| ঘৃণার বুলেটে বিদ্ধ ভালোবাসা...!
রণদীপম বসু
...
প্রিয় রাসেল
বেঁচে থাকলে তুমি আজ ঠিক আমার বয়েসী-ই হতে। কারণ একই বছরে জন্মেছিলাম আমরা। কিন্তু আমার মতোই হতে কিনা জানি না। গড়পড়তা বাঙালির মধ্যমাকৃতির দেহে অকাল-বাতাসে উড়ে যাওয়া তৃণভূমির বিরাণ হাহাকার হয়তো জ্বলজ্বল করতো না তোমার মাথায়। ঘন কালো গভীর অরণ্যে বিচ্ছুরিত আলোকরেখার মতো এক ঝাঁক রূপালী ঝিলিক নিয়ে আশ্চর্য সুঠাম ও দীর্ঘদেহী পৌরাণিক পিতার কনিষ্ঠ উত্তরাধিকার তুমি অসম্ভব ঋজুতায় অহঙ্কারী হতে। ‘হয়তো’র সম্ভাব্য-আঁটা এই অনিবার্য বৈশিষ্ট্যও তোমার আর আমার মাঝে মূলত কোন পার্থক্য সূচিত করে না আজ। বেঁচে থাকলে আমাদের আকস্মিক বন্ধুতা হওয়াও তেমন কোন আশ্চর্যের বিষয় হতো না। কারণ এখনো তুমি আমার ভাই। আমাদের পিতা তোমাকে দিয়েছিলেন রক্তের জেনেটিক স্রোত আর আমাকে দিয়েছেন দুর্বার পরিচয়।
বেঁচে থাকলে তোমার আর আমার মাঝে প্রকৃত পার্থক্য হতো না কিছুই। আজ এই দু’হাজার ন’য়ে দাঁড়িয়ে তোমার আর আমার মাঝে চৌত্রিশটি বছরের অক্ষয় পার্থক্য কখনোই মুছবে না শুধু প্রলম্বিতই হবে, হতে থাকবে, হতেই থাকবে। কেননা তুমি স্থির হয়ে গেছো পঁচাত্তরের পনেরোই আগষ্টের এক অদৃশ্য কৃষ্ণ-গহ্বরে। প্রিয় রাসেল, শেষপর্যন্ত তুমি শিশুই রয়ে গেলে।
তোমাকে যে ওরা বাড়তে দিলো না আর, এ পৃথিবীর কতোটা ক্ষতিবৃদ্ধি হলো, তা নিয়ে আমার যতটুকু মাথা-ব্যথা, তারচে’ও বড় কথা, তোমাকে যে বাড়তে দিলো না, একা একা বড় হবার দুঃসহ যন্ত্রণা আর বড়ত্বের ঘৃণায় নিমজ্জিত আমিও যে কলঙ্কের অংশীদার আজ ! তোমাকে বাড়তে দিলো না ওরা, ওরা মানে বড়’রা, মানে পৃথিবীটা শিশুদের নয়- বড়দের; শিশু আর বড়’র এই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে কতোটা নতজানু হ’লে পাপের কলঙ্ক ধোয়, ধোয়ে যায় বড় হবার শিশু-হন্তারক পাপ ? নতজানু হতে হতে বাঙালি মাথাটা এই বাংলার ক্ষয়িষ্ণু মাটি ভেদ করে কতোটা গভীর আর নিম্নবর্তী হলে ফের ভাই বলে বন্ধু বলে তোমাকে বুকে টানার বৈধতা পাবে ?
শিশুর সবুজ স্বপ্নিল জগতে ‘ঘৃণা’ নামের পুতিগন্ধময় কোনো শব্দ বা প্রতিশব্দ কিংবা বোধের অনুপ্রবেশ ঘটেনি কোথাও কোন কালে। শিশুকে দেবদূত বলে তাই। ভালোবাসা নামের শুভ্র পাখিদের অবিরল কাকলি-মুখর শিশুর বর্ণিল ঘর। যেদিন শিশুরা ঠিক ঠিক বেড়ে না ওঠে আমার মতো অনুচিত বড় হয়ে যায়, ভালোবাসা নামের অপাঙক্তেয় পরিশব্দের ন্যুনতম ছোঁয়া কিংবা আবেশ থেকে দূরে বহুদূরে দাঁড়িয়ে গা থেকে ঝেঁড়ে ফেলে মানবিক শেষ চিহ্ণটাও, বড়’রা সেদিনই শিশু-হন্তারক হয়। শিশু-হন্তারক মানেই পিতৃ-মাতৃ হন্তারক। শিশু-হন্তারক মানে ভ্রাতা-ভগ্নি হন্তারক। শিশু-হন্তারক মানে সবকিছুই হন্তারক। তবু শিশু-হন্তারক মানে সন্তান-হন্তারক নয়; কারণ তাদের কোন সন্তান থাকে না। পাশবিক যৌনক্রিড়ায় অভ্যস্ত ওরা জানে না কিভাবে সন্তানের জন্ম দিতে হয়। সন্তান-বাৎসল্যে বঞ্চিত ওরা কখনোই পিতা হতে পারে না।
তাই প্রিয় রাসেল, যেদিন ওরা, মানে সেই বড়’রা, আমাদের পিতা-মাতা-ভাই-বোন-পরিজনকে হত্যা করে শেষবার তোমার দিকে অশ্লীল তাক করেছিলো বর্বর মারণাস্ত্র, সত্যিকারের শিশুই ছিলে তুমি। তোমার ভালোবাসার উদ্বেল কষ্টের কান্নায় একটা লোমও নড়েনি তাদের। আমি স্পষ্ট কল্পনায় দেখতে পাই আজো- শিশুর অপার বিশ্বাস নিয়ে অসম্ভব প্রিয় যে বইটাকে ছোট্ট বুকের বিশ্বস্ত ঢাল বানিয়ে নিরব সংলাপে তুমি অবিচল দাঁড়িয়ে ছিলে, সেই বইটার নাম ছিলো ঝলমলে অক্ষরের প্রচ্ছদে স্পষ্ট বাংলায় আঁকা- ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’।
শেষপর্যন্ত তুমি এক অক্ষয় শিশুর উজ্জ্বলতায় আঁকা হয়ে আমাকে নিরঙ্কুশ বৈধতাহীন বড় হবার অন্ধকার গহ্বরে নিপতিত করে গেলে।
প্রিয় রাসেল, নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম জাজ্জ্বল্যমান আলামত হয়ে মহামান্য আদালতে প্রদর্শিত হলো ‘বত্রিশ নম্বরে’ রাখা তোমার সেই বুলেটবিদ্ধ বইখানা- ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। ইতিহাসের দণ্ড থেকে জানি রেহাই পায় না কেউ। কিন্তু যে অবাধ্য বুলেট সব এফোঁড়-ওফোঁড় করে সগর্বে চলে গেলো মহাকালের অপসৃত পথে, সে কি আর একই পথে ফেরতযাত্রায় এসে সেই ক্ষত আর সবকিছু বুঁজে দেবে কখনো ? দিতে পারবে কি ?
আমাদের বড় হবার লজ্জাটা অপাপবিদ্ধ শিশুদের কাছে অপরাধ হয়েই রইলো...।
...(২০/১১/২০০৯)
...
[sachalayatan]
No comments:
Post a Comment