Wednesday, November 18, 2009

| এক টুকরো আয়না...!



| এক টুকরো আয়না...!
    রণদীপম বসু

...
(০১)
এক জীবনের ফালতু প্যাঁচাল শেষ করতেই মোটামুটি পাঁচশ’ বছরের কম হলে যে চলে না, মূর্খ-চিন্তায় এ আত্মোপলব্ধি যেদিন খোঁচাতে শুরু করলো সেদিন থেকে নিজেই নিজের এক অদ্ভুত ভিকটিম হয়ে বসে আছি। কী আশ্চর্য ! পঞ্চাশ-ষাট বছরের ছোট্ট একটা গড় জীবনের মশকারি কাঁধে নিয়ে ‘মুই কী হনুরে’ হয়ে ওঠা আমাদের আলগা ফুটানিগুলো কতো যে অসার বর্জ্য, ভাটির মাঝিরা বুঝে যান ঠিকই। এই দুঃখে কাঁদবো না কি জীবন নামের মারাত্মক কৌতুকের বিষয়বস্তু হয়ে নিজেকে নিয়ে নিজে নিজেই অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকবো, সে সিদ্ধান্তটাও নেয়া হলো না আজো। কী করেই বা নেবো ? স্বপ্ন দেখা শিখতে শিখতেই তো জীবন কাবার ! স্বপ্নকে ছুঁবো কখন ? তার আগেই তো বিশাল একটা ‘ডিম্ব’ ! মানে ফুস ! হাহ্ , এগুলোকে কেউ কেউ ভাবতে পারেন মন খারাপের কথা।



যাঁরা এটা ভাববেন, বুঝতে হবে তাঁরা আসলে সেই আয়নাটার খোঁজ পেতে যাচ্ছেন, যেখানে আমাদের অসহায় ‘আমি’টার আবছা একটা প্রতিকৃতি দেখলেও দেখতে পারেন। তার অর্থ এই নয় যে, আয়নাটা হাতে পেয়ে গেছি আমরা। বরং তার অর্থ এই যে, ওই আয়নাটার খোঁজে আমাদের কিছুটা সময় ব্যয়িত হবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। আর এই সম্ভাবনাগুলোই আমাদেরকে কখনো দর্শনের কাছে, কখনো কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনে। আর কবিতা তো দর্শনই। তাই বলতে পারি আমাদেরকে মূলত কবিতার কাছেই ফিরিয়ে আনে। ভাঙা আয়নার মতো টুকরো টুকরো সেই শব্দছেঁড়া কবিতারা।

(০২)
মোটামুটি সবাই, প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও আয়নার সামনে দাঁড়াই আমরা। আর আয়নার সামনে দাঁড়ানো ঠিক ওই সময়টুকুই আসলে আমাদের নিজস্ব সময়, যখন কিনা নিজেই নিজের মুখোমুখি হই। কেবল ওই সময়টুকুতেই আমরা নিজেকে খুটিয়ে দেখি। নীরব প্রশ্নে মুখরিত হই, ক্ষতবিক্ষত হই, আলোড়িত হই, হতাশাক্রান্ত হই কিংবা উজ্জীবিত হই। যখন বলি আয়না দেখি, আসলে কি আয়না দেখি আমরা ? না। নিজেকেই দেখি। মানুষের শ্রেষ্ঠতম কৌতুহল নিজেকে দেখায়। খুব সুন্দর করে ছবি উঠিয়ে আমরা তো ছবি দেখি না, নিজেকেই দেখি। মুখ ফসকে বলি যখন- ইশ্ , কপালটা কেমোন বড় দেখাচ্ছে, আসলে কপাল দেখি না, দেখি কপালের ত্রুটিটা। অর্থাৎ নিজের অপূর্ণতাকেই খুঁজতে পছন্দ করি আমরা। নিজের অসংলগ্নতাকে খুঁজে বের করি, নিজের কল্পনা বা স্বপ্নকে খুঁজে সেই স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে তুলনা করে নিজের ঘাটতিগুলোকে চিহ্ণিত করতে উঠেপড়ে লাগি।

আয়নার সামনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষই একেকজন দার্শনিক। নিজের প্রতি কৌতুহল মানেই জীবন ও জগতের প্রতি কৌতুহল। তবে এই প্রচ্ছন্ন সম্পর্কের জটটাকে কেউ সচেতনভাবে খেয়াল করি না বলেই আমাদের দার্শনিক সত্ত্বাটি সম্পর্কে অসচেতনভাবে অজ্ঞ থেকে যাই আমরা। এতে সচেতনতা না থাকতে পারে, তাতে দার্শনিক সত্ত্বায় কোন হেরফের হয় না। আয়নার সামনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষ তাই কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও দার্শনিক হয়ে ওঠে। যেখানে কোন তত্ত্ব থাকে না, তালাশ থাকে; সরব কণ্ঠ থাকে না, থাকে উৎকণ্ঠা; গ্রীবার সামান্য তিলটার পরিবর্তন দেখেও হযতো উদগ্রীব হয়ে উঠি, কারণ চোখের সামনে প্রতিদিনের চেনা চেহারাটাকেই সবচাইতে অচেনা হয়ে উঠতে দেখি আমরা। আমাদের অভ্যস্ততার মধ্যে থেকেও এই যে আশ্চর্য হওয়ার অনভ্যস্ততা, এটাই দার্শনিকতা। আর তাই আয়নায় নিজেকে দেখার আগের ও পরের মানুষটা আশ্চর্যরকম ভিন্ন হয়ে যায়, অর্থাৎ বদলে যায়। বদলে যাবার প্রবহমান স্রোত থেকে নিজেকে কখনোই উদ্ধার করতে পারি না আমরা। কেবল চমকে উঠি। তাহলে জীবন মানেই কি অসংখ্য চমকের সমষ্টিমাত্র !

(০৩)
যিনি কবিতায় অবগাহন করেন বা কবিতায় ফিরে আসেন, তিনি এই চমকগুলোকেই আবিষ্কার করতে থাকেন। কবিতা বলতে ছন্দবদ্ধ বা সুনির্দিষ্ট কোন প্রকরণকে বোঝাচ্ছি না। এটা গল্পে হতে পারে, উপন্যাসে হতে পারে, গদ্যে হতে পারে, বা অন্য যে কোন শিল্পমাধ্যমেই হতে পারে। মোট কথা যেখানে কবিতা থাকে না বা কাব্যময়তা থাকে না, সেই শিল্প আসলে শিল্পই হয়ে উঠে না। আর যা শিল্প হয়ে উঠতে ব্যর্থ, তা আসলে কোন উপলব্ধিই তৈরি করতে পারে না। কেউ হয়তো আবার এই উপলব্ধি নামের শব্দ বা বোধটুকুর আপেক্ষিক অবস্থা বা এর সুলুকসন্ধান  নিয়েও বিশাল এক আলোচনাযজ্ঞের সূত্রপাত ঘটাতে পারেন। কেননা এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনার যথেষ্ট সুযোগ ও ক্ষেত্র রয়ে গেছে। তবে আমি সে দিকে না গিয়ে খুব মোটা দাগে এককথায় উপলব্ধি বলতে বোঝাচ্ছি ভালোলাগার তৃপ্তিকর সেই মিষ্টি অনুভূতির কথা। যেভাবে প্রেয়সীর ঢেউমাখানো চোখের নদীটা যখন কবিতা হয়ে উঠে, চোখের ভাষার অন্তর্গত কোন বাস্তব ও প্রকৃত অর্থ না খুঁজেও আমরা ভালোলাগায় আপ্লুত হতে পারি।

কবিতায় যিনি অর্থ খুঁজেন তিনি কবিতা বুঝেন কিনা জানি না, তবে কবিতা যে তাঁকে কিছু দিতে পারে না সে ব্যর্থতা কবিতার নয়। অনেককেই বলতে শুনি- আমি কবিতা বুঝি না। তিনি কতটুকু কবিতা বোঝেন সে প্রশ্নে না গিয়েও এটা বলা যায় যে- কবিতা যে বোঝার জিনিস না, এটাই তিনি বোঝেন না। সৌন্দর্য যেমন বোঝার জিনিস নয়, উপলব্ধির জিনিস, কবিতাও তাই। মোহনীয় সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সূর্যাস্ত কী, কিভাবে সূর্যাস্ত ঘটে, তাতে প্রকৃতিতে কী কী পরিবর্তন ঘটে, এর সাথে পৃথিবীর আহ্ণিক গতি বার্ষিক গতির কী সম্পর্ক, তাপদাহ না হতে সূর্যাস্তের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কতটুকু দীর্ঘ হওয়া উচিৎ, বাতাসে কতটুকু আর্দ্রতা থাকা সফল সূর্যাস্তের জন্য জরুরি, এসব গবেষণা-অভিসন্দর্ভ তৈরি করে যদি সূর্যাস্ত উপভোগ করতে হয়, তাহলে তো কম্ম সারা ! আরেকটা পণ্ডিত-জীবনের আশা বুকে ধরে সূর্যাস্তবিহীনভাবেই মূর্খ-জীবনের অস্ত টানতে হবে বৈ কি।

(০৪)
চোখের আলোয় দেখার গভীরে মনের আলোয় যে দেখা, সেটাই হলো হৃদয় দিয়ে দেখা। এই হৃদয় দিয়ে দেখার চর্চার নামই হলো শিল্প-সাধনা। একটা উৎকৃষ্ট কবিতা পাঠের পরিপূর্ণ উপলব্ধিও একটা সফল শিল্প-সাধনা বলা যেতে পারে। মোটকথা শিল্পকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জনই হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসাধনা। এই সাধনায় উত্তীর্ণ না হলে কারো দ্বারা শিল্প সৃষ্টি আদৌ কি সম্ভব ? এজন্যেই কবি বলেন- ‘যে কবিতা শুনতে জানে না, সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে..।’ আমরা তো এই দাসত্ব থেকেই মুক্তি চাই ! কিন্তু কিভাবে ?

সমস্ত কর্ম-ব্যস্ততার শেষে আমরা আমাদের একটা ভালোলাগা কবিতা পাঠ করতে পারি। যদি সুরের আচ্ছন্নতায় আমরা বিভোর হয়ে যেতে পারি, কবিতাও পারে তার শব্দ আর অক্ষরের মন্ত্রস্বরে আমাদেরকে আবিষ্ট করতে। কোন অর্থ না বুঝেও শুধু হৃদয়কাঁড়া সুরের মুর্চ্ছনায যদি অনায়াসে ডুবে যেতে পারি আমরা, কোন অর্থ না খুঁজে কবিতার স্বচ্ছ টলটলে স্রোতস্বী ঝর্ণায়ও সাঁতার দিতে পারি নির্বিঘ্নে। কারণ ‘প্রবহমান নদী যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে..।

আমাদের প্রতিদিনের অভ্যস্ততায় অন্তত একটা ভালোলাগা কবিতা কি সত্যিই পাঠ করতে পারি না আমরা ? একদিন এই পাঠ থেকেই হয়তো বেরিয়ে আসবে হৃদয়-ছন্দের নিপুণ উপলব্ধির মুগ্ধ বিস্ময়টুকু। এবং এভাবেই হয়তো একদিন অন্য এক জাদুকরি আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠবো অন্য এক আমি’র একাত্মতায়। আসুন না ততদিন না হয় আমরা সেই আয়নাটাকে খুঁজতে থাকি।

(০৫)
আমার যা বলার, এতক্ষণে তা হয়তো বলে ফেলেছি। তবে তা কতটা সফল ও স্বার্থকভাবে বলতে পারলাম সেটাই প্রশ্ন। হতে পারে আমি যা বলতে চেয়েছি তা আদৌ বলতে পারিনি, এবং এটাই খুব স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সব কথাই বিফল প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে গেলো। শুধু এটুকুই বুঝা গেলো যে, কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম আমি, যা আমার নিজস্ব মূর্খতায় গুলিয়ে ফেলেছি। অর্থাৎ বলতে পারলাম না।

আবার এও হতে পারে যে, যা বলার চেয়েছি তা বলতে পেরেছি। কিন্তু তা অসম্ভব। নিজস্ব সীমাবদ্ধতাগুলো গোনার বাইরে রাখলেও শিল্পের ব্যাখ্যা এতো সরল-সাপ্টা নয় যে উপলব্ধিকে ডিঙিয়ে তা বোঝার সামর্থের মধ্যে এতো সহজে চলে এলো। তাহলে কি শিল্প তার উচ্চমার্গতা হারায় না ? কিন্তু ব্যাখ্যাকারীর ঊনমার্গ-ব্যর্থতায় শিল্প তার অবস্থান থেকে নামবে কেন ? শিল্প তো আসলে নামে না, উপলব্ধিকে বোঝার সীমিত সামর্থের স্তরে নামিয়ে আনতে গিয়ে আমরাই নিজ নিজ বালখিল্যতার বৃত্তটাকে চিহ্ণিত করে ফেলি কেবল। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও শেষপর্যন্ত কিছু বলা বা বোঝানো হয় না। ফলাফল ? সেই ডিম্ব..! তখন থুক্কু দিয়ে ফের শুরু করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে কি ?

কিন্তু ভুতের মতো পেছনপায়ে না হেঁটে আমরা আরেকটা কাজও করতে পারি। বহুল চর্চিত কোন একটা সহজ ও প্রকৃত কবিতা বাছাই করে সেটাকে নিয়ে ইচ্ছেখুশি কিছুক্ষণ কচলাতে পারি। যিনি কবিতা বুঝতে আগ্রহী তিনি বোঝার প্যাঁচ কষতে থাকুন। আর যিনি এতসব বোঝাবুঝির টানা-হেঁচড়ায় না গিয়ে কেবল মোহময় ভালোলাগার উপলব্ধি-ধাঁধাঁয় ঘোরপাক খেতে চান, তিনি না হয় ঘোরের মধ্যেই থাকুন। এই ফাঁকে আমিও সটকে পড়ি। ধরা যাক আজকের কবিতাটা হলো-
...
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে- আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে !
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হ’য়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস;
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।

[আকাশলীনা / জীবনানন্দ দাশ]
...
[sachalayatan]
...

No comments: