‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Saturday, August 16, 2008
# শাটল ট্রেন ...(সচল পেন্সিলে আঁকা- ০৩)
শাটল ট্রেন
-রণদীপম বসু
সোহরাওয়ার্দী হলের নিয়মিত বোর্ডার হওয়া সত্ত্বেও ‘অভিজ্ঞতা মানেই জ্ঞান’ এই আত্মদর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উদ্দেশ্যহীন আমি মাঝেমধ্যে শাটল ট্রেনটাতে চড়ে বসতাম, তার পেছনে কি কোনই উদ্দেশ্য ছিলো না ! ভাষা ব্যবহারের অভ্যস্ততায় ব্যবহার করা ‘বসতাম’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ বেশিরভাগেক্ষেত্রেই এর আদি অর্থে ঠিক থাকতো না। কখনো হতো ‘দাঁড়াতাম’, কখনো ঝুলতাম, কখনো লটকাতাম, কখনো বা মাইনকা চিপায় পড়তাম ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনকার শামসুন্নাহার হল নামের নতুন ও পুরনো লেডিস হল দুটোর তাবৎ সৌন্দর্য্যের অহঙ্কারকে এতিম বানিয়ে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব সুন্দরীরা কেনই বা চট্টগ্রাম শহর থেকে আসা যাওয়া করবে, এর সুলুকসন্ধান নেয়াটাও ওই বয়সের জন্য অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ছিলো বৈ কি। সব দেশে সব কালেই তারুণ্যের মজমা হয়তো একই রকম। তবু সে সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখনকার মতো এতোটা ঝলমলে চকমকে হয়ে উঠেনি তখনো। অনেকগুলো পাহাড় তখনো আড়াআড়ি কাটা হয়ে বড় বড় লিঙ্ক রোড এবং আরো ছাত্রছাত্রী হলগুলো তৈরি হয়ে ওঠেনি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অহঙ্কার ‘অপরাজেয় বাংলা'র স্থপতি সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এর গড়া সেই দুর্দান্ত স্বাধীন শহীদ মিনারটার জায়গায় অন্য এক শহীদ মিনার তখনো আমাদের চিন্তার অগম্যে ছিলো। আরো অনেক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও নাকি হয়ে গেছে এখন। কিন্তু সেই চারদিকে চেনাঅচেনা বুনো ঝোপঝাড় লতাগুল্ম গাছগাছালি জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে একেবেঁকে চলে যাওয়া কালো সাপের মতো সরু রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো প্রাকৃতিক জীবন, সে এক অন্য জীবন ! কতকাল আগে ফেলে এসেছি ! আর যাইনি কখনোই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনগুলোর এখনকার অবস্থা কেমন জানি না, তবে কুড়ি বাইশ বছর আগেও যে ওটাকে আমরা মানে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনাই ভাবতাম তাতে কোন ভুল ছিলো না। চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, এই নির্ধারিত যাতায়াতে ছাত্রছাত্রী ছাড়া অন্য কোন যাত্রী খুব একটা উঠতো কি না তা ভালো করে খেয়াল করে দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকরাও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বাস সার্ভিস তো ছিলোই। তবু ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের শাটল সার্ভিসটার বৈশিষ্ট্যই আলাদা। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও আগাপাছ মুরগীবোঝাই এই শাটল ট্রেনটাকে যদি চলন্ত অবস্থায় অলৌকিকভাবে অনেকগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে নেয়াও যেতো, তাহলেও প্রতিটা টুকরোতেই হয়তো দেখা যেতো এক বা একাধিক বিচিত্র সব জটলা বিচিত্রতর হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত আর একেকটা বৈচিত্র্যময় গ্রুপ হয়ে গান বাদ্য নৃত্য অভিনয় কী নয় ইত্যাদির উচ্ছ্বল তারুণ্যের আড্ডায় মুখর হয়ে আছে। ছেলেতে মেয়েতে কোন বিভেদ নেই। কেউ সীটে কেউ হাতলে কেউ জানলায় কেউ মেঝেয় কেউবা সিঁড়িতে। বগির বাইরে ছাদও বাকি নেই। এই মুখরতার মধ্যে ট্রেনটা কি সত্যি সত্যি নির্ধারিত গন্তব্যে যাচ্ছে না কি পাতালের রাস্তা ধরেছে, অথবা প্রকৃতির মহাজাগতিক নিয়মগুলোর দু-একটা ওলোটপালট হয়ে আচমকা আকাশে উড়াল দিলেও বোধ করি এরা টের পেতো কি না সন্দেহ !
আর পাবেই বা কী করে ? প্রকৃতি তার কৃত্রিমতাবর্জিত আদি সৌন্দর্যকে অসংখ্য পাহাড় টিলা ঢাল বন বাগান আর হারিয়ে যাবার মতো অপরূপ গাঢ় সবুজ দিয়ে যেভাবে এক বুনো সৌম্যতায় ঘিরে রেখেছে গোটা ক্যাম্পাস, প্রকৃতির মতোই ওখানে বেড়ে ওঠা তারুণ্যে এর গভীর প্রভাব যাবে কোথায় ! ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকৃতির সহজ সরল বিশ্বাসের বন্ধন তাদেরকে বহু অসভ্য জটিলতা থেকে মুক্ত রেখে প্রাণিত সবুজ করে রেখেছিলো। এই সহজীয়া বন্ধনটাই একদিন নষ্ট হয়ে গেলো ছিয়াশির নভেম্বরে গোটা দেশ থেকে এনে জড়ো করা বহিরাগত জেহাদি ক্যাডার দিয়ে ঘটানো ইসলামী ছাত্র শিবিরের এক সশস্ত্র জংলী অভ্যুত্থানে।
দৃশ্যমান আলোর জগৎ থেকে একটা অদৃশ্য অন্ধকারে ডুব দিয়ে ওঠে আমাদের স্নিগ্ধ চোখটা অতীত হয়ে গেলো ঠিকই, কিন্তু নতুন দৃষ্টির অভিনবত্বে চমকে ওঠলাম ! এতোদিন না বুঝলেও এবার চিনতে পারছি, আমাদের মধ্যে কেউ মুসলমান, কেউ বেদ্বীন, কেউ নাজায়েজ নাফরমান, কেউ নাস্তিক জালেম ! আর কী আশ্চর্য, পাখির মতো স্বাধীন চঞ্চল নিরাপদ মেয়েগুলো দেখতে দেখতে কীভাবে যেনো আমাদের মগজের ভেতরে অচেনা গ্রহের একেকটা বিপজ্জনক সেক্সি প্রাণীতে পরিণত হয়ে গেলো ! নিষ্পাপ আল্লাহওয়ালা ছেলেগুলোকে এরা জাহান্নামের দরজায় টেনে নিতে একপায়ে খাড়া হয়ে রইলো ! জুড়ে বসা ধর্মীয় সংস্কৃতির তুলাদণ্ডে এতোদিনের বেদ্বীন চোখে দেখা ন্যাচারাল সৌন্দর্য আর সহজবোধ্যতা কী অবলীলায় নাপাক হয়ে গেলো !
দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, রোববার ও সমমনা পত্রিকাগুলোর সাথে প্রিণ্ট মিডিয়ায় নতুন ডাইমেনশান আনা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, বিচিন্তা, আগামী, যায়যায়দিন এর মতো প্রগতিশীল ম্যাগাজিনগুলো নিষিদ্ধ হলো ক্যাম্পাসে। বন্ধ হয়ে গেলো ভাষা শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এর মতো শহিদ মিনার ছোঁয়া অনুষ্ঠানগুলোর সাথে সাথে ক্যাম্পাসের সাহিত্য সংস্কৃতির যাবতীয় কর্মকাণ্ডও।
এবং বিংশ শতাব্দির শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগীয় এক ধর্মীয় রাজনৈতিক আবহে আমরাও একেকজন প্রাগৈতিহাসিক অশ্লীল প্রাণীতে পরিণত হতে লাগলাম... !
(১৬/০৮/২০০৮)
[sachalayatan]
[somewherein]
[pechali]
[amarblog]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment