, ইলতুৎ আলীদ, মাহফুজুর রহমান আকন্দ, জুলফিকার শাহাদাৎ, মাসুদ কামাল, ফজলুল হক তুহিন, সতীশ বিশ্বাস, রহমান তাওহীদ, মাসুম আওয়াল ও সাইফুল হক সিরাজী। রয়েছে সাজ্জাদ বিপবের নেয়া ছড়াকার মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন-এর একটি সুন্দর সাক্ষাৎকার। যাঁদের ছড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে সংখ্যাটি, তাঁরা হলেন- শফিক ইমতিয়াজ, সাজ্জাদ বিপব, ইমরান পরশ, মঈন মুরসালিন, নূরুল ইসলাম খান, মিজানুর রহমান শামীম, মাসুম হামিদ, মানসুর মুজাম্মিল, কমলেশ সরকার, বিপুল বড়ুয়া, সুজিত মণ্ডল, হাসান তানভীর, মামুন সারওয়ার, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, বিশ্বজিৎ সেন, নাজিব ওয়াদুদ, আসাদুজ্জামান খোকন, আবিদ আজম, মাহফুজ ফারুক, এম এ কাইউম, গিয়াস উদ্দিন রূপম, জাইদুর রহমান, গোলাম নবী পান্না, আতাউলাহ রুনু, আদিত্য রুপু, প্রতীক ওমর ও আহমাদ মোবাশ্বির।





চমচম

গাইবান্ধা থেকে প্রকাশিত প্রতীক ওমরের সম্পাদনায় দুই ফর্মা আয়তনের ছড়া বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন ‘চমচম’-এর দ্বিতীয় সংখ্যা জুন’২০০৭ কাগজটির মেটে-রং প্রচ্ছদ-কভারের ভেতরে সাধারণ কাগজ দেখে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। বরং চোখ অশিক্ষিত হলেই ঘাবড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কেননা ওখানে ভারী ভারী প্রবন্ধ গদ্য আলোচনা লিখেছেন- ইলতুৎ আলীদ, এফ শাহজাহান, অমিয় কুমার সেনগুপ্ত, ড.মাহফুজুর রহমান আখন্দ, প্রতীক ওমর ও এহসান হায়দার। ইলতুৎ আলীদের মুখোমুখি হয়েছেন মাহফুজ ফারুক এবং ছড়া লিখেছেন- জসীম মেহবুব, জোবায়ের আসাদ, মিজান আহসান, শাহীন সজল, বিকর্ণ রায়, জুলফিকার শাহাদাৎ, ডাঃ আর এ এম তারেক, মোস্তফা কামাল, গোলাম নবী পান্না, বিশ্বজিৎ সেন, এম সেলিম রেজা, রুহুল আমিন মুকুল ও এইচ এম জুয়েল মণ্ডল।





একফর্মা ছড়াপত্র

শ্রীমঙ্গল থেকে অবিনাশ আচার্য ও চন্দন কৃষ্ণ পাল সম্পাদিত একফর্মা ছড়াপত্র পঞ্চম সংখ্যা (বৈশাখ ১৪১৫) টি আগের সংখ্যাগুলোর সাথে একটু তফাৎ রয়েছে। নামে একফর্মা হলেও চলতি সংখ্যায় আর একফর্মা নেই, বেড়ে গেছে। তিন ফর্মায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার এই ছোট্ট উঠোনে তিনটি গদ্য আর গুচ্ছ গুচ্ছ ছড়া ও পদ্যের সমাহার ! গদ্যগুলো হচ্ছে- ‘ছড়া আর অছড়া’/ জুলফিকার শাহাদাৎ, ‘ছড়া পত্রিকা’ ত্রয়োদশ সংখ্যা- ‘উল্টা বুঝলি রাম’!/ রণদীপম বসু এবং যে বই পড়েছি’তে ‘ব্যবচ্ছেদ : টাকুম টুকুম’/ কমলকলি চৌধুরী। প্রকাশিত ছড়া পদ্যগুলোতে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী সহ নবীন প্রবীন মিলিয়ে আটত্রিশ জন ছড়াকারের ছড়া পদ্য ও ছড়াগুচ্ছ রয়েছে, যাঁরা বর্তমান ছড়াসাহিত্যের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বিবেচিত। এরা হলেন কাইয়ুম চৌধুরী, সিরাজুল ফরিদ, মহিউদ্দিন শীরু, রায়হান সেলিম, প্রভাস তীর্থ, ফারুক নওয়াজ, শফিক ইমতিয়াজ, আবিদ আজম, সোহেল সৌকর্য, ফারুক হাসান, জগলুল হায়দার, মোঃ আলমগীর শিমুল, গাজী আবু হানিফ, কাজী বর্ণাঢ্য, শহীদ মহাজন, মৃধা মোঃ সাহেব আলী, রমজান আলী মামুন, মতিউর রহমান মনির, গোলাম নবী পান্না, রতন চন্দ্র নাথ, মুর্শিদা আহমেদ, মুহিব নেছার, বিপুল বড়ুয়া, চন্দন কৃষ্ণ পাল, মানসুর মুজাম্মিল, নাসের মাহমুদ, আহমেদ জসিম, আতিক হেলাল, আবদুল হামিদ মাহবুব, ইমরান পরশ, আদিত্য রুপু, সুফিয়ান আহমদ চৌধুরী, সব্যসাচী পাহাড়ী, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, অবিনাশ আচার্য, সায়েক আহমদ ও অনিন্দ্য বড়ুয়া।


সম্পাদক আহমেদ মোবাশ্বির এর ‘চমক’, ফারুক রহমানের ‘নকশি’, মনির হোসেনের ‘ধাক্কা’, নাজমুল হাসানের ‘ছড়ার ডাক’, জ্যোতির্ময় মল্লিকের ‘কুটুম পাখি’, রুদ্র মুর্শিদের ‘ছন্দ’, মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘ছড়া সাম্প্রতিক’ সহ পাঁপড়, ছড়ার আসর ইত্যাদি আরো বেশ কিছু ছড়া-সাহিত্য বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছেও। এ মুহূর্তে হাতের কাছে না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও এই সব ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনা করা গেলো না, এটা এ নিবন্ধকারের অনৈচ্ছিক সীমাবদ্ধতা হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে যেগুলো উপস্থাপন করা হলো, তা যে লিটল ম্যাগিয় চিন্তাসূত্রকে পুরোপুরি ধারণ করতে পেরেছে তাও নিশ্চয় করে বলা যাবে না।

তবু ব্যক্তির চিন্তারাজ্যের সার্বভৌমত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার যেমন কোন উপায় থাকে না, তেমনি ব্যক্তিক চিন্তা-বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই। অভিন্ন আদর্শ লালন করেও এই ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য অত্যন্ত বাস্তব ও সতত ক্রিয়াশীল। এটাই সৃষ্টি-স্রোতের অনিবার্যতা। তাই ভিন্নমতের অবকাশ যত বেশি বাধাহীন উন্মুক্ত হবে, সৃষ্টি-বৈচিত্র্যও ততোধিক আকর্ষণীয় মৌলিক ও সুদূরপ্রসারী আশির্বাদ হয়ে আমাদের সমৃদ্ধিকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করে যাবে। তাই ছড়া-সাহিত্যের সৃজনস্রোতে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যেই এসব লিটল ম্যাগাজিন যত বেশি প্রকাশ হবে ততই সৃষ্টির অনুরণনও আমরা বেশি করে উপলব্ধি করতে পারবো। আর বোদ্ধা পাঠকও ঠিকই খুঁজে নেবেন তাঁর প্রয়োজনীয় লেখাটি।

[Little Magazin on Rhymes/Ranadipam Basu]

[Daily_Naya_Diganta]

Sunday, August 17, 2008

# [House Rent Law] বাড়িভাড়া আইন, কাজীর কিতাব এবং তোঘলকি বাস্তবতা...!









বাড়িভাড়া আইন, কাজীর কিতাব এবং তোঘলকি বাস্তবতা...!
-রণদীপম বসু/Ranadipam Basu


@ যে গল্পের উপসংহার নেই, ভূমিকাও নেই

অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান ; মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এই পাঁচটি অধিকার যে আসলে একটা কিতাবী বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়, আজকাল এটা যেকোনো নির্বোধও বোঝে। তাই বোধ করি কেউ এখন আর এটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন না বা করতে চান না। কিন্তু উচ্চবাচ্য করা এবং না করা এই উভয়টাই যে ব্যক্তির অন্যতম মৌলিক অধিকার এটাও কি সবাই বুঝেন ?

আমার বউ আমার, গরীবের বউ সবার- দেশে এরকম একটা সম্ভ্রান্ত নীতির জয়জয়কারে আজ আর আশ্চর্য হই না মোটেও। কেননা সমাজের একজন মানুষ এবং রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ন্যুনতম নৈতিকতা এবং দায়বোধ যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে, তখন সে কি আর মানুষ থাকে ? হয় যন্ত্র, নয় পশু হয়ে যায়। বাজার পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক করে তোলে দ্রব্যমূল্যের যথেচ্ছচারিতা আর নৈরাজ্য দেখলে এই ছোট্ট গরীব দেশটা কোনো মনুষ্য সমাজের অন্তর্ভূক্ত ভাবতেও কষ্ট হয় খুব। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন বা বাজার অর্থনীতির স্বঘোষিত মা-বাপ বনে গেছেন, এরা কি ভোক্তা সাধারণকে গরু-ছাগলের চাইতে বেশি কিছু ভাবেন ? সন্দেহ। আর আমাদের রাষ্ট্রপিতারাই বা তখত-এ-তাউসে বসে অভাজন নাগরিকদেরকে কী চোখে দেখেন এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সীমিত আয়ের নিরূপায় অসহায় নাগরিক হিসেবে আমাদের ভাবনা একটাই- সারাদিনের কর্মক্লান্ত ন্যুব্জ শরীরটাকে টেনে হিছড়ে বাজার নামক একটা অসম যুদ্ধক্ষেত্রে তুলোধুনা করিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাড়া-বাসা নামের একটা মহার্ঘ খোয়াড়ে নিয়ে যখন ছুঁড়ে দেই, তখন এই শরীরটা কি আর কোনো মানুষের শরীর থাকে ? শরীরগতভাবে মানুষ আর পশুতে প্রভেদ কতটুকু ? মানুষের বোধ, সম্মান ও অধিকার নামের ধারণাগুলো আমাদের এই শরীর থেকে যারা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে সুকৌশলে, তারা কারা ?

কদিন আগে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর একটি জরিপের ফলাফল দেখলাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এতে বলা হচ্ছে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পক্ষান্তরে এই সময়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, ২৫৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এই জরিপকালের পর পরই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যে অতীতের সমস্ত রেকর্ড চুরমার করে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে, সেটা জরিপে আসার সুযোগ হয়তো পায়নি এখনো। ক্যাবের জরিপে বলা হয়েছে, গতবছর ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৫ ভাগ, আধাপাকা বাড়িতে ১৮ দশমিক ৫৭ ভাগ, টিনশেড কাঁচা বাড়িতে ২৩ দশমিক ৩৩ ভাগ, মেসরুমে ২৬ দশমিক ৯৮ ভাগ এবং বস্তি বাড়িতে ১৪ দশমিক ১৪ ভাগ। গত বছর এই বৃদ্ধির গড় হার ২১ দশমিক ৪৮ ভাগ। অথচ ২০০৬ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির এই হার ছিল ১৪ দশমিক ১৪ ভাগ। চলতি বছরে এটা কত হবে ? তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর অন্যায় অবিচার ও দুর্নীতির ব্যাপারে যেটুকুই হোক উদ্যোগ নিলেও সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধ ও ফ্রি স্টাইলে বাড়িভাড়া বৃদ্ধিরোধ বিষয়ে যেহেতু কোনো পদপে গ্রহণ করতে পারেনি, তাই যে দুঃসহ আশঙ্কা এই প্রশ্নকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে তোলে তা হাঁড়ে হাঁড়ে অনুভব করেন কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট এই মহানগরীর আশিভাগ দুর্ভাগা নাগরিক নামের দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশাল এক জনগোষ্ঠী ; যারা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির স্বাপেক্ষে কৌতুকময় হাস্যকর আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন অনিবার্য ব্যয়ের ভারে বস্তুতঃই দিশাহারা। এদের কষ্ট এরাই বুঝে। বাকিরা তা বুঝার কথা নয়। কেননা তারা যে কেউ কেউ আমাদের স্বঘোষিত আশ্রয়দাতা মা বাপ, আর অন্যরা গোষ্ঠীবদ্ধ সৌম্যবেশধারী বিবেকহীন একদল বাড়িভাড়া ব্যবসায়ী !

@ বাড়িভাড়া, এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম !

নাগরিক জীবন-ভাবনার সাথে যে অনুষঙ্গটি আজ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো জড়িয়ে আছে অবিচ্ছেদ্যভাবে, তা হচ্ছে বাসাভাড়া বা বাড়িভাড়া। সারা মাসের বেতনের সিংহভাগ তুলে দেয়া নীতিবিবর্জিত বাড়িওয়ালা নামের এক নির্বিকার হাতে, কোন টোকেন রশিদ প্রমাণপত্রহীন। তার পর গৃহিণী নামের আরেক দুর্ভাগা প্রাণীর উপর নিজের সব অক্ষমতার ক্ষোভ ঢেলে ঢেলে সারা মাস ভাতের বদলে আঙুল চোষা। আর তাই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষের চোখে বাড়িভাড়া মানেই এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ! যার সুনির্দিষ্ট আকার নেই, অবয়ব পাল্টানোর বাঁধাধরা কোন সময়গ্রাহ্যতা নেই, অস্থির পরিমাণবাচক এই বিশেষ বস্তুটির সাথে যখনতখন আয়তন পাল্টানোর মহিমায় সহমতের ভিন্নতা মানেই ঠাঁই খুঁজো অন্যত্র। আবারো সেই পুরনো চক্র, পুনরাবর্তন। সপ্তবুহ্যের মতো, ঢুকার রাস্তা আছে বেরোবার নেই। কিন্তু কেন ?

আগে জানতাম, ভালোবাসা এবং যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই। হালে আরেকটি যে বিষয় নতুন অহমিকা আর ক্ষমতা দিয়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে, তার নাম ব্যবসা। প্রকৃতই সেবামূলক মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে কোন ব্যবসার জন্ম হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। এমন গোটাকয়েক যদি থেকেও থাকে, তাকে ব্যতিক্রমের ক্যাটেগরিতেই সসম্মানে রেখে দেয়া যায়। কাকে ব্যবসা বলে, ব্যবসার ধারণাগুলো কী কী বা ব্যবসার অর্থনৈতিক দর্শনটা কোথায় বাস করে এসব পূঁথিগত আলোচনা করার জন্য আমাদের দেশে অনেক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। নীতিহীন অর্থের হাহাকারে পিষ্ট আমাদের মতো মোটাচোখা দৃষ্টিধারীদের কাছে আজকাল ব্যবসা আর বর্বর ডাকাতির মাঝে কোন পার্থক্য কি আদৌ ঠাহর হয় ? এর অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরণই হচ্ছে ঢাকার বাড়িভাড়া ব্যবসা। যেখানে সর্বশক্তিমান প্রভুর মতোই হও বললেই হয়ে যায় ! ইচ্ছাই যথেষ্ট। বাড়িওয়ালা নামের এই স্বৈরক্ষমতাধর ব্যক্তিটির কাছে ভাড়াটিয়া হলো সহজ উচ্চারণে ‘ভাড়াইট্ট্যা’, মানে বাদাইম্যা। আর সহজ বাংলায় বাদাইম্যা শব্দের পোশাকি অর্থ হচ্ছে যার কোন চালচুলো নেই, ঠিকানাহীন। বাহ্ ! ভাড়াটিয়া শ্রেণীর প্রাণীদের কী সম্মান ! পোষালে থাকো, নইলে দূর হও।

ডাকাতির মতো ব্যাভিচারী ব্যবসায়ও বোধকরি কিছু কিছু নীতিমালা থাকে। কিন্তু বাড়িভাড়া ব্যবসায় আদৌ কি কোন নীতিমালা আছে ? যদি বলি নেই, আমার কথায় বিজ্ঞজনেরা হয়তো মাইন্ড করবেন। সাথে সাথে ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের বাড়ী ভাড়ার দর (Dhaka City Corporation::House Rent Rate) ওয়েব সাইটটিও হয়তো দেখিয়ে দেবেন কেউ কেউ। যেখানে কিছু তথ্য ছক আর কতকগুলি তালিকা দেয়া আছে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা শহরকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে ডিসিসি। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসিসি আবাসিক এলাকাগুলোকে কয়েকটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করেছে। প্রধান সড়কের পাশে হলে এক রকম ভাড়া, গলির তিনশ’ ফুটের মধ্যে হলে এক রকম ভাড়া, আর গলির তিনশ’ ফুটের বাইরে হলে আরেক রকম ভাড়া। ওগুলোকে আবার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প- এ তিন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়কাল, কাঠামো, নির্মাণশৈলী, অবস্থান ও পজেশান হস্তান্তরের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে বলেও ডিসিসির বিধান রয়েছে।

বলতেই হয়, বিশাল কাজ করেছে ডিসিসি ! ঠুঁটো জগন্নাথের জন্য বহু কষ্ট করে ওরিজিনাল ইটালিয়ান জুতো বানিয়েছে ! কিন্তু জগন্নাথ যে ঠুঁটো ! তার জন্যে আগে পা বানিয়ে হাঁটানোর ব্যবস্থা করতে হবে সেটা কি এরা জানে না ? অবশ্যই জানে। এবং একটু বেশি করেই জানে যে, জগন্নাথ হাঁটা শুরু করলে রাষ্ট্রের ওইসব চক্ষুলজ্জাহীন অসৎ কর্মচারিদের বসে বসে টু-পাইস কামানোর ধান্ধা কমে যাবে। বরং এলাকাভিত্তিক এই বাস্তবায়নহীন ভাড়াতালিকা বানিয়ে ধান্ধার পসার আরেকটু বাড়ানো হয়েছে মাত্র। সরকারের প্রাপ্য কোটি কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া এবং লক্ষ লক্ষ ভাড়াটিয়াদের নির্দয় পেষণে সহায়তাকারী এরাই যখন বিনয়ের অবতার সেজে বলে, ডিসিসি ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও এটা মানতে বাধ্য করার মতো কোন আইন ডিসিসির আছে বলে জানা নেই, তখন দুঃখ হয় খুব। হাসিও পায় !

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা যায়, ঘাস কাটা চলে না ; ঘাস কাটতে কাঁচির দরকার। অদরকারী ঘাস কাটার মুরোদহীন এইসব তলোয়ারবিদদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, এই দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ নামে যে একটি আইন রয়েছে সেটা কি তারা জানেন ? ওটার দেখভাল করার দায়িত্ব কাদের ? কারা এটাকে অতি সযত্নে শুধুই কিতাবী আইন বানিয়ে রেখেছে ? কেবল একটু সদিচ্ছা থাকলেই যে আইনটিকে বাংলাদেশে অতিসহজে ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করে সিংহভাগ নগরবাসীর অসহনীয় দুর্ভোগ মুক্তির পাশাপাশি সরকারের বিরাট রাজস্ব আয়ের বন্ধ দরজাটা নিমেষেই উন্মুক্ত করে দিতে পারে তা হচ্ছে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ বা Premises (House) Rent Control Ordinance, 1991.
তাহলে আসুন দেখি এ আইন কী বলছে আমাদের ?

@ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা

আমাদের দেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারী করা হয় পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে। এর অধীনে ১৯৬৪ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একযুগেরও বেশি সময় ধরে ১৯৮৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অতঃপর তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ এম এরশাদ কর্তৃক ১৯৮৬ সালের ২২ নং অধ্যাদেশ দ্বারা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারী করে ১৯৬৩ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর মেয়াদ ছিল তিন বছর এবং তা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়ে যায়। তিন বছর পরে আবার বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন জারী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। নইলে জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করে আইনটি পাশ করা যেতো। তাই জাতীয সংসদের অবর্তমানে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতাবলে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ জারী করেন। এ আইনে কোন মেয়াদের কথা উল্লেখ করা হয় নি। সব আইনই যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা কিন্তু নয়। তাই নতুন কোন প্রণীত আইনকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করার জন্যে নতুন নতুন বিধি প্রণয়নেরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান আইন অর্থাৎ ১৯৯১ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৪ ধারায় বিধি প্রণয়নের ক্ষমতার বিধান থাকলেও সরকার অদ্যাবধি এই আইনের অধীনে কোন নতুন বিধি প্রণয়ন করেন নাই। ফলে ১৯৬৪ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাই কার্যকর রয়ে গেছে।

অতএব, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বা বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য আমাদের দেশে কার্যকর আইন হচ্ছে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৯১ (৩নং আইন) এবং তা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের জন্য বিস্তারিত বিধি-বিধান হচ্ছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৬৪। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কতটুকু সচেতন ? নিজেদের প্রয়োজনেই আজ এই প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে আমাদের নিজ নিজ ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়ে যাওয়া আবশ্যক।

১৯৯১ সনের ৩নং আইন হিসেবে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১-এ বিভিন্ন উপধারা সংবলিত ৩৬ টি আইনী ধারা রয়েছে। তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে।

[ধারা ১.০] সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তনঃ

এ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, ১৯৯১ নামে অভিহিত হবে। (২) উপধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের ধারা ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ এবং ২৭ অবিলম্বে বলবৎ হবে এবং উক্ত ধারাগুলো ব্যতীত অন্যান্য ধারাসমূহ যে সকল এলাকায়.(Premises Rent Control Ordinance) প্রেমিসেস রেণ্ট কণ্ট্রোল অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬ ২৬ শে মার্চ, ১৯৮৯ ই তারিখে বলবৎ ছিল সেই সকল এলাকায় ২৭ শে মার্চ, ১৯৮৯ ইং তারিখে বলবৎ হয়েছে বলে গণ্য হবে।

(২) উপধারায় আরো শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, সরকার সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দ্বারা যে কোন এলাকায় এই আইন বা তার অংশবিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত তারিখ হতে বলবৎ হবে মর্মে নির্দেশ দিতে পারবেন। অনুরূপভাবে এই আইনের কোন অংশ কোন এলাকায় কার্যকরী হবে না মর্মেও নির্দেশ দিতে পারবেন।

[ধারা ২.০] সংজ্ঞাঃ

এ ধারায় বাড়ি, বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া, মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় শব্দের আইনী সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।
(ক) “নিয়ন্ত্রক” অর্থ ৩(১) এর আওতায় নিযুক্ত কোন নিয়ন্ত্রক এবং ধারা ৩(২) এর আওতায় নিযুক্ত কোন অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রকও এর অন্তর্ভূক্ত হবে,
(খ) “বাড়ি মালিক” অর্থ কোন ব্যক্তি যিনি আপাততঃ নিজের বা অপর কোন ব্যক্তির পক্ষে অথবা অপর কোন ব্যক্তির উপকারার্থে কিংবা কোন ব্যক্তির ট্রাষ্ট বা রিসিভার হিসেবে কোন বাড়ির ভাড়া পান বা পাবার অধিকার রাখেন বা যিনি বাড়িটি ভাড়া দেয়া হলে অনুরূপ ভাড়া পেতেন বা ভাড়া পাবার অধিকারী হন এবং Ges .Code of Civil Procedure, 1908 (Vol 1908).এ সংজ্ঞায়িত কোন আইনগত প্রতিনিধি উপভাড়া প্রদানকারী কোন ভাড়াটিয়া এবং বাড়ির মালিক হতে স্বত্ব প্রাপ্ত কোন ব্যক্তিও তার অন্তর্ভূক্ত হবে।
(গ) “বাড়ি” অর্থ কোন দালান বা দালানের অংশবিশেষ বা কোন কাঁচা ঘর বা ঘরের অংশবিশেষ, যা আবাসিক বা অনাবাসিক অথবা উভয় উদ্দেশ্যে পৃথকভাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে কিংবা ভাড়া দেবার ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছে এবং তৎসংলগ্ন বাগান, উঠান ও কাছারী ঘরও এর অন্তর্ভূক্ত হবে।
(ঘ) “মানসম্মত ভাড়া” অর্থ এই আইনের অধীনে নির্ধারিত বা নির্ধারিত বলে গণ্য মানসম্মত ভাড়া।
(ঙ) “ভাড়াটিয়া” অর্থ কোন ব্যক্তি যার দ্বারা অথবা যার পক্ষে কোন বাড়ির জন্যে ভাড়া পরিশোধ করা হয় এবং .Code of Civil Procedure, 1908 (Vol 1908).এ সংজ্ঞায়িত কোন আইনগত প্রতিনিধি এবং ভাড়ার সময়সীমা সমাপ্ত হবার পরও বাড়ি দখলকারী কোন ব্যক্তিও এর অন্তর্ভূক্ত হবে।
(চ) “ভাড়া” বলতে বাড়ি ভাড়াকে বোঝাবে ;
(ছ) “বিধি” বলতে এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধিকেই বোঝাবে।

[ধারা ৩.০] নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি নিয়োগঃ

এই ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তিকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক, (২) উপধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করতে পারবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতিপূর্বে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সিনিয়র সহকারী জজগণ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে অদ্যাবধি সরকার অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাউকেই নিয়োগ করেন নাই।
উপধারা (৩) ও (৪) দ্বারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

[ধারা ৪.০] দরখাস্তের শুনানীঃ

এ ধারায় বাড়িভাড়া সম্পর্কীত কতিপয় দরখাস্তের চূড়ান্ত শুনানীর ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রককে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। উপধারা (১) অনুযায়ী বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিলকৃত প্রত্যেকটি দরখাস্তের শুনানী তিন মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে।
কোন বিশেষ কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী বাকী উপধারা অনুযায়ী তার কারণ লিপিবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রক উক্ত সময়ের পর যতশীঘ্র সম্ভব দরখাস্তের শুনানী সমাপ্ত করবেন।

[ধারা ৫.০] বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়ার প্রতি নোটিশ:

আলোচ্য ধারায় বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক কর্তৃক এই আইন দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করার পূর্বে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াকে নোটিশ প্রদানের বিধান বর্ণিত হয়েছে।

[ধারা ৬.০] বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতাঃ

এই আইনের আওতায় কোন মামলাজনিত তদন্তের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রক কর্তৃক যে কোন সময় কোন বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার ভাষ্যমতে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক তদন্তের উদ্দেশ্যে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় সংশ্লিষ্ট বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শন করতে পারবেন। তদুপরি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক তার অধীনস্থ কোন কর্মকর্তাকেও অনুরূপভাবে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবেন।

[ধারা ৭.০] ভাড়া বৃদ্ধির উপর বিধি নিষেধঃ

এই আইনের বিধান অনুযায়ী, কোন বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি বৃদ্ধি করা হলে অনুরূপ অতিরিক্ত ভাড়া কোন চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না।
অর্থাৎ আলোচ্য ধারায় বাড়িওয়ালার খেয়াল-খুশিমত ভাড়া বৃদ্ধির উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, কোনক্রমেই মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না। এমনকি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই মর্মে কোন চুক্তি থাকলেও মানসম্মত ভাড়ার বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না।

[ধারা ৮.০] বাড়ি মালিক কর্তৃক উন্নয়ন এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্যে ভাড়া বৃদ্ধিকরণঃ

এই ধারায় অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের বিধান বর্ণিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাড়ি মালিক বাড়িভাড়া দেবার পরেও নিজ খরচে বাড়িটির এমন কিছু উন্নয়ন সাধন করেন অথবা আসবাবপত্র সরবরাহ করে থাকেন যাকে বাড়ি মেরামত বলা যায় না, তবে বাড়ি উন্নয়ন বলা যায়। এরূপ ক্ষেত্রে বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়া পরস্পর সম্মত হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবেন এবং উক্ত অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটিয়া কর্তৃক মানসম্মত ভাড়ার ভিত্তিতে দিতে হবে। অর্থাৎ মানসম্মত ভাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারণ করতে হবে।

[ধারা ৯.০] কর প্রদানের কারণে ভাড়া বৃদ্ধিঃ

আলোচ্য ধারার ভাষ্যমতে কোন বাড়ির পৌরকর, টোল ইত্যাদি ভাড়াটিয়া কর্তৃক প্রদেয়, তবে ভাড়ার শর্ত মোতাবেক তা পরিশোধ করতে বাড়ির মালিক রাজী হয়ে থাকলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে অনুরূপ পরিশোধযোগ্য অতিরিক্ত টাকা তার বাড়ি মালিককে প্রদান করতে হবে।

[ধারা ১০.০] প্রিমিয়াম ইত্যাদির দাবী নিষিদ্ধঃ

আলোচ্য ধারায় ভাড়া দেয়া বা ভাড়া নবায়ন করা অথবা ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে বাড়ির মালিক কর্তৃক ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত বা অনুরূপ কোন টাকা দাবী বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি অনুরূপ কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত প্রদানে কোন ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা যাবে না। এ ছাড়াও বাড়ি মালিক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অগ্রীম ভাড়া হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবী বা গ্রহণ করতে পারবেন না।


[ধারা ১১.০] উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ভাড়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমঃ

ধারা (১০)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি নির্মাণ অথবা পুনঃ নির্মাণের দ্বারা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে কোন বাড়ি কমপক্ষে বিশ বছর মেয়াদের জন্যে ভাড়া দেয়া হয় এবং যদি উক্ত মেয়াদ তা শুরু হবার তারিখ হতে দশ বছরের মধ্যে বাড়ি মালিকের ইচ্ছানুযায়ী বাতিলযোগ্য না হয়, তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়ার অতিরিক্ত হিসেবে কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত অথবা অনুরূপ কোন অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন।

[ধারা ১২.০] আসবাবপত্র ক্রয় ভাড়ার শর্ত হবে নাঃ

কোন বাড়ি ভাড়ার জন্যে বা তার নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যে কোন ব্যক্তি তার আসবাবপত্র ক্রয়ের কোন শর্ত আরোপ করতে পারবেন না।

অর্থাৎ কোন বাড়ির মালিক তার বাড়ি ভাড়া বাবদ ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র ক্রয় করতে পারবেন না। তদুপরি ভাড়া নবায়ন কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধির শর্ত যদি বাড়ি ভাড়া চুক্তিতে থেকেও থাকে তা সত্ত্বেও ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নবায়ন না করে, তাহলে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র আটক বা ক্রয় করতে পারবেন না।

[ধারা ১৩.০] ভাড়া আদায়ের রশিদ প্রদানঃ

আলোচ্য ধারায় বাড়িওয়ালার প্রতি ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক যখনই ভাড়া গ্রহণ করবেন তখনই বাড়ি ভাড়া পরিশোধের একটি রশিদ ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৮৬ এ উল্লেখিত ফরমে বা ছকে রশিদ ছাপিয়ে নিয়ে ঐ রশিদ দ্বারাই বাড়ি মালিককে ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদান করতে হবে। রশিদ ইস্যু করার সময় বাড়ি মালিক রশিদের মুড়িতেও লিখে রাখবেন এবং তা অবশ্যই বাড়ি মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ভাড়া রশিদ আদায় করার দায়িত্ব অনেকাংশেই ভাড়াটিয়ার উপর নির্ভর করে থাকে। তবে ভাড়াটিয়া ভাড়া রশিদ ছাড়া ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে অনুরূপ ভাড়া পরিশোধ প্রমাণ করা ভাড়াটিয়ার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা আদালতে দলিলী সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।

[ধারা ১৪.০] অনাদায়যোগ্য ভাড়া ইত্যাদি ফেরতঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৪ ধারায় বাড়ি মালিক কর্তৃক যে সকল অনাদায়যোগ্য ভাড়া নেয়া হয়েছে তা ফেরত প্রদানের কথা বলা হয়েছে। যখন কোন বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার কাছ হতে এরূপ কোন টাকা গ্রহণ করেন বা জমা নেন যা এই আইনের বিধানের পরিপন্থী বা প্রিমিয়াম, সালামী অথবা জামানত বাবদ অগ্রীম কোন টাকা প্রদানে ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা হয়ে থাকে যা এই আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাহলে ভাড়াটিয়ার দরখাস্ত বলে অনুরূপ টাকা প্রদান বা জমাদানের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে উক্ত টাকা ফেরত দেবার জন্যে অথবা অন্যভাবে সমন্বয় করে নেয়ার জন্যে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নির্দেশ দিতে পারবেন। যেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক অনুরূপ আদেশ প্রদান করেন সেক্ষেত্রে যে আদালতে বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের ডিক্রির জন্যে মামলা করা যেতো তা সেই আদালতেরই ডিক্রি বলে গণ্য করতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায় যে, বাড়ি মালিক নানা ছল-চাতুরীতে অযৌক্তিকভাবে ভাড়াটিয়ার কাছে অর্থ দাবী করে বসে। দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ না করলে উচ্ছেদের হুমকী পর্যন্ত দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রায় বাধ্য হয়েই উচ্ছেদের ভয়ে ভাড়াটিয়া অযৌক্তিকভাবে দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করে থাকে। তবে এরূপ ক্ষেত্রে কোন ভাড়াটিয়া যদি বাড়ি মালিকের বেআইনী দাবীকৃত ও পরিশোধিত টাকার প্রতিকার চান তাহলে উক্ত অর্থ জমা প্রদানপূর্বক রশিদ গ্রহণ করতঃ ৬ মাসের মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

[ধারা ১৫.০] নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা ও দায়িত্বঃ

বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়ার দরখাস্তের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক কোন বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারন করতে পারবেন এবং এরূপভাবে তা নির্ধারণ করবেন যেন তার বাৎসরিক পরিমাণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ধার্যকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের বেশি না হয়।

এই ১৫(১) ধারা অনুযায়ী বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণের উপায় কী ? এক্ষেত্রে আমাদেরকে দেখতে হবে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪।
বিধিমালায় বলা হয়েছে: (০১) পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে ভূমির মূল্য, ভূমি উন্নয়ন ব্যয় ও বাড়ি নির্মাণ ব্যয় থেকে অবচয় (যখন মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে তখনকার সময় পর্যন্ত) বাদ দিয়ে যা থাকবে সেটাই বাড়ির বাজার মূল্য। প্রথম তিন বছরে কোনো অবচয় নেই এবং পরবর্তী প্রত্যেক বছরে অবচয় শতকরা ১ ভাগ।
(২)আধা পাকা বাড়ির ক্ষেত্রেও এই নিয়ম। তবে আধা পাকা বাড়ির কোন অবচয় প্রথম দুবছর ধরা হবে না এবং তৃতীয় বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত অবচয় শতকরা ২ ভাগ এবং ১৯ তম বছর থেকে এ অবচয়ের হার শতকরা ৩ ভাগ।

[ধারা ১৬.০] মানসম্মত ভাড়া কার্যকর হবার তারিখ এবং তার মেয়াদঃ

নিয়ন্ত্রক কর্তৃক মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করার পর উক্ত মানসম্মত ভাড়া কোন্ তারিখ হতে বলবৎ হবে এবং কতদিন পর্যন্ত চালু থাকবে তারই বিধানাবলী ১৬ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারার মূল বক্তব্য হলো, এই আইনের ১৫ ধারা মতে ভাড়া হ্রাস বা বৃদ্ধির জন্যে দরখাস্ত করা হলে অনুরূপ দরখাস্ত দাখিলের পরবর্তী মাস হতে মানসম্মত ভাড়া প্রদান করতে হবে। কাজেই নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত যে দিনই প্রদান করুন না কেন, এই আইনের বিধান মোতাবেক তা দরখাস্ত দাখিলের পরবর্তী মাস হতেই মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবে। এই ধারায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবার তারিখ হতে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে।

[ধারা ১৭.০] কতিপয় ক্ষেত্রে ক্রোক পরোয়ানা ইত্যাদিঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের এই ধারায় বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের জন্যে ক্রোক এবং প্রয়োজন বোধে ভাড়াটিয়াকে জেলে আটকে রাখার বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে। ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের বিধান মোতাবেকই বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের ডিক্রি জারী করা হয়। তবে বাড়ি মালিক তার দরখাস্তের সাথে উক্ত ভাড়া অনাদায়যোগ্য নয় বলে এফিডেবিট দাখিল না করলে কোন প্রকার ক্রোক বা গ্রেফতারী পরোয়ানার আদেশ দেয়া যাবে না।

[ধারা ১৮.০] অনুমোদনযোগ্য ভাড়া প্রদান করা হলে সাধারণতঃ উচ্ছেদের আদেশ দেয়া হবে নাঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের এই ধারাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ধারায় ভাড়াটিয়ার অধিকার ও কর্তব্যের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ ধারার ১ উপধারামতে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) (ড) এবং (ত) দফার বিধানের পরিপন্থি কোন কাজ করলে বা কোন চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের অনুমতি ব্যতীত বাড়ি বা বাড়ির কোন অংশ উপভাড়া প্রদান করলে বা ভাড়াটিয়া যদি এরূপ কোন আচরণ করেন যা পার্শ্ববর্তী বাড়ি দখলকারীদের জন্যে বিরক্তিকর বা উৎপাতজনক হয় অথবা ভাড়াটিয়া যদি বাড়িটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকেন অথবা বাড়িটি বাড়ি মালিকের বা তার লোকজনের প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হয়ে পরে যা আদালতের কাছে সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে।
সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) (ড) এবং (ত) দফায় যথাক্রমে বর্ণিত হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করতে থাকলে যতদিন ভোগদখলের চুক্তি রয়েছে ততদিন ভাড়াটিয়া নির্বিঘ্নে ভোগদখল করতে পারবেন।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) দফাঃ
ইজারাদাতা ইজারা গ্রহীতার সাথে এই মর্মে চুক্তি করেছে বলে ধরে নেয়া হবে যে, ইজারা গ্রহীতা যদি ইজারা অনুসারে বরাদ্দকৃত খাজনা দেয় এবং তার উপর বাধ্যকরী চুক্তির শর্ত সমূহ পালন করে তাহলে বিনা বাধায় সে ইজারায় নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তি ভোগ দখল করতে পারবে। এরূপ চুক্তির সুবিধা ইজারা গ্রহীতার স্বার্থের সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং তা তার উক্ত স্বার্থের সাথে বলবৎ থাকবে এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত স্বার্থ বা তার অংশবিশেষের সাথে জড়িত হবে সে তা প্রয়োগ করতে পারবে।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (ড) দফাঃ
ইজারা গ্রহীতা উক্ত সম্পত্তির দখল নেবার সময় তা যে অবস্থায় ছিল সেরূপ ভাল অবস্থায় রাখবে এবং ইজারার মেয়াদ শেষে তা সেরূপ অবস্থায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু ব্যবহার জনিত যুক্তিসঙ্গত কোন ক্ষয়-ক্ষতির জন্যে সে দায়ী হবে না। ইজারার মেয়াদ বলবৎ থাকাকালে সে ইজারাদাতা বা তার প্রতিনিধিদেরকে উপযুক্ত সময়ের মধ্যে ইজারা সম্পত্তিতে প্রবেশ করতে এবং তার অবস্থা পরিদর্শন করতে দিতে বাধ্য থাকবে এবং সম্পত্তির অবস্থার কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে ইজারাদাতা সেই সম্পর্কে নোটিশ দিবে বা জারী করবে এবং উক্ত ত্রুটি ইজারাগ্রহীতা তার চাকর বা প্রতিনিধিগণ কর্তৃক সংঘটিত হলে নোটিশ প্রদান বা জারী করার তারিখ হতে তিন মাসের মধ্যে ইজারা গ্রহীতা উক্ত ত্রুটি সংশোধন করতে বাধ্য থাকবেন।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (ত) দফাঃ
কৃষিকার্যের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ইজারাগ্রহীতা ইজারাদাতার বিনা অনুমতিতে উক্ত সম্পত্তির উপর কোন স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করবে না।

[ধারা ১৯.০] কতিপয় পরিস্থিতিতে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমাঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ ধারাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমা দেবার বিধান বর্ণিত আছে। ১৯ ধারার ১ উপধারার ভাষ্যমতে যেক্ষেত্রে কোন ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের বরাবরে ভাড়ার টাকা মানিঅর্ডার যোগে প্রেরণ করার পরে তা বাড়ি মালিক গ্রহণ করার অস্বীকারের কারণে ফেরত আসে সেক্ষেত্রে যে তারিখে ভাড়াটিয়ার হাতে মানিঅর্ডার ফেরত আসে সেই তারিখ হতে ১৫ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি ভাড়া মানিঅর্ডারযোগে প্রেরণের খরচসহ জমা দিতে হবে।
আবার বাড়ি ভাড়া কে বা কারা পাবেন এ বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে বা নিশ্চিত না হওয়া গেলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি ভাড়া জমা দিতে থাকবেন।
১৯ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে যে, যেখানে বাড়ি মালিক তার ঠিকানা পরিবর্তন করেন এবং তার ঠিকানা বা অবস্থান সম্পর্কে ভাড়াটিয়া জ্ঞাত না থাকেন এবং ভাড়া গ্রহণ করার মতো বাড়ি মালিকের কোন প্রতিনিধিও না থাকে তাহলে উক্ত ভাড়া যে তারিখে পরিশোধযোগ্য হয় সেই তারিখ হতে ১৫ দিনের মধ্যে ভাড়াটিয়ার উক্ত ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিতে পারবেন। এমন কি যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি মালিকের ঠিকানা ও অবস্থান জানা না থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পরবর্তী সময়ের বাড়ি ভাড়াও নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিয়ে যেতে থাকবেন।
তবে এক্ষেত্রে শর্তারোপ করে নিয়ন্ত্রকের একটি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে এবং তা হলো, যে তারিখে জমা হবে তা হতে সাত দিনের মধ্যে বাড়ি মালিকের সর্বশেষ জানা ঠিকানায় নিয়ন্ত্রককে রেজিষ্ট্রি ডাকযোগে উক্ত ভাড়া যে জমা দেয়া হচ্ছে তা সম্পর্কে একটি নোটিশ প্রেরণ করতে হবে।

[ধারা ২০.০] মানি অর্ডারযোগে ভাড়া গ্রহণ বা ভাড়া উঠানোর বিষয়ে হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি মালিকের নামে যে ভাড়ার টাকা জমা দেয়া হয়েছে উক্ত ভাড়ার টাকা বাড়ি মালিক যদি উঠিয়ে নেন তাহলে তা দ্বারা এ গণ্য করা যাবে না যে, ভাড়াটিয়া তার দরখাস্তে যে কারণসমূহ উল্লেখ করেছেন তা বাড়ি মালিক স্বীকার করে নিয়েছেন অথবা বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়াকে প্রদত্ত উচ্ছেদ নোটিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাড়ি মালিক নিয়ন্ত্রকের আদালতে বাড়িভাড়া নিয়ে মামলা বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও বাড়ি মালিক নিয়ন্ত্রকের আদালতে জমাকৃত ভাড়ার টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন। কারণ এই বাড়ি ভাড়া বাড়ি মালিকেরই প্রাপ্য। তবে বাড়ি ভাড়ার জমাকৃত টাকা কে বা কারা পাবেন সে সম্পর্কে কোন বিরোধ বা সন্দেহ থাকলে উক্ত বিরোধ নিস্পত্তি বা সন্দেহ দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত জমাকৃত ভাড়ার টাকা উঠিয়ে নেয়া যাবে না।

[ধারা ২১.০] ভাড়াটিয়া কর্তৃক মেরামত ইত্যাদিঃ

বাড়ি মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ি মালিকের উপর এই আইন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনতঃ বাধ্য। ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। কিন্তু উক্তরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়ি মালিক অনীহা প্রকাশ করলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন। আবার বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া দরখাস্ত করতে পারবেন।
ভাড়াটিয়া কর্তৃক অনুরূপ দরখাস্ত পাবার পরে নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নোটিশ প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে শুনানীর সুযোগ দেবেন। শুনানী শেষে প্রয়োজন মনে করলে বাড়িটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার আদেশ দেবেন। এই আদেশ দেবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বাড়ি মালিক যদি মেরামত বা করতে ব্যর্থ হন তাহলে ভাড়াটিয়া তা নিয়ন্ত্রককে জানিয়ে সে নিজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দরখাস্ত করতে পারবে। তবে এরূপ দরখাস্তের সাথে আনুমানিক একটি খরচের হিসাব অবশ্যই নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিল করতে হবে। নিয়ন্ত্রক তদন্ত করার পরে সন্তুষ্ট হলে ভাড়াটিয়াকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের অনুমতি দেবেন।
ভাড়াটিয়া নিজে বাড়িটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে পূর্বে বাড়িটি মেরামত করার জন্য যে হিসাব দেয়া হয়েছিল তার অপেক্ষা অধিক অর্থ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। ব্যয় করলে উক্ত অতিরিক্ত ব্যয়িত অর্থ বাড়ি ভাড়ার সাথে সমন্বয় করা যাবে না। আবার এও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অনুরূপ খরচ এক বছরে বাড়ি ভাড়ার মোট অর্থের এক ষষ্ঠাংশের বেশি হবে না।

আবার মেরামত যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় তাহলে সেভাবেই নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক আদেশ প্রদান করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে হবে। বাড়ি মালিক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিজ দায়িত্বে উপরে বর্ণিত নিয়মে বাড়িটি মেরামত করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি মেরামতের যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেই অর্থ বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে অনুরূপ ব্যয়িত অর্থ অবশ্যই উক্ত বাড়ি ভাড়ার এক ষষ্ঠাংশের বেশি হতে পারবে না।

[ধারা ২২.০] ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক বাড়ি মেরামত ইত্যাদিঃ

জনস্বার্থে কোন বাড়ির আরও মেরামতের প্রয়োজন হতে পারে। তাই জনস্বার্থের গুরুত্ব বিবেচনা করেই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২২ ধারায় ডেপুটি কমিশনারকে নিজ উদ্যোগে কোন বাড়ি মেরামত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাঁর কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, বাড়িটি দিন দিন ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে এবং বাড়িটি ধ্বসে পড়লে জানমাল এমনকি পার্শ্ববর্তী বাড়িসমূহেরও ক্ষতি হবে তাহলে তিনি নিজ উদ্যোগেই অতিসত্বর উক্ত বাড়ি মেরামত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অনুরূপ মেরামতের জন্যে যত টাকা খরচ হবে তা বাড়ি মালিকের পাওনা বাড়ি ভাড়া হতে ক্রোক করে ১৯১৩ সালের সরকারী পাওনা আদায় আইনের বিধান মোতাবেক আদায় করে নিতে পারবেন।

[ধারা ২৩.০] মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দণ্ডঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় বাড়ি মালিক কর্তৃক মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে জরিমানা বা দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়ার চাইতে কম ভাড়া নিলে সেক্ষেত্রে আইনের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আইনসম্মত ভাড়ার চাইতে বেশি বাড়িভাড়া নিলে তা আইনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই আইনের ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক বাড়িভাড়া আদায় করলে সেক্ষেত্রে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন। তৎপরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

আবার ১১ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়ার অপেক্ষা অতিরিক্ত কোন ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বা অনুরূপ কোন টাকা গ্রহণ করলে বা দাবী করলে কিংবা প্রদানের জন্যে প্রস্তাব করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে দুই হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিককে দণ্ডিত করা হবে।

অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক আদালতের লিখিত আদেশ ছাড়া অগ্রীম ভাড়া বাবদ এক মাসের অধিক ভাড়া গ্রহণ করলে প্রথমবারের এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ বাড়ি মালিক গ্রহণ করেছেন তার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেক অপরাধের জন্যে এক মাসের অতিরিক্ত যে ভাড়া গ্রহণ করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

[ধারা ২৪.০] সুখাধিকার ইত্যাদিতে বাধা প্রদানে দণ্ডঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৪ ধারাটি ভাড়াটিয়ার পদাধিকার, ব্যবহারস্বত্ব বা সুখাধিকারের অধিকার সম্পর্কিত বিধান প্রবর্তন করেছে। যেমন, অন্যের জমির উপর দিয়ে চলাফেরার অধিকার, অপরের দালনের কারণে নিজ বাড়ির আলোবাতাস বন্ধ হতে না পারে এ মর্মে যে অধিকারসমূহ আইনে স্বীকৃতি পেয়েছে তাই হলো সুখাধিকার বা ইজমেণ্ট রাইট। যে বাড়িতে ভাড়াটিয়া বসবাস করছেন বা যে বাড়িতে ভাড়াটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তার সাথেও ইজমেণ্টরাইট বা সুখাধিকার ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকৃত না হলেও প্রথাগতভাবে যতটুকু সুখাধিকার ভোগ ব্যবহার করা সম্ভব তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

অনেক সময় বাড়ি মেরামত করার প্রয়োজন হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষের নির্দেশও পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে যদি সুখাধিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েও থাকে তথাপি তাতে কোন অপরাধ হবে না। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি বাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সুখাধিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় বা বাড়ির সাথে স্থায়ীভাবে ব্যবহারযোগ্য কোন জিনিস সরিয়ে ফেলে বা অপসারণ করে, ধ্বংস করে বা অব্যবহারযোগ্য করে তোলে অথবা ভাড়ার শর্তাধীনে কোন সরবরাহ বা সুবিধা বন্ধ করে দেয় তাহলে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করলে নিয়ন্ত্রক সাহেব বিষয়টি অনুসন্ধানপূর্বক সন্তুষ্ট হলে অপরাধীকে পাঁচশত টাকা জরিমানা বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। অনুরূপভাবে পুনরায উক্তরূপ কোন অপরাধ সংঘটন করলে সেক্ষেত্রে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন।

[ধারা ২৫.০] বাড়ি মালিকের ভুল নাম বা ঠিকানা দেবার দণ্ডঃ

ভাড়াটিয়া কর্তৃক কোন কোন ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে তার বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল দেয়া হতে পারে। এ কারণেই বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা নিয়ন্ত্রকের কাছে ভুল দিলে তার জন্যে এই ২৫ ধারা প্রণয়নের মাধ্যমে জরিমানা ও অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, কোন ভাড়াটিয়া তার বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল দিলে উক্ত ভাড়াটিয়া পাঁচশত টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা যে ভুল দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে অবশ্যই ছয় মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি মালিককে দরখাস্ত করতে হবে।

[ধারা ২৬.০] বাড়ির দখল বুঝিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার ব্যর্থতার দণ্ডঃ

ভাড়াচুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিককে খালি বাড়ির দখল বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন। যদি ভাড়াটিয়া তার ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বাড়িটির দখল বাড়ি মালিককে বুঝিয়ে না দেন তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়া দণ্ডিত হবেন। তবে ভাড়াটিয়ার সাথে বাড়ি মালিকের যদি উপভাড়া প্রদানের শর্ত বা চুক্তি কিংবা তার সম্মতি থাকলে ভাড়াটিয়ার বাড়ি মালিককে বাড়ি বুঝিয়ে দেবার বাধ্যবাধকতা থাকে না। বাড়ি ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যদি ভাড়াটিয়া বাড়িটির দখল বুঝিয়ে দিতে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিককে ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে মামলা দায়ের করতে হবে। এই অভিযোগ পাবার পরে নিয়ন্ত্রক অনুসন্ধান এবং শুনানী গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলে মানসম্মত ভাড়ার দশগুণ অর্থদণ্ডে ভাড়াটিয়াকে দণ্ডিত করতে পারবেন।

[ধারা ২৭.০] রশিদ প্রদানে ব্যর্থতার দণ্ডঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৭ ধারায় বাড়ি মালিকের উপর ভাড়া গ্রহণের রশিদ প্রদানের ব্যর্থতার জন্যে দণ্ড আরোপ করা হয়েছে। এই আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ি মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির রশিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে (১৯৬৪ সালের বাড়িভাড়া বিধিমালায় রশিদ ফরমের নমূনা বিধৃত আছে) যথাস্থানে স্বাক্ষর করে ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে ভাড়ার রশিদের একটি চেকমুরি সংরক্ষণ করতে হবে। এই আইন অমান্য করে কোন বাড়ি মালিক যদি ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রশিদ প্রদানে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুন অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

[ধারা ২৮.০] অভিযোগ দায়ের ইত্যাদিঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৮ ধারায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইনের ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারার অধীনে যে কোন অভিযোগ লিখিতভাবে দায়ের করতে হবে। তদুপরি চার টাকার কোর্ট ফিস সংযুক্ত করতে হবে।
অভিযোগ পাবার পরে নিয়ন্ত্রক সাহেবকে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত করে দেখতে হবে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে নিয়ন্ত্রক দণ্ড প্রদান করবেন। ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অর্থদণ্ড প্রদান করা হলে উক্ত অর্থদন্ড প্রদানের তারিখ হতে ত্রিশ দিনের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রকের আদালতে জমা না দিলে তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে ১৯১৩ সালের সরকারী দাবী আদায় আইনের বিধান মতে অর্থ দন্ডের টাকা আদায়যোগ্য হবে।
উল্লেখ্য যে, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৮ ধারার বিধানটি বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

[ধারা ২৯.০] অভিযোগ তামাদিঃ

মানুষ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎপর থাকবে আইনের এটাই কাম্য। বিলম্ব ন্যায়বিচারকে প্রতিহত করে। এ কারণেই আইনে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এই আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করতে হলে অবশ্যই উক্ত অভিযোগের অপরাধ সংঘটনের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে। অন্যথায় অনুরূপ অভিযোগ তামাদি দ্বারা বাতিল হয়ে যাবে।

[ধারা ৩০.০] আপীল ও পুনঃবিবেচনাঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০ ধারায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল এবং রিভিউ বা পুনর্বিচারের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদেশ বা সিদ্ধান্ত দ্বারা সংক্ষুব্ধ হলে সেই বাড়িটি যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা জজের কাছে উক্ত আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেই ব্যক্তি আপীল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপীল রুজু করার সময় ৩০ দিন দেয়া হয়েছে। এই সময় গণনা কালে যে দিন নিয়ন্ত্রক আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেবেন সেই দিন এবং উক্ত আদেশ বা সিদ্ধান্তের সহিমোহরী নকল তুলতে যে সময় ব্যয় হবে তা বাদ যাবে।

বাড়িভাড়া সম্পর্কিত মামলাসমূহ দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা। তাই এক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির বিধানাবলী অনুসরণ করতে হবে। কাজেই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রককে বাড়িভাড়ার সম্পর্কিত মামলাসমূহ নিস্পত্তিকালে অবশ্যই দেওয়ানী কার্যবিধির পদ্ধতিগত বিধান অনুসরণ করেই বিচার সম্পন্ন করতে হবে।

[ধারা ৩১.০] নিয়ন্ত্রকের আদেশের সত্যায়িত নকল সরবরাহঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩১ ধারায় বাড়িভাড়া সম্পর্কিত মামলার পক্ষসমূহের মামলার যে কোন আদেশ বা সহিমোহরী নকল পাবার অধিকারের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার মূল বক্তব্য হলো বাড়িভাড়া মামলার যে কোন পক্ষ নির্ধারিত ফি প্রদানপূর্বক নিয়ন্ত্রকের যে কোন আদেশ বা মামলার যে কোন কাগজ-পত্রের সহিমোহরী নকলের জন্য আবেদল করলে সেই পক্ষকে উক্ত সহিমোহরী নকল সরবরাহ করতে হবে। আর অনুরূপ সহিমোহরী নকল সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। উল্লেখ্য যে, অন্যান্য দেওয়ানী আদালতের মতই সহিমোহরী নকল তোলার পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে।

[ধারা ৩২.০] বাড়ি মালিকের বিনা অনুমতিতে বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাবেনঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩২ ধারায় ভাড়াটিয়াকে তার বাড়ি মালিকের অনুমতি ছাড়াই বিদ্যুৎ সরবরাহ পাবার অধিকার প্রদান করেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, বর্তমানে বলবৎ অন্য কোন আইনে যাই থাকুক না কেন, যে কোন ভাড়াটিয়া তার বাড়ি মালিকের অনুমতি ছাড়াই ভাড়াকৃত বাড়িতে যে কোন লাইসেন্সধারী ব্যক্তির কাছ হতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারবেন। অন্যদিকে, লাইসেন্সধারী ব্যক্তি বলতে ১৯১০ সালের বিদ্যুৎ আইনের ২ ধারার (জ) দফায় বর্ণিত লাইসেন্সীকে বুঝতে হবে।

[ধারা ৩৩.০] অব্যাহতিঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৩ ধারার বিধান দ্বারা দেশের সরকার ও বিভাগীয় চারটি শহরের যেমন- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধানাবলী হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। কাজেই সরকার ও উক্ত চারটি বিভাগীয় উন্নয়ন কর্তৃপসমূহের দখলীয় বাড়ির ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে না। এই সকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী বাড়িভাড়া সম্পর্কিত বিরোধের নিস্পত্তি হবে।

[ধারা ৩৪.০] বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৪ ধারাই এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারকে বিধি প্রণয়নের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কারণ কোন আইনের প্রয়োগ করতে হলে তার সাথে কিছু বিধি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন হয়ে পরে। তাই যখন আইন প্রণয়ন করা হয় তখন সে আইনে প্রয়োজনবোধে বিধি প্রণয়নেরও ক্ষমতা সংযুক্ত করে দেয়া হয়। কাজেই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি বাস্তবে কোন আইনগত ত্রুটি বা অসুবিধা দেখা দেয় তাহলে এই আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্যে সরকার প্রয়োজনবোধে বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন।

[ধারা ৩৫.০] হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৫ ধারার (ঘ) দফায় বলা হয়েছে যে, ১৯৮৬ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের আওতায় দায়েরকৃত কোন মামলা বা আপীল যে সকল আদালতে বিচারাধীন ছিল তাদেরকে বর্তমান বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি কার্যকরী হবার তারিখ হতে এই আইনের আওতায আপীল আদালতের কাছে বিচারাধীন রয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
আর অনুরূপ দরখাস্তসমূহ নিয়ন্ত্রকের কাছে বদলী হবার পূর্বে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থা বা পর্যায় হতেই নিয়ন্ত্রক তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।

[ধারা ৩৬.০] রহিতকরণ ও হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬ ধারাবলে ১৯৯১ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশকে (অধ্যাদেশ নং ২, ১৯৯১) রদ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এরূপ রদের পূর্বে উক্ত অধ্যাদেশের আওতায় সম্পাদিত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থাদি এই আইনের আওতায় সম্পাদিত বা গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে।

@ অতঃপর কিতাবী আইন এবং তোঘলকী বাস্তবতাঃ

জাসটিস ডিলে জাসটিস ডিনাই, কথাটা প্রবাদসত্য। যেকোন আইনেরই সাফল্য এর সুষ্ঠু প্রয়োগধর্মী বাস্তবায়নযোগ্যতায়। কাজীর গরু যদি গোয়ালেই না থাকলো, কিতাবী অস্তিত্ব দিয়ে কোন ফায়দা আছে কি ? আইনের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তির পারস্পরিক স্বার্থের সংঘাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা। এই বাড়ি ভাড়া আইনেও বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া এই দুপক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে। উভয়পক্ষের অবশ্যপালনীয় হিসেবে কিছু বিধান সুস্পষ্টভাবে দেয়া আছে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে ?

ভাড়ার পরিমাণঃ
বাড়িভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে আইনটিতে মানসম্মত ভাড়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে আইনের ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪ তে স্পষ্ট করা আছে। তবে এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশান ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব যোনে ভাগ করে ক্যাটেগরিভিত্তিক যে সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে তাকে ভিত্তি ধরে ঢাকার যে কোন অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করা মোটেও সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু তোঘলকি বাস্তবতায় স্বেচ্ছাচারী বাড়িওয়ালাদের মুখের কথাই আইন হয়ে গেছে। ভাড়াটিয়াদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যে যেভাবে পারে আইনকে সম্পূর্ণ কাঁচকলা দেখিয়ে যথেচ্ছাচারের বলী হতে বাধ্য করা হচ্ছে ভাড়াটিয়াকে। অথচ আইনের ৭নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনক্রমেই মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না। এমনকি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই মর্মে কোন চুক্তি থাকলেও মানসম্মত ভাড়ার বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না।

ভাড়া আদায়ের রশিদঃ
বাড়িভাড়া আইনের ১৩ ধারায় বাড়িওয়ালার প্রতি ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক যখনই ভাড়া গ্রহণ করবেন তখনই বাড়ি ভাড়া পরিশোধের একটি রশিদ ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৮৬ এ উল্লেখিত ফরমে বা ছকে রশিদ ছাপিয়ে নিয়ে ঐ রশিদ দ্বারাই বাড়ি মালিককে ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদান করতে হবে। রশিদ ইস্যু করার সময় বাড়ি মালিক রশিদের মুড়িতেও লিখে রাখবেন এবং তা অবশ্যই বাড়ি মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ কি মানা হচ্ছে ? আমার জানামতে ব্যক্তি ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে কোথাও এটা মানা হচ্ছে না। ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালার বাড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে রাখা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। ফলে প্রয়োজনে ভাড়াটিয়া আইনের আশ্রয় নিতে সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং বাড়িওলার স্বেচ্ছাচারিতা কোনরূপ জবাবদিহিহীনতার প্রশ্রয়ে আরো যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠছে। বৈধভাবে ভাড়া পরিশোধ করেও লেনদেনের কোন প্রমাণপত্র না পাওয়া সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। এছাড়াও এই বাড়িভাড়া প্রাপ্তির প্রমাণপত্র না দেয়ার পেছনে বাড়িওয়ালার অন্য যে দুরভিসন্ধি কাজ করে তা হলো হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ না করে সরকারের রাজস্ব আয় ফাঁকি দেয়া। এটা কি নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের আওতায় আসে না ? অথচ আইনের ২৭ ধারায় বলা আছে, এই আইন অমান্য করে কোন বাড়ি মালিক যদি ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রশিদ প্রদানে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুন অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। আর রাজস্ব ফাঁকির জন্য কী দণ্ডের বিধান আছে তা সংশ্লিষ্ট আইনের অধ্যায় খুঁজে দেখা যেতে পারে।

অগ্রিম ভাড়া ও জামানতঃ
আলোচ্য বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১০ নং ধারায় বলা আছে, ভাড়া দেয়া বা ভাড়া নবায়ন করা অথবা ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে বাড়ির মালিক কর্তৃক ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত বা অনুরূপ কোন টাকা দাবী বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি অনুরূপ কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত প্রদানে কোন ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা যাবে না। এ ছাড়াও বাড়ি মালিক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অগ্রীম ভাড়া হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবী বা গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে কি তা মানা হচ্ছে ? অথচ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত আছে যে, বাড়ি মালিক এই আইনের ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক বাড়িভাড়া আদায় করলে সেক্ষেত্রে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন। তৎপরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

আবার ১১ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়ার অপেক্ষা অতিরিক্ত কোন ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বা অনুরূপ কোন টাকা গ্রহণ করলে বা দাবী করলে কিংবা প্রদানের জন্যে প্রস্তাব করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে দুই হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিককে দণ্ডিত করা হবে।

অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক আদালতের লিখিত আদেশ ছাড়া অগ্রীম ভাড়া বাবদ এক মাসের অধিক ভাড়া গ্রহণ করলে প্রথমবারের এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ বাড়ি মালিক গ্রহণ করেছেন তার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেক অপরাধের জন্যে এক মাসের অতিরিক্ত যে ভাড়া গ্রহণ করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

ভাড়াটিয়া উচ্ছেদঃ
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না বেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি ১৮(২) ধারা মতে বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলে ও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
তবে আইনসম্মত ভাড়া দেয়ার পরও যেসব কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে-
১.০ কোন চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের অনুমতি ব্যতীত বাড়ি বা বাড়ির কোন অংশ উপভাড়া প্রদান করলে বা
২.০ ভাড়াটিয়া যদি এরূপ কোন আচরণ করেন যা পার্শ্ববর্তী বাড়ি দখলকারীদের জন্যে বিরক্তিকর বা উৎপাতজনক হয় অথবা
৩.০ ভাড়াটিয়া যদি বাড়িটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকেন অথবা
৪.০ বাড়িটির নির্মাণ পুনঃনির্মাণ অথবা বাড়ি মালিকের বা তার লোকজনের প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হয়ে পরে যা আদালতের কাছে সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে।
এ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দেয়ার পরবর্তী দুমাসের মধ্যে বাড়িওয়ালা যদি নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ বা মেরামতের কাজ শুরু না করেন অথবা সাবেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দেয়ার ছয় মাসের মধ্যে যদি বাড়িওয়ালা অন্য কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে বাড়ি ভাড়া দেন তবে আদালত বাড়িটি সাবেক ভাড়াটিয়ার দখলে দেয়া বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া বা উভয়ই দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালাকে আদেশ দিতে পারেন।
৫.০ চুক্তিতে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বা এ রকম কোন চুক্তি না থাকলে মাসিক ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে যদি ভাড়াটিয়া পরিশোধ না করেন তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে। এছাড়াও
৬.০ যদি ভাড়াটিয়া ভাড়া নেয়ার সময় যে অবস্থায় বাড়িটি পেয়েছেন তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, বাড়ির অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি করেন এবং বাড়িওয়ালা এ রকম ক্ষতির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নোটিশ দেয়ার তিন মাসের মধ্যে ক্ষতি মেরামত না করেন। অথবা
৭.০ বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া ভাড়াটিয়া যদি বাড়ির কোনো স্থায়ী অবকাঠামোর ক্ষতি করেন।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে ? সামনের মাস থেকে বাড়ি ছেড়ে দেবেন, বাড়িওয়ালার মৌখিক নির্দেশই কোনঠাসা ভাড়াটিয়ার জন্যে ফরয-ই-আইন হয়ে বাধ্যগত আজাব নেমে আসে।

বাড়ি মেরামতঃ
বাড়ি মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ি মালিকের উপর এই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২১ নং ধারায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনতঃ বাধ্য। ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। কিন্তু উক্তরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়ি মালিক অনীহা প্রকাশ করলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন। আবার বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া দরখাস্ত করতে পারবেন।
ভাড়াটিয়া কর্তৃক অনুরূপ দরখাস্ত পাবার পরে নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নোটিশ প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে শুনানীর সুযোগ দেবেন। শুনানী শেষে প্রয়োজন মনে করলে বাড়িটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার আদেশ দেবেন। এই আদেশ দেবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বাড়ি মালিক যদি মেরামত বা করতে ব্যর্থ হন তাহলে ভাড়াটিয়া তা নিয়ন্ত্রককে জানিয়ে সে নিজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দরখাস্ত করতে পারবে। তবে এরূপ দরখাস্তের সাথে আনুমানিক একটি খরচের হিসাব অবশ্যই নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিল করতে হবে। নিয়ন্ত্রক তদন্ত করার পরে সন্তুষ্ট হলে ভাড়াটিয়াকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের অনুমতি দেবেন।
ভাড়াটিয়া নিজে বাড়িটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে পূর্বে বাড়িটি মেরামত করার জন্য যে হিসাব দেয়া হয়েছিল তার অপেক্ষা অধিক অর্থ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। ব্যয় করলে উক্ত অতিরিক্ত ব্যয়িত অর্থ বাড়ি ভাড়ার সাথে সমন্বয় করা যাবে না। আবার এও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অনুরূপ খরচ এক বছরে বাড়ি ভাড়ার মোট অর্থের এক ষষ্ঠাংশের বেশি হবে না।

আবার মেরামত যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় তাহলে সেভাবেই নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক আদেশ প্রদান করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে হবে। বাড়ি মালিক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিজ দায়িত্বে উপরে বর্ণিত নিয়মে বাড়িটি মেরামত করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি মেরামতের যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেই অর্থ বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে অনুরূপ ব্যয়িত অর্থ অবশ্যই উক্ত বাড়ি ভাড়ার এক ষষ্ঠাংশের বেশি হতে পারবে না।
কিন্তু বাস্তব বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ভাড়াটেদের খোয়াড়ি জীবনই এর ভাষ্য।

ভাড়া পুনঃনির্ধারণের সময়কালঃ
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবার তারিখ হতে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু বাস্তব কী বলে ? চলতি বছরের জানুয়ারিতে গোটা ঢাকাতেই বাড়িওয়ালারা খুব অন্যায়ভাবে বাড়িভাড়া একদফা বাড়িয়ে দিলেও জুলাই থেকেই শুনা যাচ্ছে যে আরেকদফা ভাড়াবৃদ্ধি ঘটে গেছে অনেক এলাকায় এবং অন্য অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের কাছে মৌখিক এলান দিয়ে ফেলেছে, দ্রব্যমূল্যের যা দাম ! আগামী মাস থেকে ভাড়া হবে এতো। নইলে বাড়ি ছেড়ে দেবেন। বাড়ি ছাড়লেই যে বাড়িওয়ালার লাভ ! নতুন ভাড়াটিয়াকে ঠিকই বর্ধিত ভাড়ায় বাসা ভাড়া দেবেন।

কিতাবে বন্দী আইনের সাথে বাস্তবতার তোঘলকি ব্যাভিচার যে কতোটা সঙ্গতিহীন ও বিপরীতমুখি, এরই গুটিকয় নমূনা উদাহরণ দেয়া হলো শুধু। তা প্রতিকারের কোনো উপায় কি নেই ? আইনের শোভন বাক্যবন্ধে এটাও স্পষ্ট বলা আছে যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার উপর অবিচার হচ্ছে এমন মনে করার কারণ ঘটলে তিনি যথানিয়মে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার রাখেন। এবং বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এই আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করতে হলে অবশ্যই উক্ত অভিযোগের অপরাধ সংঘটনের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে। অন্যথায় অনুরূপ অভিযোগ তামাদি দ্বারা বাতিল হয়ে যাবে। আইনের এরকম আশ্রয় যদি থেকেই থাকে, তাহলে প্রশ্ন আসে, তা সত্তেও এমন ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা কেনই বা প্রতিকার চেয়ে আইনের যথাযথ আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন ?

@ আইনের আশ্রয়ে যেতে ভয় কোথায় ?

স্বার্থসংশ্লিষ্টতার সংঘাতে এসে জগতের তাবৎ সম্পর্কই আসলে পরস্পরবিরোধী শোষক ও শোষিত, অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত সম্পর্কে উপনীত হয়। একপক্ষ যদি হয় মার্জার বা বিড়াল, অপরপক্ষ মুষিক। আইনের দৃষ্টিতেও এই দুই পক্ষকে ঘিরেই ধারা উপধারাগুলো আবর্তিত হয়ে থাকে, আইনী ভাষায় যাকে বলা হয় বাদী ও বিবাদী। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাবান শোষকপক্ষের বিপরীতে শোষিতপক্ষ দুর্বল ও নিস্পেষিত হয় বলে এরাই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে আইনী আশ্রয়ে সন্তুষ্টি খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু জ্বলন্ত বাস্তবতায় এই প্রতিকার চাওয়াটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল পক্ষের জন্য আরো অসংখ্য সমস্যা ও প্রতিকূলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং ক্ষেত্রবিশেষে আর্জি অনুযায়ী আইনী বিচারের রায় আবেদনকারীর পক্ষে গেলেও পরবর্তী বাস্তবতায় উদ্ভুত নতুন নতুন সমস্যা ও ভোগান্তিগুলো এমনই প্রত্যক্ষতা নিয়ে আসে যে, ওই আইনী প্রতিকার আর আদৌ কোনো উপকারে আসে বলে মনে হয় না। বরং ক্রমাগত দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব দুর্ভোগের কাহিনী যখন অন্যদের কাছে জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, অনুরূপ ভুক্তভোগীরাও খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই তখন প্রত্যক্ষভাবে এরূপ আইনী আশ্রয় নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনী প্রক্রিয়া আবেদনকারীর আর্জি অনুযায়ী সুবিচার হয়তো করতে পারে ঠিকই, কিন্তু আর্জিকারীর প্রত্যক্ষ নিরাপত্তা ও অনাগত সম্ভাব্য সমস্যা নিরসনে নিরঙ্কুশ আশ্রয় কি দিতে পারে ? আর তাই এই বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া বিরোধে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটা করতে যাবে কে ?

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে এতো চমৎকার সব বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন বাড়িভাড়া সংক্রান্ত যথেচ্ছাচারে ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা আইনী আশ্রয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে পারছেন না তার কারণ হিসেবে সম্ভাব্য কিছু প্রেক্ষিত সরেজমিন অনুসন্ধানে ওঠে আসে।
১.০ বাড়িভাড়া আইন ও বিধিমালা সম্পর্কিত ধারণা অধিকাংশ ভাড়াটিয়ার কাছেই পরিষ্কার নয়। ফলে তাদের কাছে কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ তাও স্পষ্ট নয়।
২.০ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে বাড়ি মালিকের ইচ্ছাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এখানে ভাড়াটিয়ার কোন মতামত গ্রাহ্য হয় না এবং তা প্রযোজ্যও নয় বলে মনে করা হয়। ফলে ভাড়াবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া পক্ষান্তরে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার সামিল।
৩.০ বাড়ি মালিকরা সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। এবং সঙ্গত কারণেই বাড়িওয়ালাদের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থগত কারণে একটা স্থায়ী গোষ্ঠীবদ্ধতা বা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ভাড়াটিয়ারা অস্থায়ী এবং কার্যকারণে খুব ক্ষণস্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় ভাড়াটিয়াদের মধ্যে সেরকম কোন পারস্পরিক সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। ফলে সঙ্ঘবদ্ধ বাড়িওয়ালা সিন্ডিকেটের সাথে ব্যক্তিভাড়াটিয়ার অসম সংঘাত কোনভাবেই ভাড়াটিয়ার পক্ষে যাবার সম্ভাবনা নেই। পক্ষান্তরে ঐ এলাকায় উক্ত ভাড়াটিয়ার জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
৪.০ সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভাড়াটিয়ার কোন সামাজিক শেকড় নেই বলে আইনের আশ্রয় নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে গেলে উদ্ভুত নানান সমস্যায় পড়তে হয়। ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে ভাড়াটিয়াকে নানান লাঞ্ছনারও শিকার হতে হয়।
৫.০ ছেলেমেয়ে নিকটস্থ স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত এবং বাসার কাছে প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিং এর ব্যবস্থা থাকায় হুট করে বাসা স্থানান্তর সম্ভব নয়। ফলে ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালার অন্যায় আবদার মেনে নিতেই বাধ্য হতে হয়।
৬.০ অফিস বা কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার সুবিধাজনক অবস্থায় পুনরায় বাসা ভাড়া পাওয়া অনিশ্চিৎ।
৭.০ যখন তখন যেকোনো উছিলায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা মূলত বাড়িওয়ালাদের একটা ইচ্ছানির্ভর সঙ্ঘবদ্ধ হীনপ্রয়াস। তাই এক বাড়ি ছেড়ে সমমানের অন্য বাড়ি ভাড়া নিতে গেলেও ভাড়াটিয়াকে অধিক ভাড়াই গুনতে হয়।
৮.০ বাসা ছেড়ে দেয়া মানেই ভাড়াটিয়াকে আরেকটি বাসায় ওঠতেই হবে। বাসা স্থানান্তর জনিত অতিরিক্ত ব্যয় আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ বিবেচনায় নিলে একান্ত বাধ্য না হলে এই বিড়ম্বনায় কেউ পড়তে চায় না।
৯.০ আইনী প্রক্রিয়ায় যথাযথ সাক্ষীসাবুদ নিশ্চিৎ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। একজন বাড়িওয়ালা অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণেই পার্শ্ববর্তী বাড়িওয়ালার স্যাসহায়তা পেয়ে যান অনায়াসে। অপরপক্ষে সমদুর্ভোগে ভুক্তভোগী হওয়া সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী অন্য ভাড়াটিয়ারা আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তে আবদ্ধ থেকে এরকম আইনী কোন ঝামেলায় সহজে জড়ানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে বিচারের বাণীকে হয়তো বা নিভৃতে কাঁদা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। এক কথায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ উপস্থাপন করা একজন সাধারণ ভাড়াটিয়ার পক্ষে দুঃসাধ্য।

গভীর অনুসন্ধানে এরকম আরো অনেক প্রেক্ষিতই হয়তো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সবগুলোর পেছনেই রয়েছে ভাড়াটিয়া নামের বিশাল এক সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক জনগোষ্ঠীর নিরূপায় অসহায়ত্ব। আর এখানেই সেই মোক্ষম প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে, আইন কেন আইন ? এবং আইন আসলে কার নিরাপত্তা বিধান করে ? একজন ফরিয়াদী যখন আইনের কাছে সুবিচারপ্রার্থী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, এটা কি তার অপরাধ ! নইলে তার আর্জির বিষয়বহির্ভূত অন্য আরো যেসব জীবনঘনিষ্ঠ এন্তার বিষয় রয়ে গেছে সেগুলো এমন অরক্ষিত হয়ে যাবে কেন ?

আইনের সাফল্য আর কার্যকারিতা নির্ভর করে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নযোগ্যতার উপর। খুনের ঘটনা সংঘটিত হলে এবং প্রকাশ্যে আলামত দৃষ্ট হলে বাদী হিসেবে স্বতঃপ্রণোদিত সংক্ষুব্ধ কাউকে পাওয়া না গেলে রাষ্ট্র নিজেই বাদী হয়ে আইনের শাসন সংরক্ষণ করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটাই আইনের বাস্তবায়নযোগ্যতা এবং স্বয়ৎক্রিয়তা। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনেও যেসব নির্বিচার অপরাধ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে, যার সাথে রাষ্ট্রের বিরাট অংকের একটা রাজস্ব আয়ের বিষয়ও জড়িত, সেই আইনটির স্বতঃস্ফূর্ত সংরক্ষণের কোন বিধান কি আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে কোথাও নেই ? তাহলে এ থেকে প্রতিকারের উপায়ই কী ?

@ এর কি কোন প্রতিকার নেই ?

প্রতিটা আইনেরই দুটো ভাগ রয়েছে। একটা হচেছ .Substantive law. বা মূল আইন, যা প্রয়োজনীয় দণ্ডবিধিগুলোকে ধারণ করে। অন্যটা .Executive law বা প্রায়োগিক আইন, যা তার বাস্তবায়নযোগ্যতা প্রকাশ করে। এ আইন কোথায় কীভাবে কখন প্রয়োগ হবে তাই বাস্তবায়নযোগ্যতা। এই বাস্তবায়নযোগ্যতা আবার দু’ধরনের। আর্জি নির্ভর ও স্বয়ংক্রিয়। আর্জি নির্ভর হচ্ছে আইনী সহায়তা পেতে ইচ্ছুক কোন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনসম্মত কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদনের মাধ্যমে ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয় এবং তার আবেদনের বৈধতা আবেদনকারীকেই তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে হয়। দেওয়ানী আইনসমূহ এ ধরনের হয়। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুশাসন নিশ্চিৎ ও অব্যহত থাকার নিমিত্তে যে আইন নিজে নিজে সচল হয়ে ওঠে। ফৌজদারী আইনগুলো মূলত এই ক্যাটেগরিতে পড়ে। এ কারণেই জনগুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোকে হতে হয় স্বয়ংক্রিয়।

এ ক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ি মালিক কর্তৃক ভাড়াটিয়াকে আর্থিক, মানসিক ও কখনো কখনো শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রাপ্য হোল্ডিং ট্যাক্স ও আয়কর ফাঁকি দেবার মতো ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হলেও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, আমাদের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এর ৩০ ধারা মোতাবেক আইনটিকে দেওয়ানী আইন বিধির অন্তর্ভূক্ত করে আইনের স্বয়ংক্রিয়তা নষ্ট করে এটাকে চলমান বাস্তবতায় পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।

আমরা চাই আইনের স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বয়ংক্রিয়তা। জনগুরুত্ব বিবেচনা করে এটাকে কীভাবে সম্ভব করা হবে তা নিযে আইনী বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এখানে সময়ক্ষেপন মৌলিক মানবাধিকার নীতিকেই ক্ষুণ্ন করে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নাগরিক হিসেবে আমরাও, যদিও আইনজ্ঞ নই তবুও, মোটাদাগে কিছু প্রস্তাবনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভাবনা ও বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারি।

০১) বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও স্বয়ংক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের নিমিত্তে এ আইনের ৩৪ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সরকার কিছু বিধি প্রণয়ন করে কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে আইনটির স্বতঃস্ফূর্ত তদারকি ক্ষমতা দিতে পারে। যারা নিয়মিত ভ্রাম্যমান টীম হিসেবে যে কোন এলাকায় যে কোন বাড়ি পরিদর্শন করে ভাড়াটিয়া বা বাড়ি মালিকের কাছে সংরক্ষিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে দেখবেন। বিধি না মানার কারণে সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী উদ্যোগ নেবেন। দায়বদ্ধতা নিশ্চিৎকরনের লক্ষ্যে যে বাড়ি পরিদর্শন করবেন, তদারকী কর্তৃপক্ষ বা পরিদর্শন দল অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ভাড়াটিয়ার কাছে স্বাক্ষর, তারিখ ও বিষয় উল্লেখ করে একটি পরিদর্শন রশিদ প্রদান করবেন যার একটি অংশ কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এরকম ক্ষেত্রে বাড়ির মালিক হয়তো পরিদর্শনকারীর কাছে প্রকৃত ভাড়াটিয়াকেও আত্মীয় পরিচয় দিয়ে পূর্ব থেকে বাধ্য করতে পারে। এটাও পরিদর্শনকারীর নিশ্চিত হতে হবে। জাতীয় পরিচয় পত্র এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
০২) যেহেতু বাড়িভাড়ার সাথে সরকারের প্রাপ্য হোল্ডিং ট্যাক্স বা রাজস্ব আয় জড়িত, তাই এই তদারককারী কর্তৃপক্ষের সাথে বিশেষ আইন দ্বারা রাজস্ব বিভাগ বা বোর্ড ও সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জড়িত করা যেতে পারে।
এই বাড়িভাড়া আইন তদারকীর দায়িত্বে সরকারের কোনো দপ্তর বা স্বাধীন কর্তৃপক্ষ রয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে যথাযথ আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশান যেহেতু হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে এবং গোটা ঢাকা অঞ্চলের সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার একটা নমূনাও নির্ধারণ করে দিয়েছে, ধারণা করছি যে, ডিসিসির এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এছাড়া বাংলাদেশের আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ এর ৩৬ নং অধ্যাদেশ) এর অধীন আয়কর রিটার্ন ফরম আইটি- ১১গ এর তফসিল-২ (গৃহসম্পত্তির আয়) কলামে প্রত্যেক করদাতাকে বাৎসরিক বাড়িভাড়া আয় বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করতে হয়। তাই উপস্থাপিত তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপরও কোন না কোনভাবে এই দায়িত্ব অর্পিত আছে বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু এই অর্পিত দায়িত্ব তারা কীভাবে পালন করছেন তা দেখার দায়িত্ব কার ? এই গরীব রাষ্ট্রের এতো বিশাল একটা আয়ের খাতের আদৌ কোন পরিচর্যা হচ্ছে কি না, তার-ই বা দেখার দায়িত্ব কাদের ?
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে এ বিষয়টাকেও সরকার কোন বিধি দ্বারা স্পষ্ট করে দিতে পারেন।

০৩) গঠিত এ তদারকী কর্তৃপক্ষ যে অর্পিত দায়িত্ব পালনের উছিলায় আরেকটা অনিয়মের অত্যাচারী ঘাঁটি হয়ে ওঠবে না তার সম্ভাব্য বাস্তবতা মেনেই দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল থাকতে পারে। তারা ঐ তদারকী কর্তৃপক্ষের এলাকা পরিদর্শন রিপোর্টগুলো নিয়মিত যাচাই করবেন এবং স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্ব অবহেলার জন্য প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেবেন।
০৪) সাধারণ নাগরিকদের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দপ্তর থেকে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়ায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এই বিজ্ঞপ্তিতে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রধান প্রধান দণ্ডবিধিগুলো প্রচার করতে হবে এবং তা পালিত না হলে সুনির্দিষ্টভাবে কোন যোগাযোগ নম্বরে রিং করে অবহিতকরণের জন্য নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি অবহিত করবেন তার পরিচয় প্রদান বাধ্যমূলক নয়।
০৫) প্রচারিত নমূনা বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে, যেমন-
৫.১ আপনি কি বাড়িভাড়ায় থাকছেন ? আইনসম্মত বৈধ ভাড়াটিয়া হিসেবে আপনি আপনার সংশ্লিষ্ট মাসের বাড়িভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে অথবা ভাড়াচুক্তিতে উল্লেখিত তারিখের মধ্যে পরিশোধ করুন।
৫.২ আপনার পরিশোধকৃত বাড়িভাড়ার রশিদ সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিক বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে তাৎক্ষনিক বুঝে পেয়েছেন কি ? বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন/অধ্যাদেশ ১৯৯১ এর ১৩ ও ২৭ ধারা মোতাবেক বাড়ির মালিক তা দিতে বাধ্য।
৫.৩ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোন ভাবেই বাড়ি মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রীম বাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোন প্রকার ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তা হলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন।
এর কোন ব্যত্যয় হলে আপনার অভিযোগ এই নম্বরে ........... জানিয়ে দিন।

এভাবে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ আইন, বাড়িভাড়া কত হবে বা বাড়িভাড়া পুনঃনির্ধারণের সময়সীমা ইত্যাদিও উক্ত বিজ্ঞাপণে প্রচার করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য যোগাযোগ ঠিকানা উল্লেখ করা যেতে পারে। দুনীতি দমন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কোন ঠিকানা বা অভিযোগ নম্বরও প্রচার করা যেতে পারে।

@ মিডিয়া পারে অনেক কিছুই বদলে দিতে

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসে মিডিয়ার যে কী বিস্ময়কর ক্ষমতা. এতে আশা করি কেউ দ্বিমত করবেন না। গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়াগুলো সদিচ্ছা দেখালে অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে। তার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পেয়েছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক জনগোষ্ঠীর গলায় ফাঁস লাগানো বাড়িভাড়া সংক্রান্ত এই নিরবচ্ছিন্ন সমস্যাটিকেও আমাদের মিডিয়াগুলো একটা ব্যাপক ও বৃহত্তর সমস্যা হিসেবে আন্তরিকভাবে বিবেচনা করলে তা নিরসনে খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে অবশ্যই। প্রিণ্ট মিডিয়ায় বিশেষ করে দৈনিকগুলোতে মাঝেমধ্যে এ বিষয়ে কিছু রিপোর্টিং হলেও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এক্ষেত্রে কেন যে এতো বিস্ময়করভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে তা বোধগম্য নয়। কেবলমাত্র বাড়ি মালিক সম্প্রদায়ভুক্ত কেউ হয়তো এটা চাইবেন না যে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এ দেশে যথাযথ কার্যকর হোক। নইলে আর কারো তো তা না চাইবার কথা নয়। তাহলে কি অবৈধ সুবিধাভোগিতার দীর্ঘ কালো হাত ওই নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও শিকড় গেঁড়েছে ?

মিডিয়াই পারে এই নিষ্ক্রিয়তাটাকে ভেঙে দিতে। বিশেষ করে জলজ্যান্ত ভিজ্যুয়াল মাধ্যম হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে এখনই এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিৎ। নাহলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা আমাদেরকে কি দুঃখজনকভাবে এটা ভাবতে বাধ্য করবে না যে, আশা ভরসার চতুর্থ বিশ্ব হিসেবে মিডিয়া কর্তৃত্বও অবৈধ সুবিধা বাণিজ্যের কাছে পরাজিত ? টিভিতে নানান ধরনের টক শো আমরা দেখি। কিন্তু বাড়িভাড়ার অনিয়ম অসংগতি প্রতারণা থেকে কীভাবে পার পাওয়া যায়, কীভাবে এই অবৈধ ঘটনাগুলো রোধ করা যায়, এ নিয়ে এখনো সেরকম কোন টক শো কি আমরা আদৌ দেখেছি ? অথচ দু-একটা সরেজমিন অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও মনিটরিং কী না করতে পারে ?

টিভির কোন একটা চ্যানেলের নবটা অন করতেই কৌতূহলি দর্শক হঠাৎ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে টিভি পর্দায় দেখতে পেলেন যে মুভিসরঞ্জামসহ একদল টিভিক্রু ঢাকার কোন একটি আবাসিক এলাকায় আকস্মিক উপস্থিত। কডলেস মাইক্রোফোন হাতে উপস্থাপক বলছেন, দর্শকমণ্ডলি আমরা এখন ঢাকার অমুক এলাকার তমুক হোল্ডিং এর এতো নম্বর বাড়িতে। তারপরই দলটি বহুতল ভবনের গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলো ভেতরে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় কয়েকটি ফ্ল্যাটের বা বাসার ভাড়াটিয়ার ভাড়া সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সনাক্ত করার তাৎক্ষণিক রিপোর্ট নিয়ে প্রাপ্ত অসংগতিগুলো যাচাই করতে গিয়ে বাড়ি মালিকের অযৌক্তিক জবাবদিহিতাগুলোও রিপোর্ট করলো। এরপরেই দেখা গেলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পূর্বোক্ত হোল্ডিংয়ের তথ্য অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে প্রকৃত অবস্থার বৈষম্য উদ্ঘাটন করতে। একইভাবে হয়তো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দপ্তরে আয়কর রিটার্নসের প্রযোজ্য ফরমে প্রদত্ত অসত্য তথ্যের সত্যতাও যাচাই করলেন এরা। শেষে একজন আইন বিশেষজ্ঞের সাথে গোটা অবস্থাটি নিয়ে একটা আইনী মতামতও প্রচার করা হলো। পরিশেষে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীতভাবে তাঁর সমাপ্তি বক্তব্য টানলেন-

দর্শকমণ্ডলি, ভয়াবহ জনসংখ্যায় ফুলে ফেঁপে ওঠা আমাদের এই ঢাকা মহানগরী আজ মানুষের ভীড়ে রীতিমতো পর্যুদস্ত। এতো মানুষের চাপ সয়ে এই নগরীর নাগরিক সুবিধাগুলো আজ হুমকীর সম্মুখীন। পানি সমস্যা, বিদ্যুৎ সমস্যা, গ্যাস সমস্যা, রাস্তাঘাট যোগাযোগ সমস্যা, ড্রেনেজ সমস্যা, পরিবহন সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। কিন্তু এতো সব সমস্যার মাঝে অন্য যে গভীর সমস্যাটি নগরীর মোট জনসংখ্যার প্রায় আশিভাগ নাগরিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধান একটি মানবিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো আবাসন সমস্যা। আর এই মানবিক সমস্যাটিকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু বাড়িভাড়া ব্যবসায়ী বা বাড়িওয়ালা অত্যন্ত অমানবিক উপায়ে নিরূপায় ভাড়াটিয়াকে জিম্মি করে, বলা যায় প্রতারণা করে, সরকারের প্রাপ্য কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। এ দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ঢাকার সবকটা এলাকার জন্য যে মানসম্মত ভাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ এমনকি তারচে’ও অনেক বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে অসহায় ভাড়াটিয়াদেরকে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠেছে যে, প্রায় কোন বাড়িওয়ালাই ভাড়া পরিশোধের কোন বৈধ রশিদ ভাড়াটিয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। রাষ্ট্রীয় আইনে যে কোন বৈধ লেনদেনে বিধিবদ্ধ রশিদ বা প্রমাণপত্র থাকতে হবে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে ভাড়া পরিশোধকারীকে ভাড়া বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষরিত রশিদ দেয়া বাড়ি মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা আছে এবং আইন অমান্যকারীর জন্য জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রয়েছে । তারপরেও এ আইন মানা হচ্ছে এরকম কোন তথ্য আমাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টে আসেনি। ফলে ওই লেনদেনের বৈধতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই বাড়িভাড়ার সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত হোল্ডিং ট্যাক্স নীতিমালারও। এটা কোন লুকোছাপা বিষয় নয় আজ। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই। আমাদের সরেজমিন রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের আলোচনা থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, এই সেক্টরে অত্যন্ত নগ্নভাবে বিষয়টি প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এবং তা সুস্পষ্ট প্রতারণা ও আর্থিক নির্যাতনের মাধ্যমে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের কিছু অসাধু কর্মচারিদের সহায়তায় কিছু লোকের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠছে, অন্যদিকে ফাঁকিতে পড়ে যাচ্ছে সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব আয়। আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা অত্যন্ত জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এবং একই সাথে তা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডও। শুধু ঢাকাতেই নয়, গোটা দেশেই এই অপরাধ বিস্তৃত। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত এবং সীমিত আয়ের অসহায় নাগরিক জনগোষ্ঠীকে এই ফাঁদ থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় এবং সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয়কে কীভাবে সঠিক খাতে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, কর্তৃপক্ষ এবং সচেতন নাগরিকদেরকে এখনি ভাবতে হবে। আর কালক্ষেপনের সময় নেই। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।


এটা একটা কাল্পনিক টিভি রিপোর্ট। কিন্ত তা বাস্তবায়িত করা কি সত্যিই অসম্ভব ?

@ তবু কি সেলুকাস ?

এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কারো কাছে অনুনয় বিনয় অনুরোধ উপরোধ করার মতো সার্বজনীন বিষয় ছিলো না এটা। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের বিষয় ছিলো তা। তবু কোন স্বাভাবিক কাজ স্বাভাবিকভাবে না হওয়াটাই দুর্ভাগা জাতি হিসেবে আমাদের নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে হয়তো। তাই আগামীতে আবার যদি কখনো কৌতুক করেও বলতে হয়, ‘হা সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ !’ তা কি নিজের উপর নিজে থুথু ছিটানোই হবে না ? কেননা কখনো কখনো থুথু নিক্ষেপ থুথুরই অবমাননা হয়ে যায় !


কৃতজ্ঞতা:
০১) বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১/ সৈয়দ হাসান জামিল/ বাংলাদেশ ‘ল’ বুক সেণ্টার/ ফেব্রুয়ারি, ২০০০ ইং।
০২) বাড়ি ভাড়ার আইনি নিষ্পত্তি/ মোহাম্মদ আরজু/ যায়যায়দিন (আইন ও বিচার)/ ৩০ মে ২০০৮ইং
০৩) বাড়িওয়ালার কাছে ভাড়াটিয়ার জিম্মি দশা দূর করুন/ দাস প্রভাস/ দৈনিক ভোরের কাগজ/ ০৪ জানুয়ারি ২০০৮ইং।
০৪) রাজধানীতে বাড়ি ভাড়ায় নৈরাজ্য/ রিয়াজ উদ্দীন/ দৈনিক ডেসটিনি/ ১৪ মার্চ ২০০৮ইং।
০৫) দ্রব্যমূল্যের দ্বিগুণ হারে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া/ দুলাল আহমদ চৌধুরী//দৈনিক আমাদের সময়/ ৩১মার্চ ২০০৮ইং।

[Bari Vara Aain/House Rent Law/Ranadipam Basu]
(১৭/০৮/২০০৮)

[sachalayatan]
[mukto-mona]
[amarblog]
[khabor.com]
[sa7rong]
[muktangon]
[somewherein][episode1][episode2][episode3]
[pechali]episode-[01][02][03][04][05][06]