Wednesday, November 5, 2008

@ 'ভেজালমুক্ত আত্মহত্যার অধিকার চাই'... (রম্য-রচনা)










'ভেজালমুক্ত আত্মহত্যার অধিকার চাই'... (রম্য-রচনা)
রণদীপম বসু

(০১)
বৈকালে টাঙ্কি মারিবার নিয়মিত কর্মে বাহির হইবার পূর্বে লটকনতলায় সাঙ্গপাঙ্গ সবাই আসিয়া জমায়েত হইলেও নন্দু তখনো আসিয়া পৌঁছিল না। এই আকস্মিক বিলম্বের হেতু কী হইতে পারে তাহাও কেহ বুঝিতে পারিল না। পূর্ব ইতিহাস ঘাটিয়া দেখা হইলো, এইরূপ মহৎ কর্মে নন্দু কখনোই বিলম্ব করে নাই। তথাপি তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে অদ্যকার টাঙ্কি মারা কর্ম-পরিকল্পনায় ব্যবহাযোগ্য কলাকৌশলে আহামরি কোন অভিনবত্ব আনা যায় কিনা এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হইয়া নন্দুর ইয়ার-দোস্তগণ এই ফাঁকে নতুন নতুন প্রকৌশলের সন্ধানে তাহাদের অস্বাভাবিক সৃজন-মেধা ব্যয় করিতে থাকিল। কখন যে সূর্য পাটে বসিতে উদ্যত হইয়াছে তাহা তাহারা টের পাইলো কি পাইলো না, কিন্তু তখনো নন্দু আসিয়া পৌঁছিলো না। নানাজনের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হইতে লাগিল। পালে থাকিলে পালের রীতিনীতি মানিতে হইবে, ইহাই মান্যবিধান। অতএব নন্দু কেন আসিল না তাহা হইতেও বড় কথা হইলো নন্দু আসিল না। দৈনন্দিন কর্ম বকেয়া রাখিবার সরকারি রীতি তখনো তাহাদিগকে প্রভাবিত করে নাই বলিয়াই হয়তো এতৎবিষয়ের একটা হেস্তনেস্ত করিতেই হয়, এই অভিপ্রায়ে ইয়ারদোস্ত সকলে মিলিয়া নন্দুর ডেরায় গিয়া উপস্থিত হইল।

পরিবারের নাখান্দা অপদার্থ সদস্য হিসাবে নন্দুর অবস্থান কী, তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না। বাড়ির বাহিরের দিকের লাগোয়া পরিত্যক্ত ঘরখানা যাহা কিনা যে কোনো শুভলগ্নে ভাঙিয়া পড়িবার অপেক্ষায় প্রহর গুনিতেছে, উহাতেই পরম সন্তোষে নন্দুর নিরাপদ অবস্থান কায়েম রহিয়াছে। নিরাপদ বলিতেছি এইজন্যই যে, পরিবারের অন্য সকল কিছুতেই উপভোগ ও ব্যবহার প্রত্যাশিদের মধ্যে যেরকম তীব্র প্রতিযোগিতা বর্তমান, এই ঘরখানার প্রতি উল্টো তাহাদের বৈরাগ্যের তীব্রতা প্রকাশ পাওয়ায় ঘরখানা ভাঙিয়া না পড়া পর্যন্ত নন্দুর দখলিস্বত্ব ক্ষুণ্ন হইবার কোন আশঙ্কা অদূর ভবিষ্যতেও নাই বলিলেই চলে। ওই ঘরখানার আরেকটা বিশেষত্ব রহিয়াছে। যাতায়াত সকল প্রাণীর জন্য বিনা বাধায় সমানভাবে উন্মুক্ত হইলেও কাউকে ওইখানে আসা-যাওয়া করিতে কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। এবং যাতায়াতকারী প্রাণীরা যে নন্দুর গুটিকয়েক ইয়ারদোস্ত ছাড়া আর কেহ নয়, এইটা বোধকরি খোলাশা করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই।

এই ক্ষণে নন্দু বাড়িতেও নাই। কিন্তু যেই ঘটনার জন্য এই কাহিনীর আবশ্যকীয় অবতারণা তাহা এতদধিক উল্লেখযোগ্য হইয়া উঠিল যে, ঘরখানার অভ্যন্তরস্থ বর্ণনা আর নিতান্তই অনাবশ্যক। কেননা ততক্ষণে ভাঙা তক্তপোশের উপর ছোট্ট একখণ্ড ঢেলা-ইটচাপা চিরকুটখানাই নিমেষে সকলের দৃষ্টি ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হইয়া উঠিয়াছে। ইহাতে দুইটি মাত্র বাক্যে দাগানো হস্তাক্ষর যে নন্দুরই, ইহাতে কাহারো সন্দেহ রহিল না। ‘আত্মহত্যা আমার মৌলিক অধিকার। কেবলমাত্র ইহাতেই আমি আমার পূর্ণ অধিকার খাটাইতে পারিব।’ বেশ কিছুদূর ফাঁকা রাখিয়া চিরকূটের নিচে আরেকটি ছোট্ট বাক্য শোভা পাইতেছে- ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ি নয়।’

চিরকুটখানা পড়িয়া সবাই হৈ হৈ করিয়া উঠিল। নন্দুর যে হঠাৎ করিয়া এমন আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছা পুনর্বার জাগিয়া উঠিবে, ঘুণাক্ষরে কেহই তাহা বুঝিতে পারে নাই। অত্যন্ত সহজ সরল স্বভাবের নন্দুর পেটের ভিতর কোনরূপ জটিলতার লেশমাত্র নাই, এতোকাল তাহারা ইহাই জানিয়া আসিয়াছে। আর জানিবেই বা না কেন ! প্রতিবারেই আত্মহত্যা করিতে যাইবার পূর্বে সে হরিহর আত্মা ইয়ার-বন্ধুবর্গের সহিত সর্বাত্মক পরামর্শক্রমে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাইপূর্বক আত্মহত্যা করিবার অধিকতর কার্যকর ও সঠিক পদ্ধতিটাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করিয়া তবেই বাস্তবায়নে উদ্যোগী হইয়াছে। তথাপি উদ্দেশ্য সফল না হইবার পিছনে পরিকল্পনায় ত্রুটি রহিয়াছে ইহা বলা যাইবে না। ঘটনার মুহূর্তে কোথা হইতে আরেকটি অঘটন আসিয়া সবকিছু লেজেগোবরে করিয়া ফেলায় উদ্যোগগুলো বারেবারে সাফল্যের মুখ দেখা হইতে দূরে থাকিয়া গিয়াছে। তাই বলিয়া জানে-ইয়ার-দোস্তদের অবিশ্বাস করিবে !

এইতো আগেরবার নয়নার কাছে ছ্যাঁকা খাইয়া নন্দুর আত্মহত্যা করিবার অদম্য ইচ্ছাটা যখন সত্যি সত্যি চেগাইয়া উঠিল, কোথা হইতে যেনো গরু-মহিষ বাঁধিবার একখানা শক্তপোক্ত দড়ি আর একখানা মাটির কলসি সে জোগাড় করিয়া আনিল। নয়নার সহিত নন্দুর কোনো সম্পর্ক হইতে পারিত কিনা বা আদৌ কোনো সম্পর্ক হইয়াছিল কিনা কিংবা একটি সংলাপও আদান-প্রদান হইয়াছিল কিনা তাহা বিবেচ্য বিষয় নহে। নন্দুর যখন মনে হইয়াছে যে সে ছ্যাঁকা খাইয়াছে, তখন তাহাই সই। কেননা বীরভোগ্যা পৃথিবীর সমস্ত কিছুতে অধিকারযোগ্যতা থাকিবার পরেও নিজের ঘরেই যখন অধিকার খাটাইবার এতটুকু সুযোগও পাইলো না, কৈশোরোত্তীর্ণ সম্মানবোধ হয়তো তাহা মানিয়া লইতে পারে নাই। অতএব অধিকার প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাহাকে যদি অধিকার খাটাইবার একমাত্র জায়গা হিসাবে নিজের শরীর বা প্রাণটাকেই চিহ্ণিত করিয়া দেয় তাহাতে কাহার কী বলিবার আছে ! ইতিমধ্যেই সাঁতার শিখিয়া ফেলায় কীভাবে ডুবিয়া মরিতে হয় এই প্রক্রিয়া জানা না থাকায় ইয়ার-বন্ধুদের কাছে আসিয়া পরামর্শ চাহিল। শহরে একে তো জলাধারের সমস্যা, অন্যদিকে পদ্ধতিটা অনেক আদিম এবং নির্ভরযোগ্য মনে না হওয়ায় বাতিল হইয়া গেল। বিকল্প হিসাবে ঝুলিয়া মরাটাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে হইলেও আগে গাছে চড়া না শিখিলে এই পদ্ধতিও প্রয়োগযোগ্য হইবে না বিধায় দীর্ঘপ্রক্রিয়া হিসাবে ইহাও বাতিল হইয়া গেলো। আরো দুই একটা বিকল্প নাড়াচাড়া করিয়া অবশেষে নিরাপদ প্রক্রিয়া হিসাবে ট্রেইনের তলায় পড়িয়া আত্মাহুতি দিবার পদ্ধতিটাই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হইলো।

মরিবার ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকিবার দরুন কীভাবে কী করিতে হয় তাহা না জানিয়া একদিন সত্যি সত্যি ইস্টিশানের রেললাইনের পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইয়া গেলো। ইয়ার দোস্তরা ভালো করিয়া বুঝাইয়া দিলো, ট্রেইনটা যখন নিকটবর্তী হইবে তখনি ঝাঁপাইয়া লাইনের উপর পড়িয়া যাইতে হইবে। কিন্তু কোথা হইতে কীভাবে যেন খাকিপোশাকধারী বেরসিক পুলিশ আসিয়া কলার চাপিয়া ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। ইয়ার-দোস্তরাও রেহাই পাইলো না। ইয়া বড় লোহার গরাদের ভিতরে একরাত্রি হাতিমার্কা মশার কামড় আর পুলিশি ভেটকি খাইয়া মরিবার ইচ্ছাটা সেই যে মরিয়া গেলো, পরদিন গার্জিয়ানদের বন্ড-সহির বিনিময়ে ছাড়া পাইয়া একে অন্যকে দোষারোপ করিতে করিতে বাড়ি ফিরিয়া গেল বটে। কিন্তু ইতিমধ্যে তাহারা আরো বড় হইয়া গেলো। ইহার পর বেশ কিছুদিন কাটিয়া গেল এবং ক্রমে ক্রমে মরিবার কথা ভুলিয়াও গেলো। আর এখন মন-প্রাণ ভরিয়া টাঙ্কি মারিতে হইলে যে অনিবার্যভাবেই বাঁচিয়া থাকিতে হইবে এই বোধোদয়ও তাহারা ইতিমধ্যে অর্জন করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু নন্দুর এই আকস্মিক ঘটনায় তাহারা অতিশয় হকচকিত হইয়া এ ওর দিকে তাকাইতে লাগিল। হায় হায়, এখন কী হইবে ! নন্দু কোথায় যাইতে পারে ? নিশ্চয়ই সেই মাঠের দিকে গিয়াছে। অহেতুক আর বিলম্ব না করিয়া পড়িমরি সবাই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিল সেইদিকে।

ততক্ষণে বিকাল মজিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে। প্রয়োজনীয় আলোর স্বল্পতায় দূর হইতে মাঠের মধ্যিখানে ছায়ার মতো কাউকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া ইয়ার-দোস্তদের বুকে পানি আসিল। তথাপি দ্রুত নিশ্চিন্ত হইবার প্রত্যাশায় হাঁফাইতে হাঁফাইতে একযোগে সকলেই হাঁক ছাড়িল, ন...ন্দু... ! ছায়াটা নড়িয়া উঠিল, কিন্তু কোন প্রত্ত্যোত্তর আসিল না। দ্রুতবেগে কাছে আসিয়া সবাই দেখিল, নন্দু বিষণ্ন মনে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসিয়া বসিয়া কোঁকাইতেছে। তথাপি তাহাকে জীবিত আবিষ্কার করিয়া ইয়ার-দোস্তরা যাহার পর নাই উল্লসিত হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল- হুড়ড়েএএএএএ...। কিন্তু নন্দুর মুখ হইতে তখন কোঁকানির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ ঝরিয়া পড়িতেছে, ভেজাল বিষ বিক্রেতা মুদি দোকানি ময়নাকে এইবার সে দেখিয়াই ছাড়িবে। কিন্তু তাহার কথার মধ্যিখানেই একজন নন্দুর গলায় আঙ্গুল ঢুকাইয়া দিলো এবং হক হক করিয়া তীব্র উদ্গারে নন্দু এক কলস পরিমাণ বমি করিয়া দিলেও বমির চেহারা দেখিবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ দিবালোক হয়তো অবশিষ্ট ছিলো না। তথাপি শেষ পর্যন্ত নন্দু বুঝি বাঁচিয়া গিয়া তাহার আরেকটি উদ্যোগও ব্যর্থ হইয়া গেলো ! চারিদিকে ভেজালের ভীড়ে অতিষ্ঠ হইতে হইতে সবাই যখন বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে, সেই মুহূর্তে এইরকম একটি উপকারী ভেজালকে ‘চিয়ার আপ’ না জানাইলে কি হয় ! যেই ভাবা সেই কাজ। দুইজন দৌঁড়াইয়া গিয়া কোথাও হইতে বেশ কতকগুলি রসগোল্লা নিয়া আসিল। সোল্লাসে সবাই মিষ্টিগুলি খাইয়াও ফেলিল। কিন্তু বিষণ্ন অসুস্থ নন্দুর আরেকটি সাফল্য মাঠে মরিয়া যাওয়ায় অত্যন্ত আশাহত হইয়া সে ওই মিষ্টি ছুঁইয়াও দেখিল না। কিন্তু হঠাৎ করিয়া এই কী হইল ! মুহূর্তকালের মধ্যেই ইয়ার-দোস্তগণ তীব্র ভেদবমি করিতে করিতে লুটাইয়া পড়িল। এদিকে কিছু করিবার মতো সক্ষমতা তাহারও কমিয়া আসিতেছে। এবং হঠাৎ করিয়া সে সশব্দে কাঁদিয়া উঠিল।

(০২)
ক্লিনিকের ইমার্জেন্সীতে রীতিমতো ভীড় জমিয়া গেছে এবং মুহূর্তে মুহূর্তে তাহা বাড়িতেছে। এইদিকে সেইদিকে অনবরত ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলিয়া উঠিতেছে । কর্তব্যরত ডাক্তার সাহেব আগত সংবাদকর্মীদের কাছে ব্যাখ্যা করিতে করিতে হাঁফাইয়া উঠিতেছেন। একইসঙ্গে ভর্তি হওয়া পাঁচ-পাঁচটি তরুণ রোগীর দুঃখজনক আপডেট দিতেছেন তিনি । ভেজাল বিষের প্রয়োজনীয় বিষক্রিয়ার অভাবে বাচিঁয়া যাওয়া একমাত্র রোগীটির সঙ্গে বাকি রোগীদিগকে বাঁচানো যায় নাই ভেজাল মিষ্টিতে থাকা অনাহুত বিষক্রিয়ার কারণে। যাহার মরিয়া যাওয়ার কথা, সে মরিল না। অথচ যাহারা বাঁচিয়া থাকাকে স্বাগতম জানাইতে চাহিয়াছিল, তাহারাই কিনা মরিয়া গেলো ! জড়াইয়া গেলো ভেজাল মিষ্টির জালে !

(০৩)
সেই হইতেই আমাদের নন্দুর যখনি কোনরূপ আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠে, সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে ভীষণ কাহিলও হইয়া পড়ে। যখনি ভাবিতে বসে, জীবনটা ভেজাল হইয়া যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর মধ্যেও ভেজাল ঢুকিয়া গেছে, সে আর ঠিক থাকিতে পারে না ! তথাপি নন্দু এখন আরো অনেক বড় হইয়া গেছে। এতো বড়ো সে কখনোই হইতে চাহে নাই। কিন্তু ইহা রোধ করিবার কোন উপায়ও তাহার জানা নাই। কেননা প্রয়াত বন্ধুদের প্রতি দুর্বহ কৃতজ্ঞতার অসহ্য বোঝা মাথায় নিয়া এখনো সে তাহার সেই অপূর্ণ একটি দাবিকেই ঝাণ্ডা বানাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ‘ভেজালমুক্ত আত্মহত্যার অধিকার চাই। আত্মহত্যা আমার মৌলিক অধিকার।’

[sachalayatan]

No comments: