Wednesday, July 27, 2011

। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: গুরুদুয়ারা নানক শাহী ।


। কালের স্মৃতিচিহ্ন । ঢাকা: গুরুদুয়ারা নানক শাহী ।
-রণদীপম বসু

 …
গুরুদুয়ারা (Gurdwara) হচ্ছে শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান উপাসনালয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই গুরুদুয়ারায় প্রবেশ করে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। গুরুদুয়ারায় প্রার্থনাস্থলকে বলা হয় ‘দরবার সাহেব’। এর চারদিক দিয়েই ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা থাকে। ফলে অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপত্যের তুলনায় গুরুদুয়ারা উপাসনালয়ে প্রবেশদ্বারের সংখ্যা সাধারণত বেশি থাকে। প্রত্যেক গুরুদুয়ারায় হলুদ রঙের পতাকা টাঙানো থাকে। একে বলা হয় ‘নিশান সাহেব’। নিশানের দু’দিকে তলোয়ারের ছবি আঁকা থাকে, যা ‘খাণ্ডা’ নামে পরিচিত। এই নিশানকে শিখ-জীবনের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মিশ্রনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
 .
বাংলাদেশে শিখ-ধর্মের প্রধান উপাসনালয় হচ্ছে গুরুদুয়ারা নানক শাহী (Gurdwara Nanak Shahi)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ধার ঘেঁষে এটি অবস্থিত। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৬-১৬২৮) ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দ শিং শিখ পুরোহিত আলমাসত বা আলামাস্টকে এই বাংলা অঞ্চলে ঢাকায় প্রেরণ করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় এই গুরুদুয়ারা উপাসনালয়টি নির্মিত হয় বলে কথিত আছে। ১৮৩৩ সালে এটি সংস্কার করা হয়। শিখ পুরোহিত আলমাসত-এর দু’জন পর নাথ সাহেব পুরোহিত হিসেবে এই উপাসনালয়ের প্রধান হন। ধারণা করা হয় তাঁর হাতেই বর্তমান গুরুদুয়ারা উপাসনালয়টি সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক দানীর মতে, ১৮৪৭-এর পর থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এটি আবার সংস্কার হয়ে প্রায় নতুন চেহারা প্রাপ্ত হয়েছে।
 .
 
.
জানা যায়, অতীতে গুরুদুয়ারা নানকশাহীর উত্তর দিক দিয়ে একটি প্রবেশদ্বার ছিলো। দক্ষিণ দিকের অংশে ছিলো একটি কূপ ও সমাধিস্থল। এবং পশ্চিমে ছিলো একটি শান বাঁধানো পুকুর। মূল উপাসনালয়ের উত্তর-পূর্ব দিকে ছিলো অফিস ও আবাসিক ব্যবস্থা। উপাসনালয়ের তত্ত্বাবধায়ক থাকতেন পূর্বদিকে। এছাড়া ভক্তদের বসার জন্য ছিলো কয়েকটি কক্ষ। সবমিলিয়ে কক্ষ ছিলো মোট নয়টি।
 .
স্থাপনাটির গঠন-বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে, বর্গাকার ড্রামের ওপর স্থাপিত চমৎকার গম্বুজ-বিশিষ্ট ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে নির্মিত স্থাপনাটির আকৃতি বর্গাকার। প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য বাইরের দিকে প্রায় ৩০ ফুট। পূর্বমুখী হয়ে স্থাপিত এই গুরুদুয়ারার পূর্ব-উত্তর ও পশ্চিম দেয়ালে পাঁচটি করে প্রবেশ পথ রয়েছে। দক্ষিণ দিকে কোনো প্রবেশ-পথ নেই। সেদিকে উপাসনালয় সংলগ্ন একটি ছোট্ট কক্ষ রয়েছে। বর্গাকারে নির্মিত কেন্দ্রীয় কক্ষের চারদিকে রয়েছে পাঁচ ফুট প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার প্রত্যেক কোণে একটি করে মোট চারটি কক্ষ রয়েছে। বারান্দার পরেই রয়েছে খিলানের সাহায্যে নির্মিত তিনটি করে প্রবেশ পথ। কেন্দ্রীয় কক্ষে একটি অনুচ্চ বেদীর উপর ‘গ্রন্থসাহেব’ নামক শিখদের পবিত্র বিরাট হস্তলিখিত ধর্মগ্রন্থ খোলা অবস্থায় রক্ষিত আছে। এ গ্রন্থকেই প্রতিদিন পূজো করা হয়।
 .
 
.
গুরুদুয়ারা নানক শাহীর প্রাত্যহিক ধর্মাচরণের মধ্যে রয়েছে সকাল-সন্ধ্যা পবিত্র গ্রন্থসাহেব পাঠ ও প্রার্থনা করা, যাকে বলা হয় ‘আরদাস’। এছাড়া প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা-১টা পর্যন্ত সাপ্তাহিক জমায়েত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান গ্রন্থি বা পুরোহিত গ্রন্থপাঠ করার পাশাপাশি কীর্তনও করেন। এই কীর্তনে তবলা, ডুগডুগি, খাকসা, হারমোনিয়াম ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। প্রার্থনা শেষে স্তোত্র পাঠ ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়। প্রাতঃভোজের জন্য সেখানে একটি গুরুকা লঙ্গর বা ভোজনালয় রয়েছে। শিখরা এই ভোজকে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির সহায়ক বলে মনে করেন।
 .
বাংলাদেশে শিখ সম্প্রদায়ের আরো কিছু স্থাপত্য রয়েছে। ঢাকার বাংলাবাজারে অবস্থিত গুরুদুয়ারা গুরু তেগবাহাদুরের সঙ্গত বা আস্তানা, গুরুদুয়ারা নানক কুয়ান। তবে উর্দুবাজারের গুরুদুয়ারা সুতরা শাহী এবং ইংলিশ রোডের গুরুদুয়ারা বাবা মোহন সিং এখন বিলুপ্ত। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের চকবাজার শিখ মন্দির এবং পাহাড়তলি শিখ মন্দির, ময়মনসিংহের এ,বি গুহ রোডের গুরু নানক মন্দির অন্যতম। আর সিলেটের গুরুদুয়ারা সাহেব এখন পরিত্যক্ত বলে জানা যায়।
.
তথ্য সহায়তা:
০১)  স্থাপত্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২ / বাংলাদেশ  এশিয়াটিক সোসাইটি।
০২)  ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০৩)  ছবি : রণদীপম বসু।

[ sachalayatan ]  
...

No comments: