Monday, June 28, 2010

| জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস ও সোশ্যাল বিজনেস ডে |

| জন্মদিনে প্রফেসর ইউনূস ও সোশ্যাল বিজনেস ডে |
-রণদীপম বসু

একটি সফল ও বিশ্ব-নাড়ানো প্রায়োগিক দর্শন বা তত্ত্ব হিসেবে ‘ক্ষুদ্র-ঋণ’ বা ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ এর বিশ্বজয় এখন পুরনো ঘটনা। এর প্রবক্তা ও প্রয়োগকর্তা হিসেবে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণার প্রাক্কালে ১৩ অক্টোবর নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ওলে ডানবোল্ট মিওস যে সাইটেশনটি পড়ে শোনান, ওখানেই বিশ্ববাসীর চোখে মাইক্রোক্রেডিটের গুরুত্বটুকু ফুটে উঠে। ওখানে বলা হয়-


নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় অবদানের জন্য এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের চক্র ভেঙে বের করে আনার পথ দেখাতে না পারলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সে রকমের একটি পথের দিশা। এ পথে আনা উন্নয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অগ্রগতিকেও গতিশীল করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটি মানুষের স্বার্থে স্বপ্নের বাস্তব প্রয়োগে মুহাম্মদ ইউনূস নিজের নেতৃত্ব গুনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। জামানত ছাড়াই দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেয়া অসম্ভব একটি ধারণাই ছিলো। তিন দশক আগে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ইউনূস প্রথমবারের মতো এ অসম্ভব ধারণাকেই শুধু ভাঙেন নি, তিনি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।………….

আমরা প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক যা-ই করি না কেন, অন্তত এটা বোধ করি বলা ভুল হবে না যে, গড়পড়তা বাঙালির যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতা ও সৃজনশীলতা তিনি ধারণ করেন। তাঁর অবস্থান যে আসলেই ছোটখাটো মানবিক চাওয়া-পাওয়ার অনেক উর্ধ্বে, চমৎকার নিরবতা দিয়ে তা-ই হয়তো তিনি বুঝিয়ে দেন আমাদের। অথচ এখন পর্যন্ত মাইক্রো-ক্রেডিটের ধারণা বা দর্শন বা প্রায়োগিক কৌশলের মৌলিক কোন ত্রুটি বের করার বদলে আমরা অজ্ঞাত বা অবজ্ঞাত কোন কারণে শেষপর্যন্ত খুব অদ্ভুতভাবে হামলে পড়ি ব্যক্তি ইউনূসেরই উপর। এতে করে আসল তত্ত্বের কোথায় কী এসে যায় তা আর বোঝার উপায় থাকে না। তবে সৃজনশীল ব্যক্তিত্বরা যে এসব ক্যাচালের মধ্যেও থেমে থাকেন না তার অভূতপূর্ব নমুনা প্রফেসর ইউনূস ঠিকই রেখে যান  তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এমন কি ১০ ডিসেম্বর ২০০৬ এ পুরস্কার গ্রহণের দিনে নোবেল বক্তৃতার মধ্যে বিশ্ববাসীকে আরেকটি নতুন অর্থনৈতিক ধারণা উপহার দেয়ার মাধ্যমেও তা বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন নি। সেটা হলো Social Business বা ‘সামাজিক ব্যবসায়’।
তিনি তাঁর নোবেল বক্তৃতায় এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই সামাজিক ব্যবসা প্রসংগে বক্তব্য রাখেন। বিশ্বের তাবৎ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে দ্বিধাহীন স্পষ্টভাবে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেন এভাবে-

আমি বাজারের স্বাধীনতা জোরদার করার পক্ষে। আর একই সময়ে আমি বাজারে যে সব শক্তি কাজ করে সে সবের ওপর ধারণামূলক বিধিনিষেধ আরোপের একান্ত বিরোধী। এর উৎপত্তি হলো এই অনুমানে যে উদ্যোক্তারা একমাত্রিক মানুষ বিশেষ যারা তাদের ব্যবসায় জীবনে একটিমাত্র মিশনে নিবেদিত। বলাবাহুল্য সেটি হলো মুনাফা সর্বাধিক করা। পুঁজিবাদের এই ব্যাখ্যা উদ্যোক্তাদেরকে তাদের জীবনের সকল রাজনৈতিক, আবেগীয়, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও পরিবেশগত দিকমাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সম্ভবত এটি করা হয় এক যুক্তিনির্ভর সরলীকরণ হিসেবে। কিন্তু তাতে মানব জীবনের একান্ত নির্যাসকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।

মানুষ এক অপূর্ব সৃষ্টি যার সত্তায় মিশে আছে অনন্ত মানবীয় গুণ ও সামর্থ। আমাদের গড়া তত্ত্বগুলিতে তাই এসব মানবীয় গুণের কুসুমকলি ভাববাচ্যে দূরে না সরিয়ে রেখে  প্রস্ফুটিত করার ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত থাকা উচিত।
মুক্তবাজারে ভূমিকাপালকদের ওপর এ বিধিনিষেধই বিশ্বের বহু সমস্যার কারণ।  পৃথিবীর মোট জনসমষ্টির অর্ধেকই হতদরিদ্র। কিন্তু তাদের এই সমস্যার সমাধান বিশ্ব করেনি। স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালে নেই। সবচে সমৃদ্ধ ও মুক্তবাজার রয়েছে এমন দেশও তাদের জনসংখ্যার পঞ্চমাংশের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা দিতে পারেনি।

মুক্তবাজারের সাফল্যে আমরা এতোই চমৎকৃত যে আমরা আমাদের মৌলিক ধারণাগুলির ব্যাপারে কোনোরকম সংশয় প্রকাশ করতেও কখনও সাহস পাইনি। ব্যাপারটা আরও জঘন্য করে তোলার জন্য আমরা বরং যতোটা পারা যায় আমাদের নিজেদেরকে তাত্ত্বিক নিরিখে একমাত্রিক মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য বাড়তি খাটুনি খেটেছি যাতে করে মুক্তবাজার কার্যব্যবস্থা সাবলীল কাজ করতে পারে।

‘উদ্যোক্তা’র একটা বিস্তৃততর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আমরা মুক্তবাজারের চৌহদ্দির মধ্যে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা বিশ্বের বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। মনে করুন, একজন উদ্যোক্তার প্রেরণার একক উৎসের (যেমন, সর্বাধিক মুনাফা করা) বদলে দুটি উৎস রয়েছে এবং এ দুই উৎস আবার পরস্পর বিরোধী অথচ সমান বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন — ক) সর্বাধিক মুনাফা করা ও  খ) মানুষ ও জগতের কল্যাণ সাধন।

এখন এ দুয়ের প্রতিটি প্রেরণা একটি পৃথক ধরনের ব্যবসা অভিমুখী। আমরা প্রথম ধরনের প্রেরণাকে বলবো মুনাফা সর্বাধিকারক ব্যবসা আর দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসাকে বলবো সামাজিক ব্যবসা।
এই সামাজিক ব্যবসা হবে বাজারে প্রবর্তিত নতুন একধরনের ব্যবসা যার উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বদলে দেওয়া। এই সামাজিক ব্যবসায় বিনিযোগকারীরা তাদের বিনিয়োজিত পুঁজি ফিরে পেতে পারবে কিন্তু কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা নিতে পারবে না। বরং মুনাফা ফিরে যাবে কোম্পানিতে যা দিয়ে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে আরও দূরবর্তী এলাকায় আর সেই সাথে পণ্য বা সেবার মান আরও উন্নত হবে। এ ধরণের সামাজিক ব্যবসায় হবে লোকসান ও  মুনাফাবিহীন কোম্পানি।

আমাদের প্রস্তাবিত সামাজিক ব্যবসা আইনে স্বীকৃত। বহু কোম্পানি রয়েছে যারা তাদের মূল ব্যবসায় তৎপরতা ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা গড়তে এগিয়ে আসবে। মুনাফাবিহীন খাতের বহু কর্মীও এটিকে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবেন। মুনাফাবিহীন খাতে যেখানে প্রতিষ্ঠানকে তার কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাবার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে হয় সেখানে সামাজিক ব্যবসা হয় স্বনির্ভর আর সেই সাথে সম্প্রসারণের প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে কেননা, এটা মুনাফাবিহীন উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার পুঁজি সংগ্রহের জন্য তার নিজস্ব নতুন ধরনের মুলধন বাজারে যাবে।

বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে বিত্তবান দেশগুলির যুবক-তরুণেরা সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে অত্যন্ত আবেদনময় বলেই দেখবেন এ কারণে যে এ ব্যবসা তাদেরকে তাদের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু বদলে দেবার চ্যালেঞ্জ নেবার আমন্ত্রণ জানায়। আজকের বহু তরুণ-তরুণী বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে কোনো অর্থবহ, রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ দেখতে পায় না বলে  হতাশায় ভোগে। অথচ এর পাশাপাশি সমাজতন্ত্র তাদের লড়াই করার স্বপ্ন দেখায়। তরুণেরা তাদের একান্ত নিজের নিটোল, নিখুঁত এক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখে।

সামাজিক ব্যবসা বিশ্বের প্রায় সকল আর্থসামাজিক সমস্যার প্রতিকার দেবে। কেবল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যবসায়ের উদ্ভাবনীমূলক মডেল তৈরি করে তা সাশ্রয় ও কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়ে বাঞ্ছিত সামাজিক সুফল নিয়ে আসা। দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বিপণন ও নবায়নযোগ্য ইন্ধনশক্তি  – এ সবই হলো সামাজিক ব্যবসার রোমাঞ্চকর কর্মক্ষেত্র।
সামাজিক ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এ ব্যবসা মানবজাতির অতীব গুরুত্ববহ বিষয়গুলির সুরাহা করে। বিশ্বের মোট জনসমষ্টির যে ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিচে অবহেলিত রয়ে গেছে এ ব্যবসা তাদের জীবনের খোলনলচে বদলে দিতে পারে। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহাযতা করতে পারে।

ক্ষুদ্রঋণের পর এবার সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিও যে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে তার প্রমাণ এই ২৮ জুন ২০১০ সোমবার ঢাকা সহ বিশ্বের বেশ ক’টি শহরে দিনটিকে প্রথমবারের মতো ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ বা Social Business Day হিসেবে পালন। গৃহিত  বিভিন্ন কর্মসূচি ও মেলার মাধ্যমে ঢাকা সহ বিশ্বের আর যে শহরগুলোতে দিনটি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, জাপানের টোকিও ও ফুকোওকা, আর্জেন্টিনার বুয়েন্সআয়ার্স, জার্মানির ওয়েজবাডেন, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ, পাকিস্তানের করাচি, ভারতের রুর্কি, মুম্বাই, ইন্দোর ও ব্যাঙালোর, চীন মেইনল্যান্ডের হাং-ঝু, সাংহাই ও বেইজিং এবং পর্তুগালের পর্তু শহর। (সূত্র: ইউনূস সেন্টার ওয়েবসাইট)।
উল্লেখ্য, ২৮ জুন হলো আমাদের একমাত্র নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের শুভ-জন্মদিন। মূলত তাঁর জন্মদিনটিকে এক আলাদা মর্যাদায় স্মরণীয় করে রাখতেই এই সামাজিক ব্যবসা দিবস পালনের উদ্যোগ। সাথে দিবসের প্রতিপাদ্য তো আছেই।

১৯৪০ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত সওদাগর পরিবারে পিতা দুলা মিয়া সওদাগর ও মাতা সুফিয়া খাতুনের নয় সন্তানের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
প্রথম সোশ্যাল বিজনেস ডে’ আর ৭১তম জন্মদিনে এই ক্ষণজন্মা পুরুষ প্রফেসর ইউনূসের প্রতি একজন সাধারণ বাঙালি হিসেবে জানাই অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন প্রফেসর ইউনূস।

No comments: