Friday, September 5, 2008

@ তাঁর কথা মনে এলে...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৫)








তাঁর কথা মনে এলে...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৫)
-রণদীপম বসু



বিষণ্ন পঙক্তিমালা

‘একবার উঠেছিল, তবু মাঝপথে/ যেন থেমেছে করাত,/ শুধু গুঁড়ো পড়ে আছে।/ অর্ধেক খেলার পরে সমস্ত পুতুল গেছে উঠোন পেরিয়ে;/ অর্ধেক প্রেমের পর রোদ পড়ে এসেছে শরীরে/ অর্ধেক ঘুমের পর তুমি চলে গেছ।’......
-(অসমাপ্ত/ কাব্যগ্রন্থ:সদর স্ট্রিটের বারান্দা/ প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত)


এমন বিষণ্ন অসমাপ্তিই বুঝি জড়িয়ে থাকে মানুষের প্রতিটি জীবনে; জীবনের প্রতিটি কাণায়। ভিন্নতা হয়তো আকারে, প্রকারে আর উপলব্ধির সঘন বাস্তবতায়। তবু বিষণ্নতা তো বিষণ্নতাই। যাঁকে নিয়ে বলতে চাই, রক্ত-মাংসের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা নিয়ে যিনি এই আলো হাওয়া জল মাটিতে একদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন, আজ এক আলোকিত মুখচ্ছবি! তাঁকে নিয়ে বলার কীইবা সুযোগ ও সংগতি রয়েছে আমার? খ্যাতিমান ব্যক্তিকে সবাই চেনেন, কাছে বা দূরে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কিন্তু আমার চেনাটা কি আদৌ চেনা? গ্রহ বা নক্ষত্রকে জয় করেন যিনি, তিনি জানেন এর নাড়ির খবর। ছোঁয়ার দূরত্ব পেরোনো হয় না যার, তার তো শুধুই চলার ইতিহাস। আমাকেও বলতে হলে সেই চলার ইতিহাসই তো বলতে হবে।
একদিন কবিতাকে প্রাণের বান্ধব করে নিয়েছি বলেই জীবনের নানান ছত্রে ছত্রে পঙক্তিতে পঙক্তিতে কতো কবিতার মুখ নাড়া দিয়ে গেছে চেতনে অবচেতনে নির্জনে কোলাহলে; ভাবতে বসলেই বুকের ভেতরে আজ নড়ে ওঠে সেই সে আদিম পাথর। তাই, তাঁর কথা মনে এলে এসে যায় কবিতার কথা। স্মৃতিময় কবোষ্ণ পালকে মোড়ানো এইসব ভাবনার ফাঁকে উঁকি দেয়া এতো কবিতার মুখ; আমি কার কথা বলবো? এমনভাবে জড়িয়ে আছে সব যে, আমি কাউকেই আলাদা করতে পারি না আজ। তাঁদের প্রতি এক বিরাট কৃতজ্ঞতায় আবিষ্ট আমি আলোকিত মুখচ্ছবি আঁকতে বসে অসম্ভব আড়ষ্টতায় থেমে যাই। ওঠে আসে আরো সেইসব অসমাপ্ত মুখ। কবিতার নীল বৃষ্টি বুকে বয়ে আকস্মিক অভিমানে একদিন জীবনকে টা টা জানিয়ে চলে যাওয়া নোয়াগাঁও নিবাসী কবি বসির আহমেদ, গল্পে গল্পে খুঁজে ফেরা জীবনের গলি ঘুচির অন্ধকারে অকস্মাৎ নিজেই হারিয়ে যাওয়া তুখোড় গল্পকার মো: সিরাজ অথবা তারুণ্যকে ডিঙাতে না দেয়া এক চিরকেলে বিষণ্ন লাশের তরুণ হয়ে রয়ে যাওয়া কালিকচ্ছের ভাস্কর প্রসাদ চৌধুরী। মহাকালের বহমান স্রোতে এ মুখগুলো কি আর বুক ভরে শ্বাস নেবে কখনো! ‘অর্ধেক ঘুমের পর’ চলে গেছে এঁরা চিরায়ত ঘুমকে সাথে নিয়ে।
স্মৃতির বিষণ্ন দরজায় কড়া নাড়ে আরো কতো মুখ, কোন্ সে চলিষ্ণুতায় আবারও দেখা হবে তাদের সাথে? আতস কাচের বিম্বে মোড়ানো প্রবীণ চোখের বিবর্ধক দৃষ্টি দিয়ে উদার আকাশকে দেখে আর দৈনন্দিকতার অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ঘুমের বড়ির বদলে একটা কবিতা লিখে এখনো কি মধ্যরাতে ঘুমোতে যান কালিকচ্ছের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি সুধীর দাস? জীবনের দূর্বার গতিময়তাকে বুকে ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুপ্রায় যুবক সাংবাদিক সরাইলের তরিকুল ইসলাম দুলাল এখনো কি ফের উদ্দাম হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে? বুনো মোষের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ফেরার নিশানা হারিয়ে কখন যে সবার হয়েও ভীষণ একাকী অস্তিত্ব নিয়ে কবি ও কবিতার ছন্নছাড়া পুরুষ হয়ে গেলেন কবি জয়দুল হোসেন; একাকী নিরালায় কোনো অচেনা ব্যথায় এখনো কি খুব বিষণ্ন কাতর হয়ে ওঠেন না তিনি? মনে পড়ে সেই মৃধা কামাল, বেলাল শামস নামের তরুণ মুখগুলোকে। স্বপ্নের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত চোখের সতেজ আকাশটাতে কতো শতো চিত্রকল্পের ডানা ঝাপটানোর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠতো! মফস্বলের অধ্যাপকীয় চোখে সেই কবিতার পাখিরা এখনো কি খেলা করে? অসম্ভব শিল্পী-সরল মনের সেই ওঠতি যুবক খোকন সেন কি আজো তবলা বায়া দু’হাতে ঝুলিয়ে ‘ধা-কেটে ধা-কেটে’ বোলে স্মিতপ্রায় হেঁটে যায়?
আরো অনেকের কথাই মনে পড়ে। জানতে ইচ্ছে করে খুব, ‘সাহিত্য ভুবন’ নামের আত্মস্পন্দন বুকে নিয়ে সুধীর দা’র দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসী, কালিকচ্ছের তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাবসমৃদ্ধ সর্বধর্মসমন্বয়বাদী মহাব্যক্তিত্ব শ্রী মনমোহন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত ‘আনন্দ আশ্রম’ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘সাহিত্য একাডেমী’ সেই যৌবন উচ্ছ্বাসী কলমুখরতায় এখনো কি সরগরম হয়ে ওঠে? যে অদৃশ্য নাড়ির টানে বারবার আমি ছুটে গেছি তাঁদের কাছে, সেখান থেকে ছিটকে আজ তাঁদের কথাই মনে পড়ছে খুব। নাড়ির সে টান বুঝি তীব্র থেকে তীব্রই হয়েছে আরো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তটাতে এরা কৃতজ্ঞতার যে গ্রন্থিবন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন আমাকে, সেই স্মৃতিতর্পণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে গিয়ে আজ সেই সেতারের নাড়িতে বুঝি মধুটংকারে উথলে ওঠছে কাতর উষ্ণতায় গলানো পুরনো বেহাগ। তবে কি আজকের আনন্দই আগামী দিনের কষ্ট? কালের স্পন্দন কষ্ট আর আনন্দকে কতো সহজেই আপেক্ষিক করে দেয়!

পাণ্ডুলিপির উজ্জ্বল অক্ষরগুলো

চাকুরেদের বুঝি স্থায়ী বসত হতে নেই। জীবনের বিচ্ছিন্ন টুকরোর মতোই খণ্ডকালীন অবস্থানের তৃপ্তিকেই বসতের উপলব্ধি দিয়ে রাঙিয়ে নিতে হয়। সময়টা সম্ভবত আগষ্ট ১৯৯৩ সাল। আগন্তুক চোখে ছোট্ট বেডিং আর একটা ব্যাগ ভর্তি বইসহ কাপড় চোপড় সম্বল নিয়ে যেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কালিকচ্ছ বাজারে পা দিলাম তখনো কি জানতাম সেখানকার সঞ্চিত স্মৃতিগুলোই সেতারের আচ্ছন্ন নাড়িতে এমোন হৃদয়-ভেজা মধুটংকারের মতো এক চিরকেলে উৎস হয়ে থাকবে!
চাকুরি সূত্রে নোয়াখালীর সেনবাগের কেশারপাড় থেকে বদলি হয়ে এসেছি। একজন তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে অফিসিয়াল পরিচিতির আড়ালে যে ব্যক্তি মানুষটা বাস করে, তার এলোমেলো কবিমনের খোলা জানালা দিয়ে নিবিড় অধ্যয়ন করছি সবকিছু ; এলাকার মন মানুষ ও প্রকৃতির স্বতস্ফূর্ততাকে। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত অভিরামের স্পর্শধন্য এই মাটি ও এর মানুষগুলোর দিকে প্রতিনিয়ত কৌতূহলী হচ্ছি, রোমাঞ্চিত হচ্ছি এবং আকর্ষিতও হচ্ছি। তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন আর জীবন ধারণের মধ্যিখানে ফল্গুর মতো লোকায়ত যে সুরটি লুক্কায়িত তা খুঁজে ফেরার স্বভাবজাত প্রয়াস থেকেই একদিন আবিষ্কার করলাম, কখন যে এ মাটির স্পর্শে আর্দ্র হয়ে ওঠেছে তৃষ্ণার্ত মনের অবিচ্ছেদ্য শিকড়গুলো! চাকুরির ধরনটাই এমন যে, এলাকার তৃণমূল মানুষদের নিয়ে কাজ করতে করতে নিজের পরিচিতির পাশাপাশি এলাকাটাও চেনা হয়ে গেলো দ্রুত। অফিস শেষের ঢিলেঢালা সময়টাতে আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেলো, তাও বোধকরি এখানকার মানুষগুলোর উদারমনস্কতারই ফসল। মানুষ পর্যবেক্ষনের অবাধ্য স্বভাব দিয়ে মানুষের ভেতরে ডুব দিতে দিতে কতো বিচিত্র অনুভবের সামনে দিয়ে যে হেঁটে গেছি! সে সবই ব্যক্তিজীবনের একান্ত ইতিহাসের মালমশলা হয়ে রইলো।
বহিরাগত চাকুরে হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবসরের সময়টা নিজের সাথেই নিজেকে কাটাতে হয়। সঙ্গী কেবল বই পড়া আর টেপ রেকর্ডারে গান শুনা। তারও পরে একটা টিভি এসে যোগ দিয়েছিলো আমার নি:সঙ্গতার সাথে। তবে অফিস শেষে অবসরের কিছুটা সময় বসতাম গিয়ে চা-পাতা ও কাপড় ব্যবসায়ী মো: মাজহারুল হকের গদীঘরে। কথা দিলে যে সব কিছুর বিনিময়েও কথা রাখতে হয়- এই বোধটা আমাদের সমাজ থেকে ক্রমশ লুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকলেও মাজহারুল ভাইয়ের মতো লোক যতোদিন থাকবে ততোদিন লুপ্ত হবে না নিশ্চিত। এরকম একজন বিবেকবান মানুষের পাশে কিছুটা সময় কাটানো অত্যন্ত আনন্দের ছিলো আমার জন্য। এছাড়া ছন্নছাড়া মানুষ হিসেবে আমার প্রতি তাঁর আন্তরিক সহায়তার ঋণ ভুলি কী করে। এতোগুলো বছর পর শুনে খুব মর্মাহত হয়েছি, ডায়াবেটিস এবং আরো কতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় ফতুরপ্রায় সেই মাজহারুল ভাই আজ রোগে শোকে আর্থিক অনটনে ধুকে ধুকে কাটাচ্ছেন তাঁর দু:সহ সময়গুলো । সৎ মানুষরা কি নিয়তির কাছে এরকম অসহায় হয়ে যায়!
টিন শেডের মলিন চেহারার যে ছোট্ট ঘরটিতে হোমিও ডাক্তার বাবুটি বসেন, সেটার নাম দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসী। চেহারাগত দিক বিবেচনায় নিলে অন্যান্য দোকান পাটের তুলনায় তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। বরং অন্যদের চেয়ে একটু বেশি মলিন। প্রৌঢ় বয়েসী ডাক্তার সুধীর দাস, কালো চেহারার স্থূলাঙ্গী খাটো শরীরে ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। এর বাইরে অন্য কোন পোশাকে কখনোই দেখিনি তাঁকে। চশমা তো নয়, যেনো দুটো গোটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসই বসিয়ে রেখেছেন ফ্রেমে বন্দী চোখের উপর। মুখের দিকে তাকালে শরীর ছাপিয়ে আতস কাচের বিশাল দুটো চোখই ভেসে ওঠে। নিরীহ গরীব রোগীদের আনাগোনা বেশি। ছোট্ট শিশিবোতলে পাশে রাখা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে হ্যনিম্যানের ষষ্ট সংস্করণ চিকিৎসা পদ্ধতির বিশেষ কায়দায় দু’হাতে শিশিবোতল ঝাকানোর চেনা দৃশ্যটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়। অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে যেতে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়ের কায়দাটাই বলে দিতো, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তবু এসব দিয়ে তাঁর সাথে এই আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হবার কোন কারণ ছিলো না। কিন্তু রোগীর অবসরে তাঁর ক্রিয়াকাণ্ডের ভিন্ন এক দৃশ্যই খট্কার কারণ হলো। ছোট্ট টেবিলটাতে একটা ডায়েরী খুলে লেখার ভঙ্গীর সাথে চেহারার বিশেষ ভাব সাদৃশ্যটাতেই সন্দেহ হতে লাগলো। যে গাঙের ভাঙা বৈঠাধারী আমি, তাঁর গায়েও কি সে গাঙেরই আদিম জলের ছোঁয়া? এমনি এক বিশেষ মুহূর্তে একদিন ঠিকই ধাম করে ঢুকে গেলাম। মোহন জলের চিহ্ন আঁকা ডায়েরীর পাতাই বলে দিলো- তিনি আমাদেরই লোক! কিন্তু একজন বাতিকগ্রস্ত লিখিয়ে হিসেবে নিজের পরিচয়টাকে তখনো উন্মোচিত হতে দিইনি। সাহিত্য রসিক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবেই তাঁর দরবারে প্রশ্রয় পেলাম।
আনাগোনা বেড়ে গেলো সুধীর দা’র চেম্বারে। একদিন এক সৌজন্যমূলক আমন্ত্রণ জানালেন কালিকচ্ছের ঐতিহ্যবাহী আনন্দ আশ্রমে অনুষ্ঠিতব্য এক সাহিত্য সন্ধ্যায়। ডাঙার মাছের কাছে পানিতে বেড়ানোর আমন্ত্রণ! আমি যে রক্তের টানেই সেখানে হাজির, এটা বুঝার অবকাশ তাঁরা পাননি। তবে আমার উপস্থিতিকে আন্তরিক স্বাগত জানালেন। আগরতলার বিশিষ্ট কবি দিলীপ দাশকে সাথে নিয়ে এলেন কবি জয়দুল হোসেন। এসেছেন কবি মো: আশরাফ, যিনি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। এসেছেন কবি ও কণ্ঠশিল্পী রত্না দে সহ কাছের ও দূরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আরো অনেক নবীন প্রবীণ কবি ও সাহিত্যকর্মী। আশ্রমের পরিষ্কার তকতকে মেঝেতে গোল হয়ে বসে আলোচনাপর্বের পর একটা চমৎকার আবহের মধ্যে উপভোগ করছিলাম বিভিন্ন কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি। ব্যাংক ম্যানেজার হিসেবে উপস্থিতির সম্মানটুকু পাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু তারা তো তখনো জানতেন না যে আমিও তাঁদেরই লোক। সেটা সুপ্তই ছিলো। আমার সঙ্গী সহকর্মী আশেক কার কানে কানে কী যেনো বললো ফিসফিসিয়ে। একটু পরেই যখন আমার নাম ঘোষণা হলো, বুঝতে বাকী রইলো না ফিসফিসানির শা’নে-নজল কী ছিলো। খানিকটা অপ্রস্তুত এবং অবশেষে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করে ফেললাম বিস্ময়করভাবে মুখস্থ থাকা আরও প্রায় এক যুগ আগের লেখা আমার প্রিয় একটি কবিতা। কী আশ্চর্য! তাৎক্ষণিক অভিনন্দন প্রশংসা কিছুই বুঝি বাদ রইলো না। তবে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টা মনের গভীরে রেখাপাত করলো, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আমিও তাঁদেরই একজন হয়ে গেলাম। বড় বড় নাগরিক কবিদের মনোজগতের গূঢ় অনুষঙ্গের অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে মফস্বলের নিরিবিলিতে পড়ে থাকা আমাদের নিরীহ কবিদের বুকের দিঘিটা যে উদার বিশালতায় সাগরকেও হার মানিয়ে দিতে জানে তা উপলব্ধি করে চমৎকৃত হয়েছি। পাল্টে গেলো গোটা আবহটাই। দূরের গ্রহের মতো পাশে বসা কবি দিলীপ দাশ ঘণ্টা দুয়েকের ঘনিষ্ঠতায় কখন যে গলাগলি করা অগ্রজ বন্ধু হয়ে গেলেন, ভাবতেই অবাক লাগে! ওই বসাতেই আমার পঠিত কবিতাটা টুকে দিতে হলো তাঁকে। পরবর্তীতে আগরতলা থেকে প্রকাশিত নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ‘একুশ শতক’ এর সৌজন্য সংখ্যায় ছাপা হওয়া সেই কবিতাটি দেখে কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে মন। সাথে পাঠানো শুভেচ্ছাপত্র সহ দিলীপ দা’র কাব্যগ্রন্থ ‘মন ছুঁয়ে আছে এপাড় ওপাড়’ এখনো মহার্ঘ স্মৃতিচিহ্ন আমার।
এরপর থেকেই নিত্যদিনের কিছু কিছু সান্ধ্যকালীন মননশীল সময় ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতো সুধীর দা’র সেই ছোট্ট চেম্বারটিতে। যাঁরা আসতেন ওখানে, সবাই কালিকচ্ছ সরাইল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজন। ঢাকা আগরতলা থেকেও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আসতেন। এঁদের মধ্যে ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলেই কবি আসাদ চৌধুরী, জন্ম-মাটির টানে বছরান্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলে আগরতলার কবি দিলীপ দাশ, এমন কি পবিত্র সরকারের মতো ব্যক্তিত্বও ওই মলিন ছোট্ট ঘরটিতে অবলীলায় এসে ঢুকে যেতেন। এমন অনেককেই আসতে দেখেছি ওখানে। এই মলিন ছোট্ট ঘরটিই যে মনন আলোয় ওখানকার সবচেয়ে আলোকিত ঘর, নির্বোধ আমিই বুঝতে পেরেছি একটু দেরী করে। অথচ এই ঘরটির সংযোগ সুঁতো দিয়েই পরিচিতের ঘনিষ্ঠতায় এসেছি অনেক অনেক স্মৃতিময় মুখের সাথে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীর সংগঠক সম্পাদক কবি ও ছড়াকার জয়দুল হোসেন, তাঁর সাথে পরিচয়টাও অকস্মাৎ একদিন ওখানেই হয়েছে। তাঁরই মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বৃহত্তর সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া। ভার্সিটি বন্ধ হলে বাড়ি ফেরা স্বপ্নালু চোখের তরুণ প্রেমিক কবি ও গদ্যকার মৃধা কামাল বা সরাইলের তরুণ সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী তরিকুল ইসলাম দুলাল সহ স্বপ্নপ্রজন্মের কতো কতো তরতাজা মুখ। প্রগতিশীল তরুণ মেধাবী সমাজকর্মী ভাস্কর প্রসাদ চৌধুরী, যে নাকি বই বা পত্রিকার খোঁজে যখন তখন ঢুঁ মারতো আমার সোয়া তিনতলার চিলেনিবাসে, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একদিন বীভৎস লাশ হয়ে পড়ে রইলো সবুজ সোঁদা জমিনের ভেজা কাদায়।
নোয়াগাঁও নিবাসী অবয়বে প্রবীণ কিন্তু মননে তরুণ আলাভোলা অত্যন্ত সহজ সরল এক কবিমনের অধিকারী বসির আহমেদ বা প্রিয় বসির ভাইয়ের সাথে অসম্ভব সখ্য তো সুধীর দা’র এই ছোট্ট ঘরটি থেকেই। অনুজ প্রতিম অত্যন্ত কাছের একজন মৃত আত্মীয়ের দাফন শেষ করে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই ঢলে পড়া বসির ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু-মুহূর্তে তাঁর প্রাণপ্রিয় সঙ্গিনী স্ত্রী হিসেবে কাছে থাকতে না পারার পাথর কষ্টটা বসির-ভাবী আজও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বপ্নের সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে। ওই সময়টায় তিনি তখনও মৃত আত্মীয়বাড়ি থেকে এসে পৌঁছাতে পারেন নি বলে প্রিয়তম সঙ্গীর শেষ কথাটা আর শুনা হয়নি তাঁর। সুদূর কর্মস্থল ফেনীতে বসে অকালমৃত্যুর এ দু:সংবাদ পেয়ে অনেকণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কথা ছিলো আমি যেখানেই থাকি না কেন রূপাবলীকে, অর্থাৎ বর্তমানে আমার স্ত্রী এবং তখনকার প্রেয়সী যাকে সবাই অতসি প্রতীকী নামে জানতো, তাকে নিয়ে ওখানকার সব কবি সাহিত্যিক শিল্পী বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতিতে সবাই মিলে কোন এক বর্ষায় অন্তত একবার হলেও একটা নৌ-বিহারে যাবো ধর্মতীর্থ বা ধরন্তী- নাসিরনগরের হাওরে। আমাদের সেই নৌ বিহার কি আর হবে কখনো? নিরন্তর কাব্য-ঘোরে আবর্তিত স্বাপ্নিক মানুষ বসির ভাই আজ নেই। কখনও আসবেনও না। কালিকচ্ছের অন্তর্বাহী সাহিত্য সংস্কৃতির স্রোতটাকে দৃশ্যমান আর স্বচ্ছন্দে বইয়ে দিয়ে নতুন নতুন প্রতিভা খোঁজার প্রয়াস হিসেবে ‘সাহিত্য ভুবন’ নামে যে স্বপ্নশিশুটির জন্ম হয়েছিলো, এর আঁতুড় ঘর দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসীকে সাহিত্য ভুবন নামে ডেকে ওঠার অন্যতম কারিগর বসির ভাই আর কখনো হৈ চৈ বাঁধাতে আসবেন না ওখানে। শ্মশ্রু-গুম্ফমণ্ডিত সেই মায়াবী মুখটি মনে এলেই এক পশলা নীল বৃষ্টি নামে বুকের ভেতরে।

বৃষ্টিতে ভিজে যায় চাঁদ

কালিকচ্ছ বাজারের উপকণ্ঠেই অপোকৃত দুর্বল তেতলা দালান ঘরটার দ্বিতীয় তলায় আমার অফিস। নীচে থেকে একটা সরু সিঁড়ি মারিয়ে উপরে ওঠতে হয়। কোন পাকা বাড়িতে এতো সংকীর্ণ ও নীচু সিঁড়ি থাকতে পারে, এটা না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। পাশাপাশি দু’জন হেঁটে দোতলায় ওঠা তো দূরের কথা, বুক টানটান মাথা উঁচু স্বভার যাঁদের তাঁদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে নতজানু হবার শিক্ষা দিতে হলে এই সিঁড়িটা নিশ্চয়ই উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। দু’একবার দ্রুত ওঠানামা করালেই যথেষ্ট। মাথায় ফোলে ওঠা গোটাকয়েক তরতাজা টিউমারের সরব উপস্থিতি প্রশিক্ষণের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহমুক্তি ঘটাবে। তেতলার ছাদে একটা চিলেকোঠা, ঠাট্টা করে অনেকেই একে সোয়া তিনতলা বলতেন। ওখানেই একাকী আমার একান্ত নিবাস। ছাদের খোলা অংশটুকু আমার উঠোন। এ উঠোন থেকে প্রায় গোটা বাজারটাই দেখা যেতো এক পলকে। বাজার নিভে গেলে রাতটা যতোই গর্ভিণী হতো, ততোই হয়ে যেতো একান্ত আমার; শান্ত নীরব, একাকী। রাত-জ্যোৎস্নায় যেদিন বান ডাকতো আকাশের তারাগুলোর মতো উদ্দাম চন্দ্রঘোরে প্রথমেই ভেসে যেতাম আমি। আর প্রতিটা ঝড়ো রাতে বাতাসের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে মনে হতো এটাই বুঝি এ পৃথিবীর শেষ রাত। তবু এই ছাদটাই কীভাবে কখন যেন আমার মনের রঙটাই পেয়ে গেলো, বুঝতে পারিনি। খোলা ছাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে দৃষ্টিটা ডানে ঘুরালেই দেখা যেতো বাংলাদেশ রাইফেল্স-এর সাজানো গোছানো বিরাট ব্যাটেলিয়ান ক্যাম্পটাকে। এপাশ ওপাশ সবুজে মোড়ানো গ্রাম আর মাঝখান দিয়ে ধুসর ফিতার মতো পাকারাস্তাটা চলে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের দিকে। বাঁয়ে ঘুরলে বাজারের ওপাশ থেকে সবুজ জমিন গাছপালা গ্রাম পেরিয়ে ধর্মতীর্থ বা স্থানীয় ভাষায় ধরন্তী ঘাট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া টু নাসিরনগরের রাস্তাটা ওখানে গিয়ে হাওরটাকে স্পর্শ করেছে। ছাদ থেকে হাওরের দূরবর্তী অংশের ধবধবে উপরতল দৃশ্যমান হতো। পানিকে পানি মনে হতো না, চকচকে প্রলেপের মতো লাগতো। পরিচিতির সূত্র ধরে এই উঠোনটার ভালোলাগা উপভোগ করতে অনেকেই চলে আসতেন এখানে, বিভিন্ন সময়ে। উপলক্ষটাই শুধু আমি। কালিকচ্ছের কথা মনে এলে অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি হিসেবে এ উঠোনের অনুভবটাকেও যেন ভেতরে ভেতরে টের পেয়ে যাই খুব গভীরে, নাড়ির ভেতর। কিন্তু এই অনুভবটুকু কি আসলে বস্তুগত উপলক্ষগুলোর জন্যে? মনে হয় না। প্রকৃতি ও প্রস্থাপনার মধ্য দিয়ে আসলে এখানকার কোমলে মধুরে মেশানো ব্যক্তিমানুষগুলোই প্রতিনিয়ত দাগ কেটে গেছে মনে। প্রিজমের মতো বিশ্লিষ্ট আলোর রঙে মূলত এই মানুষগুলোর মুখচ্ছবিই ভেতরে দানা বেঁধে আছে।
পরিচিতির পরিসর বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ছুটির দিনগুলোতে যাতায়াত বেড়ে গেলো জয়দুল ভাই ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীতে। সাহিত্য একাডেমী ও জয়দুল হোসেন এ দুটো নামকে আলাদাভাবে দেখার অবকাশ কখনোই আমার হয়নি; আর কারো হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে দেশের প্রতিটা অঞ্চলে যদি নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো এরকম একজন করে জয়দুল হোসেন থাকতেন, তবে এদেশের সাহিত্য আন্দোলনের চেহারাটাই হয়তো অন্য রকম হয়ে যেতে পারতো; স্বপ্নের খুব কাছাকাছি। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল স্কুলের নিরিবিলি প্রাঙ্গণে সাহিত্য একাডেমীর অবস্থানটা অত্যন্ত শোভন ও যথাযোগ্য মনে হয়েছে সবসময়ই। এমন চমৎকার পরিবেশে গেলে মনটা অজান্তেই ভালো হয়ে যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের সব অঙ্গনের তুখোড় তারুণ্যের এমন চমৎকার সমাহারে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়েছি বরাবর। একাডেমীর নিয়মিত অনিয়মিত আকর্ষণীয় বিচিত্র সব ছোট বড় অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শওকত ওসমান, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, শান্তনু কায়সার, নাসির আহমেদ প্রমুখের মতো দেশের প্রতিষ্ঠিত ও নেতৃস্থানীয় বহু কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আন্তরিক উপস্থিতিতে বরাবরই নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছি। তখনো সংসারী হইনি, এবং পিছুটান বিহীন একাকী মানুষ বলেই কতো বিকেল, কতো সন্ধ্যা বা কতো রাত যে জয়দুল ভাই সহ হেঁটে বসে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়েছি! উটকো যন্ত্রণা হিসেবে ভাবীকেও জ্বালাতন করেছি কতো; এখন ভাবলে কষ্টও হয়, আনন্দও পাই।
এই সাহিত্য একাডেমীর কোন এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেই একদিন পরিচিত হলাম ডা:ফরিদুল হুদার সাথে। সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও কর্মকাণ্ড আমার আকর্ষণের বিষয় ছিলো না। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতির গভীরতা উপলব্ধি করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে তাঁর ব্যগ্রতা দেখে কৃতজ্ঞ না হয়ে কি পারা যায়? ঐ যুদ্ধকালীন সময়ে অনেকের মতো আমিও তো মা ভাই বোনসহ একই পরিবারের পাঁচ-পাঁচজন সদস্য হারানোর ক্ষত বুকে নিয়ে জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় নতজানু হই আজো, দূরবর্তী কোন স্বপ্নের দিকে তাকাই এক অমর্ত্য আকাঙ্ক্ষায়! ডা:ফরিদুল হুদার আগ্রহে ও তত্ত্বাবধানেই কুল্লাপাথার গণকবরে শুয়ে থাকা শহীদদের স্মৃতিভূমিতে সাহিত্য একাডেমীর সকল সদস্যকে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে মা মাটি মানুষের প্রতি রক্তের ঋণ স্মরণ করিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় দেখেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ধারণা করি কোনো অচেনা গভীরে লুকিয়ে থাকা তাঁরও কিছু কষ্টের অস্থিত্ব। ছোট্ট সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে দূর থেকে দেখা এতো বড়ো একজন ব্যক্তির কোন গোপন কষ্টের কথা কী করে জানবো আমি? সে সুযোগ কোথায়? তবে অজান্তেই কি তাঁর স্নেহধন্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি? তাঁর ব্যাপক কর্মকাণ্ড নিয়ে যাঁরা জানেন তাঁরাই বলতে পারেন সেসব কথা। আমি পারি কেবল আমার কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে ব্যক্তিগত ঋণস্বীকারের উপলব্ধিটুকু প্রকাশ করতে।

আয় বৃষ্টি ঝেপে

আমরা অধিকাংশই পেটের দায়ে চাকুরি করি, আর মনের টানে ঘর বাঁধি কবিতার সাথে। চাকুরিতে প্রেম না থাকলেও দায়টা থেকেই যায়। কিন্তু কবিতার বন্ধনে প্রেমটাই আসল। ওটা না থাকলে যে কবিতাই থাকে না। তাই কবিতার মুখ যখন দূরে সরে যায় সেই অব্যক্ত কষ্টগুলো গোমড়াতেই পারে শুধু, সারাতে পারে না কিছুই।
১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়টাতে ভিন্ন কর্মস্থলের ডাক এলো একদিন। চাকুরিবিধি অনুযায়ী যদিও তা পদোন্নতি জনিত বদলি, মনটা হাহাকার করে ওঠলো। যেনবা শেকড়ে টান পড়েছে। বসির ভাই কী যেন বলতে এসেছিলেন, খবর শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন এক অনিশ্চিৎ আমার দিকে। আসল কথা আর বলা হয়নি তাঁর, ভুলে গেছেন। কী আশ্চর্য! কালিকচ্ছ বাজার, সরাইল বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যেখানেই যাই পরিচিত মুখগুলোতে একই অভিব্যক্তি। আমার সোয়া তিন তলার উঠোনেও চলে আসছে অনেকে। এই ছাদের উঠোনে কতোজন কতো আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়ে গেছে! সবার মুখেই ছিলো হাসির উচ্ছ্বাস। কিন্তু এখোন যেন উঠোন ভর্তি শুধু কষ্ট আর কষ্ট। আবেগের আতিশয্যে চাকুরেদের জন্য খুবই সাধারণ একটা বিষয়ও বুঝি এভাবে অসাধারণ আর অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে গেলো! যাক্, ধীরে ধীরে মনকে মানানো হলো, এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের আশ্বাস দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা গেলো। রিলিজের তারিখ দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে। তখনো অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাটা বুঝি বাকিই ছিলো।
হঠাৎ করেই যেন দিনটি এসে গেলো। দূর থেকে মাইকিং-এর আওয়াজ পাচ্ছি- ‘...ব্যাংকের ম্যানেজার ..........কবি .........এর ... উপলক্ষে স্থানীয় কালিকচ্ছ প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে এক বিদায়ী সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। ....... প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী .... ডা: মো: ফরিদুল হুদা এবং ......’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে, করছে কী এরা! অচেনা এক উত্তেজনায় কাজে মন দিতে পারছি না আর। দুপুরের পর থেকেই দলে দলে আসতে শুরু করলেন পরিচিত অপরিচিত কতো মুখ। শুভেচ্ছা উপহারে খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা! এতো শুভাশীষ আমি ধারণ করবো কী করে, বুকের উঠোন যে খুব ছোট!
বিকেলে যথারীতি অনুষ্ঠানস্থলে। বিস্ময়ে হতবাক আমি; আমার জন্যেই এতো জমকপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান করে ফেললো এরা! আগত ব্যক্তিবর্গের কাছে নিজকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হলো। কচি কচি কতো শিশু কিশোরও সেজে গুজে এসেছে। হাতে হাতে সবার মালা আর ফুলের সমারোহ দেখে আশঙ্কা হলো, শেষ পর্যন্ত আমাকে এরা ফুল দিয়ে চাপা দেবে না তো! আলোচনা, স্তুতি, আবৃত্তি এবং সঙ্গীতানুষ্ঠানের দীর্ঘ সূচিবদ্ধতার মধ্যে প্রধান অতিথি এলেন। ডা: ফরিদুল হুদা। বিনম্র চেহারায় তাঁকে অতিসাধারণ আমার কাছে এক অগম্য পুরুষ বলে মনে হলো। দেখলেন, এবং আশির্বাণী দিয়ে যখন তাঁর বিশাল বুকে আমাকে টেনে নিলেন, অনন্ত কৃতজ্ঞতায় মনে হচ্ছিল- আমি ভাসছি কতো লক্ষ টন মোহন শুভেচ্ছার জলে ....।

বুক তো নয়, যেন এক মায়াবী উঠোন !!
............

No comments: