| বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও আমাদের অভিশপ্ত শিশুরা |
রণদীপম বসু
...
‘বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান’। সাতসকালে পত্রিকাগুলোর হেডলাইন দেখেই চমকে উঠলাম ! মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিনশিন ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো নিচের দিকে। নিজের জন্য নয়, আমাদের সন্তানদের ভবিতব্য চিন্তা করে। সেই উনিশশো একাত্তরেও নাকি এভাবে একবার বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বিশ্বের কিছু মানবহিতৈষী ব্যক্তি। সেটা যে কতোবড়ো দুঃসহ কাল ছিলো এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের কেউ তা কখনো বুঝবে না। বুঝার কথাও নয়। শৈশবের ধবধবে বুকে অতশত না বুঝেও সেই দুঃসহ স্মৃতি আর মা-ভাই-বোন হারানোর দগদগে ক্ষত নিয়ে আজো চলছি ঠিকই। তবু আগ্রাসী চিতার মতো দাউ দাউ জ্বলছে এখনো সেই ক্ষত। ওটা যে কোন রূপকথা ছিলো না, ছিলো বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন, সেটা এখনো বুঝাতে হয আমাদের বাঙালি প্রজন্মকে, দুর্ভাগ্যের এই কলঙ্ক-তিলক হয়তো আমাদের প্রাপ্যই ছিলো। কারণ মীর জাফর আলী খান বাঙালির পূর্বপুরুষ না হলেও আমাদের রক্তের আত্মীয় হয়ে গেছেন অনেক আগেই। আর তাই হযতো সেরকম সাদৃশ্যপূর্ণ একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সংবাদ পত্রিকায় দেখে এভাবে আঁতকে উঠা ! কিন্তু খবরটা তো আঁতকে উঠার মতোই।
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের বেলা সেন্টারে শুরু হওয়া জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনেই জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) সভাপতি রাজেন্দ্র কুমার পাচুরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশ। বিশ্বে এতগুলো দেশের মধ্যে এভাবে সবচাইতে বিলুপ্তি-ঝুঁকির দেশ হিসেবে ঠাশ করে বাংলাদেশের নাম উঠে আসা, তা কি আঁতকে উঠার মতো নয় ! ডিসেম্বর ৭ তারিখ সোমবার ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী লারস লোক্কে রাসমুসেন-এর উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ১২ দিন ব্যাপী এই সম্মেলন শেষ হবে ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে।
বেশ ক’বছর আগে থেকেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মারাত্মক প্রভাব গোটা বিশ্বজুড়ে যে সম্ভাব্য বিপর্যয় ডেকে আনবে তা নিয়ে হৈচৈ চলছে। প্রায় ১৭ বছর ধরে। তবে এসব হৈচৈ বেশিরভাগই অনুন্নত গরীব রাষ্ট্রগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ২০১৫ সালের মধ্যে আমাদের দেশের ২৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে বা ২০৩০ সালে গোটা দেশটাই তলিয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা ইত্যকার নানান কথার উড়াউড়ি খুব জোরেসোরেই শোনা যাচ্ছিল একটা সময়। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এইসব ককটেল বোধ আমাদের উপলব্ধিতে হযতো খুব একটা গেড়ে বসেনি কখনো। কিন্তু বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনুন্নত দ্বীপরাষ্ট্রগুলো যাদের অবস্থান সমুদ্র সমতলের প্রায় কাছাকাছি, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দেয়া এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো চিহ্ণিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন অনেকেই। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এর পেছনে যেসব কারণকে চিহ্ণিত করেছিলেন তার মধ্যে সর্বপ্রধানটি হলো- বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে ফুটো হয়ে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির সরাসরি ভূমণ্ডলে আছড়ে পড়া এবং এর ফলে গ্রীন হাউস ইফেক্টের মাধ্যমে উত্তরোত্তর উষ্ণ হয়ে ওঠা ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়া। যার পরিপ্রেক্ষিতে এন্টার্কটিকা অঞ্চলের বিশাল বিশাল বরফের চাই বা হিমবাহগুলো দ্রুত গলে সমুদ্রপৃষ্টের লেভেল দ্রুত বৃদ্ধি করে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে দেবে।
কিন্তু অনিবার্য এই সম্ভাবনার কাজটি প্রকৃতি নিজে থেকে করেনি। মানুষই এর উদ্গাতা। ওজোন স্তর ক্ষয় করে দেবার মতো ভয়ঙ্কর সেই কাচামালটি আর কিছু নয়, সিএফসি বা কোরো-ফোরো-কার্বন। যাকে গ্রীন হাউস গ্যাস নামেই ডাকা হয়। অথচ ক্ষতিকর এই কার্বন নিঃসরণকারী গ্যাসটিই হলো মানব সভ্যতার অন্যতম বাইপ্রোডাক্ট। সভ্যমানুষের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন-যাপনের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হিসেবে যাবতীয় বিলাস-ব্যসন-যন্ত্র-সামগ্রি উৎপাদনে এই বাই-প্রোডাক্টটি নিঃসরণ হবেই। বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ মানুষকে আড়ম্বর দিলেও সাথে করে নিয়ে এলো অস্তিত্ব বিলোপকারী এক আতঙ্কজনক সম্ভাবনাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই আড়ম্বরটুকু ভোগ করে বিশ্বের ধনী দেশগুলো যাদের সহসা তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই, আর অস্তিত্বের বিনিময়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোকে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে খুব অনুকূল অবস্থায় থেকে যাওয়ার কারণেই হযতো ধনী দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের কানে গরীব দেশ ও দেশের মানুষগুলোর গত দেড়যুগের এত চিৎকার হাহাকার কখনোই পৌঁছায়নি বা খুব একটা গা করেনি এরা। তাই বলতেই হয়, আসলে প্রকৃতি নয়, পৃথিবীতে মানুষই যে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু, সেটাই বারেবারে প্রমাণ হয়ে এসেছে।
মাথা যার ব্যথাও তার। এই জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনকে সামনে রেখে নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হিমালয় দুহিতা নেপাল কদিন আগে মন্ত্রীপরিষদের প্রতীকী বৈঠকটি সম্পন্ন করেছে (০৩-১২-২০০৯) হিমালয় চূড়ার এক অস্বাভাবিক হিমেল আবহে। আর জলবায়ুর এ পরিবর্তন অক্ষুণ্ন থাকলে অচিরেই সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবার অনিবার্য হুমকি মাথায় নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তাদের কেবিনেটের প্রতীকী বৈঠকটি করলো (১৭-১০-২০০৯) সমুদ্রের তলে বিশেষ ব্যবস্থায়। বিশ্বনেতৃত্ব এখনও কার্যকর সচেতন হয়ে না উঠলে আগামী পৃথিবীর সম্ভাব্য প্রতিচ্ছবি কী হতে পারে তা-ই বিশ্ববাসীকে দেখানোর চেষ্টা করেছে এরা। এগুলো বিশ্বনেতাদের কতটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে বা পারবে তা সময়ই বলে দেবে।
তবু এটা আজ আমাদের অস্তিত্বের দাবি, আমাদের সন্তানদের কোন মাতৃভূমি থাকবে না, রাষ্ট্রীয় পরিচয় থাকবে না, এরকম ভবিতব্য নিয়ে কোন মানুষ কি আদৌ সুস্থ থাকতে পারে ? অন্যের বিলাসের প্রায়শ্চিত্ত কেন করবো আমরা ? এই প্রতিপাদ্য নিয়েই দেশে দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জেগে উঠেছে সচেতন জনগোষ্ঠি। বিশ্বজনমতের চাপেই কিনা কে জানে, এবার সেই ধনী দেশগুলোকে কিছুটা নমনীয়ই মনে হচ্ছে। কেননা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে, যেখানে বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বনাশা ছোবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে আমাদের নিম্নাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলোকে শুরুতেই জলে ডুবিয়ে মারলেও এর সুদীর্ঘ থাবা থেকে আসলে রক্ষা পাবে না কেউই। আর এজন্যেই বুঝি এবারের বিশাল আয়োজন এই প্রাকৃতিক বৈরিতাকে রুখবার জন্যে। যদিও দেরি হয়ে গেছে অনেক, তবু শুরু তো হলো, এটাই আশার কথা। সবাই আন্তরিক হলে, মনোভাবে কোন চাতুরি না থাকলে নিশ্চয়ই আমরা এ সম্মেলন থেকে ভালো কিছু আশা করতেই পারি।
এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বেশ জোরেশোরে সেই আশাবাদই উচ্চারিত হচ্ছে। উদ্বোধনী বক্তব্যে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বনেতারা যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁরা শুধু এখানে আলোচনার জন্য আসেননি। সমাধানের পথও বের করতে চান। আমাদের বিভাজনের পথ থেকে সরে এসে একত্র হতে হবে। যে মাত্রার কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে, সেই ধারার পরিবর্তন এনে কার্বনের পরিমাণ কমাতে হবে।’
তিনি সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেন, ‘আগামী প্রজন্মকে রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখতে বিশ্ববাসী কোপেনহেগেনের দিকে তাকিয়ে আছে। আগামী দুই সপ্তাহের জন্য কোপেনহেগেন কোপেনহেগেনে (আশার আলো) পরিণত হবে। শেষ পর্যায়ে অধিকতর ভালো একটি ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আমরা অবশ্যই সেই বিশ্বে ফিরে যেতে সক্ষম হবো, যা আমাদের আজকে এখানে আসা নিশ্চিত করেছে।’
আইপিসিসি’র সভাপতি রাজেন্দ্র কুমার পাচুরি সাম্প্রতিক গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘জি-৮ রাষ্ট্রগুলোর নেতারা বলছেন বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ছে। ২০১৫ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ হবে। এতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ৪ মিটার বাড়বে। বিশ্বের বেশির ভাগ হিমবাহ গলে যাবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দ্বীপ ডুবে যাবে।’
তিনি সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেন, ‘আগামী প্রজন্মকে রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখতে বিশ্ববাসী কোপেনহেগেনের দিকে তাকিয়ে আছে। আগামী দুই সপ্তাহের জন্য কোপেনহেগেন কোপেনহেগেনে (আশার আলো) পরিণত হবে। শেষ পর্যায়ে অধিকতর ভালো একটি ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আমরা অবশ্যই সেই বিশ্বে ফিরে যেতে সক্ষম হবো, যা আমাদের আজকে এখানে আসা নিশ্চিত করেছে।’
আইপিসিসি’র সভাপতি রাজেন্দ্র কুমার পাচুরি সাম্প্রতিক গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘জি-৮ রাষ্ট্রগুলোর নেতারা বলছেন বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ছে। ২০১৫ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ হবে। এতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ৪ মিটার বাড়বে। বিশ্বের বেশির ভাগ হিমবাহ গলে যাবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দ্বীপ ডুবে যাবে।’
এরকম ভয়াবহ গবেষণা রিপোর্টের কারণেই কিনা সম্মেলনে জমায়েতও নেহায়েত কম নয়। ১৯২ টি দেশের ১১০ জন রাষ্ট্রনেতা ও প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধি বিশ্বকে বাঁচানোর প্রত্যয়ে এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। সম্মেলনে কার্বনঘটিত গ্যাস (গ্রিন হাউস গ্যাস) নিঃসরণ কমানোর নির্ভরযোগ্য উপায় এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার ও তহবিল গঠন সংক্রান্ত আলোচনা এবারে প্রাধান্য পাবার কথা। আশা করা হচ্ছে যোগদানকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সমন্বয়ে এ সম্মেলন থেকেই যুগান্তকারী কোপেনহেগেন প্রটোকল প্রণীত হবে। যদিও ইতিপূর্বে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই কিয়োটো প্রটোকলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে, চীন-ভারত-ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো উন্নয়নের দোহাই তুলে কিয়োটো প্রটোকল এড়িয়ে চলার নানা ফন্দি-ফিকির খুঁজেছে, সেই কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হবে ২০১২ সালে। এরপরই শুরু হবে নতুন প্রটোকলের বাস্তবায়ন। ১৯৯৭ সালে বিশ্ব জলবায়ু বিষয়ক জাপানের কিয়োটো সম্মেলনে শুধু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরিবেশমন্ত্রীরাই যোগ দিয়েছিলেন, এবার এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরাও। এসব আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া বিশ্বের বৃহত্তম এই জলবায়ু সম্মেলন ফলদায়ক হোক এটা বিশ্ববাসীর প্রাণের দাবী। এবার সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত নিজেরাই গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করায় এবং এসব দেশের নেতারা সম্মেলনে যোগ দেওয়ায় জলবায়ু চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছে বৈ কি। তাছাড়া ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে দক্ষিণ আফ্রিকাও কার্বন নির্গমন ২০২০ সালের মধ্যে ৩৪ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। মূলত এই সম্মেলনে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর ব্যয় ভাগাভাগি করা নিয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট দূর হওয়াও জরুরি বলে মনে করছেন সবাই।
জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনের দিকে বিশ্ববাসী কী পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তা বুঝা যায় প্রতিনিধি ছাড়াও সম্মেলনের কোন এক বৈঠকে ৩৪ হাজার লোকের অংশগ্রহণেচ্ছু আবেদনের তীব্রতা দেখে। সাড়ে ৩ হাজার সাংবাদিকও আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়। তাদের ভিড় ঠেকাতে নাকি শেষ পর্যন্ত নিবন্ধনই বন্ধ করে দেয়া হয়।
সৃষ্টিশীল প্রাণী হিসেবে মানুষ যেমন প্রকৃতিকে বশ করতে জানে, তেমনি অতিলোভের নির্বুদ্ধিতায় মানুষই নিজের অস্তিত্বকেও অনিশ্চিত অস্থির করে তুলতে পারে। হচ্ছেও তাই। অধিকতর অগ্রগামী জাতি ও রাষ্ট্রগুলোই হয়তো এ কাজে তাদের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার প্রমান রেখে যাচ্ছে। তাই বলে শুধু ধনী দেশগুলোকে দোষারোপ করেই কি নিজেদের পাপকেও ঢাকা যাবে ? নিজের ভালো নাকি পাগলেও বুঝতে পারে। কিন্তু অভিশপ্ত বাঙালি যে পাগলের যোগ্যতাও রাখে না, সেটা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। আমাদের নিজেদের দিকে তাকালে কি মনে হয় যে আমরা সম্পূর্ণ মানুষ হতে পেরেছি ? আমাদের বনদস্যুতায় সবুজ বনভূমি দিনকে দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে, লোকালয় পেরোলেই দেখা যায় মাইলের পর মাইল জুড়ে ইটভাটার চিমনি গলে বৃক্ষপোড়া কালো ধোঁয়া, আমাদের দুর্ভাগা নদীগুলো বাঙালির সমস্ত বালখিল্যতা কাঁধে নিয়ে চলিষ্ণুতা হারিয়ে গ্রাস হয়ে যাচ্ছে মানুষ নামের কিছু নদীখেকো দস্যুর কাছে। লোকালয় জুড়ে কতোশতো ফ্যাক্টরির গনগনে চিমনি বিষিয়ে দিচ্ছে শিশুদের অনিবার্য বাতাস, কেড়ে নিচ্ছে স্বপ্নদূত পাখির নিরাপদ আকাশ। দুচোখ যে দিকে যায় ফসলহীন ধুধু পোড়া মাটি, দুর্বৃত্তের মতো নতুন নতুন ঘরবাড়ি, ধেয়ে আসা বালু ঝড়ে উলটপালট করে দেয়া উষর লোকালয়ে পানির হাহাকার। অথচ অন্যদিকে দেখি হতভাগা কপোতাক্ষের নির্জীব শরীর এসে উঠে গেছে লোকালয়ে, শত শত গ্রাম অস্বাভাবিক ডুবে আছে বছর জুড়ে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বসতের যোগ্য ভূমি আর জীব-বৈচিত্র্যের অনিবার্য শৃঙ্খল। এসব কিসের আলামত ? প্রকৃতিকে দায়ি করে লাভ নেই। প্রকৃতির পাছায় গুঁতো দিতে দিতে আমরা অস্থির করে তুলেছি তাকে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান হলেও আমরা আর প্রকৃতির সন্তান থাকতে পারিনি আমাদেরই আত্মঘাতি লোভে। অতএব আমাদের এখনো হুশ না হলে প্রকৃতির প্রতিশোধ এড়াবো কী করে !
স্বার্থপর মানুষ যতকাল ভাববে পৃথিবীটা নিজেদের, ততকালই পৃথিবীটা থেকে যাবে অনিবার্য ঝুঁকির হুমকিতে। যেদিন এই মানুষগুলো সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে, ভাববে এই পৃথিবীটা আমাদের নয়, আমাদের আগামী প্রজন্মের, আমাদের শিশুদের, সেদিনই পৃথিবী হতে পারে নির্মল, ঝুঁকিমুক্ত। পশুরাও সন্তান-বাৎসল্যে টইটম্বুর হয়ে উঠে। আর আমরা মানুষরা কি পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট কোন প্রাণী হয়ে যাবো তাহলে ? এই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন আমাদেরকে হয়তো আবারো নতুন করে সেই ম্যাসেজটাই জানান দেবে- মানুষ আর পশুতে কতোটা বিভেদ থাকে, কতোটা সাদৃশ্য !
...(০৮-১২-২০০৯)
...
[sachalayatan]
...
No comments:
Post a Comment