Thursday, March 24, 2011

| কালের স্মৃতিচিহ্ন |ঢাকা: বর্ধমান হাউস|

 
| কালের স্মৃতিচিহ্ন |ঢাকা: বর্ধমান হাউস|
-রণদীপম বসু

ঢাকা তথা পূর্ব বাংলার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আন্দোলন, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মূর্তিমান সাক্ষি এই বর্ধমান হাউস (Burdwan House), বর্তমানে যাকে আমরা বাংলা একাডেমী হিসেবে চিনি। ভবনটির নির্মাণ সাল ১৯০৬। বলা হয়ে থাকে যে বর্ধমানের রাজা এটি নির্মাণ করেন। কারো মতে ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের পর এটি নির্মিত হয়। তবে সর্বজন স্বীকৃত মত অনুযায়ী ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিবর্তিত হলে পূর্ববঙ্গে গভর্ণরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের জন্য রমনা এলাকায় এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। সে সময়েই পুরানা হাইকোর্ট ভবন, কার্জন হলও নির্মিত হয় বলে জানা যায়। অর্ধচন্দ্রাকৃতি বারান্দা, নিচতলায় নাচের বলরুম, দোতলায় ফায়ার প্লেস ও অন্যান্য সুবিধাসহ অনেকটা ভিক্টোরিয়ান রীতিতে তৈরি ধবধবে সাদা এই দোতলা পাকা দালানটি মূলত ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সরকারী উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও রাজকীয় অতিথিদের জন্যে বাংলো হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে ধারণা করা হয়।  ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে গভর্ণরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য হওয়ায় বর্ধমানের রাজা স্যার বিজয়চাঁদ ম্যাকার্থি সে সময় রাজকীয় অতিথি হিসেবে এই বাড়িতে বাস করেন। তাঁর নামানুসারেই এটি বর্ধমান হাউস নামে পরিচিতি লাভ করে।
.
undefined
.
১৯২১ সালের ১ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বর্ধমান হাউস বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পড়ে। ফলে কিছুটা সময় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ১৯২৬ সালে কাজী মোতাহার হোসেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে বর্ধমান হাউসের দোতলার এক অংশে বাস করতেন। তাঁরই আমন্ত্রণে তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিছুদিন এখানে এসে অবস্থান করেন। এছাড়াও রমেশচন্দ্র মজুমদার সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের কয়েকজন শিক্ষক এখানে নানা সময়ে এই ভবনে বাস করেছেন। ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৪ এর এপ্রিল পর্যন্ত এটি ছিলো পূর্ব বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ও দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন এ বাড়িতে বাস করতেন। ১৯৫৪ এর পর থেকে বর্ধমান হাউসে ঢাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো। এখানে তখন আর্ট কাউন্সিল কার্যালয় খোলা হয়। তাছাড়া জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা ও তথ্য বিভাগের কার্যালয়ও এখানে ছিলো। ১৯৫৪ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ এখানে কয়েক মাস বাস করেন।
.
undefined
.
১৯৫২ সালে তুমুল ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলি চালানো হলে বর্ধমান হাউস তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর আবাসস্থল হওয়ায় এটি জনরোষে পড়ে এবং এটিকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে রূপান্তরিত করার দাবী প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় মোর্চা হিসেবে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাবিত ২১ দফার ষোড়শ দফায় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়- ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।’ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) প্রথম বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার প্রাথমিক নির্দেশ দেন। ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর আবু হোসেন সরকার কর্তৃক বর্ধমান হাউস চত্বরে বাংলা একাডেমীর উদ্বোধনের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন ঘটে। ৮ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসের একটি অংশে বাংলা একাডেমীর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে সমগ্র ভবন বাংলা একাডেমীর অধিকারে আসে। ১৯৬২ সালে আদি নকশার সাথে সংগতি রেখে এই ভবনের ত্রিতল নির্মিত হয়।
.
undefined
.
১৯৭৮ সাল থেকে এই ভবনকে ঘিরে প্রতিবছর বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ফেব্রুয়ারি মাস ব্যাপী একুশের গ্রন্থমেলার আয়োজন হয়ে আসছে। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এই বর্ধমান হাউসের চারটি কক্ষে স্থাপিত হয় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর। এ জাদুঘরে এখন পর্যন্ত সংগৃহিত স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্মারকলিপি, নির্বাচিত বইয়ের প্রচ্ছদ, ভাষা সৈনিকদের রচনা, আন্দোলনের ছবি, ভাষা শহীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি। আমাদের আন্দোলন সংগ্রামে কালের সাক্ষি এই বর্ধমান হাউসকে এবার যথাযথ সংরক্ষণে নজর দেয়া আবশ্যক বলে মনে হয়।
(বর্ধমান হাউসের আরো ছবি এখানে )

No comments: