Friday, June 11, 2010

| অশ্লীল |

| অশ্লীল |
-রণদীপম বসু
[সাহিত্যে শ্লীল আর অশ্লীলের সীমা নির্ধারণ করাটা মনে হয় খুবই বিটকেলে একটা ব্যাপার। তাছাড়া শ্লীল ও অশ্লীলের আপেক্ষিক অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্তর মতানৈক্য। ব্যক্তি, পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থান, সময়, সংস্কৃতি, প্রথা প্রভৃতির মতো জটিল জটিল সব অনুঘটকের জারণ-বিজারণ ক্রিয়ার দুরুহ সমীকরণ টানার দায়-দায়িত্ব যারা কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের চিরকেলে দায়িত্ব পালন করতে থাকুন। ইত্যবসরে আমরা নাহয় পাঠকের নিজস্ব বিবেচনাবোধকেই আপাত মাপকাঠি ধরে সাহিত্যক্রিয়ায় রত থাকি। আপনি আমি সেই সমীকরণের সর্বজনগ্রাহ্য ফলাফলের অনির্দিষ্ট আশায় হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও সাহিত্যের চিরায়ত স্রোতটা থেমে থাকবে না নিশ্চয়ই।

এই গল্পটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কিনা জানিনা, তবে বাস্তবসঞ্জাত চরিত্রের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপগুলোতে তথাকথিত আপত্তিকর শব্দাবলির ব্যবহারে কোন রাখঢাকের চেষ্টা করা হয়নি। আশা করি আগ্রহী পাঠক নিজ দায়িত্বেই তা পড়বেন।
]


অই খানকির পোলা !… ঘাঁড়ের উপর শার্টের কলারে একটা শক্ত হাতের খাবলে ধরা হেঁচকা টানে চমকে ওঠলো রণক। একমনে হাঁটার সম্মুখগতিতে এরকম পেছনটানে কলারের নিচের বোতামটা ফাঁস লাগার মতো গলায় বসে গেছে।
তরে যে ডাকতাছি, কানে দিয়া হান্দায় না মাদার চোদ !

ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত রণক বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেললো। মতিঝিলে পঞ্চম দিনের অফিস শেষে টাউনবাসে টানা দেড় ঘণ্টার ঝুলাডলা খেয়ে মিরপুর-দশে নেমে পনের মিনিট হেঁটে মেসের দিকে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও ঢাকায় রাত হয় না। আজই রিমিকে চিঠি লিখতে হবে অফিসের প্রথম সপ্তাহের অভিজ্ঞতা জানিয়ে। একনাগাড়ে এক সপ্তা রিমিকে না-দেখার অচিন্তনীয় বাস্তবতায় নিজেই আশ্চর্য সে ! দোকান থেকে এ-ফোর সাইজের দশ পাতা অফসেট পেপার নিয়ে এসেছে আঠারো টাকা দিয়ে। মোটা শিসের স্ট্যাডলার বল-পয়েন্ট কলম নিয়েছে একটা বিশ টাকা দিয়ে। জার্মানিরটা পায়নি, গ্রেট ব্রিটেনেরটাই নিয়েছে। অফসেটের ধবধবে সাদা দুটো খাম নিয়েছে চারটাকা দিয়ে, একটা নষ্ট হলেও যাতে আরেকটা ব্যবহার করা যায়। আর আট টাকা দিয়ে বড়সড় একটা মোম। ঢাকায় বিদ্যুতের যা হাল ! রিমিটাও যে কী না ! সেই পাগলিই রয়ে গেলো। ওর এক কথা, মোবাইলে নয় মেইলে নয়, কাগজের উপরে গুটগুট করে হাতে লেখা চিঠি চাই। কী আশ্চর্য ! বললেই হয় নাকি ! শেষ কবে যে চিঠি লিখেছে, মনেই করতে পারছে না সে ! তবে গত দুবছরে প্রায় প্রতিদিনই কাগজের বুকে কিছু না কিছু লিখেছেই সে রিমির জন্যে। কখনো ভালো লাগা কোনো কবিতার দুয়েকটা চরণ, কখনো চমৎকার কোনো বাণী, কখনো নিজেরই তৈরি কোনো বাক্য বা অন্য কিছু, যা কেবলি রিমির জন্য। দুজনের একান্ত মাধুর্যময় অসংখ্য অর্থহীনতার মাঝে রিমির হাতে ধরিয়ে দেয়া এক টুকরো কাগজের বুকে নিরিবিলি বসে থাকা কিছু কালো অক্ষর যে কী অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে দিতো !

বাঁ হাতে নেটের ব্যাগটা ঝুলিয়ে গলির মুখে এসেই ঘেমে নেয়ে একসার মুখটা তেতো হয়ে গেলো, বিদ্যুৎ নেই। ছিক্ ! যাওয়ার গ্যারান্টি আছে, আসার নেই। কুপির আলোয় অন্ধকার হয়ে থাকা ভ্যানটাতে অবশিষ্ট সবজিগুলো বিক্রির আশায় হয়তো লোকটি বসে ঝিমুচ্ছে। ওটা পেরিয়ে সামনে ডানদিকের সেলুনটাতে লোকাল জেনারেটরের সংযোগ নেয়া টিউবের আলোয় আধ-কামানো অর্ধউদোম লোকটি মৃত ফ্যানের নিচে হাপুশ-হুপুশ করছে। পুরুষের উদোম শরীর কি অশ্লীল হয় ? তবু এরকম মেদবোঝাই নাদুস-নুদুস ঝুলে পড়া উদোম শরীরটাকে রণকের কাছে অশ্লীল মনে হচ্ছে কেন ! বিপরীত দিকের ফার্মেসিটাতে প্রৌঢ়মতো লোকটি হাতে ধরা ট্যাবলেট নাকি ক্যাপসুলের স্ট্রিপটার দিকে সম্ভবত পুরু লেন্সের চশমার পেছনে রাখা শকুন চোখ দিয়ে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। সাদা দাঁড়ি আর পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটি নিশ্চয়ই কোন ইস্কুল মাস্টার হবে। ইস্কুল মাস্টাররা কি এরকম কাঠখোট্টা হয় ? ‘হাউয়ার পুলারে কইছিলাম তুই আমারটা নে, আর তরটা আমারে দে; মাদার চুদ হালায় … অই হালায়, অই …’ চা-দোকানের পাশের ‘ডিস-সংযোগ দেয়া হয়’ জাতীয় দোকানঘরটার মধ্য থেকে বিক্ষিপ্ত উড়ো-সংলাপ পেরিয়ে মুদিদোকানটার কাছাকাছি যেতে না যেতেই পেছন থেকে কলারে হেঁচকা টান- ‘অই খানকির পোলা, তরে যে ডাকতাছি কানে দিয়া হান্দায় না মাদারচোদ ?’

হেঁচকা টানের তীব্র ঝাঁকুনির মধ্যে হতভম্ভ রণকের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি লুপ্তপ্রায়। হাত থেকে নেটের ব্যাগটা খসে গেছে। প্রাণিজগতের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ প্রবণতায় তার ডান হাতটা ঝুলানো অবস্থা থেকে ততক্ষণে উপরে উঠে সেই খাবলে ধরা হাতটাকে অজান্তেই ঠেসে ধরেছে। ঝাপসা চোখে তিন-তিনটি ছায়ামূর্তি ধরা পড়েছে কেবল। ‘এইটা তো হে না বস্ !’ ‘অই, তুই চুপ করবি !’- পাশ থেকে অন্য ছায়ামূর্তির কথা থামিয়ে দিলো নেতাগোছের লোকটি, যে মুহূর্তকাল আগে রণকের কলার চেপে ধরেছিলো। ‘কী বে, পাড়ায় নতুন আইছোস ?’ উত্তর দিলো আরেক ছায়ামূর্তি- ‘সাঈদ মিয়ার বিল্ডিয়ের চাইরতলায় থাকে।’
‘অই হাউয়ার পুতেরা কয় নাই এইখানে সালাম-আসগার দিয়া চলতে হয় ? তাগো হোগায় কি বেশি তেল জইম্যা গেছে ? আবে এই মাগীর পুত, এমুন ভেটকি মাইরা চাইয়া রইছোস ক্যান ? গুয়ামারা খাইবার চাস্ ? চলতে ফিরতে এহন থাইকা জানান দিয়া হাঁটবি, বুঝলি… ? যা ভাগ্ !’
রণকের পা দুটো নিচের দিকে লম্বা হতে হতে পাতালে গিয়ে ঠেকেছে। খাম্বার মতো নিশ্চল, নিথর।

ওরা চলে গেছে। কতক্ষণ গেছে কে জানে, স্বাভাবিক বোধ-জ্ঞান ফিরে এলেও অসার দেহটা দুলছে তখনো। মাথার ভেতরে একটা তীব্র জেটবিমানের ঝা ঝা শব্দ, মাথাটাকে গুঁড়ো করে দিচ্ছে। চোখ দুটো কি গলছে, নাকি আগুন বের করছে, সে দায় বুঝার অবস্থায় এখনো হয়তো পৌঁছায়নি সে। তবে গলি-রাস্তার নিরীহ পথচারিদের কৌতুহলি দৃষ্টিও যে কী মারাত্মক বিষাক্ত হতে পারে, এ অভিজ্ঞতার প্রথম পাঠের তীব্রতায় খাপ খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল হলো কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে ফিসফিস সংলাপের মাধ্যমে আশ্বস্ত করছে। ‘খুব খারাপ লোক এরা..’ ‘নাসের এমপির লোক..’ ‘এলাকার মাস্তান..’ ‘মানুষরে মানুষ বইলা কেয়ারই করে না..’ ‘যানগা, এইসব মনে ধইরা লাভ নাই..’ ‘এরা যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটাইতে পারে।’…

রণক জানে না এই শরীরটাকে কিভাবে চারতলা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেছে। আড়ষ্ট জিহ্বায় নিছক অনভ্যস্ততার কারণে উচ্চারণযোগ্য নয় বলেই কি কতো জায়গায় কতোভাবে শোনা প্রাত্যহিক পরিচিত এই শব্দগুলো হঠাৎ এতো অচেনা আগন্তুকের মতো হামলে পড়ে একটা মানুষকে ছারখার করে দিতে পারে ! কী-হোলে ভুল চাবি ঢুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে খেয়াল হলো অন্ধকার প্যাসেজে একটা ভৌতিক নিস্তব্ধতা। সপ্তা শেষে দুদিনের ছুটিতে মেসের সব বোর্ডাররাই যার যার কর্মস্থল থেকে বাড়ির দিকে ছুট দেয়। রণকই আজ এর ব্যত্যয় ঘটালো। মাস শেষের বেতন হাতে না-পাওয়াতক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান রণকের ইচ্ছে হলেও উপায় নেই আড়াইশ কিলো দূরের যাত্রায় আপাত সওয়ার হওয়ার। রুমে ঢুকে কোনরকম খিল লাগিয়ে বিছানা পর্যন্ত গিয়েই ছেড়ে দিলো শরীর। এবং বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ দমক দিয়ে ছলকে ছলকে কাঁপতে শুরু করলো এতোকালের গর্বিত পৌরুষে লালন করা দেহ। এই পৌরুষকেই ভালোবেসেছিলো রিমি। ঢাকা আসার ঠিক আগের দিনই সে রিমিকে প্রথম চুমো খেয়েছে। এর আগে কখনোই তাকে এ সুযোগ দেয়নি রিমি। জীবনের প্রথম চুমোতে সে কেন যে জেনে গেলো পৃথিবীতে কোন রণক কোনো রিমিকে কখনো চুমো খায় না, একটি তন্বীদেহকে সযত্নে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় একটি পুরুষ শরীর ! মানুষ কি তার শারীরিক অস্তিত্বেই বেঁচে থাকে ?

জানালার কাচ ভেদ করে একটা আলো এসে রুমটাকে আধা-স্বচ্ছ করে জানিয়ে দিলো বিদ্যুৎ এসে গেছে। এবং এক ঝটকায় যে উঠে বসলো, সে রণক নয়, একটা ধাতব শরীর। খুট করে লাইটটা জ্বেলে দিলো রুমের। ঘর ভরা উজ্জ্বল আলোয় ছোট্ট রুমের অপরিসর ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে গা থেকে একে একে খুলে ফেললো শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া সব। ব্যায়ামপুষ্ট শরীরের এক আশ্চর্য উন্মুক্ত পৌরুষকে অবলোকন করলো দুটো খাট আর তার মধ্যবর্তী পাতলা ছোট্ট টেবিল, ঘরের কোণায় বুয়ার ঢাকা দেয়া ভাতের হাঁড়ি, তরকারির কড়াই, ডালের ডেকচি, জলের কলসি, দুটো বিচ্ছিন্ন মশারি, দড়িতে ঝুলানো কিছু কাপড়-চোপড়, এদিক ওদিক পড়ে থাকা কিছু পোটলা-পাটলা-শিশি-কৌটা-জলের গেলাস আর কিছু বই-পত্র-কাগজ-পত্রিকা এবং দরজা জানালা ও ঘরের হলুদ দেয়াল। খাটের তলায় পড়ে থাকা নীল ব্যাগটা দুম করে বের করে আনলো। খশ করে চেইন খুলে উপুড় করে ঢেলে দিলো সব বিছানায়। তারপর একে একে আবৃত করলো উন্মুক্ত শরীরটা আবার। এ পোশাক পরেই একদিন সে রিমিকে চুমু খেয়েছে। কিন্তু আজ চোখ বন্ধ করে যতই চেষ্টা করলো এই জাতিস্মর দেহে কিছুতেই রিমিকে ধরা গেলো না। কোথায় যেন একটা জন্মের তফাৎ হয়ে গেছে ! ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে রিমি। খশ করে এক টুকরো কাগজ টেনে নিলো। তারপর গুটগুট করে লিখে চললো অবাক বিস্ময় মাখানো অক্ষরের পর অক্ষর…। আর গলে গলে একে একে ঝরে পড়ছে এতকালোর সুকুমার শিক্ষা, প্রবৃত্তি, রুচি, সৌন্দর্য, বোধ, স্বপ্ন, স্মৃতি, বিস্মৃতি, সম্মান, ভ্রুকুটি, ক্রোধ, অপমান, ঘৃণা, প্রেম…ডট ডট ডট ডট। দম ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে থেকে লক করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো সে।

দূর থেকেই চোখে পড়লো জটলাটা। সেদিকেই এগিয়ে গেলো। রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়েই শালিসের মত করে কাকে যেন কী বলছে মাস্তান নেতাটি তার সেই নিজস্ব ভাষায়- হাউয়ার পুলার হুগায় হাত দিয়া দ্যাখ্ তো বিচি আছে নি ! জটলা ভেদ করে ঠিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রণক। তীব্র বিরক্তি আর উদ্যত ক্ষোভ নিয়ে কিছু বলার আগেই চটাশ করে তীব্র শব্দ হলো নেতাটির গালে। মুহূর্তেই জটলাটা থমকে গেলো ! নেতাটির কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবিশ্বাস চোখে দানা বাঁধার আগেই দ্বিতীয় থাপ্পড়ের সুতীব্র শব্দে জটলাটা অস্থির হয়ে উঠলো। এবং কেউ কেউ অবাক হয়ে দেখলো একটি তীব্র যুবক গট গট করে হেঁটে চলে যাচ্ছে কোথায় কে জানে।

এই সাতসকালে কৌতুহলী মানুষের ভীড় সরাতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হলো। বহুতল ভবন তোলার জন্য পুরানো বিল্ডিং ভেঙে যে ভিত্তি খোড়া হয়েছে পুকুরের মতো করে, তার মধ্যেই লাশটা প্রায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরিরত দারোগার উদ্দেশ্যে কনস্টেবলটি চিৎকার করে ওঠলো- স্যার, লাশের মুঠায় একটা কী জানি দেখা যাইতেছে, কাগজ মনে হয়। দারোগা এগিয়ে গেলো। কনস্টেবলটি লাশের মুঠো থেকে কুকড়ানো কাগজটি বের করে মেলে ধরেই চেঁচিয়ে ওঠলো- আরে, হালার পুতে কী লিখছে দেখেন !

সুরতহাল রিপোর্টেই খুনের ক্লু পেয়ে যাবার আনন্দে কনস্টেবলের হাত থেকে বাজপাখির মতো প্রায় ছোঁ দিয়ে তুলে নিলো কাগজটি। সামনে মেলে ধরতেই দারোগা সাহেবের বিশ্বস্ত চোখ দুটো অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে ওঠলো। গুট গুট অক্ষরে ওটাতে লেখা- খানকির পোলা, হাউয়ার পুত, হোগায় তেল জমছে, মাগীর পুত, গুয়ামারা খাইবার চাস, মাদার চোদ !

(১০-০৬-২০১০)

...
[sachalayatan]
...

No comments: