Saturday, November 28, 2009

অদৃশ্য বাতিঘর-১০ (কবিতাগুচ্ছ)



অদৃশ্য বাতিঘর-১০ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু
...

বিষণ্ন লিরিক
...
(০১)
চুপে চুপে খুঁজে নাও কাঙ্ক্ষিত গোলাপ তোমার
বাহারি পাঁপড়ির ভিড়ে
নিসর্গে ভেজা এই স্বপ্নালু উদ্যানে জলে
দিলাম উন্মুক্ত করে তোমার প্রবেশ;
অবারিত ইচ্ছেকে শুধু
নির্বিশেষে কোরো না উন্মুক্ত যেনো
তবে নতমুখী হয়ে যাবে উন্মিলিত পুষ্পেরা সব।
নতমুখী গোলাপেরা কখনো বোঝে না মানুষের ভাষা।

(০২)
পই পই বলেছি তোমায়
মানুষের বিষণ্ন কষ্টের হ্রদে দিতে নেই
অবাধ উন্মুক্ত ঝাপ-
সন্তর্পণে নামতে হয় খুব,
উদ্বেল ঢেউয়ের তোড়ে যেনো না ভেঙে পড়ে
হৃদয়ের নরোম কিনার।
বোঝ নি নির্বোধ তুমি- তাই ক্ষমাহীন বিশ্বাসী জলে
ক্রমশই হয়ে গেছো অবাঞ্চিত আজ...।
...
(১৯৯৭)

নীলকমল ঘাট
...
(মেঘনাপাড়ের বন্ধু মোস্তফা কামাল-কে)

পাতালের অদ্ভুত অতল থেকে এই বুক হয়ে
উঠে আসে অচেনা শীৎকার এক-
কারা যেন তুলে নেয নোঙড়ের ফলায়
পৃথিবীর নরোম পাঁজর,
কলকল জ্যোৎস্নারা সরে যায় ধীরে খুব
সরে যায় ছুঁয়ে থাকা কোন এক নীলকমল ঘাট।
তারপর হুড়হাড় পাড় ভাঙার শব্দ কেবল।

সরে যায় একে একে বসতির চিহ্ণ বিপুল
জীবনের মেঘনার সুঠাম সীমান্ত জুড়ে
ঝেঁকে আসে কুয়াশার রতিময় বিভ্রান্ত শরীর,
কলকল কলকল মুছে যায় সব
যেনোবা ছিলো না কিছুই কখনো কোথাও-
সাইরেন শূন্যতা কাঁদে আর
বিস্তীর্ণ শূন্যতা ঘিরে এই বুকের গভীরে খুব
পাড় ভাঙার শব্দ কেবল-
ভেঙে যায় কোনো এক নীলকমল ঘাট...।
...
(১৯৯৮)

শিকড়
...
উদ্ভ্রান্ত অনয় স্রোতেই গিয়েছে শিকড় আমার;
মাটিকে আঁকড়ানোর অক্ষম যন্ত্রণায় এখোন
ক্রমাগত ডুবতে ডুবতে নিয়ত পালানো আর
উদ্বাস্তু পায়ের চিহ্ণে কেবলই কষ্টের ক্ষরণ।
শুশুক দৃষ্টিতে ভেজা যতো না সুলুক স্বপ্ন ছিলো,
জাগরিত পুষ্পচোখে খুঁজতো সে উদাত্ত আকাশ;
অনুক্ষণ ওখানে এখোন কতো যে গভীর হলো
অন্ধ ক্ষত এক- শিকড়বিহীন কষ্টের আবাস।

যদি সে ছিঁড়তে চাই চলমান অখণ্ড বিষাদ,
শিকড়ের টান বাজে গভীরে আমার; যাযাবর
মনে জাগে বৃক্ষেরই স্বর। অন্তর্লীন অবসাদ
মাটিকে জড়াতে চায়- নেই হায় আপন শিকড় !

শিকড়ের খোঁজে খোঁজে হারিয়েছি শিকড় আমার,
মৃত্তিকা টাটায় চোখ- ওপাশে দুস্তর পারাবার।
...
(০৬/০৫/১৯৯৬)

যুদ্ধে আর প্রেমে
...
তোমার অভিন্ন জমিনে এই
বারে বারে যুদ্ধ আসে বারে বারে প্রেম;
ভ্রূণে আর রক্তে মাখা আমি তো অন্ধ যোদ্ধা নই
অথবা বিভ্রান্ত যুগল,
তবু উন্মাতাল আবাহনে শিরা উপশিরা যতো
কেঁপে উঠে সংঘাতে প্রবল-
সংক্ষুব্ধ ঘূর্ণি হয়ে ছেনে যাই
তোমার অরণ্য ফসল।

অতিথি স্বপ্নেরা এসে আশার শোলক বোনে
রেখে যায় কতো না অঙ্কুর গাথা-
উত্থিত জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে যায় সব।
মুছে গেলে সব স্মৃতি সব দুঃখ সব কথা
তবুও যুদ্ধ আসে- আসে প্রেম
এবং স্বপ্নেরাও ফিরে আসে বারে বারে
স্বপ্নের কাছে।
...

তোমাদের জেগে থাকাই
...
(মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের প্রতি)

এরকম অসম্ভব ঘুমের ভেতর
যদি কাটিয়ে দেয়া যেতো হাজারটা বছর
এবং তারপর জেগে উঠে
বিস্তীর্ণ আকাশের মতোন অদ্ভুত স্বচ্ছতা মেখে
প্রতিটি মানুষের বুকে পড়া যেতো তাঁর
সুবর্ণ অতীত সব,
তবে তোমাদের ঘুমগুলো হোক না গভীর আরো-
সবটুকু শুদ্ধতা ঢেলে দেবো তাও।

কিন্তু এ জনপদ নিদ্রায় অসার আজ
জেগে নেই প্রহরায় কেউ,
এতো যে নিদ্রাহীন একদিন কাটিয়েছো
                      ঘুমের প্রহর জেগে
আর নিরাপদে ঘুমিয়েছে চরাচর-
ওগুলো কি অতীত শুধুই ?
আহত এ বদ্বীপ জুড়ে
নিদ্রাখোর মানুষের অন্ধ-মিছিলে আজো
ঘুমে আর নির্ঘুমে কোথায় প্রভেদ !

জেগে তো আছিই বেশ;
তবু কতোটা নিরাপদ হবে তোমাদের ঘুমেরা আর-
একপাল স্তন্যপায়ী জড়ত্বের কাছে !
বিবর্ণ সময়ঘাতে ক্রন্দসী মৃত্তিকা কাঁদে-
                       জেগে নেই কেউ।

তোমাদের জেগে থাকাই
বড়ো বেশি প্রয়োজন ছিলো এখানে এখোন।
...

No comments: