Saturday, October 10, 2009

@ টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০৪ (কবিতাগুচ্ছ)


| স্রোত-স্বর |
রণদীপম বসু
...
ডিঙাটা বাইছিলো যে দুর্বিনীত হাত
উন্মত্ত বৈঠায় শ্লোকে
প্রতিকূল স্রোত ভেঙে ধাবমান সে তো
লুঠতে নয়, তোমাকে সাজাতেই আসছিলো ;
কী আশ্চর্য প্যারাডক্স- ওটাকে সরাতে গিয়ে
ভয় থির থির তুমি
অদ্ভুত এ দৃশ্য থেকে নদীটাই ফেলে দিলে !

যে-চোখে নদীই নেই, জলের ভ্রুকুটিহীন নিরক্ত গহ্বর
ওখানে কেন সে আসবে আর !
পাড়-হীন তুমি হারিয়েছো স্রোত-স্বর
হারিয়েছো নদীচোখ।
(১৪-১০-২০০৭)

...


  | ছায়াবৃত্ত |
রণদীপম বসু
...
নীলডুবো জলের কাছে বললাম-
আমাকে তোমার আলোটুকু দেবে ?
একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে জল বললো- এই নাও, সাবধানে রেখো।

জলের আলোয় রাঙা হেঁটে হেঁটে আমি
ঠিক পাহাড়টার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশ থেকে
এক প্রাচীন বৃক্ষ ডেকে উঠলো- 'সবুজ পাখি শোনো,
পাহাড়ের কাছে কিছু চাইতে যেয়ো না যেনো !'
আকস্মিক বিস্ময় চাপা থাকে না কারো, উত্তর এলো-
'প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ বুকে বৃষ্টিভেজা পাহাড়টাকে
বুঁদ হয়ে ওভাবেই থাকতে দাও।'

বৃক্ষজ্ঞানহীন আমি বললাম- কিন্তু তুমি আমাকে পাখি বললে কেন ?
‘ডানার সাহস পেলে মানুষ পাখি এবং বৃক্ষ হয়ে যায়’-
মন্ত্রঃপুত বৃক্ষস্বরে চমকে ওঠে দেখি, আমার দুই কাঁধ জুড়ে
বিস্তৃত সবুজ ডানায় আলোকিত চারপাশ !

আমাকে আর পাহাড়ের কাছে চাইতে হবে না কিছু,
চূড়া থেকে ঝাঁপ দেবার মানবিক ইচ্ছেটা ঝলমল করে উঠলো-
সজোর ঝাপটায় ঝাঁপ দিলাম উৎফুল্ল ডানায় ফের,
কী আশ্চর্য ! মরমর করে গোটাকয় শেকড় ছিঁড়লো বটে,
তবু অসংখ্য শেকড়ে বদ্ধ প্রোথিত আমার পা নড়লো না একটুও।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, জানতে চাইলাম-
হে জ্ঞানী বৃক্ষ, আমি কি বৃক্ষই তবে !
মাথাটাকে নাড়ালো দু'চারবার, তারপর বললো- না, শেকড়-বাকড়
শুধু মানুষেরই হয়, বৃক্ষের নয়।
- অসম্ভব ! আমি তো হেঁটে হেঁটেই এসেছিলাম এখানে !
বাতাসে শিষ কেটে আবারো বললো সে, এ-সবই
মানুষের কাল্পনিক ভ্রমণ।

দরদর ঘেমে নেয়ে বৃক্ষল-শরীরে আমার ছটফটে মানবিক ক্রোধ
ঠোকাঠুকি করে, ছেঁড়া-ফাড়া অন্ধকার খুঁড়ে আচ্ছন্ন ঘুমের রেশ কেটেকুটে
প্রবল নিঃশ্বাসে খুঁজি একান্ত বিছানা আমার... নিরিবিলি বালিশের ওম...
নিশ্চিন্ত দেয়ালে ঘেরা ছোট্ট সেই ঘর...
আমি খুঁজতেই থাকি নিশ্চল মাংসপিণ্ড কিংবা
কবন্ধহীন বৃত্তে ঘেরা ছায়ার সংসার... আমি খুঁজতেই থাকি...
খুঁজতেই থাকি-
শেষবার কবে যেনো অভ্যাসবশেই  বিছানায় এলিয়েছিলাম গা।

এইসব ছায়াবৃত্ত ভেঙে
জলরাঙা চোখ ফুঁড়ে এক ঝাঁক প্রজাপতি তখন
ঘরময় ছোটাছুটি করে...
(১২/১১/২০০৯)
 ...


| কবিতা লিখতেই হবে এমন কথা নেই |
রণদীপম বসু
...
কবিতা লিখতেই হবে এমন কথা নেই
কিন্তু অসভ্য বর্বরের মতো বসে থাকবো কবিতাহীন
এটা কী করে হয় !
মানুষ আর প্রাণীর ফারাকটা অস্পষ্ট হলেও
যেটুকু স্পষ্টতা তা কবিতার জন্যেই।
সেই থেকে প্রাণপণে কবিতাকেই খুঁজি।

রমনা পার্কে সেদিন কেউ কবিতা কবিতা বলে ডেকে ওঠতেই
বুকের ভেতরের নদীটা গুমড়ে ওঠলো। পাড় ভাঙার শব্দে
চমকে তাকালাম ! মেয়েটির নাম কবিতা। এখন যার আলিঙ্গনে আবদ্ধ,
একটু পরে অন্য কেউ স্থান নেবে তার। এরপর আরো কেউ।
তারপর আরো... আরো...। এভাবেই কবিতার হাতবদল হতে হতে
কবিতা কারো একার থাকে না। কিন্তু সবারও নয়। বেবুশ্যের বিষে আর্দ্র
নীলাভ্র কবিতা সে নিজেরও নয়। কবিতা আসলে কারোরই নয়। তবু
মানুষ কবিতাকে পেতে চায় তার বর্বরতা ঘোচাতে, এবং কবিতাকে পেতে গিয়ে
কবিতা পড়তে গিয়ে মানুষ শেষপর্যন্ত বর্বর হয়।

কবিতা লিখতেই হবে এমন কথা নেই। কবিতা পড়তে হয়,
পড়তে পড়তেই মানুষ কবিতাকে হারিয়ে ফেলে। তখন আবার
কবিতা লিখতে হয়।
মানুষ অসভ্য প্রাণী; কবিতা ছাড়া মানুষের চলে না।
(০৪-০৩-২০১০)
[sachalayatan]
...


একদিন সেও কিনা...
-রণদীপম বসু

...
কখনোই বলে নি সে- ভালোবাসি,
ডুবু ডুবু চোখে জ্যোৎস্নাকে ঘৃণা করে চাঁদেপাওয়া অক্ষরের শুদ্ধতায়
সে কোন্ ইচ্ছের ক্রন্দন শুনেছে সে বহুকাল? কেউ কি জানতো,
জ্যোৎস্নাকে ঘৃণা করে করে জ্যোৎস্নার নীল জলে একদিন ডুব দেবে সে !

না-পাওয়ার যন্ত্রণা পাথর-বন্দী হলে পাওয়ার কষ্টেই ইচ্ছেরা কাঁদে।
হয়তো সে জেনেছিলো- জলের অক্ষর জলে মুছে না কখনো,
জ্যোৎস্নার কষ্টও জ্যোৎস্নারা পারে না ধুয়ে দিতে।
জ্যোৎস্নার ধবল শয্যায় শুয়ে শেষবার চেয়েছিলো জ্যোৎস্নার দিকেই;
চোখ থেকে ঝরে পড়া জ্যোৎস্নার মতোই কেউ কি জানতো,
রাতের উন্মুক্ত স্থিরতায় বেঁধে কতটুকু অন্ধকার জমেছিলো চোখে !

কখনোই বলে নি সে ভালোবাসি,
শুধু জ্যোৎস্নাকে ঘৃণা করে করে সেও কিনা একদিন জ্যোৎস্না হয়ে গেলো !
 (১৬-০৩-২০১০)
...
(ছবি-কৃতজ্ঞতা: লোটাকম্বল)
...
[sachalayatan]
...


 ঘুম
-রণদীপম বসু
...
একদিন ঘুম ভেঙে দেখি যদি- ভাঙেনি আমার ঘুম
সেদিন তুমি এসেই না হয় ভাঙিয়ে দিয়ো
শুধু তোমাকে দেখবো বলেই অঢেল ঘুমের স্রোত
দেখে নিয়ো স্বপ্নের ডিঙি বেয়ে ঠিক ঠিক পৌঁছে যাবে তোমার ডাঙায়
যেখানে তুমিই হবে আমৃত্যু সওয়ারি আমার...

অথবা না-আসোই যদি
ভুল করে মেলে দিয়ো ভাঁজ-ভাঙা একটুকু স্বপ্ন-চাদর
ঘুম ভাঙা চোখ মেলে হয়তো দেখতেও পারো জেগেই আছি
বুঝে নিয়ো আসলে তা জাগা নয়-
ডুবে আছি অন্তহীন তোমার ঘুমে...
(০৩-০৪-২০১০)
...


| বোকা মেয়ে জানলো না |
 -রণদীপম বসু
...

কথায় কথায় ‘দিব্যি’ টানা ঠিক নয়। তবু
মেয়েটি, ছেলেটির কোন অক্ষমতাকে নয়, বরং
অনির্ণীত সামর্থ্য আর অপরিমেয় সম্ভাবনাকেই জিম্মি করে দিলো
              সমুদ্রের দোহাই টেনে।

মেয়েটি কি জানতো, ছেলেটি সমুদ্র আর সমুদ্রের
              অপার্থিব জগতটাকে অসম্ভব ভালোবাসে ?
সমুদ্রের গভীর নীল জলে সে শুধু মেয়েটির প্রতিচ্ছবি
              দেখতো বলেই কিনা কে জানে,
পড়ন্ত বিকেলের ধুসর আলোয় চুপ করে বসে থাকে
বিষণ্ন সৈকতের প্রান্তসীমায়-

সমুদ্রের এই বিশালতায় সে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলো-
তাই শিখেছিলো হিরন্ময় সাঁতার;
সমুদ্রের অতল-স্পর্শতাকে ছুঁতে চেয়েছিলো-
তাই অনেক প্রতীক্ষার পর তাকে ভুলতে হয়েছে ফের
পুরনো সাঁতার।
ভুলে যাবার মতো ভয়ঙ্কর কঠিন সাধনার কাজ
                     যে সম্ভব করে তুলতে পারে
সেই অপরিমেয় সামর্থ্যবান ছেলেটি
সমুদ্রের নির্জন নিসঙ্গতায় মুখর হতে চেয়েছিলো-
এবং সমুদ্র কখন নিসঙ্গ হবে তারই অধ্যয়নে ব্যস্ত ছিলো সে...

অতঃপর এক নিসঙ্গ বিকেলে সমুদ্রের দূরাগত গর্জন শুনতে শুনতে
একটি ছেলে চুপ করে বসে থাকে সৈকতের নিস্তব্ধ প্রান্তসীমায়।
সাঁতার ভুলে যাওয়া ছেলেটি ততদিনে জেনে গেছে-
সমুদ্রের বিশালতায় ঝাঁপ দেয়া যায় না কখনো,
              হেঁটে হেঁটে নেমে যেতে হয়; কারণ-
সমুদ্রকে ছুঁয়ে দিলে সমুদ্রই টেনে নেয় বুকে !

সে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে...
তার অনির্ণীত সামর্থ্য আর অপরিমেয় সম্ভাবনা
              জিম্মি হয়ে আছে এই সমুদ্রের কাছে !
চাইলেই সে নেমে যেতে পারে একটু একটু করে
সমুদ্রের জরায়ু ফুঁড়ে এক নিঃসীম অন্ধকারের বিবর্ধক জগতে
চাইলেই নেমে যেতে পারে, কিন্তু
সন্ধ্যার গাঢ় নোনা আভায়
সমুদ্রের কালো জল কোন প্রতিচ্ছবিই দেখালো না তাকে;
ফেলফেল অন্ধকারে এক অচেনা সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে রইলো সে...

বোকা মেয়ে জানলো না-
একটি ছেলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে এসে
শেষপর্যন্ত একাই ফিরে গেলো তার সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে।

 ছেলেটির অনির্ণীত সম্ভাবনা
              মেয়েটির কাছে অযথাই জিম্মি হয়ে রইলো।
...
(২৩-০৫-২০১০)
...
[sachalayatan]
...

No comments: