Saturday, April 24, 2010

| বিজয় বনাম অভ্র বিতর্ক, ভাষা উন্মুক্তির লক্ষ্যটাই নির্ধারণ করে দিলো...|


| বিজয় বনাম অভ্র বিতর্ক, ভাষা উন্মুক্তির লক্ষ্যটাই নির্ধারণ করে দিলো...|
-রণদীপম বসু
...
'আহ্লাদে গদগদ, ভূমিতে না পড়ে পদ', ছোটবেলায় মা-মাসিদের কাছে শুনা এ কটাক্ষপূর্ণ ছন্দময় বাক্যবন্ধটায় বেশ আমোদ পেতাম। 'মুই কি হনুরে' জাতীয় আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলে মানুষ যে কতোটা অহঙ্কারি হয়ে ওঠে, তারই প্রবাদতুল্য নমুনা-বচন এটা। এমন অবস্থায় এলে নাকি মানুষের পা তখন আর বাস্তবের মাটিতে পড়তে চায় না। আর বাস্তববিবর্জিত হলে যা হয়, একটু চিপায় পড়লেই যুক্তিহীন আবোলতাবোল বকতে থাকে। তার সাথে যদি ক্ষমতার মদমত্ততা যুক্ত থাকে, তাইলে তো আর কথাই নেই। ধরাকে সরা জ্ঞান করে এরা এই বোধটুকুও হারিয়ে ফেলে যে, 'কাউকে কাউকে সবসময় বোকা বানানো যায়, সবাইকে কিছুদিন বোকা বানানো যায়, কিন্তু সবাইকে সবসময় বোকা বানানো যায় না'।
ইতিহাসে নজর দিলে এই আলামত দেখতে পাই আমরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্'র আচরণে। তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি ঢাকায় এসেই যখন বড়ো অহঙ্কারি স্বরে তাঁর স্বভাবসুলভ ইংরেজিতে বলে ওঠেন- উর্দু, এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, মুখের উপর বাঙালির পুচকে দামাল ছেলেমেয়েরা তাঁর মুখের কথা পড়তে না পড়তেই 'নো নো' বলে চিৎকার করে ওঠে সমুচিত জবাব দিয়ে তাঁর দর্প চূর্ণ করে দেয়। এরপর বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলো, মায়ের ভাষার কোন বিকল্প হয় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরকম নজির ভুরি ভুরি রয়েছে।
ভিন্নভাষী জিন্নাহ্'র এই রাজনৈতিক চালবাজীর না হয় একটা যুক্তি মেলে। কিন্তু বহুকাল পরে এসে একজন সামান্য বাঙালি ব্যক্তিও যখন সাময়িক পরজীবী ক্ষমতার ফানুসে ভেসে নিজস্ব অন্ধতাকে কিছু বালখিল্য মন্তব্যের স্রোতে ভাসিয়ে একটা অহেতুক বিতর্কের ঝড় বইয়ে দেয়, তখন তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি-সুস্থতার প্রশ্ন তো জড়িত হয়ই, সাথে সাথে ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার একটা নিকৃষ্ট নমুনাও তৈরি হয়ে যায় বৈকি। বাঙালি হয়েও ভাষার ব্যাপারী এই ব্যক্তি কি আজো বুঝেন নি যে, ভাষার প্রশ্নে বাঙালি কখনো আপোস করে না !

ইতোমধ্যেই যে বিতর্কটা যথেষ্ট গতি পেয়ে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখি হতে চলেছে বলে অনুমান করছি, তার কিছু নমুনা এই অযোগ্য হাতেও কালের অক্ষরে এঁকে রাখা জরুরি মনে করছি।

বিজয় বনাম অভ্র বিতর্ক
০৮ এপ্রিল ২০১০ তারিখে 'সাইবার যুদ্ধের যুগে প্রথম পা, একুশ শতক' শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি লেখাকে ঘিরেই বিতর্কের তীব্র সূত্রপাত। বিজয় সফটঅয়্যার ও কী-বোর্ডের স্বত্ত্বাধিকারী ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বঘোষিত রূপায়নকারী হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্যকারী জনাব মোস্তফা জব্বার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মিডিয়াতে বাংলা কম্পিউটিং নিয়ে লেখালেখি করেন। শুনা কথা, ইতিপূর্বেও তিনি নাকি বাংলায় লেখার অত্যন্ত জনপ্রিয় উন্মুক্ত ও ফ্রি সফটঅয়্যার অভ্র নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এবার জনকণ্ঠের লেখাটাতে তিনি অভ্রকে সরাসরি পাইরেটেড সফটঅয়্যার হিসেবে উল্লেখ করে দাবি উত্থাপন করেন যে অভ্র'র ইউনিবিজয় কীবোর্ড লেআউটে তাঁর প্যাটেন্ট করা বিজয়ের কীবোর্ড লেআউট চুরি করে হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। এখানেই তাঁর বক্তব্য শেষ নয়। তিনি অভ্র প্রোগ্রামারকে রীতিমতো হ্যাকিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত করে বলেন-

"আমার বিজয় সফটওয়্যারের পাইরেটেড সংস্করণ ইন্টারনেটে প্রদান করার ক্ষেত্রে এই হ্যাকাররা চরম পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। এই হ্যাকার ও পাইরেটদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে ইউএনডিপির নামও যুক্ত আছে। অভ্র নামক একটি পাইরেটেড বাংলা সফটওয়্যারকে নির্বাচন কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ইউএনডিপির অবদান সবচেয়ে বেশি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন সেলের ওয়েবসাইট হ্যাক হলে তার দায় থেকেও ইউএনডিপিকে ছাড় দেয়া যায় না।"
অর্থাৎ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সরকারি কতকগুলো ওয়েবসাইট হ্যাকের বিষয়টিকে কৌশলে তুলে এনে এর সাথে বাংলা ভাষায় অনলাইনে যুগান্তকারী অবদানসমৃদ্ধ সফটঅয়্যার নির্মাতা অভ্র টীমকে জুড়ে দেয়ার খুব ঘৃণ্য একটি অপচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। জনাব মোস্তফা জব্বার বর্তমানে বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের প্রধান বিশেষজ্ঞের পদে গদিনশীন। কেউ কেউ বলেন, তাঁর হাত নাকি বর্তমান আইটি-বান্ধব সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে তাঁর এহেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা বক্তব্য বাংলায় আলোকিত রফিক-জব্বার-সালাম-বরকতদের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার প্রজন্মের একান্ত আবেগের জায়গাটিতে ঘৃতাহুতি ঘটালো। বাংলা ব্লগস্ফিয়ারের অন্তর্জালিক জগতটা উত্থাল হয়ে ওঠলো। প্রতিক্রিয়া আর প্রতিবাদের বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো আমরাবন্ধু, সচলায়তন, সামহোয়ারইন, আমারব্লগ, মুক্তমনা, ফেসবুক, টেকটিউন সহ অন্যান্য অন্তর্জালিক বিশ্ব। সচলায়তন, আমরাবন্ধু, আমারব্লগ সহ কিছু কিছু ব্লগ রীতিমতো তাদের ব্যানার অভ্র-ব্যানারে পরিবর্তন করে অভ্রকে নৈতিক সমর্থনের জানিয়ে দিলো।

ফেসবুকের লিঙ্ক-শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রথম অন্তর্জালিক প্রতিক্রিয়াটা চোখে পড়লো আমরাবন্ধু ব্লগে প্রকাশিত ব্লগার লোকেন বোসের পোস্ট করা 'মোস্তফা জব্বার, যদি মনে করেন 'অভ্র' বিজয়ের পাইরেটেড, মেহদী বিজয় হ্যাক করে অভ্র বানিয়েছে, তাহলে তা প্রমাণ করুন' লেখাটায়। এরপর বিভিন্ন ব্লগে প্রতিক্রিয়ার ঝড় বইতে লাগলো। বিভিন্ন পোস্টে অভ্র বা অমিক্রনল্যাব-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা আর সহযোদ্ধা হবার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে শত শত বাঙালি তরুণের মন্তব্য প্রতিমন্তব্য থেকে উঠে আসতে লাগলো বাংলা কম্পিউটিং ইতিহাসের বহু অজানা অধ্যায়। নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা তৈরির সফটঅয়্যারে বাংলা ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে ব্যয় সাশ্রয়ের নিমিত্তে অভ্র'র মেধাবি নির্মাতা মেহদী হাসান খান সম্পূর্ণ ফ্রি ও উন্মুক্ত সফটঅয়্যার হিসেবে বিনামূল্যে অভ্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে যে অসামান্য বিরল নজির সৃষ্টি করলো, তা বাঙালি হিসেবে আমাদের অহঙ্কারি করলেও এতে জনাব মোস্তফা জব্বারের পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবার বিষজ্বালায় নাকি উন্মাদগ্রস্ত হয়ে তিনি এসব উল্টোপাল্টা বকছেন, নিন্দুকেরা বলে। যদি তা-ই সত্য হয় তাহলে বলতেই হয়, লোভ যখন লোলুপতার পর্যায়ে চলে যায়, মানুষ তখন মা'কে নিয়েও ব্যবসা করতে কুণ্ঠিত হয় না। আমরা বাঙালদের কাছে মা আর মাতৃভাষায় কোন তফাৎ বুঝি না, এটা হয়তো আমাদেরই সীমাবদ্ধতা।

 প্রিন্টিং মিডিয়া জনকণ্ঠের অভ্র'র বিরুদ্ধে যে মিথ্যা বানোয়াট লেখাটিকে ঘিরে অন্তর্জাল বিশ্বে এতো বড়ো তোলপাড়, আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করা গেলো, জনকণ্ঠ এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ ! কোন প্রতিবাদলিপি প্রকাশের দায়টুকুও তারা দেখাতে ব্যর্থ হলো। অথচ কী আশ্চর্য ব্যাপার, জনকণ্ঠের অনলাইন সংস্করণ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় অভ্র'র উন্মুক্ত ফ্রি সফটঅয়্যারের লেআউট দিয়েই ! জনকণ্ঠের বাংলা হেল্প উইজারডটিতে ক্লিক করলেই তা জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে বিস্তৃতভাবেই ভেসে ওঠে ! আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোর এই অকৃতজ্ঞতার নির্লজ্জ চেহারা সত্যিই পীড়াদায়ক বৈকি।

বিভিন্ন সময়ে অভ্র'র বিরুদ্ধে মোস্তফা জব্বার সাহেবে কটাক্ষ এড়িয়ে বরাবর নিশ্চুপ থাকলেও এবার সময়ের প্রয়োজনেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটি ঘটলো, অভ্র টীমের পক্ষে নির্মাতা মেহদী হাসান খান তাঁর বিনয়ী কলমটাকে আর ক্ষান্ত রাখলেন না। 'ভাষা উন্মুক্ত হবেই' শিরোনামে বাংলা কমিউনিটি ব্লগ সচলায়তনে মোস্তফা জব্বারের মিথ্যা বাটোয়াট অসার বক্তব্যের সমুচিত জবাব নিয়ে হাজির হলেন তিনি। অত্যন্ত বিনয়াবিষ্ট থেকেও পয়েন্টে টু পয়েন্ট যুক্তি ও প্রমাণ হাজির করে তিনি দেখিয়ে দিলেন আইটি সেক্টরের ক্ষমতাবান প্রতিনিধি হয়েও একজন লোভী পিশাচ লোক কিভাবে উদ্ভট ও অসার বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেই নিজের বালখিল্যতার হাটে হাড়ি ভাঙতে পারে।   মুহূর্তের মধ্যেই গোটা বাংলা অন্তর্জাল বিশ্ব ঝাঁকি খেয়ে ওঠলো। ঝাঁপিয়ে পড়লো মেহদী'র পোস্টে। প্রচণ্ড পাঠকচাপে সচলায়তনের নাভিশ্বাস অবস্থা ! অতি অল্পসময়ের মধ্যেই কিভাবে একটা পোস্ট পাঠকপ্রিয়তায় সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলতে পারে, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করলাম পোস্টের হিট-কাউন্টারের শনৈ শনৈ উর্ধ্বগতি থেকে।
আমরা যে যেভাবে যা-ই বলি না কেন, মেহদীর একটি পোস্টই অনেক ধোয়াশা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এটার কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে তাঁর লেখাটার হুবহু কপিই এখানে পত্রস্থ করে দেয়া সম্ভবত অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে -
------------------------------------------------------
ভাষা উন্মুক্ত হবেই

লিখেছেন মেহদী হাসান খান (তারিখ: মঙ্গল, ২০১০-০৪-২০ ১৯:৫০)
ক্যাটেগরী: সমসাময়িক | অভ্র | জনকণ্ঠ | পাইরেসি | প্রতিক্রিয়া | মোস্তফা জব্বার

গত ৮ এপ্রিল, ২০১০ তারিখ "সাইবার যুদ্ধের যুগে প্রথম পা ॥ একুশ শতক" শিরোনামে মোস্তফা জব্বার দৈনিক জনকণ্ঠে একটি লেখা দিয়েছেন, যার মূল বক্তব্য সাম্প্রতিক সরকারী অনেকগুলো ওয়েবসাইট হ্যাকিং এর ঘটনা। সুকৌশলে তিনি এর সঙ্গে জড়িয়েছেন বিনামূল্যে বাংলা লেখার সফটওয়্যার অভ্র কীবোর্ড, জাতিসঙ্ঘের UNDP এবং নির্বাচন কমিশন কে। অভ্রকে "পাইরেটেড সফটওয়্যার" উল্লেখ করে তিনি বলেন-
"আমার বিজয় সফটওয়্যারের পাইরেটেড সংস্করণ ইন্টারনেটে প্রদান করার ক্ষেত্রে এই হ্যাকাররা চরম পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছে। এই হ্যাকার ও পাইরেটদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে ইউএনডিপির নামও যুক্ত আছে। অভ্র নামক একটি পাইরেটেড বাংলা সফটওয়্যারকে নির্বাচন কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ইউএনডিপির অবদান সবচেয়ে বেশি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন সেলের ওয়েবসাইট হ্যাক হলে তার দায় থেকেও ইউএনডিপিকে ছাড় দেয়া যায় না।"

এ ধরণের মন্তব্য ওনার এটাই প্রথম না। এর আগেও তিনি জনকণ্ঠে অভ্রকে সরাসরি "চুরি করা সফটওয়্যার" অভিহিত করেন। আমরা প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছিলাম, জনকণ্ঠ সেটা ছাপায়নি। বাংলা কম্পিউটিং নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের জন্য এটা স্বাভাবিক একটা অভিজ্ঞতা। উকিল নোটিশ, RAB দিয়ে আক্রমণের হুমকি এসব উপেক্ষা করেই তারা কাজ করেন। আমরাও তাই করে আসছিলাম, উনি একেকটা মিথ্যাচার প্রচার করেন, আমরা জবাব দেই আমাদের কাজ দিয়ে। জেদ নিয়ে পড়ে থাকি বাংলা লেখালিখিকে কীভাবে আরো সহজ করা যায়, আরো ব্যবহার-বান্ধব করা যায় এবং সর্বোপরি সেটা কীভাবে বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় এসব নিয়ে। আমরা বিরক্ত হই, নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে দুঃখিত হই, আবার একইসাথে মোস্তফা জব্বারের প্রতিক্রিয়া দেখে টের পাই- ঠিক পথেই এগুচ্ছি।

কিন্তু এবার একটা অভাবনীয় ব্যাপার ঘটল। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আমি দেখলাম শত শত মানুষ কীভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদে। ব্লগ থেকে ব্লগে, ফেসবুকে, মেইলে কিভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেই প্রতিবাদ। বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলো তাদের ব্যানার পরিবর্তন করে অভ্রর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে, ব্লগাররা যুক্তি দিয়ে মানুষের বিভ্রান্তি কাটাতে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক ব্লগ, ফেসবুকে নতুন গ্রুপ খোলা হচ্ছে, বাংলা ফোরামগুলো নতুন নতুন থ্রেড খুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, মানুষ এমনকি ব্যক্তিগতভাবে মেইল করে মোস্তফা জব্বারকে বুঝাতে চেষ্টা করছেন।

একটা বিপ্লব ঘটাতে অন্তত একজনকে নেতৃত্ব দিতে হয়। সেরকম কোন নেতৃত্ব ছাড়া সব মানুষ কীভাবে এক হয়ে গেলেন? মোস্তফা জব্বার অভ্রকে পাইরেটেড না বলে গান শোনার সফটওয়্যার উইনঅ্যাম্পকে চুরি করা সফটওয়্যার বললে কি একই প্রতিক্রিয়া হত? "ঝামেলা অভ্রর টীম সামলাক, আমাদের কী?"- এই কথাটা ভেবে সবাই কেন চুপচাপ থাকলেন না? আমি তখন ঢাকার বাইরে, সাথে মোবাইলে অপেরা মিনির ভাঙাচোরা বাংলা সাপোর্ট আর একটা ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া কিছু নেই (এই লেখা দেরীতে আসার কারণও এটা)। বসে বসে সবার লেখা পড়া আর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা ছাড়া করার কিছু ছিল না। সে উত্তর খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, সবাই লড়ছেন একটা স্বপ্নের জন্য। যে স্বপ্নে নিজের ভাষায় লিখতে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। যে স্বপ্নে বাংলায় লিখলে কেউ খড়্গ হাতে তেড়ে এসে জানতে চাইবে না লেখার আগে আপনি টাকা দিয়ে লেখার অধিকার কিনেছেন কিনা। মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণাটি নতুন না, কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য স্বপ্নটি সবাইকে প্রথমবার দেখিয়েছিল এই অভ্র। "ভাষা হোক উন্মুক্ত" কথাটা শুধু অভ্রের স্লোগান না, এটা একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার আশ্বাস। মোস্তফা জব্বার যখন জেনে শুনে সেই অধিকারটা কেড়ে নিতে চান, মানুষ কেন চুপ করে থাকবে? স্বাধীনতার ডাক বড় খারাপ জিনিস, দাবানলের মত তার ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।

আমি হয়তো চুপ থাকতাম, অন্য সব সময়ের মত মোস্তফা জব্বারের হুংকারে কান না দিয়ে অভ্রর পরের ভার্শনের জন্য কাজ করে যেতাম। কিন্তু এবার কৃতজ্ঞতা থেকে লিখতে বসেছি। যেসব সাহসী মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে চুপ করে ঘটনাটা বয়ে যেতে দেননি, কৃতজ্ঞতাটা তাদের প্রতি। সবাইকে অন্তত এটুকু তো বলতেই হবে যে তারা ঠিক পথেই আছেন।

পাইরেসীর অভিযোগের জবাবঃ

মোস্তফা জব্বার তার লেখায় ঢালাওভাবে পুরো অভ্র কীবোর্ডকেই "পাইরেটেড" হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। অভিযোগটা গুরুতর, একটা জাতীয় দৈনিকে অভিযোগটা কেউ করলে আমরা অবশ্যই ধরে নিব তিনি যা লিখছেন বুঝেশুনে লিখছেন। মজার ব্যাপার হল, মানুষজন অভ্র কীভাবে পাইরেটেড প্রশ্নটা করে তাকে চেপে ধরার পর তিনি বললেন অভ্র নিয়ে তার আপত্তি নেই, অভ্রতে ইউনিবিজয় নামে যে কীবোর্ড লেআউট আছে ঐটা তার বিজয় লেআউট থেকে চুরি করা। চমৎকার, আসুন দেখি কী করলে একটা কপিরাইটেড/পেটেন্ডেড লেআউট (অথবা সেটার প্রয়োগ) এ আমরা চুরির অভিযোগ দিতে পারি।

১) অবিকল লেআউট স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলেঃ

অনুমতির প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন বলি, ২০০৩ সালে অভ্র ডেভেলপের পরিকল্পনা করার সময় আমি ফোনে মোস্তফা জব্বারের কাছে বিজয় লেআউট ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলাম। তাকে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছিল, সফটওয়্যারটা যে কেউ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবে। বিজয় তখনও ইউনিকোড সমর্থন করত না, ইউনিকোড সমর্থন দেয়ার কোন পরিকল্পনাও তার ছিল না। এই সফটওয়্যারটা ইউনিকোড সমর্থিত হবে, সুতরাং তিনি বিজয় ফন্টের অপব্যবহারের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। শুধুমাত্র লেআউট একই, এছাড়া সফটওয়্যার দুটোতে কোন মিল থাকবে না।

তিনিও তার জবাব জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে টাকা না দিলে তিনি অনুমতি দিবেন না। বেশ ভালো কথা, আমিও বিজয় কীবোর্ড অভ্রর সাথে দেইনি। জ্বী মোস্তফা জব্বার, অভ্র আপনার বিজয় কীবোর্ড ব্যবহার করে না। ইউনিবিজয় আর বিজয় কোনদিনই এক কীবোর্ড লেআউট ছিল না, এখনও নেই। যেখানে একটা কী এর পার্থক্য একটা আলাদা লেআউটের জন্ম দেয়, ইউনিবিজয়ের সাথে বিজয়ের সেখানে অন্তত ৮ টি কীতে পার্থক্য রয়েছে।

কীবোর্ড লেআউট যে সমস্ত কী এর একটা সেট, যেখানে একটা কী এর পার্থক্য হলে দুইটা সেট আলাদা হয়ে যায়, এটা বুঝতে পারেন মোস্তফা জব্বার? না পারলেও পড়তে থাকুন। "ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা" যাতে বুঝতে পারেন সেজন্য খুব সহজ করে নিচে লিখেছি।

২) ফিজিক্যাল লেআউট অনুমতি ছাড়া বিতরণ করলেঃ
প্রশ্নই আসে না। অভ্র কীবোর্ড একটা সফটওয়্যার মাত্র, এর সাথে বিজয় লেআউট ছাপানো কোন কীবোর্ড আমরা বিতরণ করি না।

৩) কীবোর্ড ইন্টারফেস প্রোগ্রামের কোড অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলেঃ
আবারো বলি, এই পয়েন্টও খাটে না। বিজয় ক্লোজড সোর্স, সেটার সোর্স থেকে অভ্র ডেভেলপ করা সম্ভব না। কীভাবে বিজয় হ্যাক করে অভ্র বানানো হল তার ব্যাখ্যা আপনার কাছে দাবী করছি। জবাব দেয়ার আগে দয়া করে "ইংরেজীতে হ্যাকিং লিখে গুগলে অনুসন্ধান" করে যে "মজার মজার সব তথ্য পাওয়া যায়", সেগুলো নিয়ে একটু পড়াশোনা করবেন।

৪) ট্রেডমার্ক লঙ্ঘন করলেঃ
বিজয় শব্দটি আপনার রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক। সেটা যাতে লঙ্ঘন করা না হয় এবং ইউনিবিজয় যে পরিষ্কারভাবে আলাদা একটা লেআউট সেটা বোঝাতেই এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা কোনদিনই অভ্রর সাথে বিজয় নামে কোন লেআউট ব্যবহার করিনি। উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, SlideShow শব্দটা মাইক্রোসফটের রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক (এখানে লিস্ট দেখুনঃ http://www.microsoft.com/about/legal/en/us/IntellectualProperty/Trademarks/EN-US.aspx), অন্য একটা প্রতিষ্ঠান যখন DVD SlideShow Builder (http://www.photo-to-dvd.com/dvd-slideshow-builder.html) নামে একটা সফটওয়্যার বানায়, তখন মাইক্রোসফটের লেজে কামড় বসানো হয় না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ইউনিবিজয় বা ইউনিজয় লেআউটগুলো বের হয়েছে ২০০৩ সাল বা তারও আগে, ১৯৮৭ সালে ডিজাইন করা হলেও আপনি বিজয়ের পেটেন্ট পেয়েছেন ২০০৮/২০০৯ সালে। সেক্ষেত্রে পেটেন্টের আগের থেকেই থাকা এই লেআউটগুলো কীভাবে পেটেন্ট বিরোধী হয়ে গেল আমাদের বোঝাবেন?

আপনি যদি এখনও কিছু না বুঝে থাকেন-
ধরুন একজন ব্যবসায়ী মঙ্গলগ্রহটা কিনতে চাইলেন, বাংলাদেশের পেটেন্ট অফিস তাকে মঙ্গলগ্রহের পেটেন্টও দিয়ে দিল। একদিন সেই ব্যবসায়ী অবিষ্কার করলেন তার গ্রহে কেউ যায় না। এদিকে বাংলাদেশের গাজীপুর নামের একটা জায়গায় গিজগিজ করে মানুষ। মঙ্গলগ্রহের মাটি লাল, গাজীপুরের মাটিও লাল। তিনি রেগে জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘোষণা করে দিলেন, গাজীপুরে কেউ থাকতে পারবে না। কারণ গাজীপুরের মাটি মঙ্গলগ্রহ থেকে চুরি করা হয়েছে। চুরি যদি নাই করা হবে তাহলে এটা লাল কেন? তার মাথায় একবারও আসল না মঙ্গলগ্রহে থাকার পরিবেশ নেই দেখে মানুষ থাকে না, যাওয়ার খরচও অনেক। আবার গাজীপুরে লাল মাটির লোভেও কেউ থাকে না, বেঁচে থাকার জন্য সেখানে আরো উপাদেয় উপকরণ আছে। ব্যাপারটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? গাজীপুরের মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে, তাদের দেখতে চাওয়ার অধিকার আছে সেই ব্যবসায়ীর পেটেন্টের কাগজ, সেখানে কোথায় লেখা আছে লাল মাটি হলেই সে জায়গা ব্যবসায়ীর হবে। সেটা যদি লেখাও থাকে, বাংলাদেশের পেটেন্ট অফিস কিভাবে দেশের সব লাল মাটি বিক্রি করে দিতে পারে সে প্রশ্ন করার অধিকারও তাদের আছে।

মোস্তফা জব্বার, আমি আপনার মত কখনই ভাবি না মানুষ সারাজীবন বিজয় বা অভ্রই ব্যবহার করে যাবে। নতুন দিনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে অন্য প্রযুক্তির জন্য যায়গা ছেড়ে দিতে হয়, এটা ধ্রূব সত্য। বাংলা কীবোর্ড নিয়ে গবেষণা থেমে থাকবে না। আপনি আপনার পেটেন্টের কাগজ সবার কাছে প্রকাশ করুন। দেখিয়ে দিন ঠিক কোন রাস্তাগুলো দিয়ে হাঁটা আপনি বন্ধ করে দিতে চান। বারবার একেকজন কাজ করার পর আপনি বলতে পারেন না এই রাস্তায় তো বেড়া দেয়া ছিল। আবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে দাবিও করতে পারেন না বাংলা কম্পিউটিং এর ইতিহাসে আপনার বিশাল অবদান, আপনি ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ।

আমরা বিজয় কীবোর্ডকে প্রমোট করার জন্য মাঠে নামিনি। নেমেছি বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যবসার শিকার হওয়া থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন অভ্রতে আপনার ডিজাইন করা বিজয় কীবোর্ড লেআউট আছে, আমি সে মুহূর্তে সেটা বাদ দিব। আর যদি প্রমাণ ছাড়া আসেন, তাহলে নতুন কিছু বলেন। এক গান এতবার শুনতে আমাদের কারোই ভালো লাগছে না আর।

নির্বাচন কমিশন ও ইউএনডিপির সাথে অভ্রর অবৈধ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের জবাবঃ
ইউএনডিপি কে, কেন, কোথায়, কীভাবে এবং তাদের সাথে অভ্রের কী সম্পর্ক এসব বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, আশা করি আপনি যা বলেছেন সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন থেকে সরাসরি ডাক পেয়েই আমি গিয়েছিলাম। অভ্রকে সেখানে ব্যবহার করাতে কোন রকম লবিং বা প্রভাব খাটানোর মত কাজ করতে হয়নি। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের টাকা বাঁচানো। যারা জানেন না তাদের জন্য বিস্তারিতভাবে বলি।

নির্বাচন কমিশন ডাটা এন্ট্রি, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করা এসবের জন্য প্রথম যে সফটওয়্যারটা ব্যবহার করেছিল সেটায় সরাসরিই বাংলা লেখা যেত, অভ্র বা বিজয়ের মত কোন কীবোর্ড ইন্টারফেস প্রয়োজন হত না। সমস্যা হল প্রতিটা ল্যাপটপের জন্য সেটার একটা আলাদা লাইসেন্স কিনতে হত, হাজার হাজার ল্যাপটপের জন্য হাজার হাজার লাইসেন্স। বুঝতেই পারছেন, বিশাল খরচের ব্যাপার। সে খরচ কমানোর জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় এরকম একটা সফটওয়্যার তারা নিজেরাই ডেভেলপ করে নিবেন। বুয়েটের একজন শিক্ষককে সে দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা সেটাই করেন, শুধুমাত্র বাংলা লেখার অংশটা ছাড়া। যেহেতু অভ্র আগের থেকেই বিনামূল্যে পাওয়া যায় এবং ততদিনে একটা স্টেবল প্রজেক্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, তারা একই চাকা আবার আবিষ্কার করে সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীতে তারা অভ্র ব্যবহার করলেন, বিনিময়ে তাদের কাছে আমি একটা জিনিসই চেয়েছিলাম- অভ্র যে নির্বাচন কমিশনে ব্যবহৃত হল তার একটা সনদ। সেটা তারা দিয়েছেন। এর বেশি কোন ঘটনা এখানে ঘটেনি।

আপনার ভাষ্যমতে আপনি যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে অভ্রর জন্য ৫ কোটি টাকার বিজয়ের লাইসেন্স বিক্রি করতে ব্যর্থ হন, এক কথায় বলি, আমাদের সমস্ত পরিশ্রম সার্থক। এ দেশের মানুষের ৫ কোটি টাকা নর্দমায় ভেসে যায়নি, বরং অন্য কোন কাজে লেগেছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে আরেকবার কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য।

শেষ কথাঃ
অনেকদিন আগে আমার কম্পিউটারে একটা ভাইরাস এসেছিল। খুবই বিরক্তিকর ভাইরাস। রাইট ক্লিক করলে সেখানে মেনুতে লেখা থাকতো - "If freedom is outlawed, only outlaws will have freedom"। ভাইরাসটা কে বানিয়েছে জানিনা, তাদের এসব কাজের প্রতিও আমার কোন সমর্থন নেই। কিন্তু মেসেজটার কথা আমি কখনই ভুলিনি। ফেসবুকে আমার প্রিয় উক্তির ঘরে সেটা লিখে রেখেছি। স্বাধীনতাকে শেকলবন্দী করা যায় না, মরিয়া মানুষ সেটাকে যেভাবেই হোক ছিনিয়ে আনে- এর চেয়ে বড় সত্যি কথা আর কী হতে পারে? কথাটার মানে আপনি বুঝতে পারবেন বলে মনে হয় না। সবারই সীমাবদ্ধতা থাকে, এতে দুঃখ করার কিছু নেই। মায়ের ভাষা নিয়ে এত চমৎকারভাবে কীভাবে ব্যবসা করা যায় সেটাও আমরা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি।

ভালো থাকুন।

---
অভ্র টীম এর পক্ষে-
মেহ্‌দী হাসান খান
---------------------------------------------------------
২১ এপ্রিল ২০১০-এ অনলাইনভিত্তিক মুক্তধারার বাংলা পত্রিকা নতুন দেশ-এও মেহদীর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ দৈনিক কালের কণ্ঠে সাংবাদিক ব্লগার বিপ্লব রহমানের 'কতদূর এগোল বাংলা, আইটিতে বাংলার জয়জয়কার' শিরোনামে একটি তথ্যবহুল ফিচার প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে নাকি বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে এসব হুমকি-ধামকির কারণ হিসেবে ওই রিপোর্টের নিম্নোক্ত অংশটিকেই দায়ী করা হয়-
...বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান উদ্যোক্তা এবং আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গত চার দশকে বাংলা ভাষার ব্যবহার এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। এ ক্ষেত্রে ইউনিকোড প্রযুক্তি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এতদিন কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, যার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল ছিল না। গত পাঁচ বছর ধরে সার্বজনীন ইউনিকোডে বাংলা লেখা হচ্ছে, ফলে ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। বাংলা ব্লগের বিপুল জনপ্রিয়তা ও বাংলা উইকিপিডিয়ার বিস্তার লাভই এর বড় প্রমাণ।
রাগিব হাসান জানান, সমপ্রতি উবুন্টু লিনাক্স, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ_এসবের মাধ্যমেও বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এর পাশাপাশি ওপেন অফিস, ফায়ারফক্স এসবেরও বাংলা সংস্করণ বেরিয়েছে। অত্যন্ত উদ্যমী একঝাঁক তরুণ কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন সফটওয়্যারকে স্থানীয়করণ করতে।
তিনি বলেন, ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সুবিধা কম বলেই কেবল অনেকে বাংলা কথাকে ইংরেজি হরফে লিখছে বা ইংরেজিতেই আলাপ করছে। ই-মেইল, ফেইসবুক বা ব্লগে সরাসরি বাংলায় লেখার ব্যবস্থা পেলেই বাঙালিরা বাংলাতেই কথা বলবেন।
'অভ্র' সফটওয়্যার আবিষ্কার করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান। মেহেদী, রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক_এই কয়েকজন বন্ধু গত ছয় বছর ধরে অভ্র নিয়ে কাজ করছেন। মেহেদী হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, অভ্র বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারীর ইউনিজয়, প্রভাত ও ফোনেটিক কিবোর্ড বাছাই করারও সুযোগ রয়েছে। এমনকি যিনি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত নন, তিনি যেন অন্তত কিছু বাক্য বাংলায় লিখতে পারেন, সে জন্য মাউস চেপে (ভার্চুয়াল কিবোর্ড) বাংলায় লেখার অপশনও তৈরি করেছেন তারা। বাংলা উইকিপিডিয়া, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সার্চ ইঞ্জিনে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে অভ্র-ফোনেটিক অপশন।
জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকমের প্রধান সঞ্চালক ও ব্লগার সুশান্ত দাস গুপ্ত বলেন, মূলত ইউনিকোডের কল্যাণেই বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমি নিজে বাংলা টাইপ করতে ভয় পেতাম, কিন্তু অভ্র কিবোর্ড আসার পর এখন আমি ইংরেজির চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা টাইপ করতে পারছি।' ওয়েবে বাংলা প্রসারে হাসিন হায়দার, সবুজ কুণ্ডু, এএসএম মাহবুব মুর্শেদ, আহমেদ অরূপ কামাল, আরিল প্রমুখের অবদান উল্লেখযোগ্য বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার প্রসারে মুস্তফা জব্বার, লিড প্রোগ্রামার পাপ্পান এবং অভ্রর সব কোডারের বড় অবদান রয়েছে।
অবশ্য ইউনিকোড বা অভ্র ব্যবহার তুলনামূলক সাম্প্রতিক হওয়ায় অনেকেই এর ব্যবহার শুরু করেনি। আমাদের দেশে এখনো বিজয় সফটওয়ার বেশি জনপ্রিয়। ফলে লেখালেখির আদান-প্রদানে ফন্ট ভেঙে যাওয়াসহ নানা সমস্যা হচ্ছে। ...

ইউনিকোডে বাংলার প্রচার পসারের পিছনে আরো যাঁদের অবদান রয়েছে তাঁদের নামও রিপোর্টটিতে এসেছে- হাসিন হায়দার, সবুজ কুণ্ডু, এএসএম মাহবুব মুর্শেদ, আহমেদ অরূপ কামাল, আরিল প্রমুখ। তবু মেহদী হাসান খানের পেছনে ভাষা-ব্যাপারী মোস্তফা জব্বারের এমন উঠেপড়ে লাগার কারণটা নিশ্চয়ই আর বুঝার বাকী নেই আমাদের। বিজয় আর অভ্র'র লেআউট বিষয়ে তাঁর উঠেপড়ে লাগাটা যে কতোটা অনৈতিক ও পেটেন্ট আইনের দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তা বুঝতে সচলায়তন ব্লগে ব্লগার জ্বিনের বাদশা'র 'অভ্র, বিজয়, পেটেন্ট বিষয়ে' শিরোনামে পোস্ট করা অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটা আমাদেরকে যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে।

মেহদী হাসান খান একজন প্রচারবিমুখ আত্মনিমগ্ন নিরিবিলি মানুষ। মেডিক্যাল পাশ করে পুরোপুরি একজন ডাক্তার হলেও ডাক্তারিকে আদৌ পেশা হিসেবে নিয়েছেন কিনা তাঁর ঘনিষ্টজনেরাই বলতে পারবেন। ব্যক্তি তিনি আরো বহু মানবিক গুণের সমষ্টি। আর সবকিছু বাদ দিলেও আমরা তাঁকে যে একটি গুণের জন্যই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করতে পারবো না তা হলো, তিনি বাংলা লেখার ফ্রি ও উন্মুক্ত অমিক্রনল্যাব সফটঅয়্যার অভ্র'র স্বপ্নদ্রষ্টা ও নির্মাতা। যে অভ্র না হলে বহু বহু অগণিত বাঙালি তরুণের অনলাইনভিত্তিক বাংলা লেখার আবেগসঞ্জাত দূরগামী স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যেতো, বাংলা ভাষার বিশ্বময় ছড়িয়ে গিয়ে মাথা উঁচু করে নিজের অহঙ্কারি অবস্থানটুকু জানানোর সুযোগ আপাত অধরাই থেকে যেতো। ল্যাটিন হরফে বাংলা লেখার জারজ-সম্ভাবনায় ডুবে গিয়ে বাংলা তার চিরায়ত পরিচিতিটাই বিশ্বদরবারে হারিয়ে ফেলতে পারতো। মেহদী আমাদেরকে সেখান থেকে তুলে এনে স্বপ্ন দেখার এলেমটুকু হাতে ধরিয়ে দিলেন অভ্র'র মাধ্যমে। আগামীতে কী হবে জানি না, এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে ইউনিকোড ভিত্তিক লেআউট দিয়ে অনায়াসে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে মেহদী যেটুকু করেছেন, বাঙালি যদি অকৃতজ্ঞ জাতি না হয়, এ জাতি একদিন মেহদী হাসান খানকে 'একুশে পদক' দিয়ে কৃতজ্ঞতার দায় মোচন করবে। এই মেহদী হাসান এতোটাই প্রচারবিমুখ বিবরবাসী যে, প্রিন্টিং মিডিয়ার কোথাও কোন সাক্ষাতকারের কথা ওঠলেই নাকি তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দুঃখ, বাঙালি সন্তান হয়েও ছেলেটা আগের প্রজন্মের পূর্বসূরী বহু গুণে গুণান্বিত মোস্তফা জব্বার সাহেবের কাছ থেকেও কিছু শিখতে পারলো না ! বাংলা মায়ের এই বেয়াড়া ছেলেগুলো সত্যিই কেমন যেন !

তবে এবার বোধয় প্রথম আলো তাঁকে হাতছাড়া করেনি। কিংবা যাঁরা তাঁকে ধরেবেঁধে সাক্ষাতকারের রশি পরিয়ে দিতে সহায়তা করেছেন, তাঁরা যে সময়ের প্রয়োজনে একটি কাজের কাজ করেছেন সেটা বলতেই হয়। প্রিন্টিং মিডিয়ায় এই ভাষা-যুদ্ধটাকে ছড়িয়ে দিতে এর খুবই প্রয়োজন ছিলো। প্রথম আলোতে মোস্তফা জব্বার ও মেহদী হাসান খানের বক্তব্য পাশাপাশি রেখে নিউজটা বিস্তৃত পরিসরে আরো আলোচনার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে এ জাতির সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যে অধিকতর সহায়ক ভূমিকা রাখবে তা বলা যায়। এই ভূমিকাটা কী হতে পারে তা বুঝতে দু'জনের বক্তব্যেই চোখ বুলিয়ে নিতে পারি- (পত্রিকার অনলাইন আর্কাইভের স্থায়িত্ব নিয়ে ভরসা কম, তাই পাঠকদের জন্য প্রথম আলোয় প্রকাশিত ফিচারটি হুবহু তুলে রাখা হলো)
------------------------------------------------
সাম্প্রতিক বিতর্ক
অভ্র কি পাইরেটেড? | তারিখ: ২৩-০৪-২০১০


৮ এপ্রিল একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘সাইবার যুদ্ধের যুগে প্রথম পা’ শিরোনামে আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার একটি লেখায় বলেছেন, বিনা মূল্যের বাংলা লেখার সফটওয়্যার অভ্রের একটা অংশ পাইরেটেড।
ওই লেখা থেকেই সূত্রপাত। মোস্তাফা জব্বারের লেখা নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয় প্রায় প্রতিটি বাংলা ব্লগসাইটে, অনলাইন ফোরামে আর ফেসবুকের গ্রুপে। সচলায়তন, আমার ব্লগ ও আমরা বন্ধু—এই তিনটি ব্লগসাইট রীতিমতো প্রথম পৃষ্ঠার ব্যানারে অভ্রকে সমর্থন জানিয়েছে। অনলাইনে অভ্র বনাম বিজয় বিতর্ক চলছে এখনো। নিচে বিজয়ের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফা জব্বার ও অভ্রর নির্মাতা অমিক্রন ল্যাবের পক্ষে মেহ্দী হাসান খানের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

মোস্তাফা জব্বারের বক্তব্য  
‘অভ্র পাইরেটেড সফটওয়্যার’—আমার এই মন্তব্যটির একমাত্র কারণ হচ্ছে, এই সফটওয়্যারটিতে ইউনিবিজয় নামের যে কিবোর্ড আছে তার বর্ণ-অংশটি আমার কপিরাইট ও প্যাটেন্টকৃত বিজয় বাংলা কিবোর্ড লে-আউটের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে এক বা হুবহু নকল।
বিজয় কিবোর্ড লে-আউট ১৯৮৯ সাল থেকে কপিরাইট নিবন্ধিত এবং ২০০৪ সালে এর প্যাটেন্ট করা হয়েছে।বিজয় শব্দটিও ক্লাস-৯ শ্রেণীতে ট্রেডমার্ককৃত। এসব ট্রেডমার্ক, কপিরাইট ও প্যাটেন্টসংক্রান্ত সব দলিল যে কেউ আমার কাছে উপস্থিত হলে দেখতে পাবেন। বলে রাখা ভালো, ২০০৫ সালের কপিরাইট আইন, ২০০৯ সালের ট্রেডমার্ক আইন এবং ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট আইনসহ আন্তর্জাতিক চুক্তি-কনভেনশন ও রীতি-রেওয়াজ অনুসারে, আমার অনুমতি ছাড়া কেউ এই বিজয় কিবোর্ড লেআউটের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ কোথাও যুক্ত করতে পারেন না। সুতরাং যিনি বা যাঁরাই তাঁদের সফটওয়্যার বা হার্ডওয়ারে বিজয় কিবোর্ড লেআউট অন্তর্ভুক্ত করবেন, তিনি বা তাঁরাই পাইরেসির দায়ে অভিযুক্ত হবেন। অভ্রকে সেই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এই অভিযোগের বাইরে অভ্র, ওপেন সোর্স বা ওপেন সোর্স ঘরানার কোনো সফটওয়্যার বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নেই, কোনো অভিযোগও নেই। বিজয় আমি তৈরি করেছি, নাকি অন্য কেউ করেছে তার জবাবও এসব প্রত্যয়ন থেকেই জানা যাবে।
কিবোর্ডের লে-আউটের প্যাটেন্ট বা কপিরাইট হয় কি না সেই প্রশ্নের জবাব আমি দেব না, সরকার দেবে। কারণ এগুলো রেজিস্ট্রার অব কপিরাইট এবং রেজিস্ট্রার অব প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস থেকে দেওয়া হয়েছে। আইন অনুসারে এই প্রত্যয়নের বিরুদ্ধে আপিল করার সময়ও অতিক্রান্ত হয়েছে। বলে রাখা ভালো, বিজয়-এর কপিরাইট হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে এবং প্যাটেন্ট হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে। শেখ হাসিনার আগের বা বর্তমান শাসনকালে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সুপিরিয়র ইলেকট্রনিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল এবং আদালত বিজয় কিবোর্ডের কপিরাইট আমার—সেই রায় দিয়েছেন। সুপিরিয়র সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি এবং প্যাটেন্ট হওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও বিজয় কিবোর্ডের প্যাটেন্ট স্বত্ব বলবত্ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে তা বলবত্ করেছে। সুতরাং এটি কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। উপরন্তু আমি যদি অভ্রকে পাইরেটেড সফটওয়্যার বলে তার মানহানি করে থাকি তবে আদালতে আমার বিরুদ্ধে সিআরপিসির ৫০০ এবং ৫০১ ধারায় মামলা হতে পারে এবং আমি যদি প্রমাণ করতে না পারি যে, অভ্র বিজয় অন্তর্ভুক্ত করে পাইরেসি করেনি, তবে আমার শাস্তি হবে। এরপর পাঠকেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন অভ্র পাইরেটেড কি না।

মেহ্দী হাসান খানের বক্তব্য
একটি স্বপ্ন নিয়ে সবাই এগোচ্ছে। আর তা হচ্ছে ইন্টারনেটে নিজের ভাষায় লেখা। যে স্বপ্নে বাংলায় লিখলে কেউ খড়্গ হাতে তেড়ে এসে জানতে চাইবে না লেখার আগে আপনি টাকা দিয়ে লেখার অধিকার কিনেছেন কি না। মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণাটি নতুন না, কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য স্বপ্নটি সবাইকে প্রথমবার দেখিয়েছিল এই অভ্র। ভাষা হোক উন্মুক্ত, কথাটা শুধু অভ্রের স্লোগান না, এটা একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার আশ্বাস। মোস্তাফা জব্বার যখন জেনে-শুনে সেই অধিকারটা কেড়ে নিতে চান, মানুষ কেন চুপ করে থাকবে? স্বাধীনতার ডাক বড় খারাপ জিনিস, দাবানলের মতো তার ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।
তিনি তাঁর লেখায় ঢালাওভাবে পুরো অভ্র কিবোর্ডকেই পাইরেটেড হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, অভ্র নিয়ে আপত্তি নেই, অভ্রতে ইউনিবিজয় নামে যে কিবোর্ড লে-আউট আছে, ওটা তাঁর বিজয় লে-আউট থেকে চুরি করা। তবে একটা কপিরাইট বা প্যাটেন্টকৃত করা লে-আউট (অথবা সেটার প্রয়োগ) চুরির অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে—
অবিকল লে-আউট স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে এ সমস্যা হতে পারে। ২০০৩ সালে অভ্র তৈরির পরিকল্পনা করার সময় আমি ফোনে মোস্তাফা জব্বারের কাছে বিজয় লে-আউট ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলাম। বিজয় তখনো ইউনিকোড সমর্থন করত না, ইউনিকোড সমর্থন দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। এই সফটওয়্যারটা ইউনিকোড-সমর্থিত হবে, সুতরাং তিনি বিজয় ফন্টের অপব্যবহারের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। শুধু লে-আউট এক, এ ছাড়া সফটওয়্যার দুটোতে কোনো মিল থাকবে না।
তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁকে টাকা না দিলে তিনি অনুমতি দেবেন না। বিজয় কিবোর্ড অভ্রর সঙ্গে দেওয়া হয়নি। ইউনিবিজয় আর বিজয় কোনো দিনই এক কিবোর্ড লে-আউট ছিল না, এখনো নেই। যেখানে একটা কি বা বোতামের পার্থক্য একটা আলাদা লে-আউটের জন্ম দেয়, ইউনিবিজয়ের সঙ্গে বিজয়ের সেখানে অন্তত আটটি ‘কি’তে পার্থক্য রয়েছে। কিবোর্ড লে-আউট কি-র একটা সেট, যেখানে একটা কি-র পার্থক্য হলে দুটো সেট আলাদা হয়ে যায়। হার্ডওয়্যারের লে-আউট অনুমতি ছাড়া বিতরণ করলেও এ সমস্যা হতে পারে। তবে অভ্র কিবোর্ড একটা সফটওয়্যার মাত্র, এর সঙ্গে বিজয় লে-আউটের ছাপানো কোনো কিবোর্ড বিতরণ করা হয় না। এ ছাড়া কিবোর্ড ইন্টারফেস প্রোগ্রামের সংকেত অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে পাইরেটেড বলা যায়। তবে বিজয় ‘ক্লোজড সোর্স’, সেটার উৎস থেকে অভ্র নির্মাণকরা সম্ভব না। কীভাবে বিজয় হ্যাক করে অভ্র বানানো হলো তার ব্যাখ্যা আমরা দাবি করছি। ট্রেডমার্ক লঙ্ঘন করলেও এ সমস্যা হয়। তবে বিজয় শব্দটি রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক। সেটা যাতে লঙ্ঘন করা না হয় এবং ইউনিবিজয় যে পরিষ্কারভাবে আলাদা একটা লে-আউট, সেটা বোঝাতেই এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা কোনো দিনই অভ্রর সঙ্গে বিজয় নামের কোনো লে-আউট ব্যবহার করিনি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ইউনিবিজয় বা ইউনিজয় লে-আউটগুলো বের হয়েছে ২০০৩ সাল বা তারও আগে। ১৯৮৭ সালে ডিজাইন করা হলেও বিজয়ের প্যাটেন্ট হয়েছে ২০০৮-২০০৯ সালে। সে ক্ষেত্রে প্যাটেন্ট হওয়ার আগে থেকেই থাকা এই লে-আউটগুলো কীভাবে প্যাটেন্টবিরোধী হয়? যদি প্রমাণিত হয় যে অভ্রতে বিজয় কিবোর্ড লে-আউট আছে, আমরা সে মুহূর্তে সেটা বাদ দেব।
----------------------
কেঁচো খুঁড়তে সাপ!
বাংলা অন্তর্জাল বিশ্বে গতিসৃষ্টিকারী মেধাবী ব্লগারদের অনেকেই যে তাঁদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রেও যথেষ্ট সুনাম ও সৃজনশীলতার অধিকারী তা বিভিন্ন ব্লগ বা ফোরামগুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। বাঙালি হিসেবে তাঁদেরকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। এরাই যে আগামী দিনে এই জাতির কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন সে আশা আমরা করতেই পারি। এদের মধ্যে অনেকেই আইটি ও কম্পিউটার প্রকৌশলী রয়েছেন। তাঁরা তাঁদের অবদান দিয়ে আমাদের ভাষা ও প্রযুক্তিকে এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। কেউ অন্তরালে, কেউ প্রকাশ্যে। বিজয় বনাম অভ্র বিতর্কটি এবার তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে এ নিয়ে অনেক সমৃদ্ধ আলোচনা-পর্যালোচনা করে যাচ্ছেন। এগুলো থেকেও আমরা আগামী দিনের একটা রূপরেখা কল্পনা করে নিতে পারি।

এসবের পাশাপাশি আরেকটি যে বিষয় সেসব মেধাবি ব্লগারদের কল্যাণে সামনে চলে আসছে তা হলো বিজয় সফটঅয়্যার তৈরির নেপথ্য কাহিনী। কেঁচো খুঁড়তে সাপও নাকি বেরিয়ে আসছে !

দেখা যাচ্ছে যে মুনিরুল আবেদিন পাপ্পানা নামের একজন মেধাবী কম্পিউটার প্রকৌশলী বিজয় ২০০০ ভার্সনের প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যিনি বর্তমানে মাইক্রোসপটে কর্মরত আছেন বলে জানা যায়। যাদের পিসিতে বিজয় ইনস্টল রয়েছে তার কিভাবে বিজয় সফটঅয়্যার থেকেই এই তথ্য বের করবেন তার একটা ছবি গাইড (উপরে প্রদত্ত) অন্তর্জালে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বিষয় থেকে আমাদেরকে অনুধাবন করতে হচ্ছে যে জনাব মোস্তফা জব্বার নিজেকে যতই আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবী করুন না কেন, আসলে তিনি কপিরাইট ও প্যাটেন্ট বাগিয়ে নিয়ে অন্যের মেধাস্বত্বকে অর্থ ও ক্ষমতার বিনিময়ে নিজে ভোগ করছেন তো বটেই, বদলে কৃতজ্ঞতাটুকুও স্বীকার করছেন না। তবে একটি ব্লগপোস্টের মন্তব্যে মুনিরুল আবেদিন পাপ্পানার বিষয়টাকে স্পষ্ট করতে অভ্র'র মেহদীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য মনে করছি-

...পাপ্পানা ভাই কোনদিনই বিজয় কীবোর্ড লেআউটের ডিজাইন করেননি। বিজয় এসেছে ১৯৮৭ সালে, প্রথমে ম্যাকের জন্য, লেআউট মোস্তাফা জব্বারের ডিজাইন করা, প্রোগ্রামার ছিলেন জোশী নামে ভারতীয় একজন। ২০০০ সালের দিকে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তন আসায় কোড নতুন করে লেখার দরকার হয়, তখন পাপ্পানা ভাই কাজটা নেন। তার বানানো বিজয় ২০০০-কেই শুধু খোলস পালটে আরো ৩ বছর বিজয় ২০০৩ নামে চালানো হয়। বিজয় ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত কাজ আরেকজনের করা (অনুমতি না নিয়ে তার নাম বলতে চাচ্ছি না)।

এছাড়া এর একটি ইউটিউবভিত্তিক ভিডিও ভার্সনও ফেসবুকের মাধ্যমে অন্তর্জালে ছড়িয়ে গেছে। এছাড়া শেহাব নামের একজন ব্লগার 'পাপ্পানা ডট পিডিএফ!!!' শিরোনামের একটি ব্লগপোস্টে উল্লেখ করেছেন- 'আমি আমার ল্যাপটপে বিজয় ২০০৬ ইনস্টল করলাম। তারপর এটার লে আউট পিডিএফ প্রিন্ট করতে গিয়ে দেখি জেনারেটেড ফাইলের নাম পাপ্পানা ডট পিডিএফ!' তিনি তার ব্লগে এর একটি ছবিও উপস্থাপন করেন।

সময় তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তি দুনিয়ায় আসলে একেবারে মৌলিক কিছু নেই। সৃজনশীল মেধাবীদের অবদানের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই প্রযুক্তি এগিয়ে চলে। তবে এসব বিতর্ক আমাদেরকে অনেককিছুই জানতে, নতুনভাবে ভাবতে সহায়তা করে থাকে। টেকি বা টেকনিক্যাল বিষয়ে শূণ্য পর্যায়ের ধারণা নিয়েও আমার মতো আম পাবলিকও জানতে পারি যে, অভ্র'রও আগে শহিদলিপি নামে একটা অসম্পূর্ণ প্রোগ্রামের কথা। বা বর্ণসফট নামের সফটঅয়্যারের কথা যা শেষ পর্যন্ত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সন্তোষজনক সাফল্য কিংবা জনপ্রিয়তার কিনারায় পৌঁছতে না পারলেও সফল সফটঅয়্যার নির্মাতাদের প্রেরণার উৎস হয়েছিলো ঠিকই।

যখন ভাষা উন্মুক্তির প্রশ্ন
জনগোষ্ঠীর অনুভব অনুভূতির সচল মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা বড় অস্থির, একে ধরেবেঁধে রাখার কথা একান্ত গবেট না হলে কেউ ভাবতে পারে না। স্বতঃস্ফূর্ততা হচ্ছে ভাষার চলিষ্ণুতার নিয়ামক। আর ভাষার আকাশ উন্মুক্ত।
যে জাতি রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার অর্জন করে সে রাষ্ট্রের নাগরিককে যদি তাঁর ভাষা লিপিবদ্ধ করতে আর্থিক বিনিময়মূল্য পরিশোধ করতে হয়, তা বড়ই দুর্ভাগ্যের। ওই রক্ত কি এই মূল্য পরিশোধে যথেষ্ট ছিলো না ! পৃথিবীর তাবৎ কিছুই মূল্যের বিনিময়ে অর্জন করতে পারি, তাই বলে ভাষাকেও অর্থমূল্যের তুলাদণ্ডে উঠিয়ে দিতে হবে ! বিজয় বনাম অভ্র, এই বিতর্কটা চোখে আঙুল দিয়ে সেই ভাবনার উৎসবিন্দুটার দিকেই আমাদের মনোযোগ নিবিষ্ট করে দিলো। এ জন্যে অবশ্যই মোস্তফা জব্বার সাহেব ধন্যবাদ প্রাপ্য। নইলে ভাষা যে খাঁচায় বদ্ধ কোনো পাখি নয় এ বোধটার প্রতি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি পুনঃসচেতন হয়ে ওঠা হতো না আমাদের। আর আমাদের তরুণ মেধাবী প্রজন্মটা যে কতোটা উদার ও ত্যাগী এবং ভাষার প্রশ্নে কেমন একাট্টা তা আবারো অনুভব করার সুযোগটাও তৈরি হতো না আমাদের।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা লাল বাহাদুর শাস্ত্রী'র একটা কথা আপ্তবাক্যের মতো সত্য, নোবোডি কিকস এ্যা ডেড ডগ। অভ্রের গায়ে বিজয়ের খোঁচায় সেটাই আবার প্রমাণীত হলো। তবে এখনো মেলা দূর যেতে হবে আমাদের, অভ্রের।

দেশে থাকি বিধায় অফিসের প্রয়োজনেই আমাকে বিজয় ব্যবহার করতে হয়। প্রকাশনাশিল্পেও বিজয়ের জয়জয়কার। কিন্তু অনলাইনে লেখালেখি করতে হয় ইউনিকোডভিক্তিক সফটঅয়্যারে। সেখানে বিজয় অচল। অতএব আবার লিখো। নয়তো কনভার্টার, আবার এডিট। আবার বিজয়ে ওয়ার্ডের লেখা এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটারে ট্রান্সফার ? সব হিব্রু ! অন্য ফন্ট ? লেখায় এমন ঘুটা হয়ে যায় যে, নিজে নিজে চুল ছিঁড়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই।

নিজের আঙিনার মধ্যে কুকুর মহাবিক্রমধারীই হয়। আমাদের বিজয় মনে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে জিম্মি করে দেশের মধ্যে তার বিক্রমটুকু দেখানোর চেষ্টা করছে স্রেফ পাবলিককে গাধা ভেবে। অভিন্ন ইউনিকোড ফন্ট প্রচলন করে রাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ সময় ও শ্রম এই খাতে বাঁচানো কথাটা রাষ্ট্রনেতা কারোর মাথায় কেন আসে না, তা অবাক ব্যাপার বৈকি ! এতে ইংরেজি ফন্টের মতো সাবলীলতা পেয়ে একটা অভিন্ন বাংলা ফন্টই কোনরূপ বিকৃতি ছাড়া দেশে বিদেশে সমভাবে জ্বলজ্বল করবে,  রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপুল ব্যয় হ্রাস পেয়ে তথ্য আদান-প্রদানে বাধাহীন ব্যাপক গতিশীলতা তৈরি হবে। তা যে হচ্ছে না, এখানেই আমাদের ভাষা-ব্যাপারীদের অর্থগৃধ্নুদার গোপন মাজেজা হয়তো।  কেঁচোর গভীরে এই সাপগুলোকেই আজ চেনার সময় এসে গেছে আমাদের। বাঙালি তার ভাষার অস্তিত্ব নিয়েই দর্পভরে বেঁচে থাকবে। আজ সময় এসেছে অভ্রের মাধ্যমেই ইউনিকোডভিত্তিক ভাষালিপি ব্যবহার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসব বাধাবিঘ্ন দুহাতে ছুঁড়ে ফেলে সবার সৃজনশীলতাকে একাট্টা করে নিজেদেরকে বিকশিত করার। বিজয় বনাম অভ্র বিতর্ক সেই লক্ষ্যটাকেই চিহ্নিত করে দিয়েছে আমাদের।
দুয়েকটা অর্থপিশাচ সব কালে সব জাতিতেই থাকে। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর প্রাণের চাহিদা একাট্টা হলে এই পিশাচরা এমনিতেই পিছু হটে যাবে। আসুন, আমরা সবাই একাট্টা হয়ে আমাদের স্বপ্নগুলোকে লক্ষ্যনিষ্ঠ করি। আমাদের যে আরো বহু দূর যেতে হবে, মাইলস টু গো !
আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে, প্রকাশনা শিল্পে, অফিস আদালতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সর্বক্ষেত্রে আমাদের ভাষাচিহ্ন ইউনিকোডভিত্তিক এক ও অভিন্ন অক্ষরে যূথবদ্ধ করে তোলার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হই, পরবর্তী প্রজন্মের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হবার আগেই।

[এই প্রথম বিজয়বর্জিত এতো বড় একটা লেখা  মুর্শেদের ইউনিকোড লেখনীতে সরাসরি টাইপ করে লিখলাম। একবার মাত্র টাইপ করে একটা লেখাকে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারের যোগ্য পরিবেশ জানি না কবে অর্জিত হবে। তবু স্বপ্ন দেখবোই। দেখতেই থাকবো। ভাষা উন্মুক্ত হবেই।]
...

3 comments:

শিবলী said...

ভাইয়া আমি কি আপনার এই পোষ্টের সবার ওপরের লোগো(অভ্র'র পাশে আছি)টা ব্যাবহার করতে পারি আমার সৃজনশীল ব্লগে
http://srizonshil.blogspot.com/

নীল নক্ষত্র said...

আমার নীল নক্ষত্র এবং স্মৃতি কণা ব্লগে অভ্র প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, আমার এই ক্ষুদ্র সমর্থনের বিষয়টি জানিয়ে গেলাম

নীল নক্ষত্র said...

যদি আরো ভাল কোন পরামর্শ থাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না। অভ্রর সমর্থনে জন্য আমি যে কোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত