Thursday, May 13, 2010

| অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব |

| অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব |
-রণদীপম বসু
কলঙ্ক
খুব বেশিকাল আগের কথা নয়, একসময় সাধারণ পৌর শহরগুলোতেই কিছু কিছু ভ্রাম্যমান নারী-পুরুষ দেখা যেত যাদের কোমরে অনিবার্যভাবে বাঁধা থাকতো একটি ঝাড়ু, আর গলায় বা কোমরে ঝুলানো থাকতো একটি টিনের মগ জাতিয় পাত্র। ঝাড়ুটি হলো তার পেশাগত প্রতীক বা পরিচয়। তাদের কাজ হচ্ছে লোকালয়ের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখা। পেশাগতভাবে এরা পৌর-কর্তৃপক্ষের শুধু যে বেতনভুক কর্মচারী তা-ই নয়, সম্প্রদায়গতভাবেও এদের পেশাটা তা-ই। সামাজিক শ্রমবিন্যাস অনুযায়ী তাদের জন্য অন্য পেশা বরাদ্দ ছিলো না। তাই জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এ পেশাই তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস।  আর সাথের মগটি ছিলো তাদের সামাজিক অবস্থানের এক ভয়াবহ অস্পৃশ্যতার প্রতীক। অর্থাৎ সব ধরনের ছোঁয়াছুয়ির উর্ধ্বে থেকে অন্য কাউকে যাতে কোনরূপ অশূচি হবার বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। পানির তেষ্টা পেলে কোন হোটেল বা চা-দোকানের বাইরে থেকে মগটা বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দোকানের কেউ হয়তো নিরাপদ অবস্থান থেকে ওই মগটিতে পানি ঢেলে দিতো। এমনকি কোন পাবলিক টিউবওয়েলে ছোঁয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এরা অপেক্ষায় থাকতো দয়া করে কেউ যদি টিউবওয়েল চেপে কিছুটা পানি ঐ মগে ঢেলে দেয়। কিংবা টাকা দিয়ে দোকান থেকে চা খেতে চাইলেও চায়ের কাপ স্পর্শ করার অধিকার নেই বলে গরম চা ওই মগেই ঢেলে দেয়া হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্য লোকজনের সাথে এক কাতারে বসার তো প্রশ্নই উঠে না! নিরাপদ দূরত্ব বাঁচিয়ে মাটিতে বসে পড়াটাই তাদের জন্য অনুমোদিত ব্যবস্থা। তারপরও তাদের ছোঁয়ায় ঐ স্থানটা নোংরা হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল থাকতো সবসময়। এরা হলো ধাঙড়, মেথর বা সুইপার। তাদের বসবাসের ব্যবস্থাও সেরকমই। ভদ্রপাড়া থেকে দূরে স্বতন্ত্র কোন বস্তি বা পল্লীতে এদের গোষ্ঠিগত বসবাস। এদের সংস্কৃতি ভিন্ন, জীবনধারা ভিন্ন, উৎসব-উদযাপন সবই ভিন্ন এবং অনিবার্যভাবে গোষ্ঠিগত।


এদেরই একটি অংশ আবার চর্মকার বলে পরিচিত, ভাষার অপভ্রংশতায় যাদেরকে চামার বলে ডাকা হয়। যারা মূলত মৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে জুতো বা চামড়া জাতিয় দ্রব্যাদি তৈরির সাথে জড়িত। এরা সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। সমাজের যে কোন সামাজিক কর্মকাণ্ডে এদের শ্রমের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার এদের নেই। এধরনের আরো বহু সম্প্রদায় রয়েছে আমাদের সমাজে একই রকম অস্পৃশ্য। স্বভাবতই অধিকতর সভ্য ও শিক্ষিত নাগরিকদের বাসস্থান শহরের চিত্র থেকে যদি আমাদের দৃষ্টিটাকে দূরবর্তী পল্লী অঞ্চলের দিকে নিয়ে যাই, তাহলে এই বাস্তবতাই আরো অনেক কঠিন ও তীব্র হয়ে দেখা দেবে। কেননা গ্রামের সামাজিক কাঠামোতে জীবিকার উৎস আরো অনেক বেশি সঙ্কুচিত বলে এসব অস্পৃষ্য সম্প্রদায়গুলোর মানবেতর জীবন-ধারণ খুবই শোচনীয় পর্যায়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের বসবাস থাকে গ্রামের বাইরের দিকে অত্যন্ত অবহেলিতভাবে অবস্থায়। দেখতে শুনতে চেহারায় আকারে অন্য বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মতো হয়েও কেন এরা সামাজিকভাবে এতো অস্পৃশ্য অপাঙক্তেয় ? যুগে যুগে এ প্রশ্নটা যে উত্থাপিত হয়নি তা নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এদের পেশার অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ইদানিং জীবিকার তাগিদে ভাগ বসালেও এই অস্পৃশ্যদের জন্য অন্য পেশায় জড়িত হওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়নি আজো। কারণ অস্পৃশ্যতা এদের গা থেকে মুছে যায়নি বা মুছা হয়নি। অথচ তাদের পেশায় ভাগ বসালেও অন্য সম্প্রদায়কে কিন্তু এই অস্পৃশ্যতার দায় বইতে হয় না। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সমাজ নিয়ন্ত্রিত এই অস্পৃশ্যতার দায় আসলে পেশা বা কর্মগত নয়, সম্পূর্ণই জন্মগত একটা অভিশাপ। কর্মদোষ নয়, জন্মদোষটাই এখানে একমাত্র উপাত্ত। কিন্তু সমাজ বা সামাজিক ব্যবস্থা কি চাইলেই কোন সম্প্রদায়কে অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য বানিয়ে দিতে পারে ? প্রশ্নটা যত সহজে করা যায়, উত্তরটা বোধ করি তত সহজ বা সাবলীল নয়। এর পেছনে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরিতে যে ধর্মীয় বর্ণাশ্রমগত নিপীড়নের ইতিহাস তথা  মানব-দলনের যে ঐতিহ্য বা কালো অধ্যায় মিশে আছে তার শিকড় এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, গোটা সামাজিক সত্তাটাই বুঝি এই বর্ণবাদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে। অর্থাৎ আচারে বিচারে জীবনে যাপনে সামাজিকতায় এই ধর্মীয় বর্ণবাদী ব্যবস্থা থেকে সমাজকে বা সমাজের কোন অংশকে পৃথক করা শরীর থেকে চামড়া আলগা করার মতোই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়ার কোথাও একটু টান পড়লে গোটা শরীরটাই আৎকে ওঠে, বিগড়ে যায়। তাই বলে কি এই সভ্য জগতের তথাকথিত সভ্য মানুষদেরকেও এভাবেই হাজার বছরের কলঙ্ক বয়ে বয়ে যেতে হবে ?

সভ্য মানুষরা তা বয়ে যাচ্ছে বৈ কি ! কেননা আজো যারা এই সমাজ সংসারের অধিকর্তা হিসেবে জন্মগতভাবে মহান উত্তরাধিকার বহন করছে, সেইসব ক্ষমতাসীন উচ্চবর্ণীয়দের অনুকূল এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে পাল্টানোর খায়েশ তাদের হবেই বা কেন !  কিন্তু সমাজের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও একটা আরোপিত ব্যবস্থায় কেবল জন্মগত কারণে নিম্নবর্ণীয় বা অস্পৃশ্য হবার অভিশাপে যাদের সমস্ত অর্জন কুক্ষিগত হয়ে চলে যায় অন্যের অধিকারে, তারা এটা মানবেন কেন ? আসলে এরা কখনোই মানেনি তা। ক্ষমতাহীন এই না-মানার প্রতিবাদ-বিদ্রোহকে তাই দমন করা হয়েছে বড় নিষ্ঠুরভাবে, নির্দয় প্রক্রিয়ায়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয় আমাদেরকে।

বৈদিক নৃশংসতা
ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানতে পারি, মুঘলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর এই আক্রমণেই একদিন ধ্বংস হয়ে যায় এসব আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতাকেই কেউ কেউ হরপ্পা সভ্যতা বা দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিকে দাসে পরিণত করার লক্ষে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠলো মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকলো তার ভিত্তি এক আজব চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলো, এদেরকেই সুকৌশলে করা হলো অছ্যুৎ, দস্যু, সমাজচ্যুত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। চাতুর্যপূর্ণ চতুর্বর্ণের এই অসম সমাজ ব্যবস্থার কুফল সমাজে গভীরভাবে সংক্রমিত হতে থাকলে এই মাটির সন্তান শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। গৌতম বুদ্ধ (Buddha) এ দেশেরই আদিনিবাসী হওয়ায় তাঁর এই সামাজিক বিদ্রোহে আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠি তাঁকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়। ফলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এবং বুদ্ধের নির্বাণলাভ বা মৃত্যুর পর আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্ম। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্মের ডাক।

মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট মহামতি অশোকের (৩০৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্বকালকেই (২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। গৌরবময় আর্যসম্রাট হয়েও মহামতি অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ২৬১) ভয়াবহ রক্তপাত, আহত-নিহতের বিপুল সংখ্যাধিক্য ও যুদ্ধের বীভৎসতায় বিচলিত হয়ে যান। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এই যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি দেখে তিনি বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। প্রচলিত হিন্দুধর্মের মানবাধিকারহীন অসহিষ্ণুতা আর যুদ্ধের পথ ত্যাগ করে তিনি বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মকেই তাঁর আচরিত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর অশোক দেশে ও বিদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর প্রতিনিধিদের পাঠান। জানা যায় তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলংকা পাঠান। এছাড়া তিনি কাশ্মীর, গান্ধার, ভানাভাসী, কোংকন, মহারাষ্ট্র, ব্যকট্রিয়, নেপাল, থাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, লাক্ষাদ্বীপ প্রভৃতি স্থানেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করান।

সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপর নেমে আসে দলন-পীড়ন। ব্রাহ্মণ্যবাদের কালো থাবার নিচে প্রকৃতই চাপা পড়ে যায় আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠির উজ্জ্বল আগামী। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দীর্ঘকালব্যাপী ব্রাহ্মণ্যবাদের এই অত্যাচার নির্যাতন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের কোমরটাই ভেঙে দেয়। শেষপর্যন্ত যাঁরা বেঁচে গেলো তারাও এ দেশ থেকে বিতারিত হলো।

ইতিহাস গবেষক মনীন্দ্র মোহন বসু এ প্রসঙ্গে লিখেন-
‘অবশেষে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধমত তিব্বত, নেপাল প্রভৃতি দেশে যাইয়া আশ্রয়লাভ করিয়াছে। বৌদ্ধধর্মের এই পরাজয় এত সম্পূর্ণ হইয়াছিল যে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থসমূহও ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। থেরবাদী সম্প্রদায়ের গ্রন্থগুলো সিংহল ও ব্রহ্মদেশ হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। আর মহাযান মতের শাস্ত্রসমূহ পাওয়া গিয়াছে প্রধানত চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে। চর্যাপদের পুঁথি নেপালে আবিষ্কার হইয়াছিল। আর ইহার অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে তিব্বতী ভাষায়। এখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের সমাধির স্মৃতিচিহ্ন মাত্রই দৃষ্ট হইয়া থাকে।’
উল্লেখ্য হীনযান বা থেরবাদী মত ও মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধমত বৌদ্ধধর্মেরই দুটি শাখা।

অধ্যাপক হরলাল রায় চর্যাগীতি গ্রন্থে লিখেন-
‘ধর্ম কোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পালি সাহিত্যের সৃষ্টি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণেই বৌদ্ধধর্ম ভারত হতে বিতাড়িত হয়েছিল। … বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমি ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। যারা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল, তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে কুক্ষিগত করে। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা রিক্ত সর্বস্বান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ভারত থেকে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।’

অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি জাতিভেদমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদী চতুর্বর্ণ প্রথার নিগড়ে ভারতের মাটিবর্তি অহিংস বৌদ্ধধর্ম দীর্ঘকাল যাবৎ নিগৃহিত হতে হতে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পতিত হলো। যদিও চীন ও জাপান সহ অনেকগুলো দেশের কোটি কোটি মানুষ বুদ্ধের অহিংস ধর্ম গ্রহণ করে ততদিনে বৌদ্ধ হয়ে গেলেন, ভারতবর্ষ রয়ে গেলো এক বিদ্বেষপূর্ণ অমানবিক বর্ণবাদী বিষাক্ত দর্শনের নিরাপদ প্রজননভূমি হয়ে।

মনুসংহিতা ও  ব্রাহ্মণ্যবাদ
পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ (Manu-smriti) বা ‘মনুসংহিতা’ (Manu-samhita)। ব্রাহ্মণ্যবাদের (Hinduism) আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলো উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোন মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ ব্যাপারে কোন বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং মনুসংহিতা থেকে অনুবাদ ও ভাবার্থসহ কিছু শ্লোকের নমুনা-উদাহরণ টানলেই বিষয়গুলো আমাদের সামনে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।

উল্লেখ্য, মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। কথিত হয় যে মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এ সবকিছু রক্ষার জন্য তাঁর মানব সৃষ্টিও জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষও সৃষ্টি হলো। কিন্তু মানব সৃষ্টি ও পরিপালনের ক্ষেত্রে এসে ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বোধ করি নিজেকে আর সুমহান মর্যাদায় ধরে রাখতে পারেন নি। যে শ্রেণীবিদ্বেষপ্রসূত তীব্র অসমতাভিত্তিক বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেয়া হয়েছে তাতেই সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে যে এটা আদৌ কোন অতিলৌকিক পবিত্র বিধিবিধান কিনা। বরং ধর্মীয় মোড়কে এক ঘৃণ্য আর্থ-সমাজ-রাজনীতির অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক হীন প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। তার পেছনে যে এক অতীব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড প্রতারক গোষ্ঠির সূক্ষ্মতম কারসাজিই কার্যকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন পড়ে না। বিস্তৃত পরিসরে না গিয়ে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের নমুনা-উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারি। এক্ষেত্রে বঙ্গানুবাদসহ উদ্ধৃত শ্লোক ব্যবহারে সদেশ প্রকাশনী কলকাতা থেকে বইমেলা ১৪১২-এ প্রকাশিত মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মনুসংহিতা’ সুলভ সংস্করণ গ্রন্থটির সহায়তা নেয়া হয়েছে।

০১
এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে অতঃপর স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা কি আদতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, না কি কিছু বিভেদপূর্ণ বর্ণ (varnas) (জাতি) সৃষ্টি করলেন, মনুসংহিতা পাঠ করলে তা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়। তবে গোটা গ্রন্থে যেখানে যা কিছুই বলা হয়েছে জাতি হিসেবে ব্রহ্মাসৃষ্ট বর্ণগুলোকেই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-

সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। (১/৮৭)
বঙ্গানুবাদ: এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।

অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। (১/৮৮)
বঙ্গানুবাদ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।

প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। (১/৮৯)
বঙ্গানুবাদ: প্রজারণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।

পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। (১/৯০)
বঙ্গানুবাদ: পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল।

অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।
প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।। (১০/১)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।

এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। (১/৯১)
বঙ্গানুবাদ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, -তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।
উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই। তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ। সন্দেহ তীব্র হলে নিচের শ্লোকগুলো দেখা যেতে পারে-

উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।। (১/৯৩)
বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।

ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।। (১/৯৯)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।

সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।। (১/১০০)
বঙ্গানুবাদ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।

স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।। (১/১০১)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।

ন তং স্তেনা ন চামিত্রা হরন্তি ন চ নশ্যতি।
তস্মাদ্রাজ্ঞা নিধাতব্যো ব্রাহ্মণেষ্বক্ষয়ো নিধিঃ।। (৭/৮৩)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণকে যে ভূমি-অর্থ প্রভৃতি দান করা হয় তা এমনই নিধি (ন্যস্ত সম্পত্তি) যে, সেই নিধি চোরেরা অপহরণ করতে পারে না, শত্রুরা হরণ করতে পারে না, এবং তা নিজেও নষ্ট বা অদৃষ্ট হয় না। এই জন্য রাজার কর্তব্য হল, ব্রাহ্মণগণের কাছে এই অক্ষয় নিধি ন্যস্ত করা।

সমমব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণব্রুবে।
প্রাধীতে শতসাহস্রমনন্তং বেদপারগে।। (৭/৮৫)
বঙ্গানুবাদ: অব্রাহ্মণকে যে বস্তু দান করা হয় তার সমপরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার দ্বারা অতিরিক্ত ফল হয় না। ব্রাহ্মণব্রুবকে (অর্থাৎ যিনি জাতিমাত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণোচিত গুণসম্পন্ন নন) দান করলে পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ফল লাভ হয়। যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করেছেন, তাঁকে দান করলে লক্ষগুণ ফল লাভ হয়; এবং যিনি সমস্ত বেদশাখাধ্যেতা বেদপারগ ব্রাহ্মণ, তাঁকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়।
বুঝাই যাচ্ছে, কথিত ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ হতে সৃষ্ট বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই জগদীশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অতএব কাউকে কর দিয়ে ব্রাহ্মণের চলার কথা নয়। এবং তা-ই মনুসংহিতার পাতায় পাতায় খুব ভালোভাবে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
মনুশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য হিসেবে নিরাপদে রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজনেই প্রজাদের কাছ থেকে কর ধার্য্য ও গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে-

নোচ্ছিন্দ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাঞ্চাতিতৃষ্ণয়া।
উচ্ছিন্দন্ হ্যাত্মনো মূলমাত্মানং তাংশ্চ পীড়য়েৎ।। (৭/১৩৯)
বঙ্গানুবাদ: কর, শুল্ক প্রভৃতি গ্রহণ না করে রাজা নিজের মূলোচ্ছেদন করবেন না অর্থাৎ রাজকোষ শূন্য করবেন না; এবং অতিলোভবশতঃ বেশি কর নিয়ে প্রজাদেরও মূল নষ্ট করবেন না। কারণ, এইভাবে নিজের ও পরের মূলোচ্ছেদ ঘটালে নিজেকে এবং প্রজাবর্গকে উৎপীড়িত করা হয়।
অতএব কার কাছ থেকে কিভাবে কী পরিমাণ কর আদায় করা হবে তার বিস্তারিত শ্লোক-বয়ান মনুশাস্ত্রে উদ্ধৃত রয়েছে। তবে সাধারণসূত্রে বলা হচ্ছে-

যৎ কিঞ্চিদপি বর্ষস্য দাপয়েৎ করসংজ্ঞিতম্।
ব্যবহারেণ জীবন্তং রাজা রাষ্ট্রে পৃথগ্জনম্।। (৭/১৩৭)
বঙ্গানুবাদ: যে সব ‘পৃথগ্জন’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয় ছাড়া অন্য লোক কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি কোনও একটি ব্যবহার অর্থাৎ বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের কাছ থেকে রাজা বার্ষিক যৎ কিঞ্চিৎ হলেও কর গ্রহণ করবেন।
যে ব্রাহ্মণ কল্পশাস্ত্রের সাথে এক বেদ অথবা ব্যাকরণ প্রভৃতি ছয়টি বেদাঙ্গের সাথে বেদশাখা অধ্যয়ন করেন এবং বেদাধ্যয়নাদি কাজে নিরত থাকেন, তাঁকে ‘শ্রোত্রিয়’ বলা হয়। উপরোক্ত ৭/১৩৭ সংখ্যক শ্লোকে এই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয়ের কাছ থেকে কোনরূপ কর গ্রহণকে নিরস্ত করা হয়েছে। তবে মনুসংহিতার ১০/১২৯ সংখ্যক শ্লোকের দ্বারা (পরবর্তীতে নিচে বর্ণিত হয়েছে) শূদ্রের ধন-সম্পদ অর্জনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও শূদ্রের কাছ থেকে কর আদায় নিষিদ্ধ হয়নি। যেহেতু তার অর্জিত সম্পদ থাকার কথা নয়, তাই এই কর পরিশোধ হবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে-

কারুকান্ শিল্পিনশ্চৈব শূদ্রাংশ্চাত্মোপজীবিনঃ।
একৈকং কারয়েৎ কর্ম মাসি মাসি মহীপতিঃ।। (৭/১৩৮)
বঙ্গানুবাদ: পাচক, মোদক প্রভৃতি কারুক এবং কাংস্যকার, লৌহকার, শঙ্খকার প্রভৃতি শিল্পী ও কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকানির্বাহকারী শূদ্র- এদের দ্বারা রাজা প্রতি মাসে একদিন করে নিজের কাজ করিয়ে নেবেন।
কিন্তু পরধন অর্জনে মত্ত ব্রাহ্মণের কাছে কোনক্রমেই কর নেয়া যাবে না। অর্থাভাবে রাজা মরণাপন্ন হলেও ক্ষতি নেই, তবু কোন ব্রাহ্মণ যেন রাজার রাজ্যে ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন, এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে-

ম্রিয়মাণোহপ্যাদদীত ন রাজা শ্রোত্রিয়াৎ করম্।
ন চ ক্ষুধাহস্য সংসীদেচ্ছ্রোত্রিয়ো বিষয়ে বসন্।। (৭/১৩৩)
বঙ্গানুবাদ: রাজা ধনাভাবে মরণাপন্ন হলেও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনও যেন কর গ্রহণ না করেন। রাজার রাজ্যে বাস করতে থেকে কোনও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ যেন ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন।
মনুসংহিতার পরতে পরতে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা প্রদান আর নিম্নবর্ণ শূদ্রের নিচত্ব ও তাকে বঞ্চনা করার কৌশল বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, রাজকার্যে ও বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে সবাইকে উদ্ধারের নিমিত্তে ক্ষমতাসীন পরামর্শক ব্রাহ্মণের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। প্রয়োজনীয় গুণ ও যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক ব্রাহ্মণ হলেই হলো, এবং তা-ই হতে হবে। কিন্তু যত যোগ্যতা বা গুণের আধারই হোক শূদ্রকে কিছুতেই নিয়োগ মর্যাদা দেয়া যাবে না।

জাতিমাত্রোপজীবী বা কামং স্যাদ্ব্রাহ্মণব্রুবঃ।
ধর্মপ্রবক্তা নৃপতের্ন তু শূদ্রঃ কথঞ্চন।। (৮/২০)
বঙ্গানুবাদ: বিদ্যা ও গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণের অভাব হলে রাজা জাতিমাত্রোপজীবী অর্থাৎ জাতিসর্বস্ব ব্রাহ্মণকে অথবা ক্রিয়ানুষ্ঠানবিহীন ব্রাহ্মণব্রুবকেও (অর্থাৎ নামে মাত্র ব্রাহ্মণকেও) নিজের ধর্মপ্রবক্তার পদে (শাস্ত্রীয় আইন বিশ্লেষক) নিযুক্ত করবেন, কিন্তু শূদ্র যদি সর্বগুণসম্পন্ন, ধার্মিক এবং ব্যবহারজ্ঞও হয়, তবুও তাকে ঐ পদে নিয়োগ করতে পারবেন না।
শাস্ত্র বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্রাহ্মণকেই ধর্মপ্রবক্তা করার বিধান থাকায় বিদ্বান্ ব্রাহ্মণকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করতে হয়। কাজেই ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্য তিন বর্ণের লোককে ধর্ম নিরূপণের কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। তবুও এখানে শূদ্রকে ঐ কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করার তাৎপর্য হলো, ঐ কাজের জন্য উপযুক্ত বিদ্বান ব্রাহ্মণ পাওয়া না গেলে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যকে ঐ কাজে হয়তো নিয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই শূদ্রকে নয়। এই ব্রহ্মবিধি ভঙ্গ হলে কী পরিণতি হবে তাও মনুশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-

যস্য শূদ্রস্তু কুরুতে রাজ্ঞো ধর্মবিবেচনম্।
তস্য সীদতি তদ্রাষ্ট্রং পঙ্কে গৌরিব পশ্যতঃ।। (৮/২১)
বঙ্গানুবাদ: বিচারসভায় যে রাজার সাক্ষাতে শূদ্র ন্যায়-অন্যায় ধর্ম বিচার করে, সেই রাজার রাজ্য কাদায় নিমগ্ন গোরুর মতো দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়।

যদ্রাষ্ট্রং শূদ্রভূয়িষ্ঠং নাস্তিকাক্রান্তমদ্বিজম্।
বিনশ্যত্যাশু তৎ কৃৎস্নং দুর্ভিক্ষব্যাধিপীড়িতম্।। (৮/২২)
বঙ্গানুবাদ: যে রাজ্য ধর্মাধিকরণে (বিবাদ নিরূপণের ব্যাপারে-) শূদ্রের প্রাধান্য ও নাস্তিকদের প্রভুত্ব, এবং যেখানে দ্বিজগণের (ব্রাহ্মণদের) অভাব, সেই রাজ্য দুর্ভিক্ষ ও নানারকম রোগে পীড়িত হয়ে অতি শীঘ্রই বিনষ্ট হয়।
অপরাধ সংঘটন হলে রাজার বিচারে দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনুসংহিতার ৮/৩৭৯ সংখ্যক শ্লোক অনুযায়ী শাস্ত্রের বিধান হলো- প্রাণদণ্ডের যোগ্য অপরাধেও ব্রাহ্মণের এই দণ্ড বা অঙ্গচ্ছেদনাদি করা যাবে না। যদিও অন্যান্য বর্ণের পক্ষে বধাদি প্রাণদণ্ডই বিধেয়। এছাড়া মনুশাস্ত্রে আরো বলা হচ্ছে-

ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্থিতম্।
রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্।। (৮/৩৮০)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে কোনও পাপ বা অপরাধই করুক না কেন (যত কিছু অপরাধ আছে সে সবগুলি একসাথে অনুষ্ঠান করলেও) রাজা তাকে হত্যা করবেন না; পরন্তু সমস্ত ধনের সাথে অক্ষত শরীরে তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করবেন।
কারণ-
ন ব্রাহ্মণবধাদ্ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি।
তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ।। (৮/৩৮১)
বঙ্গানুবাদ: এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম (অর্থাৎ পাপ) আর কিছুই নেই। এই কারণে ব্রাহ্মণকে বধ (এবং অঙ্গচ্ছেদনাদি) করার কথা রাজা কখনও মনে মনেও চিন্তা করবেন না।

০২
মনুষ্য সমাজে সন্তান জন্ম নিলে তার একক পরিচিতির জন্যে একটি নামের প্রয়োজন হয়। অবশ্য পালনীয় বৈদিক বিধি মনুসংহিতায় তা অস্বীকার করা হয়নি। তবে বর্ণপ্রথার কঠিন নিগড় নামকরণ ব্যবস্থার মধ্যেও পরিয়ে দেয়া হয়েছে সুকৌশলে। বিধি অনুসারে এমনভাবে নামকরণ করতে হবে, নাম থেকেই যেন বুঝা যায় কে উচ্চবর্ণের প্রভুবংশীয় এবং কে নিম্নবর্গীয় দাসজাত শূদ্রবংশীয়।

মঙ্গল্যং ব্রাহ্মণস্য স্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য বলান্বিতম্।
বৈশ্যস্য ধনসংযুক্তং শূদ্রস্য তু জুগুপ্সিতম্।। (২/৩১)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক শব্দ (‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম’; সেই ধর্মের সাধক ‘মঙ্গল্য’; ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবতাবাচক শব্দ বা ঋষিবাচক শব্দ মঙ্গলের সাধন, তাই ‘মঙ্গল্য’; যেমন- ইন্দ্র, বায়ু, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি); ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলসূচক শব্দ (যেমন, প্রজাপাল, দুর্যোধন, নৃসিংহ প্রভৃতি); বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক অর্থাৎ পুষ্টিবৃদ্ধিসমন্বিত (যেমন ধনকর্মা, গোমান, ধনপতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নাম হবে জুগুপ্সিত (নিন্দা বা হীনতাবোধক, যেমন- কৃপণক, দীন, শবরক ইত্যাদি)।

শর্মবদ্বাহ্মণস্য স্যাদ্ রাজ্ঞো রক্ষাসমন্বিতম্।
বৈশ্যস্য পুষ্টিসংযুক্তং শূদ্রস্য প্রৈষ্যসংযুতম্।। (২/৩২)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের নামের সাথে শর্মা এই উপপদ যুক্ত হবে (অর্থাৎ আগে মঙ্গলবাচক শব্দ তারপর ‘শর্মা’ এই উপপদ যুক্ত হবে; যেমন শুভশর্মা), ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে ‘বর্মা’ বা এইরকম কোনও রক্ষাবাচক উপাধি যুক্ত হবে; (যেমন বলবর্মা), বৈশ্যের নামের সাথে যুক্ত হবে ‘বৃদ্ধ, গুপ্ত, ভূতি’ প্রভৃতি পুষ্টিবোধক উপপদ (যেমন গোবৃদ্ধ, ধনগুপ্ত, বসুভূতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নামের উপাধি হবে প্রৈষ্য (দাস বা ভৃত্য) বাচক শব্দ (যেমন দীনদাস, ব্রাহ্মণদাস, দেবদাস প্রভৃতি)।
আর স্ত্রী-জাতির নামের ক্ষেত্রে ?

স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।
মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।। (২/৩৩)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)।
যাই হোক, পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক ক্ষেত্র বা আবহ তৈরি করে, বৈদিক ঈশ্বরের মনেও তা রেখাপাত করতে পেরেছে বলে মনে হয়। ভাবতে ভালোই লাগে, ঈশ্বর কি তাহলে পুরুষ সম্প্রদায়ের কেউ ? অবশ্য মনুসংহিতায় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ব্রহ্মা তো পুরুষগুণবাচকই। সেভাবেই তাঁকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যাবার আগে এই সংহিতা বা শাস্ত্র রচিত হবার শাস্ত্র-বর্ণিত ইতিহাস অতি সংপ্তিভাবে জেনে রাখলে শাস্ত্রবিধিগুলো অনুধাবনে সহায়তা হতে পারে।

স্বয়ম্ভু ভগবান কর্তৃক পূর্বে অপ্রকাশিত এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি ও সংহারের পর্যায়ক্রমিক বিশদ বর্ণনার এক পর্যায়ে এসে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে-

এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্।
সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।। (১/৫৭)
বঙ্গানুবাদ: এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই এই শাস্ত্র প্রস্তুতির উল্লেখ-

ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাসৌ মামেব স্বয়মাদিতঃ।
বিধিবদ্ গ্রাহয়ামাস মরীচ্যাদীংস্ত্বহং মুনীন্।। (১/৫৮)
বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে আমাকে যথাবিধি অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং আমি (মনু) মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করিয়েছি।

প্রখ্যাত শাস্ত্রভাষ্যকার মেধাতিথি মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৫৮ সংখ্যক শ্লোকের ভাষ্যে বলেন- “নারদশ্চ স্মরতি। শতসাহস্রো গ্রন্থঃ প্রজাপতিনা কৃতঃ স মন্বাদিভিঃ ক্রমেণ সংক্ষিপ্ত ইতি।” অর্থাৎ এখানে নারদ বলছেন- “এই গ্রন্থ শতসাহস্র বা লক্ষ সন্দর্ভাত্মক; প্রজাপতি (ব্রহ্মা) এটি রচনা করেছেন। তারপর ঐ লক্ষ সন্দর্ভটিকে ক্রমে ক্রমে মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ সংক্ষিপ্ত করেছেন।

এই একই শ্লোকের টিকায় কুল্লুকভট্ট নারদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন- ব্রহ্মা প্রথমে স্মৃতিগ্রন্থটি প্রণয়ন করেন; তারপর মনু নিজ ভাষায় তার সারসংক্ষেপ করেন এবং সেই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটিই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন।

পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে। মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে (শ্লোক ৩২-৩৫) দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে বিরাট্ পুরুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং সেই বিরাট্ পুরুষ তপস্যার দ্বারা মনু-কে সৃষ্টি করেছিলেন। মনু আবার প্রজাসৃষ্টির অভিলাষে ক্লেশকর তপস্যা করে যে দশজন প্রজাপতি (এঁরা সকলেই মহর্ষি) সৃষ্টি করলেন তাঁরা হলেন- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু এবং নারদ। প্রথম অধ্যায়ের শ্লোক ৫৮-৫৯ অনুযায়ী বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা মনুসংহিতায় আলোচনীয় শাস্ত্র অর্থাৎ বিধিনিষেধসমূহ প্রস্তুত করে প্রথমে মনু-কে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং তারপর মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পড়িয়েছিলেন। ভৃগুমনি এই সম্পূর্ণশাস্ত্র মনুর কাছে অধ্যয়ন করলেন। চারটি বর্ণের ও সঙ্কর জাতিগণের ধর্মসমূহ জানার উদ্দেশ্যে মনু-সমীপে আগত মহর্ষিদের মনু জানালেন যে, তিনি এইসব শাস্ত্র ভৃগুকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই ভৃগুই ঐ শাস্ত্র আদ্যোপান্ত সকলকে শোনাবেন। মনুকর্তৃক এইভাবে আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি ভৃগু খুশি হয়ে সকল ঋষিকে তাঁদের জিজ্ঞাস্যের উত্তর দিতে লাগলেন- এভাবেই মনুসংহিতা ভৃগু কর্তৃক সংস্কার ও সংকলিত হয়ে প্রচারিত হলো। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের অন্তিম শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়-

ইত্যেতন্মানবং শাস্ত্রং ভৃগুপ্রোক্তং পঠন্ দ্বিজঃ।
ভবত্যাচারবান্নিত্যং যথেষ্টাং প্রাপ্লুয়াদ্ গতিম্।। (১২/১২৬)
বঙ্গানুবাদ: ভৃগুর দ্বারা কথিত এই মনু-সৃষ্ট-শাস্ত্র নিয়মিত পাঠ করতে থাকলে দ্বিজগণ সতত আচারনিষ্ঠ হন এবং যথাভিলষিত উৎকৃষ্ট গতি অর্থাৎ স্বর্গ লাভ করেন।
কিন্তু এ মুহূর্তে স্বর্গ লাভের বদলে আমাদের প্রয়োজন মনুসংহিতা গ্রন্থটি অলৌকিকতার মোড়কে লৌকিক বর্ণাশ্রমপ্রসূত কী ভয়ানক জাতি-বিভেদ ও বর্ণ-বিদ্বেষে দুষ্ট তা অনুধাবন করা। তাই প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ফিরে আসাই উত্তম।

০৩
মনুসংহিতায় নারীকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে তা মনুর শ্লোক থেকেই ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়-

ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।
ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।। (৯/৩৩)
বঙ্গানুবাদ: নারী শস্যক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি।

বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূতপ্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।। (৯/৩৫)
বঙ্গানুবাদ: বীজ ও যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণযুক্ত হয়ে থাকে।
শাস্ত্রীয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত মনুশাস্ত্রে শস্যক্ষেত্ররূপী নারীর চেয়ে বীজরূপ পুরুষেরই শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে তা কি আর বলতে হয় ! তবে পবিত্র শাস্ত্র এটা প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি। নারী যে একটা নিকৃষ্ট কামজ সত্ত্বা তা প্রমাণেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে-

স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ্ দূষণম্।
অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।। (২/২১৩)
বঙ্গানুবাদ: ইহলোকে (শৃঙ্গার চেষ্টার দ্বারা মোহিত করে) পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব; এই কারণে পণ্ডিতেরা স্ত্রীলোকসম্বন্ধে কখনোই অনবধান হন না।

মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।। (২/২১৫)
বঙ্গানুবাদ: মাতা, ভগিনী বা কন্যার সাথে কোনও পুরুষ নির্জন গৃহাদিতে বাস করবে না, কারণ ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান্ (চঞ্চল) যে, এরা (শাস্ত্রালোচনার দ্বারা আত্মসংযম অভ্যাস করতে পেরেছেন এমন) বিদ্বান্ ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে (অর্থাৎ কামক্রোধাদির বশবর্তী করে তোলে)।
অর্থাৎ তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও আসলে পুরুষ অভব্যই হয়, এবং তার দুরাচারকে সুকৌশলে ব্রহ্মবাক্য দিয়ে শেষপর্যন্ত নারীর উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। নারী যে আসলে মানুষ নয়, অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতোই পুরুষের ব্যবহারযোগ্য উপভোগের সামগ্রী মাত্র তা নিচের শ্লোক থেকে বুঝতে কি কোন সমস্যা হয় ?

স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।
বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।। (২/২৪০)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে।
মনুশাস্ত্রে আসলে নারীর স্বাধীনতা কখনোই স্বীকার করা হয়নি-

বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।
ন স্বাতস্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহেষ্বপি।। (৫/১৪৭)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বালিকাই হোক, যুবতীই হোক কিংবা বৃদ্ধাই হোক, সে গৃহমধ্যে থেকে কোনও কাজই স্বামী প্রভৃতির অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না।

বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পানিগ্রাহস্য যৌবনে।
পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্।। (৫/১৪৮)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায় পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনকালে পাণিগ্রহীতার অর্থাৎ স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রদের অধীনে থাকবে। (পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ড, স্বামীর সপিণ্ড না থাকলে পিতার সপিণ্ড এবং পিতার সপিণ্ড না থাকলে রাজার বশে থাকবে), কিন্তু কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না।
উল্লেখ্য যে, সপিণ্ড মানে যিনি মৃতব্যক্তির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পিণ্ড দানের যোগ্য। হিন্দুশাস্ত্রে পিণ্ডদানের ক্রমাধিকারের সাথে সম্পত্তির অধিকার অর্জনের বিষয়ও জড়িত।

পিত্রা ভর্ত্রা সুতৈর্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।
এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্যাদুভে কুলে।। (৫/১৪৯)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোক কখনো পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না; কারণ, স্ত্রীলোক এদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে পিতৃকুল ও পতিকুল- উভয় কুলকেই কলঙ্কিত করে তোলে।

বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।
উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।। (৫/১৫৪)
বঙ্গানুবাদ: স্বামী বিশীল (অর্থাৎ জুয়াখেলা প্রভৃতিতে আসক্ত এবং সদাচারশূন্য), কামবৃত্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীতে অনুরক্ত) এবং শাস্ত্রাধ্যায়নাদি ও ধনদানাদি গুণবিহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রীর কর্তব্য হল স্বামীকে দেবতার মতো সেবা করা।

কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।
ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।। (৫/১৫৭)
বঙ্গানুবাদ: পতি মৃত হলে স্ত্রী বরং পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি অল্পাহারের দ্বারা জীবন ক্ষয় করবে, কিন্তু ব্যভিচারবুদ্ধিতে পরপুরুষের নামোচ্চারণও করবে না।
অর্থাৎ নারীর কোন জৈবিক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না। এই চাওয়া-পাওয়াকে পবিত্র মনুশাস্ত্রে স্বীকার করা হয়নি। তবে নারীর ক্ষেত্রে জৈবনিক চাহিদাকে স্বীকার করা না হলেও শাস্ত্রে পুরুষের কামচরিতার্থতার প্রয়োজনকে কিন্তু অস্বীকার করা হয়নি, বরং তা পূরণের জন্য পবিত্র বিধানও তৈরি করে দেয়া হয়েছে-

ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।
পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।। (৫/১৬৮)
বঙ্গানুবাদ: (সুশীলা-) ভার্যা স্বামীর পূর্বে মারা গেলে তার দাহাদি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে পুরুষ পুনরায় দারপরিগ্রহ ও অগ্ন্যাধ্যান করবে (যদি ধর্মানুষ্ঠান ও কামচরিতার্থতার প্রয়োজন থাকে, তবেই ঐ স্বামীর পুনরায় দারপরিগ্রহ করা উচিৎ। তা না হলে পত্নী নেই বলে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস অবলম্বন করতে পারে)।
যারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থে নারী-পুরুষের সমতা খুঁজে বেড়ান, তারা আসলে কী যে খুঁজেন বুঝা দায়। তবে  মনুশাস্ত্রে স্ত্রীর মর্যাদা কতটুকু তা এই শ্লোক থেকেও কিঞ্চিত অনুধাবন করা যেতে পারে-

ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ শিষ্যো ভ্রাতা চ সোদরঃ।
প্রাপ্তাপরাধাস্তাড্যাঃ স্যূ রজ্জ্বা বেণুলেন বা।। (৮/২৯৯)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য, শিষ্য এবং কনিষ্ঠ সহোদরভ্রাতা অপরাধ করলে সূক্ষ্ম দড়ির দ্বারা কিংবা বেতের দ্বারা শাসনের জন্য প্রহার করবে।
তবে প্রিয়জনকে প্রহার বলে কথা, তাই শাস্ত্র কি এতোটা নির্দয় হতে পারে ! প্রহারের নিয়মও বলে দেয়া হয়েছে-

পৃষ্ঠতস্তু শরীরস্য নোত্তমাঙ্গে কথঞ্চন।
অতোহন্যথা তু প্রহরন্ প্রাপ্তঃ স্যাচ্চৌরকিল্বিষম্।। (৮/৩০০)
বঙ্গানুবাদ: রজ্জু প্রভৃতির দ্বারা প্রহার যদি করতে হয়, তাহলে শরীরের পশ্চাদ্ভাগে প্রহার কর্তব্য; কখনো উত্তমাঙ্গে বা মাথায় যেন প্রহার করা না হয়; এই ব্যবস্থার অন্যথা করে অন্যত্র প্রহার করলে প্রহারকারী চোরের মতো অপরাধী ও দণ্ডনীয় হবে।
তারপরও এসব হচ্ছে শাস্ত্রবাক্য। আর শাস্ত্র কি উচিত কথা বলতে কার্পণ্য করতে পারে ? তাই বলা হচ্ছে-

ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।। (৮/৪১৬)
বঙ্গানুবাদ: স্মৃতিকারদের মতে ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পে অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে।
দাসী হোক বাঁদী হোক, তবু তো স্ত্রী, তাকে ছাড়া পুরুষের চলেও না। তাই মনুসংহিতায় পুরুষদেরকে স্ত্রী-স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞাত করা না হলে কি চলে !

শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জবম্।
দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।। (৯/১৭)
বঙ্গানুবাদ: বেশি নিদ্রা যাওয়া, কেবল বসে থাকার ইচ্ছা, শরীরকে অলংকৃত করা, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, নীচহৃদয়তা, অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কুচর্মা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা- স্ত্রীলোকদের এই সব স্বভাব মনু এদের সৃষ্টি-কালেই করে গিয়েছেন।
এরকম অদ্ভুত বক্তব্য মনুশাস্ত্রে নিতান্ত কম নয়। তাই বোধ করি শাস্ত্র অত্যন্ত সচেতনভাবেই স্ত্রী-রক্ষকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে-

ইমং হি সর্ববর্ণানাং পশ্যন্তো ধর্মমুত্তমম্।
যতন্তে রক্ষিতুং ভার্যাং ভর্তারো দুর্বলা অপি।। (৯/৬)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোককে রক্ষণরূপ-ধর্ম সকল বর্ণের পক্ষে শ্রেষ্ঠ ধর্ম- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। এই ব্যাপার বুঝে অন্ধ, পঙ্গু প্রভৃতি দুর্বল স্বামীরাও নিজ নিজ স্ত্রীকে রক্ষা করবার জন্য যত্ন করবে।
প্রশ্ন হতে পারে, স্ত্রী-রক্ষায় এতোটা গুরুত্ব দেয়া হলো কেন ? কারণ-

স্বাং প্রসূতিং চরিত্রঞ্চ কুলমাত্মানমেব চ।
স্বঞ্চ ধর্মং প্রযত্নেন জায়াং রক্ষন্ হি রক্ষতি।। (৯/৭)
বঙ্গানুবাদ: যে লোক যত্নের সাথে নিজের স্ত্রীকে রক্ষ করে, তার দ্বারা নিজ সন্তান রক্ষিত হয়। কারণ, সাঙ্কর্যাদি দোষ না থাকলে বিশুদ্ধ সন্তান-সন্ততি জন্মে। স্ত্রীকে রক্ষার দ্বারা শিষ্টাচার রক্ষিত হয় এবং নিজের কুলমর্যাদা রক্ষিত হয়। স্ত্রীকে রক্ষা করলে নিজেকেও রক্ষা করা হয় এবং স্ত্রীকে রক্ষা করলে স্বামী তার নিজের ধর্মকেও রক্ষা করতে পারে।
তাই, কিভাবে স্ত্রীকে রক্ষা করতে হবে তার উপায়ও মনু বাতলে দিয়েছেন-

ন কশ্চিদ্যোষিতঃ শক্তঃ প্রসহ্য পরিরক্ষিতুম্।
এতৈরুপায়যোগৈস্তু শক্যাস্তাঃ পরিরক্ষিতুম্।। (৯/১০)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকসমূহকে কেউ বলপূর্বক বা সংরোধ বা তাড়নাদির দ্বারা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বক্ষ্যমাণ উপায়গুলি অবলম্বন করলে তাদের রক্ষা করা যায়।
কী উপায় ?

অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।
শৌচে ধর্মেহন্নপক্ত্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।। (৯/১১)
বঙ্গানুবাদ: টাকাকড়ি ঠিকমত হিসাব করে জমা রাখা এবং খরচ করা, গৃহ ও গৃহস্থালী শুদ্ধ রাখা, ধর্ম-কর্ম সমূহের আয়োজন করা, অন্নপাক করা এবং শয্যাসনাদির তত্ত্বাবধান করা- এই সব কাজে স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করে অন্যমনস্ক রাখবে।
মূলত মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে-

নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।। (৯/১৮)
বঙ্গানুবাদ: স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ,  -এই হলো শাস্ত্রস্থিতি।
০৪
সম্পদ অর্জন এবং তা নিজের অধিকারে রাখার প্রচেষ্টা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এককালে ব্যক্তির উত্তরাধিকার তৈরি জরুরি হয়ে পড়ে। এবং এ কারণেই মানব সমাজে বিবাহপ্রথার সৃষ্টি হয় বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। বৈদিক সমাজে বিবাহকে অন্যতম ধর্মানুষ্টানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথার তীব্র উপস্থিতি। বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় শূদ্রনারীকে উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা ভোগ করার ব্যবস্থা পাকা করা হলেও শূদ্রদের জন্য কোন মর্যাদা বা সুযোগ না রেখে সর্বতোভাবে বঞ্চিত করার কূটকৌশলী প্রয়াস মনুসংহিতার বিবাহ ব্যবস্থায় তীব্রভাবে লক্ষ্যণীয়।

সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।। (৩/১২)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে বক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (পরবর্তী শ্লোকে তা বর্ণিত হয়েছে)

শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।
তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজম্মনঃ।। (৩/১৩)
বঙ্গানুবাদ: একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে।
অর্থাৎ এখানে ‘অনুলোম’ বিবাহের বিষয়টিকেই অনুমোদন করা হয়েছে। উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের কন্যার বিবাহকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিবাহের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিবাহ সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সাথে বিবাহই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এখানেও অন্য ভার্যায় সমস্যা নেই, শূদ্রা ভার্যার ক্ষেত্রেই যত বিপত্তি।

দৈবপিত্র্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।
নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।। (৩/১৮)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ বা যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম যেমন শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়।)
অর্থাৎ শূদ্রা নারী ব্রাহ্মণের প্রথম পরবর্তী ভার্যা হয়ে ব্রহ্মভোগের বস্তু হলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীর কোনো মর্যাদাই তার প্রাপ্য হয় না। আর যদি সে প্রথম বিয়ে করা স্ত্রী হয় ?

শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।। (৩/১৭)
বঙ্গানুবাদ: সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন (অর্থাৎ সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়)।
এছাড়া ব্যভিচারের দণ্ডের ক্ষেত্রেও বৈষম্যবাদী বর্ণপ্রথা চোখে পড়ার মতো-

শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্।
অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।। (৮/৩৭৪)
বঙ্গানুবাদ: কোনও দ্বিজাতি-নারী (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ত্রিয় ও বৈশ্য নারী) স্বামীর দ্বারা রক্ষিত হোক্ বা না-ই হোক্, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরক্ষিতা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে, আর যদি স্বামীর দ্বারা রক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ঐ শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে।
অথচ উচ্চবর্ণিয়দের ক্ষেত্রে একই অপরাধের জন্য বিবিধ বিধানের মাধ্যমে মনুশাস্ত্রে বর্ণক্রমানুসারে বিভিন্ন মাত্রার কিছু অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে মাত্র।

০৫
বৈদিক শাস্ত্র মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে যে, ব্রহ্মা তাঁর পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ শূদ্রের জন্ম নিজে নিজে বা তার ইচ্ছায় হয়নি বা এ প্রক্রিয়ায় তার কোন কর্মদোষও জড়িত নেই। জড়িত কেবল স্রষ্টা ব্রহ্মার তীব্র বৈষম্যমূলক দৃষ্টি। অথচ মনুসংহিতায় শূদ্রের প্রতি অন্য বর্ণকে যে অমানবিক আচরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা এককথায় ন্যাক্কারজনক।

ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবিষ্কৃতম্।
ন চাস্যোপদিশেদ্ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ।। (৪/৮০)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না।
কেউ এ বিধান অমান্য করলে তার পরিণতি বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

যো হ্যস্য ধর্মমাচষ্টে যশ্চৈবাদিশতি ব্রতম্।
সোহসংবৃতং নাম তমঃ সহ তেনৈব মজ্জতি।। (৪/৮১)
বঙ্গানুবাদ: যে ব্যক্তি (কোন ব্রাহ্মণকে ব্যবধানে না রেখে) নিজে শূদ্রকে ধর্মোপদেশ দেন, বা প্রায়শ্চিত্তাদি ব্রতের অনুষ্ঠান করতে আদেশ দেন, তিনি সেই শূদ্রের সাথে অসংবৃত নামক গহন নরকে নিমগ্ন হন।
উল্লেখ্য যে, মনুশাস্ত্রে শূদ্রের কোনরূপ সম্পদ অর্জনকেও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।। (১০/১২৯)
বঙ্গানুবাদ: ‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷’
এই যখন অবস্থা- সম্পদ অর্জন নয়, কোনরূপ খাবার সরবরাহও নয়, তাহলে শূদ্রদের বেঁচে থাকার উপায় ? উপায় একটা রয়েছে বৈ কি। এক্ষেত্রে যেসব জন্মদাস শূদ্র ব্রাহ্মণ বা অন্য উচ্চবর্ণীয়দের সেবা শুশ্রূষায় কৃতপরায়ণ হবে তাদের প্রতি অবশ্য কিছুটা করুণা দেখানো হয়েছে। যেমন-

শূদ্রাণাং মাসিকং কার্যং বপনং ন্যায়বর্তিনাম্।
বৈশ্যবচ্ছৌচকল্পশ্চ দ্বিজোচ্ছিষ্টঞ্চ ভোজনম্।। (৫/১৪০)
বঙ্গানুবাদ: ন্যায়চরণকারী শূদ্রগণ (অর্থাৎ সে সব শূদ্র ব্রাহ্মণ-শুশ্রূষা পরায়ণ) মাসে মাসে কেশ বপন (অর্থাৎ কেশমুণ্ডন) করবে এবং জননশৌচে ও মরণাশৌচে বৈশ্যের মত অশৌচ পালনের পর শুদ্ধ হবে এবং ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট ভোজন করবে।

উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ।। (১০/১২৫)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ-পরিত্যক্ত বস্ত্র, ধানের পুলাক অর্থাৎ আগড়া (অসার ধান) এবং জীর্ণ পুরাতন ‘পরিচ্ছদ’ অর্থাৎ শয্যা-আসন প্রভৃতি আশ্রিত শূদ্রকে দেবেন।
মনুসংহিতায় বর্ণিত সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বর্ণবৈষম্যের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। অধমর্ণদের প্রতি উত্তমর্ণের খারাপ আচরণের দণ্ডের সাথে উত্তমর্ণের প্রতি অধমণের্র খারাপ আচরণের দণ্ডে যথেষ্ট ভেদ রয়েছে। কিন্তু নিম্নবর্ণ শূদ্র ও অন্ত্যজদের প্রতি দণ্ড প্রয়োগের বিধি একেবারেই অমানবিকতায় পর্যবসিত হতে দেখা যায়।

পঞ্চাশদ্ ব্রাহ্মণো দণ্ড্যঃ ত্রিয়স্যাভিশংসনে।
বৈশ্যে স্যাদর্দ্ধপঞ্চাশৎ শূদ্রে দ্বাদশকো দমঃ।। (৮/২৬৮)
বঙ্গানুবাদ: (উত্তমর্ণ) ব্রাহ্মণ যদি (অধমর্ণ অনুসারে) ক্ষত্রিয়ের প্রতি আক্রোশন বা গালিগালাজ করে তা হলে তার পঞ্চাশ দণ্ড হবে, বৈশ্যের প্রতি করলে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রের প্রতি করলে বারো পণ দণ্ড হবে।

শতং ব্রাহ্মণমাক্রুশ্য ক্ষত্রিয়ো দণ্ডমর্হতি।
বৈশ্যোহ প্যর্দ্ধশতং দ্বে বা শূদ্রস্তু বধমর্হতি।। (৮/২৬৭)
বঙ্গানুবাদ: ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে গালাগালি দেয় তা হলে তার এক শ পণ দণ্ড হবে। এই একই অপরাধে বৈশ্যের দণ্ড হবে দেড় শ কিংবা দুই শ পণ; আর শূদ্র শারীরিক দণ্ড প্রাপ্ত হবে (এই দণ্ড অপরাধের তীব্রতা অনুযায়ী বধ পর্যন্ত হতে পারে)।
এই শারীরিক দণ্ড কেমন হবে তাও বিশদ ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে-

যেন কেনচিদঙ্গেন হিংস্যাচ্চেৎ শ্রেষ্ঠমন্ত্যজঃ।
ছেত্তব্যং তত্তদেবাস্য তন্মনোরনুশাসনম্।। (৮/২৭৯)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র কিংবা অন্ত্যজ ব্যক্তি (শূদ্র থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত নিকৃষ্ট জাতি) দ্বিজাতিগণকে (ব্রাহ্মণ, ত্রিয়, বৈশ্য) যে অঙ্গের দ্বারা পীড়ন করবে তার সেই অঙ্গ ছেদন করে দেবে, এটি মনুর নির্দেশ।
মনুশাস্ত্র অনুযায়ী একজাতি শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এইসব দ্বিজাতিকে দারুণ কথা বলে গালি দেয় তা হলে তার জিহ্বাছেদন কর্তব্য (৮/২৭০), যদি নাম ও জাতি তুলে আক্রোশন করে তবে তার মুখের মধ্যে দশ-আঙুল পরিমাণ জ্বলন্ত লৌহময় কীলক প্রবেশ করিয়ে দেবে (৮/২৭১), যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণকে “তোমার এই ধর্ম অনুষ্ঠেয়, এখানে ধর্মানুষ্ঠানে তোমাকে এই সব কাজ করতে হবে” এইসব বলে ধর্মোপদেশ করে তা হলে রাজা তার মুখে ও কানে উত্তপ্ত তেল ঢেলে দেবেন (৮/২৭২), যদি হাত উঁচিয়ে কিংবা লাঠি উঁচিয়ে ক্রোধের সাথে উচ্চ জাতিকে প্রহার করে তবে তার হাত কেটে দেবে এবং পায়ের দ্বারা যদি ক্রোধের সাথে প্রহার করে তা হলে পা কেটে দেবে (৮/২৮০), ঔদ্ধত্যবশতঃ ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু-গয়ের প্রভৃতি দিলে রাজা অপরাধীর ওষ্ঠদ্বয় কেটে দেবেন, মূত্রাদি ত্যাগ করলে পুরুষাঙ্গ এবং পায়ুবায়ু ত্যাগ করলে মলদ্বার কেটে দেবেন (৮/২৮২)। (অপমান করার অভিপ্রায়ে কোনও শূদ্র যদি ঔদ্ধত্যবশতঃ) ব্রাহ্মণের চুল ধরে টানে, কিংবা পা, দাড়ি, গ্রীবা (গলা) কিংবা বৃষণ (অণ্ডকোষ) ধরে টানে তাহলে রাজা কোন রকম বিচার না করেই ঐ শূদ্রের দুটি হাতই কেটে দেবেন (৮/২৮৩)। শুধু তা-ই নয়-

ব্রাহ্মণান্ বাধমানন্তু কামাদবরবর্ণজম্।
হন্যাচ্চিত্রৈর্বধোপায়ৈরুদ্বেজনকরৈর্নৃপঃ।। (৯/২৪৮)
বঙ্গানুবাদ: যদি কোনও শূদ্র ইচ্ছাপূর্বক ব্রাহ্মণকে শারীরিক বা আর্থিক পীড়া দেয়, তাহলে অতি কষ্টপ্রদ নানা উদ্বেগজনক-উপায়ে (যেমন শূলে চড়িয়ে, মস্তক ছেদন করে দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগ করিয়ে) সেই শূদ্রকে বধ করা উচিত।
তাছাড়া-

সহাসনমভিপ্রেপ্সু রুৎকৃষ্টস্যাপকৃষ্টজঃ।
কট্যাং কৃতাঙ্কো নির্বাস্যঃ স্ফিচং বাহস্যাবকর্তয়েৎ।। (৮/২৮১)
বঙ্গানুবাদ: যদি কোন শূদ্রজাতীয় ব্যক্তি ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই আসনে বসে তা হলে তার কোমরে ছেঁকা লাগিয়ে দাগ দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে কিংবা তার পাছা খানিকটা কেটে দেবে।
শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-

শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।। (৮/৪১৩)
বঙ্গানুবাদ: ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।। (৮/৪১৪)
বঙ্গানুবাদ: প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ?

বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।
তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।। (৮/৪১৮)
বঙ্গানুবাদ: রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে।
অর্থাৎ শূদ্রকে তার নিজ কর্মের বাইরে বিকল্প জীবিকা গ্রহণের কোন সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ উচ্চবর্ণিয়দের জন্য প্রতিকুল সময়ে ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ এই মনুসংহিতায় বিশদভাবেই দেয়া হয়েছে।

০৬
ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হলো চতুবর্ণ প্রথা। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে কোন মানুষের উল্লেখ নাই বললেই চলে। অর্থাৎ মানুষ সম্পর্কিত ধারণা বা মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আরেকটি গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।

যেহেতু চারটি বর্ণ নিয়ে সমাজ, তাই এই অস্পৃশ্যরা বর্ণ-বিভাগেরও বাইরে। মনুসংহিতায় এদেরকে ‘সঙ্করজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে এরা কি এই বৈদিক সমাজ বা হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয় ? একটা অস্পষ্ট বিভ্রান্তি থেকে যায়-

ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।। (১০/৪)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি।
প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর। চারটি বর্ণের মধ্যে তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।

এবার বর্ণসঙ্কর বিষয়ে মনুর বৈদিক অভিজ্ঞানশ্রুতি থেকে কিঞ্চিৎ ধারণা নিতে পারি।

সর্ববর্ণেষু তুল্যাসু পত্নীষ্বক্ষতযোনিষু।
আনুলোম্যেন সম্ভূতা জাত্যা জ্ঞেয়াস্ত এব তে।। (১০/৫)
বঙ্গানুবাদ: সকল বর্ণের পক্ষেই স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি (অর্থাৎ প্রথমবিবাহিতা এবং যার সাথে আগে কোনও পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক হয় নি) সবর্ণ বা সমান জাতির নারীর গর্ভে সবর্ণ পতিকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান পিতামাতার জাতি থেকে অভিন্ন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণীতে ব্রাহ্মণকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান ‘ব্রাহ্মণ’হবে; ক্ষত্রিয়কর্তৃক এই রকম ক্ষত্রিয়া পত্নীর গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘ক্ষত্রিয়’ হবে; বৈশ্যকর্তৃক স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি বৈশ্যার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘বৈশ্য’ এবং শূদ্রকর্তৃক ঐ রকম শূদ্রার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘শূদ্র’ হবে। এসব ছাড়া অসবর্ণা স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন সন্তান জনকের সাথে সবর্ণ হয় না, নিশ্চয়ই জাত্যন্তর হবে।

স্ত্রীষ্বনন্তরজাতাসু দ্বিজৈরুৎপাদিতান্ সুতান্।
সদৃশানেব তানাহুর্মাতৃদোষবিগর্হিতান্।। (১০/৬)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ প্রভৃতি দ্বিজ বর্ণ-ত্রয়ের দ্বারা অনুলোমক্রমে অনন্তর অর্থাৎ অব্যবহিত পরবর্তী জাতীয়া নারীর গর্ভে জাত সন্তানেরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণকর্তৃক ক্ষত্রিয়াতে উৎপন্ন সন্তান এবং ক্ষত্রিয় কর্তৃক বৈশ্যানারীতে উৎপন্ন সন্তান এবং বৈশ্যকর্তৃক শূদ্রা নারীতে উৎপন্ন সন্তানগণ হীনজাতীয়া মাতার গর্ভে উৎপন্ন বলে পিতৃজাতি প্রাপ্ত হয় না, কিন্তু উৎপাদকের (পিতার) জাতির সদৃশ হয়। এই সন্তানেরাই মূর্ধাবসিক্ত, মাহিষ্য ও করণ নামে অভিহিত হয়। এরা মাতৃজাতির তুলনায় উৎকৃষ্ট কিন্তু পিতৃজাতির তুলনায় নিকৃষ্ট।

বিপ্রস্য ত্রিষু বর্ণেষু নৃপতের্বর্ণয়োর্দ্বয়োঃ।
বৈশ্যস্য বর্ণে চৈকস্মিন্ ষড়েতেহপসদাঃ স্মৃতাঃ।। (১০/১০)
বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণের পক্ষে তিনটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ পরিণীতা ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) উৎপন্ন (মূর্দ্ধাবসিক্ত, অম্বষ্ঠ বা ভৃজ্যকণ্ঠ ও নিষাদ বা পারশব), ক্ষত্রিয় পুরুষের পক্ষে দুইটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ বৈশ্যা ও শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (মাহিষ্য ও উগ্র), এবং বৈশ্য পুরুষের পক্ষে একটি বর্ণের নারীতে (অর্থাৎ শূদ্রা স্ত্রীতে) জাত (করণ)- এই ছয় জাতীয় অনুলোমজ সন্তান অপসদ নামে অভিহিত হয় (অপসদ মানে পুত্রের যে প্রয়োজন তা থেকে এরা অপসারিত; সমান জাতীয় পুত্রের তুলনায় এরা অপসদ অর্থাৎ অপকৃষ্ট); এই অনুলোম-সঙ্করজাতির কথা স্মৃতিমধ্যে বর্ণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রের প্রয়োজন হয় পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি বা সদগতির লক্ষে (স্বর্গারোহন) শ্রাদ্ধাদিতে পিণ্ডদান করার জন্য। পিণ্ডদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে মূলত অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। বৈদিক শাস্ত্রে পুত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায় নিম্নোক্ত শ্লোকটি থেকে-

সংস্থিতস্যানপত্যস্য সগোত্রাৎ পুত্রমাহরেৎ।
তত্র যদ্ রিক্থজাতং স্যাত্তত্তস্মিন্ প্রতিপাদয়েৎ।। (৯/১৯০)
বঙ্গানুবাদ: কোনও ব্যক্তি যদি অপুত্র অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তার স্ত্রী গুরুজনদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে সগোত্র পুরুষের দ্বারা পুত্র উৎপাদন করবে এবং মৃত ব্যক্তির যা কিছু ধনসম্পত্তি তা ঐ পুত্রকে অর্পণ করবে।
বৈদিক বিধান এমনই অলৌকিক শাস্ত্র যে সম্পদরক্ষায় পুত্রের প্রয়োজনে মনুসংহিতার ৫/১৫৭ সংখ্যক শ্লোকে (ইতঃপূর্বে উদ্ধৃত) বর্ণিত বিধবার কর্তব্যও সাময়িক রদ হয়ে যায়।

শাস্ত্র অনুযায়ী উপরোক্ত অনুলোমজ (উচ্চবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণ মাতার গর্ভজাত) সন্তানেরা সবর্ণ পুত্রের সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও এরা বর্ণবহির্ভূত নয়। এরা মাতৃজাতির তুল্য অর্থাৎ মাতৃজাতির সংস্কারের যোগ্য হয়। কিন্তু প্রতিলোম-সঙ্করের (নিম্নবর্ণ পিতার ঔরসে অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্ণ মাতার গর্ভজাত সন্তানের) ক্ষেত্রেই যতসব শাস্ত্রীয় সমস্যা ও জটিলতার সূত্রপাত। এক্ষেত্রে সর্বজ্ঞ মনু একের পর এক প্রতিলোমজ সঙ্করের উৎপত্তি ও পর্যায়ক্রমিক যে বহুবিধ জাতি-তালিকা তৈরি করতে থাকেন, রীতিমতো বিভ্রান্ত হবার মতো। এবং একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে আমরা কতকগুলো স্পর্শাদি-অযোগ্য অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য জাতির সন্ধান পেতে থাকি। যেমন প্রাথমিকভাবে সূত, মাগধ, বৈদেহ, আয়োগব, ক্ষত্তা, চণ্ডাল নামের যে প্রতিলোমজ-সঙ্কর জাতি পাই, তাদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য। তবে আয়োগব ও ক্ষত্তা অস্পৃশ্য না হলেও এরা অপসদ  বা নরাধম, অর্থাৎ পুত্রকাজ করার অযোগ্য। কারণ এরা শূদ্র পিতার ঔরসে প্রতিলোমজ-সঙ্কর। এক্ষেত্রে মনুসংহিতায় সুকৌশলে তৈরি বিধিবদ্ধ সূত্রগুলো কিঞ্চিৎ অধ্যয়ন করে নেয়া যায়-

একান্তরে ত্বানুলোম্যাদম্বষ্ঠোগ্রৌ যথা স্মৃতৌ।
ক্ষত্ত্ববৈদেহকৌ তদ্বৎ প্রাতিলোম্যেহপি জন্মনি।। (১০/১৩)
বঙ্গানুবাদ: একান্তরে অর্থাৎ একটি মাত্র বর্ণের ব্যবধানে অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষের ঔরসে বৈশ্যজাতীয় নারীর গর্ভে জাত অম্বষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়পুরুষের ঔরসে শূদ্রানারীর গর্ভে জাত উগ্র- এইসব অনুলোমজ সন্তান যেমন স্পর্শাদিযোগ্য হয়, সেইরকম প্রতিলোমক্রমে একান্তরিত অর্থাৎ একজাতি-ব্যবধানে উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে জাত (যেমন, শূদ্রপুরুষ থেকে ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন ক্ষত্তা এবং বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন বৈদেহ) দুই জাতি স্পর্শাদিযোগ্য হবে। (তবে যজনাদিক্রিয়াতে এদের তুল্যতা নেই।)
এই সূত্রানুযায়ী প্রতিলোমজগণের মধ্যে দুই বর্ণ-ব্যবধানে (অর্থাৎ শূদ্র পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে) উৎপন্ন চণ্ডাল এই সূত্রে পড়ে না বলে শাস্ত্রানুযায়ী চণ্ডালই একমাত্র অস্পৃশ্য হয়ে যায়।

এখানে একটা সাধারণ সূত্র খেয়াল রাখতে হবে। চতুর্বর্ণ প্রথার মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এরা বর্ণক্রমে দ্বিজজাতি। অর্থাৎ তাদের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান থাকায় এরা উৎকৃষ্ট জাতি। তাই এই তিন বর্ণের নারীতে অনুলোমক্রমে উৎপাদিত সন্তানও দ্বিজ হয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া, ক্ষত্রিয়জাতীয়া ও বৈশ্যজাতীয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া ও বৈশ্যা স্ত্রীতে এবং বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক বৈশ্যনারীতে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হবে। আর বাহ্যক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রতিলোমক্রমে অনন্তরবর্তী উচ্চবর্ণের স্ত্রীতে যেমন বৈশ্যপুরুষ কর্তৃক ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে এবং ক্ষত্রিয়পুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে যে সন্তান উৎপাদিত হয় সেও তাদের আত্মা অর্থাৎ দ্বিজ হয়। এককথায় দ্বিজদের মধ্যে আন্তসম্পর্কক্রমে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কররা দ্বিজজাতিই হবে।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও শূদ্র নারী বা পুরুষের আবির্ভাব ঘটলে। শাস্ত্রীয় বিধানে দাসজাতি শূদ্রবর্ণের জন্য উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নাই বলে এরা একজাতি। তাই তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট বর্ণসঙ্করাও দ্বিজ হয় না। এক্ষেত্রে অনুলোম প্রক্রিয়ায় শূদ্রা স্ত্রী উচ্চবর্ণভোগ্যা হওয়া তার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার বলে উৎপাদিত সন্তান দ্বিজ হয় না বটে, তবে মাতৃজাতি শূদ্র থেকে কিঞ্চিৎ উৎকৃষ্ট হয়। কিন্তু শূদ্রবর্ণের পুরুষের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ প্রতিলোম প্রক্রিয়ায় উচ্চবর্ণের স্ত্রীভোগ গুরুতর সামাজিক অপরাধ বা দূষণ হিসেবেই চিহ্নিত। তাই এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর সন্তান তাদের পুত্র-অধিকার হারিয়ে নরাধম হয়ে যায়। আর এই অপরাধের মাত্রা বা দূষণপ্রক্রিয়া তীব্রতম হলে অর্থাৎ শূদ্রপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণা স্ত্রী দূষিত হলে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর অস্পৃশ্য চণ্ডাল হয়ে যায়।
অতএব, শূদ্র পুরুষ যেখানে বর্ণসঙ্করে জড়িত সেখানে কি সমস্যা না হয়ে পারে ?

আয়োগবশ্চ ক্ষত্তা চ চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্।
প্রাতিলোম্যেন জায়ন্তে শূদ্রাদপসদাস্ত্রয়ঃ।। (১০/১৬)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র পুরুষ থেকে প্রতিলোমক্রমে জাত অর্থাৎ শূদ্র পুরুষের ঔরসে বৈশ্যা স্ত্রীতে জাত আয়োগব, ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে জাত ক্ষত্তা এবং ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত চণ্ডাল- এই তিন জাতি পুত্রকাজ করার অযোগ্য। এই জন্য এরা অপসদ অর্থাৎ নরাধম বলে পরিগণিত হয়। এদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য।

চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।
অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।। (১০/৫১)
বঙ্গানুবাদ: চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র’ করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধনস্বরূপ। (অপপাত্র হলো যে পাত্রে ভোজন করলে তা আর সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করা চলবে না, তা পরিত্যাগই করতে হবে। অথবা তারা যে পাত্র স্পর্শ করে থাকবে তাতে অন্ন-শক্তু প্রভৃতি দেয়া চলবে না; কিন্তু পাত্রটি মাটির উপর রেখে দিলে কিংবা অন্য কোনও লোক তা হাতে করে ধরে থাকলে তার উপর ভাত-ছাতু প্রভৃতি দিয়ে মাটির উপর রেখে দিলে তারা ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে। অন্য অর্থে ভাঙা পাত্রকে অপপাত্র বলে।)

বাসাংসি মৃতচেলানি ভিন্নভাণ্ডেষু ভোজনম্।
কার্ষ্ণায়সমলঙ্কারঃ পরিব্রজ্যা চ নিত্যশঃ।। (১০/৫২)
বঙ্গানুবাদ: মৃত লোকের কাপড় এদের আচ্ছাদন (পোষাক) হবে; এরা ভাঙা পাত্রে ভোজন করবে; এদের অলঙ্কার হবে লৌহনির্মিত; এবং এরা সকল সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াবে। অর্থাৎ একই স্থানে বাস করবে না।
খুব সাধারণভাবে সঙ্কর জাতি থেকে সঙ্কর জাতিরই জন্ম হয়। আর শাস্ত্রানুযায়ী জন্মদোষ যেহেতু প্রজন্মক্রমেই স্থায়ী দোষ, যা থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই, তাই যেখানে নরাধম ও অস্পৃশ্যের ছোঁয়া পড়ে সেখানে পরবর্তী বংশ পরম্পরায় অস্পৃশ্য-সঙ্কর জাতিরই উৎপত্তি হতে থাকে। এভাবে ডাল-পালা বিস্তৃত করতে করতে সর্বজ্ঞ মনু তাঁর শঙ্করায়ন-শাস্ত্রকে এতোটাই জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে শেষপর্যন্ত শত শত অন্ত্যজ-অছ্যুৎ সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠির বিশাল এক জনগোষ্ঠিই সেখানে বাঁধা পড়ে যায়, যারা মূলত শ্রমজীবী। সমাজের গতিচক্রটিকে এরাই ধারণ করে অথচ এরাই হয়ে যায় বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্টি- অছ্যুৎ, অস্পৃশ্য, দলিত বা নির্যাতিতও। মনুসংহিতায় এই ব্রাত্যজনগোষ্ঠির উৎপত্তি নির্ধারণক্রমে সৃষ্ট  যে জালিকাবিন্যাস, এর সুদীর্ঘ তালিকা দেখলে রীতিমতো আঁৎকে ওঠতে হয় ! প্রাসঙ্গিক হিসেবে দুয়েকটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য, যেমন-

যথৈব শূদ্রো ব্রাহ্মণ্যাং বাহ্যং জন্তুং প্রসূয়তে।
তথা বাহ্যতরং বাহ্যশ্চাতু র্বর্ণ্যে প্রসূয়তে।। (১০/৩০)
বঙ্গানুবাদ: শূদ্র যেমন ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্ট চণ্ডাল নামক সন্তানের জন্ম দেয়, সেইরকম সূত (ক্ষত্রিয় পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত সন্তান সূত) প্রভতি অন্যান্য বাহ্যজাতি (বৈদেহক, চণ্ডাল, মাগধ, ক্ষত্তা এবং আয়োগব) অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় পুরুষ চারবর্ণের নারীতে আরও বেশি বাহ্য অর্থাৎ নিকৃষ্টজাতীয় সন্তান উৎপাদন করে।

নিষাদো মার্গবৎ সূতে দাশং নৌকর্মজীবিনম্।
কৈবর্তমিতি যং প্রাহুরার্য্যাবর্তনিবাসিনঃ।। (১০/৩৪)
বঙ্গানুবাদ: আয়োগবজাতীয় (শূদ্র পুরুষ থেকে বৈশ্যনারীর গর্ভজাত সন্তান হলো আয়োগব) নারীতে নিষাদজাতীয় পুরুষ (ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রা নারীতে জাত সন্তানকে নিষাদ বলে) ‘মার্গব’ নামক সঙ্কর সৃষ্টি করে থাকে। তাদের দাস বলা হয়; আর্যাবর্তনিবাসিগণ তাদের কৈবর্ত নামে অভিহিত করেন। তারা নৌকর্মের দ্বারা জীবিকার্জন করে। (নৌকর্ম হলো নৌকা চালান, তার দ্বারা জীবন ধারণ করা।)

কারাবরো নিষাদাত্তু চর্মকারঃ প্রসূয়তে।
বৈদেহিকাদন্ধ্রমেদৌ বহির্গ্রামপ্রতিশ্রয়ৌ।। (১০/৩৬)
বঙ্গানুবাদ: নিষাদ পুরুষ থেকে ‘বৈদেহী’ নারীতে (বৈশ্য পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রীতে উৎপন্ন সন্তানকে বৈদেহ বলে) ‘কারাবর’ জাতি জন্মে; এরা চামড়ার কাজ করে। কারাবর এবং নিষাদজাতীয়া নারীতে ‘বৈদেহিক’ পুরুষ থেকে ‘অন্ধ্র’ এবং ‘মেদ’ এই দুই বর্ণসঙ্কর সৃষ্ট হয়; গ্রামের বাইরে এদের বাসস্থান।

চাণ্ডালৎ পাণ্ডুসোপাকন্ত্বক্সারব্যবহারবান্।
আহিণ্ডিকো নিষাদেন বৈদেহ্যামেব জায়তে।। (১০/৩৭)
বঙ্গানুবাদ: চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে বৈদেহজাতীয় নারীতে ‘পাণ্ডুসোপাক’ নামক বণসঙ্করের উৎপত্তি; এরা বাঁশ থেকে ঝোড়া-চুব্ড়ী প্রভৃতি তৈয়ার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নিষাদ পুরুষের ঔরসে ঐ ‘বৈদেহী’ নারীতেই ‘আহিণ্ডিক’ জাতির উৎপত্তি। (তাদেরও ঐ একই বৃত্তি।)

নিষাদস্ত্রী তু চাণ্ডালাৎ পুত্রমন্ত্যাবসায়িনম্।
শ্মশানগোচরং সূতে বাহ্যানামপি গর্হিতম্।। (১০/৩৯)
বঙ্গানুবাদ: নিষাদজাতীয়া নারী চণ্ডালজাতীয় পুরুষ থেকে ‘অন্ত্যাবসায়ী’ নামক সন্তান প্রসব করে; সে শ্মশানের কাজে নিযুক্ত হয়; সে নিকৃষ্টজাতিরও নিন্দিত।
অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠির উৎপাদনরহস্য নিয়ে এরকম ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত-শ্লোক মনুসংহিতায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। এই সঙ্করায়ন-প্রক্রিয়ায় অনন্তপ্রকার বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হতে পারে বলে খোদ শাস্ত্রকারই এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তাই বাস্তবে এই অছ্যুৎ বর্ণসঙ্কর চেনার উপায় বা প্রক্রিয়া কী হবে, এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে। হয়তো এসেছেও। নইলে পবিত্র মনুসংহিতায় এরকম শ্লোক আসতো কি?

সঙ্করে জাতয়স্ত্বেতাঃ পিতৃমাতৃপ্রদর্শিতাঃ।
প্রচ্ছন্না বা প্রকাশা বা বেদিতব্যাঃ স্বকর্মভিঃ।। (১০/৪০)
বঙ্গানুবাদ: পিতা-মাতার নাম নির্দেশপূর্বক এইসব হীন সঙ্করজাতির কথা বলা হলো; এছাড়া যাদের পিতা-মাতার নাম জানা যায় না, এমন যারা গুপ্তভাবে বা প্রকাশ্যভাবে বর্ণসঙ্কররূপে উৎপাদিত হয়, তাদের  জাতিপরিচয় তাদের ক্রিয়াকলাপ থেকে জানতে হবে।
কারণ-

পিত্র্যং বা ভজতে শীলং মাতুর্ব্বোভয়মেব বা।
ন কথঞ্চন দুর্যোনিঃ প্রকৃতিং স্বাং নিযচ্ছতি।। (১০/৫৯)
বঙ্গানুবাদ: জন্মগত দোষযুক্ত ব্যক্তি পিতার দুষ্ট স্বভাব অথবা মাতার নিন্দিত স্বভাব অথবা উভয়েরই স্বভাবের অনুবর্তী হয়। যে লোক দুর্যোনি অর্থাৎ বর্ণসঙ্করজাত নিন্দিত ব্যক্তি, সে কখনো নিজ জন্মের কারণ অর্থাৎ পিতামাতার স্বভাবকে গোপন করতে পারে না।

স্বার্থগৃধ্নুতায় ক্ষমতাদর্পী বৈদিক ব্রাহ্মণ তথা স্বঘোষিত উচ্চবর্ণধারী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিটা কী জঘণ্য বর্ণবিদ্বেষী হতে পারে মনুসংহিতায় উদ্ধৃত উপরোক্ত অবশ্য-পালনীয় শ্লোকগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এরকম শত-সহস্র বর্ণবিদ্বেষী শ্লোক গোটা মনুসংহিতা জুড়ে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হলো, বৈদিক বা আর্য-সভ্যতার বাইরে আর কোন দেশে বা সভ্যতায় বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অস্তিত্ব মনুসংহিতায় স্বীকার করা হয়নি। হয়তো এটাই মনুকৃত একমাত্র সত্যবাদিতা বা বাস্তবতা স্বীকার। তবে  আর্য-সভ্যতার বাইরেও পৃথিবীতে যে আরো বহু দেশ রয়েছে বা থাকতে পারে তা হয়তো অস্বীকার করার উপায় ছিলো না। ফলে সেসব দেশেও শাসক সম্প্রদায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং তাদের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে এরা এতোই একদেশদর্শী ছিলো যে, মনুসংহিতা অনুযায়ী শাসকশ্রেণী ক্ষত্রিয় হলেও সেসব দেশের শাসককে উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয় বলে গ্রহণ করা সংগত বিবেচিত হয়নি। কারণ উপনয়নাদি-সংস্কার পালন না করা এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ওরা শূদ্র হয়ে গেছে। মনুশাস্ত্র অনুযায়ী-

পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদ্রবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ।
পারদা পহ্নবাশ্চীনাঃ কিরাতা দরদাঃ খশাঃ।। (১০/৪৪)
বঙ্গানুবাদ: পৌণ্ড্রক, উড্র, দ্রাবিড়, কাম্বোজ, যবন, শাক, পারদ, পহব, চীন, কিরাত, দরদ ও খশ- এই সব দেশোদ্ভব ক্ষত্রিয়গণ তাদের কর্মদোষে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
কী তাদের কর্মদোষ ?

শনকৈস্তু ক্রিয়ালোপাদিমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ।
বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ।। (১০/৪৩)
বঙ্গানুবাদ: ওই সমস্ত ক্ষত্রিয়জাতিগণ পুরুষানুক্রমে উপনয়নাদি, নিত্যাগ্নিহোত্র ও সন্ধ্যাবন্দনা প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান না করায় এবং ‘ব্রাহ্মণ’ নামক বেদাংশে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করায় ক্রমে ক্রমে বৃষলত্ব অর্থাৎ শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।

০৭
ধর্মীয় মোড়কে সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদই পৃথিবীর প্রাচীনতম বর্ণবাদী দর্শন। এবং বেদ-নির্যাস হিসেবে স্বীকৃত মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা যদি এ দর্শনের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক ভিত্তিমূল হয় তাহলেই বলতেই হয়, এটা কেন সম্পূর্ণ মানবতা-বিরোধী একটা অসভ্য দর্শন হবে না ? একটা সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠিকে জঘণ্যতম বর্ণাশ্রমে বিভাজিত করা এবং একজন কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা’র নাম দিয়ে সমাজের উৎপাদনসংশ্লিষ্ট বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে ক্ষমতায় আসীন শাসক গোষ্ঠির প্রতিভূ বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ নামের এক স্বার্থান্বেষী পরভোজী শ্রেণীর সেবাদাস বানিয়ে ফেলা যে একটা চতুর রাজনীতি, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ রাজনীতির পেছনে যে গভীর ও সূক্ষ্ম কূটাভাষ লুকিয়ে আছে তা হলো নিকৃষ্টবর্ণ শূদ্রসংশ্লিষ্টতায় কতকগুলো বর্ণবহির্ভূত অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করে গোটা জনগোষ্ঠিকে প্রথমে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলা হলো- উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণী। ক্ষমতালিপ্সু শাসক বা ক্ষমতাসীনরা উৎকৃষ্ট বা উচ্চশ্রেণীভুক্ত আর্য, আর শ্রমজীবী শাসিতরা হলো নিকৃষ্ট বা নিম্নশ্রেণীর অনার্য শূদ্র। এই শ্রেণীবিভেদ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি এরা। যেহেতু শাসিতরাই সংখ্যাধিক্যে বিপুল, তাই সুকৌশলে এদের মধ্যে আবার তৈরি করা হলো বিষাক্ত বিভেদের এক ভয়ানক বিচ্ছিন্নতা। আজব এক সত্ত্বার জন্ম দেয়া হলো- যার নাম অস্পৃশ্য (Untouchable)। মারাঠি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘দলিত’, অর্থাৎ নির্যাতিত।

ধর্মের অলৌকিক মোড়কে ঘটানো এই রাজনৈতিক কূটচালে খুব স্বাভাবিকভাবে ধরাশায়ী হলো বিশাল এক জনগোষ্ঠি। লেখাপড়া বা শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে তাদেরকে চিরকালের অন্ধ বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রও খুব ভালোভাবেই নিষ্পন্ন হলো। একটা প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতার সামাজিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দুমড়েমুচড়ে তার জায়গায় ধীরে ধীরে কার্যকর করা হলো একটা তীব্র বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থা ব্র্রাহ্মণ্যবাদ। যার নাম বৈদিক বা আর্য সভ্যতা। এভাবেই প্রাচীন ভারতবর্ষে বহিরাগত লুণ্ঠনকারী আর্যদের চাপিয়ে দেয়া ট্র্যাজিক অবদান হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ। এরপর শত সহস্র বছর ধরে প্রতিপালিত এই বিষাক্ত বর্ণদর্শন মিশে গেলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর অবশ্যপালনীয় উপাচার ও সংস্কৃতির রক্তে। তা থেকে আর মুক্ত হতে পারেনি এই সমাজ। মুক্ত হওয়া এখনো যে সম্ভব হয়নি তার প্রমাণ বর্তমান বাংলা ও ভারতীয় হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলো। বিবাহে, প্রয়ানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে তথা সর্বক্ষেত্রে এই বর্ণাশ্রমের বিষাক্ত থাবা আজো আদিরূপেই বর্তমান। যদিও তা দৃশ্যমান স্বরূপে ততোটা আক্রমণাত্মক নয়, কিন্তু অন্তর্গত অবস্থানে কোনভাবেই কম ক্রিয়াশীল নয়।

ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তিমূল এই মনুসংহিতা অধ্যয়নে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলেই এর তীব্র ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায় খুব সহজেই। এমন মানববিদ্বেষী বিষাক্ত বিধান কোন স্রষ্টা নামীয় অলৌকিক মুখ থেকে নিঃসৃত হতে পারে কিনা তা সন্দেহ করা অযৌক্তিক হবে কি ? হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সমকালীন সামাজিক বাস্তবতা ও বিদ্বেষমূলক জীবনাচারের প্রয়োজনেই এর শ্লোকগুলো বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে হয়। ভূমি নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষিতে কিভাবে জমি ও বাসস্থানের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে, সীমানায় কী গাছ বা উদ্ভিদ রোপন করলে স্থানচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকবে না। কিংবা যে লোক আবদ্ধ জলস্রোতের বাঁধ ভেঙে দেয় তার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা মাথায় বস্ত্রাদি বেষ্টন করে বা চর্মপাদুকা পরে ভোজন করা হলে পরিণতি কী হবে; নতুবা কোন্ বস্তু উষ্ণ অবস্থায়, কোন্ বস্তু ঠাণ্ডা অবস্থায়, কোন্ দ্রব্য তিনদিন পরেও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, রসুন কারা খেতে পারবে, কখন লবণ বিক্রি করা যাবে না বা রাজা দেবতার প্রতিনিধি ইত্যাদি বিধান রচনায় কোন অলৌকিক উৎস থাকার দাবী একান্তই হাস্যকর মনে হয়। প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খুটিনাটি উপাচার ও কর্তব্য পালনের যে পৌনপুনিক অগুনতি বিধি রচিত হয়েছে তাতে এটা মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে মনুসংহিতার এক বা একাধিক শাস্ত্ররচয়িতারা আসলে চলমান পরিবেশ-প্রতিবেশেই লালিত-পালিত স্বেচ্ছা-অন্তরালবর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি।

তবু এটাই অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় সামাজিক আর্যবিধান হিসেবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। গৌতম বুদ্ধ এই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী হলেও এর পর সুদীর্ঘকাল এই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপক্ষে আর টু-শব্দটি করার মতো কেউ দাঁড়াতে যে পারে নি, তার কারণও যুগে যুগে এই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিভূ বর্ণবাদী নেতৃত্বের নির্লজ্জ আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুকঠিন সামাজিক দ্বৈত-কাঠামো। এ বড় শক্ত দূর্গ।এ সবকিছু বিবেচনায় নিলে এটা ভাবা কি খুব অযৌক্তিক হবে যে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বর্ণবাদী শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোন নির্যাতিত শূদ্র বা অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠি কখনোই তার সমকালীন সমাজকে দুষিত করেনি, বরং এক কাল্পনিক স্রষ্টা ব্রহ্মার নামে কোন চতুর স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠি কর্তৃক সৃষ্ট মানবতাবিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদই আমাদের এই প্রাচীন মানব সমাজকে ভয়ঙ্করভাবে দুষিত করে দিয়েছে ? যার বিষাক্ত নীল ছোবল পবিত্র মানবাত্মাকেই কলঙ্কিত করেছে।

অতঃপর আরেক বিদ্রোহীর উত্থান
শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধের প্রয়ানের দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পর তাঁর আর এক সার্থক বিপ্লবী অনুগামীর আবির্ভাব হলো এই ভারতবর্ষেই। যিনি মনু’র মানবতাবিরোধী শাস্ত্রধারী হিন্দুদের প্রচলিত জাত-পাতের ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন-

‘মনুসংহিতাকে হিন্দু ধর্মের আচরণবিধির পবিত্র গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়। মনুস্মৃতিকে ব্রাহ্মণ জগদীশ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, শূদ্রের সম্পদ অর্জনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়েছে। যে কোন বর্ণের নারী ব্রাহ্মণদের উপভোগের বস্তু। গ্রন্থটি ব্রাহ্মণ্যবাদের কালাকানুন এবং সভ্যসমাজের কলঙ্ক। কাজেই গ্রন্থটিকে অবিলম্বে ভষ্মীভূত করা প্রয়োজন।’
বর্ণবাদের অসভ্য উৎস হিন্দু সমাজের সংবিধান বলে খ্যাত মনুসংহিতা যে আদৌ কোন ধর্মগ্রন্থ হতে পারে না, কিছু কুচক্রী স্বার্থান্বেষী লোভী ভণ্ড প্রতারক মানুষের শোষণের হাতিয়ার কেবল, আম্বেদকরই প্রথম উচ্চারণ করলেন তা। এবং খুব স্পষ্টভাবে ইতিহাস ঘেটে ঘেটে যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে। এমন তীব্র ও স্পষ্ট বক্তব্য এর আগের সুদীর্ঘ অতীতে আর কারো মুখ থেকে উচ্চারিত হতে শুনা যায় নি। কিন্তু চলমান বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই তাঁর। তাই তিনি এও বলেন-

আমার কাছে আমার জীবন অপেক্ষা আমার দেশের স্বার্থ অনেক বড়। আমার অসহায় এবং নির্যাতিত দলিত সমাজের স্বার্থ তার চেয়ে বড়।
শিক্ষা সংহতি ও সংগ্রামী ঐক্যই শূদ্র, দলিত-শোষিত সমাজের মুক্তি আনতে পারে। তোমরা সংঘবদ্ধ হও অধিকার আদায় করে লও।
তিনি উপমহাদেশের কোটি কোটি লাঞ্ছিত, দলিত ও মানবিক অধিকারহীন জনগণের মুক্তিদাতা, সারা বিশ্বে মানবাধিকার যোদ্ধা নামে খ্যাত এক দলিত পুরুষ বাবা সাহেব ড. ভীম রাও রামজি আম্বেদকর (Baba Saheb D. Bhima Rao Ramji Ambedkar)। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য-
‘দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এ অঞ্চল থেকে বর্ণ-বৈষম্য শোষণ নির্মূল করা দরকার। …দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ বিকাশের শত্রু হল ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ।’
তাঁর এ কথা বলার নেপথ্যশক্তি তিনি প্রজাতন্ত্রী ভারতের সংবিধান প্রণেতা কিংবা ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও মনীষী বলে নয়। তিনিই ভারতের প্রথম দলিত (Dalit) গ্রাজুয়েট। যিনি তাঁর গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন দলিত জনগোষ্ঠির মুক্তির লক্ষে বর্ণবাদী অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি এই যুদ্ধ থেকে এক পা’ও পিছু হঠেননি। আদর্শের প্রশ্নে ছেড়ে কথা বলেননি ভারতের বর্ণবাদী হিন্দুদের কট্টর প্রতিনিধি মহাত্মা গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজিকেও। আম্বেদকর মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’ (harijan) শব্দটিকে বাতিল করে দেন এই যুক্তিতে যে, গান্ধীর (Gandhi) এই পদক্ষেপ নিতান্তই হঠকারী সমাজ-সংস্কারমূলক ফাঁকা বুলি মাত্র৷ গান্ধীর উদ্দেশ্য দলিতদের মুক্তি নয়, বরং সংগঠিত দলিতদের জোটবদ্ধ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কূট-রাজনীতি। উপমহাদেশের নিপীড়িত দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তি বিরোধী গান্ধীর এসব রাজনৈতিক কৌশলের সাথে কখনোই আপোষ করেননি আম্বেদকর। গোটা ভারত জুড়ে সর্বতোমুখি এক দলিত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান তিনি। তাঁর হাত দিয়েই দলিত সাহিত্য নামে এক মাটিবর্তি সাহিত্যের জন্ম হয়, যার মাধ্যমে তিনি হিন্দু বর্ণবাদের মুখোশ উন্মোচন করে দলিত আন্দোলনে তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শক্তি যুক্ত করে সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা হাজার বছরের নিগড় ভেঙে বর্ণ হিন্দুদের সংরক্ষিত চাভাকর লেক বা চৌদার পুকুর থেকে জলপান করেন, অসংখ্য দলিত অনুসারী নিয়ে তিনি ভারতীয় বর্ণবাদের আকরগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা‘ পুড়িয়ে এর মানবতাবিরোধী অবস্থানের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতীকী ও প্রত্যক্ষ অনাস্থা প্রকাশ করেন। দলিতদের শিক্ষার প্রতি ব্যাপক দৃষ্টি দিয়ে, যা এর আগে কল্পনাও করা যায় নি, তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯২৮ সালে গঠিত ‘ডিপ্রেসড কাশেস এডুকেশন সোসাইটি’র মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে বোম্বেতে সিদ্ধার্থ কলেজ ও ১৯৫১ সালে আওরঙ্গবাদে মিলিন্দ কলেজের প্রতিষ্ঠা তাঁর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফসল৷ তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে আম্বেদকরের এই বিপুল অবদান, যা সংক্ষেপে বলে শেষ হওয়ার নয়। আম্বেদকর আর দলিত আন্দোলন একই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত।

তাঁর উত্থানও এই হাজার বছরের অত্যাচারিত অছ্যুৎ দলিত সম্প্রদায় থেকেই। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর রক্তে মাংসে মনে মননে দলিত হবার কষ্টই বেজে গেছে আজীবন। কিন্তু হাজার হাজার বছরের গভীর শিকড়ে প্রোথিত পাহাড়ের মতো জেকে বসা এমন একটা অসম অটল ব্যবস্থার বিপরীতে তাঁর ছোট্ট জীবনের সর্বসত্ত্ব কতোটুকু আর ! গোটা দেশ জুড়ে তীব্র এক ঝড় উঠালেও টলাতে পারেননি তিনি এই অসম ব্যবস্থাকে। শেষপর্যন্ত বুদ্ধের মতোই বর্ণান্ধ হিন্দু সমাজ ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আরেকটি সামাজিক বিদ্রোহের সূচনার দিকেই এগিয়ে গেলেন, লক্ষ লক্ষ দলিত অনুসারী নিয়ে।

দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন-
“…নির্যাতিত শ্রেণীর মানুষদের হিন্দু হয়েও যদি সম অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, বিগত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন বা সংগ্রাম করেও তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র ন্যায়বোধের পরিচয় পাওয়া না যায় তাহলে নির্যাতিত সমাজকে ভাল করে ভেবে দেখতে হবে। তাই দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে আত্মসম্মান ও মানবিক অধিকার লাভ করতে হলে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। … আমার চরম দুর্ভাগ্য যে, অস্পৃশ্য সমাজে জন্মেছি বলে আমাকে আত্মসম্মানহীন অপমানজনক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।”
এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন-
“আমি অস্পৃশ্য হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও অস্পৃশ্য হয়ে মরবো না।”
অতঃপর দার্শনিক স্থিরতা দিয়ে মানুষের সাম্যের জায়গাটাকে খুঁজে গেছেন আজীবন।

মহারাষ্ট্রের অত্যন্ত গরীব ও একেবারে নিচু তলার এক দলিত মাহার (Mahar) বা চর্মকার পরিবারে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্ম আম্বেদকরের। মহারাষ্ট্রে অনেকগুলো দলিত সম্প্রদায়ের বাস হলেও এদের মধ্যে মাহাররাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু মাহারদের আলাদা কোন গ্রাম বা পল্লী ছিলো না। প্রতিটা হিন্দু গ্রামের উপান্তে বা প্রান্তসীমায় দু-চার ঘর মাহার থাকতো। গ্রামের প্রধান এলাকার বাইরে ঘর বেঁধে থাকতে হতো। তাদের কাজ ছিলো গ্রাম পাহারা দেয়া, গ্রামের মরা পশু অপসারণ করা, গ্রাম-প্রধান বা মোড়লদের হুকুম অনুযায়ী সমাজের সামষ্টিক কাজে বেগার খাটা, ময়লা পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
মাহারদের অসংখ্য কর্তব্য থাকলেও কোন জীবিকার ব্যবস্থা ছিলো না। বর্ণ হিন্দুদের বাড়ির এঁটো কুড়িয়ে, কাটা ক্ষেতের পরিত্যক্ত ফসল কুড়িয়ে, মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করে, আর মরা পশুর মাংস খেয়ে জীবন কাটাতে হতো তাদের৷ এদের অস্পৃশ্যতা এতোটাই তীব্র ছিলো যে, তাদের ছোঁয়া লাগলে, এমনকি ছায়া মাড়ালেও উচ্চ শ্রেণীর স্পর্শদোষ ঘটত৷ বর্ণভিত্তিক সমাজে এরা শূদ্রেরও অধম। এক সময়ে তাদের গলায় মাটির পাত্র বাঁধতে বাধ্য করা হতো, যাতে তাদের থুতু মাটিতে পড়ে দূষণ সৃষ্টি না করে৷ আরেকটি বাধ্যবাধকতা ছিল, পেছন দিকে ঝাড়ু বেঁধে রাখা যাতে অন্যদের চোখে পড়ার আগে তাদের পায়ের ছাপ মুছে যায়৷ এরকম একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে ভবিষ্যৎ যে কোথায় নির্ধারিত হয়ে যায় তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু যে অছ্যুৎ জাতির জন্য একজন আম্বেদকরকে পেতে হবে তাদের প্রথম স্বপ্ন তৈরি হতে, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে, আত্মমুক্তি ঘটাতে, তাদের বৌদ্ধিক উত্তরণ ঘটাতে, তাদের জন্য একজন আম্বেদকরের জন্ম হয়ে যায় ঠিকই।

স্কুলজীবনের শুরুতেই হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার অভিশাপের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তাঁর শিশুমন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকে। ছাত্রজীবনের অপমানজনক দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার তাঁর সংবেদনশীল কোমল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করে। যা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর মনে প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করে। অস্পৃশ্যের সন্তান বলে স্কুলে বেঞ্চটুলের পরিবর্তে ক্লাশের একেবারে পেছনে ছালার চটে তাঁকে বসতে দেয়া হতো। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁর বইখাতা স্পর্শ করতেন না, থুথুর ছোঁয়ায় বাতাস দুষিত হবে বলে তাঁকে ক্লাশে কোন পড়া জিজ্ঞাসা করা হতো না, এমনকি খড়িমাটি অপবিত্র হয়ে যাবে এই শংকায় তাকে বোর্ডে পর্যন্ত লিখতে দেয়া হতো না। স্কুলে স্বহস্তে জল পান করতে পারতেন না। তাঁর মুখের উপর পাত্র উঁচু করে জল ঢেলে দেয়া হতো। উঁচু বর্ণের সহপাঠিদের টিফিন বক্সগুলোয় যাতে তাঁর কোনরূপ ছোঁয়া না লাগে সেজন্য সাবধানে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। এরকম বহু নির্মম ঘটনা তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছিলো অবশ্যই। কিন্তু এসবই একজন মুক্তিকামী আম্বেদকরের উন্মেষ ঘটায়। অস্পৃশ্যদের মুক্তির দিশারী দলিত আন্দোলনের বীজ হয়ে মানবতার খোঁজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে দেয় আম্বেদকরকে। পরবর্তীকালের প্রতিটা আন্দোলনের উৎস ও ফলাফল বিশ্লেষণ করলে একটাই প্রতিপাদ্য পেয়ে যাই আমরা, মানবতার সন্ধান। মানুষ হয়ে যে সমাজের মানুষদের মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই তাদের প্রতি ঘৃণায় ক্ষোভে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি খুঁজতে থাকেন মানবতার  সাম্যের অমিয়বাণীর উৎসটাকে।
‘তিনটি শব্দের মধ্যে আমার জীবন দর্শন খুঁজে পাই। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যদিও আমরা ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতিকে গ্রহণ করেছি বস্তুত আমাদের সমাজ জীবনে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমি বুদ্ধের বাণী থেকে গ্রহণ করেছি। হিন্দু ধর্মে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কোন স্থান নেই, তাই বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করলে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ পরস্পরের পরিপূরক হবে।’
‘কেন আমি বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি’ শীর্ষক প্রচারিত এক বক্তৃতায় বলেন-
‘আমি তিনটি নীতির জন্য বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি। প্রথমটি হলো প্রজ্ঞা (অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত জ্ঞান), দ্বিতীয়টি হলো করুণা (প্রেম অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা) এবং তৃতীয়টি হলো সাম্য (সমতা অর্থাৎ সমস্ত মানুষকে সমান মনে করা)।’
শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামী নিয়ে এই বৌদ্ধধর্মেই দীক্ষা নিয়ে অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক মুছে এক নবজন্ম নিয়েছিলেন, এবং দিয়েছিলেন অন্যদেরকেও। অস্পৃশ্য হয়ে জন্মালেও অস্পৃশ্য হয়ে মরেননি তিনি। বুদ্ধের পবিত্র আলো বুকে ধরে এক মহান পাহাড়ের সৌম্য স্থিরতা নিয়ে মহানির্বাণে প্রস্থান করলেন।

আজ আম্বেদকর নেই। রয়ে গেছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। অথচ বর্ণান্ধতার গোঁড়ামি থেকে হিন্দু সমাজ মুক্ত হতে পারলো না আজো। এ আমাদেরই নিরন্তর মূর্খতা, অনপনেয় কলঙ্ক। একজন আম্বেদকর কষ্টে, যাপনে, বিদ্রোহে, সাম্যে সারাটা জীবন পথ দেখিয়ে গেছেন ঠিকই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তারপরও যদি মহামূর্খ আমরা চোখ বন্ধ করেই থাকি, অধোগামিতার প্রলয় কি বন্ধ হবে আদৌ ?
———————————————


কৃতজ্ঞতা: তথ্য সূত্র-
১) ‘মনুসংহিতা’ / সম্পাদনা মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় / সুলভ সংস্করণ, বইমেলা ১৪১২, কলকাতা।
২) অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির প্রবক্তা ডঃ আম্বেদকর / সুভাষ কান্তি বড়ুয়া / ১৯৯৮ প্রথম সংস্করণ।
৩) ইংরেজিবাংলা ‘উইকিপিডিয়া’, অনলাইন মুক্তবিশ্বকোষ (Wikipedia, the free encyclopedia)।
৪) ’তিতাস’ থেকে ‘পিতৃগণ’ / জাকির তালুকদার।
৫) বিশ্ব মর্যাদা দিবসের ভাবনা ড. আম্বেদকর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা / ‘সন্তবন্ধু’ মাস্টার কানাই লাল রবিদাস, সহসভাপতি, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত অধিকার আন্দোলন এবং আহবায়ক, বাংলাদেশ দলিত ফোরাম। (BPERM)।
৬) ভারতীয় শাসকদের ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা / বাঙ্গাল আব্দুল কুদ্দুস।


[mukto-mona] Part: |01|02|03|04|05|06|
...

No comments: