Friday, October 9, 2009

| ষোড়শ সংখ্যা ‘প্রতীকী’, কিছু কথা কিছু আকথা…|



| ষোড়শ সংখ্যা ‘প্রতীকী’, কিছু কথা কিছু আকথা…|
রণদীপম বসু

০১.
কে কেন কিভাবে লিখেন, এ নিয়ে দুনিয়াজোড়া মজার মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। আবার প্রতিটা মানুষই নাকি কোন না কোনভাবে কিছু কিছু মজার স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বিশেষ করে যাঁরা ভাবনার খুব গভীরতলে পৌঁছে যান, তাঁরাই আবার খুব হালকামাত্রায় এসে বেশ হাস্যকর কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বসেন। বিজ্ঞানী নিউটনের এরকম একটা ঘটনার কথা তো বহুল প্রচলিত, যা সেই ছাত্রকালে শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম। কী এক গবেষণা চালাতে গিয়ে নিউটন নাকি একবার দুই কোঠা বিশিষ্ট বড় একটি বাক্সের মধ্যবর্তী পার্টিশনটাতে দুই আকৃতির দুটো ছিদ্র করেছিলেন, কোঠা বদল করতে বড় বিড়ালের জন্য একটি এবং ছোটটির জন্য অন্যটি। শুধুমাত্র একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য দুটো বেড়ালের জন্য যে একটি রাস্তাই যথেষ্ট, এ কথাটা নিউটনকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। অবশেষে তাঁর সহকারী হাতে-কলমে দেখিয়ে দেয়ার পর নিউটনের উক্তি ছিলো- তাই তো ! ঘটনাটি আদৌ সত্য কিনা, না কি বাঙালির রসসৃষ্টির অসাধারণ প্রতিভার আরেকটি নমুনা উদাহরণ কে জানে। তবে মনোবিজ্ঞান বলে যে, ভাবনার উচ্চস্তরে অবস্থান করলে একই সময়ে নিচের স্তরের এরকম ছোটখাটো অসংগতি ঘটানো মানব-মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রবণতার একটা অংশ।

এই স্বাভাবিক প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মিজানুর রহমান শামীম সম্পাদিত ছড়ার কাগজ ‘প্রতীকী’ ১৬ সংখ্যায় মুদ্রিত হিমাদ্রি নির্ঝর-এর ‘ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন-দুঃশাসন’: রচনার ঊনতা-পূর্ণতা’ শিরোনামের সমালোচনামূলক সিরিয়াস গদ্যটিতে। একেতো গদ্যের টোন সিরিয়াস, তার উপরে গদ্যের বিষয়বস্তু হলো প্রতীকী’র ১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত আমারই লেখা গদ্য ‘ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন-দুঃশাসন’-এর ঊনতা-পূর্ণতা খোঁজার প্রয়াস। সংগত কারণে আগ্রহের মাত্রায় আমার ঘাটতি থাকার কথা নয়। গদ্যের পরতে পরতে লেখকের প্রশংসনীয় জ্ঞান ও মেধার বিকিরণ চোখ এড়ায় না। গদ্যটিতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো ‘উৎকর্ষ’, ‘উৎকর্ষতা’, ‘নৈর্ব্যক্তিকতা’ শব্দগুলোর ব্যবহার নিয়ে তাঁর প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে কোনভাবে ছোট না করেও বিশেষ্য ‘উৎকর্ষ’ শব্দকে বিশেষণ হিসেবে ‘উৎকৃষ্টতা’র বদলে প্রতিরূপে ‘উৎকর্ষতা’র ব্যবহার করা এবং ‘নৈর্ব্যক্তিক’ বিশেষণকেও যে ‘নৈর্ব্যক্তিকতা’র বিশেষ্য বানিয়ে নতুন শব্দ হিসেবে প্রথাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিন্ন করা যেতে পারে, তা নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী আলোচনার প্রেক্ষিত তৈরি হতে পারতো। পারেনি যে তার কারণ অন্যত্র। অনেকেই ভুল করে এমন ব্যবহার করেন, না কি জেনেশুনেই করেন আমি জানি না। হয়তো বাংলা ভাষার উপর স্বেচ্ছাচার হচ্ছে কিংবা গেলোরে গেলোরে বলে রব উঠাতে পারেন কেউ কেউ, তবু আপাতত এটুকু বলে রাখি যে, যেহেতু শব্দগুলো অভিধানে নেই অর্থাৎ অন্যকোন শব্দ বা শব্দার্থকে কোনভাবেই আঘাত করে না, তাই আমি অত্যন্ত সচেতনভাবেই এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছি। যেভাবে ব্যবহার করেছি ’বাধকতা’ শব্দটিও।

অত্যন্ত মজার বিষয় হলো, হিমাদ্রি নির্ঝর শব্দের এই প্রথাহীন ব্যবহারে আপত্তি জানালেও অন্য জায়গায় আবার হুমায়ুন আজাদ ও জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ভিন্ন চেতনার কথাই বলছেন- ‘হুমায়ুন আজাদের কিশোর কবিতাগুলো শতাব্দীর পরমায়ু উৎরে যাবে অনায়াসে- এমনটি ভাবতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয় না’। ছন্দমিলহীন ক’টি কিশোর কবিতা এমন অজর প্রাণশক্তির বড়াই করতে পারে ? বস্তুত কবিতায় আধুনিকতা অন্ত্যমিলহীনতায় নয়, অভিনব শব্দসুষমায় নবতর ভাব সঞ্চারণে। জীবনানন্দ দাশ কেন আধুনিক- অন্ত্যমিলহীনতার জন্যে, না-কি অগতানুগতিক বাকভঙ্গিমা আর শব্দে নবতর অর্থব্যক্তি সৃজনের জন্য ?…’ খুবই চমৎকার উদ্ধৃতি বলা যায়। কিন্তু একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। হতে পারে হিমাদ্রি নির্ঝরের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব হলেই কেবল অভিনব শব্দসুষমায় নবতর ভাব সঞ্চারণ এবং অগতানুগতিক বাকভঙ্গিমা আর শব্দে নবতর অর্থব্যক্তি সৃজন করা যাবে, নইলে কিছুতেই তা মানা যাবে না। আমার এই সীমিত জ্ঞান দিয়ে যতটুকু জানি, হুমায়ুন আজাদ কিংবা জীবনানন্দ দাশ প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই এরকম অভিনবত্ব ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। আর এজন্যে প্রথম প্রথম তাঁদেরকে অনেক গঞ্জনাও সইতে হয়েছে। নইলে এমনি এমনি কি আর হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচনগুচ্ছের ১৮২ নম্বর প্রবচনে বলতে যান- ‘মানুষ মরলে লাশ হয়, সংস্কৃতি মরলে প্রথা হয়’ !

এটা কিছুতেই বোধগম্য হয় না যে, বহতা নদীর মতো সংস্কৃতি বা সাহিত্যের ‘উৎকর্ষ’ মাধ্যম কবিতার আধুনিকতা নিয়ে যখন জগৎ জুড়ে নতুন নতুন আন্দোলনের সূচনা হচ্ছে, পুরনো প্রথা ভেঙে নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি এগিয়ে যাচ্ছে, তখন হিমাদ্রি নির্ঝর কী করে এই আধুনিকতাকে বিস্ময়করভাবে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলেন এভাবে- ‘অন্ত্যমিলহীন কিশোর কবিতা রচিত হওয়া মোটেই দোষের নয়; কিন্তু আল-মাহমুদের অন্ত্যমিলযুক্ত কিশোর কবিতাগুলো যদি একালের কিশোর পাঠকদের রসেন্দ্রিয়কে কিছুমাত্র পীড়িত না করে, তবে ‘Quit Rhyme’ আন্দোলনের তেলহীন সলতে পুড়িয়ে গলদঘর্ম হয়ে লাভ কী ?’ সম্ভবত গোটা গদ্যে তিনি প্রথাবদ্ধ এই থিমটাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি অনেকগুলো স্ববিরোধিতায় নিজেই আক্রান্ত হয়ে গেছেন। পরিবর্তন চাইলে পরিবর্তনের নিরবচ্ছিন্ন স্রোতটাকেই ধারণ করতে হয়। গজ-ফিতা মেপে এতোটুকু পরিবর্তন চাই, আর না, এটা আধুনিকতার কোন  লক্ষণ হয় কি ? আমার গদ্যে কি কোথাও তেলহীন সলতে পোড়ানোর কথা বলেছিলাম ? গদ্যের টোনটাই তো ছিলো ওই তেলটুকুর আবশ্যকতা নিয়েই। সলতেও জ্বলবে, আলোও ছড়াবে, প্রয়োজন আমাদের তেল যোগানদারের।

তিরিশের দশকের (দশক নামকরণে তিরিশ হয় কিনা তা নিয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে) আগে আমাদের রসপ্রিয় পাঠকদের ইন্দ্রিয়ও রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতায় পীড়িত ছিলো না বলেই জানি। তবু বাংলা কাব্যসাহিত্যের সেই পঞ্চপাণ্ডবদের পশ্চিমা আধুনিকতার হাতুড়ি কিন্তু আক্রান্ত করেছিলো রবীন্দ্রনাথকেও। রবীন্দ্রবলয় ভেঙে গেলে রবীন্দ্রনাথও প্রথম প্রথম কম মনঃক্ষুণ্ন হন নি। সেই তিনিই আবার শেষ বয়সে এসে গদ্যকবিতায় হাত মকশো করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এবং সফলও হয়েছিলেন বলা যায়। ‘বাঁশি’, ‘রেলগাড়ির কামরায়’ প্রভৃতি কবিতা তাঁর ছন্দমিলযুক্ত গীতিকবিতাগুলোর চাইতে গুণে মানে কোন অংশে কম তো ছিলোই না, বরং আবেদনময়তায় অনেক বেশি এগিয়ে। আধুনিকতা মানে যে এক জায়গায় থেমে যাওয়া নয় কিংবা নির্দিষ্ট কোন বৃত্তের মধ্যে আবর্তনও নয়, এই সহজ কথাটাই অতিরিক্ত ভাবুকজনেরা কি অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যান, না কি উদ্দেশ্যমূলক এড়িয়ে যান, এটা একটা রহস্য বৈ কি !

অথচ আমাদের অভিজ্ঞতার অত্যন্ত নিম্ন লেভেল দিয়ে বুঝি- আধুনিকতা মানে ক্রমাগত বৃত্ত ভেঙে ভেঙে এগিয়ে যাওয়া। মানুষের সংস্কৃতি মানেই তাই। প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আজাদের উদ্ধৃতি টানার লোভ এবারও সংবরণ করতে পারছি না। কেননা তিনি আমার মতো হিমাদ্রি নির্ঝরেরও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হবেন ধারণা করছি। ড. আজাদের প্রবচনগুচ্ছের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০০ সম্বর প্রবচনটি হলো- ‘পৃথিবীতে যতো দিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততো দিন পৃথিবী মানুষের।’ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকলে অবশ্য সমস্ত প্রাক-আলোচনাই অর্থহীন। সে ক্ষেত্রে আর কথা না বাড়ানোই সংগত।

এবার হিমাদ্রি নির্ঝরের লেখা থেকে একটু হৃষ্টপুষ্ট অংশ উদ্ধৃত করি, যা তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন।
‘ লেখক ছড়া-কবিতা-পদ্যের ভেদলক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু বাক্যব্যয় করলেও ‘আমাদের সেই সব অহংকার’ উপশিরোনামে উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে ছড়া-কবিতা-পদ্যের মিশেল দিয়ে সেসবকে আবার ‘আধুনিকতায় ছুঁয়ে যাওয়া কিশোর কবিতার মাস্টারপিস’ বললেন কেনো বোঝা গেলো না। উদ্ধৃত তিরিশটি ছড়া-কবিতা-পদ্যের গুণলক্ষণকে মাস্টারপিসের আদর্শ গুণলক্ষণ ধরলে বাংলা শিশু সাহিত্যে মাস্টারপিসের সংখ্যা কয়েক হাজার তো হবেই। তাহলে মাত্র তিরিশটি উদ্ধৃতি কেন, আর বর্তমানে শিশুসাহিত্যে কিছুই হচ্ছে না, হলোনা- এমন হা-পিত্যেশই বা কেনো ? তিরিশ সংখ্যক উদ্ধৃতির পংক্তি ক’টি নেয়া হয়েছে জুলফিকার শাহাদাৎ-এর ‘ডাক দিয়ে যায় কে’ কবিতা থেকে। কবিতাটি তাঁর ‘আকাশকে খোলা চিঠি’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রতীকী’র উদ্ধৃতির অংশবিশেষ এখানে আবার উদ্ধৃত করছিঃ
‘নিঝুমরাতে চাঁদের পানে দু’চোখ মেলে চাই/ দেখি শুধু হাজার তারার মুগ্ধ পাড়াটাই।/ জোছনামাখা চাঁদের হাসি/ ঝরে পড়ে রাশিরাশি/ তখন আমি যাই ছুটে যাই ঘর থেকে ঠিক দূরে।’
এখন ক’টি প্রশ্ন করি জুলফিকারকে নয়, রণদীপমকে- এক, ‘চাঁদের পাড়াটাই’ কি মুগ্ধ (Charmed; enchanted); না-কি কবি ? বস্তুত চাঁদের পাড়া’ হওয়ার কথা মোহনীয় (Charming; enchanting), আর কবি’র হওয়ার কথা মুগ্ধ। দুই, ‘চাঁদের আলোই জোসনা, যা চাঁদের হাসির রূপকল্প; ‘জোসনা যদি চাঁদের হাসির নামান্তর হয়, তাহলে ‘জোসনামাখাহাসি’ কি যৌক্তিক শব্দবন্ধ ?
তিন. ‘ঠিক’ শব্দটি কি নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক ? ঠিক দুপুর, ঠিক মধ্যরাত, ঠিক দশটা, ঠিক দশ হাত, ঠিক মাঝখান- এ প্রয়োগগুলোর প্রতিটি নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক; কিন্তু ‘দূরে’ শব্দটি নির্দিষ্ট স্থানিক অবস্থান নির্দেশ করে না, তাই ‘ঠিক দূরে’ আরোপিত মনে হয়।
এখানে আমার মন্তব্য : আলোচিত উদ্ধৃতাংশ কিংবা কবিতাটি শিশুকিশোর সাহিত্যের মাস্টারপিস তো নয়ই, জুলফিকার- এরও শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়। এর চেয়ে ভালো কবিতা তাঁর আছে। বলতে দ্বিধা নেই জুলফিকার শাহাদাৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কিশোর কবিতা রচয়িতা। উদ্ধৃতাংশটুকু জুলফিকার তোষণের নমুনা মাত্র, কিংবা বলা যায় ‘ misquoted’।

মারাত্মক ব্যাপার-স্যাপার ! আসলে থলেতে বিড়াল থাকলে তা কোন না কোনভাবে বেরিয়েই যায়। এখানেও থলের বেড়ালটার উঁকিঝুকি প্রত্যক্ষ করতে আর কোন সমস্যা হয় না। সব সমস্যার গোঁড়ায় মনে হচ্ছে তিরিশটি উদ্ধৃত কবিতা-পদ্যাংশের তিরিশ সংখ্যক উদ্ধৃতিটা কেন জুলফিকার শাহাদাৎ-এর লেখা থেকে নেয়া হলো ! হা হা হা ! হিমাদ্রি নির্ঝরের বক্তব্য অনুযায়ী উদ্ধৃতাংশটুকু যদি জুলফিকারের শ্রেষ্ঠ কবিতার না হয়ে তার কোন অপ-কবিতা থেকে নেয়া অপ-উদ্ধৃতি হয়ে থাকে, তাহলে এটা জুলফিকার তোষণ হলো কী করে ! এ তো রীতিমতো জুলফিকারকে অপমানই করলাম আমি ! এক্ষেত্রে আমাকে তিনি জুলফিকার-বিদ্বেষী আখ্যা দিতে পারতেন। ওটা না করে তাঁর স্ববিরোধী হয়ে উঠার কারণ যে ভিন্ন তা অনুমেয়।

হিমাদ্রি নির্ঝরের কথা অনুযায়ী ছড়া-কবিতা-পদ্যের ভেদলক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু বাক্যব্যয় করলেও তা যে কোন কোন ক্ষেত্রে আমার সময় ও বাক্যের ভীষণ অপচয়ই হয়েছে, তার বিবৃতি-ব্যাখ্যা টানতে গেলে মিজানুর রহমান শামীমের ‘প্রতীকী’ আর সীমিত আয়তনের ছড়ার কাগজ থাকবে কিনা, না কি রণদীপম বসু রচিত একক গদ্যকাগজ হয়ে যাবে, এটাও যে ভাবার বিষয় ছিলো, তাকে তিনি গুরুত্ব দেন নি।  যেভাবে মাস্টারপিস উদ্ধৃতি তিরিশটি না হয়ে তিনশ’ বা তার অধিক হলে ‘প্রতীকী’র সেই সংখ্যাটায় কীরকম ঘটনা ঘটতে পারতো, তার হিসাব না করে যখন আমাদের সিরিয়াস ভাবুকরা  অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে বসেন- মাত্র তিরিশটি উদ্ধৃতি কেন ? অবগতির জন্য এটা বলা যায় যে, আমাদের শিশুসাহিত্যে উদ্ধৃত করার মতো হাজারটা নমুনা খুঁজে আনা অসম্ভব কিছু না। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা উত্তর এই বাংলাদেশে বর্তমানে যাঁরা এই অঙ্গনে খুব অযৌক্তিকভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের রচনা ঘেটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে হতাশই হতে হয়। এজন্যেই এতো হা-পিত্যেশ। আর সেই তিরিশটি উদ্ধৃতি টানার আগে যে ছোট্ট একটু প্রাক-মন্তব্য করে রেখেছিলাম, তা বোধ করি ভাবনার আতিশয্যে হিমাদ্রি নির্ঝরের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ওটুকু খেয়াল করলে অনেক প্রশ্নের মীমাংসা সেখানেই হয়ে যেতো না কি ? আবার একটু খেয়াল করে দেখবেন কি, কী লেখা ছিলো ওই প্রাক-মন্তব্যে ?-
ছন্দ মিলের দুঃশাসন যেমন একদিকে অনেক চমৎকার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে, অন্যদিকে ছন্দ বা মিল-এর সফল শাসন ও পরিমিতবোধে  উত্তীর্ণ লেখাগুলোই শিল্প সৌকর্যে পাঠক-নন্দিত সৃষ্টি হয়ে সংরক্ষণযোগ্য হয়ে ওঠে শিল্পের নিকানো উঠোনে। আমাদের অহংকার সেই সব রচনা থেকে এরকম কিছু সফল পংক্তির উদাহরণ চেখে নেয়া যেতে পারে। পাঠকের উন্মুক্ত বিবেচনায় সমর্পণ করে এগুলো থেকেও আধুনিকতায় ছুঁয়ে যাওয়া কিশোর কবিতার অন্যতম কিছু মাস্টারপিস কবিতা বেছে নেয়া যেতে পারে।

আরো আশ্চর্য় হই, যিনি ‘অভিনব শব্দসুষমায় নবতর ভাব সঞ্চারণে’র কথা কিংবা ‘অগতানুগতিক বাকভঙ্গিমা আর শব্দে নবতর অর্থব্যক্তি সৃজনের’ কথা বলেন, তিনিই কিভাবে ব্যাকরণের গজ-ফিতা-পাল্লা-পাথর মেপে মেপে মজার মজার প্রশ্নগুলো করেন ! যে গদ্যটি নিয়ে তাঁর লেখার সূত্রপাত এবং বিস্তার, সেই গদ্যে ধারণ করা কবিতা বিষয়ক নিচের উদ্ধৃত ব্যাখ্যাটি কি তিনি তাহলে অস্বীকার করেন ?
“শেষ পর্যন্ত আমাদের অগতির গতি রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যেতে হয়- ‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’ এটাকেই যথার্থ সংজ্ঞা বলে মনে হয়। প্রয়োজনীয় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে অপরূপ শব্দচিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয় তার মধ্যে অরূপের সন্ধান অর্থাৎ অন্তর্গত অনুভূতির রসে ভিন্ন কোন অর্থের আবহ তৈরি করাকে কবিতা বলা যায়।
কিন্তু আমাদের অর্থময় চেনা জগতের বাস্তব শব্দ দিয়ে তো আসলে  অবাস্তব কিছু নয় বরং আমাদের চেনা দৃশ্য বা বাস্তব আদলই তৈরি করা যায়। তাই এ বাস্তবতাকে তীর্যকভাবে দেখার প্রয়োজনেই চলে এলো প্রতীক উপমা রূপক ইত্যাদির আলংকারিক ব্যবহারের মাধ্যমে চিত্রকল্প সৃষ্টির এক শিল্পীত প্রবণতা। সেজন্যেই জীবনানন্দ দাশের কথায় ‘উপমাই কবিতা’ বলতে মূলত কবিতার চিত্রকল্পতাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এভাবে যথাযোগ্য শ্রেষ্ঠ শব্দগুলোকে শ্রেষ্ঠ বিন্যাসের মাধ্যমে যে অপরূপ শব্দশরীরী চিত্রটা তৈরি হয়ে যায় তাও যখন প্রকাশের বর্ণনাময় আতিশয্যে রহস্যবিহীন, নিরাভরণ ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখন রূপকল্পের দ্যোতনাময় মায়াবী চাদরে জড়িয়ে তাকে করে তোলা হয় চেনা অচেনার মিশেলে গড়া আধা-বাস্তব আধা-কল্পনার এক স্পন্দনশীল মূর্তি। এটাই কবিতা। আক্ষরিক ব্যাখ্যাযোগ্যতার গভীরে ক্রিয়াশীল অন্য এক উপলব্ধির অর্থময় অনুভব। পাঠকমনের সৃজনশীল কল্পনাও এখানে ক্রিয়াশীল হবার বিষয়নিষ্ঠ সুযোগ পেয়ে  যায়। সে রচনা তখন আর স্রষ্টা বা কবির একার থাকে না, পাঠকের স্বতস্ফূর্ত অন্তর্ভূক্তি একে নিয়ে যায় রসঘন এক ব্যাখ্যাহীন পরিতৃপ্তির অন্তর্গত জগতে। এবং তখনই একটি সার্থক কবিতা প্রকৃতই কবিতা হয়ে ওঠে। এখানে আর বুঝানোর কিছু থাকে না, বুঝে নিতে হয়; ম্যাকলিশের সেই বিখ্যাত পংক্তির মতোই- ‘কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে ওঠে।’ কেননা বুঝাতে গেলে সে যে আর কবিতাই থাকে না। এই উপলব্ধিজাত বিস্ময় থেকেই বুঝি রবার্ট ফ্রস্টও উচ্চারণ করেন- ‘সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়’।”

চিন্তা, চেতনা, ভাবনার মৌলিক কাঠামো বা দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা থাকতেই পারে। বস্তুত হিমাদ্রি নির্ঝর কবিতা বিষয়ে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন তা যদি তিনি ব্যাখ্যা না করেন, তাহলে সব আলোচনাই শেষ পর্যন্ত অর্থহীনতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এবং তাতে করে আবারো যে আমার সব কথাই তাঁর ভাষায় অর্থহীন ‘বাক্যব্যয়’ই হবে, তা থেকে সন্দেহমুক্ত হই কী করে ! তবু ‘ছড়া-কবিতায় ছন্দের শাসন-দুঃশাসন’ শিরোনামের গদ্যটাকে তিনি যে তাঁর মহত্ব ও উদারতা দিয়ে আলোচনার যোগ্য মনে করেছেন, সে জন্যে তাঁর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আশা করি আগামীতে তাঁর সাথে এই অসমাপ্ত আলোচনাটা এগিয়ে নেয়ার কিঞ্চিৎ সুযোগ তিনি আবারো সৃষ্টি করে দেবেন।


০২.
এবার সিরিয়াস আলোচনা বাদ দিয়ে আমরা মনে হয় একটু হালকা বিনোদনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি।

প্রাচীন গ্রীসের ডেলফির মন্দিরে যেদিন দৈববাণী হলো- তোমাদের মধ্যে সক্রেটিসই সবচেয়ে জ্ঞানী, এথেন্স নগরীতে নাকি হুলুস্থুল অবস্থা। চালচুলোহীন ওই ভবঘুরে লোকটিই জ্ঞানী ! সেই সময়ের তথাকথিত জ্ঞানী বলে প্রচারিত ব্যক্তিরা অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে সক্রেটিসকে ডেকে পাঠালেন। দৈববাণীর কারণ জানতে সক্রেটিসকে প্রশ্ন করা হলে সক্রেটিসের জবাব নাকি এরকম ছিলো- ‘আমি শুধু এটুকুই জানি, আমি কিছু জানি না। আর আপনারা এটাও জানেন না যে আপনারা কিছুই জানেন না।’
অর্বাচীন’ শব্দটির অর্থ বুঝতে কারো বাংলা অভিধান খোঁজার দরকার পড়ে না। তবে ন্যুনতম সহবৎ জ্ঞান অর্জনের জন্য এটুকু জানা মনে হয় জরুরি যে, নিজে অর্বাচীন না হলে অন্যকে অর্বাচীন বলার মতো পাঁঠামী কেউ করতে যায় না। তবে কি অর্বাচীন শব্দটি বাংলা ভাষা থেকে হারিয়ে যাবে ? না, তা যাবে না। গাধা প্রাণীটি যেমন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ‘গাধা’ শব্দটি তার প্রয়োগযোগ্যতার কারণেই বাংলা ভাষা থেকে সহজে হারাবে না, অর্বাচীন শব্দটাও তাই। কেননা আমাদের সমাজে মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি এই অর্বাচীন শব্দ ব্যবহারকারীর সংখ্যাতেও টান নেই। তার কিছু উৎকৃষ্ট নমুনা সংরক্ষণ ও প্রকাশ করার কৌতুক করে ‘প্রতীকী’ সম্পাদক মিজানুর রহমান শামীম যে রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসার দাবীদার বৈ কি। নইলে আমরা কিছু মজাদার বিনোদন থেকে যে বঞ্চিত হতাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটাও বলে রাখা আবশ্যক, যাঁরা অনেক শ্রম-ক্লান্তির পর মাঝে মাঝে সুক্ষ্ম বিনোদন নেয়ার মতো স্নায়ু-সংবেদনশীলতায় থাকেন না এবং তখনকার মতো স্থূল বিনোদন পেতে ভাঁড়ামো আর গোয়ার্তুমিকে আপাত অগ্রাধিকার দেবেন, তাঁরা প্রতীকী’র ১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত জনৈক কুমার গৌরব-এর লেখা ‘প্রতীকী’র ১৫তম সংখ্যা- একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া’ রচনাটি পড়ে দেখতে পারেন। যে লেখাটির আগার সাথে পাছার সংশ্রব নেই, পাছার সাথে মাঝের মিল নেই ইত্যাদি। আশা করা যায় বিনোদন প্রাপ্তিতে ঘাটতি হবে না। পড়তে গিয়ে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না যে, লেখক কি আদৌ কোন রচনা লিখছেন, না-কি বর্জ্যত্যাগ করছেন ! অক্ষর বা শব্দ যেমন প্রয়োগ ও লেখার গুণে স্নিগ্ধ সুবাস ছড়ায়, শালীনতার অভাব বা লেখার অশ্লীলতার কারণে অক্ষর থেকেও দুর্গন্ধ ছড়ায়। ওই লেখাটিও সেরকমই। এরকম দুর্গন্ধযুক্ত লেখার জবাব দেয়া রুচিসম্মত নয়। ঘাটাঘাটিতে দুর্গন্ধ আরো বেশি করে ছড়িয়ে স্বস্তিকর বাতাসকেও আক্রান্ত করে। কিন্তু লেখক হিসেবে পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তার চেয়েও বড় কথা, কিছু বিনোদন প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা স্বীকারেরও একটা বিষয় রয়েছে।

এই গল্পটা তো সবাই জানেন। ছেলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শ্বশুরের সাথেই কোন কথা বলে না, কেবল এড়িয়ে এড়িয়ে থাকে। বংশের এমন দুর্নাম বাবা সহ্য করেন কিভাবে ! তাই ছেলেকে ডেকে বলে দিলেন শ্বশুরের সাথে যাতে অবশ্যই কুশল বিনিময় করে এবং খানিকটা কথাবার্তাও বলে নেয়। পরবর্তীতে ছেলে পিতার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরেই পালন করলো। শ্বশুরকে দেখেই বলে উঠলো- বাবা, আপনি বিয়া করছেন ?

আমাদের কুমার গৌরব লেখার শুরুতেই তাঁর পরিচয় দিয়ে রেখেছেন- তিনি কোন কবিতাকর্মী, গদ্যকার বা সাহিত্যকর্মী নন। তবে ছড়া/কবিতা তাঁর খুব ভালো লাগে। গ্রামে বসবাস করেও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করা তাঁর পুরনো অভ্যাস। গল্পের সেই ছেলের মতো আর কি। আর নতুন অভ্যাসটা তিনি তার লেখাতেই সেই ছেলেটির মতোই দেখিয়ে দিয়েছেন।  তার ছোট্ট একটু নমুনা- ‘কখনো কখনো কোন অর্বাচীন লেখকের মতামত হয়ে পড়েছে একপেশে কিংবা তৈলমর্দন নির্ভর। যেমন- প্রতীকীর ১৫তম সংখ্যার ৭৩ থেকে ৯০ পৃষ্ঠায় রনদীপম বসু’র গদ্য ‘ছড়া কবিতায় ছন্দের শাসন ও দুঃশাসন’। তিনি তাঁর গদ্যে খ্যাতিমান কবি সুজন বড়ুয়াকে একহাত নিয়েছেন। সুজন বড়ুয়ার কিশোর কবিতায় কবিতার একটি শব্দ ‘খর’ নিয়ে তিনি যে নিষ্ফল আস্ফালন করেছেন তাতে মনে হয়েছে সুজন বড়ুয়ার মত খ্যাতিমান কবিকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনাই তার একমাত্র ব্রত। বাংলাদেশের কিশোর কবিতাঙ্গনে সুজন বড়ুয়া এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। সম্পূর্ণ চার রঙা যাঁর আলোতে বর্তমান সময়ের অনেক কিশোর কবিতাকর্মী আলোকিত হয়েছেন। কেউ কেউ নিজ স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে এতাঁর লেখার চর্বিত চর্বন করে যাচ্ছেন। রনদীপম বসুর গাত্রদাহ কোথায় তা বোঝা দুস্কর। রনদীপম বসুর সারা জীবনের অর্জিত সাধনায় সম্ভব হবে কি সুজন বড়ুয়ার কিশোর কবিতার মত অন্ততঃ একটি কবিতা লেখা ?…’

হা হা হা ! একটু হেসে নিলাম। সেই স্কুলজীবনের প্রবচনটা মনে পড়লো- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ যাকে যেখানে মানায়। মানসিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত না হলে কেউ সাহিত্য আলোচনায় এমন অভব্য শব্দপ্রয়োগ করতে পারে, তা আগে জানা ছিলো না। এগুলোর কি কোন সুস্থ জবাব হয় ? হুমায়ুন আজাদ এজন্যেই হয়তো তাঁর প্রবচনগুচ্ছে ১৯০ নম্বর প্রবচনটা লিখেছিলেন- ‘গাধা একশো বছর বাঁচলেও সিংহ হয় না।’ ঘটের মধ্যে ন্যুনতম শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ থাকলে কুয়োর ব্যাঙের মতো নিজের গণ্ডিটাকেই অপরিসীম মহাসাগর ভাবার মতো হঠকারি নির্বুদ্ধিতা আর ভাঁড়ামোতে ভর করতো না তাঁকে। গোটা লেখাতে বহুবার উচ্চারিত ‘রণদীপম বসু’ নামটাকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করার মধ্যে প্রচুর বীরত্ব থাকতে পারে, ভদ্রতা নেই। এজন্যে তাঁকে আগাম দোষারোপ করবো না। অর্বাচীন ভুতের উৎপাত ছাপাখানায়ও থাকতে পারে।  তবে লেখালেখির জগতে একান্ত অপগণ্ড না হলে সারা জীবনের অর্জিত সাধনা দিয়ে কেউ সুজন বড়ুয়ার মতো কবিতা লিখতে যাবে না, এটা যাঁরা কবিতার অ আ-ও বুঝেন তাঁরাও নিশ্চয়ই অনুধাবন করেন। আর কারো মতো কবিতা লিখতে না পারলে তাঁর সাহিত্যমান নিয়ে আলোচনা করা যাবে না এরকম উজবুক ধরনের ভয়ঙ্কর চিন্তাচেতনা ধারণ করলে প্রথমেই আমাদের সাহিত্য জগতের বাঘা বাঘা সব সাহিত্য-সমালোচকের নাম ও কৃতিগুলোকেই যে কেটেছেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে, এই সহজ কথাটা বুঝতে না চাওয়ার মধ্যে দুরভিসন্ধি যেমন থাকে, তেমনি মূর্খতার আলামতও ঢেকে রাখা যায় না। ভাগ্যিস কুমার গৌরব যে বলে বসেন নি, সারা জীবনের সাধনা দিয়ে আগে সুজন বড়ুয়ার মতো এরকম সম্পূর্ণ চার রঙা গোলগাল একখান গৌরবর্ণ জ্যোতির্ময় চেহারা বানিয়ে তারপর তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনা করতে আসেন !  এজন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ তো বটেই। নইলে আজ এই দুয়েকটা কথা বলার সুযোগ কি আর ঘটতো !

কুমার গৌরবের বক্তব্য অনুযায়ী সুজন বড়ুয়ার মতো ‘বাংলাদেশের কিশোর কবিতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা’র একটি রচনার একটি শব্দ ‘খর’-এর ভুল ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করাটা তাঁর মতে ‘নিষ্ফল আস্ফালন’ হয়ে গেছে আমার। এরকম আরোপিত সিদ্ধান্তের হেঁচকা টানে আমাকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেয়ার প্রেক্ষিতে জবাব দিতে গেলে আলোচনায় একটু খরতা এসে যায় বৈ কি। এ জন্যে লেখক ও সম্মানিত পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার স্বাভাবিক গদ্যভাষা থেকে এ লেখাটার উপস্থাপনভঙ্গির ভিন্নতার কারণে।  ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী’র উল্লেখযোগ্য একটা উক্তি ছিলো, যা বাংলা উচ্চারণে এরকম- ‘নোবোডি কিকস এ্যা ডেড-ডগ’। মহাজন ব্যক্তিদের কিছু কিছু উক্তিকে আপ্তবাক্য হিসেবে মান্য করতে হয়। সুজন বড়ুয়া, এখন পর্যন্ত যাঁর রচনাবলীর কিশোর-কবিতা নামধারী রচনার শতকরা নব্বইভাগ বর্জ্য-পদ্য ছাড়া আর কিছু না, বাকিগুলোর সিংহভাগই ‘হতে পারতো’ জাতীয় লেখা, তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার রুচি বা দুর্মতি কোনটাই আমার নেই বা কখনো ছিলোও না। কিন্তু আমার কলমের সামনে অযাচিতভাবে এসে সামনে দাঁড়িয়ে যাবার কৃতিত্ব বা দায় একান্ত তাঁরই।  কুমার গৌরবের বক্তব্য অনুযাযী ‘সুজন বড়ুয়ার মত খ্যাতিমান কবিকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনাই’ আমার একমাত্র ব্রত কিনা তার জবার একটু খেয়াল করলে এ রচনাতেই পাঠকরা পেয়ে যেতে পারেন ।

পাঠকের বিনোদন পাওয়ার মতো কুমার গৌরবের বহু প্রণিধানযোগ্য উক্তি তাঁর লেখাটিতে রয়েছে। আসুন আগে সেরকম আরো কিছু উক্তি শুনে নেই আমরা।

‘মাগো তুমি বলো শুধু- “খোকন পড়ো,/ হতে হবে জ্ঞানী গুণী অনেক বড়,/ হতে হবে উঁচু শির পাহাড়ের মতো থির/ হতে হবে সুগভীর সাগর খর/ আকাশের মতো খোলা বিশাল বড়।” -(কোন একদিন/ সুজন বড়ুয়া)
‘একজন কিশোর সাগরের মত ‘খর’ হতে চাইছে কেন। এখানেই রনদীপম বসুর আপত্তি। দুরন্ত কিশোরের সাগরের মত ‘খর’ হতে চাওয়াকে তিনি নেতিবাচক অর্থে চিন্তা করেছেন, যাতে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার প্রকাশ পেয়েছে। …… রনদীপম বসুর মত অর্বাচীনদের যা বোঝার কথা নয়।’

বিশাল কবিতা বোদ্ধার মতো কথাই বটে ! সারারাত রামায়ণ পড়ে অতঃপর প্রশ্ন হলো- সীতা কার বাপ ? উপরের পঙক্তিগুলোতে কোথাও কি তা বুঝানো হয়েছে যে এগুলো একান্তই খোকার চাওয়া ? না-কি খোকার মায়ের ইচ্ছেটাই এখানে প্রতিফলিত ? আমার গদ্যে শুধু ‘খর’ই নয়, পরবর্তীতে কবি যে তাঁর অন্য বইয়ে এই ‘খর’ শব্দটিকে ‘খড়’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছেন, সে ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছিলো। সে বিষয়টা তিনি আদৌ পড়েছেন, না কি সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন তা বুঝা যাচ্ছে না। তবে এটা বুঝা যাচ্ছে যে, আর যাই হোক তালে তিনি ঠিকই আছেন। এ বিষয়টাতে আর কথা না বাড়িয়ে বরং আমার গদ্যটাতে এ ব্যাপারে কিভাবে কী বলা হয়েছিলো তা পাঠকের বিবেচনার জন্য উদ্ধৃত করি-

‘অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৩৯১ প্রাপ্ত ‘আজ সারাদিন আমরা স্বাধীন’ বই এর উপরে উদ্ধৃতাংশের কবিতাটি একটি সেরা রচনা এবং প্রচলিত প্রকরণে আদর্শ নমূনা হিসেবে কিশোরকবিতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারতো। উদ্ধৃত অংশটুকু কবিতাটির প্রথম প্যারা। এখানে একটি খোকার প্রতি একজন মায়ের চিরকালীন চাওয়াটুকু বর্ণিত হয়েছে খোকার জবানীতে। কবিতার পরবর্তী ছ’টি প্যারাতে লেখক ছন্দের নিপুণ ব্যবহার ও চমৎকার কাব্যময় অভিব্যক্তির মাধ্যমে চিরায়ত খোকার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ রূপকাশ্রয়ে সমাপ্তিও টেনেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। কিন্তু কবিতাটির শুরুতেই প্রথম প্যারায় যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঠক এখানে এসেই অকস্মাৎ কর্কশ হোঁচট খেয়ে ছিটকে গেলে বাকী পথ পেরোবেন কী করে? উদ্ধৃত অংশের চতুর্থ পঙক্তিতে মায়ের অন্যতম চাওয়া ‘হতে হবে সুগভীর সাগর খর’। এখানে ‘খর’ শব্দটি ব্যবহার করে লেখক আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন?
‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ ৮ম পুনমুদ্রণ: মাঘ ১৪১৩/ জানুয়ারি ২০০৭ সংস্করণ থেকে দেখা যাক ‘খর’ শব্দটির কী অর্থ বেরিয়ে আসে। খর(১)- ১ ধারাল; তীক্ষ্ণ (খর অসি)। ২ প্রবল (খর দাহন)। ৩ তীব্রগতি (খরস্রোতা)। ৪ কর্কশ; কঠোর; রূঢ় (খর বচন)। ৫ উগ্র; কড়া (খর ঝাল)। ৬ প্রখর; প্রচণ্ড (খর রৌদ্র)। ৭ ধাতব পদার্থ মিশ্রিত (খর পানি)। খর(২) ১ গর্দভ; খচ্চর; অশ্বতর। ২ রাস বিশেষ।
দেখা যাচ্ছে যে ‘খর’ শব্দটি একটি বিশেষণবাচক শব্দ এবং মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে এ শব্দের প্রয়োগ নেতিবাচক গুণাবলীই (?) প্রকাশ করে। কোন মা কি তাঁর সন্তানের মধ্যে ‘সুগভীর সাগরের’ বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে কোন খর বা নেতিবাচক গুণের প্রকাশ ঘটাতে চাইতে পারেন?  শুধুমাত্র ছন্দ ও মিলের সুতীব্র মোহে চিরকালীন মায়েদের নির্মল আকাঙ্ক্ষায়ও বিপত্তি ঘটিয়ে দেয়া হলো!
উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি ২০০৭ এ প্রকাশিত একই লেখকের ‘এসো ছন্দ শিখি ছড়া-কবিতা লিখি’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ছন্দ যেন মন্দ না হয়’ শিরোনামের নিবন্ধটিতে বিষয়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখক নিজের রচিত এই কবিতাটিরই পুরো উদ্ধৃতি টেনে এখানে আবার আলোচ্য ‘খর’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত করেছেন ‘খড়’ শব্দ দিয়ে। পূর্বোক্ত বাংলা অভিধানে ‘খড়’ শব্দের অর্থ দেয়া আছে- শুষ্ক শস্যশূন্য ধানগাছ; বিচালি বা শুকনা ঘাস। অতএব পঙক্তিটির সর্বশেষ সংস্করণ ‘হতে হবে সুগভীর সাগর খড়’-এর ভাবগত অর্থ কী হতে পারে  তার সুযোগ্য ব্যাখ্যা হয়তো প্রাজ্ঞজনেরাই দিতে পারবেন।’

কুমার গৌরব যে সুজন বড়ুয়ার একজন অন্ধ ভক্ত তা তাঁর লেখাটির পরতে পরতে ক্ষোভের সাথে রণদীপম বসুর উপর খড়গ-হস্ত হয়ে উঠা দেখেই বুঝা যায়। এক্ষেত্রে সুজন বড়ুয়া প্রশংসার দাবীদার যে, অন্তত এমন একজন অন্ধ ভক্ত তিনি তৈরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তবে অন্ধত্ব যে শেষ বিচারে বিপর্যয়ই ডেকে আনে তাও জেনে রাখা উচিত ছিলো। কুমার গৌরবের লেখাটিতে আসলে ক্ষোভের বিষয় দুটো। একটি হলো পৃথিবীতে আর যে কারো সমালোচনা হোক ক্ষতি নেই, এমন কি প্রায় সুজন বড়ুয়ার কাতারের রাশেদ রউফ-এর লেখার সমালোচনাও করা যাবে, কিন্তু সুজন বড়ুয়ার লেখার সমালোচনা করা যাবে না। আর দ্বিতীয়টি হলো, ভাশুরের নাম মুখে আনার মতোই পরিত্যাজ্য লেখক জুলফিকার শাহাদাৎ-এর নাম কেন উচ্চারণ করা হবে ? তাঁর গোটা লেখাটার সারবস্তু হচ্ছে- ‘ঠাকুর ঘরে কে রে ? আমি কলা খাই না !’ আমার সেই গদ্যটিতে তিরিশজন লেখকের তিরিশটা উদ্ধৃতির মধ্যে জুলফিকার শাহাদাৎ কেন আসবে, এটাই তাঁর আসল ক্ষোভ। আর এই ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি জুলফিকারের কবিতার যে উদ্ভট বিশ্লেষণ করেছেন, তা এতোটাই হাস্যকর যে তা যাঁরা কবিতা বিষয়ে সামান্য ধারণাও রাখেন, তাঁদের জন্য বেশ বিনোদনের খোরাক হবে বলে মনে করি।

কুমার গৌরব আরেকটা যে মহান তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন তাও বেশ চমকপ্রদ। তাঁর নমুনা- ‘রনদীপম বসুর আরো অনেক গদ্যে ঘুরে ফিরে জুলফিকার শাহাদাৎ এসেছেন বার বার। খবর নিয়ে জানা যায় জুলফিকার শাহাদাৎ তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ, একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জুলফিকার শাহাদাৎকে হাইলাইট করাও রনদীপম বসুর আর একটি চাতুর্য্যপূর্ণ মিশন। তাই বলে এমন নির্লজ্জ সাফাই ? ঘোড়াও এতে না হেসে পারে না।…’
এবার পাঠকরাই বলুন, এ কথার কী জবাব হয় ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন লেখক শিক্ষক কি তাহলে আরেকজন লেখক শিক্ষকের আলোচনা করতে পারবেন না ? একই পত্রিকায় কর্মরত একজন লেখক কি আরেকজনের নাম মুখে আনতে পারবেন না ? তবে একই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে কর্মরত থেকেও লেখক ফারুক নওয়াজ কিন্তু সুজন বড়ুয়ার প্রশংসা করতে পারবেন এবং করেছেনও। তার কারণ কি সুজন বড়ুয়া জুলফিকার শাহাদাৎ নয়, এজন্যেই ? আরেকটা প্রবচন মনে হলো- ‘যে সমাজে গাধার সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে গাধা, আর মানুষের সাংঘাতিক অপরাধ হচ্ছে সে মানুষ, সে সমাজে গাধারাই রীতিনীতির সিদ্ধান্ত দেয়’। আমি যদি এখন দেড়মন গোবর নিয়ে বলি এগুলো পোলাও-এর চাল, কেউ কি তা বিশ্বাস করবে ? আর দেড়মন পোলাও-এর চালকে গোবর বললেই কি মানুষ তা ফেলে দেবে ? আসুন কুমার গৌরবের গুরু সুজন বড়ুয়া জ্বলজ্বলে অক্ষরে জুলফিকার শাহাদাৎ সম্পর্কে কী বললেন তা দেখি-

‘কিশোর কবিতা এখন এক জনপ্রিয় সাহিত্য মাধ্যম। কবিতার ভাব, অর্থ ও আঙ্গিক সব আধুনিক মোহনীয় বৈশিষ্ট্য এ শ্রেণীর রচনায় উপস্থিত। অনুপস্থিত শুধু কবিতার গভীর রহস্যময়তা। কৈশোর সংলগ্ন শিল্পিত কিন্তু সরল প্রকাশভঙ্গির জন্যই এর পরিচয় কিশোর কবিতা। বাংলাদেশে প্রবহমান কিশোর কবিতার বর্তমান ধারায় জুলফিকার শাহাদাৎ একটি নতুন কষ্ঠস্বর। গতানুগতিক প্রথার বেড়াজাল ভাঙার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত কবি তিনি। তাঁর প্রতিটি লেখাই বিষয়ে আঙ্গিকে, শব্দে, ছন্দে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পুষ্ট। আবেগের সঙ্গে বুদ্ধির মেলবন্ধনই তাঁর কবিতা। বাংলাদেশের সবুজ গ্রাম, নিবিড় প্রকৃতি ও সংগ্রামী জীবনের অনুষঙ্গগুলো তাঁর কবিতায় পায় ভিন্ন মাত্রা। এই বইয়ের একুশটি কবিতাও এ বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। অথচ এটি নিছক তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নয়, আধুনিক মননঘন পরিণত উচ্চারণ। এই বই বাংলাদেশের কিশোর কবিতার জগতে নিঃসন্দেহে এক নতুন আলোক-বিন্দু।’- (সুজন বড়ুয়া, ১২.০১.০৭)।  ‘আকাশকে খোলাচিঠি’ বইটির সূত্র ধরে এই হলো জুলফিকার শাহাদাৎ সম্পর্কে সুজন বড়ুয়ার মূল্যায়ন।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নভাবে বহু গদ্য লিখতে হয়েছে আমাকে। ছড়া সাহিত্য বা শিশু-সাহিত্য নিয়েও লেখা হয়েছে বেশ কতকগুলো। কিন্তু আমার মনে পড়ে না, এতোটা হাতখোলা প্রশস্তি আমি জুলফিকার শাহাদাৎ-কে নিয়ে কোথাও করেছি কিনা। বরাবরই লেখার গুণমুগ্ধ আমি। লেখা উপেক্ষা করে লেখক বা ব্যক্তিকে কখনো প্রাধান্য দিয়েছি বলেও মনে পড়ে না। ভালো লাগলে একেবারে নবীন লেখকের চমৎকার লেখাটিও অনায়াসে তুলে এনে সবার সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টায় সবসময় সচেষ্ট থেকেছি এবং এখনও আছি। ফোর-কালারের খ্যাতিমান ব্যক্তি হলেই যে তাঁর বর্জ্যকেও গায়ে মেখে নিতে হবে, এরকম আহামরি রুচিবোধ প্রদর্শনে অন্ধভক্ত কুমার গৌরবের জন্য শ্লাঘার বিষয় হতে পারে, রণদীপম বসুর মেরুদণ্ড এতোটা নিগ্রহে এখনো পৌঁছায়নি। আর তৈলমর্দনের বিষয়টা যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিকই হয়, তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তৈল মর্দনের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সম্পর্কে ব্যক্তিচর্চাকারী কুমার গৌরবই ভালো বলতে পারেন। এক্ষেত্রে আমার অনভিজ্ঞতাই আমার মহার্ঘ সম্পদ হয়ে থাকলো না হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, অন্ধতা বা গোঁড়ামি শেষ বিচারে আসলে বিপর্যয়ই ডেকে আনে। আমাদের প্রয়োজন গুণমুগ্ধ হওয়া, কিছুতেই অন্ধভক্তি নয়। কিন্তু আমাদের অন্ধভক্তদেরকে এ কথাটা বুঝানোর মতো কোন আধুনিক প্রযুক্তি বোধ হয় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনো যে আদিম প্রক্রিয়াটিই ব্যবহার করতে হয়, তা হলো গুঁতো দেয়া। এতেও অনেক ক্ষেত্রে কোন কাজে আসে না। কারণ চামড়ার পুরুত্বের সাথে অনুভূতির তীব্রতা সব সময়ই বিপরীতানুপাতিক হয়। কুমার গৌরব যে উল্লেখ করেছেন- ‘রনদীপম বসুর আরো অনেক গদ্যে ঘুরে ফিরে জুলফিকার শাহাদাৎ এসেছেন বার বার’, সেক্ষেত্রে তিনি যদি কিছু নমুনা-উদ্ধৃতি টানতেন তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে সেই প্রেক্ষাপটগুলো আলোচনা করায় সুবিধা পাওয়া যেতো। প্রতিটা লেখকেরই কিছু না কিছু দায়বদ্ধতা থাকে বা থাকা উচিত। প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)-এর চমৎকার একটা উক্তি আছে- ‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই, তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ এই কথাটাকে আমি আমার ক্ষেত্রে আপ্তবাক্য হিসেবে জ্ঞান করি। যেখানেই কোন অনাচার বা অনৈতিক কর্মকাণ্ড নজরে আসে এবং তা আমাকে ভাবায়, সম্ভব হলে সাধ্যানুযায়ী এর প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে এসেছি আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে। এরকমই ২০০৭ সালে ‘এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ ঘোষণায় সাহিত্য-পাঠকদেরকে রামছাগল বিবেচনা করার যে অনৈতিক প্রক্রিয়া খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়েছে আমার, সেই নেক্কারজনক ঘটনা নিয়ে আমাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ভানুমতির খেল শিরোনামে একটা গদ্য লিখেছিলাম, যা একটি দৈনিকের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো। যেখানে একই বিষয় ছড়া-কবিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুটো বই সুজন বড়ুয়া’র ‘বুকের ভেতর শাপলা ফোটে’ এবং শিবুকান্তি দাশের ‘রোদের কণা রুপোর সিকি’ নিয়ে পরিপূর্ণ ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষণমূলক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছিলো। সেখানে অন্যতম প্রতিযোগী হিসেবে অধিকতর যোগ্য বই জুলফিকার শাহাদাৎ-এর ‘আকাশকে খোলাচিঠি’ নিয়েও খুব সঙ্গতভাবেই তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছিলো। নইলে ভানুমতির খেলটাকে পাঠকরা যথাযথভাবে যাচাই করতেন কিভাবে ?  পাঠকরা খুব শীঘ্রই অন্য কোন ছোটকাগজে সেই গদ্যটার সর্বশেষ রিভিউটা পড়ার সুযোগ পাবেন আশা করছি। এতেও যদি আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখা জাস্টিফাইড ভক্ত-পাঠকদের দৃষ্টি-বিভ্রম কিছুটা ঘুঁচে।

এ তো গেলো দৃশ্যমান কৃতকর্মের যৎকিঞ্চিৎ ফিরিস্তি। এর বাইরেও লোকচুর অন্তরালে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যেখানে ব্যক্তির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবান হতেই হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেগুলো এমন একপক্ষীয় ও ব্যক্তিগত সাক্ষ্যবাহী যে তার খণ্ডিত যে প্রমাণটুকু পাঠকের চোখের সামনে থাকে তা থেকে পাঠক আসলে কিছুই প্রমাণ করতে পারে না। এরকম একটা অভিজ্ঞতা আজ প্রসঙ্গক্রমে পাঠকের সাথে শেয়ার করছি। তবে তার আগে পাঠকের কাছে আবারো মার্জনা চেয়ে রাখছি। কুমার গৌরব জেনে বা না জেনে রণদীপম বসুর যোগ্যতা নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে রেখেছেন তার প্রমাণপত্র এখানে হাজির করা তাঁর কৃতকর্মের মতোই আরেকটা ছ্যাবলামো হয়ে যাবে। তিনি যেহেতু ব্যক্তিগত খোঁজ-খবর সংগ্রহে ইতোমধ্যেই তাঁর অতুলনীয় দক্ষতা দেখিয়ে দিয়েছেন, আশা করি বাকি খোঁজ-খবরটুকুও নিজ দায়ে সংগ্রহ করে তাঁর জানার কুয়োটাকে সম্প্রসারণ করতে উদ্যোগি হবেন। এখানে যে অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করতে চাচ্ছি, তা হচ্ছে কুমার গৌরবের মূর্তিমান গুরু সুজন বড়ুয়ার সম্পাদক হিসেবে কবিতা বুঝার ভয়ানক গুণাবলী বিষয়ক।

ব্যক্তির যোগ্যতা আসলে তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডেই কোন না কোনভাবে প্রকাশ পাবেই। সেটা সম্ভবত ২০০৭ সালের এপ্রিল বা মে মাসের কথা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে যে শিশু-কিশোরদের সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘শিশু’ নিয়মিত বের হয়, তাতে ডাকযোগে একটি কিশোর-কবিতা পাঠাই আমি। শিশু’র সম্পাদক হিসেবে সরকার নিয়োজিত যে আমলা-ব্যক্তিদের নাম প্রিন্টার্স লাইনে আসে, তা কেবলই একটা পদাধিকার সিস্টেম। মূলত পত্রিকাটির সম্পাদনা করেন মূলতঃ সুজন বড়ুয়াই। ছুড়ি-কাচি নিয়ে লেখকদের উপর চড়াও হওয়ার স্বয়ম্ভু ক্ষমতা পদাধিকার বলেই তাঁরা পেয়ে যান। যোগ্য হাতে ছুড়ি কাচি থাকলে বাঁদর যেমন শিবের মহিমা পেয়ে যায়, তেমনি কিরকম হাতে পড়লে শিবও বাঁদর হয়ে যায় তা পাঠকদের বিবেচনার কাছেই সিদ্ধান্তটা তুলে দেয়া হলো।
আমার প্রেরিত কবিতাটার চেহারা ছিলো এরকম-

/আলোর দুপুর উল্টে দিয়ে  আগুন জামা গায়
বোশেখ এলেই রোদ বালিকার দুষ্টু নাচন
তপ্ত নূপুর পায়।

ও বালিকা দুষ্টু কেন,
এই আমাকে তুমি চেন ?
মেঘ ভাইয়ারা আরো ভালো, তোমার মতো নয়
তবুও ভালোবাসি তোমায়- আর কে এমন হয়!

আমি যখন চুপটি করে
খেলতে চলি ভরদুপুরে
তুমিও না হয় অমনি আমার  খেলার সঙ্গী হয়ো
শুধু, ওই জামাটা পাল্টে তোমার  অন্য জামা নিও।

তখন মা আর বকবে না
যেতে বারণ করবে না
কত্তো খেলা শিখিয়ে দেবো  খেলবে গিয়ে ঘরে,
মেঘ ভাইয়াকেও সঙ্গে এনো  খেলার সাথি করে।

(রোদ বালিকা/ রণদীপম বসু)

পরবর্তীতে ২০০৮-এর বইমেলায় ‘মুক্তদেশ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আমার কিশোর-কবিতার বই ‘খোকার জানালা’-তেও কবিতাটা স্থান পেয়েছে। পাঠকরা সেখান থেকেও মিলিয়ে দেখতে পারেন, অন্যদিকে শিশু একাডেমীর মালখানায় নিশ্চয়ই আমার স্বহস্তে লিখিত কাগজটা রক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু ‘শিশু’ জুন ২০০৭ সংখ্যায় উপরোক্ত কবিতাটাই যেভাবে রক্তাক্ত হয়ে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হলো, তার নমুনা এবার দেখুন-

/আলোর দুপুর উল্টে দিয়ে  আগুন জামা গায়
বোশেখ এলেই রোদ বালিকার দুষ্টু নাচন
তপ্ত নূপুর পায়।

ও বালিকা দুষ্টু কেন,
এই আমাকে তুমি চেন ?
মেঘ ভাইয়ারা আরো ভালো, তোমার মতো নয়
তবুও ভালোবাসি তোমায়- আর কে এমন হয়!

আমি যখন চুপিসারে খেলতে চলি ভরদুপুরে
তুমিও না হয় খেলার সঙ্গী হয়ো আমার প্রিয়
শুধু তোমার ওই জামাটা পাল্টে তুমি অন্য জামা নিও-
তখন মা আর বকবে না
যেতে বারণ করবে না
কত্ত খেলা শিখিয়ে দেবো  খেলবে গিয়ে ঘরে,
মেঘ ভাইয়াকেও সঙ্গে এনো  খেলার সাথি করে।

সেদিন থেকেই এটা বুঝে গেছি যে, কোন সৃষ্টিই ঐ শিশু পত্রিকার জন্য কোনভাবেই নিরাপদ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সুজন বড়ুয়ার মতো কবিতা বোদ্ধার উপস্থিতি সেখানে থাকবে। লেখকরা যে কেবল সম্মানি বা মুদ্রিত হওয়ার জন্যই লিখেন না, তার পেছনে থাকে সৃষ্টির যন্ত্রণা ও আনন্দ, সেই উপলব্ধি যে ধারণ করতে জানে না তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির হাল-হকিকত কী হবে তা নিশ্চয়ই এ থেকেই অনুমেয়। রণদীপম বসু ভুলেও আর কখনো ‘শিশু’র ঠিকানায় ডাকবাক্সে কিছু ফেলেনি বা তাঁর লেখাগুলোর সম্মানীর জন্যেও শিশু একাডেমীতে যায় নি।

আমাদের কুমার গৌরব যেভাবে ধ্রুবতারার মূর্তি বানিয়ে সুজন-পূজায় মত্ত আছেন, তাতে অন্ধ আবেগ থাকতে পারে, যুক্তি নেই। আমাদের মেরুদণ্ডহীন অন্ধত্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেই বোধ করি হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচনগুচ্ছের ৭৯ নম্বর প্রবচনটি এভাবে লিখেছিলেন- ‘মূর্তি ভাঙতে লাগে মেরুদণ্ড, মূর্তিপূজা করতে লাগে মেরুদণ্ডহীনতা।’ সুজন বড়ুয়াকে নিয়ে কিছু লেখার মতো এমন আহামরি সম্ভার তাঁর রচনাবলীতে পাইনি যে বিরোধিতা করার জন্যেও তাঁকে নিয়ে তেমন কিছু লিখতে হবে আমাকে। এই যেমন পৃথিবীতে কতো কিছু থাকতেও উল্লেখযোগ্যহীন জনৈক কুমার গৌরবকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা রুচি কোনটাই না থাকার পরও এতোক্ষণ সময় ও কালির অপচয় করতে হলো আমাকে, যা সাহিত্যের কোন কাজেই আসবে না। একমাত্র আশা, যদি কারো বোধোদয় ঘটাতে তা কাজে লাগে। সুজন বড়ুয়াকে আকাশের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা বানিয়ে পরিশেষে তিনি যেমন বলেছেন- ‘রনদীপম বসু এরকম একপেশে, তৈলমর্দন নির্ভর গদ্য অথবা কারো আজ্ঞাবহ হয়ে তাকে আকাশে তোলার হাস্যকর মন্তব্য নির্ভর গদ্য লেখা থেকে বিরত থাকলে সাহিত্যের এ মাধ্যমটি বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাবে বৈকি।’  তার প্রেক্ষিতে ছোট্ট একটা কৌতুক দিয়েই লেখাটার মুখ গুটিয়ে ফেলতে চাচ্ছি। কৌতুকটা হলো-
ছেলেকে নিয়ে পিতা গেছেন রাঙামাটি বেড়াতে। প্রকৃতির বিচিত্র লীলা আর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ পিতা  ছেলের কাছে জানতে চাইছেন- বাবু, সিনারিগুলো কেমন লাগছে তোমার ? ছেলে বলছে- বাবা, সিনারি দেখবো কী করে ? পাহাড়ের জন্যে তো কোন সিনারিই দেখা যাচ্ছে না !

কুমার গৌরবের চোখের সামনেও রণদীপম বসু’র মতো একটা পাহাড় যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সাহিত্যের সিনারি দেখাটা তাঁর জন্যে বড় বিপদ বৈ কি !


[ 'প্রতীকী' ১৭সংখ্যায় প্রকাশিতব্য]

No comments: