Friday, June 25, 2010

| যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর…|৩১|


| যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর…|৩১|
-রণদীপম বসু

তারিখ: নেই (অনুমান এপ্রিল, ১৯৯৩)

কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো রূপা। এমন কতো ঘটনাই তো আকছার ঘটছে জানি, শুনি। কিন্তু এটা নাকের সামনে ঘটলো বলেই হয়তো খুব রেখাপাত করলো মনটায়। পাঁচ কদম সামনে বাড়লেই যে দোকানটা থেকে আমি হরদম চা পান সিগারেট এবং অন্যান্য কিছুর জন্যে রুম থেকেই চেঁচিয়ে আনিয়ে নেই, সেই দোকানদারকে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো। দু’মিনিটও হয়নি চা দিয়ে গেলো আমাকে। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে দেখি এই কাণ্ড। চা’র কাপটা এখনো আমার টেবিলে রয়ে গেছে, অথচ…। জমি-জিরাত নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে গণ্ডগোল হবে হয়তো। তবে সবকিছুর মূলে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’। সহজ সরল লোকটা বুঝি ফেসে গেলো। ওর লক্ষ্মী কচি বউটা আমাদের পাশেই থাকে। তার নিরাপত্তাহীন ভয়ার্ত মুখ কল্পনা করে ভীষণ খারাপ লাগছে। এখনো থেকে থেকে তার বুকফাঁটা চাপাকান্না শুনতে পাচ্ছি। জানি না এ কান্না তার ভালোবাসার নাকি নিরাপত্তাহীনতার। সে যাই হোক, একটি অসহায় হতভাগা লোকের জন্য এই যে কান্নার অর্ঘ্য, তোমার কথা মনে পড়ছে রূপা। বউটা খুব ভালো, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। কোলের ছোট্ট শিশু মেয়েটা বুঝিবা হতবাক। কোন কান্না নেই তার। কত কে আসছে চেনা-জানা তার, সান্ত্বনা জানাচ্ছে। বহিরাগত চাকুরে হিসেবে কোন সাহায্য আমি করতে পারবো না জানি, তাই সান্ত্বনা দিতে যাইনি। সান্ত্বনার ছলনায় যাদের কারো কারো চোখ শুধু নারীর শরীর খোঁজে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই কেমন কেমন লাগছিলো। প্রতিবেশিসুলভ দায়িত্ব সম্পর্কে এখনো আমি অসামাজিকই রয়ে গেলাম হয়তো। মনে মনে মেয়েটির জন্য সমবেদনা বোধ করছি।



অবরুদ্ধ ফাটকে দাঁড়িয়ে লোকটি জানিনা কী ভাববে। বউটির নিরাপত্তাহীনতার কথা ? নিজের অসহায়ত্বের কথা ? নাকি অন্যকিছু ? হয়তো অকস্মাৎ বিপদে ছিটকে পড়ে একটা সংজ্ঞাহীন চিন্তাহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইবে আপাতত। কিন্তু আমি ভাবি অন্যকথা। একজন নারী একজন পুরুষের কাছে আগে কী চায় ? ভালোবাসা, নিরাপত্তা, নাকি অন্যকিছু ? জানি না রূপা, আমি কিচ্ছু জানি না। বউটিকে দেখে তোমার কথাই মনে পড়লো সবার আগে। এমোন নিরাপত্তাহীন ভয়ার্ত অসহায় তোমার মুখ যাতে কোনোদিন আমার কল্পনা করতেও না হয় ! এ মুহূর্তে পৃথিবীতে এটাই আমার সবচেয়ে বড় কামনা। অন্যরা যেখানে সান্ত্বনার বাণী নিয়ে এগিয়ে গেলো, সেখানে আমি স্বার্থপরের মতো তোমার কথাটাই আগে ভাবলাম। লোকটা আমি আসলেই ভীষণ স্বার্থপর এবং ছোট। এতো বড় বড় সার্টিফিকেট পেয়েও বুঝি নিজেকে বড়োতে উন্নীত করতে পারলাম না। ওদের থেকেও ছোট রয়ে গেলাম।

এজন্যে আমাকে ক্ষমা কোরো রূপা। তোমার এতো বড় উদার মনের পাশে আমার এই স্বার্থপর সংকীর্ণ মনটার নগন্যতা কল্পনা করে লজ্জাই পাচ্ছি। তবু আমি আমার নগন্যতা স্বীকার করছি।

(চলবে…)

পর্ব:[৩০] [*] [৩২]

No comments: