| কবি ও শিশুসাহিত্য এবং আমাদের দায়বদ্ধতা…|
-রণদীপম বসু
…
কবি কিংবা শিল্পী, হওয়া না-হওয়ায় কী এসে যায় ?
সমাজে একজন ব্যক্তির কবি বা শিল্পী হওয়া না-হওয়ায় আদৌ কি কিছু এসে যায় ? অত্যন্ত বিরল-ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের বর্তমান আর্থিক মানদণ্ড প্রধান সমাজে একজন কবি বা শিল্পীকে কোন অবহেলিত গোত্রের প্রতিনিধি বলেই মনে হয়। তাই একজন ব্যক্তির কবি কিংবা শিল্পী তথা একজন স্রষ্টা হয়ে ওঠায় ব্যক্তির লাভ-ক্ষতির হিসাবের জবেদা টানার চেয়ে সমাজে এর কী প্রভাব অভিযোজিত হয় তা-ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল একজন ব্যক্তিই, যে পর্যন্ত না তাঁর কোন কাজ বা উদ্যোগ সমাজে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সাথেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা মাত্রিক পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি তখন ব্যক্তিত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন। মানে দাঁড়ালো, ব্যক্তি যখন বিশিষ্ট বা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হয়ে ওঠেন তখনই তিনি ব্যক্তিত্বের পর্যায়ভুক্ত। এখন প্রশ্ন আসবে, তাহলে ব্যক্তি কি কোন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয় ? আমরা তো জানি যে, জগতের প্রতিটা মানুষই ভিন্ন এবং কোন না কোনভাবে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সেক্ষেত্রে প্রতিটা ব্যক্তিই তো একেকজন ব্যক্তিত্ব হবার কথা। অতি সত্য কথা। আর এজন্যেই সমাজের মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার কথা এসেছে। অর্থাৎ সমাজকে প্রভাবিত করার মতো বিশিষ্টতা যিনি অর্জন করেছেন, তিনিই ব্যক্তিত্ব। এলাকার সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী ব্যক্তিটিও সমাজকে কোনোভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে হয়তো। তাকেও কি আমরা ব্যক্তিত্ব বলবো ? অবশ্যই না। কেন বলবো না ? কারণ সন্ত্রাসীকে কেউ অনুকরণ করে না। বাধ্য হয়ে উপরে উপরে আনুগত্য প্রদর্শন আর আদর্শ বা ‘রোল-মডেল’ হিসেবে মেনে নিয়ে অনুকরণ বা অনুসরণ এক কথা নয়। তাছাড়া যে কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য যে-কোন বিচারেই ক্ষতিকারক, তাকে গুণবাচক অর্থে বিবেচনা করার কোন যৌক্তিকতা আছে কি ? অতএব, যিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধরে নেই, তাঁকেই আমরা ব্যক্তিত্ব বলতে পারি। এই বৈশিষ্ট্যসূচক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাজনীতিক, ক্রিড়াবিদ, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, সমাজসেবী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, শিল্প-উদ্যোক্তা, লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিক ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য কবি বা শিল্পী হয়ে ওঠাও তা-ই। এই ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কেউ হয়তো মহান সংগঠক, সাহসের প্রতীক, কেউ অভূতপূর্ব সৃজনশীলতার প্রতীকী স্রষ্টা।
সমাজে একজন ব্যক্তির কবি বা শিল্পী হওয়া না-হওয়ায় আদৌ কি কিছু এসে যায় ? অত্যন্ত বিরল-ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের বর্তমান আর্থিক মানদণ্ড প্রধান সমাজে একজন কবি বা শিল্পীকে কোন অবহেলিত গোত্রের প্রতিনিধি বলেই মনে হয়। তাই একজন ব্যক্তির কবি কিংবা শিল্পী তথা একজন স্রষ্টা হয়ে ওঠায় ব্যক্তির লাভ-ক্ষতির হিসাবের জবেদা টানার চেয়ে সমাজে এর কী প্রভাব অভিযোজিত হয় তা-ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল একজন ব্যক্তিই, যে পর্যন্ত না তাঁর কোন কাজ বা উদ্যোগ সমাজে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সাথেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা মাত্রিক পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি তখন ব্যক্তিত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন। মানে দাঁড়ালো, ব্যক্তি যখন বিশিষ্ট বা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হয়ে ওঠেন তখনই তিনি ব্যক্তিত্বের পর্যায়ভুক্ত। এখন প্রশ্ন আসবে, তাহলে ব্যক্তি কি কোন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয় ? আমরা তো জানি যে, জগতের প্রতিটা মানুষই ভিন্ন এবং কোন না কোনভাবে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সেক্ষেত্রে প্রতিটা ব্যক্তিই তো একেকজন ব্যক্তিত্ব হবার কথা। অতি সত্য কথা। আর এজন্যেই সমাজের মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার কথা এসেছে। অর্থাৎ সমাজকে প্রভাবিত করার মতো বিশিষ্টতা যিনি অর্জন করেছেন, তিনিই ব্যক্তিত্ব। এলাকার সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী ব্যক্তিটিও সমাজকে কোনোভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে হয়তো। তাকেও কি আমরা ব্যক্তিত্ব বলবো ? অবশ্যই না। কেন বলবো না ? কারণ সন্ত্রাসীকে কেউ অনুকরণ করে না। বাধ্য হয়ে উপরে উপরে আনুগত্য প্রদর্শন আর আদর্শ বা ‘রোল-মডেল’ হিসেবে মেনে নিয়ে অনুকরণ বা অনুসরণ এক কথা নয়। তাছাড়া যে কর্মকাণ্ড সমাজের জন্য যে-কোন বিচারেই ক্ষতিকারক, তাকে গুণবাচক অর্থে বিবেচনা করার কোন যৌক্তিকতা আছে কি ? অতএব, যিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধরে নেই, তাঁকেই আমরা ব্যক্তিত্ব বলতে পারি। এই বৈশিষ্ট্যসূচক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাজনীতিক, ক্রিড়াবিদ, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, সমাজসেবী, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, শিল্প-উদ্যোক্তা, লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিক ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য কবি বা শিল্পী হয়ে ওঠাও তা-ই। এই ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কেউ হয়তো মহান সংগঠক, সাহসের প্রতীক, কেউ অভূতপূর্ব সৃজনশীলতার প্রতীকী স্রষ্টা।
যে কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠির মধ্যে এই ব্যক্তিত্বদের প্রভাব অপরিসীম, বিশেষ করে সৃজনশীল ব্যক্তিত্বদের। আর সে কারণেই মানব-মনের খুব গভীরে নিজেকে একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবিষ্কার করার সংগোপন ইচ্ছাটা মানুষ সহজাতভাবেই লালন করে থাকে। তা শুরু হয় শৈশব থেকেই। আচারে আচরণে কাজে কর্মে সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে একটি শিশু বা কিশোর মনে মনে একজন আদর্শ রোল-মডেলও নির্বাচন করে ফেলে এবং অনুকরণপ্রিয় শিশু বা কিশোরটি তার আদর্শ অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপনেরও চেষ্টা করে থাকে। এই যে নির্বাচন প্রক্রিয়া, এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে থাকে শিশু বা কিশোরটির অন্তর্জগতে, যে জগতটি নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত তার পরিবেশ, পরিস্থিতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা বা সামাজিক ও পারিবারিক আবহের মাধ্যমে। শিশুটি সহজ-সরল হলে কী হবে, তার মনোজগতকে এতো সরল ভাবার কোন কারণ নেই। তাই শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা শিশুর পিতাটিকে সঠিকভাবে জাগিয়ে তুলে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে তার মনোজগত নিয়ে নাড়াচাড়া করা বা নিয়ন্ত্রণ করা বোধ করি জগতের অন্যতম জটিল একটা কাজ। এই অনিবার্য কাজটুকু করার প্রাথমিক দায়িত্ব অর্পিত হয় শিশুর অভিভাবক ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকের উপর। কিন্তু তাঁরা তো আসলে অনেক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ একেকজন ব্যক্তি। এই কাজের জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণের সৃজনশীল প্রক্রিয়া। ফলে তাঁদেরকে নৈতিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন সমাজের পূর্বাপর স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বরা। আর যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ব্যক্তিত্বরা এগিয়ে আসেন, সে প্রক্রিয়াটির নামই হলো শিশু-শিক্ষা বা শিশু-সাহিত্য। এর লালন পালন ও সৃজনের দায়িত্ব যেহেতু সেই সব কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কাঁধেই বর্তায়, তাই দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত কবি বা শিল্পী হয়ে ওঠায় সমাজের অনেককিছুই এসে যায় বৈকি। ফলে তাঁদের জন্য একটা দায়বদ্ধতার প্রশ্নও চলে আসে। কী এই দায়বদ্ধতা ?
শিশু-সাহিত্য ও আমাদের দায়বদ্ধতা
দায়বদ্ধতার আলোচনায় গেলে অনিবার্যভাবে শিশু-সাহিত্যের আলোচনাই এসে যায়। কারণ, একটি জাতি গঠনে ঐ জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় সদ্য নবীন প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের উপরই। আর এর সুদূরপ্রসারী ফল এই জাতিকেই বহন করতে হয়। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা শিশু-কিশোররা স্বাভাবিকভাবেই কোন বিক্ষিপ্ত প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারে না বলে তা তাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাছাড়া জাতির যে কোন অর্জন বা বিসর্জনও চূড়ান্ত বিচারে নিবেদিত হয় আগামী দিনের নাগরিক শিশুদের কথা মনে রেখেই। ফলে শিশুকে বাদ দিয়ে যেমন কোন উদ্যোগই আসলে যথার্থ হয় না, তেমনি কবি ও শিল্পী যখন আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, শিশু-সাহিত্য না আসাটাই বরং অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
দায়বদ্ধতার আলোচনায় গেলে অনিবার্যভাবে শিশু-সাহিত্যের আলোচনাই এসে যায়। কারণ, একটি জাতি গঠনে ঐ জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় সদ্য নবীন প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের উপরই। আর এর সুদূরপ্রসারী ফল এই জাতিকেই বহন করতে হয়। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা শিশু-কিশোররা স্বাভাবিকভাবেই কোন বিক্ষিপ্ত প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারে না বলে তা তাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাছাড়া জাতির যে কোন অর্জন বা বিসর্জনও চূড়ান্ত বিচারে নিবেদিত হয় আগামী দিনের নাগরিক শিশুদের কথা মনে রেখেই। ফলে শিশুকে বাদ দিয়ে যেমন কোন উদ্যোগই আসলে যথার্থ হয় না, তেমনি কবি ও শিল্পী যখন আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, শিশু-সাহিত্য না আসাটাই বরং অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
একটি জাতির শিশু-সাহিত্য আসলে জানান দেয় ঐ জাতির পরবর্তী গন্তব্য কোথায়। কেননা শিশুরাই আমাদের অনিবার্য আগামী। শিশুকে তার সমস্ত কল্পনার রসে সঞ্জীবিত করে তার স্বপ্ন ও সৃজনশীলতার আকাঙ্ক্ষাকে পরিপুষ্ট ও উজ্জীবিত করে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় সব উপকরণের শ্রেষ্ঠ জোগানদাতা হচ্ছে শিশু-সাহিত্য। তাই এই শিশু-সাহিত্যের যাঁরা ধারক বাহক, যাঁরা স্রষ্টা, তাঁদের ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার যেমন কোন উপায় নেই, তেমনি একটি শিশু কী পড়বে কী শিখবে কিভাবে গড়ে ওঠবে তার দায় এড়ানোরও উপায় নেই সেই শিশু-সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের। এই দায়বদ্ধতা যাদের নেই, শিশু-সাহিত্যের মতো এমন সংবেদনশীল একটা ক্ষেত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করার অধিকার বা যোগ্যতা কোনটাই তাদের নেই। জাতির মানববৃক্ষের চারা পরিচর্যার দায়িত্ব একটি জাতি নিশ্চয়ই গোড়ায় কুঠার হানা কোন কাঠুরেকে দিতে পারে না, কিংবা কোন দায়বদ্ধহীন প্রক্রিয়ার হাতে সমর্পণ করে গরু-ছাগলে মুড়িয়ে দেয়ার আত্মঘাতি ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দায়বদ্ধতা নিরূপণ হবে কী করে ? এককথায় এর উত্তর হতে পারে- সময়কে সঠিকভাবে ধারণ করা।
কিভাবে সময়কে সঠিকভাবে ধারণ করবো ? এক্ষেত্রে দুটো উদ্যোগ নেয়া যায়। প্রথমটি হলো, প্রচলিত শিশু-পাঠ্যক্রমকে যুগোপযোগী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত ও বিজ্ঞানভিত্তিক করে তোলা। প্রচলিত ব্যবস্থায় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেই আমাদের শিশুরা প্রথমেই হয়ে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত- আমরা ও তারা। যে মুহূর্তে একটি শিশুর মধ্যে এই ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলা জরুরি যে, আমরা সবাই মানুষ, আমরা একজাতি, মানুষ জাতি, ঠিক তখনই তার কল্পজগতের অনন্ত সম্ভাবনাময় শিশুসত্তায় প্রথম ধাক্কাটি আসে ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে মানব সমাজে নিজেকে খণ্ডিত হবার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে- আমরা অমুক জাতি, ওরা তমুক জাতি, তারা সমুক জাতি ইত্যাদি। শিশুর উন্মিলিত চোখ এই বিভ্রান্তিকর বিভেদের কোন জবাব পায় না। অবোধ শিশু ধর্ম বোঝে না, সে বুঝে কল্পনা। সে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান হবার মর্ম বুঝে না, সে বুঝে মানুষ, সহপাঠি, বন্ধু। অথচ উদারতার বদলে সে পেয়ে যায় সঙ্কুচিত হবার শিক্ষা, নিজেকে প্রসারিত করার জায়গায় সে হয়ে যায় আত্মকেন্দ্রিক। বড় হয়ে যে ধর্ম-দর্শনের জটিল শিক্ষা থেকে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে নিজেকে খুঁজে ফেরার কথা, সে সব কিছু না-জেনে না-বুঝে মানুষ না-হয়ে এক বিভাজিত অন্ধ পরিচয়ে বড় হতে থাকে। একই কারণে তার মানবিক বোধে ঘটে যেতে পারে ভয়ঙ্কর বিকৃতি বা অপূর্ণতা। ফলে শৈশবের সেই অবচেতন মনে ধর্মীয় বিভেদের ছাপ পড়ে যাওয়া শিশুটির বড় হয়ে মানুষ হবার চেয়েও ধর্ম পরিচয়টাই প্রকট হয়ে থাকার সম্ভাবনায় নিক্ষিপ্ত হয়। এতে করে যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানচেতনা তার থেকে যোজন দূরত্বে সরে যেতে থাকে। যে শিশু-বয়সে সহজাত অসংখ্য প্রশ্নমুখীনতার মাধ্যমে যুক্তিবোধ গড়ে ওঠার কথা, সে সময়ে তাকে দেয়া হয় কোন প্রশ্ন না-করে যুক্তিহীনভাবে মেনে নিতে বাধ্য হবার শিক্ষা। ফলে শুকিয়ে যায় তার সহজাত সৃজনশীলতা। বিজ্ঞান-দৃষ্টি হয়ে যায় অন্ধ। সৃষ্টির মধ্যে বিনোদন না খুঁজে সে ধ্বংসাত্মক কাজের দিকে এগিয়ে যায়। অনুরূপ শিক্ষায় সে এও জেনে যায়, সহপাঠি হলে কী হবে, ছেলে আর মেয়ে সমান নয়, তারা ভিন্ন। তাদের চাওয়া পাওয়া ভিন্ন, লক্ষ্য ভিন্ন। ফলে একইসাথে কেউ পায় ছেলে হয়ে জন্ম নেয়ায় হীন-অহঙ্কারি হবার শিক্ষা, কারো মধ্যে অজান্তেই ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়ে হয়ে জন্মানোর হীনম্মণ্যতার বিষ।
এসব জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের স্বপ্নময় শিশুরা যাতে উন্মুক্ত উদার মন নিয়ে অবাধে বড় হতে পারে, তাদের যুক্তিবোধ মানবিক গুণাবলি পূর্ণ বিকশিত হতে পারে, সে জন্য প্রচলিত পাঠ্যক্রম থেকে সব ধরনের অন্ধ বিভেদমূলক পাঠ অপসারণ করে সময়োপযোগী যুক্তিবোধসম্পন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সময় বদলে গেছে আজ। পুরনো মৃত অনগ্রসর চিন্তা-চেতনার ধ্বজাধারী পাঠ শিখিয়ে এক অথর্ব জাতি তৈরি করার অফেরতযোগ্য মাশুল গুনতে না-হলে এখনই যোগ্য শিশু-কিশোর উপযোগী পাঠ্যক্রম নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরকে। এক্ষেত্রে কেবল কবি-শিল্পীরা নন, আমরাও দায়বদ্ধ।
দ্বিতীয়ত শিশু-সাহিত্যের নাম দিয়ে যা-কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে, তাকে প্রকৃত অর্থেই যাচাই বাছাইয়ের একটা প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। শিশু-পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস করার প্রথমোক্ত প্রস্তাবনায় যদিও রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা মূখ্য ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু করার নেই। সাহিত্য অঙ্গনে যাঁরা বোদ্ধা, সৃজন-ভূমিকা নিয়ে বিচরণ করছেন, তাঁদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে এবং এ কাজে অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে শিশু-সাহিত্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত সমালোচনামূলক ধারা তৈরির জন্য। মূলধারার সাহিত্যে সমালোচনা-সাহিত্য নামে একটা স্বতন্ত্র শাখা ব্যাপকভাবে চালু থাকলেও আমাদের শিশুসাহিত্যে এটা আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। অথচ এক্ষেত্রেই এটার প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশি। শিশুর মনস্তত্ত্ব, তার স্বপ্ন, তার আকাঙ্ক্ষা, তার কল্পনা, তার কৌতুহল, তার ধারণক্ষমতা, তার কষ্ট, তার আনন্দ, তার বিদ্রোহ ইত্যাদি কিছুই না-জেনে না-খুঁজে গৎবাঁধা খিচুড়ি বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দিলেই যে শিশুসাহিত্য হয় না তা বোঝা এবং বুঝানোর তাগিদেই ছাঁকনি হিসেবে একটা সমালোচনামূলক ধারা আবশ্যক বলে মনে হয়। শিশু তো আসলে গিলে না কিছু, আমরাই গেলাই তাকে। তাই অভিভাবক হিসেবেও আমাদের জন্যেই এটা জানা অত্যন্ত জরুরি যে, আমরা আমাদের শিশুকে আসলে কী বানাতে চাই এবং তাকে কী গিলাচ্ছি আমরা ? শিশু-সাহিত্য ভেবে আমরা শিশুদেরকে যা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি বা আমাদের শিশুরা যা পাচ্ছে নির্দ্বিধায় তুলে নিচ্ছে তা কতোটা শিশু-সাহিত্যের শর্ত পূরণ করছে, এটা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমরা ? আমাদের নিজস্ব হঠকারিতা দিয়ে আমাদের শিশুদেরকে শিব গড়তে আসলেই কোন বানর বানিয়ে তুলছি না তো ?
অতঃপর আবারো সেই প্রশ্ন
খুব নগন্য হলেও সাহিত্যের তথাকথিত পিঠ-চুলকানি বাদ দিয়ে কাউকে কাউকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও শিশুসাহিত্য নিয়ে একটু আধটু স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্লেষণের চেষ্টা-চরিত করতে দেখা যায়। অবশ্য তাও বিচ্ছিন্ন কিছু স্বঘোষিত ছড়া বিষয়ক লিটল-ম্যাগাজিনে। কিন্তু মূলধারার যে প্রকাশ-মাধ্যম যেমন দৈনিক বা সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা-ম্যাগাজিন কিংবা মূলধারার লিটল-ম্যাগাজিনও, সেখানে শিশু-সাহিত্য বরাবরের মতোই দুঃখজনকভাবে উপেক্ষিতই শুধু নয়, যেন নিষিদ্ধ। এই আশ্চর্য রহস্যময়তার কারণ কী, তা অজানা। এর একটি কারণ হতে পারে, আগে যেমন আমাদের সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা মূলধারার সাহিত্য রচনার পাশাপাশি শিশুসাহিত্যও সৃষ্টি করে গেছেন একাধারে, ইদানিং সেখানেও একটা বিভাজন বুঝি অজান্তেই ঘটে গেছে। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখন মূলধারার সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা শিশুসাহিত্য রচনায় যেন সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অন্যদিকে শিশু-সাহিত্যিক নামে এমন একটা স্বতন্ত্র গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেছে যে, এদের সিংহভাগই বোধ করি মূলধারার সাহিত্যে কী ঘটছে না ঘটছে তার খোঁজ-খবরও রাখেন না, অন্তত তাদের সৃষ্টিকর্ম থেকে এই ধারণাই তৈরি হয়ে যায়। এমনকি দিনের পর দিন তাদের নবিশি কর্মকাণ্ডকে শিশু-সাহিত্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার উদ্ভট মানসিকতা দেখে এমন ধারণায় উপনীত হওয়াও বিচিত্র নয় যে, সাহিত্য যে একটা স্বতন্ত্র শিল্প-মাধ্যম সে বোধটাও বুঝি তারা হারিয়ে ফেলেছে, সাহিত্যের সময়জ্ঞান তো লোপ পেয়েছেই।
খুব নগন্য হলেও সাহিত্যের তথাকথিত পিঠ-চুলকানি বাদ দিয়ে কাউকে কাউকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও শিশুসাহিত্য নিয়ে একটু আধটু স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্লেষণের চেষ্টা-চরিত করতে দেখা যায়। অবশ্য তাও বিচ্ছিন্ন কিছু স্বঘোষিত ছড়া বিষয়ক লিটল-ম্যাগাজিনে। কিন্তু মূলধারার যে প্রকাশ-মাধ্যম যেমন দৈনিক বা সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা-ম্যাগাজিন কিংবা মূলধারার লিটল-ম্যাগাজিনও, সেখানে শিশু-সাহিত্য বরাবরের মতোই দুঃখজনকভাবে উপেক্ষিতই শুধু নয়, যেন নিষিদ্ধ। এই আশ্চর্য রহস্যময়তার কারণ কী, তা অজানা। এর একটি কারণ হতে পারে, আগে যেমন আমাদের সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা মূলধারার সাহিত্য রচনার পাশাপাশি শিশুসাহিত্যও সৃষ্টি করে গেছেন একাধারে, ইদানিং সেখানেও একটা বিভাজন বুঝি অজান্তেই ঘটে গেছে। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখন মূলধারার সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা শিশুসাহিত্য রচনায় যেন সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অন্যদিকে শিশু-সাহিত্যিক নামে এমন একটা স্বতন্ত্র গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেছে যে, এদের সিংহভাগই বোধ করি মূলধারার সাহিত্যে কী ঘটছে না ঘটছে তার খোঁজ-খবরও রাখেন না, অন্তত তাদের সৃষ্টিকর্ম থেকে এই ধারণাই তৈরি হয়ে যায়। এমনকি দিনের পর দিন তাদের নবিশি কর্মকাণ্ডকে শিশু-সাহিত্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার উদ্ভট মানসিকতা দেখে এমন ধারণায় উপনীত হওয়াও বিচিত্র নয় যে, সাহিত্য যে একটা স্বতন্ত্র শিল্প-মাধ্যম সে বোধটাও বুঝি তারা হারিয়ে ফেলেছে, সাহিত্যের সময়জ্ঞান তো লোপ পেয়েছেই।
শিল্পের ধর্ম হচ্ছে তার নির্মাণ বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে পূর্বসূরীকে অতিক্রম করা কিংবা অতিক্রম করা না গেলেও পাশাপাশি এগিয়ে যাওয়া। ভূতের মতো পেছন-হাঁটা নয়। শিশু-সাহিত্যে আমাদের যে পুরনো ক্লাসিক সম্পদ রয়ে গেছে তার সাপেক্ষে আমাদের বর্তমান স্রোত দেখলে মনে হবে আমাদের শিশুরা বুঝি একটা ভুত-প্রজন্মের হাতেই জিম্মি হয়ে গেছে। কালের বিচারে এরা হয়তো হারিয়ে যাবে। তবে যাদেরকে তুলনামূলক মেধাবী বলে আপাত ধারণা করা হয়, সাহিত্যের খাতিরে তাদের সৃজনকর্মের কিঞ্চিৎ নির্মোহ সমালোচনা করলেই এরাও এটাকে গঠনমূলক দৃষ্টিতে না দেখে যেভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে চমকিত করে দেন, এতে করে সেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের পার্থক্যটা ফের সামনে চলে আসে। লেখায় ও মুখে এদের অসহিষ্ণুতা দেখলে মনে হয় আমরা তাদেরকে ভুল করে ব্যক্তিত্ব ভাবলে কী হবে, তারা যে আসলে মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন নি, বাঘ নাই বনে শিয়াল রাজার মতো সচেতন বা অবচেতন ইচ্ছায় ব্যক্তিত্ব সাজার কৃত্রিম চেষ্টা করেছিলেন মাত্র, বোঝার বাকি থাকে না। এদেরকেই হয়তো বলা যেতে পারে ‘ছদ্ম-ব্যক্তিত্ব’। সাহিত্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল শাখাটি এভাবে ছদ্ম-ব্যক্তিত্বদের কবলে জিম্মি হয়ে যাবে, তা কি মেনে নেয়া যায় ? তা মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে- ভিন্নার্থে আমাদের কচি কচি অবোধ শিশুদেরকে আমাদের আগামীকে একটা দুষ্টগ্রহে ছেড়ে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে একজন কবি বা শিল্পী কখনোই ছদ্ম-ব্যক্তিত্ব হন না। ছদ্ম-ব্যক্তিত্ব তারাই যারা কবি বা শিল্পী হওয়া পরের কথা, প্রয়োজনীয় মানবিক গুণাবলি অর্জনেই যাদের দুঃখজনক ঘাটতি রয়ে যাবার পরেও নিজের ঘাটতি পূরণে সচেষ্ট না হয়ে সমাজকে নিরন্তর প্রবঞ্চনা করে যায়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। এই ছদ্ম-ব্যক্তিত্বদেরকে চিহ্নিত করা জরুরি আমাদের আগামীর স্বার্থেই। আর এজন্যেই দরকার সমালোচনা নামের এক নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ টেবিল।
একজন নির্বোধ শিক্ষক কখনোই নীতিনিষ্ঠ জ্ঞানী ছাত্র উপহার দিতে পারে না। আমরা আমাদের শিশুদেরকে সেইসব যোগ্য ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করতে চাই যাঁরা নৈতিকতায় আপোষহীন, জ্ঞানে উজ্জ্বল, মানবিকতায় অনুকরণীয় এবং সৃষ্টি ও কল্পনায় অবাধ। আমরা আমাদের শিশুদেরকে সেই কবিদের হাতে সমর্পণ করতে চাই। কিন্তু কবি বলতে আমরা কী বুঝবো ?
কবি ও কবিতা
আলোচনার কান ধরে টান দিলে কবিতা এসে যেতেই পারে। তাই এখানে বলে নেয়া ভালো যে এটা কোন কবিতার ক্লাশ বা কাব্য আলোচনা নয়। স্রেফ অভিজ্ঞতা বিনিময়। শেখা বা জানার প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা ব্যক্তিমাত্রেই স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব মেধা, বোধ ও সীমাবদ্ধতার স্কেলে নিয়ন্ত্রিত বলে রহিমকে রাম বানিয়ে ফেলা বা শিল্পের কলা’কে হস্তী-ভক্ষ্য কদলীবৃক্ষ বানিয়ে গিলে ফেলার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়ার নয়। এমন দুর্যোগ ঘনীভূত হলে হাত তোলে জানান দেয়ার স্বাধীনতা সবারই রয়েছে, যে, আর্ট আর অষ্টকদলী একই বস্তু নয় !
আলোচনার কান ধরে টান দিলে কবিতা এসে যেতেই পারে। তাই এখানে বলে নেয়া ভালো যে এটা কোন কবিতার ক্লাশ বা কাব্য আলোচনা নয়। স্রেফ অভিজ্ঞতা বিনিময়। শেখা বা জানার প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা ব্যক্তিমাত্রেই স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব মেধা, বোধ ও সীমাবদ্ধতার স্কেলে নিয়ন্ত্রিত বলে রহিমকে রাম বানিয়ে ফেলা বা শিল্পের কলা’কে হস্তী-ভক্ষ্য কদলীবৃক্ষ বানিয়ে গিলে ফেলার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়ার নয়। এমন দুর্যোগ ঘনীভূত হলে হাত তোলে জানান দেয়ার স্বাধীনতা সবারই রয়েছে, যে, আর্ট আর অষ্টকদলী একই বস্তু নয় !
দুর্দান্ত সব কবিতা উপহার দিয়েও বোহেমিয়ান শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান কবি যখন নিজেকে পদ্যকার হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কৌতুক আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন, তখন সত্যিকারের কবিরা নিজ নিজ কৃতকর্মগুলো হাতে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসেন বৈ কি। কবি শব্দের আগে একটা ‘সত্যিকারের’ শব্দ বসানো মানেই যুক্তিবিদ্যার আরোহী পদ্ধতি অনুযায়ী কাল্পনিকভাবে হলেও প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্টো স্বভাবের আরেকটা সত্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়। তাহলে কি মিথ্যাকারের কবিও রয়েছে ! রয়েছে বৈ কি ! নইলে কবি জীবনানন্দ দাশ কেনই বা সাধ করে ‘কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি’ উক্তি করে এমন ল্যাঙ মারতে গেলেন !
জীবনানন্দের এই উক্তিটাতে যে অবশ্যই জটিল একটা বিভ্রম লুকিয়ে আছে তা অস্বীকার করার জো নেই। তাই উক্তিটাকে খুব সরলভাবে নেয়ারও উপায় নেই। এ কারণেই কৌতুহলটা উচ্চকিত হয়ে ওঠে, বিভ্রমটা কী ? তাঁর উক্তির প্রথম অংশটা আবারো আমরা খেয়াল করি, ‘কবিতা লিখে অনেকেই…’। হাঁ, লিখতেই পারে ! তাতে কী হয়েছে ? হয়েছে বা হচ্ছে অনেক কিছুই, আবার কিছুই না। যে কোনো কাজের অনিবার্য ফলাফলের মতোই কিছু সম্ভাব্যতাকে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, এদের ‘কেউ কেউ কবি’ বলে। কিন্তু উক্তির প্রথম অংশে কাজের ডিটেইলসটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। এখানেও কতকগুলো সম্ভাব্যতার অনির্দেশ্যতা দেখতে পাই আমরা। যেহেতু অনেকেই কবিতা লিখেন, তাহলে অনেকে আবার অকবিতাও লিখেন। আবার অনেকে কবিতাই লিখেন না। অকবিতা লিখলে কবি হওয়া যায় কিনা, সে বিষয়টা এখানে অপ্রযোজ্য হয়ে আছে। অকবিতা লিখা এবং কবিতা না লিখা আবার দুটো ভিন্ন বিষয়। আমাদের অনেকেই যে প্রশ্নটি করতে দ্বিধা করেন তা হলো, কবিতা না লিখলে কি কবি হওয়া যায় না ? প্রশ্নটাকে অর্থহীন ভেবে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই। জীবনানন্দের ভাষায় কেবল কবিতা লিখলেই যদি কবি হওয়া না যায়, তাহলে উল্টো যুক্তিতে যদি বলি, কবিতা না লিখেও কেউ কেউ কবি, এটাকে কি ফ্যালাসি বলবো ? মোটেও ফ্যালাসি নয় তা।
যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় ফ্যালাসি হচ্ছে অর্থহীন প্রতিতুলনা দিয়ে কোন উদ্ভট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমন, আমার দাঁড়ি আছে, ছাগলেরও দাঁড়ি আছে, অতএব আমি ছাগল এইরকম। তাই বিষয়টা ফ্যালাসি না হলেও ফ্যালাসির মতো মনে হতে পারে। কেননা জীবনানন্দের উক্তি থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কবিতা লেখাটা কবি হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোন ফ্যাক্টর বা শর্ত নয়। তাহলে কী শর্ত ? আলোচনার এই উন্মুক্ততায় এসে এখানেই আমরা থমকে যাই। সেরকম কোন শর্ত এখনো স্বতঃসিদ্ধতা পায় নি বলেই অনুমিত একটা ধারণা থেকে আমরা এটা বুঝে নেই যে, কবি একটি অন্তর্গত সত্তার নাম। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে গেলে যে সব সৎ-গুণাবলী ও সুকৃতি থাকতে হয়, একজন কবির সত্তায় তা তো থাকবেই, বরং মেধা মনন আর সৃজনশীলতায় মাখানো আরো কিছু উপলব্ধির অনুরণনও সেখানে থাকতে হয়।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে, আমরা কী করে বুঝবো ‘তিনি’ একজন কবি ? বোঝার কি কোনো কায়দা আছে ? এ ক্ষেত্রে আবারো যুক্তির সিঁড়িকেই মাধ্যম করে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। একবাক্যে যেহেতু জগতের সবাইকে বাছবিচারহীনভাবে কবি বলে স্বীকৃতি দেয়াটা বালখিল্য উদ্ভটতা হিসেবে গণ্য হবে, তাই উল্টোভাবে ‘কেউ কবি নয়’ থেকে পর্যায়ক্রমে সামনে কবি হওয়ার দিকে আগানোটাই যুক্তিসঙ্গত প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। অর্থাৎ ধীরে ধীরে একজন কবি তৈরি হয়ে ওঠেন। সুকৃতি আর মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়েই এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা আগাতে থাকে। যাঁর মধ্যে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার মানবিক গুণাবলীরই ঘাটতি রয়েছে, তিনি যদি মানুষই হয়ে ওঠতে না পারলেন, কবি হবেন কী করে ! এখানে আবার প্রশ্ন, মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ একজন পরিপূর্ণ মানুষ আর কবির মধ্যে তফাৎটা কোথায় তাহলে ? পরিপূর্ণ একজন মানুষ হওয়ার পরও কবি হয়ে ওঠতে বাকি যে মেধা মনন বোধ উপলব্ধি ও সৃজনশীল সুকৃতিটুকু দরকার, মূলতঃ সেটাই তফাৎ। এবং খুব সঙ্গতভাবেই, যেহেতু প্রসঙ্গ কবি হওয়ার, তাই শেষ পর্যন্ত কবিতা বা কাব্যবোধের বিষয়টা অনিবার্যভাবে চলে আসাটাই তো স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত।
জীবনানন্দের কথাতেই ফিরে যাই আবার- কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি। এখন মনে হয় কথাটার অন্তর্গত ভাবের আরেকটু কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। আমাদের উপলব্ধিবোধটাকে একটু অন্তর্মুখী করে কয়েকটা বিষয় এবার মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। ধরে নেই প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় অগ্রগামী, ব্যক্তিক স্বভাব, রুচি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সার্বিক জীবনাচারে মানবিক বিবেচনাবোধে উত্তীর্ণ একজন ‘তিনি’ যে চমৎকার একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হতেই পারেন তাতে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্তু স্রষ্টা হিসেবে তাঁর রচনায় যদি সৃজনশীল কাব্যবোধের প্রকাশ না ঘটে, তাহলে কবি পরিচয়ের প্রাসঙ্গিকতা এখানে কতোটা প্রযোজ্য হবে ?
আবার অন্যদিকে একটি রচনা কবিতা বা কাব্যগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠতে যে সব শর্তাবলী প্রয়োগ আবশ্যক, সেই সব কিছু ঠিক রেখেই ‘তিনি’ উৎকর্ষ কাব্যসাধনায় মগ্ন রয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি অসৎ, সামাজিক জীবনে অসদাচারী এবং সামষ্টিকভাবে তিনি মানবতার বিরুদ্ধ অবস্থানে নিজেকে জড়িত রেখেছেন বা পশ্চাৎপদ মানসিকতায় তিনি প্রগতির বিপক্ষ-কাতারে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখেন, তাঁকে কি আমরা কবি বলতে পারি ?
‘কবিতা লিখে অনেকেই, কেউ কেউ কবি ’, জীবনানন্দের কথাটিকে এসব শ্রেয়বোধ দিয়ে যদি বিশ্লেষণ করি আমরা, তাহলেই হয়তো অনেকগুলো বিভ্রমের পর্দা আমাদের চোখের সামনে থেকে নির্দ্বিধায় অপসৃত হয়ে যাবে। আমরা কি আদৌ করবো তা ? গুটিকয় পঙক্তি বা বাক্য রচনা করেই আমরা বুঝে না বুঝে নিজের বা অন্যের নামের আগে ‘কবি’ উপাধীর সুদৃশ্য যে তকমাটি অনায়াসে বসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছি না, এটা কি আমাদের বাছবিচারহীন উদারতার মূর্খামী, না কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বুদ্ধিবৃত্তিক বালখিল্যতা, এই আত্মবিশ্লেষণটা কি এখন জরুরি নয় ?
অতঃপর ছড়াকার-ছড়াশিল্পী সমাচার
ছড়াসাহিত্যেও ইদানিং মনে হয় একটা পরিচিতি সংকট ক্রমেই দৃষ্ট হয়ে ওঠছে। রচনার মূল যে অভিক্ষেপ ছড়া, সেটা কি হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সে বিষয়টা খুব সচেতনভাবে আমরা এড়িয়ে তো যাচ্ছিই, বরং কেউ কেউ আবার এতদিনকার ‘ছড়াকার’ পরিচয়টাকে নিজের জন্য অতি অপ্রতুল বিবেচনায় আকর্ষণীয় নতুন তকমা ধারণ করতে চাচ্ছি ‘ছড়াশিল্পী’ নামে ! ছড়াকে যেনতেন একটা আকার হয়তো দিয়ে দিচ্ছি আমরা, কিন্তু এই ছড়াকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে নিজস্ব মন ও মননে কতটুকু সৃজনশীল শিল্পসত্তা ধারণ করতে হয়, তা কি আদৌ ভাবি আমরা ?
ছড়াসাহিত্যেও ইদানিং মনে হয় একটা পরিচিতি সংকট ক্রমেই দৃষ্ট হয়ে ওঠছে। রচনার মূল যে অভিক্ষেপ ছড়া, সেটা কি হচ্ছে নাকি হচ্ছে না সে বিষয়টা খুব সচেতনভাবে আমরা এড়িয়ে তো যাচ্ছিই, বরং কেউ কেউ আবার এতদিনকার ‘ছড়াকার’ পরিচয়টাকে নিজের জন্য অতি অপ্রতুল বিবেচনায় আকর্ষণীয় নতুন তকমা ধারণ করতে চাচ্ছি ‘ছড়াশিল্পী’ নামে ! ছড়াকে যেনতেন একটা আকার হয়তো দিয়ে দিচ্ছি আমরা, কিন্তু এই ছড়াকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে নিজস্ব মন ও মননে কতটুকু সৃজনশীল শিল্পসত্তা ধারণ করতে হয়, তা কি আদৌ ভাবি আমরা ?
যারা এই অল্পতে তুষ্ট নন, তাঁদেরকে বিনীতভাবে বলি, একজন ব্যক্তি ক্রমে ক্রমে শিল্পী হয়ে ওঠলে এটা সমাজের জন্য সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই গৌরবের ব্যাপার। এতে সমাজ সংস্কৃতি ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। আমরাও তো এই উত্তরণই চাই। কিন্তু চিন্তাভাবনায় ঘাটতি রেখে এমন স্বেচ্ছামুকুট ধারণ করার আগে অন্ততঃ এক হাজারবার ভাবা জরুরি নয় কি যে, অন্যের কথা বাদ দিলেও নিজের কাছেই নিজেকে যেন জবাবদিহিতায় পড়তে না হয় ? কারণ তিনিই শিল্পী যিনি নিজের মধ্যে শিল্পের কলাকৈবল্যসমেত এক মহৎ কবিসত্তা ধারণ করেন।
আমাদের লোকছড়া নিয়ে ব্যাপক সন্ধান ও গবেষণা থাকলেও আধুনিক ছড়া সাহিত্যের গবেষণাকর্ম খুঁজতে এখনো আমাদেরকে দূরবীক্ষণ আর অনুবীক্ষণযন্ত্র হাতে নিয়েই বেরোতে হয়। ঘাড় ফেরালেই যেদিন এই চর্মচক্ষেই আধুনিক ছড়াসাহিত্যের প্রয়োজনীয় গবেষণাকর্ম অনায়াসলব্ধ হয়ে ওঠবে, সেদিনই হয়তো শিশু ও ছড়াসাহিত্যের এরকম বহু অনর্থক সংকটও অনেকাংশে কেটে যাবে। আমরা সেদিনের প্রতীক্ষাতেই রইলাম…।
…
[sachalayatan]
...
…
[sachalayatan]
...
No comments:
Post a Comment