Wednesday, September 3, 2008

@ টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০১ (কবিতাগুচ্ছ)







টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০১ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু


ওহে নির্লজ্জ নগরবাসী ...

থু থু গুলো ছুঁড়ে দাও
কারো না কারোর ঘৃণায় নৈবেদ্য হবে

ডেলফির মন্দির থেকে ঘোষিত অমোঘ স্বর
আমাকে উৎপীড়ণ করে ছুঁড়ে দাও ছুঁড়ে দাও বলে
আমি তো জমাইনি তা
আজীবন গিলে ফেলা নিজের লজ্জাগুলোই
ওঠে আসে উদ্ভ্রান্ত উদ্গারে..
প্রাচীন বর্জ্যের মল
দলা পচা দুর্গন্ধ থুথুর ভারে এ প্রথম আক্রান্ত আমি

পাকস্থলি ছোট-বড় অন্ত্র সব নিরুদ্দেশ
মুখগহ্বর জুড়ে স্যুয়ারেজ পাইপ, ছুটে আসা বিষাক্ত ঘৃণার স্রোত
আমাকে নিমজ্জন করে
কোথায় ফেলবো তা ? ফুটপাথ, রাজপথ, পরিত্যক্ত নর্দমায় ?
ছেয়ে থাকা কিলবিলে কীট জোঁক পিঁপড়েও
বইবে না মানুষের আদিম লজ্জার ভার

ডেলফির মন্দিরে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে
আমাকে ফেলতেই হবে, আহা কতো নিরূপায়
ঘৃণার ভারে জর্জরিত পৃথিবীর আদিম সত্তা
কারো না কারোর ঘৃণায় নৈবেদ্য হবে
ওহে নির্লজ্জ নগরবাসী তোমরা কি জানো
আমার উৎক্ষিপ্ত ঘৃণাকে আমি কোথায় নৈবেদ্য দেবো ? @

[ভাড়াটে ঘাতক দিয়ে কারো মৃত্যুকে চিহ্ণিত করেও যারা নির্দোষ,
অলৌকিক এ স্বীকৃতির বৈধতা বিলায় যারা, আমার এ পঙক্তিমালা তাদের জন্য।
]
(৩১/০৮/২০০৮)
[sachalayatan]


বুকের ওড়নায় দেখো...

বোঝাতে পারি নি বলে নয়
বোঝাতে চাই নি বলেই বুঝতে পারো নি তুমি

অখণ্ড ঘৃণায় মেখে ছুঁড়ে দেবে ?
তাই দাও। এই বুক, বুকের খণ্ডিত আকাশ
বিষণ্ন জমিন এবং আমাকে দেখছো যা
তুমি তো জানো না যে এ সবই তোমার
লম্বিত সত্ত্বাই কেবল

যা কিছু ছুঁড়ো না কেন আমি যে আমি নই
ক্ষোভের ধারালো কাণায় ঘেষে ছিঁড়ে ফেলো বুক
তখনো বুঝবে কিনা অথবা বুঝবে না কিছুই
বিপণ্ন আয়নার চোখে চোখ রেখে
হয়তো জানবেও না- চেয়ে আছো আমার দিকেই

চমকে ওঠবে কি-
বুকের ওড়নায় মাখা ক্ষতনীল রক্তের চিহ্ণগুলো দেখে ?
(২৮/০৯/২০০৮)
[sachalayatan]



শীত কুড়ানো কৈশোর ফেলে

তোমাদের শহরে উত্তুরে হাওয়া নেই
বাদুড় ঝাপটানো রাতে নিঃশব্দ টিনের চালে
টুপটাপ পতনের শব্দ কোথায় পাবো ?
শিশিরহীন পথভুলো ধোঁয়াকেই অভ্রান্ত কুয়াশা ভেবে
তোমাদের সকালগুলো হারিয়ে যায় শৈশবহারা ঘুমে
বিকেলগুলো গিলে খায় ঝলমলে শপিং মল আর বুড়োদের পার্ক।
সর্ষে ক্ষেতের আলে আলে শীত কুড়ানো কৈশোর ফেলে
বড়জোর যেতে পারি সুতন্বির ঘাটে,
আমাকে খেয়া পার হতে বোলো না
নক্সীকাঁথায় মুড়ে ইচ্ছেখুশি যেতে পারা স্বপ্নের হাত ধরে
রূপকথা’র দেশে যাবার ঘুটঘুটে অন্ধকার তোমাদের শহরে নেই।

স্নানরত চাঁদটা’র সাথে প্রতিরাত কথা হয় আমার
উনুনের ওম ফেলে ছুটে আসি রোজ, একদিন আমাকে সে
সত্যিই নিয়ে যাবে হীরেমোতি কন্যার কাছে। এমন ইচ্ছের মতো
বেড়ে ওঠা ঝোপের পাশে এরকম নিরিবিলি ঘাট নিঝুম পুকুর
তোমাদের শহরে তো নেই !

চোয়ালে গেঁথে যাওয়া ইস্কুল পালানো ডাঙ্গুলির দাগ, স্বপ্নের কাছাকাছি
ভুবনের হাট আর পাখি হ’তে বাধাহীন পূর্বধলা মাঠ
তোমাদের শহরে আছে কি কোথাও...?
(২৩/০১/২০০৯)


আত্মপরিচয়

মাছুম শিশুদের দিকে বর্বর মারণ-অস্ত্রগুলো নির্বিচার তাক করার আগে
কী আশ্চর্য, একবারও ভাবলো না ওরা, অভিধান থেকে পশুরাও
মুছে না শৈশব ! বাড়ন্ত শৈশবে পৌঁছার আগে
উষার আলোয় রাঙা জীবনের কাছে নতজানু হয়ে পশুরও বৈধ মাতৃজরায়ু থাকে।
বারুদের গন্ধ ঠাশা অবৈধ ধূলোমেঘে ঢেকে যাওয়া গাজা’র আকাশ
কীভাবে ফিরিয়ে দেবে মানুষের অপসৃত বৈধ পরিচয় !

ভদ্রমহোদয়গণ, জান্তব ট্যাঙ্কের চাপায় থেতলে দেয়ার আগে মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে
ভাবতে পারে না যারা- শিশুদের কোনো সীমান্ত নেই, মানুষের পৃথিবীটা
শিশুদেরই অনিবার্য বৈধ অধিকার,
পবিত্র ফিলিস্তিনের দোহাই, ওদেরকে খাঁচাবদ্ধ করুন। না হয় আর দেরি নয়,
হাত পা নাক মুখ চোখ কান এবং অভিন্ন দেহের আকার ওদেরই অনুরূপ দেখে
মানুষের অভিধান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করুন !

পশুরা পশুই হয়, তবু এরা ঘৃণ্য অমানুষ নয় !
সন্তানের চোখে চোখ রেখে, ভদ্রমহোদয়গণ, এবার আপনাদের আত্মপরিচয় দিন।
(২৩/০১/২০০৯)
[sachalayatan]



আয় বাবা বুকে আয়...

‘উঁহু, এটা নয়, ওইটা এখানে !’
‘হাঁ হাঁ, এটা ঐদিকে !’
ছিন্নভিন্ন দেহাংশগুলো সাজাতে সাজাতে
সন্ত্রস্ত ফিসফিসানিগুলো গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।
পিতার বন্ধুদের সংখ্যা কমতে কমতে সামান্য ক’জনে এসে দাঁড়িয়েছে,
কী আশ্চর্য ! ‘কোলে এসো’ বলে একবারও হাত বাড়ালো না কেউ !

‘কিন্তু এই জায়গাটা খালি যে !’
এমন অদ্ভুত প্রশ্নের নিরুত্তর মর্ম খুঁজে তন্নতন্ন হয় একজোড়া শৈশব আকাশ,
‘আয় বাবা বুকে আয়’ ডাকে যেখানে ঝাঁপ দিতো অপার বিশ্বাসে, ওটা নেই !
‘ওটা নেই’
গুমোট নৈঃশব্দের চাদরে ঢেকে দেয়া দেহে ‘আয় বাবা বুকে আয়’ ডাকা ফিলিস্তিনি বুকটাকে
কোথাও পাওয়া গেলো না আর।

‘চলুন দাফন করি।’
ঘরঘর ঘরঘর দ্রিম দ্রিম... বীভৎস কোলাহলে চাপা পড়া
মৌলভী সাহেবের কান্নাতুর মোনাজাতে হাত উঠালো সবাই,
কেউ জানলো না
একটা উদ্বাস্তু শৈশব কখন যে অগোচরে ছুটে গেলো কোথায়...

ঘররঘর ঘররঘর ঘুমম্ ঘরঘর...
বিশাল দানবচাকা যান্ত্রিক বেল্টের দাঁতে খাবলে খাবলে এদিকেই আসছে !
হিংস্র ধাতব চোখে দ্রিম দ্রাম কীসের স্ফুলিঙ্গ এসব ! ধ্বসে যাওয়া বসত বাজার ফেলে
দিগবিদিক ছুটছে সবাই ! চারপাশ ছারখার করে ওটা কি সত্যিই পাহাড় !
দাউ দাউ বারুদপোড়া আকাশের তলে হঠাৎ দেখলো সবাই ভয়াল বিস্ময়ে-
মৃত্যুদানবের পথরোধ করে নির্ভীক দাঁড়িয়ে গেছে অনড় এক শিশু ! যুবা নয় তারুণ্য নয়,
মৃত্যুকে যুঝবে আজ অবুঝ শৈশব !
দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ তার, অতশত বোঝে না সে, অভ্রান্ত বিশ্বাসী হাতে
নিমেষেই উঠে আসে শৈশবের বৈধ হাতিয়ার। ধেয়ে আসা পৃথিবীর
ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অব্যর্থ নিশানায় ছুটে যায় শিশুতোষ মানবিক ক্রোধ
একটুকরো প্রতিবাদ, অধিকার, অনাবিল মাটির ঢেলা...

ঘরঘর ঘরঘর ঘরঘর... আয় বাবা বুকে আয়... ঘরঘর ঘরঘর ঘরঘর...
আয় বাবা আয়...
(২৫/০১/২০০৯)
[sachalayatan]
[sa7rong]

No comments: