Saturday, November 28, 2009

অদৃশ্য বাতিঘর-০৮ (কবিতাগুচ্ছ)



অদৃশ্য বাতিঘর-০৮ (কবিতাগুচ্ছ)
- রণদীপম বসু

...
স্বপ্নের কাছে সমর্পিত
...
(তরিকুল ইসলাম দুলাল বন্ধুবরেষু)

স্বপ্নের কাছে সমর্পিত হবো দ্বিধাহীন-
         খুব বেশি আকাঙ্ক্ষা তো নয়
তবু নিজ নিজ বৃত্তের মাঝে বহমান মানুষেরা আজ
একান্ত স্বাধীন নয় আর
হুট করে হানা দেয় বিরোধী আপন ছায়া
বিষাক্ত আঁচড় কাটে স্বপ্নবান চোখে।
কী করে সরাই তাকে ?

আদিম অরণ্যে একা নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
নদীর দু’হাত ছুঁয়ে নির্জন সংলাপ কিছু-
           বড় কোন চাওয়া তো নয়
তবু কে যেনো সামনে দাঁড়ায় পাহাড়ের মতো
কী যেনো লঙ্ঘন দোষে তাড়া দেয় খুব
ফিরে আসি বৈরী বৃত্তেই ফের।

প্রথম বৃষ্টির ছোঁয়ায় সবুজ যে বৃক্ষশিশু,
বিস্ময়ের চোখ মেলে চিনে নেয় প্রথম আকাশ
ওটা তো ঠিকানা নয় তার-
তবু সন্ধানী শিকড়ে খুঁজে হয়তো বা পেয়ে যায় একদিন।
আমি তো বৃক্ষও নই- কে দেবে খুঁজে ঠিক
           নিজস্ব ঠিকানা আমার ?
বৃত্ত থেকে বৃত্তে ফের নিজেকে সমর্পণ কেবল।

আপন ছায়ারা বৈরী যার, বুঝি সেইসব মানুষেরা
একে একে হয়ে যায় স্বপ্নচারী ভীষণ
এবং
হয়তো বা স্বপ্নচারী মানুষেরাই
চিরকার রয়ে যায় ঠিকানা বিহীন...।
...
(১২/০৩/২০০৩)


মানুষের এপিটাফ
...
যদি পৃথিবীর সবগুলো ফুটন্ত গোলাপ
এবং ফুটবে বলে গোপন স্পন্দনে স্পন্দিত ছিল যারা
নীরব হুঙ্কারে অকস্মাৎ গর্জে উঠে মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ায়
কেউ কি জবাব দেবে
মানুষের মানচিত্র কতোটা শোভন আজ
         প্রশ্নবিদ্ধ প্রকৃতির চোখে ?

অথবা পশু আর মানুষের মধ্যবর্তী ব্যবধানে
এতকাল দাঁড়ানো বৃক্ষেরা সব
যদি আত্মঘাতী প্রতিবাদে হয়ে উঠে উন্মুখ চঞ্চল
সভ্যতার বিস্ময়স্রষ্টা মানুষের বর্ণমালা
        হবে কতোটা নিরাপদ অহঙ্কারী আর ?

প্রপিতামহের প্রাচীন মানচিত্র ছুঁয়ে
বারুদ ঝলসানো মুখে শিশুর নিস্পন্দ চোখ
সে-তো মানুষের এপিটাফ শুধুই- ক্রমশই ধ্বসে যায়-
লিখে যায় ইতিহাস হয়তোবা অন্য কোনো বিবর্ণ ভাষায়...
...
(১৬/০৪/২০০৩)

শোকার্ত
...
আমায় ফিরিয়ে নাও
তোমার ক্রান্তিহীন জঠরে হে গর্ভধারিণী
তোমার পবিত্র-স্তনে
আমার এ তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ভেজাবার আগেই
যেন জন্মমাত্র শোকার্ত আমি
নবজাত কান্নার বদলে মুক্ত-প্রাণে
         গাইতে পারি-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি...!
...
(১৯৮২)

ফিরে যাবো আমি সেই
...
ফিরে যাবো আমি ফের পুরনো জীবনে সেই
রয়ে যাবে যা কিছু অর্জন
আর বিসর্জন সবই-
মুছে যাবে এই নাম পুরনো নামের ভীড়ে
যারা আজ শ্যাওলা-পিচ্ছিল হয়ে গোপন ব্যথার মতোন
শুধুই অতীত কিছু।

কিছু গান রয়ে যাবে সুরের স্বভাবী হয়ে
কিছু ভুল থেকে যাবে কালের গাণ্ডীব হয়ে
কিছু রাত গলে যাবে কিছু সুর ছিঁড়ে যাবে
কিছু কথা মরে যাবে
কিছু ঋণ শোধ হবে অনন্তের অম্লান দেনায় ধুয়ে;
তারপর একদিন নিবিড় জ্যোৎস্নায় গলে
চিড়ল গাছের ফাঁকে উঁকি দেবো ঠিক
ছুঁয়ে যাবো দশদিক অপার মোহে- তবু
আমাকে পাবে না কেউ...।
ফিরে তো যাবোই আমি
খেলাচ্ছলে একদিন এসেছি এখানে এই
অতঃপর ফিরে যেতে পুরনো জীবনে আবার।
...
(২১/১২/২০০২)

পাতার বাঁশি
...
পাতার বাঁশি বাজছে দূরে- ঐ সুদূরে
হাসছে নাকি কাঁদছে সে সুর
পুবাল হাওয়া বইছে বুঝি
বন-কৈশোরের গন্ধ ভাসে।

ধলপুকুরের চড়ুইভাতি কোজাগরির পিঠেপুলি
গুলতি-মাখা পাখির ছানা বেতস-দানা আসছে ভেসে
ঐতো শুনি পাঠশালার ঐ ঘণ্টা বাজে
বালক-বেলার কলধ্বনি দিক কাঁপিয়ে খেমটা নাচে
তুলসী-তলার উলধ্বনি সাঁঝের দাওয়ায় বর্ণপুঁথি
ঢুলু-ঢুলু চোখের কোণে ঝাপসা বাজে
রাত-দুপুরে বাঁশের ঝাড়ে হুড়োহুড়ি বসলো বুঝি পেত্নি-বুড়ি
নকশি-কাঁথার ওমের তলে গুটি-শুটি-
              সবকিছুরই গন্ধ ভাসে
পুবাল হাওয়া ঐ সুদূরে ডাকছে কাকে
বালক-বেলা আসছে ফিরে সায়াহ্ণের এই ধল-প্রহরে ?

এখোন আমি ফিরবো কিংবা যাবো কোথায়
পাতার বাঁশি বাজছে দূরে- ঐ সুদূরে
বালক-বেলার গন্ধ-বুকে
              হাসছে নাকি কাঁদছে সে সুর
এই অবেলায় রূপকথার ওই পঙক্তি ছেড়ে

পাতার বাঁশি বাজছে দূরে- ঐ সুদূরে...।
...
(২২/১২/২০০২)

No comments: