Thursday, April 8, 2010

| দুই-মেগাপিক্সেল | ক্ষুধা ও শিল্প…|


| দুই-মেগাপিক্সেল | ক্ষুধা ও শিল্প…|
-রণদীপম বসু

ছবিতে যে শিল্পকর্ম দেখা যাচ্ছে, এটা কোন পথ-শিল্প নয়। বা কোনো দিবস উদযাপনও নয়। ছন্নছাড়া মনের খেয়ালে কোন্ সুদূর মফস্বল থেকে রাজধানী শহরে চলে আসা এক ক্ষুধার্ত অসহায় শিল্পীর কষ্টের ক্ষরণ। ব্যক্তি ভিক্ষা চাইতে পারে, কিন্তু শিল্পীর হাত কি কখনো ভিক্ষুক হয় ? তবু ক্ষুধার কাছে ব্যক্তি আর শিল্পীসত্তা যখন একাকার হয়ে যায়, শিল্প বুঝি থমকেই যায়। আহা ক্ষুধা !



কী চমৎকার করে ফুল-লতা-পাতার আল্পনা আঁকা ! তার পাশেই শিল্পীত অক্ষরে উদ্ধৃত- ‘ছন্নছাড়া মন চলে এল রাজধানী শহরে’। শিল্পীর মন তো ছন্নছাড়াই হবে। কিন্তু এই অপরিচিত ইট-সিমেন্ট-রডের নির্মম নিরাবেগ শহর কি আর শিল্পী বুঝে, না বুঝতে চায় ! ছোট্ট একটা পোটলা নিয়ে ভবঘুরে লোকটি হয়তো বহু পথ হেঁটে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়েছে ফুটপাথেই। এই নতুন অপরিচিত নগরে কোথায় কার কাছে যাবে সে ! পৃথিবীর সব ক্ষুধার্ত মানুষের অভিব্যক্তি বুঝি একই হয়। হবে না কেন ! ক্ষুধা যে আন্তর্জাতিক ভাষা। তার কোন ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, অক্ষর নেই। কিন্তু তার প্রকাশ অচেনা নয় কোথাও। ভীষণ পরিচিত। অসহ্য আবেগ-কাতর।

ক্ষুধার কাছে শিল্পী কী আর অশিল্পী কী ! তবু শিল্পীসত্তাই বা ভিক্ষা চায় কী করে ! তাই ধুমায়িত চায়ের কাপ, গোল রুটি, থালায় ছড়ানো ভাত বা স্বচ্ছ গ্লাসে ভরা জল, অদ্ভুত জীবন্ত করে আঁকা এই ছবিগুলোর নিচেই লিখে দিয়েছে- ‘চা, রুটি, ভাত, জল খাবার জন্য পথ চলতে যদি কারও মন চায় তবে ১ টাকা ২ টাকা সমাধানও করতে পারেন, ক্ষুধার্ত হয়ে বসে আছি।’ ক্ষুধার কাছে শিল্পীর রঙ-তুলিও কতো অসহায় তা বুঝা যায়- ‘সে সব রং তুলি ধর্য্যের কাজ কর্মে আর মন বসে না’ জাতীয় অক্ষরোক্তিতে।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের মিরপুর-২ ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়ের সামনের রাজপথে ফুটপাথ ঘেষে একজন অসহায় শিল্পীর কাতরতা ফোটে ওঠেছে তাঁর অঙ্কিত শিল্পকর্ম সদৃশ এরকম উদ্ধৃতিগুলোতে-
`DONOT WIPE’ , ‘জীবন বড় কঠিন’, ‘কথা বলার মন মানসিকতা আর নাই’, ‘কেবা এই সমাধান করবে, সব মানুষের ঘরে ঘরে সমস্যার আগুন এখনও জ্বলছে’ ইত্যাদি।


ব্যস্ত নগরীর প্রতিদিনকার হাজারো ঘটনার মধ্যে এরকম ভিন্ন আঙ্গিকের একটা বিষয় সাধারণ পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ এক-দু টাকা রেখেও যাচ্ছেন। যদিও সংখ্যায় খুবই কম। তবে অহেতুক জটলাটাই বড় হয়ে যায় শেষে। ক্ষুধার কাছে শিল্পী পরাজিত হলেও তার আত্মাভিমান এখনো দমে যায়নি। তাই হয়তো ক্ষুধার্ত মৌন শিল্পী লিখে দিলেন এক কোণায়- ‘দেখা হলে ভীড় ছেড়ে চলে যান’
আবার জীবন ও জগত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কিছু স্কুল-ফেরৎ ছাত্রের অবাক বিস্ময়ও হয়তো চোখ এড়ায়নি তাঁর। সেজন্যেই হয়তো নিরাভরণ কষ্ট ফুটে ওঠেছে এভাবে- ‘পেটের ক্ষুধা তাই তোমাদের কাছে ক্ষণিকের পরিচয়’।

ইতোমধ্যেই হয়তো অসংখ্য ব্যক্তিগত প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে তাঁকে। নইলে কেন লেখা থাকবে- ‘পাকা.. বাড়ি ছিল, মোড়ল গঞ্জ বিশাল নদীর কুলে, জেলা বাগের হাট, বসত বাড়ি সহায় সম্পত্তি তাও সব চলে গেছে নদীর জলে’। বুঝা গেলো নদীভাঙা মানুষ তিনি। এককালে সবই ছিলো, আজ সর্বস্বান্ত। নদীমাতৃক এই দেশের কোন দুর্ভাগা জনপদের আরেক ট্র্র্যাজিক ইতিহাস উন্মোচিত হয়ে যায় আমাদের সামনে। কিন্তু শুধুই কি তাই ? ‘জগতের সব মানুষ সমান না, সব মানুষও মানুষ না, আজও মানসিক জ্বালা যন্ত্রণা ফুরায় না’, এরকম অঙ্কিত উদ্ধৃতি হয়তো আরো কোনো বেদনার অজানা ইতিহাসও বুকে ধরে আছে। এর পরই লেখা- ‘এগুলো সব সময় লিখিনা আর সব সময় খেয়ালও থাকে না’। শিল্পীমনের বিবেচনাবোধ হয়তো তা-ই।


মুখ ফোটে একটি শব্দও তাঁকে উচ্চারণ করতে দেখলাম না। চুপ মেরে থেমে থাকা ট্রাকটার পেছনে মাটিতে মুখ গুঁজে বসে আছেন। আরো কতো কথা লেখা রয়েছে শিল্পীত হরফে ! পড়তে পড়তে বুকের ভেতরটায় চিনচিন করে ওঠলো। আমার সাধ্য নেই কারো দুর্ভাগ্যের নিয়তিকে রাশ টেনে ধরার। পকেট থেকে দুই-মেগাপিক্সেলটা বের করে তাক করলাম, আরেকটা কষ্টের স্মৃতিই না হয় গেঁথে নেই। তাঁর মফস্বলি চোখের সামনে হয়তো এরকম ক্যামেরা তাক করার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তাই কি হঠাৎ নিরবে উঠে গিয়ে গুটগুট করে লিখে ফেললেন- ‘এগুলো সাংবাদিকরা তুলে তুলে মাঝে মধ্যে পত্রিকায়ও দেয়’ !

লজ্জা পেলাম কি ? জানি না। শুধু এটুকুই বুঝলাম, শিল্পীর অভিমান বড় কঠিন। ক্ষুধা শিল্পীর রং-তুলি কেড়ে নিয়েছে ঠিকই, শিল্পীকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে, হয়তো পরাজিতও করেছে। শুধু শিল্পীর চোখকে এখনো ফাঁকি দিতে পারে নি। কিন্তু তা কতক্ষণ ! ক্ষুধা যে শেষপর্যন্ত সবকিছুই গ্রাস করে ফেলে…!
(০৭-০৪-২০১০)

[somewherein | alternative]
...

No comments: